ক্ষ্যাপা তিনজন – ৩

তিন

ঠগ আর বদমায়েশের আখড়া হয়ে গড়ে উঠেছে ছোট্ট হর্স স্প্রিঙস। ওল্ড করাল সেলুনকে ঘিরেই ওটা গড়ে উঠেছে। সেলুনের মালিক ক্রদার্স হলেও, ওর কর্মচারী স্যাম হাডসনই সব দেখাশোনা করে।

হর্স স্প্রিঙসে নতুন কোন পিস্তলবাজ এলে তাকে যাচাই করে দেখা স্যামের একটা রুটিন-বাঁধা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদের তিনটে শ্রেণীতে ফেলা হয়: যারা শার্পি বুমারের কাছে মূল্যবান হবে; যারা খামোকা রুস্তম বা ধোঁকাবাজ; এবং যারা আইনের লোক।

কিন্তু আজ বিকেলের দিকে যে লোকটা পৌঁছেচে, যার নাম রেড রিভার রেগান, তাকে কোন শ্রেণীতে ফেলা যায় তা বুঝে উঠতে পারছে না।

নির্বিকার ভাব নিয়ে অপেক্ষায় আছে স্যাম। কিন্তু নতুন লোকটা কিছুই প্রকাশ করছে না-একটা মন্তব্যও না।

‘থাকছ?’ শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন করল স্যাম।

‘হয়তো। খাবার কেমন?’

‘একেবারে সেরা।’ স্যাম ভাল খাবার পছন্দ করে। তাই উৎসাহ দেখাল। ‘পেশাদার রাঁধুনী!’

‘তাহলে হয়তো কিছুদিন থাকব।’

‘কাজ খুঁজছ?’

‘হয়তো। তেমন জরুরী না।’ রনির শান্ত নীল চোখ স্যামের ওপর এসে স্থির হলো। ‘তুমি স্যাম?’

‘হ্যাঁ, তুমি কিভাবে জানলে?’

‘ক্লিফটনের এক লোক তোমার কথা বলেছিল। ওর নাম ডীন।’

নড করল স্যাম। ডীন ওকে পাঠিয়ে থাকলে যাচাই করেই পাঠিয়েছে। সতর্ক লোক ডীন। সে নিজেও সাবধানী, কারণ শার্সি বুমারের হয়ে কাজ করতে হলে ভুল এড়িয়ে চলাই ভাল।

‘ওকে কতদিন হলো চেনো?’

‘মোটেও চিনি না। অল্প কিছু কথা হয়েছে মাত্র।’

দরজা ঠেলে একটা লোক ভিতরে ঢুকল। বারের পিছনে আয়নায় জনি রিগকে দেখা গেল। দেঁতো গানম্যান ধীর পায়ে বারের দিকে এগিয়ে এল। ওর ‘হাওডি’র জবাবে নড করল রনি। রাই হুইস্কির অর্ডার দিল রিগ।

আড়চোখে স্যামের দিকে তাকাল ড্যাশার। ‘খাবার?’

‘ওদিকে।’ তোয়ালে হাতে দিক নির্দেশ করল সে। ‘বীফ আর বীস্। কিন্তু এমন সুস্বাদু বীন্‌স্‌ কম লোকেই খেয়েছে।’

‘ক্রিওজোটের আগুনে বেক করা?’

‘হ্যাঁ।’ সমঝদার বুঝে প্রসন্ন হলো স্যাম। ‘অবশ্যই! রাঁধুনী আর কোন ভাবে বেক করতে নারাজ।’

প্রশস্ত দরজা দিয়ে খাবার-ঘরে ঢুকল রনি। ভিতরে দুটো ‘পটবেলি’ স্টোভ জ্বলছে। সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই। সাত হাজার ফুট উঁচুতে এখানে সূর্য ডোবার পর চারপাশ দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

গোটা ছয়েক টেবিল রয়েছে ভিতরে, কিন্তু কাস্টমার মাত্র একজন। লোকটার পরনে ধূসর টুঈডের স্যুট আর কালো ফ্ল্যাট-টপ হ্যাট। ঠোঁটের ওপর সরু করে ছাঁটা গোঁফ, আর চিবুকের কাছে সামান্য কিছুটা দাড়ি। লোকটা তার কালো চোখ তুলে রনিকে এক-নজর দেখে নিজের খাওয়ায় মন দিল।

মিনিটখানেক পরে ছোট আকৃতির চটপটে একটা মেয়ে রনির অর্ডার নিয়ে গেল। এই সময়ে জনি রিগ এসে রনির টেবিলেই বসল। অন্য টেবিলে বসা লোকটাকে জনি চেনে কিনা তা ওর ভাবে বোঝা গেল না।

‘এই এলাকা র‍্যাঞ্চ করার জন্যে ভাল?’ চোখ তুলে প্রশ্ন করল ড্যাশার।

‘খুব ভাল, যদি অ্যাপাচিদের সাথে শান্তি বজায় রাখতে পারো।’

‘আশপাশে বড় র‍্যাঞ্চ আছে?’

‘কম। বেশিরভাগ ছোট।’

‘সার্কেল এইচ কেমন?’ রনি টের পেল স্যুট পরা লোকের মাথাটা একটু ফিরল। না শোনার ভাব দেখিয়ে শুনছে। ‘ওদের অনেক গরু আছে?’

‘কিছু।’ কথা বলার আগ্রহ দেখাচ্ছে না রিগ।

‘শুনেছি বাড় হ্যাডলে দাপটের লোক,’ বলে চলল রনি, ‘মনে হয় না রাসলাররা ওকে ঘাঁটাতে সাহস পাবে।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রিগ জোরের সাথে বলল, ‘সার্কেল এইচকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পায় না!’

কথাটার যেন আরও গূঢ় কোন অর্থ আছে, ভাবছে রনি। নাকি বাড ভালই আছে এবং রাসলারদের ঠেকাবার ক্ষমতা রাখে? ওই স্যুট পরা লোকটার সম্পর্কে কৌতূহল হচ্ছে ওর।

খেতে-খেতে ভাবছে ড্যাশার। হ্যাডলে আর সুজানার সাথে যত জলদি দেখা করা যায় ততই ভাল। কিন্তু এই দেশে অন্ধের মত এগোনোও ঠিক হবে না। হর্স স্প্রিঙসে কিছু সময় কাটালে সেটা বৃথা যাবে না।

কফি শেষ করে আস্তাবলে গিয়ে সহিসের সাথে বেশ কিছুটা সময় কাটাল ড্যাশার। কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেস করা যাচ্ছে না বলে কাজের তথ্য জোগাড় হলো না। নিজের পরিচয় বেশিদিন গোপন রাখা ওর পক্ষে সম্ভব হবে না, কারণ ভাসকো এদিকেই কোথাও আছে।

সেলুনে ফিরে দেখল পোকার খেলা চলছে। খেলতে বসার ইচ্ছা ওর নেই। জনিকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে ওর কাছেই একটা আসনে বসল।

‘মরগ্যান বাড়ি ফিরে গেছে?’ আলাপ জমাবার চেষ্টা করল রনি

মুখ তুলে তাকিয়ে হাসল রিগ। ‘হ্যাঁ। সে তোমার খুব প্রশংসা করছিল। বলেছে তুমি না থাকলে ওরা মারা পড়ত সন্দেহ নেই।’

‘ভাল র‍্যাঞ্চ করেছে?’

‘মোটামুটি চলছে।’

‘ম্যাকক্লিল্যানটা কেমন?’

‘কাউ-টাউন। কিছু মাইনিঙও আছে। আগে ওখানে সৈন্যও থাকত।

‘টাকাওয়ালা শহর?’

কাঁধ উঁচাল রিগ। ‘মাঝেমাঝে। ওদিকে একটা বড় মাইন আছে। তাছাড়া র‍্যাঞ্চাররা যখন টাকা দেয় অনেক টাকা জমে।’

‘শুনলাম ওখানে একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছে?’

চোখ তুলে তাকাল রিগ। সতর্ক হয়ে উঠেছে। ‘তোমাকে কে বলল?

মাথা হেলিয়ে টেক্সাসের দিকে ইঙ্গিত করল ড্যাশার। ‘ওদিকের ট্রেইলে একজন বলছিল, ম্যাকক্লিল্যান থেকে চিঠি পেয়েছে।’

‘হ্যাঁ, ব্যাঙ্কে লুট হয়েছে।’

‘ধরা পড়েছে কেউ?’

শব্দ করে হাসল রিগ। ‘ওরা ধরবে? সাহসই পায়নি।’

‘ভীতু শেরিফ?’

অস্বস্তি বোধ করছে গানম্যান। কথা যেদিকে মোড় নিচ্ছে সেটা ওর পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু আবার এই রেগান লোকটার সাথে যেন একটা পেশাগত মিল খুঁজে পাচ্ছে। ‘ঠিক ভীতু নয়, হয়তো গোলাগুলি এড়িয়ে চলতে চায়।’

হাসল রেড রিভার রেগান। ‘ধনী শহরে দুর্বল শেরিফ থাকা ভাল না।’ এক মিনিট চুপ করে থেকে সে আবার বলল, ‘ওই ব্যাঙ্ক আবারও ঝামেলায় পড়তে পারে।’

‘তার মানে?’

কাঁধ উঁচাল রনি। ‘বলা যায় না, হয়তো কিছু লোক ভাবতে পারে -মুখ তুলে গানম্যানের চোখে চোখ রাখল সে-’যে আরও একবার লুট করার এটাই উপযুক্ত সময়। একটা ডাকাতির পর আরও একটার কথা ওরা কেউ ভাবতেও পারবে না।’

চিন্তায় জনি রিগের কপালে ভাঁজ পড়ল। পরিকল্পনাটা চমৎকার। লোকটা কি ওকে বাজিয়ে দেখছে? কে ও? চোখ তুলে দেখল স্যাম ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। হঠাৎ অস্থির বোধ করে উঠে দাঁড়াল সে।

‘রাত বাড়ছে, আমি চললাম।’

‘দেখা হবে,’ বলল রনি। ‘তুমি আবার কখনও এলে হয়তো ওই ব্যাপারে আরও আলাপ করা যাবে।’

একটু ইতস্তত করে মাথা নাড়ল জনি রিগ। ‘তুমি আমার কাছে হেঁয়ালিই রয়ে গেলে, রেগান,’ নিচু স্বরে বলল সে। ‘তোমাকে বোঝা কঠিন। কিন্তু এই এলাকায় নতুন এসে ওসব ব্যাপারে মাথা ঘামানো তোমার ঠিক হবে না। এখানে স্থানীয় লোকই স্থানীয় কাজ সামলায়।’

চোখে কঠিন ভাব ফুটিয়ে তুলল ড্যাশার। ‘মানে তুমি?’ ওর স্বরে চ্যালেঞ্জের আভাসে একটু আড়ষ্ট হয়েও নিজেকে সামলে নিল রিগ।

‘না,’ বলল সে। ‘মানে অন্য লোক, যারা কারও নাক গলানো পছন্দ করে না!’

গানম্যান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে নিজের কামরায় এল রনি। একটা একটা করে বুট খুলে সশব্দে মেঝের ওপর ফেলল। তারপর হ্যাট খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিল-কিন্তু ঘুমাল না।

বেশ কিছুটা দক্ষিণে সার্কেল এইচে বিছানার ওপর বসে শার্পি বুমার একটা পাতলা গড়নের লোকের কথা শুনছে। লোকটার একটা চোখ আধ বোজা।

‘ওর কাছে নগদ পনেরো হাজার ডলার আছে! এবং টাকাটা নিয়ে সোজা এখানেই আসছে সে!’

শার্পি লোকটা লম্বা। ওর কাঁধের চেয়ে পাছা বেশি চওড়া হলেও, কাঁধে থোকা-থোকা পেশি আছে। ভাসকোর দিকে চতুর দৃষ্টি স্থির রেখে সে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে তোমার সঙ্গী দুজনকেই ও শেষ করেছে?’

নার্ভাস বোধ করছে ভাসকো। ‘হ্যাঁ।’ ঠোঁট চাটল লোকটা। ‘আমার ওপর পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাবু করে ওদের মোকাবিলা করেছে। তুমি তো জানো ছেলেটা কাঁচা ছিল। তবু, ওই লোক দারুণ ফাস্ট না হলে দুজনকে একসাথে শেষ করতে পারত না।’

‘লোকটার নাম জানো?’

মাথা ঝাঁকাল ভাসকো। ‘ও একটা সাধারণ কাউহ্যাণ্ড। শহরের কাছেই থাকে।’

‘নামটা কি?’ বিরক্তি প্রকাশ পেল ওর স্বরে।

‘ড্যাশার।’

‘কে?’ সিধে হয়ে বসল শার্সি। ‘রনি ড্যাশার?’

‘হ্যাঁ।’ শার্পির প্রতিক্রিয়ায় অবাক হয়েছে সে। ‘ওকে তুমি চেনো?’

নাক দিয়ে একটা শব্দ করল শার্সি। ‘বার টোয়েন্টির লোক। আমার সাথে সামনা-সামনি দেখা হয়নি বটে, কিন্তু ওর কথা আমি শুনেছি। ঝানু পিস্তলবাজ- সাক্ষাৎ শয়তান! আমার কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে ওর মোকাবিলা হয়েছে, সেই বন্ধুরা এখন কবরে।’

নীরবে দাঁড়িয়ে আছে ভাসকো। এত অল্পে রক্ষা পেয়ে গেছে বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে ওর। যার নাম শার্সি বুমারের মত লোককে বিচলিত করে তুলতে পারে, সে সহজ লোক নয়।

উঠে দাঁড়াল শার্পি। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা লোকটার পাশে ভাসকোকে খাটো দেখাচ্ছে। ভাসকোকে উপেক্ষা করে এগিয়ে পাশের কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল সে। ওপাশের দরজার তলা দিয়ে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। কামরা পেরিয়ে বন্ধ দরজার তালা খুলে নক করল।

‘কে?’ একটা মেয়ে শঙ্কিত স্বরে সাড়া দিল।

‘শার্সি। দরজা খোলো।’

হুড়কো নামানোর আওয়াজের পর দরজা খুলে গেল। মেয়েটা একপাশে সরে দাড়াল।

কামরাটা বড়। বেশ রুচিশীল আসবাবপত্র। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। সাথে একটা পটবেলি স্টোভও ঘর গরম রাখার জন্যে জ্বালানো আছে। বই আর কাগজ-পত্র প্রচুর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোন অস্ত্র ওখানে নেই। ঘরে দুজন থাকে। মেয়েটা; আর কম্বলে পা ঢেকে চেয়ারে বসা বিশাল আকৃতির এক বুড়ো।

বাড হ্যাডলে ঠিক বুড়ো নয়; মাঝ-বয়সী। কিন্তু গত কয়েক মাসে ওর বয়স অন্তত বারো বছর বেড়ে গেছে। ঢাল বেয়ে নিচে নামার সময়ে ওয়্যাগন উলটে রুক্ষ পাথরের ওপর আছাড় খেয়ে ওর দুই ঊরু, কোমরের হাড়, আর কলারবোন ভাঙার পর এখন এই অবস্থা। কয়েক মাস বিছানায় পড়ে থাকার সুযোগে শার্পি বুমার কৌশলে র‍্যাঞ্চের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।

এখন হ্যাডলে আর সেই আগের হ্যাডলে নেই, কেবল কাঠামোটাই পড়ে আছে। নিজের এই অক্ষমতা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে আরও ভেঙে পড়েছে সে। নিজের বা মেয়ের জন্যে কিছুই করার উপায় নেই ওর। সুজানা আঠারোয় পা দিয়েছে। চমৎকার ছিপছিপে গড়ন, সুন্দর কোমল চেহারা। কিন্তু শার্পির দিকে যখন তাকাল, চোখে কোমলতার বিন্দুমাত্র আভাস থাকল না।

‘রনি ড্যাশার কিজন্যে আসছে?’ কঠিন স্বরে বাডের কাছে জানতে চাইল শার্পি।

হ্যাডলের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘ড্যাশার? এখানে আসছে?’ দাঁত বের করে হাসল সে। ‘তুমি কি এখনই বিদায় নিচ্ছ? নাকি সীসা হজম করার জন্যে থাকবে?’

‘বোকার মত কথা বোলো না!’ ধমকে উঠল শার্পি। ‘তুমি ওর কাছে টাকা পাও?’

‘ওর কাছে? এক পয়সাও না! অবশ্য বাক উইলিয়ামসের কাছে পাই,’ চিন্তাগ্রস্ত ভাবে বলল বাড। ‘হয়তো ওই টাকাই সে আনছে।’

সুজানার দিকে ফিরল শার্পি। মেয়েটার চোখে বিজয়-উল্লাস দেখে চতুর গানম্যানের মন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। র‍্যাঞ্চটা পুরোপুরি নিজের আয়ত্তে আসার আগে, বাইরের কারও মনে সন্দেহ না জাগাবার উদ্দেশ্যে, মেয়েটাকে সে মাঝেমাঝে চিঠি লিখতে দিয়েছে বটে, কিন্তু প্রত্যেকটা চিঠি পোস্ট করতে দেয়ার আগে সে নিজে পড়ে দেখেছে। সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পায়নি। শার্পি বোকা নয়, সে আঁচ করছে এই সময়ে এখানে আসার পিছনে হয়তো ড্যাশারের গূঢ় কোন মতলব থাকতে পারে।

‘ও এখানে এসে পৌঁছবে মনে করে আশায় বুক বেঁধে বোকার মত কিছু করে বোসো না,’ ওদের সাবধান করল শার্পি। ‘আমার অজান্তে কেউ এই র‍্যাঞ্চে পৌঁছতে পারবে না। জানো’-ওর স্বরে গর্ব প্রকাশ পেল-’এই এলাকার সত্তর মাইলের মধ্যে কেউ এলেই সে-খবর আমার কাছে আসে। চারদিকের যেখানেই ওকে দেখা যাক, আমি জানব।’

‘তাহলে এখনও পৌছেনি ও?’ প্রশ্ন করল সুজানা। শার্পির প্রথম প্রশ্নে সে ধরে নিয়েছিল রনি কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

‘ড্যাশার?’ মাথা নেড়ে একটা চেয়ারে বসল সে। ‘না, আশপাশে কোথাও নেই। ওই গাধা ভাসকো আর তার দুই সঙ্গী ওকে টুইন রিভার্সে ব্যাঙ্ক থেকে পনেরো হাজার ডলার তুলতে দেখেছে। ওরা ড্যাশারকে চেনে না, মনে করেছিল কাজটা সহজ হবে।’

‘ভাসকো মারা গেছে?’ খুশি হয়ে উঠল বাড।

বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকাল শার্সি। ভাবল, লোকটার প্রায় পঙ্গু অবস্থা, আউটলদের কবলে পড়ে সে সর্বস্ব হারাতে চলেছে, তবু নিৰ্ভীক; উদ্যম হারায়নি।

‘না, সে মরেনি,’ জবাব দিল গানম্যান। ‘চোয়ালে আঘাত পেয়েছিল, তবে এখন আবার ঠিক মতই খেতে পারছে। কেবল ওর সঙ্গী দুজন মরেছে।’

খুশিতে হেসে উঠল বাড। ‘ওহ্, ড্যাশার যদি তার দলবল নিয়ে এই মুহূর্তে এখানে হাজির হত! কিংবা কেবল ড্যাশার আর ডাগ মারফি! তোমাদের শায়েস্তা করার জন্যে ওরা দুজনই যথেষ্ট!’

বিরূপ মন্তব্যের জবাবে নাক দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করল শার্পি। ‘বোকার মত কথা বলছ! ড্যাশার এই রকম কঠিন লোকজনের বিরুদ্ধে কখনও দাঁড়ায়নি। এতদিন শুধু সাধারণ চোর আর ছ্যাঁচড়দের সাথেই লড়েছে ও।’

উঠে দাঁড়াল শার্পি। ‘বাড়, আগামীকাল সই করার জন্যে কিছু কাগজ-পত্র নিয়ে আসব আমি। তুমি তৈরি থেকো।’

‘আমি সই করব না!’ কিন্তু ওর স্বরে ততটা জোর এল না।

কাঁধ উঁচাল শার্পি। এই ধরনের প্রতিবাদ সে আগেও শুনেছে। সে জানে ওকে কিভাবে কাবু করতে হয়। ‘তোমার মেয়ের কোন অঘটন ঘটতে পারে ভেবেই তুমি তা করবে,’ স্থির বিশ্বাস নিয়ে বলল গানম্যান।

‘আমার সবকিছু নেয়ার পরেও তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রাখবে তা আমি কিভাবে জানব? এখনই আমার শক্ত হওয়া দরকার।’

‘না, জানো না,’ নির্লিপ্ত স্বরে বলল শার্পি। ‘মোটেও না। কিন্তু তুমি জানো, রাজি না হলে সুজানাকে আমি নিজে উপভোগ করে আমার লোকজনের হাতে তুলে দেব। এটা যতদিন ঠেকাতে পারো সেটাই তোমার লাভ।’

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দরজায় তালা দিয়ে চলে গেল শার্সি। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই সুজানা বলল, ‘আমিই রনিকে আসতে বলেছি, ড্যাডি।’

‘তুই? কিভাবে?’ অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকাল বাড।

‘শেষ চিঠিতে। আমরা কোড মেসেজ পাঠাবার খেলা খেলতাম, মনে আছে? ওই ভাবে।’

‘কিন্তু ও যে চিঠিটা ওই ভাবে পড়বে তা তুই কিভাবে জানিস?’ সন্দেহ প্রকাশ করল বাড। ওর মনে আশা জাগছে। কিন্তু শার্পির এত লোকজন রয়েছে, রনি একা কি করবে? তবে অতীতে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ও।

‘চিঠিতে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছি, হয়তো ও বুঝবে। তাছাড়া টাকা দিতে এলেও সে টের পাবে এখানে কিছু গোলমাল আছে।’

‘যদি পৌছতে পারে।’

ক্ষীণ একটা আশা। কিন্তু অসম্ভব। শাৰ্পি অত্যন্ত ধূর্ত লোক, এবং অ্যাপাচির মত নির্দয়। ওর প্রত্যেকটা কাজে সতর্ক প্ল্যানিঙের পরিচয় পেয়েছে বাড। ওর সাথে আছে চৌকস আর তীক্ষ্ণবুদ্ধি বাণ্ডি বুল। ব্যবসার সব লেনদেন সে-ই সামলায়।

শার্পি বুমার ভবঘুরে রাইডার হিসেবে একটা রাত কাটাবার জন্যে সার্কেল এইচে আশ্রয় নিয়েছিল। পরে শিকার করার অছিলায় আরও কয়েকদিন থাকার অনুমতি নিয়ে র‍্যাঞ্চের কাজে সাহায্য করা শুরু করে। এই অ্যাপাচি এলাকায় ভাল কাউহ্যাণ্ড পাওয়া দুষ্কর, তাই কিছুটা কৃতজ্ঞই বোধ করেছিল বাড।

শার্পির কীর্তিকলাপ বাডের অজানা ছিল না। কিন্তু লোকটা চুপচাপ আর বন্ধুসুলভ ছিল। তারপর বাডের যোগ্য ফোরম্যান চার্লি হর্স স্প্রিঙসে পিস্তলের লড়াইয়ে মারা পড়ল। তখন কেউ ভাবেনি ওই ঘটনার সাথে শার্পির কোন যোগাযোগ থাকতে পারে। জনি রিগ আর ভাসকোর হাতেই মারা পড়েছে চার্লি। কি নিয়ে বিবাদ তা কেউ জানে না। ক্রস ফায়ারে ঘটনাস্থলেই শেষ হয়েছে ফোরম্যান।

ওই ঘটনার তিনদিন পর র‍্যাঞ্চের চারজন পুরানো কাউহ্যাণ্ড অ্যামবুশে মারা পড়ল। শোনা যায় ওটা ইণ্ডিয়ানদের কাজ। ওই সময়ে শার্পির উপস্থিতিতে বাড়ের সুবিধাই হয়েছিল। কাউহ্যাণ্ডদের মতই কাজ করত সে, কিন্তু বেতন নিতে রাজি হয়নি। এর পরেই দুর্ঘটনায় বিছানায় পড়ল বাড। এবং না বুঝে শার্পির মাধ্যমেই কর্মচারীদের নির্দেশ পাঠাত

বাড যখন মৃত্যুর সাথে লড়ছে, আর সুজানা বাপের সেবায় ব্যস্ত, সেই ফাঁকে কর্তৃত্ব নিয়ে ফেলল শার্সি। ওকে দিয়েই বাড সব নির্দেশ জারি করছে বলে সে ফোরম্যান হয়ে বসল। কাউহ্যাণ্ডরা কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেল না।

প্রথমেই নিজেকে কাজের লোক বলে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিল বুমার। সুজানাও ওকে বন্ধু বলেই জানত। ভিতরে-ভিতরে কি ঘটছে সেটা টের পেল যখন জানল ভাসকো আর জনি রিগকে কাজে নিয়েছে শার্পি। ওদের বরখাস্ত করার নির্দেশ দিল মেয়েটা, কিন্তু আপত্তি জানাল সে। সুজানা শক্ত হওয়ায় শেষে রাজি হলো শার্সি। কয়েকদিন ওদের আর দেখা গেল না। এই সময়ে তিনজন পুরানো কাউহ্যাণ্ডকে বিনা কারণে বরখাস্ত করল নতুন ফোরম্যান। ওদের একজন হর্স স্প্রিঙসে মুখ খুলেছিল। কয়েক ঘণ্টা পর ওর মৃতদেহ পাওয়া গেল একটা গলিতে।

থমথমে ভাব নেমে এল র‍্যাঞ্চের ওপর। বাড হ্যাডলে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে বটে, কিন্তু বুঝতে পারছে খোঁড়া হয়েই তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে। কি ঘটছে তা টের পাচ্ছে সে, কিন্তু কিছুই করার উপায় নেই। শেরিফের কাছে খবর পাঠাবার চেষ্টা করেছিল, চিঠিটা র‍্যাঞ্চ ছেড়ে যেতে দেয়া হয়নি। সুজানা নিজে যাওয়ার চেষ্টা করে দেখেছে বাড়িটা পাহারা দেয়া হচ্ছে।

নিজের বাড়িতেই ওরা বন্দি। র‍্যাঞ্চ কর্মচারী সবাই শার্পির লোক। একদিন শার্পি নিজেই এসে শান্ত স্বরে বর্তমান পরিস্থিতি কি জানিয়েছে।

চালকের আসনে বসেছে শার্সি। স্পষ্টই সে বলেছে ওরা যদি তার কথা মত আদেশ মেনে চলে তবেই বাঁচবে, নইলে মারা পড়তে পারে। একা পেয়ে সুজানাকে ইঙ্গিত দিয়েছে যে তাকে সাহায্য করলে ওর বাবা নিরাপদ থাকবে। এবং বাডকে বলেছে কথা মেনে না চললে মেয়েটার বিপদ ঘটবে।

শার্পি ভাল করেই জানে বাড়ের প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধব আছে। প্রথমে সে ভেবেছিল গরুগুলো বিক্রি করে টাকা নেবে। কিন্তু র‍্যাঞ্চটা ওকে প্রলুব্ধ করেছে। শেষে পুরোটাই হাতিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরে তদন্ত হোক এটা সে চায় না। তাই আইন-সম্মত ভাব বজায় রেখে সতর্কতার সাথে কাজ করছে, যেন পরে ওর মালিকানা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে না পারে।

শার্পি গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে যে বাড তাকে পার্টনার হিসেবে নিয়েছে, পরে হয়তো পুরোটাই ওর কাছে বিক্রি করে দেবে। হ্যাডলের অত্যন্ত অসুস্থ থাকার খবরও সে নিয়মিত প্রভাবশালী মহলে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। এবং র‍্যাঞ্চারকে হুমকি, চাপ, আর এমন কঠিন নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, যে কেবল এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে হলেও বাডকে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হবে।

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। সবাই জানছে র‍্যাঞ্চার অত্যন্ত অসুস্থ থাকায় বর্তমানে কারও সাথে দেখা করছে না, এবং মেয়েটাও তার বাবার পাশ থেকে নড়ে না।

.

দুপুরের দিকে জনি রিগ র‍্যাঞ্চে পৌঁছল। ওকে র‍্যাঞ্চহাউসে ঢুকতে দেখে শার্পি মুখ তুলে তাকাল।

‘বস্, হর্স স্প্রিঙসে আমাকে একজন খুব চমকে দিয়েছে,’ জানাল রিগ। ‘ম্যাকক্লিল্যানের ব্যাঙ্কটা আবার লুট করার প্রস্তাব দিল। ওকে কঠিন লোক বলেই মনে হলো—দুটো পিস্তল ঝোলায়। তোমার কাজে লাগতে পারে।

মাথা নাড়ল বুমার। ‘বাড়তি লোকের এখন প্রয়োজন নেই।’ হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় আসতেই সোজা হয়ে বসল সে। ‘লোকটার নাম কি? চেহারা কেমন?’

‘ওর নাম রেগান,’ বলল রিগ। ‘কালো চুল, তীক্ষ্ণ একজোড়া নীল চোখ, মনে হয় যেন সব ভেদ করে দেখতে পাচ্ছে—’

উঠে দাঁড়াল শার্পি। ‘কালো চুল? কাঁধ দুটো একটু সামনের দিকে ঝোঁকানো?’ জনিকে নড করতে দেখে শার্পির চোখ সরু হলো। তাড়া দিল সে, ‘যাও! এখনই ভাসকোকে নিয়ে আড়াল থেকে লোকটাকে দেখাও! এখনই!’

‘নিশ্চয়, বস্।’ হ্যাটটা মাথায় পরল জনি। ‘তোমার মনে হচ্ছে ও আইনের লোক?’

‘লম্যান? তাহলে তো চিন্তাই ছিল না। আমার ধারণা ও রনি ড্যাশার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *