চাঁদের অমাবস্যা – ২

দুই 

দাদাসাহেব বড়বাড়ির প্রধান মুরুব্বি। দীর্ঘ প্রশস্ত মানুষ, প্রৌঢ়-বয়সেও মুখভরা একরাশ কালো দাড়ি। তবে চুল-গোঁফ সুন্নত অনুযায়ী ছোট করে ছাঁটা। 

বছর পাঁচেক হল দেশের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তার পূর্বে তিনি সরকারি চাকুরিতে নিযুক্ত ছিলেন বলে কেবল ছুটি-ছাটাতেই দেশে আসতেন। সারা জীবন চাকুরি করেছেন বটে কিন্তু চাকুরিতে কখনো মন ছিল না! মাজহাব -শরিয়ত ব্যাপারে সর্বদা মশগুল থাকতেন বলে কর্মজীবনেও বিশেষ কৃতকার্য হন নাই। উপাধি-ইনাম তো দূরের কথা, পদোন্নতিও বিশেষ হয় নাই। অবশ্য সে-জন্য সেদিনও তাঁর কোনো আফসোস ছিল না, আজও নাই। বরঞ্চ চাকুরিজীবন শেষ হলে তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন : অবশেষে তিনি নিজের সময়ের ষোল আনা মালিক হলেন, তাতে কারো হিস্সা-দাবি থাকল না। তাছাড়া, এবাদতে এবং মাজহাবি কাজে সম্পূর্ণভাবে মনঃপ্রাণ দেবার পথে আর কোনো বাধা থাকল না। 

অন্য একটি কারণেও চাকুরিজীবনে তিনি সুখী ছিলেন না। সে-জীবন পরাধীন যুগে কেটেছে। পরাধীনতার অবমাননা যতটা তাঁকে কষ্ট দেয় নাই ততটা দিয়েছে মনিবের বিধর্মীয়তা। বিধর্মীয় মনিব তাঁর প্রিয় ধর্মের প্রতি প্রকাশ্যে কোনো বিরোধিতা বা অবজ্ঞা প্রকাশ না করলেও তার সে-বিরোধিতা-অবজ্ঞা অহরহ অনুভব করেছেন। এমন মনিবের অধীনে গোলামি করা নিতান্তই পীড়াদায়ক। অবসরপ্রাপ্তিতে তাই তাঁর আনন্দের সীমা থাকে নাই। 

দেশের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করলে তিনি অবিলম্বে এ-কথা বুঝতে পারেন যে, অবসর গ্রহণ সময়োচিতই হয়েছে। বাড়িতে সংখ্যায় দশাধিক বালক-বালিকা। তাঁর গ্রামবাসী বড় ছেলের ছয়টি ছেলেমেয়ে। বিধবা মেয়েরও পাঁচটি সন্তানসন্ততি। তাদের শিক্ষাদীক্ষার একান্ত প্রয়োজন। সে-শিক্ষাদীক্ষা হেলা করা যায় না। তবে ভাগ্য ভালো, এখনো তাদের মন সার-দেয়া জমির মতো। তাতে যে-বীজ রোপণ করা যাবে সে-বীজই ফলবতী হবে। 

প্রথম সপ্তাহে তিনি নির্দেশ দিলেন, বিমিল্লাহ না বলে কেউ যেন লোকমা না তোলে। শীঘ্র আরেক হুকুম হল, কারো একটি নামাজ যেন কাজা না হয়। (অবশ্য একেবারে নামাজ না পড়া কল্পনাতীত।) তারপর ঈমানের অর্থ, কোরান পাঠ ও হাদিস-সুন্নার প্রয়োজনীয়তা, তবি পড়ার উপকারিতা, নফল নামাজের কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ ব্যাখ্যান দিতে লাগলেন। মাসখানেকের মধ্যে বাড়িময় এমন ঘোরতর পরিবর্তন ঘটল যে ঝানু মোল্লামৌলবীদেরও তাক লেগে গেল। মাথা নেড়ে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, দাদাসাহেব অসাধ্য সাধন করেছেন। 

সকলের বিস্ময়ের পাত্র দাদাসাহেবের মেয়েপক্ষের নাতি, আমজাদ। ঘুমে অতি সহজে কাবু হয়ে পড়ে যে ছেলে সেও একটি নামাজ কামাই করে না। একবার নিদ্রার কবলে পড়লে যার শূন্য পেটে রসজবজবে মিঠাই-মণ্ডাও একটু আলোড়ন জাগাতে পারে না সে-ই গভীর নিদ্রা থেকে উঠে ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়, একবার ডাকতে হয় না। স্বাভাবিক কথা, আমজাদ দাদাসাহেবের বড়ই প্রিয়পাত্র। 

দাদাসাহেব ওয়াজ-নছিহত করেন, কিন্তু সহজে কাউকে ভর্ৎসনা করেন না। তাঁর নিষ্পলক দৃষ্টিই যথেষ্ট। তাঁর স্তব্ধতায় ছেলেমেয়েদের বুকে এক নিমেষে হিমশীতলতা আসে। যেমন সেদিন রাতের ঘটনা। সকলে খেতে বসেছে। দস্তরখানায় স্তূপাকার খাদ্য। ডালভাত, মাছতরকারি, দু-তিন রকমের ভাজি, একটু কাসুন্দি ও গরম পাতের ঘি, ঘন লাল সুরুয়ায় বড় বড় করে কাটা গোরুগোস্ত। ছোটপাতে মুখরোচক আচার-চাটনিও কয়েক পদের। সকলেই পাতে খাবার তুলে নিয়েছে। দাদাসাহেব শ্যেনদৃষ্টিতে চতুর্দিকে তাকান। তারপর হঠাৎ তিনি বলেন, বিসমিল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গে চারধারে গুঞ্জন ওঠে, বিসমিল্লাহ। কেবল একজন সে-গুঞ্জনে যোগ দিতে ভুলে যায়। আমজাদের বড় ভাই, কুদ্দুস। হয়তো সেদিন তার পেটে ক্ষুধার দাউ-দাউ আগুন, অথবা কোনো কারণে অন্যমনস্ক। 

থমথমে নিস্তব্ধতা নামে। দেখা যায় দাদাসাহেব গুরুগম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কুদ্দুসের দিকে। তার মুখে তখন ঠাসা ভাত। না গিলে সে ভয়ে পাথর হয়ে তাকিয়ে থাকে বাসনের দিকে, চোখ তুলতে সাহস হয় না। প্রথমে কানপাটা, তারপর গোটা কান, অবশেষে সমস্ত মুখ লাল হয়ে ওঠে। দাদাসাহেবের মুখে কিন্তু একটি কথা নাই। 

পরে দাদাসাহেব শান্তকণ্ঠে বুঝিয়ে বলেন। খোদাকে কখনো ভুলতে নাই, বিশেষ করে যখন কেউ তাঁর অসীম দানদয়াশীলতায় শরিলাভ করে। নিঃস্বার্থতা, ত্যাগশীলতা এবং আত্মসংযম ধর্মের গোড়াঘাট। সে-সব গুণ ছাড়া দুনিয়ার কোনো সংগ্রামে তো জয়ী হওয়া যায়ই না, ক্ষমাশীল অসীম দয়াবান খোদারও প্রিয়পাত্র হওয়া মুশকিল। এ-উপদেশ দেন খেতে খেতেই। নীরব-ভোজনের পক্ষপাতী তিনি নন। সুন্নার নির্দেশ হল, সদালাপের সঙ্গেই ক্ষুধানিবৃত্তি করা উচিত। সদালাপের জন্যে ধর্মতত্ত্বের চেয়ে আর কোন বিষয় বেশি উপযুক্ত? ঠোঁটে মধুর হাসির আভাস, কণ্ঠ শান্ত স্নিগ্ধ, দাদাসাহেব একাকী কথা বলে যান। খাবার শেষে তখন হয়তো কুদ্দুসের সামান্য ভুলটার কথা কারো মনে নাই। কিন্তু খাদ্যই যে জীবনের সবচেয়ে প্রধান বস্তু নয় সে-কথা প্রমাণ করবার জন্যে সে পরদিন স্বইচ্ছায় নফল রোজা রাখে। 

দাদাসাহেবের স্বাভাবিক স্থৈর্য-গাম্ভীর্যে সহজে তারতম্য ঘটে না। কিন্তু একটি ব্যাপারে তিনি কখনো-কখনো অসংযত হয়ে পড়েন। সে-ব্যাপার ধর্ম। যে-মানুষকে দূর থেকে লম্বা-লম্বা পা ফেলে আসতে দেখলে অনেক ছেলের মনে তাঁর দৃশ্যপথ থেকে অদৃশ্য হবার প্রবল বাসনা জাগে, যাঁকে বয়স্থব্যক্তিরা সমীহ-সম্মান না করে পারে না, ধর্মের ব্যাপারে তিনিই শিশুর মতো সরল বা প্রাণবন্ত বালকের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারেন। 

আরেকদিনের ঘটনা। ঘটনাটির উৎপত্তি জেলা শহরের খবর কাগজে প্রকাশিত একটি সংবাদে। অজস্র ছাপাভুলসমেত মেটে কাগজে প্রকাশিত খবর কাগজটি দেশের খবর ছাড়া বিদেশী খবরও সরবরাহ করে থাকে। অধর্মীয় পাঠ্যবস্তুর মধ্যে সে-সংবাদপত্রই সময় পেলে দাদাসাহেব একনজর চেয়ে দেখেন। সেদিন সকালে তাতে একটি খবর পড়ে তিনি বেসামাল ধরনে আনন্দোৎফুল্ল হয়ে পড়েন। তাঁর হাঁকডাক শুনে সবাই ছুটে আসে। অবশ্য এত হৈ- হুলুস্থুলের কারণ প্রথমে কেউ বুঝতে না পারলেও তাঁর উত্তেজিত উজ্জ্বল মুখ দেখে কারো সন্দেহ থাকে না যে, একটি গুরুতর কিন্তু অতিশয় প্রীতিকর এবং শুভময় ঘটনাই ঘটেছে। 

ব্যাপারটা খোলাসা হলে জানা যায়, জেলা-শহরের সংবাদপত্রটিতে খবর বেরিয়েছে যে আমেরিকায় একজন বিশেষ গুণী এবং ধর্মসিক্ত ব্যক্তি তাঁর দেশবাসীদের ইসলামধর্মে দীক্ষিত করবার জন্যে বিষম তোড়জোড় শুরু করেছেন। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শুনতে আসে তাঁর ওয়াজ। তাঁর যুক্তিপূর্ণ আবেদন-হুজ্জাতে এবং তাঁর উদ্দীপনা-ভরা বক্তৃতায় লোকেরা এত ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে যে রিভল্ভারধারী শতশত তাগড়া তাগড়া পুলিশও তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে পারে না। 

নাকের ডগায় চশমা বসিয়ে দাদাসাহেব এবার সংযত তবু গর্বিতকণ্ঠে সংবাদটি আবার পড়ে শোনান। ততক্ষণে গোলযোগ শুনে তাঁর বিধবা মেয়ে আনোয়ারাও রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এসে উপস্থিত হয়েছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে সংবাদটি বুঝবার চেষ্টা করে। কোথায় আমেরিকা, কী তার বাসিন্দাদের ধর্ম সে-সব পরিষ্কারভাবে তার জানা নাই। কিন্তু এ-কথা সে বুঝতে পারে যে, সেখানে ইসলাম ধর্মের গর্বিত পতাকা উঠবার বেশি দেরি নাই। আনোয়ারার রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, চোখেও আকস্মিকভাবে বৃষ্টির ঝাপটার মতো পানি আসে। 

আনন্দোচ্ছ্বসিত ব্যক্তি নিরস্ত্র। দাদাসাহেবের নিরস্ত্রভাবের সুযোগ নিয়ে তবারক হঠাৎ একটি উক্তি করে। ছেলেদের মধ্যে সে বয়োজ্যেষ্ঠ, ইস্কুলে সর্বোচ্চ শ্রেণীতে পড়ে। 

‘লোকটা যে হাবসী।’ 

চশমার ওপর দিয়ে দাদাসাহেব পরমবিস্ময়ে তার দিকে তাকান। 

‘দোষ কী তাতে? আমাদের মাহাবে জাতবিচার বর্ণবিচার নাই। সকলেই খোদার বান্দা। সবাই তাঁর চোখে সমান।’

ছেলের বেয়াদবিতে আশঙ্কিত হয়ে তার মা আনোয়ারা ভর্ৎসনা করে, 

‘তুই চুপ কর, ফজুল কথা বলিস্ না।’

দাদাসাহেব তখনো অস্ত্রগ্রহণ করেন নাই। সুতরাং মায়ের কথা উপেক্ষা করে তবারক আবার বলে, ‘সে শুধু হাবসীদেরই মুসলমান করছে।’

এবার দাদাসাহেব কিছু দমিত হন, তাঁর উৎসাহে একটু ভাটা লাগে। হয়তো মনে একটু সন্দেহও জাগে। জানালার বাইরে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবিতভাবে নীরব থাকেন। তারপর আস্তে বলেন, ‘সবকিছুরই আরম্ভ আছে। আরম্ভ হয়েছে। বাকি খোদার মর্জি।’

তাঁর মুখভাব লক্ষ করে সমাকুল আনোয়ারা আবার তার ছেলেকে ভর্ৎসনা করে। 

‘চুপ কর। কেন আবার ফজুল কথা বলছিস?’ 

‘না, কোনো ফজুল কথা বলছে না।’ দাদাসাহেব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলেন। ছেলেদের ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস। ‘তবারকের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নাই। একটুতে সে খুশি হয় না।’ 

তবারক প্রতিবাদ করে না। এবার নিশ্চিন্ত হলে তার মায়ের মুখ সন্তানগৌরবে রক্তিমাভা লাভ করে। সংযত-আনন্দের সঙ্গে সে দাদাসাহেবকে প্রশ্ন করে, ‘বড় সুসংবাদ। ফকির- মিসকিন খাওয়ালে কেমন হয়?’ 

দাদাসাহেবের উৎসাহ নিচের খাদে নেবে সেখানেই আছে, মনের সন্দেহটাও কাটে নাই। কিন্তু এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা যায় না। সে রাতে এক অজানা মার্কিন নিগ্রোর বদৌলতে তিন গ্রামের ফকির-মিসকিন জেয়াফত পেল। 

এশার নামাজের পর, ঘরে অনুজ্জ্বল লণ্ঠনের আলো, পায়ের ওপর ছক–কাটা লাল কম্বল, দাদাসাহেব কখনো কখনো ইতিহাসের গল্প বলেন। দেয়ালে দীর্ঘ ছায়া, আলো-অন্ধকারে দাদার মুখমণ্ডলে একটা অস্পষ্ট শ্রান্তির ভাব। দিনশেষে হয়তো বার্ধক্যের জন্য শ্রান্তি বোধ করেন, অথবা রাত্রির সন্নিধানে নিজের জীবনসন্ধ্যার বিষয়ে অজ্ঞাতে সচেতন হয়ে ওঠেন। 

তিনি বলেন : ‘কোথায় না খোদাভক্ত খোদাভীত খোদাপ্রেমিক দীনদয়াময় বীর্যবান মুসলমান ধর্মের পতাকা উত্তোলন করে নাই, কোথায় না সভ্যতার উজ্জ্বল মশাল বহন করে নিয়ে যায় নাই? তাদের জয় বিজয় ও কৃতিত্বের কাহিনী ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে মণিমুক্তার মতো ঝলমল করে। ইরান-তুরান – খোরাসান, সামারা-সিকিলিয়েহ- বালারাম; দূর দূর দেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারিত হয়েছে। তারা বাগদাদ-দামাস্কাস কুতুবা গ্রানাদার মতো মনোরম শহর সৃষ্টি করেছে, নির্মাণ করেছে বৃহৎ মহৎ সুদৃশ্য প্রাসাদ-দুর্গ-তোরণ-মিনার। কত নাম বলি? খুন্দ প্রাসাদ, বাবউজ্জাহাবের সোনালি তোরণ, বিশাল দুর্গ-প্রাসাদ, মেদিনাত্-উল-হামরা, নাইল নদীতীরে কাছর্-উল-খাবরি। তারপর শত শত মনোরম উদ্যান, শত শত শিক্ষাকেন্দ্র, বাণিজ্যবন্দর। ত 

কিন্তু ইতিহাসের কথা দাদাসাহেব কখনো কখনোই বলেন। ইতিহাস মানুষের সৃষ্টি। তাঁর মতে, মানুষের সৃষ্টির কথা তুললে ভালো-খারাপের কথা ওঠে। দয়াবান নিষ্ঠাবান সচ্চরিত্র মহৎ খলিফা উমর বা রশীদ-মামুনের কথা তুললে ইয়াজিদ-হাজ্জাজ বিন ইউসুফ-মুতাওয়াক্কিলের নৃশংসতা হীনতা বিশ্বাসঘাতকতার কথা ঢেকে রাখা যায় না। কখনো কখনো দাদাসাহেব গভীর দুঃখের সঙ্গে ভাবেন, দ্বিতীয় দলই যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কী করে তাদের কথা ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায়? তাদের কথা ভাবলে কোনো-কোনো সময়ে তাঁর হৃৎকম্পনের মতো ভাব হয়। শুষ্ক হৃদয়ে ভাবেন, নির্দয় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নাকি নিজেই পনের হাজার মানুষের মস্তকচ্যুত করে। একটি দুটি নয়, পনের হাজার মানুষ! ওবাইদুল্লাহ্ বিন জিয়াদ কসাই নাম অর্জন করেছিল তার নিষ্ঠুরতা হিংস্রতার জন্যে। ইতিহাসের কথা তুললে তাদের নাম কি এড়ানো যায়? 

দাদাসাহেব এ কথা বোঝেন যে পাপ-মন্দের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম চিরন্তন। খোদা সত্যপথ দেখিয়েছেন মানুষকে, কিন্তু ক-জন মানুষ সে পথে চলতে পারে? তবু একটা কথা থাকে। মানুষ কুপথে কেন যায়? 

একটি বিষয়ে দাদাসাহেব নিঃসন্দেহ হতে পারেন না। মানুষের পঙ্কিলতা, তার চারিত্রিক দোষঘাট হিংস্রতা অমানুষিকতা কিশোর মনের জানার প্রয়োজন আছে কি? জীবনের শুরুতেই মানুষের ভুলভ্রান্তি অপচার-ব্যভিচারের কথা তাদের জানা উচিত কি? তরুণমনের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন আর বিশ্বাস নবজাত বলেই সুন্দর ও পবিত্র। তা ধ্বংস করা কি ঠিক? দাদাসাহেব আপন মনে প্রশ্ন করেন কিন্তু সঠিক কোনো উত্তর পান না। এবং উত্তর পান না বলেই ইতিহাসের কথা কদাচিৎই বলেন। 

অবশ্য প্রশ্নের উত্তর পান না বলে দাদাসাহেব বিচলিত হন না। তিনি পরমসত্যে বিশ্বাসী। তাঁর মতে সে সত্য কেবল আসল কিতাবেই পাওয়া যায় এবং সে-সত্য মানুষের বিগতদিনের বা বর্তমানকালের কার্যকলাপে ধ্বংস হয় না : চিরন্তন সত্যকে কখনো ধ্বংস করা যায় না। তাঁর গূঢ়বিশ্বাস, সে-কিতাবের আদেশ-নির্দেশ বাধা-নিষেধ অনুসরণ করে জীবনযাপন করলেই মানুষের মুক্তিলাভ হয়। 

কখনো-সখনো তিনি ছেলেদের বংশের কথাও বলেন। বিনীতিশালীনতায় ঢাকা থাকে বলে সহজে তা পরিলক্ষিত হয় না, কিন্তু দাদাসাহেবের মনে বংশগৌরব কম নয়। আজ সে ধনসম্পদ বা মান-ইজ্জত নাই, কিন্তু এককালে চারধারে তাদের বড় নাম-ডাক ছিল। তখন তাঁরা বিশাল জমিদারির মালিক ছিলেন। তাঁদের ঘোড়াশালে তখন ঘোড়া ছিল, হাতিশালে হাতি। খিল্লাত পরিধান করে রেশমের খরিতায় পত্রাদি বাঁধতেন, খাশমহল আতর বাইমস্কের সুগন্ধিতে ফুরফুর করত এবং বিশেষ উৎসবের দিনে বাদশাহি কায়দায় পথে-ঘাটে মোহর ছড়াতেন। তখন আবদার- চোবদার রাখতেন গণ্ডায় গণ্ডায়, সাবর সেবন্দিও পুষতেন। আজ সেদিন আর নাই। তবে সে সমারোহ জাঁকজমক আজ নাই বলে দাদাসাহেবের মনে কোনো সময়ে দুঃখ এলেও বংশগৌরবের মতোই সে দুঃখ তিনি ঢেকে রাখেন, প্রকাশ করেন না। তাছাড়া তাঁর বিশ্বাস, জাঁকজমক হল বাইরের খোলস, অর্থ থাকলেই সে খোলস আসে। বংশের আসল দাম ধন-দৌলতের ওপর নির্ভর করে না। গরিব হলেও আসল খানদানিবংশের দাম পড়ে না। শুধু সোনারূপা, হাতিঘোড়া, পাইক-বরকন্দাজের শানশওকাত থাকলেই একটি বংশ খানদান হয় না। খানদানির মূলভিত্তি হল নেক-চরিত্র, ধর্মের প্রতি ভক্তিনিষ্ঠা, সাধুতা- দয়াশীলতা, বিনয়-নিরভিমান ব্যবহার ইত্যাদি গুণাগুণ। দাদাসাহেবের বিশ্বাস, এ সব গুণাগুণ বংশপরম্পরাক্রমে তাঁদের মধ্যে প্রবহমাণ আছে। একটি তুলনায় তিনি তাঁর যুক্তির পূর্ণ সমর্থন পান। মুসলমানদের শানশওকাত আজ নাই, কিন্তু তাই তাদের অন্তস্থিত মূল্য কি কিছু কমেছে? অবশ্য এ-যুক্তি তাঁরই। 

.

আজ সন্ধ্যায় ছক-কাটা লাল কম্বল গায়ে জড়িয়ে দাদাসাহেব প্রথমে চোখ নিমীলিত করে তবি পড়তে শুরু করেন। পায়ের কাছে কুদ্দুস, তবারক এবং আমজাদ বসে। তারা কতক্ষণ তাঁর নিমীলিত চোখের পানে তাকিয়ে থাকে, তারপর লক্ষ করে, তাঁর মুখ ভাবনাচ্ছন্ন। কিচ্ছা কাহিনীর আশা কিছুটা ছেড়ে দিয়ে তারা শোনে বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার গোঙানি। থেকে থেকে পশলা বৃষ্টি নাবে কিন্তু দুরন্ত হাওয়ায় সে-বৃষ্টি শীঘ্র বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। থেকে থেকে সে-হাওয়া ভীতিবিহ্বল অন্ধ পশুর মতো জানালা-দরজায় ঝাপটা দিয়ে যায়। শীতের সন্ধ্যায় এ-অসময়ী ঝড় ছেলেদের মনে বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে তোলে। 

দাদাসাহেব তাঁর নিয়মিত বৈঠক শুরু না করে আপন ভাবনায় কেমন নিঝুম হয়ে থাকেন। মাথা নত করে তবি টেপেন, অস্পষ্টভাবে তাঁর ঠোঁট নড়ে, দেহ নিস্পন্দ। আমজাদ একবার ঝুঁকে তাঁর চোখ দেখবার চেষ্টা করে কিন্তু তা ছায়াচ্ছন্ন বলে দেখতে পায় না। তারপর একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে সে জানালার দিকে তাকায়। ঝড়ের লেজের বাড়ি খেয়ে জানালাটি তখন থরথর করে কাঁপছে। 

একটু পরে কিছু সচকিত হয়ে ছেলেরা শোনে দাদাসাহেব অনুচ্চস্বরে কোরানের একটি সুরা আবৃত্তি করতে শুরু করেছেন। চোখ পূর্ববৎ নিমীলিত কিন্তু তাঁর কণ্ঠে মিষ্টি-মধুর শব্দলহরি জেগেছে। এবার কিছুটা আশান্বিত হয়ে তারা নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে, ঝড়ে আর কান দেয় না। 

আবৃত্তি শেষ করে দাদাসাহেব আবার নীরব হন। তারপর যেন অপেক্ষমাণ ছেলেদের কথা স্মরণ করে আচম্বিতে ঘোষণা করেন, ‘কম লোকেই বোঝে, কিন্তু তোমাদের কাদের দাদা দরবেশ মানুষ।’

ছেলেরা এবার অনুমান করে যে, দাদাসাহেব তাঁর ভাই কাদেরের কথা ভাবছেন। কেন জানতে ইচ্ছা করলেও তাঁর ভাবনাগ্রস্ত মুখ দেখে কোনো প্রশ্ন করতে সাহস পায় না। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্যে একটু অপেক্ষা করে। দাদাসাহেব আবার চোখ বুজে নীরবাচ্ছন্ন হলে তারা নিরাশ হয়ে ঝড়ের বিচিত্র আর্তনাদে কান ফেরায়। 

কাদের দাদাসাহেবের কনিষ্ঠতম ভাই হলেও দু-জনের মধ্যে প্রায় ত্রিশ বছরের ব্যবধান। দুনিয়ায় কাদেরের যখন আবির্ভাব হয় তখন দাদাসাহেবের ওয়ালেদ বয়োবৃদ্ধ। তখন তাঁর চোখে ছানি পড়েছে, হয়তো চরিত্রে ভীমরতির আভাসও দেখা দিয়েছে। জন্মের প্রথম দিন থেকেই অপ্রত্যাশিত শিশুসন্তান তার বাপের চোখের মণি হল। তাতে দোষ নাই। সবাই মেনে নিল তাঁর শেষ-সন্তানের প্রতি অপরিমিত স্নেহ : বৃদ্ধ বয়সে নোতুন প্রাণের সংস্পর্শে জীবনের প্রতি পুনরুদ্ভূত তীব্র অভীপ্সা কৌতূহলজনক হলেও নিন্দনীয় নয়। কিন্তু চেতনাবোধের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের যে চরিত্র প্রকাশ পেল তাতে সবাই শীঘ্র সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল তাদের আদর্শের সঙ্গে সে চরিত্র যেন ঠিক খাপ খায় না। তার অদম্য খামখেয়ালি ভাব, উগ্র মেজাজ এবং সৃষ্টিছাড়া দুরন্তপনা তাদের কাছে নেহাতই বেখাপ্পা ঠেকে। কেবল বৃদ্ধ বাপ অবিচলিত থাকেন। তার বিসদৃশ চরিত্র হয়তো তাঁর নজরে পড়ে না। পড়লেও এবং সংগোপনে তার চারিত্রিক রুক্ষতা স্নেহের মলমে মোলায়েম করবার চেষ্টা করে থাকলেও সে চেষ্টায় তিনি কৃতকার্য হন না। 

কাদেরের উগ্র-দুর্দান্ত স্বভাব বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা না হয়ে আরো তেজী হতে থাকে। কিছুদিন সে ইস্কুল করে, কিন্তু ইস্কুলের চার দেয়ালের শক্তি কি তাকে দু-মিনিটের জন্যেও কয়েদ করে রাখে! সে যে বিদ্রোহী ছেলে তাতে সন্দেহ রইল না। কেবল কিসের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ সে-কথা কেউ বুঝল না। 

চোখ না খুলেই হঠাৎ দাদাসাহেব অনুচ্চকণ্ঠে আপন মনে বলেন, ‘দরবেশের বিদ্রোহ সাধারণ লোকে কী করে বোঝে?’ 

হঠাৎ একদিন সে-দুরন্ত ছেলের মধ্যে ঘোরতর পরিবর্তন এল। যেন অকস্মাৎ ঝড় থামল। বয়স তখন আঠার-উনিশ। মুখে আর কথা নাই, চলনে তেজ নাই, চোখে চোখে কারো দিকে তাকায় না। একা একা থাকে, কারো সঙ্গ পছন্দ হয় না। এই সময়ে দাদাসাহেব তাকে তাঁর কার্যস্থলে নিয়ে যান। ধর্মের ব্যাপারে কিছু শিক্ষাদীক্ষা দেবার চেষ্টা করেন, নানারকম উপদেশ-নছিহত দেন যাতে এতদিন যা বাদ পড়েছে তার কিছুটা পূরণ হয়, তার জ্ঞানবোধ আর চারিত্রিক অভাব কিছুটা কাটে। এই সময়ে কাদেরের প্রতি তাঁর পিতার অন্ধস্নেহের কিছুটা যেন তার মনেও দেখা দেয়। ইস্কুলের লেখাপড়া তার বিশেষ হল না, কারণ গোড়া থেকে শুরু করার বয়স তখন পেরিয়ে গেছে। তবে পার্থিব জ্ঞানার্জন না হলেও তার আধ্যাত্মিক উন্নতির বিষয়ে দাদাসাহেবের মনে কোনো সন্দেহ রইল না। তারপর একদিন সে হঠাৎ দেশের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে। 

‘আমিই তাকে শিখিয়েছি। আমার হাতেই সব শিখেছে, তোমাদের কাদের দাদা’, দাদাসাহেব আবার বলেন। কথাটায় আত্মদত্ত লক্ষ করে একটু লজ্জিত হয়ে যোগ দেন, ‘অবশ্য দরবেশকে কে কী শেখাতে পারে?’ 

দাদাসাহেবের বাপ-মা দুজনেরই ততদিনে ইন্তেকাল হয়েছে। কাদেরের স্বভাব পরিবর্তনের পরে আশা হল, সেই জমিজমা ঘরসংসার দেখবে। ভরসা হল চারিত্রিক বিশৃঙ্খলা কেটেছে, এবার একটু কেমন বিহ্বলতা যে দেখা দিয়েছে তাও কাটবে এবং ঘরসংসারের জটিলতা বুঝতে তার দেরি হবে না। সে আশা পূর্ণ হয় নাই। 

‘সংসারে দরবেশের মন কখনো পড়ে না।’ দাদাসাহেব আবার আপন মনে উক্তি করেন। তারপর ছেলেদের উপস্থিতি সম্বন্ধে সজ্ঞান হয়ে তাদের দিকে একবার তাকান। সংক্ষিপ্তভাবে বলেন, ‘তোমাদের কাদের দাদার কথা বলছি।’

অবশেষে সংসারের ভার নিল দাদাসাহেবের জ্যেষ্ঠপুত্র হামিদ। সিধেসাধা গোবেচারা মানুষ, সদাসর্বদা আদেশাধীন, নম্র-বাধ্য। অশেষ শ্রমসহিষ্ণুতার সঙ্গে এবং বারংবার চেষ্টার ফলে কলেজের শেষ পরীক্ষা কোনো প্রকারে পাস করলেও সকলের আশা হয় সে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করবে। যোগদান করেওছিল, কিন্তু ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো তার প্রাণ শীঘ্রই আইঢাই করতে শুরু করে। চাকুরি অসহ্য হয়ে উঠলে তাতে ইস্তফা দিয়ে দেশের বাড়িতে ফিরে আসে। নামে শুধু কাদের সংসারের দায়িত্ব নিয়েছিল। হামিদের প্রত্যাবর্তনের পর সে-দায়িত্বও থাকল না। 

আজ কাদের সম্পূর্ণভাবে নিষ্কর্মা। অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং অসামাজিক বলে তার মনের পরিচয় পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু তার বাইরের চেহারা স্বভাবত নিদ্রালস। নিদ্রালস ভাব কাটলে চরম উদাসীনতা নাবে তার মুখে। দাদাসাহেব বলেন, তা তার মুখাচ্ছাদন মাত্র। বিছানায় যখন লম্বা হয়ে পড়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তখন খাটের খুরোতে আর তাতে তফাৎ থাকে না! মাছ ধরার বাতিক জাগলে ছিপ-বড়শি নিয়ে পুকুরধারে গিয়ে যখন বসে তখন প্রাতঃকাল মধ্যদিনের উত্তাপ পেরিয়ে নিষ্প্রভ অপরাহ্ণে গড়িয়ে যায়, সে নড়েচড়ে না, নিস্পৃহমুখ দেখে মনে হয় তার যেন কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষাই নাই। বার দুয়েক তাকে তর্ক করতে দেখা গেছে। পরিবারের কারো সঙ্গে নয়, মসজিদের এক চোখ-কানা ইমামের সঙ্গে। যুক্তিতর্কের সূত্র বেশিক্ষণ ধরে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। মতবিরোধ ঘটলে হঠাৎ তার মেজাজ রুক্ষ হয়ে ওঠে, কিশোর বয়সে যেমন হত। তবে শীঘ্র নিজেকে সংযত করে অপ্রস্তুত ইমামকে রেহাই দেয়। দ্বিতীয়বারও তার বক্তব্যের মূলকথা উত্তপ্ত ভাষায় বাষ্পীভূত হতে দেরি লাগে নাই। তার সাধারণ মানুষসুলভ কর্মের মধ্যে আকস্মিক বিয়েই হয়তো একমাত্র উল্লেখযোগ্য। তিন বছর আগে চির বিবাহ-বিরোধী কাদের মত বদলিয়ে হঠাৎ বিয়ে করে। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে আজ তার সম্বন্ধ অতি ক্ষীণ। অনেক সময় দীর্ঘকাল তাদের মধ্যে কথালাপ হয় না। 

দরবেশ বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল, সেটাই মস্ত কথা। আর দশজন জামাইর মতো ব্যবহার কীভাবে করে? একবার দাদাসাহেব তার স্ত্রী-উদাসীনতা সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘কেবল কথা বলে না। মারপিট করে কি? না, তা করে না। তবে নালিশের কারণ কী? 

কাদেরের দরবেশীলাভের ইতিহাস একদিন কিছুটা সংগোপনে দাদাসাহেব ছেলেদের বলেছিলেন। তখন সে অবিবাহিত। একদিন মধ্যরাতে সে জেগেই শুয়েছিল, হঠাৎ বাড়ির দেউড়ির কাছে থেকে কে যেন তাকে ডাকল। অপরিচিত কণ্ঠস্বর, তবু কোন বন্ধু যেন ডাকল তাকে। ধড়মড়িয়ে উঠে দরজার খিল খুলে সে বেরিয়ে গেল। কাউকে দেখতে পেল না, কিন্তু তাতে নিরুৎসাহ হল না, বিস্মিত হল না, ভীতও হল না। তারপর সে হাঁটতে থাকল। অনির্দিষ্টভাবে নয়, কারণ কণ্ঠস্বরটি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। সে-রাতে বুজুর্গের সঙ্গে তার প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়। পরদিন সকালে যখন সে ঘরে ফেরে, তার মুখ ফ্যাকাসে, রক্তহীন, কিন্তু চোখে অত্যুজ্জ্বল দীপ্তি, অলৌকিক তৃপ্তি-সন্তোষ ভাব। সেই থেকে বুজুর্গের সঙ্গে তার প্রায় সাক্ষাৎ হয়। 

দাদাসাহেব বলেন, ‘অবশ্য মুখ খুলে এসব কথা সে কখনো বলে নাই। এসব কথা কেউ মুখ খুলে বলে না।’ কী করে কথাটা তিনি জানতে পেরেছেন তা তিনি পরিষ্কার করে বলেন না। 

আজ ঝোড়ো সন্ধ্যায় দাদাসাহেব ধর্মোপদেশ না দিয়ে, নীতিমূলক কিচ্ছা-কাহিনী না বলে কাদেরের কথাই কেন ভাবছেন, তার কারণ আছে। সকালবেলায় তার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকালে তিনি লক্ষ্য করে দেখেন, তার মুখ ফ্যাকাসে ও রক্তহীন। তাঁর বুঝতে দেরি হয় না কেন। তবে তার চোখ দেখে তিনি অতিশয় বিস্মিত হন। তাতে কেমন তীক্ষ্ণ খরধার। শুধু তাই নয়। এক পলকের জন্যে সে এক বিশেষ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকায়, যার অর্থ তিনি বোঝেন না। ইশারায় সে যেন তাঁকে কিছু জানাতে চায়। 

সে-দৃষ্টি সারাদিন দাদাসাহেবকে নিপীড়িত করেছে, তার সঙ্গে নির্জনে একটু আলাপের জন্যে, তাকে দু-একটা প্রশ্ন করবার জন্যে একটি প্রবল বাসনা থেকে থেকে তিনি বোধ করেছেন। 

বিষাদাচ্ছন্নকণ্ঠে দাদাসাহেব উচ্চস্বরে বলেন, ‘বলবার হলে সে-ই বলবে। আমার পক্ষে জিজ্ঞাসা করাটা সমীচীন হবে না।’ 

বাইরে ঝড় থেমেছে। রুদ্ধ জানালার দিকে একবার তাকিয়ে দাদাসাহেব পিঠ সোজা করে বসেন। বড়ঘরে দেয়ালঘড়িতে সাড়ে দশটার ঘণ্টা বাজে। ছেলেদের দিকে তাকাবার আগে আরেকবার ভাবেন কাদেরের কথা। ভাবেন, অবশ্য এ কথা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না, কিন্তু বুজুর্গ মানুষ সহজে দেখা দেন না। দরবেশ না হলে কাদের কি বুজুর্গের দেখা পেত? না, কাদের যে দরবেশ তাতে সন্দেহ নাই। 

তারপর চোখ খুলে তিনি ছেলেদের দিকে তাকান। একটু কেশে গম্ভীরভাবে ঘোষণা করেন, ‘আজ তোমাদের প্রিয় পয়গম্বরের ইন্তেকালের কথা বলব। ত 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *