ক্ষ্যাপা তিনজন – ২

দুই

পরদিন সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়ল রনি। বিদায় দেয়ার সময়ে বারবার ওকে সাবধান থাকতে অনুরোধ করেছে বাক। আরও বলেছে ডাগ মারফি আর ডেড-শট ওয়াইল্স্ ফিরলেই সে ওদের পাঠিয়ে দেবে। রনি অবশ্য বলেছে সে একাই সব সামলাতে পারবে। কিন্তু জানে, বুড়ো তবু ওদের পাঠাবে।

তৃতীয় দিন সকালে স্যান ইসিড্রোর তীরে পৌছার আগেই রনি ট্রেইল ছেড়ে সরে গেল। পাথরের গোলকধাঁধার ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে ঝর্নার ধারে পৌছল। এমন করার নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই-নিছক খেয়াল-বশেই এই বাড়তি সাবধানতা। একটা বিপজ্জনক কাজ হাতে নিয়েছে ও। ট্রেইলে নিজের পার হওয়ার চিহ্ন রাখতে চাইছে না।

ডান দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে হর্সশু মেসা। দক্ষিণে কিছুটা দূরে জনসন মেসা প্রাচীরের মত দেখাচ্ছে। গিরিপথ পেরিয়ে ওপাশে রয়েছে বিশাল সমতল জমি। ওর ওপর দিয়েই বইছে উত্তাল কেনেডিয়ান রিভার।

ঘোড়াটাকে পানি খেতে দিয়ে নিচে নামল রনি। পাথরের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়া পানি বোতলে ভরে নিল। এই ঝর্নাটা নিঃসন্দেহে অ্যাপাচিদের কাছে পরিচিত। কিন্তু আশপাশে কারও উপস্থিতির চিহ্ন দেখতে পেল না। চিন্তিত ভাবে ভুরু কুঁচকাল রনি। আজ সারা সকাল কেমন যেন একটা অনিশ্চয়তা আর অশুভ আশঙ্কা ওর মন ছেয়ে রেখেছে।

কোন কারণ নেই, তবু অস্বস্তি বোধ করছে রনি। খুব সতর্ক নজর রাখছে সামনের নির্জন এলাকার ওপর।

সামনের ট্রেইলেই কোথাও আছে ভাসকো। কিন্তু ওই আউটলকে ভয় পাচ্ছে না রনি, অ্যাপাচিদের নিয়েই ওর দুশ্চিন্তা। রেজারভেশনেই ওদের থাকার কথা, কিন্তু ইদানীং ইণ্ডিয়ান এজেন্টদের অন্যায়-অবিচারে ওরা অতিষ্ঠ হয়ে আবার রেইড করতে শুরু করেছে। দশ-বারোটা রেইডের খবর টুইন রিভার্সেও পৌঁছেচে।

যে এলাকা দিয়ে রনি এগোচ্ছে, সেটাই ছিল অ্যাপাচিদের শক্ত ঘাঁটি। জাত- যোদ্ধা ওরা। রেইড চালিয়ে লোকজন খুন করে দমকা হাওয়ার মত মরুভূমিতে অদৃশ্য হওয়ায় ওদের জুড়ি নেই।

মাঝ-দুপুর নাগাদ রনি ক্লিফটন হাউস স্টেজ স্টেশনে পৌছে যাবে। ওখানে গেলেই এদিকে বর্তমানে ইণ্ডিয়ানদের আক্রমণ চলছে কিনা জানা যাবে। হয়তো বাড হ্যাডলে বা সার্কেল এইচ সম্পর্কেও কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

এলাকাটা আবার খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে আবার ঘোড়ার পিঠে উঠল রনি। ঝর্নাটা পেরিয়ে গিরিপথ ধরল।

স্তব্ধ পরিবেশ। রনির কঠিন নীল চোখদুটো অনবরত চারপাশ দেখে আবার ট্রেইলের ওপর ফিরে আসছে। এখানে নাল-বিহীন ঘোড়ার খুরের কিছু ছাপও দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমে অনেকদিন হলো আছে ও-অ্যাপাচিদের হালকা ভাবে নেয়ার পাত্র সে নয়।

দুপাশ থেকে ক্যানিয়নের দেয়াল সরে গেল। উন্মুক্ত এলাকায় এসে পড়েছে রনি। সামনে চিকোরিকা ক্রীক দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। কেনেডিয়ানের ওপাশে গ্রামা ঘাসে ছাওয়া খোলা জমি দূরে ব্লু মাউন্টিনস পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্লিফটন হাউস এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। চোখের আড়ালে আছে।

একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে চমকে লাগাম টেনে থেমে দাঁড়াল রনি। শব্দটা আবার শোনা গেল। ওয়্যাগন চালকের পরিষ্কার তীক্ষ্ণ স্বর। পরক্ষণেই গুলির মত আওয়াজ তুলে বাতাসে চাবুক ফোটার শব্দ এল।

‘গাধা,’ বিড়বিড় করল রনি ড্যাশার। এই এলাকায় অমন চিৎকার করা নেহাত বোকামি।

গেল্ডিঙটাকে আবার আগে বাড়াল রনি। দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছে গাড়ি-চালক ক্রীকের তলায় নেমেছে। এগিয়ে গিয়ে ওয়্যাগনটা দেখতে পেল। ছয়টা বলিষ্ঠ খচ্চর ওয়্যাগন টানছে। একটা লোক আর মহিলা পাশাপাশি বসে আছে। ওদের সাথে বাকস্কিন ঘোড়ার পিঠে রয়েছে চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সের একটা ছেলে।

পাথর আর ঝোপের আংশিক আড়াল নিয়ে এগিয়ে গেল ড্যাশার। ঢালু ঢাল বেয়ে ওয়্যাগনটাকে কোনাকুনি ভাবে উপরে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করছে চালক। ছেলেটা ‘আগে-আগে চলছে-পিছন ফিরে চিৎকার করে সে ওয়্যাগনের আরোহীদের কি যেন বলল। গাড়িটা উপরে উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস কাঁপিয়ে একটা গুলির শব্দ উঠল।

ওপাশের পাথরের ভিতর থেকে একটু ধোঁয়া উঠতে দেখল রনি। মুহূর্তে আড়াল থেকে সাত-আটজন অ্যাপাচি বেরিয়ে ওয়্যাগন লক্ষ্য করে ছুটে এল। ঘোড়া সহ ছেলেটা পড়ে গেছে। খাপ থেকে রাইফেলটা বের করার ফাঁকে দেখতে পেল চালকও তার পুরোনো শার্পস রাইফেলটা তুলে নিয়েছে।

রাইফেল কাঁধে ছুঁইয়েই ট্রিগার টিপে দিল ড্যাশার। উইনচেস্টারটা ওর হাতে লাফিয়ে উঠল। প্রথম অ্যাপাচিটা ঘোড়া থেকে পড়ে কিছুটা ধুলো উড়িয়ে স্থির হয়ে গেল।

ওয়্যাগন চালকও নিশ্চয় একই মুহূর্তে গুলি ছুঁড়েছিল। একটা ঘোড়া পড়তে দেখা গেল। দুদিক থেকে আক্রমণ আসতে দেখে অ্যাপাচিরা একটু হকচকিয়ে গেছে। একটু সামনে বেড়ে আবার গুলি ছুঁড়ল ড্যাশার-দ্বিতীয় ইন্ডিয়ান ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ল।

দ্রুত আরও দুটো গুলি ছুঁড়ে রাইফেল খাপে গুঁজে ঊর্ধ্বশ্বাসে ইন্ডিয়ানদের লক্ষ্য করে ঘোড়া ছোটাল রনি। অ্যাপাচিরা পাথরের পিছনে আড়াল নিতে ছুটছে। পাথরের কাছে পৌছার আগেই প্রথম জনের পথ আটকে দাঁড়াল ড্যাশার। মারিয়া হয়ে অ্যাপাচি লোকটা সোজা ওর দিকেই এগিয়ে ছুরি হাতে ঝাঁপ দিল।

ডান দিকের পিস্তলটা বেরিয়ে এসেছিল ড্যাশারের হাতে-ভারী নলটা সজোরে ছুরি ধরা হাতের ওপর নামিয়ে আনল সে। ইণ্ডিয়ানের কব্জির হাড় ভেঙে গেছে। ব্যথায় চিৎকার করে নিচে পড়ল লোকটা। ঘোড়ার খুরের তলায় পিষে এর চিত্কার গোঙানিতে পরিণত হলো।

ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ওয়্যাগনের কাছে ফিরে এল রনি। চালক ঘোড়ার তলা থেকে ছেলেটাকে বেরোতে সাহায্য করছে।

‘তুমি ঠিক সময় মত এসে পড়েছিলে, মিস্টার!’ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল ছেলেটা। ‘নইলে আমার বাঁচার কোন উপায় ছিল না!’

ওয়্যাগন-ড্রাইভারের চেহারাটা বিষণ্ন। একেবারে সাদা হয়ে গেছে এর মুখ- ভয়ে এখনও কাপছে লোকটা।

‘ধন্যবাদ, মিস্টার,’ বলে সরু হাত বাড়িয়ে দিল ড্রাইভার। ‘সত্যিই সাহায্য করেছ!’

লোকটার চোখ দুটো এখন ওকে যাচাই করে দেখছে। কৌতূহল প্রকাশ পাচ্ছে ওর চোখে।

‘গোলাগুলিতে তোমার দারুণ হাত,’ মন্তব্য করল লোকটা। ‘তুমি কি এদিককার লোক?’

‘ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছি,’ বলল রনি। ভাবছি পশ্চিমে মগোলসের দিকটা একটু দেখব।’

লোকটার চেহারা একটু আড়ষ্ট হলো। সতর্ক ভাবে সে বলল, ‘ওই এলাকা থেকে দূরে থাকাই ভাল বন্ধু হিসেবেই বলছি। এসব এলাকা আমি চিনি। বছর দুই হলো ম্যাকক্লিল্যানের কাছে র‍্যাঞ্চ করছি। এইমাত্র কলোরাডো থেকে বউ আর ছেলেকে নিয়ে ফিরছি। মগোলন্‌স্ এড়িয়ে চলাই তোমার জন্যে ভাল। অবশ্য যদি—’

কথার মাঝখানেই হঠাৎ থেমে গেল লোকটা। নার্ভাস ভাবে জিভ দিয়ে চেটে ঠোঁট ভেজাল।

‘যদি কি?’ লোকটার ওয়্যাগনের পাশে-পাশে ঘোড়া হাঁটিয়ে এগোচ্ছে রনি।

‘কিছু না।’ লোকটা ওর চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। ‘তোমাকে আবারও ধন্যবাদ। তোমার জন্যেই আমরা এ যাত্রা বেঁচে গেছি। কথাটা আমি ভুলব না।’ মুখ তুলে তাকাল সে। ‘আমার নাম মরগ্যান। ম্যাকক্লিল্যানের ছয় মাইল উত্তরে আমার র‍্যাঞ্চ। যখন খুশি এসো।’

মগোলন্‌স্ সম্পর্কে লোকটার রহস্যময় মন্তব্যে কৌতূহল বোধ করছে রনি। ‘আমি ক্লিফটনের দিকে যাচ্ছি। হয়তো ওখানেই আজকের রাতটা কাটাব। চলো একসাথেই এগোই।’

‘ওখানকার খাবারটা ভাল,’ মন্তব্য করল মরগ্যান।

এই এলাকায় তথ্য জোগাড় করার সবথেকে খারাপ উপায় হচ্ছে প্রশ্ন করা। এটা ভাল করেই জানে রনি। সে নিজেও চাপা প্রকৃতির, কিন্তু পশ্চিমের লোকের তুলনায় কম। কিছু-কিছু এলাকায় প্রশ্ন করা বা মুখ খোলা দুটোই খারাপ। তবু কিছু তথ্য পাওয়ার আশায় মামুলি কথাবার্তা চালিয়ে গেল রনি।

শেষে ছেলেটাই ওর সাথে কথা শুরু করল। ‘তোমার ঘোড়াটা চমৎকার! কিন্তু ওটাকে মাসট্যাঙ বলে আমার মনে হচ্ছে না।

‘ঠিকই ধরেছ,’ ব্যাখ্যা করল রনি। ‘এখান থেকে উত্তরে একটা ঘোড়ার র‍্যাঞ্চ আছে। লোকটা আমার বন্ধু। ওর একটা উপকার করায় সে আমাকে এই ঘোড়াটা উপহার দিয়েছে। টপারের মা অ্যারাবিয়ান মেয়ার আর বাপ হচ্ছে বিশাল আইরিশ স্ট্যালিয়ান। এর হাঁটাই অনেক ঘোড়ার দৌড়ানোর মত দ্রুত।’

‘এই রকম একটা ঘোড়াই আমার পছন্দ!’ গদগদ স্বরে বলল ছেলেটা। ‘ওকে আমি বাতাসের আগে ঢাল বেয়ে ছুটে নামতে দেখেছি!’ রনির দিকে মুখ তুলে চাইল সে। ‘আমার নাম জেরোমি। তোমার কি নাম?’

রনি দেখল এই প্রশ্নে ড্রাইভারের মাথাটা সামান্য এদিকে ফিরেছে। ওর কৌতূহল স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু সেও জানে পশ্চিমে প্রশ্ন করা হারাম।

‘আমার নাম রেগান,’ সহজ সুরেই জবাব দিল ড্যাশার। ‘কিন্তু বেশিরভাগ লোক আমাকে রেড রিভার বলে ডাকে।’

ক্লিফটন হাউসে পৌছানো পর্যন্ত ওরা নিচু স্বরে আলাপ চালাল। স্টেজ স্টেশনে চারটে জিন চাপানো ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে ওটা বেশ জনপ্রিয়। একটা ওয়্যাগনও একপাশে দাঁড় করানো রয়েছে। আশপাশে কয়েকজন ইতস্তত দাঁড়িয়ে সময় কাটাচ্ছে। ওদের চোখ প্রথমে মরগ্যানের ওপর থেকে ঘুরে রনিকে দেখে আবার মরগ্যানের দিকে ফিরল।

ছেঁড়া জামা আর মাথায় নোঙরা সমব্রেরো পরা একটা হ্যাঙলা লোক মরগ্যানের দিকে এগিয়ে ওর সাথে কথা বলল। লোকটার দাঁতগুলো বড়-বড়, ঊরুর সাথে বাঁধা রয়েছে ওর পিস্তল।

মেক্সিকান আস্তাবল-রক্ষী রনির দিকে এগিয়ে এল।

‘কর্ন আছে তোমাদের?’ প্রশ্ন করল রনি। ‘থাকলে ওকে কিছু খেতে দাও। কাল সকালেই আমি আবার রওনা হব।’

‘সি, সেনিয়র। লোকটা রনির ঊরুর সাথে বাঁধা পিস্তল দুটো আর রাইফেলটা খেয়াল করল। রাইফেলটা খাপ থেকে বের করে নিয়েছে রনি।

মরগ্যান আর বড় দাঁতওয়ালা লোকটা ওকে লক্ষ করছে। ওদের উপেক্ষা করে লম্বা কামরাটায় ঢুকল ড্যাশার। বারে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। কয়েকজন একটা টেবিলে বসে ড্র পোকার খেলছে।

‘পথে কোন ইণ্ডিয়ান দেখেছ?’ প্রশ্ন করল একজন বিশাল লোক। শেভ না করায় বক্তার চেহারা কালচে দেখাচ্ছে।

‘হ্যাঁ।’ দরজার দিকে মাথা ঝাঁকাল রনি। ‘মরগ্যান আর আমার সাথে ওদের ছোট একটা মোকাবিলা হয়ে গেছে। ওরা সাত-আটজন ছিল।’

‘পড়েছে কেউ?’

‘চার বা পাঁচজনও হতে পারে।’

সঙ্গীর সাথে মরগ্যান ভিতরে ঢুকেছে।

‘চমৎকার শূটিঙ, মরগ্যান,’ বলল বিশাল লোকটা। ‘আমি জানতাম না তোমার হাত এত ভাল।’

‘আমি না। রেগান একাই চারজনকে মেরেছে। আমার এক গুলির শার্প নিয়ে আজ ওদের হাতে নির্ঘাত মারা পড়তাম। আমি একটাকে ফেলেছি। লোড করে ওঠার আগেই ওরা আমাদের ধরে ফেলত। ছেলেটা নিজের ঘোড়ার নিচে আটকা পড়েছিল।’

‘ঠিক সময়েই পৌছেছিলে তুমি,’ বিশাল লোকটা বলল। ‘তোমার নাম রেগান? আমি সায়মন ড্রিল। পশ্চিমে আমার র‍্যাঞ্চ।’

‘যা শুনছি তাতে মনে হচ্ছে র‍্যাঞ্চ করার জন্যে কঠিন এলাকা বেছে নিয়েছ তুমি,’ বলল ড্যাশার।

‘এদিকে থাকার কথা ভাবছ?’ প্রশ্ন করল সায়মন। ‘কাজ করতে চাইলে ডি বারে এসো। আমার ভাল লোক দরকার।’

‘হয়তো পরে।’ হাসল রনি। ‘এখনও ফতুর হইনি আমি।’ সবাই হেসে উঠল।

‘তোমার ঘোড়াটা সামলে রেখো,’ পরামর্শ দিল সায়মন। ‘এই দেশে ভাল ঘোড়া অদৃশ্য হতে সময় লাগে না।’

হঠাৎ কামরাটা স্তব্ধ হয়ে গেল। মরগ্যানের দেঁতো সঙ্গী ধীরে সোজা হয়ে র‍্যাঞ্চারের দিকে ফিরল। সায়মন সেটা খেয়াল করে থাকলেও ওর আচরণে টের পাওয়া গেল না। কামরার নীরবতা উপলব্ধি করে রনি বলল, ‘আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে ওরা ঘোড়া চোরের জন্যে দড়ির ফাঁস ব্যবহার করে।’

‘এখানেও আমরা কেউ-কেউ সেটাই করার ইচ্ছা রাখি।’ সায়মন কথা বলছে কিন্তু একা রনিকে বলছে না- কামরার সবাইকেই শোনাচ্ছে। এবং না শোনার ভান করলেও প্রত্যেকটা লোক মনোযোগ দিয়েই ওর কথা শুনছে।

‘এখানকারই কেউ?’ নাড়ি টিপে বোঝার চেষ্টা করল রনি। ‘নাকি মেক্সিকোতে পাচার করা হচ্ছে?’

‘দুটোই,’ জবাব দিল সায়মন। বুড়ো আঙুল দুটো বেল্টের ফাঁকে গুঁজল সে। রনি খেয়াল করল লোকটার কোমরে একটাই অস্ত্র ঝুলছে—তাও বেশি উঁচুতে। ‘বেশির ভাগ এখানেই থাকছে। আমার ধারণা টেক্সাসের রেঞ্জ ডিটেকটিভরা খুঁজলো পাহাড়ী মাঠগুলোতে অনেক হারানো গরু-ঘোড়া দেখতে পাবে। র‍্যাঞ্চারদের সবার এক হয়ে রাসলারদের চুরি বন্ধ করার সময় এসে গেছে। হাণ্ট’-তাস খেলোয়াড়দের একজন মুখ তুলে তাকাল-’তুমি এতে আমার সাথে আছ?’

সায়মানের দিকে চেয়ে ঢোক গিলল হান্ট। ‘আমার কোন স্টক খোয়া যায়নি- অর্থাৎ তেমন কিছু না।’

সায়মন ড্রিলের চেহারা কঠিন হলো। ‘তাহলে ব্যাপারটা এই রকম? ভাল, কিন্তু এমন অনেকে আছে যারা ওই লাইনে ভাবে না। শূটিঙ শুরু হলে কেবল দুটো পক্ষ থাকবে। হয় আমাদের পক্ষে, নইলে বিপক্ষে!’

কালো সরু গোঁফওয়ালা একজন পাতলা গড়নের লোক শান্ত স্বরে বলল, ‘এই ধরনের কথা একটু নিচু স্বরে বলা ভাল, সায়মন। কথাটা যদি শার্পির কানে যায়, সে হয়তো এটা পছন্দ করবে না।’

সায়মন অটল রইল। ‘আমি শার্পিকে অভিযুক্ত করিনি। কারও বিরুদ্ধেই আমি অভিযোগ আনিনি। কিন্তু সময় এলে আমি ঠিকই নাম বলব।’

‘তুমি শার্পি বুমারের কথা বলছ না তো?’ কথার ছলে প্রশ্ন করল রনি। ‘একজন শার্পি বুমারের কথা আমি শুনেছি বলে মনে হচ্ছে।

‘শুনেছ?’ বড় দাঁতওয়ালা লোকটা বলল। ‘না শোনার কোন কারণ নেই! সে এই দেশের সবথেকে ফাস্ট গানম্যান! আমার ধারণা ওয়েস হার্ডিনও ওর সামনে কিছুই না!’

‘কি করছে ও? র‍্যাঞ্চিঙ?’ জানতে চাইল রনি। ‘আমি শুনেছিলাম একটা শহরের মার্শাল হিসেবে যথেচ্ছ পিস্তল ব্যবহার করত ও-জুয়াড়ীদের সাথে বেশ খাতিরও ছিল।’

‘সে র‍্যাঞ্চিঙই করছে,’ জবাব দিল সায়মন। ‘হ্যাডলে নামের একটা ব্র্যাঞ্চারের সাথে জুটেছে ও।’

ব্যস্ত ভাবে দরজার দিকে এগোল মরগ্যান। যেন বেরিয়ে পড়তে পারলেই বাঁচে। ওর দিকে চেয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল সায়মন। কিন্তু কিছু বলার আগেই বেরিয়ে গেল লোকটা। এক মুহূর্ত পরে সায়মন মাথা ঝাঁকিয়ে দরজার দিকে দেখাল। ‘ওর কাছে কিছু ভাল স্টক আছে,’ বলল সে।

দেঁতো লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। ‘অর্থাৎ?’ ওর স্বরে অশুভ সুর। ‘মরগ্যান আমার বন্ধু।’

আবার কামরাটা স্তব্ধ হলো। দুজনকে যাচাই করে দেখে র‍্যাঞ্চারের জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করছে রনি। কিন্তু ওদের কথার মাঝে নাক গলাবার অধিকার ওর নেই-এবং তা সে করবেও না।

রনিকে অবাক করে দিয়ে র‍্যাঞ্চার নিজেই চমৎকার ভাবে পরিস্থিতি সামলে নিল। বলল, ‘মানে আবার কি? কিছুই না। আমি ওর তাগড়া মিউলগুলোর কথা বলছিলাম। মিসৌরির এপাশে আর এত ভাল মিউল আমি দেখিনি!’

গানম্যানকে উপেক্ষা করে ওর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল সায়মন।

এক মিনিট পর আবার দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। রনি দেখল লোকটা চলে গেছে। নিচু স্বরে সে বলল, ‘মরগ্যানের বন্ধু লোকটাকে দেখে মনে হয় পিস্তলে হয়তো ওর হাত ভাল।’

‘তা ঠিক।’ সায়মনের স্বর শুষ্ক। ‘ওর নাম জনি রিগ। লোকটা পিস্তলবাজ। হ্যাডলের র‍্যাঞ্চে কাজ করে।’

‘জনি রিগ? তাই? এমন নাম ও কোথায় পেল?’

হেসে উঠল সায়মন। ‘আর পাঁচজনের মত। অহরহ নাম বদলায় ওরা।’

‘হর্স স্প্রিঙসের ট্রেইলটা কেমন?’ প্রশ্ন করল রনি। ‘ওই পথেই যাব আমি।’

‘প্রায় আগের মতই।’ রনিকে যাচাই করে দেখল সায়মন। ‘ওই চাকরিটা খোলা রইল, বন্ধু।’ মাথা ঝাঁকিয়ে পিস্তল দুটোর দিকে ইঙ্গিত করল র‍্যাঞ্চার। ‘ওগুলোয় তোমার ভাল হাত আছে বুঝতে পারছি।’

মাথা নাড়ল রনি। ‘হয়তো পরে।’

যাওয়ার জন্যে ঘুরল সায়মন। ‘শোনো,’ শান্ত স্বরে বলল সে, ‘তুমি যদি হর্স স্প্রিঙসের দিকে যাও তবে তোমার ঘোড়া আর টাকা, দুটোই ভাল মত সামলে রেখো।’

লোকটার যাওয়া দেখল রনি। তারপর পোকার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পেশাদার জুয়াড়ীর নজর নিজের ওপর অনুভব করেও ওকে উপেক্ষা করল সে। দেখল জুয়াড়ীর হাত বেশ চালু এবং লোকটা চতুর। জিতছে ও, কিন্তু সামান্যই। এই খেলায় ওর হয়তো কয়েক ডলার জিত থাকবে। অনেক জুয়াড়ীই বেশি জিততে গিয়ে হয় আর সব খেলোয়াড়দের ভয় পাইয়ে তাড়িয়ে দেয় বা গুলি খেয়ে মরে।

এই লোক বারবারই জিতবে, কিন্তু একবারে বেশি নেবে না। এসব খেলোয়াড় খেলা ছেড়ে উঠে গেলেও কেউ টের পাবে না যারা জিতেছে সেও তাদেরই একজন।

খেলোয়াড়দের একজন ওকে নাম ধরে ডাকায় রনি জানল লোকটার নাম ডীন। নামটা মনে গেঁথে নিয়ে এক রাতের জন্যে ভাড়া করা কামরায় এসে ঢুকল রনি। সাপার খাওয়ার জন্যে একটা স্যাণ্ডউইচ কিনে এনেছে।

কামরায় গরুর চামড়ায় ছাওয়া একটা বাঙ্ক, পাশেই কাঠের চেয়ার। একটা ছোট টেবিলে এক জগ পানি আর গামলা রাখা আছে। একটা জানালাও রয়েছে। দরজাটা ভিতর থেকে লাগাবার ব্যবস্থা আছে। দরজা বন্ধ করে গানবেল্ট খুলে চেয়ারের ওপর রাখল রনি। একটা পিস্তল খাপ থেকে বের করে কম্বলের তলায় রাখল। উরুর পাশে ওটা হাতের কাছে থাকবে। সে জানে, বালিশের তলা পর্যন্ত হাত আনার সময় পায়নি বলে অনেকেই রাতের বেলা বিছানায় খুন হয়েছে।

দরজায় হালকা টোকা পড়ল। বাকি পিস্তলটা কোমরে গুঁজে দরজার দিকে এগোল রনি।

‘কে?’

‘ডীন।’ নিচু স্বর। ‘আলাপ করতে এলাম।’

বাম হাতে দরজা খুলে দিল সে। ডীন ভিতরে ঢুকে আড়চোখে কোমরে গোঁজা পিস্তলটা লক্ষ করে হাসল।

‘এটা ফ্রেণ্ডলি ভিজিট।’

‘নিশ্চয়,’ সায় দিল রনি, ‘বিছানার কিনারে বসতে পারো তুমি।’

এগিয়ে বিছানার ওপর বসল জুয়াড়ী। পায়ের ওপর পা তুলে হ্যাট খুলে হাঁটুর ওপর রাখল।

‘অ্যাপাচিদের বিরুদ্ধে লড়ার পরেই সায়মনের সাথে পরিচয়?’

‘হ্যাঁ।’

লোকটা নিজের মর্জিতে এসেছে, কথা সে-ই বলুক। অপেক্ষা করছে রনি। ‘এখান থেকে পশ্চিমের এলাকাটা চমৎকার যদি ঠিক লোকের সাথে পরিচয় থাকে।’

‘হ্যাঁ। বেশিরভাগ এলাকাতেই তাই হয়।’

‘টেক্সাস থেকে?’

‘অনেক দেশ ঘুরে এসেছি। তোমার মতলবটা কি? তুমি খেলা শুরু করেছ, আমি শো দিয়েছি। তোমার হাতের তাস দেখাও?’

‘স্মার্ট।’ হাসল ডীন। ‘পছন্দ করলাম। রেখে-ঢেকে-চলতে-জানা মানুষের সংখ্যা খুব কম।’

‘ছেলেবেলায় শুনেছি, ‘খালি কলসি বাজে বেশি।’

‘ঠিক।’ রনির দিকে চেয়ে ওকে যাচাই করে দেখে ডীন আবার বলল, ‘তোমার কায়দায় যারা পিস্তল ঝোলায় তাদের প্রায় সবাইকেই আমি চিনি-কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনে উঠতে পারছি না।

‘তাহলে হয়তো একজন আছে যাকে তুমি চেনো না।’

‘বিশ্বাস করা কঠিন। যারা চেনার মত, যেমন ডক হলিডে, বেন থমসন, হিকক, হার্ডিন, আরূপ এবং আরও অনেকের সাথেই আমার পরিচয় আছে। যাক, সায়মন তোমাকে চাকরি দিতে চেয়েছিল-নিচ্ছ?’

‘জবাবটা তুমি শুনেছ-এখনও টাকায় টান পড়েনি আমার।’

‘ভাল বেতন দেবে ও।’

‘একজন ভাল দিলেও অন্য কেউ আরও বেশি দিতে পারে।’

হাসল ডীন। ‘তুমি তাহলে কাজের জন্যে সবথেকে চড়া দাম চাও?’

‘তুমি চাইতে না?’

‘চাইতাম।’ নীরবে একটু চিন্তা করে ডীন আবার বলল, ‘কিন্তু মানুষ কি পাচ্ছে, সেটা আগে থেকে যাচাই করে দেখতে চায়। লোক-দেখাতেও অনেকে তোমার মত পিস্তল ঝোলাতে পারে।’

‘অর্থাৎ?’ কঠিন ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে আছে রনি।

হঠাৎ আতঙ্কিত বোধ করছে ডীন। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। ‘কিছু না!’ বলে উঠল সে। ‘কাজের নমুনা না দেখে মানুষ কিভাবে বুঝবে? কাজ দেখাতে পারো??

চেয়ার থেকে একটু সামনে ঝুঁকল রনি। ওর নীল চোখ দুটো ভয়ানক আর কঠিন হয়ে উঠেছে।

‘কেউ যদি বলে সে পিয়ানো বাজাতে জানে,’ শান্ত নিচু স্বরে বলল রনি, ‘তাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে হলে একটা পিয়ানো দরকার। কেউ যদি বলে সে ঘোড়া পোষ মানাতে পারে তবে তাকে বুনো ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিতে হয়। কিন্তু কেউ যদি বলে সে ফাইটার, মিথ্যে বড়াই করছে কিনা বুঝতে হলে তুমি কিছু শুরু করো।’

পরস্পরের চোখে চোখ রেখে দুজন তাকিয়ে আছে। শেষে ডীনই চোখ সরাতে বাধ্য হলো। হেরে গিয়ে রাগ হচ্ছে ওর, কিন্তু পেশাদার জুয়াড়ী সে-তাই চেহারায় কিছু প্রকাশ পেল না।

‘তোমার কথায় যুক্তি আছে, বন্ধু। ফাইটার না হয়েও যে বলে সে ফাইটার, সে বোকা। নিজের মরণ সে নিজেই ডেকে আনবে।’ একটা চুরুট ধরিয়ে একটু ইতস্তত করল ডীন। ‘তুমি কি আমাকেই তোমার মূল্য যাচাই করে দেখার প্রস্তাব দিচ্ছ?’

‘আরে, না,’ সহজ সরল একটা হাসি দিল রনি। ‘আমার মনে হয় না তুমি পিস্তলবাজ ভাড়া করার লোক। কিন্তু তুমি বা আর কেউ যদি সত্যিই বাজিয়ে দেখতে চায় তবে ওটাই একমাত্র উপায়, কি বলো? শো চেয়ে দেখো লোকটা ব্লাফ দিচ্ছে কিনা। তুমি তো পোকার খেলোয়াড়, এটা নিশ্চয়ই বোঝো?’

মাথা ঝাঁকাল ডীন, দ্রুত চিন্তা চলছে ওর মাথায়। ‘হ্যাঁ, আমি বুঝি। আমার ধারণা তুমি ব্লাফ দিচ্ছ মনে করে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে দেখবে তোমার হাতে ফুল হাউস।’

‘হয়তো। কিন্তু তাতে কি?’

‘তাহলে,’ নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলল সে, ‘আমি বলব তুমি যদি সায়মন ড্রিলের টাকা চাও, ওর কাছেই কাজ নাও। কিন্তু যে আরও বেশি টাকা দিতে পারবে তার সাথে কথা বলতে চাইলে হর্স স্প্রিঙসে গিয়ে ওল্ড করাল বারের স্যামকে বোলো আমি তোমাকে পাঠিয়েছি। তুমি কাজ খুঁজছ।’

‘ধন্যবাদ।’ উঠে দাঁড়াল রনি। ‘দেখি, সেটাও করতে পারি।’

‘তা যদি না করো,’ দরজার কাছে পৌঁছে বলল ডীন, ‘তবে এই এলাকা ছেড়ে চলে যেয়ো। জানাশোনা না থাকলে স্ট্রেঞ্জারের জন্যে এটা অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠতে পারে।’

‘কিংবা যাদের ভুল লোকের সাথে জানাশোনা?’

হাসল ডীন। ‘দেখতে পাচ্ছি পরস্পরকে আমরা পরিষ্কার বুঝেছি। তুমি যদি এদিকে থাকো, তবে হয়তো কোন রাতে পোকার খেলা যেতে পারে।‘

‘হয়তো। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। বাচ্চার হাত থেকে লজেন্স ছিনিয়ে নেয়ার মতই হবে।’

‘মানে?’ খেপে উঠল ডীন।

‘তুমি টেক্স ইউয়াল্টের নাম শুনেছ?’

‘কে?’ আড়ষ্ট হলো ডীন। চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। নামটা যে ওর পরিচিত তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ইউয়াল্ট তাসের সবথেকে ধুরন্ধর ওস্তাদ। তাসে যত রকম চুরি আছে সবই সে জানে, এবং নিজেও অনেক নতুন উপায় উদ্ভাবন করেছে।

‘ভাবলাম তোমার জেনে রাখা ভাল,’ নরম সুরে বলল ড্যাশার, ‘আমি নিজে যেটুকু জানতাম না, তাও টেক্স ইউয়াল্ট আমাকে শিখিয়েছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *