ক্ষ্যাপা তিনজন – ৮

আট

র‍্যাঞ্চ থেকে বেশ কিছু মাইল দূরে চলে এসেছে ওরা তিনজন। কয়েকবার ঘোড়া থামিয়ে কান পেতে শুনেছে রনি। মাথাটাকে পরিষ্কার আর সক্রিয় রাখার চেষ্টা করছে ও। একা থাকলেও অনুসরণকারী ঝানু আউটলদের ফাঁকি দিয়ে পালানো সহজ হত না, কিন্তু একজন খোঁড়া আর একটা মেয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাজটা প্রায় অসম্ভব ঠেকছে। অন্ধকারে ঘন পাইন জঙ্গলের ভিতর পুরু নরম পাইন কাঁটার কার্পেটের ওপর দিয়ে ঘোড়াগুলো নিঃশব্দে এগোচ্ছে। মাঝেমাঝে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসছে, মাথার উপর তারা দেখা যাচ্ছে আকাশে। বাতাসটা ঠাণ্ডা, তাজা, আর স্তব্ধ। কান পাতলে পিছনে বহু দূর থেকে একটা- দুটো চিৎকার এখনও কানে আসছে, তবে ওদের ভিতর দূরত্ব আগের তুলনায় বেড়েছে।

বাম দিকে কালো দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে নয় হাজার ফুট উঁচু লিলি মাউন্টিন। ডান ধারে জ্যাকসন মেসার কাঁধ। সামনেই কোথাও রয়েছে ওয়েস্ট ফর্ক ক্রসিঙের ট্রেইল। ইচ্ছে করেই বাকস্কিনটাকে এগিয়ে নিয়ে ওই ট্রেইল ধরল রনি। জানে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে যেকোন সময়ে আউটলর দল ওদের ধরে ফেলতে পারে, কিন্তু বাঁচার জন্যে ফল্স্ ট্রেইল রাখা অত্যন্ত জরুরী, তাই ঝুঁকিটা নেয়াই সবথেকে ভাল উপায়।

কয়েক মিনিট পথ চলার পরেই বাকস্কিনের খুর পাথরে বাড়ি খাওয়ার আওয়াজ উঠল। বাম দিকের এলাকাটা পুরো স্যাণ্ডস্টোনে ছাওয়া। ট্রেইল ছাড়ার জন্যে আদর্শ জায়গা। কিন্তু এখানে ট্রেইল ছাড়ল না রনি। পিছনের অনুসরণকারী লোকগুলো পাসিকে ফাঁকি দিয়ে বহুবার পালিয়েছে-এত সহজে ওদের ফাঁকি দেয়া যাবে না। আরও অনেকদূর এগিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে একটা বালুময় জায়গায় বামে ঘুরল। মাইলখানেক এগিয়ে ওদের থামাল রনি।

‘একটু বিশ্রাম নাও,’ বলল সে। ‘আমি ট্রেইল ঢাকার জন্যে ফিরে যাচ্ছি।’ অন্ধকারে অদৃশ্য হলো রনি। কি করবে সেটা আগেই মনেমনে ঠিক করে নিয়েছে। ট্রেইল ছেড়ে ওয়াশ ধরে এগোবার পথে কতগুলো গরুকে বিশ্রাম নিতে দেখেছিল-সেগুলোকে তাড়িয়ে ওয়াশ ধরে রওনা করিয়ে দিল। এখন আর নরম বালুর ওপর ঘোড়ার খুরের চিহ্ন আলাদা করে চেনার সাধ্য কারও হবে না। গরুগুলোকে ছেড়ে ফিরে আসার জোগাড় করছে, এই সময়ে অনুসরণকারীদের ঘোড়া ছুটিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেল। ওয়াশের কাছে পৌছে ওদের গতি ধীর হলো।

‘এখানে?’ স্বরটা অপরিচিত

‘না!’ ফিউরি প্রায় গর্জে উঠল। দু’দুবার অপদস্থ হয়ে দারুণ খেপে আছে সে। ‘আমরা সোজা ক্রসিঙে যাব। চিহ্ন দেখে অনুসরণ করা এখন সম্ভব না। এই এলাকা ছেড়ে বেরোতে হলে ওকে নদী পার হতেই হবে।’

‘সে যদি পশ্চিমে যায়?’ প্রশ্ন করল একজন।

‘তোমার মাথা-খারাপ হয়েছে? ওদিকে কতগুলো কানা-ক্যানিয়ন ছাড়া আর কিছু নেই। বেরোতে হলে ওকে উত্তর বা দক্ষিণের ক্রসিঙ পেরোতে হবে।’

‘শার্পি এখানে উপস্থিত থাকলে ভাল হত,’ মন্তব্য করল একজন।

‘সে থাকলে এমন কি হাতি-ঘোড়া মারত?’ ধমকে উঠল ফিউরি। ‘আমরা যা করছি সেও তাই করত। চিন্তার কারণ নেই—ওই শয়তানটাকে আমরা ঠিকই শেষ করব!’

লোকগুলো ট্রেইল ধরে এগিয়ে গেল। ওদের খুরের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাবার পর ফিরে চলল রনি। বালু যেখানে সবথেকে পুরু, সেখান দিয়ে এগোচ্ছে। আলগা বালুর ওপর চলতে ঘোড়াটার একটু কষ্ট হলেও এতে স্পষ্ট কোন ছাপ থাকছে না।

‘চলো, এগোই,’ ওদের কাছে পৌছে বলল রনি। ‘ফিউরি লোকজন নিয়ে ক্রসিঙে গেছে। ওখানে আমাদের না পেয়ে দিনের আলো ফুটলেই ট্র্যাক খুঁজে পিছু নেবে।’

এগিয়ে চলল ওরা। বাম পাশে জার্কি মাউণ্টিনস। সামনে ক্লিয়ার ক্রীক পার হলো। ওটা লিলি মাউন্টিনের খাড়া ভাঁজ বেয়ে নেমে উত্তরে বয়ে গেছে। উঁচু পাহাড় আর তারা দেখে দিক ঠিক রাখছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে কয়োটির ডাক ভেসে আসছে। এছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ভোর হওয়ার আগেই পাথরের আড়ালে একটা গর্তে ক্যাম্প করল রনি।

ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বাবার কাছে ছুটে গেল সুজানা। হ্যাডলের চেহারা ক্লান্তিতে মলিন, কিন্তু চোখ দুটো সংকল্পে উজ্জ্বল। দুজনে মিলে বুড়োকে নিচে নামাল ওরা।

‘আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না, রনি,’ বলল বাড। ‘আমি ঠিকই আছি- অনেকদিন পর ঘোড়ায় চড়েছি, তাই একটু কাহিল। বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

দ্রুত হাতে সাবধানে একটা ছোট্ট আগুন জ্বেলে ফেলল রনি। একটু দূরে সরে ফিরে দেখল চারপাশের পাথর আগুনটাকে চমৎকার আড়াল করেছে। আঁচ করল র‍্যাঞ্চ থেকে প্রায় পনেরো মাইল দূরে চলে এসেছে ওরা। দিনের আলোয় অনুসরণকারী আউলটরা দ্রুত এগিয়ে আসবে। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই আবার রওনা হতে হবে।

.

ঝর্নায় ঘোড়াকে পানি খাওয়াবার সময়ে নরম মাটিতে কতগুলো ছাপ দেখতে পেয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে চিহ্নগুলো পরীক্ষা করছে রনি। নাল ছাড়া ঘোড়া। সুজানা ঘোড়া নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে এল।

‘বুনো ঘোড়া?’ প্রশ্ন করল মেয়েটা।

‘না।’

পশ্চিমের মেয়েকে এর বেশি কিছু বলতে হলো না। কথাটার অর্থ সে পরিষ্কার বুঝেছে। বাড হ্যাডলে খাপ থেকে রাইফেলটা টেনে বের করল।

‘কয়জন?’ জানতে চাইল বাড়।

‘ছয় থেকে আটজন হবে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’ হ্যাটটা মাথার পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে ভাগ্যকে একটা গালি দিল রনি। পিছনে আউটল, সামনে ইণ্ডিয়ান। প্রশ্ন হচ্ছে: কোন্ দল বেশি খারাপ? এই ঝর্নাটাই ওয়েস্ট ফর্ক। এখান থেকে টার্কিফেদার ক্রীক খুব দূরে নয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখছে সে। বড়জোর ঘণ্টাখানেক আগের ছাপ ওগুলো। ইণ্ডিয়ানরা কি চলে গেছে? নাকি সামনেই কোথাও ক্যাম্প করেছে? শার্পি তার লোকজন নিয়ে কতদূর এগিয়েছে?

ওরা যে পথে চলছে তাতে ওখান থেকে আলমার দূরত্ব পঞ্চাশ মাইলের বেশি হবে না। কিন্তু অ্যাপাচিদের উপস্থিতি ছাড়াও ওই পাহাড়ী ট্রেইলের প্রতিটি মাইল অত্যন্ত দুর্গম।

‘ঝুঁকিটা আমরা নেব,’ নিজের সিদ্ধান্ত জানাল রনি। ‘আমরা এগিয়ে টার্কিফেদারে পৌছে ক্যাম্প করব। আমাদের সবারই বিশ্রাম দরকার- ঘোড়ারও। শার্সি ধাওয়া করে আসছে বলেই আমাদের ধরে নিতে হবে।’

‘ইণ্ডিয়ানদের কি হবে?’ প্রশ্ন করল বাড।

হাসল রনি। ‘ওরা নিজেদেরটা নিজেই সামলাতে পারবে।’ হ্যাটটা নামিয়ে চুলের ভিতর আঙুল চালিয়ে ওটা আবার মাথায় এঁটে বসিয়ে সামনের দিকটা টেনে নামিয়ে দিল। ‘বলা যায় না, এইসব পাহাড়ে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়ানোয় অনেক ঝুঁকি। হয়তো ওদের একটা বিপদও ঘটে যেতে পারে!’

ঘোড়ার পিঠে চেপে সতর্কভাবে আগে বাড়ল রনি। ট্র্যাকগুলো স্পষ্ট। ওরাও সম্ভবত একই পথে এগোচ্ছে। এটা হয়তো ওয়ার-পার্টি নাও হতে পারে, যদিও সেটার সম্ভাবনাই বেশি। গতিপথ দেখে মনে হয় আলমার কাছাকাছি কোন বসতি, বা মাইনিঙ ক্যাম্পে অনর্থ ঘটাতে চলেছে ওরা।

পাহাড়ের পাথর আর গাছের ফাঁকে সরু পথ দিয়ে দুটো ঘোড়া পাশাপাশি চলার জায়গা নেই। সার বেঁধে পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে ওরা। নিচের ঘাসে ছাওয়া সবুজ উপত্যকাটা উপর থেকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু ট্রেইল ছেড়ে একটা স্যাণ্ডস্টোন ক্লিফের দিকে এগোল রনি। গোলাপী রঙের পাথরের মাঝখানে কোয়ার্টসের একটা সাদা ডোরা দেখা যাচ্ছে। ওটার গোড়ায় সিকামোর আর কটনউড গাছ ওখানে পানির আশ্বাস দিচ্ছে।

খুব সাবধানে পথ চলছে রনি। মাঝেমাঝে থেমে কান পেতে শুনছে। স্বীকার না করলেও দুশ্চিন্তায় ওর মুখের ভিতরটা শুকিয়ে এসেছে। ওদের পথের ওপরই কিছুটা দূরে হঠাৎ একটা চিল আকাশে উড়ল। মনে হলো কাছাকাছি কিছু নড়তে দেখেই ভয় পেয়ে ওটা আকাশে উঠেছে।

পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে থাকা একটা বড় পাথর ঘুরে সামনে সরু ক্যানিয়নের মত উপত্যকা ওর চোখে পড়ল। দুপাশের পাথর চেপে এসে ক্যানিয়নের অন্য মাথা খুব সরু হয়ে শেষ হয়েছে। ছোট্ট মালভূমির মত জায়গাটাতে বেশ কিছু বড়-বড় গাছ জন্মেছে। উপরের ক্লিফ থেকে কিছু বিশাল আকারের পাথরও গড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে এগোল রনি। শেষ একশো গজ খোলা আর ঢালু। কিন্তু ওরা নিরাপদেই গাছের আড়ালে পৌঁছল।

লাগাম টেনে ঘোড়া থামিয়ে সব খুঁটিয়ে দেখল রনি।

মালভূমি বলা চললেও এর এলাকা মাত্র এক একর। মাঝখানের খোলা জায়গাটা সবুজ ঘাসে ভরা। চারপাশে পাইন, সিডার, সিকামোর আর কটনউড গাছ ওটাকে ঘিরে রেখেছে। প্রচুর ম্যানজানিটাও জন্মেছে। একটা ছোট্ট জলপ্রপাত উপরে ক্লিফের ফাটল থেকে বেরিয়ে গোড়ায় খসে পড়া পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে। বাম দিকে দুপাশের ক্লিফ চেপে এসেছে, কেবল একটা সরু ফাঁক দেখা যাচ্ছে।

‘আমরা রাতটা এখানেই কাটাব, বাড়,’ বলল রনি। ‘হয়তো আগামী দিনটাও আমাদের এখানে কাটাতে হতে পারে। ঘটনা কেমন গড়ায় তার ওপর সব নির্ভর করবে। বাধ্য না হলে ইণ্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে যেতে চাচ্ছি না আমি।’

ক্লিফের গোড়ার কাছে কতগুলো বড়-বড় পাথর আর গাছের ভিতর বেশ নিরাপদ একটা জায়গা বেছে নিয়ে ওরা ক্যাম্প করল। রাইফেলটা তুলে নিয়ে খোলা জায়গার কাছে মাত্র পৌঁছেচে, এই সময়ে ওরা যেদিক দিয়ে ঢুকেছে সেখানে জঙ্গলে বাদামী রঙের একটা নড়াচড়া ওর চোখে পড়ল। এবং তারপরেই ঘোড়ার পিঠে কয়েকজন ইণ্ডিয়ান বেরিয়ে এল।

ওরা সংখ্যায় চারজন। যেদিক দিয়ে এল তাতে বোঝা যাচ্ছে এরা অনুসরণ করছিল-অর্থাৎ এরা সামনের লোকগুলো নয়, ভিন্ন একটা দল। ওর চোখের সামনেই উলটো দিক থেকে কতগুলো অ্যাপাচি বেরিয়ে এল। এরা সংখ্যায় এগারো জন। বাড় আর সুজানাকে সাবধান করা দরকার, কিন্তু ফিরে যাবার উপায় নেই। ওরা ট্র্যাক দেখতে পেয়েছে, জানে রনিরা কোথায় আছে।

এক মুহূর্ত পরে ফিরে তাকিয়ে দেখল সুজানা ওর দিকেই আসছে। ওর ইশারা পেয়ে চট করে উপুড় হয়ে শুয়ে ক্রল করে এগিয়ে এল। ‘অ্যাপাচি,’ ফিসফিস করে বলল রনি। ‘ঝামেলা হবে।’

ইণ্ডিয়ানদের দেখে সুজানার চোখ বিস্ফারিত হয়েছে। কিন্তু কোন প্রতিবাদ বা নালিশ নেই-নীরবেই বর্তমান অবস্থাকে স্বীকার করে নিল পশ্চিমের মেয়ে। ওই লোকগুলোর মধ্যে বিতর্ক চলছে। সম্ভবত এখন আক্রমণ করবে, নাকি পরে, সেটা নিয়েই। সন্ধ্যা হতে আর বেশি বাকি নেই। অ্যাপাচিরা রাতে কখনও লড়ে না।

‘ওরা কি এখনই আক্রমণ করবে?’ প্রশ্ন করল সুজানা।

‘কিছুই বলা যায় না, অ্যাপাচিদের মাথায় কখন কি খেলবে তা কেউ বলতে পারে না। মনে হচ্ছে কিছু লোক চাইছে, কিছু চাইছে না। যাক, আত্মরক্ষার জন্যে আমাদের পজিশনটা ভাল। তবে আমাদের সাথে আরও খাবার থাকলে ভাল হত।’

‘মানে, আমরা এখানে আটকা পড়তে পারি?’

‘হতে পারে।’ হঠাৎ হাসল রনি। ‘শার্পি এখন আমাদের ধরে ফেললে মন্দ হয় না। অ্যাপাচিদের সাথে সে-ই ফাইট করুক।’ চিন্তাযুক্ত মুখে কিছুক্ষণ অ্যাপাচিদের দিকে চেয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাবার কি অবস্থা?’

‘খুব ক্লান্ত, রনি। কিন্তু মুখে কিছুতেই স্বীকার করবে না। কেবল মনের জোরেই সব ধকল সহ্য করছে।’

দুজনে নীরবে অ্যাপাচিদের দিকে তাকিয়ে আছে। সুজানা আবার বলল, ‘ওরা কতদূরে আছে? আমরা এখান থেকে ওদের গুলি করে মারতে পারব না?’

ড্যাশারের কঠিন নীল চোখ কৌতুকে ভরে উঠল।

‘তা পারব,’ বলল সে। ‘কিন্তু সেধে বিপদ ডেকে এনে লাভ আছে? কিছু করতে চাইলে ওরাই তা শুরু করুক। ওরা হয়তো ঝামেলায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’ আরও কিছুক্ষণ ওদিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘মনে হয় ওরা তিনশো গজ দূরে আছে।’

‘ওরা কি ভাল গুলি ছুঁড়তে পারে, রনি?’

আড়চোখে তাকাল রনি। ‘আমার থেকে শুনে রাখো, সু, ওদের কেউ-কেউ দারুণ গুলি ছোঁড়ে। একবার সত্তরজন মেক্সিকান একটা অ্যাপাচিকে কোণঠাসা করেছিল। ওদের সবাইকে ঠেকিয়ে লোকটা পালাতে সক্ষম হয়েছিল। লড়াইয়ে সাতজন মেক্সিকানকে ও গুলি করে মেরেছিল। প্রত্যেকটা গুলিই খুলি ফুটো করে ঢুকেছিল। একেই বলে শূটিঙ! ওকে ছেড়ে বাকি মেক্সিকানদের বাড়ি ফিরে যাওয়ায় আমি কোন দোষ দেখি না।’

ঘাসের গন্ধটা চমৎকার। গা এলিয়ে দিয়ে পেশীগুলোকে ঢিলে করল রনি। ‘তুমি ফিরে যাও, সুজানা,’ শান্ত স্বরে বলল সে। ‘আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করো। মনে হচ্ছে সামনে লম্বা অপেক্ষা রয়েছে।’

‘তুমি কি করবে?’ উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল মেয়েটা।

‘অপেক্ষা করব। ওরা যদি এদিকে আসতে চায় ঠেকাবার চেষ্টা করব। যদি না পারি দৌড়ে ছুটে আসব।’

‘সাবধান থেকো,’ অগত্যা বলল সুজানা। ‘তুমি বড্ড বেশি ঝুঁকি নাও।’

‘তা নয়।’ মাথা নাড়ল রনি। ‘কেবল বোকারাই ঝুঁকি নেয়। এড়ানো সম্ভব হলে ভাল যোদ্ধা কখনও ঝুঁকি নেয় না। কিন্তু যেখানে উপায় নেই সেখানে মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়।

‘পৃথিবীতে কেবল দুই রকম যোদ্ধাই আছে। ভাল যোদ্ধা আর মৃত যোদ্ধা। যখন আমি ছোট ছিলাম, একবার খেলার সাথীরা উঁচু ক্যানিয়নে গাছের গুঁড়ির তৈরি পুলের ওপর দিয়ে আমি হাঁটতে রাজি হইনি বলে আমাকে ঠাট্টা করেছিল। ওরা সবাই কয়েকবার করে পার হলো, কিন্তু আমি যাইনি। ওপারে যদি কিছু থাকত, যেটা আমার চাই, তাহলে আমি নিশ্চয়ই ওটা আনতে যেতাম। কিন্তু কেবল নিজেকে জাহির করার জন্যে বাহাদুরি দেখাবার কোন মানে হয় না।’ হাসল রনি। ‘সাহসী আর বোকার মধ্যে এখানেই তফাত।’

মেয়েটা চলে যাওয়ার পর বুকের কাছে শার্টে হাত মুছে অ্যাপাচিরা যেখানে অদৃশ্য হয়েছে সেদিকে নজর রাখল রনি। হঠাৎ ওদের আবার দেখা গেল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ওরা। পনেরোজনই একসাথে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ পেটের ভিতর কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করল সে। আসুক ওরা, দূরত্ব আরও কিছু কমুক।

তিনশো গজ থেকে হেঁটে এগোচ্ছে পোনি। দুশো গজ, একশো পঞ্চাশ, শেষে একশো হলো। রাইফেলটা স্থির হাতে ধরে সামনের ইণ্ডিয়ানটার পেট লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল রনি। ওর হাতে উইনচেস্টারটা গর্জে লাফিয়ে উঠল নালের মুখ ঘুরিয়ে এক মুহূর্ত স্থির রেখে আবার গুলি ছুঁড়ল। একে-একে ঘোড়ার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ল দুজন। আরও তিনবার দ্রুত ট্রিগার টিপল সে। তারপর উঠে পিছন দিকে ছুটল।

পাথরে ঘেরা ক্যাম্পটা পঞ্চাশ গজ দূরে। পিছন থেকে তীক্ষ্ণ ইণ্ডিয়ান স্বরে চিংকার উঠল। ওর পাশ ঘেঁষে একটা গুলি বেরিয়ে গিয়ে গাছে বিঁধল। ওদিকে ক্যাম্পের পাথরের আড়াল থেকে দুটো রাইফেল জবাব দিল। রনি ঘুরে দাঁড়িয়ে কোমরের পাশ থেকেই দুটো গুলি ছুঁড়ল। দুটোই হিট। একটায় ঘোড়া উলটে পড়ল, অন্যটা লাগল একজন অ্যাপাচির হাঁটুতে। আবার ছুটল ড্যাশার। ছুটতে ছুটতেই রাইফেলে গুলি ভরছে।

একটা গাছের আড়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ে গড়িয়ে গুলি ছোঁড়ার পজিশন নিল। তাকিয়ে আছে। খোলা মাঠটা সম্পূর্ণ ফাঁকা, ওখানে জীবনের কোন চিহ্ন নেই-

একেবারে স্তব্ধ। কেবল একটা মরা ঘোড়া আর একটা লাশ পড়ে আছে।

রনির দিকে তাকাল সুজানা মেয়েটার চেহারা উত্তেজনা আর ভয়ে একেবারে ফেকাসে হয়ে গেছে। শব্দ করে হেসে উঠল বাড। ‘আমি একটাকে ফেলেছি!’ খুশি স্বরে বলল সে। নিউ মেক্সিকোতে আসার পর এই প্রথম ওকে সাত্যিই জীবন্ত হতে দেখল রনি। ‘ওদের থামাতে পেরেছি, রনি?’

‘হয়তো কিছুক্ষণের জন্যে।’ ইণ্ডিয়ানরা যেদিক থেকে এসেছে সেই উঁচু ক্লিফ আর গাছপালার দিকে তাকাল ড্যাশার। ‘ওরা কাল সকালেই আবার আসবে। অবশ্য সংখ্যায় কিছু কমেছে।’

আগুনের ধারে সরে গেছে সুজানা। ‘কফি তৈরি,’ নিচু স্বরে জানাল সে। ‘তোমাদেরটা নিয়ে আসব?’

ফিরে তাকাল রনি। জানে মেয়েটা অত্যন্ত ভয় পেয়েছে, এমন একটা বিপদে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে তার কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। এমন মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। এটা সত্যিই বিরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *