এগারো
ইতস্তত করছে বাণ্ডি বুল। মুহূর্তের জন্যে ওর মাথা রাগে গরম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে লাগতে যাওয়ার ফলাফল আঁচ করে নিজেকে সংযত রাখল। কিন্তু এই দুজনকে বাঙ্কহাউসে ঢোকা থেকে বিরত রাখার কোন ভাল অজুহাত ওর মাথায় আসছে না। ‘ওদের বিব্রত কোরো না!’ প্রতিবাদ করল বাণ্ডি। ‘ওরা দুজনই আহত। ওদের বিশ্রাম নিতে দাও।’
‘বিশ্রাম ওরা পাবে।’ সরাসরি বাণ্ডির দিকে চোখ ফেরাল ডাগ। পরস্পরকে যাচাই করছে ওরা। শেষে বাণ্ডিই চোখ সরিয়ে নিল। ‘শুনে রাখো,’ আবার বলল সে, ‘ডেড-শট আর আমি এখানকার সব খবরাখবর নিতে চাই। তাই না, ডেড- শী?’
‘নিশ্চয়।’ বুটের গোড়ালির ওপর দুলছে ডেড-শট। ওর চোখ দুটো কঠিন হয়ে উঠেছে, কিন্তু মুখে হাসি। ‘এখানকার সব ঘটনাই আমাদের কাছে খুব ইন্টারেস্টিঙ মনে হচ্ছে। রনি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এখানে থাকছি। ও যদি ফিরে না আসে, তবে সে যা শুরু করেছিল তা আমরাই শেষ করব। পুরাপুরি!’
বাণ্ডির ভিতরে কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে। ঝামেলায় জড়াতে তৈরি লোক সে অনেক দেখেছে, কিন্তু এমন আর দুটো দেখেনি।
‘ঠিক আছে, তোমরা চাইলে ওদের সাথে কথা বলো,’ পরোয়াহীন ভাব দেখিয়ে বলল বাণ্ডি, ‘কিন্তু ওরা কর্মচারীর বেশি কিছু না। ওরা জানে সামান্যই, আঁচ করে বেশি। ওদের মধ্যে দাড়িওয়ালা লোকটা টোনি, আর অন্যজন রুবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ দরজার দিকে এগোল ডাগ। ‘তোমার সাথে পরে দেখা হবে।’ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বামে সরে দাঁড়াল সে। ডেড-শট ওকে অনুসরণ করল।
মুখ তুলে তাকিয়ে দুজন অপরিচিত লোককে ঢুকতে দেখে ওদের চেহারা কঠিন হলো। ‘তোমরা আবার কে?’ প্রশ্ন করল রুবেন।
‘দুজন ভবঘুরে স্ট্রেঞ্জার। কিছু প্রশ্ন নিয়ে এসেছি।’
ডাগ মারফি ওদের যাচাই করে দেখল। লীডার গোছের কেউ নেই, তবে এরা কঠিন লোক।
‘আমরা সব ফাইটিঙেই আগ্রহী, তবে আপাতত এই ইণ্ডিয়ান লড়াই সম্পর্কে জানতে চাই।’
‘গল্প শোনাবার মূড আমাদের নেই,’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল রুবেন। নবাগত লোক দুটোর মাতব্বরি চাল ওর অসহ্য ঠেকছে।
‘আহা, এমন পরপর ভাব দেখাচ্ছ কেন?’ সহজ সুরে বলল ডেড-শট। তারপর একটা বাঙ্কে বসে সিগারেট রোল করতে শুরু করল। ‘আমরা শুধু ওদিকে পাহাড়ে কি ঘটেছে সেই গল্প শুনতে চাই। ওটা নিশ্চয় আকর্ষণীয় হবে। তোমাদের কে গুলি করেছে?’
টোনি এতক্ষণ তাকিয়ে দেখছিল, এবার তার হলুদ চোখ দুটো সরিয়ে নিল। আহত হয়ে ওর মেজাজটা একটু তিরিক্ষি হয়ে আছে। ওদের কারও চোটই মারাত্মক নয়, তবে বেশ কিছু রক্ত হারিয়েছে। কিন্তু ও কিছু বলার আগে রুবেনই পালটা প্রশ্নে জবাব দিল। ‘তোমরা কে? এখানে কি চাও?’
‘সাধারণ কাউহ্যাণ্ড। ওদিকে আমাদের একজন বন্ধু আছে।’ মাথা ঝাঁকিয়ে পাহাড়ের দিক ইঙ্গিত করল ডেড-শট। ‘ওর নাম ড্যাশার। ওকে চেনো?’
চমকে মাথা তুলে স্ট্রেঞ্জার দুজনের দিকে কতক্ষণ চেয়ে থাকল। ‘না,’জবাব দিল রুবেন, ‘ওর নামও শুনিনি।’
হেসে উঠল ডাগ। শব্দটা টোনির কানে অপ্রীতিকর শোনাল। চট করে ওকে যাচাই করে দেখে সাবধানে বলল, ‘না, ওকে চিনি না।’ ডাগের ওপর থেকে চোখ সরাল না সে।
‘এরকম একটা জবাবই আশা করেছিলাম,’ ডাগ বলল, কিন্তু আমার ধারণা আমরা তোমাদের বোঝাতে পারব যে বাড়াবাড়ি না করাই ভাল। জানো, তোমাদের মেয়াদ এখানে শেষ? মানে শার্সি, আর তার দলের, সবার।
‘মেয়াদ শেষ?’ কুৎসিত ভাবে হাসল রুবেন। ‘বোকার মত কথা বোলো না! এই র্যাঞ্চ দখলে রাখতে শার্পির কোন ঝামেলাই হবে না-হলেও বাঙি প্রলেপ দিয়ে তা ঠিক করে নেবে।’
‘ও, তাহলে সেও একই গোয়ালের গরু? দলের লোক?’
‘তাছাড়া কি?’ হাসি মিলিয়ে ওর চেহারা গম্ভীর হলো। ‘তোমাদের কেটে পড়া ভাল। এই মুহূর্তে আমি ঝামেলায় যেতে চাই না।’
‘না,’ শান্ত স্বরে বলল মারফি। ‘আমরা নয়, তোমরাই যাবে। অবশ্য সেটাও তোমাদের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। যদি লক্ষ্মী ছেলের মত কথা বলো, কেবল তাহলেই ঘোড়ায় চড়ে এখান থেকে যেতে পারবে। নইলে কয়েটিদের খাওয়া শেষ হলে ওরা তোমাদের কবর দেবে।’
‘মুখেই কেবল বড়বড় কথা,’ অবজ্ঞার সাথে ভেঙচি কাটল রুবেন। ‘করার মুরোদ আছে?’
‘নিশ্চয়! দেখতে চাও?’ একপা আগে বেড়ে তৈরি হয়ে দাঁড়াল ডাগ।
হঠাৎ কৌতুকের সাথে রুবেনের সাহসও অনেকখানি উবে গেল। লোকটা চতুর নয় বটে, কিন্তু বিপদ-সঙ্কেত দেখতে পেলে ঠিকই চেনে। এবং এখন সে বিপদ দেখতে পাচ্ছে। পরিষ্কার।
‘তুমি কি জানতে চাও?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ফাইট করে লাভ নেই।’
‘ড্যাশার এখন কোথায়?’
হেসে উঠল রুবেন। ‘আমি যেসব প্রশ্নের উত্তর জানি তেমন কিছু জিজ্ঞেস করো। লোকটা স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে। পাথরের ওপর চললে সাপ যতটুকু ট্রেইল রাখে, সে তাও রাখেনি। যাও বা ট্রেইল পেলাম, দেখলাম যে পথে পাহাড়ী ছাগলও নামতে ভয় পাবে সেই পথেই নেমেছে ও।
‘নিচে একটা আগুন জ্বলতে দেখে আমরা আক্রমণ করতে এগোলাম-উলটো দিক থেকে অ্যাপাচিরাও একই উদ্দেশ্যে আগুনের দিকে এগোচ্ছিল। লড়াই হলো, আমরাই জিতলাম, কিন্তু বার্ট ডেভিসকে হারালাম। ড্যাশার এর ফাঁকে সরে পড়ল। আমরা যখন ফিরি তখনও ওর ট্রেইলের সন্ধান পাওয়া যায়নি।’
হঠাৎ মাথা তুলল ডেড-শট। ঘোড়ার খুরের শব্দ ওর কানে এসেছে। কিন্তু বাইরে উঁকি দিয়ে কিছুই চোখে পড়ল না। চারদিক নিস্তব্ধ। অবিরাম তুষার পড়ছে। রনির কথা মনে হলো ওর। উঁচু পাহাড়ে আরও ভারী তুষারপাত হচ্ছে এখন, বাতাসও খুব ঠাণ্ডা।
রাতে চামড়া আর মাংস ভেদ করে শীত হাড় পর্যন্ত গিয়ে বিধবে। তুষার এই হারে পড়তে থাকলে ভোর হওয়ার আগেই সব গিরিপথ বন্ধ হয়ে যাবে। এই প্রথম রনির জন্যে ডেড-শটের দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কারণ এখন কেবল আউটল নয়, বরফ আর পাহাড়ী শীতের বিরুদ্ধেও ওকে যুঝতে হবে।
‘তোমাদের জখম ব্যাণ্ডেজ করা শেষ হলে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এখান থেকে বিদেয় হও,’ বলল ডাগ। ‘এখানে আর তোমাদের রাখা হবে না।’
‘আমাকে আদেশ দিচ্ছ তুমি?’ অবজ্ঞার সাথে বলল রুবেন। ওর সাহস আবার ফিরে আসছে। সে লক্ষ করেছে টোনি ব্যাণ্ডেজ বাঁধা শেষ করে নিজের বাঙ্কের মাথার কাছে দাঁড়িয়েছে। রুবেন জানে আকস্মিক প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্যে বালিশের তলায় একটা পিস্তল রাখে টোনি। উত্তেজনায় রুবেনের ঊরুর পেশী জিনসের মোটা কাপড়ের নিচে আঁকড়ে শক্ত হয়ে ফুলে উঠল।
ওর এই আড়ষ্ট অবস্থাই মারফিকে সাবধান করল। ওদের দুজনের ওপর চোখ রেখেই সে কথার ছলে প্রশ্ন করল, ‘বাণ্ডি এখানকার কি? সে-ই বস্, নাকি শার্পি?’
‘শার্পি।’ রুবেনের স্বর নীরস শোনাল। ‘বাণ্ডি নিজেকে অনেক বড় মনে করে, কিন্তু শার্পির কাছে ও কিছুই না। তবে আমি শার্সি হলে ওর ওপর কড়া নজর রাখতাম। লোকটা ঠাণ্ডা মেজাজে একা বসে মাছির পা একটা-একটা করে ছিঁড়তে পারে-ওর রুচিটাই বিকৃত।’
‘ভাল; এখন আমরা যাচ্ছি।’ একজন থেকে অন্যজনের দিকে তাকাল মারফি। ‘মনে রেখো কি বলেছি। কোন রকম চালাকি করতে যেয়ো না, তাহলে মিছে মারা পড়বে। সময় থাকতেই চলে যাও, কারণ বাছাই করে ছাঁটাই শুরু হয়ে গেছে। তোমাদের এক ঘণ্টা সময় দেয়া হলো!’
পাশ ফিরে চেয়ে মারফি দেখল দরজার পাশে ঝোলানো শেভ করার আয়নায় টোনিকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ডেড-শটের দিকে চেয়ে নড করে ঘুরে দরজার দিকে এগোল সে। চট করে বালিশের তলা থেকে পিস্তল বের করার জন্যে হাত বাড়াল টোনি।
আয়নায় নড়াচড়া লক্ষ করে মুহূর্তে ঘুরে কোমরের পাশ থেকেই গুলি করল মারফি। গুলিটা সরাসরি টোনির বুকে বিঁধল। পিস্তল তুলে তাক করারও সময় পায়নি ও। হাঁটু ভাঁজ হয়ে মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল লোকটা। রুবেনের মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে, ওর টেবিলে রাখা পিস্তলের বাঁট ধরা হাত ওই অবস্থাতেই স্থির হয়ে রয়েছে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছে স্ট্রেঞ্জার দুজনের হাতে তারই দিকে তাক করা পিস্তল দুটো কোথা থেকে এল।
‘তুমি কি ড্রটা শেষ করতে চাও?’ সহজ সুরে প্রশ্ন করল ডাগ। ‘তাহলে আমি না হয় আমারটা খাপে রাখি, তারপর আবার প্রথম থেকে শুরু করা যাবে?’
‘তোমার ড্র দেখে আমার শখ মিটে গেছে, মিস্টার,’ বলে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল রুবেন। ‘আমি কেবল প্রাণ থাকতে এখান থেকে সরে পড়ার একটা সুযোগ চাই।’
‘বেশ, আমরা বাধা দেব না।’
টোনির দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে উঠে দাঁড়াল রুবেন। ‘এমন আমি জীবনে দেখিনি। ওই ছেলের চোরা-পিস্তলে অগাধ বিশ্বাস ছিল।’ বেডরোল তুলে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে থামল সে। ‘আমি কোনদিকে যাব?’
‘সেটা তোমার ইচ্ছা,’ জবাব দিল ডেড-শট। ‘কিন্তু তোমাকে যেন আমরা আবার না দেখি। যদি চাও, হর্স স্প্রিঙসে গিয়ে তুমি শার্পির দলের সবাইকে সুস্থ আবহাওয়ায় সরে যাওয়ার পরামর্শ দিতে পারো।’
রুবেন চলে যাওয়ার পর র্যাঞ্চহাউসে ফেরার জন্যে এগিয়েও তুষারের ওপর কয়েকটা ঘোড়ার খুরের ছাপ দেখে ওরা থামল। ঘোড়াগুলোকে বাঙ্কহাউসের পাশ দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটিয়ে নিয়ে ট্রেইল ধরা হয়েছে। ওরা জানে না যে এই আরোহীদেরই রনিকে বাধা দেয়ার জন্যে বাণ্ডি আলমার দিকে রওনা করিয়ে দিয়েছে। এবং নিজেও ঘোড়ায় চড়ে উত্তরে টার্কি স্প্রিঙস ক্যানিয়নের দিকে গেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিজের লোকজনকে র্যাঞ্চে নিয়ে আসার সময় হয়েছে।
‘ওদের কি আমরা অনুসরণ করব?’ কি করা উচিত বুঝতে পারছে না ডেড- শট।
‘চলো, আগে বাণ্ডিকে খুঁজে বের করি। ওর সাথে আমাদের আবার কথা হওয়া দরকার।’
.
পাহাড়ে অনবরত বরফ পড়ছে। তুষারের সাদা চাদরে ঢাকা পড়েছে ট্রেইল। কেবল ডাইনে আর বাঁয়ের ঝোপঝাড় দেখে ট্রেইল চিনে রনিকে এগোতে হচ্ছে। উইলো ক্রীক পার হয়ে এসেছে ওরা। রনির ধারণা সামনে একটা ট্রেইল দেখতে পেয়েছে ও।
বাড হ্যাডলে রনির পাশে সরে এল। ‘শার্পি এই তুষারের মধ্যে আমাদের অনুসরণ করবে না,’ বলল সে। ‘ও নির্ঘাত ফিরে যাবে।
‘আমারও তাই মনে হয়।’ বুড়োর চেহারা খুঁটিয়ে লক্ষ করল রনি। লোকটা কাহিল হয়ে পড়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন থামার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। একজনের নয়, সবারই। ‘কিন্তু ভেব না সে পুরোপুরি হাল ছাড়বে। অন্য পথে ও আমাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে।’
রনির কথাটা একটু ভেবে দেখল হ্যাডলে। ‘হ্যাঁ, ও যদি ঘোরা পথে লোক পাঠায় তবে বারবার ঘোড়া বদলে নিয়ে ছুটলে আমাদের আগে ওরা আলমায় পৌঁছতে পারবে।’
‘ও কি পথে তাজা ঘোড়া পাবে?’
‘নিশ্চয়। রাসলারদের সাথে ওর ভাল যোগাযোগ আছে। রাসলারদের গোটা- ছয়েক আস্তানায় ওরা ঘোড়া বদলাবার সুযোগ পাবে। হ্যাঁ,’ স্বীকার করল বাড়, ‘ওরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে-অবশ্য যদি আমরা বেরোতে পারি।’
‘আমরা বেরোব। আচ্ছা, আলমায় কি ওর বন্ধুবান্ধব আছে?’
‘হ্যাঁ। ওই ঈগল সেলুনটা হচ্ছে টাউট আর আউটলদের আড্ডা। অনেক আগেই ওটা পুড়িয়ে শেষ করা আমাদের উচিত ছিল।’
অনেক উঁচুতে উঠেছে ওরা। দশ হাজার ফুট উঁচুতে গোড়ালির গাঁট পর্যন্ত তুষারের ওপর ঘোড়াগুলো নিষ্ঠার সাথে পরিশ্রম করে চলেছে।
বাকি দুজনের যে কতটা সহ্য করতে হচ্ছে, সেটা রনি নিজের কষ্ট থেকেই বেশ বুঝতে পারছে। সব রকম আবহাওয়াতে কষ্ট সহ্য করে সে অভ্যস্ত। তুষারপাত থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন থেকে ট্রেইলগুলো বন্ধ হওয়া শুরু করবে। ওরা যদি এখন থামে তাহলে পাহাড়েই আটকা পড়বে। পরিস্থিতির গুরুত্ব সে জানে, তাই সামান্য বিশ্রাম ছাড়া কোথাও বেশিক্ষণ থামার ইচ্ছা ওর নেই।
ওপাশে পৌছার জন্যে ওদের এখন আর মাত্র একশো ফুট উঁচুতে উঠতে হবে। কিন্তু গিরিপথের কাঁধটা এখনও বেশ দূরে। পথ যেন ফুরোতেই চায় না। তুষার আরও গভীর হয়েছে প্রায় ঘোড়ার হাঁটু পর্যন্ত। পায়ে-পায়ে এগোচ্ছে ঘোড়া।
বাতাসে তুষারের ঘনত্ব এখন আরও বেড়েছে। সামনে বা পিছনে বেশিদূর দেখা যাচ্ছে না। পিঠ সোজা করে জিনের ওপর স্থির বসে আছে বাড। তুষারের পুরু আবরণে ওকে স্নোম্যানের মতই দেখাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ রনির দেহের ভর সামনের দিকে ঝুঁকে এল। নিচে নামছে ওরা! আরও কিছুদূর এগোবার পর তুষার পাতলা হয়ে এল। রনি বুঝল পুব ঢালের তুষার পশ্চিম ঢালে বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না- মাত্র অল্পকিছু তুষার উপচে এপাশে আসছে।
বিশ্রাম নেয়ার জন্যে ক্যাম্প কর জায়গা খুঁজছে রনি। সে জানে বাড কেবল মনের জোরেই ঘোড়ার ওপর টিকে আছে-লোকটা যেকোন মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। আরও কিছুটা নামার পরে পাহাড়ের গায়ে বিরাট একটা গর্ত দেখতে পেয়ে আপাতত ওখানেই থামার সিদ্ধান্ত নিল রনি। বারো ফুট চওড়া গর্তটা পাহাড়ের ভিতর প্রায় বিশ ফুট ঢুকে গেছে। ছাদটা দশ ফুট উঁচু। ক্যাম্প করার জন্যে আদর্শ জায়গা। ভিতরে ঘোড়াগুলোর জন্যেও যথেষ্ট জায়গা হবে।
বাডকে ধরাধরি করে পাথরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দ্রুত কাঠ জোগাড় করে এনে আগুন জ্বালাল রনি। সুজানা তুষার গলিয়ে কফি তৈরি করতে ব্যস্ত হলো। ওদের খাবার ফুরিয়ে গেলেও কফি আছে। গরম কফিতে খিদে না মিটলেও শীতের কামড় কিছুটা কাটবে।
‘একটু সামনে ঝুঁকে বসো, বাড়,’ পরামর্শ দিল রনি। ‘আগুনের তাপে কিছুটা -আরাম পাবে।’
‘ওহ্, দারুণ চাঙ্গা বোধ হচ্ছে, বাছা।’ শীতে কাঁপা হাত দুটো আগুনের দিকে বাড়িয়ে ধরল হ্যাডলে। ‘মনে হচ্ছে আমার বয়স বিশ বছর কমে গেছে।’
‘যাত্রার কঠিন অংশ আমরা পিছনে ফেলে এসেছি!’ উৎসাহ যোগাবার চেষ্টা করল ড্যাশার।
‘ওরা যদি সামনে আমাদের বাধা দেয়?’ প্রশ্ন তুলল সুজানা।
‘ট্রেইলের ওপর নজর ওরা অবশ্যই রাখবে। কিন্তু হয়তো ততটা সতর্ক থাকবে না। ভাবতেই পারবে না এই দুর্যোগ মাথায় করে আমরা পাহাড় ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসতে পারব। অতর্কিতে আক্রমণ করে আমিই ওদের শেষ করব।’
‘না, রনি, প্লীজ, ঝুঁকি নিও না!’ উদ্বিগ্ন হলো সুজানা।
ওর দিকে চেয়ে হাসল রনি, কিন্তু ওর চোখ দুটো সঙ্কল্পে কঠিন। ‘হ্যাঁ, সু, আমি ঠিক তাই করব, ওদের এক-এক করে শেষ করব। ওরা আমাকে খেপিয়ে তুলেছে।’
বিশ্রাম নেয়ার ফাঁকে কফি খাচ্ছে ওরা। সামনের সমস্যা নিয়ে ভাবছে রনি ট্রেইলের ওপর যে নজর রাখা হবে এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। সিলভার ক্যানিয়ন ধরে নামবে ওরা, নিচের দিকে ছোটছোট কয়েকটা মাইনিঙ ক্যাম্প আছে। কিন্তু কোনটাই নিরাপদ হবে না। হয়তো মরিয়া হয়ে শার্পি ওদের মৃত্যুর জন্যে পুরস্কারও ঘোষণা করে থাকতে পারে। তাহলে দেখামাত্র গুলি করবে ওরা।
দুঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা হলো ওরা। তুষারপাত থেমে গেছে। খাপ থেকে রাইফেল বের করে তুষার ঝেড়ে কল-কব্জা পরীক্ষা করে দেখে নিল রনি। পিস্তল দুটোর বেলাতেও তাই করল। কিন্তু একটা পিস্তল কোমরে গুঁজল। এতে পিস্তলটা দেহের তাপে গরম থাকবে, ঠাণ্ডায় আঁকড়ে যাবে না।
ঘোড়াগুলোর মধ্যে এখন আর কোন তেজ অবশিষ্ট নেই। মন্থর গতিতে হাঁটছে। ট্রেইলটা এখন ক্রমাগত নিচে নামছে। দূরে একটা কেবিন দেখতে পেল রনি। কিন্তু ওটার চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে না। পরবর্তী মাইলে আরও দুটো কেবিন চোখে পড়ল। সবই প্রসপেক্টর বা কোন মাইনারের তাড়াহুড়া করে তৈরি জোড়াতালি দেয়া কেবিন।
যত নিচে নামছে ঝোপঝাড় আর গাছপালাগুলো ততই ঘন আর লম্বা হচ্ছে। সামনের দিকে জঙ্গলের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে রনি। একটু ঝিলিক বা সামান্য ইঙ্গিত দেখার অপেক্ষায় আছে।
হঠাৎ সেটাই তার চোখে পড়ল: একটা আলোকিত জানালা!
সঙ্গীদের ইঙ্গিতে থামিয়ে নিচে নেমে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেল রনি। বেশ কাছে পৌঁছে উঁকি দিয়ে দেখল কেবিনে যাওয়ার পথে তুষারের ওপর সদ্য তৈরি ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে।
হাত দুটো কোটের বোতামের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে আঙুলগুলোকে গরম রাখার জন্যে দেহের সাথে চেপে ধরল। এই সময়ে হাতের আঙুল আড়ষ্ট হতে দেয়া যাবে না। আঙুলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিয়ে কেবিনের দিকে এগোল রনি।
জানালায় আলো সুজানা আর বাডও দেখেছে। ওরা জানে রনি কি করতে গেছে।
‘ড্যাড, ওকে আমরা সাহায্য করতে পারি না?’ রনির জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সুজানা।
‘না, বাছা,’ বলল সে, ‘ওর অজান্তে আমাদের এগোনো ঠিক হবে না। তাতে ওর ঝামেলাই বাড়বে। এখন ওর কাছে প্রতিটা বুলেটই শত্রুর বুলেট, যেকোন নড়াচড়াই শত্রুর। আমরা কেবল ওর বাধাই হয়ে দাঁড়াব।’
.
অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলে নিঃশব্দে তুষার ভেঙে জানালার তলায় হাজির হলো রনি। উবু অবস্থা থেকে সামান্য মাথা উঁচিয়ে ভিতরে উঁকি দিল। তিনজন লোক একটা টেবিল ঘিরে বসে তাস খেলছে। তিনজনই কঠিন-দর্শন লোক। কেবিনটাকে ঘুরে সামনে এসে বাম হাতে ঠেলে দরজা খুলল সে।
তিনজনই মুখ তুলে দরজার দিকে চাইল। অবাক চোখে ওরা দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে দেখছে। ভিতরে ঢুকে দরজা টেনে দিল রনি।
‘হাওড়ি, বয়েজ! আমি রনি ড্যাশার!’
ওদের দুজন চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু বের করার সময় পেল না, রনির জোড়া পিস্তলের গুলিতে ওরা ঢলে পড়ল। তৃতীয় লোকটা শূন্যে হাত তুলে চিৎকার করল, ‘মেরো না! আমি এর মধ্যে নেই!’
‘তাহলে বাইরেই থাকো,’ বলল রনি। তারপর ওর দিকে এগিয়ে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করল, ‘তোমাদের কে পাঠিয়েছে? শার্পি?’
‘আমাকে কেউ পাঠায়নি! এটা আমারই কেবিন। তোমাকে মারার জন্যে ওদের পাঠানো হয়েছিল। আমি পিস্তলবাজ নই-ওদের কিভাবে ঠেকাব?’
‘বুঝলাম। এখানে তোমার ঘোড়া কয়টা আছে?’
‘তিনটে ঘোড়া আর একটা খচ্চর আছে। তুমি আমাকে পথে বসাবার কথা ভাবছ না তো?’
‘তুমি যাতায়াতের জন্যে মিউলটা ব্যবহার করতে পারবে। এখন কফি আর খাবার তৈরি করো।’