ক্ষ্যাপা তিনজন – ৯

নয়

পাথরের দেয়ালে আগুনের আলো পড়ে কাঁপছে। হালকা বাতাস যেন গাছের পাতার সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে। আগুনের ওপাশে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে বাড হ্যাডলে। উত্তেজনার পর অবসাদে ওর লম্বা মুখটা আরও বসে গেছে। মনের জোর দিয়েই চেহারায় একটা শক্ত ভাব সে সারাদিন টিকিয়ে রেখেছিল ॥ কিন্তু এখন ঘুমে অচেতন চেহারায় সেই প্রত্যয় আর নেই। লোকটাকে এখন খুব অসহায় দেখাচ্ছে।

নিচু স্বরে সুজানার সাথে কথা বলল ড্যাশার। ‘ওকে দেখে মনে হচ্ছে এর ভিতর আর একবিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট নেই। বুঝতে পারছি না এই অবস্থায় ওকে নিয়ে আজ রাতেই এখান থেকে সরে পড়ার ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে কিনা।

‘পথ চলা কি বেশি কষ্টের হবে?’

‘আজকের চেয়ে বেশি কষ্টকর হবে। আজকের পথটা সুস্থ মানুষের জন্যেও বেশ কষ্টের ছিল।’

‘এখানে একটা দিন বিশ্রাম নিলে হয় না? আবার ঘোড়ার জিনে চাপার আগে ওর একটু বিশ্রাম দরকার।’

‘হয়তো সেটাই আমাদের করতে হতে পারে,’ স্বীকার করল রনি, কিন্তু সেটা আমি চাচ্ছি না। কয়েক ঘণ্টা বেশি বিশ্রামে ওর এমন কিছু উপকার হবে না। তাছাড়া দুশ্চিন্তায় বিশ্রামও ভাল হবে না। আমাদের আরও নিরাপদ কোন জায়গায় সরে যেতে হবে। রাতেই বেরিয়ে না পড়লে এখান থেকে আর বেরোনো যাবে না।’

‘শার্পির কি হবে? ও কতটা পিছনে আছে বলে তোমার ধারণা?’

‘বেশি পিছিয়ে নেই।’ কাঠের টুকরোগুলো আগুনের ভিতর এগিয়ে দিলা রনি। ‘আমাদের ট্রেইল ওকে কিছুটা বিভ্রান্ত করবে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের অভিজ্ঞ চোখে ধুলো দেয়া যাবে না। যাহোক, কালই যদি ওরা এসে পড়ে, সেটা আমাদের জন্যে ভালই হবে।’

‘কী বলছ, তুমি?’ শিউরে উঠল সুজানা। ‘একবার ওর হাত থেকে বেরিয়ে আসার পর, আবার ওর খপ্পরে পড়ার আগে আমি আত্মহত্যা করব!’

‘আমি ঠিকই বলছি। ওরা যদি কাল এই উপত্যকায় এসে পৌঁছে, তৰে অ্যাপাচিদের সাথে ওদের দেখা হবে-অর্থাৎ ওদের মধ্যে লড়াই বাধবে। এবং সেটাই ঘটাবার একটা প্ল্যান এসেছে আমার মাথায়।’

রাত গভীর হলে উঠে দাঁড়াল রনি। খুব সাবধানে আলো এড়িয়ে পাথর আর গাছের অন্ধকারের আড়ালে এগিয়ে লম্বা ঘাসের জমিতে এসে পড়ল সে। অ্যাপাচিরা আধমাইলের মধ্যেই কোথাও ক্যাম্প করেছে। হয়তো আরও কাছে। সন্ধ্যা হওয়ার আগে কতগুলো কাককে একটা জায়গায় জড়ো হতে দেখেছে। ওর নিশ্চিত ধারণা কাকগুলো ইণ্ডিয়ানদের ক্যাম্প দেখেই আকৃষ্ট হয়েছে।

নিজেদের আর ইণ্ডিয়ান ক্যাম্পের মাঝামাঝি একটা জায়গায় এসে রনি আর নিজের ট্র্যাক গোপন রাখার কোন চেষ্টাই করল না। উপত্যকায় প্রথম ঢোকার সময়েই প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি দেখে নিয়েছিল। ওর মনে আছে, ট্রেইলের মাথায় ক্লিফের গোড়ায় একটা ছোট্ট ঝর্নার পাশে চওড়া পাথরের শেলফ দেখেছে। ট্র্যাক রেখে সোজা ওদিকেই এগোল। ওখানে কতগুলো পাথরের পিছনে একেবারে আড়ালে ছোট একটা আগুন জ্বালাল। আগুন ভাল মত ধরে উঠলে ধীরে জ্বলার মত কিছু কাঠ চাপিয়ে সরে এল।

এবার পাথরের চওড়া শেলফে উঠে কোন রকম ছাপ না রেখে সাবধানে পা ফেলে ঝর্নায় নামল। বেশ কিছুদূর পানির ভিতর দিয়ে পা ঘষে ঘষে এগোল। তারপর জঙ্গলের ভিতর ঢুকে সাবধানে ফিরতি পথ ধরল। এতে প্রায় দু’ঘণ্টা সময় লাগল ওর। কিন্তু সে জানে, চালাকিটা কাজে আসবে। সোজা ক্যাম্পে না ফিরে, বাম দিকে পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে আসায় যে সরু ফাঁকের সৃষ্টি হয়েছে, সেদিকে এগোল। কাছে গিয়ে দেখল এলাকাটা ঘন জঙ্গলে ভরা। ওর ভিতর দিয়ে জায়গা করে নিয়ে উপর থেকে খসে পড়া পাথরের একটা স্তূপের গোড়ায় পৌছল।

উপরে উঠে দেখল ক্লিফের দেয়ালে একটা গুহার মত ফাটল রয়েছে। ওদিক থেকে বাতাস ওর মুখে এসে লাগছে। অন্ধকারে ওটার গভীরতা কত বোঝা যাচ্ছে না। সামনের দিকে ঢিল ছুঁড়ে বুঝল অন্তত তিরিশ ফুট। আলগা পাথরের চূড়ায় অল্প কিছুটা হেঁটে হঠাৎ পায়ের তলায় অন্য ধরনের জমি ঠেকল। চট করে উবু হয়ে বসে হাত দিয়ে অনুভব করল। অল্প কিছু আলগা পাথরের নিচে মসৃণ অখণ্ড পাথর-একটা ট্রেইল! নিচের দিকে ঢালু হয়ে পাহাড়ের ভিতর ঢুকেছে।

ওটা ইণ্ডিয়ানদের নাকি জীবজন্তুর ব্যবহারের জন্যে তৈরি, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা যে ওই গুহা বা ফাটলটার সাথে গিয়ে মিশেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওটা অনুসরণ করল না রনি, উঠে সোজা ক্যাম্পের দিকে রওনা হলো। বাতাসে একটা ভেজা ভেজা ভাব ছিল সম্ভবত খোলা মুখের গুহা।

ক্যাম্পের খুব কাছে পৌছে আগুনটা দেখতে পেল রনি। আগুন জ্বালাবার জায়গা বাছাই করা ভাল হয়েছে। নিচু স্বরে সুজানাকে ডাকতেই মেয়েটা পাথরের আড়াল থেকে রাইফেল হাতে বেরিয়ে এল। রনিকে দেখে ওর চেহারায় স্বস্তির ভাব ফুটল।

‘কি খবর? আমি তো ভয়ই পাচ্ছিলাম তুমি হারিয়ে গেছ বা বিপদে পড়েছ!’ বলল সুজানা। ‘কিছু পেলে?’

‘হয়তো।’ আগুনের আওতার বাইরে অন্ধকার জায়গায় আড়াল নিয়ে বসল ড্যাশার। ‘তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও, ঘণ্টাখানেক পরে তোমাকে আমি জাগাব।’

‘পাহারা দিতে?’

‘হ্যাঁ। রাতে অ্যাপাচিদের আক্রমণ আসবার ভয় নেই, কিন্তু শার্পির রাতে লড়তে বাধা নেই। এদিক দিয়ে অ্যাপাচিরাই বরং ভাল।’

প্রায় হাতের মুঠোয় চলে আসা জয় এভাবে ফস্কে যাওয়া কিছুতেই বরদাস্ত করবে না শার্লি, এটা রনি ভাল করেই জানে। ধূর্ত আর নিষ্ঠুর লোকটা হন্যে হয়েই ওদের খুঁজে বের করবে।

.

আগের দিন শার্পি বুমারের পাইয়ূট ইণ্ডিয়ান ট্র্যাকার চারবার ড্যাশারের ট্রেইল হারিয়ে, আবার খুঁজে পেয়েছে। রাতের বেলা ক্লিফের কিনারে ক্যাম্প করেছে ওরা। ওই ক্লিফ থেকেই বাকস্কিনটাকে নিচে নামিয়ে এনেছিল রনি। ট্রেইলটার দিকে চেয়ে তিক্তভাবে একটা গালি আওড়াল শার্পি।

‘শক্ত নার্ভ লোকটার,’ আক্ষেপের সাথে স্বীকার করল গানম্যান। ‘আগে থেকে না জেনে আমি এমন ট্রেইল ধরার ঝুঁকি নিতাম না।’

শার্পির সাথে আটজন আছে। প্রত্যেকে বাছাই করা কঠিন লোক। হাতে চোট, আর মাথা-ব্যথা নিয়েও ফিউরি পিছনে পড়ে থাকতে রাজি হয়নি। যাকে রনি বেঁধে রেখেছিল, সেই লম্বা লোকটাও এসেছে। ওর নাম টিচ।

‘তুমি ঠিক জানো ড্যাশার ওই পথেই নেমেছে?’ শার্পি এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।

‘একটা পাহাড়ী ছাগলও ওই পথে যেতে সাহস পাবে না!’ মন্তব্য করল টিচ।

মাথা ঝাঁকাল পাইয়ূট। ‘ড্যাশার সাহস করেছে। ওল্ড মিমব্রেনো ট্রেইল ধরেই নেমেছে ও।’

‘তাহলে এখনও বেশি দূরে যেতে পারেনি,’ সন্তুষ্টির সাথে বলল ফিউরি। ‘আমি কেবল একটা গুলি করার সুযোগ চাই।’

‘তুমি কি এখনই ওই পথে নামতে চাও নাকি, ফিউরি?’ হাত তুলে ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় পাহাড়ের গায়ে সরু রেখার মত ট্রেইলটা দেখাল শার্পি। ‘যেতে চাইলে আমি বাধা দেব না। ওকে মারার প্রথম সুযোগ তুমিই পাবে।’

সন্দিগ্ধ চোখে বসের দিকে তাকাল ফিউরি। ‘আমি অপেক্ষাই করব,’ দৃঢ় স্বরে বলল সে। ‘আমরা কালই ওকে ধরব।’

শার্সি নিশ্চিন্ত বোধ করছে। সামনের পাহাড়গুলোতে কোন সম্ভাব্য ফাঁক বা ট্রেইল ওর চোখে পড়েনি।

‘বেরোবার কোন পথ নেই,’ বলল সে। ‘ফাঁদে পড়েছে ও।’

ক্লিফের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল আলফনসো। ড্যাশারকে সে মোটেও ভয় পায় না। মবীটির নামডাকওয়ালা শেরিফকে সে গুলি করে হত্যা করে বেরিয়ে এসেছে-কেউ ওকে বাধা দিতে সাহস পায়নি। কিন্তু অ্যাপাচিদের সাথে সংঘর্ষে যেতে নারাজ। সে দেখেছে ধরতে পারলে ওরা মানুষের কি অবস্থা করে। এটা ওদের এলাকা—তাই কেমন যেন একটা অস্বস্তি ওকে অস্থির করে তুলছে।

কথা বলে চলেছে শার্সি। ‘নিজেরাই চেয়ে দেখো-নিচে নেমেছে ড্যাশার কিন্তু ওই গর্ত থেকে বেরোবার কোন পথ নেই।’ হাত তুলে পশ্চিমের পাহাড়গুলো দেখাল। পাঁচটা চূড়া দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটাই দশ-এগারো হাজার ফুট উঁচু। ‘শীত এসে যাচ্ছে; চূড়াগুলো এখনই বরফে ঢাকা। তুষার পড়তে শুরু করলে পশ্চিমে যাবার সব পাস বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘পাস আছে তাহলে?’ প্রশ্ন তুলল টিচ

‘নাহ্। এখানে নেই। অনেক উত্তরে আছে। এখানে ওরা বাক্স-বন্দি। ওকে কালই আমরা ধরব।’

‘হয়তো। কিন্তু এই ড্যাশার লোকটা উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু করবে বলে আমার মনে হয় না। ওর নিশ্চয়ই একটা নির্দিষ্ট প্ল্যান আছে। লোকটা বিশেষ কোথাও যাচ্ছে!’

‘ওখানেই আছে ও,’ টিচের কথার জবাব দিল শাৰ্পি।

তবু টিচের মন্তব্য ওকে ভাবিয়ে তুলল। সত্যিই তো, বেরোবার পথ না থাকলে ড্যাশার এমন বেয়াড়া এলাকায় কেন ঢুকবে? নিচের অন্ধকার বেসিনের দিকে চেয়ে ভাবছে গানম্যান। একে-একে তারা ফুটছে আকাশে। হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল শার্পির চোখ। অন্ধকারে নিচে বিন্দুর মত একটা আলো দেখা যাচ্ছে— একটা ক্যাম্পফায়ার। তাহলে ড্যাশার আর হ্যাডলেরা ওখানেই আছে। ভুরু কুঁচকাল সে। কিছুটা দক্ষিণে আরও একটা আভা দেখা যাচ্ছে। ওটাও কি ক্যাম্পফায়ার? কে থাকতে পারে ওখানে?

শার্সি জানে না, এখন সে যে আলোটা দেখতে পাচ্ছে সেটা অ্যাপাচিদের জ্বালা ছোট্ট আগুন। একমাত্র উপর ছাড়া আর কোনদিক থেকে ওটা দেখা যাবে না।

পরে, খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই যখন কম্বলের তলায় ঢুকেছে, শাি আবার ক্লিফের ধারে এসে দাঁড়াল। দক্ষিণের আলোটা নিভে গেছে, কেবল এই ক্লিফটা ঢালু হয়ে যেখানে বেসিনের সাথে মিশেছে, সেখানে আর একটা আগুন জ্বলছে! আর কে থাকতে পারে ওখানে? রাতের অভিযানে বেরিয়ে এটাই জ্বেলেছিল রনি।

হঠাৎ থমকাল সে। তারপর একটু হাসল। অবশ্যই! ট্রেইল-পটু ড্যাশারের মাথাতেই কেবল তাকে বিভ্রান্ত করার এমন একটা ফন্দি আসবে!

.

সকাল হয়েছে। লম্বা ঘাসে প্রায় সম্পূর্ণ ঢাকা কিছু ছোট-ছোট পাথরের পিছনে ঝোপের ভিতর শুয়ে আছে রনি। ওটা নিরাপত্তার জন্যে বিশেষ উপযোগী না হলেও বিস্তৃত এলাকার ওপর নজর রাখার জন্যে ভাল। তাছাড়া এতে বড় পাথরের উপর বা পাশ দিয়ে দেখার জন্যে ওকে মাথা বের করতে হবে না, কারণ ওইসব জায়গাতেই ওকে দেখার আশা করবে অ্যাপাচি যোদ্ধারা।

ওর পিছনে সুজানা শুকনো কাঠের আগুনে কফি আর অবশিষ্ট খাবার গরম করায় ব্যস্ত। বাড পিঠ সোজা করে বসেছে। হাঁটুর ওপর রাইফেলটা রাখা আছে। চোখ আর গাল বসে গেছে, কিন্তু উদ্দীপনা একটুও কমেনি। সুজানার হাত থেকে কফি নেয়ার সময়ে জঙ্গলের ভিতর একটু নড়াচড়া রনির নজরে পড়ল। ঘাসে সামান্য একটু দোলা, কিন্তু রনি জানে ইণ্ডিয়ানটা ওর দিকে রওনা হয়েছে। কাজ শুরু হয়ে গেছে, বা এখনই হবে।

আড়চোখে ক্লিফ থেকে নিচে নামার ট্রেইলটা একবার খুঁটিয়ে দেখল রনি। ওখানে কোন গতিবিধি নেই। প্রভাতী সূর্যের আলো চূড়া থেকে অনেক নিচে নেমেছে। কিন্তু রনির কাছে এখনও পৌঁছায়নি। সে জানে না শার্পি তার দলবল নিয়ে আগেই বেসিনে নেমে পড়েছে। সূর্যের আলো ক্লিফের মাথায় পড়ার সাথেসাথে রওনা হয়েছিল ওরা। ফিউরিকে আর ঠেকিয়ে রাখা যায়নি।

সুজানা তার রাইফেল তুলে নিয়ে পাথরের পিছনে পজিশন নিল। রনি পিছনে তাকিয়ে দেখল ওদের জিন চড়ানো ঘোড়াগুলো চোখের আড়ালে নিরাপদেই আছে। হঠাৎ ছুটে পালাবার দরকার হলে কোন অসুবিধা হবে না। রাইফেল কাঁধে ঠেকিয়ে তৈরি থাকল সে।

ড্যাশার নিজের জায়গায় পজিশন নেয়ার অনেক আগেই ওর গত রাতের রেখে আসা ট্র্যাক অ্যাপাচিদের নজরে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে দ্রুত আলাপ করে চারজন ওই ট্রেইল অনুসরণ করে এগোল। ওদের ধারণা তিনজনের কেউ পালাবার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আগুনটার কাছে পৌঁছে গেল।

ওখানে থমকে সতর্ক হয়ে উঠল। বুঝতে পারছে এর মধ্যে কোথাও একটা গোলমাল রয়েছে। এই পর্যন্ত এসে থাকলে লোকটা ট্রেইল ধরে উপরে না উঠে এখানে ক্যাম্প করবে কেন? ওরা এই ধাঁধার সমাধান ভেবে বের করার আগেই নয়জন রাইডার বেসিনের নিচে পৌঁছে গাছগুলো পেরিয়ে এগোবার জন্যে তৈরি হচ্ছে।

অ্যাপাচিরা সাবধানে সামনে এগোল। ওপাশ থেকে শার্সি বুমারও আগুনের ধোঁয়া দেখতে পেয়েছে। উপর থেকে এই আগুনটাই সে গতরাতে দেখতে পেয়েছিল। তৃতীয় আগুন। গাছ ঘুরে সামনে বাড়ল শার্পি-ওর দুপাশে ডেভিস দুই ভাই। বার্ট আর সার্ট। বেরিয়ে আসার আগের মুহূর্তে পাতার ফাঁক দিয়ে ওপাশে বাদামী একটা লোককে নড়তে দেখল শাৰ্পি। অ্যাপাচি!

মুহূর্তে কোল্টটা উঠে এল ওর হাতে। রাইফেল বাগিয়ে ধরল অ্যাপাচি। কিন্তু ঝিলিক দিয়ে গর্জে উঠল কোল্ট। গতির মধ্যেই মারা পড়ল ইণ্ডিয়ান। মুহূর্তে গোলাগুলির শব্দে ভরে উঠল বেসিন। বুক খামচে কাশতে কাশতে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল বার্ট ডেভিস। ওর মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে।

গোলাগুলির শব্দ শুনে ফাঁদে কাজ হয়েছে বুঝে, সবথেকে কাছের নড়াচড়ার ওপর দৃষ্টি স্থির করল রনি। শব্দের সাথে নড়াচড়া স্থির হলো। রাইফেল নিচু করে ধরে লোকটার অবস্থান আঁচ করে ট্রিগার টিপে দিল সে। মাথা তুলে রনির দ্বিতীয় গুলিতে মুখ থুবড়ে পড়ল। জবাবে ওদিক থেকে দুটো রাইফেল গর্জে উঠল। ক্যাম্প থেকে বাড আর সুজানা পালটা জবাব দিল। ওরা দুজন একই লোককে গুলি করেছে। ইণ্ডিয়ানটা যেখানে শুয়ে ছিল সেখানেই মরল।

গোলাগুলি চলছে; রনি পিছিয়ে ঘোড়াগুলোর কাছে পৌঁছে গেল। ‘জলদি এসো!’ নিচু স্বরে ডাকল সে। ‘ঘোড়ায় ওঠো! তুমি আগে, বাড!’

দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে গাছের ভিতর দিয়ে পথ দেখিয়ে ওদের গুহার ট্রেইলের দিকে নিয়ে গেল রনি। ওই পথে এখান থেকে বের হওয়া যাবে কিনা জানে না সে। কিন্তু অপেক্ষা করার উপায় নেই। ওদিকে এখনও লড়াই চলছে, তবে গোলাগুলির হার কমে এসেছে। যে দলই জিতুক, তাতে ওদের কোন সুবিধা নেই। পাথরের স্তূপ বেয়ে উপরে উঠে বাকস্কিন ওপাশের ঢালু জায়গায় নেমে বিনা দ্বিধায় সরু ফাটলের ভিতর ঢুকল। ঘোড়ার গতি কমাল রনি। সে জানে একটাকে ঢুকতে দেখলে পরের ঘোড়াগুলোও অনুসরণ করবে।

যে ফাটলে ওরা ঢুকেছে, সেটা চওড়ায় আট ফুটের বেশি নয়। দুপাশের দেয়াল কাঁচের মত মসৃণ। এক সময়ে এই পথ দিয়ে তোড়ের সাথে পানি বয়েছে। মেঝেতে শক্ত ভেজা বালু। রনির নজর সামনের দিকে, কিন্তু খুরের শব্দে বুঝতে পারছে সঙ্গীরা তার পিছনেই আছে। একশো গজ যাওয়ার পর দেয়ালগুলো ঘেঁষে এসে পথটাকে সঙ্কীর্ণ করে তুলল। এখন দুপাশের দেয়ালেই ঘষা খাচ্ছে বুট। তারপর ওটা আবার চওড়া হলো। গুহার অন্য প্রান্ত দিয়ে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল রনি। সাফল্যের আনন্দে হাসি ফুটল ওর মুখে। এতক্ষণে পিছন ফিরে চেয়ে হালকা রসিকতায় সে বলল, ‘সার্কেল এইচ কাউহ্যাণ্ডের কি খবর, হ্যাডলে?’ ঠাট্টা করলেও ওর চোখ দুটো সতর্ক দৃষ্টিতে হ্যাডলের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করায় ব্যস্ত। প্রত্যেক মানুষেরই সহ্যশক্তির একটা সীমা আছে। হ্যাডলে কঠিন লোক, কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টের পরে দুর্বল শরীরে সে আর কত ধকল সহ্য করতে পারবে? স্যাডলে টিকে থাকাই হয়তো ওর জন্যে এখন কঠিন হয়ে উঠেছে।

‘আমি ঠিকই আছি,’ রনির চোখের দিকে কটমট করে চেয়ে থেকে জবাব দিল সে। ‘তোমার কি খবর? সুজানা আর আমাকে নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না, সার্কেল এইচের রাইডাররা চিরকালই বার ২০ রাইডারের চেয়ে শক্ত!’

শব্দ করে হাসল রনি। তারপর হালকা সুরেই বলল, ‘দেমাগ দেখো বুড়োর! তোমাদের বেস্ট রাইডার বার ২০-র গাধার ওয়্যাগন চালাবারও যোগ্য না!’

হার মানার পাত্র নয় হ্যাডলে। সে জবাব দিল, ‘তোমাদের বেস্ট রাইডাররা যা শিখেছে, তা আমরাই শিখিয়েছি!’

গোলাগুলির শব্দ থেমে গেছে। চালমাত অবস্থা, নাকি লড়াই শেষ, তা এখনই বোঝার উপায় নেই।

ওদের ফালতু বড়াই থামিয়ে দিয়ে সুজানা বলে উঠল, ‘আপাতত হয়তো আমরা নিরাপদ, কিন্তু কেউ কি আমাকে বলবে, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

ড্যাশার চারপাশের খাড়া দেয়ালে ঘেরা এলাকাটা খুঁটিয়ে দেখছে। এখান থেকে বেরোবার কোন পথ ওর চোখে পড়ল না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ওরা আবার আটকা পড়েছে-এবং আরও কঠিন ভাবে। আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি খারাপ দেখালেও রনির ধারণা এখান থেকে বেরোবার একটা পথ থাকতেই হবে—কারণ যে ট্রেইল ধরে ওরা এখানে পৌঁছেচে সেটা প্রাচীন হলেও বহুল ব্যবহৃত। এখানে কারও বেশিদিন থাকার কোন চিহ্ন নেই। এই এলাকায় থাকার মত কোন আকর্ষণও নেই। সুতরাং আর সবাই অন্য কোন পথে বেরিয়ে গেছে।

‘তোমাদের ঘোড়াগুলোকে একটু বিশ্রাম দাও,’ শান্ত স্বরে বলল রনি। ‘কিন্তু ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমো না।’

ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে এলাকাটা ঘুরে দেখার জন্যে এগোল সে। ম্যানজানিটার ঘন, বড় ঝাড়ের পাশে উঁচু অ্যাসপেন গাছটার কাছে পৌছার আগে কোন চিহ্নই ওর নজরে পড়েনি। গাছের বাকলে পাঁচ থেকে আট ফুট পর্যন্ত অনেক আঁচড়ের দাগ রয়েছে। নিচের অংশে কাদা আর লোম লেপটে আছে। গাছটার কাছে রনিকে থামতে দেখে কৌতূহলী হয়ে সুজানা ওর দিকে এগিয়ে এল।

‘কি দেখছ, রনি?’ মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল সে।

‘বেয়ার ট্রী। কোন ভালুক নিজের চিহ্ন না রেখে এটা পার হবে না। বংশপরম্পরায় প্রত্যেক গ্রিজলি ওই একই গাছের কাছে গিয়ে যত উঁচুতে সম্ভব নিজের নখের চিহ্ন রাখে। এতে ওদের কি লাভ হয় জানি না, হয়তো বছর-বছর কত বড় হচ্ছে তার প্রমাণ নিজের চোখে দেখে সান্ত্বনা পায়। আর নিচের দিকে গা ঘষে পিঠ চুলকে নেয়াটা সম্ভবত একটা বাড়তি বিলাস।’

‘এগুলো গ্রিজলি কিভাবে বুঝলে?’

‘আকার আর লোম দেখে। আঁচড়ের দাগ কত উঁচুতে দেখেছ? ব্ল্যাক বেয়ার এত বড় হয় না। তাছাড়া গাছের সাথে পিঠ ঘষে কিছু লোমও রেখে গেছে। এরা রঙে grizzle, অর্থাৎ ধূসর বলেই এদের নাম গ্রিজলি বেয়ার বা শুধু গ্রিজলি।’

ঘুরে, ম্যানজানিটার ঘন ঝোপ-ঝাড়ের ভিতর অন্ধকার একটা ফাঁক দেখিয়ে রনি আবার বলল, ‘ওটাই আমাদের ট্রেইল। চলো, এগোই।’

ওয়্যাগনের চাকার অত্যন্ত ক্ষীণ একটা ট্র্যাক ওই দিকেই গেছে দেখতে পেয়েছে ড্যাশার। স্যাডলের ওপর বসে ঝুঁকে মাথা নিচু করে এগোচ্ছে ওরা। কিছুদূর এগিয়ে যে ট্রেইল ধরে ভিতরে ঢুকেছে, সেটারই এদিককার প্রসার ওদের নজরে পড়ল। কিন্তু এটা দিক পরিবর্তন করে ঘুরে দক্ষিণ-পশ্চিমে গেছে। পাহাড়ের একটা বাঁক ঘুরে এখন ওরা উত্তর-পশ্চিমে চলেছে। খাঁজটা ক্রমেই চওড়া হয়ে একটা ক্যানিয়নে পরিণত হলো। দুপাশের দেয়াল খাড়া হয়ে উপরে উঠেছে। একপাশে ক্লিফ থেকে খসে পড়া পাথরের বিরাট একটা স্তূপ।

ক্যানিয়নের তলায় আগাছার ঝোপ, আর ঘন ঘাস জন্মেছে। চাকার দাগ ধরে দ্রুত এগোচ্ছে ওরা। বহুকাল ব্যবহৃত পুরানো ট্রেইলটা উপড়ে-পড়া গাছ, বা বড় পাথর এড়াতে মাঝেমাঝে দিক পরিবর্তন করলেও একটা নির্দিষ্ট দিকেই এগিয়েছে। হঠাৎ ক্যানিয়ন শেষ হয়ে একটা খোলা জায়গায় পৌঁছল ওরা। আড়াআড়ি একটা ক্রীক বয়ে গেছে। সামনে আধমাইল দূরে ট্র্যাকটা আবার শুরু হয়েছে।

পাশাপাশি ঘোড়া চালিয়ে ক্রীক পার হলো ওরা। বাড় কথা বলছে না। শুকনো আর বিষণ্ণ চেহারায় ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। রনিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকাতে দেখে সে কষ্টের সাথে একটু হাসল।

‘ভয় নেই, আমি জিনের ওপর টিকে থাকতে পারব। জানি, ওখানে লড়াইয়ে যে দল জিতবে, তারাই আমাদের পিছু নেবে।’

‘আমি যেমন শুনেছি, তাতে বুঝতে পারছি এটাই টার্কিফেদার,’ বলল রনি। ‘এর উত্তরে হচ্ছে আয়রন ক্রীক। ওটা ধরে কিছুদূর চললে, কয়েকটা ক্যানিয়ন পার হয়ে আমরা স্নো ক্রীক ট্রেইলে পড়ব।’

চারপাশ এক নজর দেখে নিয়ে ভুরু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকাল হ্যাডলে। ‘আমাদের তাড়াহুড়া করার আরও কারণ আছে,’ মৃদু স্বরে বলল সে, ‘তুষার পড়ার সম্ভাবনা আছে।’

অশুভ আশঙ্কায় রনির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আজ সারাটা দিন তার ঠিক ওই কথাই মনে হয়েছে, মনকে প্রবোধ দিয়েছে এটা তার ভুল ধারণা। সাধারণত এত আগে তুষার পড়ে না। কিন্তু এখানে ওরা রয়েছে অনেক উঁচুতে, এবং মগোলন্‌স্ পার হতে তাদের আরও উঁচুতে উঠতে হবে।

লীড নিয়ে উঁচু নিচু জমির ওপর দিয়ে এখন দ্রুত এগোচ্ছে রনি। ছড়ানো গাছের এলাকা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকল ওরা। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আয়রন ক্রীকের ধারে পৌঁছল। ক্রীক ধরে বেশ কিছুদূর গিয়ে আবছা একটা ট্রেইল দেখা গেল। ‘এটাই এগিয়ে স্নো ক্রীক ট্রেইলে মিশেছে,’ জানাল ড্যাশার। ‘এখন থেকে আরও দ্রুত চলা সম্ভব হবে।’

পিছনের ট্রেইলের ওপর নজর রাখছে রনি। সে জানে ওরা অনুসরণ করবেই। কখন দেখা হবে, সেটাই কেবল অনিশ্চিত। ট্রেইলটা এখন ক্রমাগত উপরে উঠছে। যে উজ্জ্বল সূর্যের মুখ ওরা আজ ভোরে দেখেছিল সেটা গুহা পার হওয়ার সময়েই ধূসর আকাশে অদৃশ্য হয়েছে। এখন পুরো আকাশটাকেই ছেয়ে ফেলেছে একটা স্থির ধূসরতা। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ওর গাল ছুঁয়ে গেল। দুশ্চিন্তায় কপাল কুঁচকাল সে।

যদি সত্যিই ঝড় হয়, তবে ওদের জন্যে এরচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আর হতে পারে না। ওদের পাহাড় পার হতে হবে, এবং তার পরেও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে-প্রায় পুরো একটা দিনের ব্যাপার। সরল রেখায় আলমার দূরত্ব বারো মাইলের বেশি হবে না, কিন্তু পাহাড়ী পথে ঘুরে-ঘুরে এর পাঁচগুণ পথ ওদের চলতে হবে। আয়রন ক্রীক মেসায় একটা ঝর্নার ধারে অল্পক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চলল ওরা।

হঠাৎ হাতের ওপর ঠাণ্ডা একটা পরশ পেয়ে চমকে তাকাল রনি। হালকা এক থোকা নরম তুষার!

আশঙ্কায় রনির দেহ যেন মুহূর্তের জন্যে আড়ষ্ট হলো। আকাশের দিকে তাকাল সে। এখনও অনেক পথ বাকি। তুষার ঝড়ের মধ্যে ভারী কোট ছাড়াই ওদের পাহাড় পেরোতে হবে। পথে কোথাও আশ্রয় বা খাবার পাওয়া যাবে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *