এক
বুড়ো ব্যাঙ্কারের টাকা গোনা দেখছে কাউবয় রনি ড্যাশার। খুব যত্নের সাথে কাজ করছে লোকটা। পনেরো হাজার ডলারের ব্যাপার-যত্ন আর সতর্কতা আপনা থেকেই আসে। চোখের সামনে টাকার স্তূপটা বড় হচ্ছে। কিন্তু ওটার পিছনে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে মাসের পর মাস হাড়ভাঙা পরিশ্রম গেছে। তার ওপর ছিল ঝড়ের সময়ে বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দে অস্থির গরুগুলোর স্ট্যামপিডের ভয়, আর ডাকাতের হামলা।
এছাড়া আরও অনেক খেসারত ওদের দিতে হয়েছে। লোন ট্রী ক্যানিয়নে ওর প্রিয় কাউ-পোনিটা একটা অবাধ্য ষাঁড়ের আক্রমণে মারা পড়েছে। একটা মসিহর্নকে দড়ির ফাঁসে ধরার চেষ্টায় জুনিপার ঝোপে দড়ি পেঁচিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে পা ভেঙে তিন সপ্তাহ বিছানায় পড়ে ছিল ল্যাঙ্কি। টোয়া থেকে আসা তরুণ ছেলেটার রক্তও মিশে আছে ওই টাকায়। অসীম উদ্দীপনা আর প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে বেচারি ওদের দলে যোগ দিয়েছিল। স্ট্যামপিডের আগে-আগে ঘোড়া নিয়ে ছোটার সময়ে প্রেয়ারি কুকুরের একটা গর্তে খুর ঢুকে যাওয়ায় ছিটকে পড়ে ঘোড়ার সাথে সেও প্রাণ হারাল। দেহের যেটুকু পাওয়া গেল তা কবর দিয়ে হ্যাট আর পিস্তল এল পেসোতে ওর ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘এই নাও, রনি,’ গোনা শেষ করে বলল ব্যাঙ্কার। ‘আমি জানি দেনা শোধ করতে পেরে বাক এখন অনেক হালকা বোধ করবে।’
‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করল রনি, ‘কিছু কিছু ব্যাপারকে সে খুব গুরুত্ব দেয়। পারতপক্ষে ঋণের মধ্যে ঢুকতে চায় না বাক।’
‘জানি, পশ্চিমের র্যাঞ্চটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার পরই নিজের র্যাঞ্চ বাকের কাছে বাকিতে বিক্রি করে পশ্চিমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাড হ্যাডলে। জানত টাকাটা মার যাওয়ার ভয় নেই। তুমি নিজেই কি টাকাটা পৌঁছে দিতে যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ, বুড়ো বাড হ্যাডলে আমারও বন্ধু। তাছাড়া বাক বার ২০ র্যাঞ্চ ফেলে এই মুহূর্তে পশ্চিমে যেতে পারবে না।’
‘হ্যাডলের এখন একটা মেয়েও আছে শুনছি।’
‘এখন মানে? আগেও তো ছিল। তিন বছর আগে এখান থেকে সময়েই ওর বয়স ছিল পনেরো।’
‘ভাল কথা’-চেয়ার ঘুরিয়ে ওর দিকে ফিরে বসল ব্যাঙ্কার-’তোমার সাথে আর কে যাচ্ছে?’
‘আমি একাই যাচ্ছি। ডাগ মারফি কি একটা কাজে ব্যস্ত, আর এখন বাকের পক্ষে আরেকজন কাউকে ছাড়াও সম্ভব না। তাছাড়া এটা দুজনের কাজও নয়।’
‘হয়তো। কিন্তু ওদিককার ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। কয়েকদিন আগেই ম্যাকক্লিলান থেকে আমার এক বন্ধুর চিঠিতে জানলাম সপ্তাহ তিনেক আগে ওর ব্যাঙ্কে ডাকাত পড়েছিল। ক্যাশিয়ার খুন হয়ে গেছে, একজন ডেপুটি শেরিফ আহত। ডাকাত দলটাকে ধরা যায়নি, পাসির চোখে ধুলো দিয়ে ওরা পালিয়েছে।’
‘ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।’
টাকাগুলো তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলো রনি।
‘বাক আমার জন্যে অপেক্ষা করছে, এখন আমার র্যাঞ্চে ফিরে যাওয়াই ভাল। এই টাকা নিয়ে তুমি মিছে দুশ্চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক মতই এটা বাডের কাছে পৌঁছে দেব।
প্যাকেটগুলো কালো শার্টের ভিতর ভরে, প্যান্টের বেল্টটা একটু এঁটে, গান- বেল্ট ঠিক মত বসিয়ে, পিস্তল দুটো একটু আলগা করে, দরজার দিকে এগোল ড্যাশার।
চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রনির যাওয়া দেখছে ব্যাঙ্কার। সেই পরিচিত হাঁটার ঢঙ, বলিষ্ঠ গড়ন আর সরু কোমর। কোল্ট •৪৫ পিস্তল দুটোর ওপর বহুল ব্যবহারের ছাপ রয়েছে। বুট জোড়া ধুলোময়।
জানালা থেকে সরে আসছে, এই সময়ে ওর চোখের কোণে নড়াচড়া ধরা পড়ল। একটা লোক ব্যাঙ্কের পাশ থেকে রাস্তায় নেমে রনির পিছু নিল। হয়তো ওই লোক রনিকে টাকা তুলতে দেখেছে। ভুরু কুঁচকাল ব্যাঙ্কার। স্ত্রী সাপার নিয়ে তার জন্যে বাড়িতে অপেক্ষা করছে। এখন যদি রনিকে সাবধান করতে সে সেলুনে ঢোকে তবে কত ঘণ্টার জন্যে যে আটকা পড়বে তার ঠিক নেই।…যাকগে, নিজেরটা নিজেই সামলাতে পারবে ড্যাশার…সবসময়ে ও তাই করেছে।
.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দালানের কোনাগুলো আবছা হয়ে উঠছে। রাস্তা পার হয়ে সেলুনে ঢুকল রনি। ভিতরে, পোকার খেলা চলছে একটা টেবিলে। খেলোয়াড়রা কেউ ওর চোখে চোখ রাখছে না—সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাচ্ছে। পরস্পরকে ওরা চেনে, এবং জানে, মোটামুটি সমানে-সমানেই খেলা চলছে। কিন্তু রনি হচ্ছে ড্র পোকারের দক্ষ ওস্তাদ। ওকে খেলায় নিতে চায় না কেউ।
বারে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। নবাগত। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে ওদের একজনকে পার হতে দেখেছে রনি। এক নজর দেখে ধাঁচটা বুঝে নিল। ভবঘুরে গোছের লোক-কিছুটা আউটল ধরনের ছাপও যেন রয়েছে।
ওদের জামা-কাপড়ে রয়েছে ট্রেইলের পুরু ধুলো। কিন্তু অস্ত্রগুলো মোছা, পরিষ্কার। গানবেল্টের কার্তুজগুলো ঝকঝক করছে। ওদের মধ্যে কম বয়সী লোকটা যখন রনির দিকে আড়চোখে তাকাল, রনি দেখল ওর একটা চোখ অর্ধেক বোজা। প্রথমে ভেবেছিল লোকটা চোখ টিপছে-পরে বুঝল ওর চোখটাই ওই রকম।
বাকি দুজনও শক্ত চেহারার। লম্বা লোকটার কাঁধ একটু কুঁজো। চেহারায় বদমেজাজ আর নিষ্ঠুরতার গভীর ছাপ পড়েছে। তৃতীয়জন মাত্র কৈশোর পেরিয়েছে। কিন্তু ওর চেহারা দেখে বোঝা যায় এরই মধ্যে ট্রেইলে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে ও।
রেঞ্জ জীবন মানুষকে শক্ত করে তোলে। এমন ভবঘুরে লোক এই সময়ে প্রায়ই দেখা যায়, কারণ টুইন রিভার্স শহরটা যে ট্রেইলের ওপর পড়েছে সেটা এই মাসগুলোতে বেশি ব্যবহৃত হয়।
‘কাল সকালেই রওনা হচ্ছ, রনি?’ বারের ওপর কনুই রেখে সামনে ঝুঁকে প্রশ্ন করল বারটেণ্ডার। ‘জনি বলছিল তুমি পশ্চিমে বাড হ্যাডলের ওখানে যাচ্ছ।’
নামটা শুনেই স্ট্রেঞ্জার তিনজন চমকে ফিরে তাকাল। লোকগুলোর মুখের ভাবে, আর ওই নাম ওদের কাছে পরিচিত বুঝে রনির কৌতূহল জাগল। মুখ ফিরিয়ে নিল ওরা। আধ-বোজা চোখের লোকটা নিচু স্বরে অন্য দুজনকে কি যেন বলছে।
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল ড্যাশার। ‘তিন বছর আগে ওর গরু আর র্যাঞ্চ কিনেছিল বাক। ওই ব্যাপারেই আমাকে পাঠাচ্ছে ও। কিছুদিন ভাল পাহাড়ী বাতাস খেয়ে আসা যাবে।’
‘শুনেছি বাড নাকি ওখানে একটা ভাল র্যাঞ্চ কিনেছে?’
‘কেনেনি। ওর বৌ ছিল স্প্যানিশ। পুরানো একটা স্প্যানিশ গ্রান্টের অংশ হিসেবে পরিবারের তরফ থেকে সে ওটা পেয়েছিল। তাই পনেরো বছর বয়সের হাড্ডিসার মেয়েটাকে নিয়ে ওখানেই বাস করতে গেছে।’
ওদের মধ্যে একজন হেসে উঠল। মুখ তুলে তাকাল রনি। দুজন চোখ নামিয়ে নিলেও আধ বোজা চোখের লোকটা নির্ভীক ভাবে চেয়ে রইল।
‘তোমার বাড হ্যাডলের ওখানে যাওয়ার কথা আমাদের কানে এল,’ মন্তব্য করল সে। ‘ওখানে যাওয়ার কথা ভুলে যাও-ওখানকার লোকজন স্ট্রেঞ্জার মোটেও পছন্দ করে না।’
‘তাই নাকি?’ বিদ্রূপের স্বরে বলল রনি। ‘হয়তো আমাকে দেখে ওদের মত পালটাবে।’
এবার লম্বা লোকটা ওর কথার জবাব দিল, ‘তুমি যেতে চাচ্ছ যাও। হয়তো ওকে খুঁজেও পাবে-কিন্তু এর ফল ভাল হবে না!’ কথা শেষ করে গ্লাস নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল সে। সঙ্গী দুজনও ওর পিছু নিল। বাইরে ওদের মধ্যে একজন কি যেন বলল-একসাথে হেসে উঠল ওরা।
আড়চোখে বারটেণ্ডারের দিকে চাইল রনি। ‘ওদের তুমি চেনো?’
‘আজ দুপুর থেকে নিয়ে সারাদিন এখানেই কাটিয়েছে ওরা। ট্যারা লোকটা ওর ঘোড়ার খুরে নতুন নাল লাগাতে দিয়েছে। তারপর সবাই পশ্চিমে রওনা হবে।’
তথ্যটা জেনে নিজের মনেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবে দেখছে রনি। টাকাটার কথা কি ওরা জানে? হয়তো ওরা সাধারণ কাউহ্যাণ্ড—নতুন শহরে একটু রঙবাজি করছে? কিন্তু রনির মন বলছে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ওরা মোটেও সহজ লোক না। সবদিক বিচার করে সে সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে তার কাছ থেকে টাকাটা লুট করাই যদি ওদের উদ্দেশ্য হয়, তবে ওরা তা আজ রাতেই করবে-সম্ভবত এখনই। ওদের মিছে অপেক্ষা করিয়ে লাভ নেই। কয়েক মিনিট শহরের প্ল্যানটা ভাল ভাবে স্মরণ করে নিয়ে বারটেণ্ডারকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এল ড্যাশার।
সেলুনের উলটো দিকে জিন চড়ানো ঘোড়ার পাশে ওদের একজন বসে আছে। রনি বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিল সে। ওটা হঠাৎ খুব উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল। একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল রনির ঠোঁটে। একটা সিগনাল। ওরা ভেবেছেটা কি? সে একটা অজ্ঞ হাঁদারাম? নিচে নেমে ঘোড়ার পেটি আঁটার ফাঁকে সে আড়চোখে কম বয়সী লোকটাকে লক্ষ করছে।
ওখানে কেবল তিনটে জায়গা আছে, যেখানে দাঁড়ালে লোকে ওই সঙ্কেতটা দেখতে পাবে। হার্ডওয়্যার দোকানের ওপাশে একটা সরু ফাঁক রয়েছে। আরও একটু দূরে, লিভারি আস্তাবলের পাশের গলি থেকেও দেখা যাবে। তৃতীয়টা হচ্ছে উলটো দিকে শেরিফের অফিসের পাশে। বোকা ছাড়া আর কেউ লিভারি আস্তাবলের পাশে অপেক্ষা করবে না, কারণ গলিটার অন্য প্রান্ত ঘোড়ার করাল দিয়ে বন্ধ।
রাতটা বেশ ঠাণ্ডা। রাস্তার ওপাশে ওই লোকটার বসে থাকার মাত্র একটাই কারণ থাকতে পারে-রনি বার থেকে বেরোলে অন্যদের সাবধান করা। এখন রনি যেদিকেই যাক, ওদের তৈরি থাকতে হবে। সুতরাং বাকি দুজনকে দুদিকে থাকতে হবে।
অর্থাৎ হার্ডওয়্যার স্টোরের পাশে আর শেরিফের অফিসের কাছেই অপেক্ষা করছে ওরা। একজন ওকে থামাবে, বাকি দুজন পিছন দিক থেকে এগিয়ে আসবে। লোকটা কি পিস্তল ঠেকাবে? নাকি সিগারেট ধরাবার জন্যে আগুন চেয়ে সঙ্গীদের এগিয়ে আসার সময় দেবে? সহজ হলেও প্ল্যানটা চমৎকার।
পেটি শক্ত করে এঁটে ঘোড়ার পিঠে ওঠার জন্যে পাদানিতে পা রাখল রনি। তারপর, কি যেন মনে পড়েছে, এমন ভাব দেখিয়ে আবার সেলুনে ঢুকল। সেলুনের লোকজনের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে সোজা কামরা পার হয়ে পিছনের দরজা দিয়ে গলিতে নামল।
স্পারের শব্দ না তুলে সাবধানে দ্রুত হেঁটে শেরিফের অফিসের দিকে এগোল রনি। দালানটার পিছনে পৌঁছে সতর্ক ভাবে উঁকি দিল। অন্ধকারে সরু গলির মুখে সত্যিই একজন অপেক্ষা করছে। কঠিন একটা হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। নিঃশব্দে রনি লোকটার পিছনে এসে দাঁড়াল। ‘শিকার খুঁজছ?’ হালকা সুরে প্রশ্ন করল সে।
ট্যারা লোকটা ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল। একই সাথে পিস্তল বের করার জন্যে হাত বাড়াল। ড্যাশারের শক্ত মুঠির প্রচণ্ড ঘুসিটা পড়ল ওর চিবুকে। হাঁটু ভাঁজ হয়ে আসছে, দ্বিতীয় ঘুসিটা ঝুলে পড়া চোয়ালে আঘাত হেনে ওকে অজ্ঞান করে ফেলল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওর শিথিল দেহটা ঝপ করে মাটিতে পড়ল।
লোকটাকে টপকে গলির মুখে এসে দাঁড়াল রনি।
সংক্ষিপ্ত ধস্তাধস্তির শব্দে সন্দিগ্ধ হয়ে সিগনাল-দাতা তরুণ ঘোড়াটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এল। ‘ভাসকো? কি হয়েছে?’ নিচু স্বরে প্রশ্ন করল সে।
গলি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল রনি। ‘মতের বিরোধ!’
হঠাৎ সামনা-সামনি পড়ে গিয়ে থতমত খেল তরুণ। অভিজ্ঞতার অভাবে কথায় এড়াবার চেষ্টা না করে সরাসরি পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল সে।
সেলুনের ওপাশে লুকানো লম্বা লোকটাও এদিকে কিছু গোলমাল হয়েছে বুঝে আড়াল থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে এগোচ্ছে। ড্যাশারকে চেনার সঙ্গে সঙ্গে সেও পিস্তল বের করল।
রনি যে কখন পিস্তল বের করেছে দেখতে পেল না ওরা। কেবল নলের মুখে দুটো শিখা জ্বলে উঠতে দেখল। প্রথম গুলি লম্বা লোকটার বাম পকেট ফুটো করল-দ্বিতীয় গুলি বেল্টের দু’ইঞ্চি উপরে পেটে বিধল। দুজনের মধ্যে ও-ই বেশি বিপজ্জনক ছিল। তৃতীয় গুলিতে বিস্ফারিত চোখে হাঁটু গেড়ে পড়ে গেল তরুণ। ওর বুলেটটা রনির শার্টের হাতা টেনে বেরিয়ে গেল। চতুর্থ গুলিতে ছেলেটা পিস্তল ছেড়ে মুখ থুবড়ে পড়ল।
ঘুরে, দুই লাফে সরু গলিতে ফিরে এল ড্যাশার। ওখানে কেউ নেই! ট্যারা লোকটার ঘোড়ার খুরের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে।
গোলাগুলির শব্দে দরজা-জানালা দিয়ে লোকজন উঁকি দিচ্ছে। কিছু লোক রাস্তাতেও নেমেছে। হার্ডওয়্যার স্টোরের সামনে লম্বা লোকটার ওপর ঝুঁকে আছে দুজন। এগিয়ে গেল রনি। লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওকে চিত করল।
মারা যাচ্ছে ও। মাথাটা সামান্য তুলে ধরে ওকে একটু আরাম দেয়ার চেষ্টা করল ড্যাশার। মরণাপন্ন লোকটার ওপর তার কোন আক্রোশ নেই। তবে কোন দুঃখও বোধ করছে না। লোকটা নিজের পথ নিজেই বেছে নিয়েছে।
হঠাৎ চোখের পাতা খুলে গেল। লোকটা রনির দিকে তাকাল। ‘ফাস্ট!’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল সে। ‘তুমি খুব ফাস্ট!’
লোকটার শ্বাস ভারী। আরও লোকজন এগিয়ে আসার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ‘সরি,’ বলল সে।
‘এমন কেন করলে?’ প্রশ্ন করল রনি।
‘টাকা। ভাসকো দেখেছে।’
‘হ্যাডলের ব্যাপারটা কি? তোমরা ওকে চেনো?’
কয়েকবার চেষ্টার পর ওর মুখ থেকে কথা বেরোল। ‘চি…চিনি। ওখানে… যেয়ো…না। পারবে না। বাণ্ডি…শাৰ্পি…ভয়ানক।’
‘হ্যাডলের খবর কি? ওরা ভাল তো?’ লোকটার মরণ ঘনিয়ে এসেছে বুঝে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করল রনি।
কোন জবাব এল না। কথাগুলো হয়তো লোকটা বোঝেনি, ওর চেতনা এখন ঝিমিয়ে আসছে। তবু ঠোঁট নড়ে উঠল, কি যেন বলার চেষ্টা করছে ও। ‘হাসির…কথা…হাড্ডিসা…র!’ কথার সাথে লম্বা মানুষটার জীবনও ফুরাল।
উঠে দাঁড়িয়ে পিস্তল দুটোতে গুলি ভরে নিল রনি। তরুণ ছেলেটার কাছে কয়েকজন ভিড় করে আছে। ওদের মধ্যে বারটেণ্ডারকেও দেখা যাচ্ছে। সাদা এপ্রোনটা আছে ওর পরনে-হাতে একটা শটগান। ওদিকে এগোল ড্যাশার।
‘এদিককার কি খবর?’ বারটেণ্ডারকে প্রশ্ন করল সে।
অন্য একজন জবাব দিল। ‘মারা পড়েছে। দুটো গুলিই পেটে বিধেছে-ঠিক নাভির ওপর। একটা রূপার ডলার দিয়েই গর্ত ঢাকা যায়।’
‘ওদের সাথে আরও একজন ছিল!’ বলে উঠল বারটেণ্ডার। ‘সে কোথায়?’
‘ভেগেছে। তবে যাওয়ার আগে চোয়ালে একটা চোট নিয়ে গেছে।’
নিজের ঘোড়া, টপারের কাছে ফিরে এল রনি। জিনে উঠে বসতেই সাদা গেল্ডিঙটা পরিচিত ফিরতি ট্রেইল ধরল। রনির জন্যে বাক উইলিয়ামস র্যাঞ্চে অপেক্ষা করছে। দেরি দেখে নিশ্চয় এতক্ষণে অস্থির হয়ে উঠেছে বুড়ো।
র্যাঞ্চে ফিরে দেখল, সাপার খেতে বসেছে বাক। ওর স্ত্রী জেনি খাবার বেড়ে দিচ্ছে। শার্টের বোতাম খুলে টাকার প্যাকেটগুলো টেবিলে রাখল রনি।
‘সেই কখন বেরিয়েছ, আর ফেরার নাম নেই! আমার তো দুশ্চিন্তাই হচ্ছিল!’ অভিযোগ করল বাক।
‘দুশ্চিন্তা?’ টিপ্পনী কাটার সুযোগ ছাড়ল না রনি। ‘আমার ওপর কাজ চাপিয়ে দিয়ে নিজে দিব্যি একা-একা গিলতে বসে গেছ! তোমার চিন্তা করার অবসর আছে?’
‘ঠাট্টা রাখো। এত দেরি হলো কেন?’ চেহারা দেখেই অভিজ্ঞ বুড়ো টের পেয়েছে রনি কিছু একটা ঘটিয়ে এসেছে।
বাকের একমাত্র ছেলে বছর সাতেক আগে রাসলারদের গুলিতে মারা পড়েছে। অবশ্য র্যাঞ্চারের হাত থেকে ওরা কেউ রেহাই পায়নি। কিন্তু ছেলের শোকে চুল পেকে অকালেই বুড়ো হয়ে গেছে বাক। বছর ছয়েক আগে রনি বার ২০ র্যাঞ্চে কাউহ্যাণ্ড হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে সে র্যাঞ্চের সেকেণ্ড-ম্যান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব কাজেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বিচক্ষণতা আর সাহসের পরিচয় পেয়ে বাক ওকে একটু ভিন্ন নজরে দেখে। হয়তোবা নিজেও যৌবনে ওই রকম বেপরোয়া ছিল বলেই-কিংবা ছেলের অভাব কিছুটা পুরোন হওয়ার কারণে। একই রক্ত না হলেও ওদের মধ্যে সুন্দর একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
র্যাঞ্চারের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা চেয়ার টেনে সাপার খেতে বসে পড়ল রনি। বাককে আরও একটু না জ্বালিয়ে মুখ খুলবে না। প্লেটে রসাল মাংসের একটা বড় চাক আর সবজি তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করল। ওর কাপে কফি ঢেলে দিল জেনি।
‘কি হলো-শহরে কি ঘটেছে বললে না?’ তাড়া লাগাল বাক।
ধীরে-ধীরে শহরে যা-যা ঘটেছে সব খুলে বলল রনি। কেবল বাড় হ্যাডলের বিপদ সম্পর্কে আউটলর কথাগুলো চেপে গেল। রনির কথা শুনে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করল জেনি। আউটলদের সম্পর্কে কিছু মামুলি কথাবার্তা বলল বাক। কিন্তু রনির মন তখন অনেক দূরে-ট্রেইলে।
হ্যাডলে যদি সত্যিই কোন ঝামেলায় পড়ে থাকে তবে সময় মতই ওখানে পৌছবে রনি। চমৎকার মানুষ বাড। বিশাল আর কঠিন লোক-কিন্তু অতিথিপরায়ণ বলে ওর খ্যাতি আছে।
আউটল মরার আগে কিছু নাম উল্লেখ করেছিল-মনে পড়ল রনির।
কি যেন বলেছিল? বাণ্ডি আর শার্সি। শাৰ্পি!
চমকে উঠল রনি। কাপ নামিয়ে রাখতে গিয়ে টেবিলে ঠুকে গিয়ে একটু কফি চলকে পড়ল।
‘কি হলো?’ জানতে চাইল বাক। ধুরন্ধর চোখ দুটো জবাব খুঁজছে। কিছু মনে পড়েছে?’
‘কই, না তো?’
‘তোমাকে আমি ভাল মতই চিনি, রনি,’ বলল বাক। ‘বিশেষ একটা চিন্তা তোমার মাথায় এসেছে।’
কাপটা তুলে নিয়ে হাত দিয়ে টেবিল মুছল রনি। ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছুই হয়নি।
‘ডাগ মারফি ফিরেছে?’
বাকের চোখ উজ্জ্বল হলো। জেনির উদ্দেশে সে বলল, ‘দেখেছ? আমি জানতাম! একটা বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছে ও। নইলে এই সময়ে হঠাৎ মারফির কথা জিজ্ঞেস করত না!’
আরও এক চাক মাংস আর কিছু আলু ফর্ক বিধিয়ে নিজের প্লেটে তুলে নিল।
‘কেন? ওর কথা মনে আসাই তো স্বাভাবিক। ডাগ একজন টপ কাউহ্যাণ্ড। ল্যাসো ছোঁড়া আর ঘোড়া বশ করায় সে ডেড-শট ওয়াইলসের মতই ওস্তাদ!’
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রনির দিকে চেয়ে থাকল বাক।
‘হ্যাঁ, পিস্তলেও ওর হাত দারুণ। আর ডাগের মত ঝামেলার মোকাবিলা করতে তৈরি মানুষও আমি একটার বেশি দুটো দেখিনি!’
‘সেটা আবার কে?’ প্রশ্ন করল রনি।
‘বোঝো না? আমার মনে হয় বিপদের সাথে তোমার ঘনিষ্ঠ কোন আত্মীয়তা আছে। যেখানেই যাও, সেও হাজির! কত লোক শহরে যাচ্ছে-আসছে, কিছুই ঘটে না-কিন্তু তুমি গেলে কিছু-না-কিছু ঘটবেই!’
‘এই ট্রিপে কিছু ঘটার চান্স নেই,’ নির্বিকার চেহারায় মিথ্যা বলল রনি। ‘তোমার টাকা আমি নিরাপদে বাডের কাছে পৌঁছে দেব।’
বাককে সান্ত্বনা দিল বটে, কিন্তু শার্পির নামটা ওকে ভাবিয়ে তুলেছে। অবশ্য শার্পি নামের আরও অনেক লোক থাকতে পারে। বাণ্ডি তার অপরিচিত। এক শার্শির কথা সে শুনেছে, এবং যা শুনেছে তার পুরোটাই খারাপ।
শার্সি বুমার প্রথমে মোষ শিকারি ছিল। পরে শিকার ছেড়ে পশ্চিমের একটা বুনো শহরে মার্শাল হিসেবে কাজ নেয়। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারল না- যথেচ্ছ হত্যার কারণে তার চাকরি গেল। ওখান থেকে সরে লোকটা এওয়ার্থ, অ্যাবিলিন, ডজ, সিমেরন, ব্লুফিল্ড, ইত্যাদি শহরে ঘুরেছে। প্রত্যেক শহরেই পিস্তলের লড়াইয়ে সে মানুষ মেরেছে। তারমধ্যে অন্তত দুটো ছিল স্রেফ খুন। বদমেজাজ আর কথায়-কথায় পিস্তল তোলার অভ্যাসের কারণে বন্ধুর বদলে কেবল শত্রুই বেড়েছে ওর।
এরপর হঠাৎ করেই গা-ঢাকা দিয়েছে শার্সি। নেভাডা আর মনট্যানার মাইনিঙ ক্যাম্পে গুজব শোনা যায় যে লোকটা ক্যালগেরিতে একজন মাউন্টেড পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে ওখান থেকে সরে পড়েছে। শহরে ওই মরণাপন্ন আউটল যদি এর কথাই বলে থাকে, তবে সত্যিই বিপদের কথা। শার্পি একটা জঘন্য প্রকৃতির খুনী।
কিন্তু বাড হ্যাডলের র্যাঞ্চে ওই ধরনের লোক কি করছে? ভেবে পাচ্ছে না রনি। তাছাড়া পিস্তলবাজের ভয়ে ভীত হওয়ার লোক নয় বাড। হয়তো মিছেই দুশ্চিন্তা করছে ও।
‘সকালেই রওনা হব আমি,’ বলে উঠল সে। ‘এই লম্বা যাত্রায় ধীরে-সুস্থেই এগোব। কিছু কঠিন এলাকা পেরোতে হবে-তাই ঝুঁকি না নিয়ে কেবল দিনের বেলায় পথ চলব।’
‘আমিও তোমার সাথে রওনা হব কি না ভাবছি,’ পরিস্থিতি বোঝার জন্যে কথা পাড়ল বাক। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। ‘লম্বা পথ। অ্যাপাচিরা আবার রেজারভেশন থেকে বেরিয়ে পড়েছে কিনা কে জানে?’
জেনি কি যেন বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই সশব্দে হেসে উঠল রনি।
‘তোমার কি ধারণা আমার একজন নার্সমেইড দরকার? তুমি এখানে এদিকটা সামলাও। হ্যাডলের টাকা পৌঁছে দিয়ে ওখানে কয়েকদিন বিশ্রাম করার ইচ্ছা আছে আমার।’
উঠে দাঁড়াল রনি। ‘আচ্ছা, সুজানার লেখা শেষ চিঠিটা কি আছে তোমার কাছে?’
‘আছে। কিন্তু ওটা দিয়ে কি হবে? চিঠিটা তো তোমাকে পুরোটাই পড়ে শুনিয়েছি আমি?’
‘হ্যাঁ। তবু নিজে একবার পড়ে দেখতে চাই।’
বাঙ্কহাউসে ফিরে চিঠিটা পড়তে বসল। একটা জায়গায় মেয়েটা লিখেছে:
রনিকে বোলো, ওর কাছে যেসব খেলা আমি শিখেছিলাম সেগুলোর কথা আমার খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে যেটা আমি সবথেকে বেশি পছন্দ করতাম সেটার কথা। বাবাও প্রায়ই ড্রাই ক্যানিয়নে ওর সাথে প্রথম দেখা হওয়ার কথা স্মরণ করে। অনেকটা সেই রকমই আছি। রনি এলে আমাদের খুব ভাল লাগবে।
রনির মনে আছে, রাসলাররা হ্যাডলেকে ড্রাই ক্যানিয়নে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। ওই সময়ে রনি ওখানে না পৌছলে র্যাঞ্চারের বাঁচার কোন উপায় ছিল না। চারজন রাসলারের মধ্যে দুজন রনির গুলিতে মারা পড়ার পর বাকি দুজন আত্মসমর্পণ করেছিল।
চিঠিটার ওপর আর একবার চোখ বুলিয়ে কাগজ-পেনসিল নিয়ে বসল রনি। যেসব অক্ষরের ওপর দুবার কলম ঘোরানো হয়েছে, কেবল সেগুলো কাগজে লিখে ফেলল।
‘ন-ধা-ব-সা-ব-খ-ছি-আ-দে-প-বি’
এবার অক্ষরগুলো উল্টো করে আবার সাজিয়ে লিখল:
‘বিপদে আছি খুব সাবধানত’
সাধারণ চিঠির ভিতর এভাবে গোপন মেসেজ পাঠানোই ছিল সুজানার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। এর আগে চিঠিটা রনিকে পড়ে শোনানো হয়েছিল বলে ব্যাপারটা সে টের পায়নি। তাছাড়া ওরা যে বিপদে থাকতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেনি ও। এখন বুঝতে পারছে শুধু বিপদ নয়, কঠিন বিপদে পড়েছে ওরা। চিঠিতে স্পষ্ট করে কিছু লেখার স্বাধীনতাটুকুও নেই। অর্থাৎ চিঠি সেন্সর করছে কেউ।