ষোল
আদালতের সামনে ঘাসশূন্য বৃক্ষছায়াচ্ছন্ন প্রাঙ্গণটি অতিক্রম করে দু-দিন আগে স্ব-ইচ্ছায় যে-ঘরে সে এসেছিল, আজ সে ঘরেই তারা তাকে নিয়ে এসেছে। টেবিলের ওপাশে সেদিনের মতো উপরিতন পুলিশ -কর্মচারীটিও যথাস্থানে বসে। ছোটখাটো মানুষ দেখতে নিরীহ। সামনের দাঁত অসমান, নিচের ঠোটটা ভারি। তাই হয়তো মুখ খুলে রাখার অভ্যাস। তবে একটা স্থায়ী ভ্রূকুটির জন্যে তার মুখের শিথিলতা কিছু রক্ষা পায়।
তাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে পুলিশ কর্মচারী চোখ তুলে তাকায়। দেখতে-না-দেখতে তার চোখে-মুখে বিপুল পরিবর্তন উপস্থিত হয়। তার ভ্রূকুটি গাঢ় হয়ে ওঠে, দৃষ্টিতে ক্ষীণ ধার দেখা দেয়। সন্দেহের অবশ্য কোনো অবকাশ ছিল না, তবু যুবক শিক্ষকের মন থেকে এবার সব সন্দেহ দূর হয়। কিন্তু তার মুখে ভাবান্তর ঘটে না। সেদিনের ঘরটি এবং টেবিলের ওপাশে পুলিশ-কর্মচারীকে সে যেন বহুদূর থেকেই দেখে। তার দৃষ্টি স্বচ্ছ, তবু কিছুই নিকটে মনে হয় না। পুলিশ-কর্মচারীটি সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে তাকায়। সাব-ইন্সপেক্টরের পেছনে দণ্ডায়মান কনস্টেবলটির বুটে আওয়াজ হয়।
‘বসেন।’ পুলিশ-কর্মচারী সাব-ইন্সপেক্টরকে বসতে বলে। সাব-ইন্সপেক্টর বসলে তার মধ্যে সর্বপ্রথম স্বচ্ছন্দতা আসে। তার বয়স বেশি নয়।
‘ঘরেই ছিল। পালাবার চেষ্টা করে নাই।’ অল্পবয়স্ক সাব-ইন্সপেক্টরটি বলে।
যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, সে-ই উক্তিটির বিষয়বস্তু। তবু তার মনে হয়, সাব-ইন্সপেক্টর অন্য কোনো মানুষের কথা বলছে যেন। অপরিচিত কোনো মানুষ ঘরেই ছিল, পালাবার চেষ্টা করে নাই।
ততক্ষণে পুলিশ-কর্মচারির দৃষ্টি তার ওপর আবার নিবদ্ধ হয়েছে। সে-দৃষ্টিতে প্রবঞ্চিত মানুষের ক্রোধভাব যেন। যুবক শিক্ষক এবারও বোঝে যে, সে-ই তার ক্রোধের কারণ। কিন্তু তাতে বিচলিত না হয়ে নিস্পৃহ-নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় সরকারি ক্ষমতাপত্র সমেত অল্পবয়স্ক সাব-ইন্সপেক্টর এবং দু’জন বন্দুকধারী কনস্টেবল সকালবেলায় তার বাড়িতে উপস্থিত হলেও সে বিচলিত হয় নাই। বরঞ্চ তাদের আগমন, তারপর সুটকেস হাতে তাদের সঙ্গে থানা অভিমুখে যাত্রা সবই তার কাছে বারবার মহড়া-দেয়া অভিনয়ের মতো সুপরিচিত মনে হয়েছে। পুলিশ কর্মচারীর চোখে এখন সে যে-ক্রোধ দেখতে পায়, সে- ক্রোধও অপ্রত্যাশিত মনে হয় না। তাছাড়া, সে- ক্রোধ সত্য নয় যেন। আসলে তা বর্তমান অভিনয়ের একটি অংশমাত্র।
শীঘ্র যুবক শিক্ষক কেমন অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। তখনো সে ফুলতোলা সুটকেসটি হাতে করে দাঁড়িয়ে। সে সুটকেসটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে যেন। সে বুঝতে পারে না সেটি কোথায় রাখবে। কনস্টেবলটি তার সমস্যার কথা বুঝে তার হাত থেকে সুটকেসটি তুলে নিয়ে দেয়ালের পাশে রাখে। ঘরের নিঃশব্দতায় শক্ত বুটের অজস্র আওয়াজ হয়।
পুলিশ-কর্মচারীর রাগ পড়ে, ভ্রূকুটিটাও ক্ষণকালের জন্যে অন্তর্ধান করে। সে যুবক শিক্ষককে বলে, ‘বসেন।’
বসার অনুরোধটি মহড়ায় যেন বাদ পড়েছিল। তাই যুবক শিক্ষকের বসতে কিছু দ্বিধা হয়। তারপর আস্তে বসে পড়ে সে টেবিলের তলে আলগোছে হাত কচলাতে শুরু করে। তারপর সে অপেক্ষা করে।
পুলিশ-কর্মচারীর মুখমণ্ডলে ক্রোধভাব কঠিনতা এবং ভ্রূকুটি ফিরতে দেরি হয় না। সঙ্গে সঙ্গে ধমকে বলে ওঠে, ‘চালাকি করতে চেয়েছিলেন? না, চালাকিতে কাজ হয় না।’
যুবক শিক্ষক তার ভর্ৎসনা শোনে, কিন্তু কিছু বলে না। হয়তো অভিনয়ে তার বলার সময় এখনো আসে নাই বলেই সে নির্বাক হয়ে থাকে। বাইরে আদালতের সামনে মামলাবাজদের কলরব তার কানে লাগে।
পুলিশ-কর্মচারী চোখ ছোট করে তীক্ষ্ণভাবে যুবক শিক্ষককে কয়েক মুহূর্ত পরীক্ষা করে দেখে। নিচের ঠোঁটটা অভ্যাসমত ঝুলেই থাকে। তারপর হঠাৎ টেবিলে হাত পিটিয়ে বাঘা-গলায় আবার সে আগের কথাই একটু ঘুরিয়ে বলে, ‘ভেবেছিলেন চালাকি করে পার হয়ে যাবেন?’
এবারও যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। সব কথা জেনে পুলিশ কর্মচারী অর্থহীন কথা বলছে। সেটাও অভিনয়ের অংশ। এখানে যুবক শিক্ষকও একজন অভিনেতা। তবে যথানিৰ্দিষ্ট সময়েই সে কথা বলবে।
তার নীরবতা পুলিশ-কর্মচারীর পছন্দ হয় না। টেবিলে দু-হাত চেপে সামনে ঝুঁকে থুত ছিটিয়ে আবার সে বলে, ‘কী, অপরাধ স্বীকার করতে রাজি আছেন?’
এবার একটা উত্তর না দিয়ে উপায় নাই। তবে প্রশ্নটির মতো উত্তরটিও তার মুখস্থ বলে কোনো দ্বিধা না করে সে ক্ষুদ্র গলায় তার বক্তব্য বলে। কিন্তু তার বক্তব্যটি শুনে পুলিশ -কর্মচারীটি অকস্মাৎ ক্রোধে আত্মহারা হয়ে পড়ে। সেটাও অভিনয় সন্দেহ নাই, কিন্তু তবু তার ক্রোধের ঝাপটা গায়ে লাগে বলে যুবক শিক্ষক ঈষৎ চমকে ওঠে।
‘সত্য কথা!’ পুলিশ -কর্মচারী আবার হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।
যুবক শিক্ষক তার বক্তব্যটি আবার বলে, ক্ষুদ্র নিস্তেজ কণ্ঠে। সেদিন সে সত্য কথাই বলেছিল।
পুলিশ-কর্মচারী কয়েক মুহূর্তের জন্যে বাকশূন্য হয়ে পড়ে যেন। বাক্শক্তি ফিরে এলে সে এবার গভীর বিরক্তির সঙ্গে বলে, ‘তদারক হবে। কিন্তু আপনার তাতে লোকসান বই লাভ নাই।’
যুবক শিক্ষক এবার নীরব হয়ে থাকলে পুলিশ-কর্মচারী সহসা হয়তো বুঝতে পারে না, সে কী বলবে। ভাগ্যবশত এমন সময় একটি ছেলে দু-পেয়ালা চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। এক পেয়ালা পুলিশ কর্মচারীর জন্যে দ্বিতীয় পেয়ালা সাব-ইন্সপেক্টরের জন্যে। এক চুমুক দিয়ে উপরিতন কর্মচারীটি পকেট থেকে একটা আধা-ভরা সিগারেট-প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট ধরায়। মুহূর্তের মধ্যে তার গন্ধে ঘরটা ভরে ওঠে।
গন্ধটা নাকে লাগতেই যুবক শিক্ষক সন্তর্পণে তা বার-দুয়েক ঘ্রাণ করে দেখে, তারপর তার মনের অন্তরালে কোথাও ঈষৎ বেদনার ভাব দেখা দেয়। কাদেরের কথা তার মনে পড়ে। সে-রাতে কাদের তাকে একটি সিগারেট দিয়েছিল। সে-কথাটাই স্মরণ হয়। না, কাদেরের কথা যে স্মরণ হয়, তা নয়। কাদের যেন তার মন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে সিগারেটের গন্ধটি একটি দৃঢ়জীবনের স্মৃতিই যেন জাগায় তার মনে। সে-রাত আর আজকার মধ্যে এতই কি ব্যবধান?
চা-এ আরো কয়েকবার চুমুক দিয়ে পুলিশ -কর্মচারী কণ্ঠস্বর নিচতম খাদে নাবিয়ে অন্তরঙ্গভাবে বলে, ‘আপনি মাস্টার। কথাটা বুঝতে দেরি হবে না আপনার।’
পরম হিতৈষীর মতো সে একটি নাতিদীর্ঘ কিন্তু সহৃদয় বক্তৃতা শুরু করে। প্রথমে তার দিকে নিষ্পলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক কান দিয়েই তার কথা শোনে। তারপর বিস্ময়ে তার মন ভরে ওঠে। সে বুঝতে পারে যে, পুলিশ কর্মচারী তাকে সুবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির মতো ব্যবহার করতে বলে যে-সব যুক্তিতর্কের অবতারণা করছে, সে-সব যুক্তিতর্ক সে যে শুধু জানে তা নয়, সে-সব নিজেই সে ভেবে দেখেছে। পুলিশ-কর্মচারী নূতন কিছুই বলছে না; যা সে বলছে যুবক শিক্ষক তার মহড়া দিয়েছে অনেকবার। তার কার্যের কী পরিণাম হবে, কেন হবে, কী কী ভাবে হবে—সে-সব কথা উপলব্ধি করে তার ভীতির শেষ থাকে নাই। সে-ভীতি এখনো যায় নাই। তবে তা এমনই এক ধরনের ভীতি যা শরীরে কোথাও গভীর ক্ষতের মতো লেগে আছে, তা উপড়ানোও যায় না অস্বীকার করাও যায় না। এমন ভয়কে মেনে নিয়ে ভুলে যাওয়াই ভালো।
পুলিশ-কর্মচারীর কথা শুনে অকস্মাৎ সে একটা অপরিসীম তৃপ্তিও বোধ করতে শুরু করে। সে কি তার মনের যুক্তিতর্কের কথা অপরের মুখে শুনছে না? এ কি তার বিচক্ষণতা এবং পরিণামদর্শিতার প্রমাণ নয়?
ভ্রূকুটি করে পুলিশ-কর্মচারী প্রশ্ন করে, ‘শুনছেন আমার কথা?’
সচকিত হয়ে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয়, কিন্তু পুলিশ-কর্মচারী তাকে ভুল বোঝে। তার চোখে প্রথমে সন্দেহ, শেষে কেমন যেন অহেতুক প্রতিহিংসার ভাব দেখা দেয়। বিকৃতকণ্ঠে সে বলে, ‘হবে, তদারক হবে। আপনার ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন। যার ক্ষতি করতে চান, তার ক্ষতি করা সহজ হবে না।’
সে যে কারো ক্ষতি করতে চায় না, সে-কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করলেও শেষপর্যন্ত সে কিছুই বলতে পারে না। এক কথায় উক্তিটির উত্তর দেয়া যায় না। তাছাড়া, কী একটা কথা সে বুঝতে চেষ্টা করে বলে কোনো উত্তর তৈরি করাও তার পক্ষে হয় না।
নিজেকে কিছুটা সংযত করে পুলিশ-কর্মচারী আবার বলে, ‘হয় অপরাধ স্বীকার করেন, না হয় আজগুবি কথাটা ছাড়েন।’
সাব-ইন্সপেক্টরও এবার তার উপরিতন কর্মচারীকে সমর্থন করে বলে, ‘নিজের মন্দ না চাইলে আজগুবি কথাটা ছাড়াই ভালো হবে।’
তাদের কথা যুবক শিক্ষকের কানে আর পৌঁছায় না। তার মন অন্যত্র। তার মনের তৃপ্তির কারণ সে বুঝতে পেরেছে। বিচক্ষণতা-পরিণামদর্শিতার প্রমাণ পেলে তৃপ্ত হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সে-জন্যে সে তৃপ্ত নয়। তার তৃপ্তির কারণ এই যে, মনে-মনে যে-সব সম্ভাবনা সে দেখেছিল, তা সত্যে পরিণত হয়ে তার সিদ্ধান্তকে অর্থপূর্ণ করেছে। কথাটা অত্যন্ত বড় মনে হয় তার কাছে। তার মনে যে তুমুল দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল, সে-দ্বন্দ্বের ভিত্তি কাল্পনিক ভয় নয়। তাছাড়া, যে-সংগ্রাম পরের বিরুদ্ধে মনে হলেও আসলে নিজেরই বিরুদ্ধে ছিল, সে-সংগ্রামে সে জয়লাভ করেছে।
তার তৃপ্তির ভাবটি স্থায়ী হয় না। এক প্রকার প্রাকৃতিক আলোড়নে নদী যেমন হঠাৎ শুকিয়ে যায়, তেমনি তার মন থেকে সব ভাববোধ নিঃশেষ হয়ে যায়। সে তার উত্তর পেয়েছে। কিন্তু সে উত্তরটি চতুর্দিকে মরুভূমির সৃষ্টি করে যেন।
দূর থেকে পুলিশ-কর্মচারীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
‘বুঝতে পারছেন? হোক আপনার কথা সত্য, কিন্তু সাক্ষী কই? আপনি নিজের চোখে কিছু দেখেন নাই, কিন্তু অপর পক্ষ দেখেছে।’ সে যেন একটু দ্বিধা করে। তারপর বলে, ‘আপনাকে স্বচক্ষে দেখেছে।’
হয়তো কথাটি পুলিশ কর্মচারীর নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিন্তু সে কী করতে পারে? ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মূল্য কী?
ক্ষীণভাবে পুলিশ-কর্মচারীর কণ্ঠস্বর যুবক শিক্ষকের কানে পৌঁছালে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বক্তব্যটির পুনরাবৃত্তি করে। যেন সে কথাটি প্রথম বার বলছে। কিন্তু তার দ্বিতীয় বক্তব্য নাই। একই কথা বারবার বলছে সে-কথা বুঝলেও সে অপ্রস্তুত বোধ করে না।
‘সত্য কথা!’ ব্যঙ্গের সুরে পুলিশ কর্মচারী চিৎকার করে ওঠে। ব্যঙ্গটি যুবক শিক্ষককে স্পর্শ করে না। সে আপন-মনে একটি দৃশ্য দেখবার চেষ্টা করে। যে-দৃশ্যটি মন থেকে এ-ক’দিন ঠেকিয়ে রেখেছে, সে দৃশ্যটিই সে দেখবার চেষ্টা করে। অল্প চেষ্টাতে দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাঁশঝাড়ে যুবতী নারীর দৃশ্য। একটু পরে সে বোঝে, কিছুই সে স্পষ্টভাবে দেখতে পারছে না। কী করে দেখতে পারবে? দু-রাতের এক রাতেও সে-প্রাণহীন দেহটির দিকে ভালো করে তাকাবার সাহস তার হয় নাই। শুধু কয়েক মুহূর্তের জন্যেই সে তার দিকে তাকাতে সক্ষম হয়েছিল। তার দেহে যে প্রাণ নাই, সে-কথা বোঝার আগে। এখন যেটুকু সে দেখতে পায়, তা সে সংক্ষিপ্ত স্মৃতির জন্যেই। শাড়িটা অসংলগ্ন, পায়ের কাছে এক ঝলক চাঁদের আলো। একটি হাতই দেখা যায়। অন্য হাতটি কি দেহের তলে চাপা পড়েছে? মুখে ছায়া, শুধু ছায়া। আসলে মুখটা ঠিক মনে পড়ে না।
যুবক শিক্ষকের মনে ভয় বা ঘৃণা বা দুঃখ – কোনো ভাবই জাগে না। তবে কেন সে দৃশ্যটি স্মরণ করার চেষ্টা করছে? আজ যে স্থানে সে এসে পৌঁচেছে, তারই অর্থ কি সে-পরিত্যক্ত প্রাণহীন দেহটির মধ্যে সন্ধান করছে? কাদের তার জন্যে যে-ভাবাবেগ বোধ করে নাই, সে ভাবাবেগই কি সে নিজের মনে সৃষ্টি করতে চাইছে? সে জানে না কেন সে দৃশ্যটি স্মরণ করবার চেষ্টা করে।
হয়তো সে-দেহটি প্রাণ নেই বলে অর্থহীন নয়। বাঁশঝাড়ে যুবতী নারীর জীবন শেষ হলেও সে দৃশ্য স্মরণ করে যুবক শিক্ষকের মনে কোনো ভাবের আভাসও না দেখা গেলেও, সেখানেই যুবতী নারীর কথা শেষ হয় নাই। কারণ, তার জন্যে এখনো কি কারো শাস্তি পাওয়া বাকি নাই?
কিন্তু কে শাস্তি পাবে? পুলিশ-কর্মচারীর সামনে বসে যুবক শিক্ষকের হয়তো এই ধারণা হয় যে, কে শাস্তি পাবে সেটি আর প্রধান কথা নয়। শাস্তিটার অর্থ যখন মৃত যুবতী নারীর কাছে আর পৌঁছবে না, তখন কে শাস্তি পাবে তাতে তার আর কী এসে যাবে? শাস্তিটা তার জন্যে নয়। যুবক শিক্ষক যদি ভুল করে শাস্তিটা নিজের ওপরই টেনে আনে, যুবতী নারীর মৃত্যুর জন্যে সে-ই যদি অবশেষে শাস্তি পায়, তবে শাস্তিটা আসলে যার উদ্দেশ্যে সেখানে তা পৌঁছবে। সে-কথায় সে কি একবার সান্ত্বনা পেতে পারে না?
কিন্তু যুবক শিক্ষক জানে না। যে-দৃশ্যে কোনোই মনোভাব জাগে না, সে-দৃশ্যই সে অর্থহীনভাবে দেখবার চেষ্টা করে।
তার ব্যঙ্গ যুবক শিক্ষকের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না দেখে পুলিশ-কর্মচারী এবার তার দিকে তাকায়, তারপর তার ঝানু চোখে ঈষৎ কৌতূহলের ভাব দেখা দেয়। যুবক শিক্ষক তারই দিকে নিষ্পলকদৃষ্টিতে চেয়ে পূর্ববৎ স্থির হয়ে বসে আছে, চোখে-মুখে কোনো উদ্ধত ভাব নাই। বরঞ্চ সমীহ বিনয়ের ভাবই যেন তাতে। গায়ের জীর্ণ আলোয়ানটি ঘরের উজ্জ্বল আলোয় অতিশয় জীর্ণ মনে হয়। আর মনে হয় কোনো কথায় তার কান নাই। কোনো, কথার প্রয়োজন সে বোধ করে না।
পুলিশ-কর্মচারীর চোখ একবার ক্রোধে সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু যুবক শিক্ষকের দৃষ্টির সামনে সে–ক্রোধ হয়তো অর্থহীন মনে হয় বলে সে নিজেকে সংযত করে। তারপর তার সরকারি ভ্রূকুটিও প্রত্যাবর্তন করে। সোজা হয়ে বসে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে যুবক শিক্ষককে প্রশ্ন করে, ‘আপনার আর কিছু বলবার নাই?’
যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না।
‘শুনছেন?’ সাব-ইন্সপেক্টর বলে। কনস্টেবলের বুটের আওয়াজ হয়।
সচকিতভাবে সজ্ঞান হয়ে যুবক শিক্ষক আবার তার বক্তব্যটি বলে। শুনে পুলিশ–কর্মচারীর মুখে তীব্র বিরক্তির ভাব জাগে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্যে কেবল। তারপর সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে। বাজে কথার সময় শেষ হয়েছে।