একলব্য – ৮

তদ্‌বেক্ষ্য কুমারাস্তে বিস্ময়োৎফুল্ললোচনাঃ। 
ঘটনা দেখে রাজকুমারদের চোখ কপালে উঠল।

.

দ্রোণ ভার্যা আর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে হস্তিনাপুর নগরের দিকে পা বাড়ালেন। 

দ্রোণের জন্ম হয়েছে পাঞ্চালে, বাল্য ও কৈশোরও কেটেছে পাঞ্চালে। সেই জন্মস্থান ত্যাগ করে, দ্রুপদের ওপর উদগ্র প্রতিশোধস্পৃহায় উদ্দীপ্ত দ্রোণ কুরু রাজধানী হস্তিনাপুরের দিকে রওনা দিলেন। 

পাঞ্চালদেশের পূর্বদিকে গোমতী নদী বয়ে চলেছে বুকভরা জল নিয়ে। পাঞ্চালের উত্তর-পশ্চিমে সুপ্রসিদ্ধ কুরুদেশ। সেই দেশে পৌঁছাতে হলে সুবিশাল এক অরণ্যভূমি পার হতে হবে আর পেরোতে হবে গঙ্গা নদী। 

কুরুবংশ এবং পাঞ্চালবংশ অনাত্মীয় ছিল না। পাঞ্চালদেশের সবচাইতে নামি রাজা ছিলেন সৃঞ্জয়। তেমনি কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ রাজার নাম কুরু। প্রথমদিকে এই দুই বংশের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। 

কিন্তু কালক্রমে উভয় দেশের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে গেল। ফলে পাঞ্চালদেশের সঙ্গে কুরুরাজ্যের সম্পর্কের অবনতি ঘটল। মাঝেমধ্যে যুদ্ধও লাগল। সেই যুদ্ধবিগ্রহ এক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে, কুরুরাজ্য কখনো পাঞ্চালদের দখলে চলে গেল, আবার কখনো পাঞ্চালরা বিধ্বস্ত হলো কুরুরাজ্যের রাজাদের হাতে। মহারাজ কুরুর পিতা সম্বরণ একবার পাঞ্চালরাজ দিবোদাসের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে বনেজঙ্গলে, গিরিগুহায় ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হন। 

এই রকম আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ আর আস্ফালন উভয় রাজ্যের মধ্যে মাঝে মাঝেই চলত। রাজ্য দুটো একেবারে পাশাপাশি। ফলে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক একটা আক্রোশ তৈরি হয়েই ছিল। সাধারণভাবে এটা সত্য যে, পাশাপাশি দুটো দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক কখনো মিত্রতার হয় না। পাঞ্চালদেশ আর কুরুরাজ্যের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হতে দেখা যায়। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ দ্বারা লাঞ্ছিত—বঞ্চিত হয়ে দ্রোণ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গন্তব্য হিসেবে কুরুদেশকে বেছে নিলেন। 

দ্রোণ যখন কুরু রাজধানী হস্তিনাপুরে পৌঁছলেন, তখন রাজা শান্তনু বেঁচে নেই। তাঁর পুত্ররা অকালে স্বর্গত। শান্তনু কিংবা তাঁর বাবা প্রতীপের আমল থেকে পাঞ্চালদের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হয় নি। তার পরও দুই দেশের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সব সময়েই লেগে ছিল। দ্রোণ সেই উত্তেজনাকে আপন আনুকূল্যে ব্যবহার করার জন্য হস্তিনাপুর এলেন। 

দ্রোণের হস্তিনাপুর আসার আরেকটা কারণ ছিল। ব্রাহ্মণ্যবৃত্তি ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়বৃত্তি গ্রহণ করার ব্যাপারে দ্রোণ দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু পাঞ্চালরাজ্য তাঁর এই বৃত্তি ত্যাগকে সুনজরে দেখে নি। তা ছাড়া রাজা দ্রুপদ তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হওয়ার পর নিন্দা আরও তীব্রতর হবে—এটা দ্রোণ ভেবেছেন। নতুন বৃত্তি প্রসারে চেনা জায়গাটি দ্রোণের প্রতি আনুকূল্য দেখাবে না। দ্রোণ মনে করলেন—নিজের অস্ত্র-সামর্থ্য প্রকাশের পক্ষে হস্তিনাপুরই হবে অধিকতর সুবিধেজনক জায়গা। 

নতুন স্থানে এলে একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন। কোনো নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে সেই আশ্রয় মিললে ভালোরকমভাবে গুছিয়ে নেওয়া যায়। দ্রোণের জন্য সেই আশ্রয় হস্তিনাপুরে অপেক্ষা করছিল। 

স্ত্রী কৃপীর যমজ ভ্রাতা কৃপ হস্তিনাপুরেই থাকেন। যেহেতু রাজা শান্তনু দ্বারা কৃপ লালিত, সে জন্য কুরুরাজপ্রাসাদে তাঁর মর্যাদা সুবিদিত। ফলে আশ্রয়ের সুবিধাটুকু দ্রোণ কৃপের কাছ থেকে পেয়ে গেলেন। 

নিস্তব্ধ আক্রোশে পাঞ্চালরাজ্যের প্রান্তবাহিনী গঙ্গা পেরিয়ে, শ্বাপদসংকুল বিশাল অরণ্য অতিক্রম করে দ্রোণ শ্যালক কৃপের বাড়িতে এসে পৌঁছেছিলেন। কৃপ ভগিনী, ভাগিনা এবং বোনজামাইকে সাদরে গ্রহণ করলেন। 

আশ্রয় মিলল, খাদ্যাভাব ঘুচল, তবুও দ্রোণের মনের অস্থিরতা মিটল না। একদিন সেই অস্থিরতার কথা কৃপকে খুলে বললেন। জানালেন—ব্রাহ্মণ্যবৃত্তি আর নয়, চাই অস্ত্রবৃত্তির প্রসার 

কৃপ বললেন, ‘আর্য, তাই যদি চান, চলুন আমার সঙ্গে। কুরুপ্রধানদের কারও সঙ্গে দেখা করি। আপনার বাসনা পূর্ণ হবে। 

 ‘না কৃপ। কোনো কুরুপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে নিজেকে আর ছোট করতে চাই না।’

‘তাহলে চলুন পিতামহ ভীষ্মের কাছে যাই। তিনি আপনার নাম শুনেছেন। তাঁর কাছে কর্মপ্রার্থী হোন। তিনি আপনাকে ফিরাবেন না।’ 

করুণ কণ্ঠে দ্রোণ বললেন, ‘একবার পরশুরামের কাছে গিয়েছিলাম, আরেক বার গেলাম দ্রুপদের কাছে। অভীষ্ট অর্জিত হয় নি আমার। বরং পাঞ্চাল দ্রুপদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছি।’ বলতে বলতে গলা বুজে এল দ্রোণের। আবেগে তাঁর কণ্ঠধ্বনি জড়িয়ে গেল। 

যে দারিদ্র্য দ্রোণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, সেই দারিদ্র্যের কারণ দেখিয়ে অর্থলাভের জন্য ভীষ্ম কেন, কারও কাছে যেতে রাজি নন দ্রোণ। ঠিক করেছেন—তিনি চলবেন এবার আপন পুরুষকারের নির্দেশে। তিনি পৌরুষ প্রদর্শন করবেন এবং তা দেখে কেউ যদি তাঁকে কাছে ডেকে নেন, তবেই তিনি তাঁর কাছে যাবেন। কৃপাপ্রার্থী হয়ে নয়। তাঁর অস্ত্রবিদ্যার করণ-কৌশল দেখে কেউ যদি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মর্যাদা দেন, তবেই সাড়া দেবেন তিনি। তার আগে নয়। 

ভগ্নিপতির কথা শুনে নীরব রইলেন আচার্য কৃপ। তারপর বললেন, ‘আর্য, আপনি যা ভালো মনে করেন, করুন। আমি আপনার সঙ্গে আছি।’ 

কৃপের কথা শুনে পৌরুষের হাসি হাসলেন দ্রোণ। 

এর পর থেকে দ্রোণ কৃপাচার্যের বাড়িতে আত্মপরিচয় গোপন করে সপরিবারে বসবাস করতে শুরু করলেন। তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে কুরুরাজবাড়িতে প্রবেশের সুযোগ খুঁজছিলেন। 

কৃপাচার্য আগে থেকে পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন। খুব দক্ষ ধনুর্বিদ ছিলেন না কৃপ, তবে প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য তিনি যথেষ্ট ছিলেন। মহামতি ভীষ্ম কৃপাচার্যের অস্ত্রক্ষমতা আর সীমাবদ্ধতা—দু-ই জানতেন। যতদিন কৃপাচার্যের বাড়া অস্ত্রগুরু মিলবে না, ততদিন কুরুবাড়ির ছেলেদের অস্ত্রশিক্ষাভার কৃপের ওপর ন্যস্ত করলেন পিতামহ ভীষ্ম। 

একদিন কুরুবাড়ির ছেলেরা কৃপের বাড়িতে গৌরবর্ণ এক প্রায়-যুবককে দেখল। ছেলেটি বেশ সুশ্রী। তাদের বয়সি হয়েও তাদের চেয়ে ভালো অস্ত্রবিদ্যা জানে সে। কৃতবিদ্যা অন্যকে শেখাতে কুণ্ঠিত নয় সে। কৃপাচার্য শিক্ষাদান শেষ করে চলে গেলে প্রায়-যুবকটি আরব্ধপাঠ আরও ভালো করে বুঝিয়ে দেয় সবাইকে। এই যুবকটি হলো অশ্বত্থামা। 

পাণ্ডবভ্রাতারাই তার কাছ থেকে পাঠ নিতে বেশি আগ্রহী। পাণ্ডব-কৌরব বালকরা পরিচয় জানতে চাইলেও পূর্বপরিকল্পনামতো আত্মপরিচয় দেয় না অশ্বত্থামা। পুত্রকে এই কাজে বাধা দিলেন না দ্রোণ। তিনি চাইলেন—কুরুবাড়ির অধিবাসীদের একাংশের সঙ্গে তাঁর পুত্রের পরিচয় হোক। এই পরিচয় হয়তো কোনো এক সময় আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেবে। 

সেই সুযোগ এসে গেল একদিন। হস্তিনা নগরের প্রান্তদেশেই কৃপাচার্যের বাড়ি। একদিন খেলতে খেলতে পাণ্ডব-কৌরবরা কৃপাচার্যের বাড়িসংলগ্ন মাঠে চলে এল। তারা বীটা খেলছিল। গোলাকার বীটাকে হাত অথবা পায়ের সাহায্যে ছোড়া যায় অথবা লাখি মারা যায়। ছেলেরা বাঁটা নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। অনবধানে একসময় সেই বীটা একটি অন্ধকূপের মধ্যে গিয়ে পড়ল। 

লাঠির খোঁচা দিয়ে, ঢিল ছুড়ে বালকরা বীটাটিকে কূপ থেকে বের করে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। কিন্তু ব্যর্থ হলো। উৎকণ্ঠিত বালকরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। হঠাৎ তাদের চোখ পড়ল একজন প্রবীণ মানুষের ওপর। তিনি দ্রোণ। 

মেদবর্জিত শরীর দ্রোণের। চুলে সামান্য পাক ধরেছে। গলায় উপবীত। সামনে হোমকুণ্ডলী। খেলার প্রধান উপকরণ বীটা কূপে পড়ে গেছে। এখন তাদের প্রচুর অবসর। অগ্নিহোত্র করতে বসা একজন ব্রাহ্মণের প্রতি স্বভাবত কুরুবাড়ির রাজকুমাররা কৌতূহলী হয়ে উঠল। তাঁর দিকে এগিয়ে গেল তারা। তাঁকে ঘিরে কুমাররা অগ্নিহোত্রের জোগাড়যন্ত্র দেখতে লাগল। 

একসময় উৎসুক রাজকুমারদের দিকে চোখ তুললেন দ্রোণ। নরম গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে বাছারা! আমি একজন ব্রাহ্মণ। যাগযজ্ঞের সময় গোল করছ কেন?’ 

স্থূলকায় ভীম বলে উঠল, ‘আমরা বিপদে পড়েছি। আমাদের খেলার বীটাটি ওই কুয়ায় পড়ে গেছে।’ 

দ্রোণ এবার অর্ধনিমীলিত চোখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে বস? এরা কারা?’ যেন দ্রোণ তাদের চেনেনই না। এরা যে রাজকুমার, সে বিষয়ে তিনি একেবারেই অজ্ঞ, এমন ভান করে কথাগুলো জিজ্ঞেস করলেন। 

ভীম বলল, ‘আমি ভীম। আমি একটু বেশি খাই বলে এরা আমাকে বৃকোদর বলে সম্বোধন করে। ও হ্যাঁ, এরা সবাই কুরুরাজবাড়ির কুমার।’ 

মৃদু হাসলেন দ্রোণ। যে সুযোগের জন্যই তিনি এতদিন অপেক্ষা করে ছিলেন, সেই সুযোগ এখন তাঁর হাতে এসে ধরা দিল। এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। 

‘হ্যাঁ, তোমাদের কী সমস্যার কথা বলছিলে যেন?’ রাজকুমারদের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন দ্রোণ। 

দুর্যোধন বলে উঠল, ‘আমাদের খেলার বাঁটাটা ওই অন্ধকূপে পড়ে গেছে। আপনি ওটি তুলে দিন।’ 

এ কে রে বাবা! কোনো বিনয় নয়, কোনো প্রার্থনা নয়। সরাসরি তুলে দিতে বলল। বেশ উদ্ধত ভঙ্গি তো ছেলেটার কণ্ঠে! কিন্তু এই মুহূর্তে রাগলে চলবে না। তাহলে হারতে হবে। হারাতে হবে কুরুবাড়ির সঙ্গে সংযুক্তির সুযোগটা। 

‘তোমার নাম কী? তোমার পরিচয়?’ দ্রোণ জিজ্ঞেস করলেন। 

‘আমার নাম দুর্যোধন। কুরুরাজা ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠপুত্র আমি। আশা করি, আমার পরিচয় আপনার জানা হয়ে গেছে। এবার বীটাটি তুলে আনার ব্যবস্থা নিন।’ আগের মতোই দুর্বিনীত কণ্ঠে কথাগুলো বলল দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের ভাবভঙ্গি দেখে ক্রোধ দ্রোণের মাথায় চাগিয়ে উঠতে লাগল। তিনি নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি হোমস্থানের দিকে নিবিড় চোখে তাকিয়ে অগ্ন্যুৎপাতি ক্রোধকে দমন করতে চাইছেন। 

এ সময় একটা কোমল কণ্ঠ দ্রোণের কানে ভেসে এল, ‘ক্ষমা করবেন আচার্য দুর্যোধন একটু ওই রকমই। তার আচরণ মাঝেমধ্যে শালীনতাকে অতিক্রম করে ফেলে।’ এরপর যুধিষ্ঠির আরও নিচু কণ্ঠে অনুনয়ের সুরে বলল, ‘দেখুন না, আমাদের খেলার বীটাটা আমাদেরই অসাবধানতায় কূপে পড়ে গেছে। আপনি বয়স্ক। গায়ের জোর এবং বুদ্ধি আমাদের চেয়েও আপনার অনেক বেশি। আমাদের আনন্দের উপকরণটি যদি আপনি উদ্ধার করে দেন, তাহলে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আমরা।’ সাথিদের ওপর দৃষ্টি ফেলে কথা শেষ করল যুধিষ্ঠির। 

দুর্যোধন ছাড়া সবাই সমস্বরে বলল, ‘জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির যথার্থ বলেছেন। আমরা আপনার উপকারের কথা মনে রাখব।’ 

ও, তাহলে এ-ই যুধিষ্ঠির। শান্ত সৌম্য বিবেচক হিসেবে যে ছেলেটির কথা পাঞ্চাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। হেসে ফেললেন দ্রোণ। বললেন, ‘তোমাদের বীটা আমি উদ্ধার করে দেব। তার আগে তোমাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে।’ 

‘কী প্রশ্ন আচার্য?’ আগের মতো স্নিগ্ধ কণ্ঠে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করল। 

‘তোমরা তো ক্ষত্রিয়ের জাত, কিন্তু তোমাদের সামর্থ্য দেখে আমি স্তম্ভিত হচ্ছি।’ প্রশ্ন না করে বেশ উচ্চকণ্ঠে বললেন দ্রোণ। 

ভীম বলল, ‘আপনার কথার সামঞ্জস্য আমরা ধরতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলবেন?’ 

‘এত বয়স হলো তোমাদের, কী অস্ত্রবিদ্যা অর্জন করেছ তোমরা? প্রসিদ্ধ ভরতবংশে জন্ম তোমাদের। সামান্য কুয়ো থেকে একটা বীটা তুলে আনতে পারছ না তোমরা? অস্ত্রকৌশলীদের জন্য এটি একটি সাধারণ ব্যাপারমাত্র।’ 

অচেনা লোকের ধিক্কার শুনে রাজকুমাররা মাথা নিচু করে থাকল। তিনি বলছেন, অস্ত্র প্রয়োগ করে কুয়ো থেকে বীটাটি তুলে আনা সম্ভব। তা কী করে সম্ভব? কুয়োর গহিন তলদেশের অন্ধকারে বীটাটি হারিয়ে গেছে। মানুষ সেখানে না নেমে শুধু অস্ত্রের মাধ্যমে তা ওপরে তুলে আনা অতি সাধারণ ব্যাপার—বলছেন এই আচার্য। কী অদ্ভুত! 

এই সময় আচার্য বললেন, ‘তোমরা ভাবছ, তা কী করে সম্ভব!’ যেন রাজপুত্রদের মনের কথা বুঝতে পেরেছেন তিনি। ‘বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? তবে এই দেখো 

বলে নিজের হাতের আংটিটি খুলে সেই কূপে ফেলে দিলেন। তারপর ধীরেসুস্থে তিনি আবার বললেন, ‘বীটা এবং আংটি দুটোকেই আমি কূপ থেকে তুলে আনছি। তবে তার আগে একটি কথা…।’ বলে থেমে গেলেন আচার্য। 

যুধিষ্ঠির ত্বরিত জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কথা আচার্য?’ 

‘যদি দুটোকে আমি তুলে আনতে পারি, তবে আমাকে উত্তমরূপে একদিন খাওয়াবে তো বাছারা?’ 

অগ্রজ যুধিষ্ঠির বললেন, ‘একদিন কেন, আপনি প্রতিদিন উত্তম ভোজন লাভ করবেন।’ 

যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে দ্রোণ হাসলেন। তারপর নলখাগড়ার বন থেকে কতকগুলি খাগের তীর বানিয়ে আনলেন। একটির পর একটি সেই খাগের তীর ছুড়ে বীটাটিকে ওপরে তুলে আনলেন। ঘটনা দেখে রাজপুত্রদের চোখ কপালে উঠল। বীটাটি কুয়োর বাইরে চলে এসেছে, কিন্তু আংটিটি কোথায়? 

‘আংটিটা যে কুয়োতেই রয়ে গেছে।’ দ্রোণকে জব্দ করার জন্য যেন দুর্যোধন বলল।

‘এত বিচলিত হচ্ছ কেন? আংটিকেও ওপরে তুলে আনব।’ বালকদের চমকিত করার এই তো সুযোগ। 

দ্রোণ ধনুক-বাণ হাতে তুলে নিলেন। শর নিক্ষেপ করলেন তিনি। আংটির গায়ে এমনভাবে তীর ছুড়লেন যার ফলে একের পর এক বাণ-পরম্পরায় বাণবিদ্ধ আংটিটি ওপরে উঠে এল। আংটিটি দুর্যোধনের হাতে দিয়ে পরখ করে দেখতে বললেন — এটি কিছুক্ষণ আগে নিক্ষিপ্ত আংটি কি না। দ্রোণের কাণ্ড দেখে বিস্ময়স্তব্ধ হয়ে রাজকুমাররা দাঁড়িয়ে রইল। যুধিষ্ঠির এবং দুর্যোধন একযোগে দ্রোণের পায়ের কাছে নত হলো। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য রাজপুত্ররাও। 

করজোড়ে যুধিষ্ঠির বলল, ‘আচার্য, আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন। মানুষের এমন ক্ষমতা আগে কখনো দেখি নি।’ 

দ্রোণ নরম কণ্ঠে বললেন, ‘উঠে দাঁড়াও তোমরা। তোমাদের আচরণে আমি মুগ্ধ।’ 

যুধিষ্ঠির বলল, ‘কে আপনি মহাত্মন? আপনার পরিচয় কী?’ একটু থেমে আবার বলল, ‘যে কৌশলে আপনি বীটাটি তুলে আমাদের উপকার করলেন, তার প্রতিদানে আমরা আপনাকে কী দেব বলুন?’ 

দ্রোণ বললেন, ‘আমি তোমার প্রশ্নের সবটুকুর উত্তর দিচ্ছি না। আমার কৌশলে তোমরা যদি তৃপ্তি পেয়ে থাকো, তাহলে মহামতি ভীষ্মের কাছে গিয়ে আমি কী করেছি, তার বর্ণনাটুকু দাও। আমার পাওনা হয়ে যাবে। আর কিছু চাই না আমি তোমাদের কাছে। আর হ্যাঁ, মহামতিকে আমার অস্ত্রকুশলতার বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে আমার চেহারার বর্ণনাটাও দিয়ো।’ 

রাজকুমাররা তা-ই করল। দ্রোণের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সবিস্তারে পিতামহ ভীষ্মকে জানাল তারা। তাদের কথায় থাকল কৃতজ্ঞতামিশ্রিত বিস্ময়। 

ভীষ্ম সূক্ষ্মদর্শী, বিচক্ষণ। তিনি বুঝতে পারলেন এই আচার্য দ্রোণ ছাড়া আর কেউ নন। অস্ত্রবেত্তা দ্রোণ সম্পর্কে ভীষ্ম পূর্বে যৎকিঞ্চিত শুনেছেন। 

ভীষ্ম দ্রোণকে ডেকে পাঠালেন। রাজকীয় সৎকারে সম্মানিত করলেন তাঁকে। যথোপযুক্ত আসনে উপবেশন করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন আপনি পাঞ্চাল ছেড়ে হস্তিনাপুরে এলেন?’ 

দ্রোণ জীবনের সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক বর্ণনা করলেন ভীষ্মের সামনে। পিতা ভরদ্বাজের আশ্রমে দ্রুপদের পাঠ নিতে আসা, ঋষি অগ্নিবেশ্যের অস্ত্রাশ্রমে পাঞ্চাল দ্রুপদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়া, দ্রুপদের প্রতিশ্রুতি, দ্রোণের দারিদ্র্যময় অবস্থা, অশ্বত্থামার জন্ম, ধনীপুত্রদের দুগ্ধ বলে পিষ্টরস খাওয়ানো এবং উপহাস, সপুত্র-পরিবারে দ্রুপদের কাছে গমন, দ্রুপদ দ্বারা চরমভাবে লাঞ্ছিত হওয়া—সবকিছু একের পর এক বলে গেলেন দ্রোণ। সবশেষে বললেন, ‘উপযুক্ত অস্ত্রশিষ্য পাব বলে আমি হস্তিনাপুরে এসেছি।’ 

স্মিত হেসে ভীষ্ম বললেন, ‘আপনার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। আজ থেকে আপনি এই প্রাসাদের রাজপুত্রদের অস্ত্রগুরু হিসেবে নিযুক্তি পেলেন। একজন যথার্থ অস্ত্রগুরুর বুদ্ধিমত্তা, উদারতা, অস্ত্রাভিজ্ঞতা এবং শক্তিমত্তা—এই চারটি গুণ থাকা প্রয়োজন। আমার মনে হচ্ছে, আপনার মধ্যে এই চতুর্বিদগুণ বর্তমান। আপনি রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার দায়িত্বটুকু গ্রহণ করে আমাকে কৃতার্থ করুন আচার্য।’ 

দ্ৰোণ নির্বাকপ্ৰায়। এত সহজে তাঁর অভিলাষ পূর্ণ হতে চলেছে! কুরুবংশের ভবিষ্যৎ গুরু হতে চলেছেন তিনি? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না যেন দ্রোণ। 

এই সময় ভীষ্মের জলদগম্ভীর কণ্ঠ আবার শুনতে পেলেন দ্রোণ, ‘আপনার ভোজন ও উত্তম আবাসনের সকল দায়িত্ব এই কুরুরাজবাড়ি নিল। আজ থেকে কুরুরাজ্যের সকল ভোগ্যবস্তু আপনার ভোগ্য হবে। বিশ্বাস করবেন—কুরুবাড়ির সকলে আপনার অনুগত হলো।’ 

দ্রোণ দেখলেন—যেভাবে তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন, যে সম্মানের অভিলাষ তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল এতদিন, তার অনেকটাই ভীষ্মের কথায় পূরণ হয়ে গেল। 

ভীষ্মের এই ধরনের বক্তব্যের অন্য একটা গূঢ় কারণ ছিল। দ্রোণের ছিল অত্যাশ্চর্য অস্ত্রক্ষমতা। পাঞ্চালরাজ্যের সঙ্গে হস্তিনাপুরের চিরন্তন শত্রুতা। দ্রোণের অস্ত্রশিক্ষা যদি এই রাজ্যের রাজপুত্রদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর করে তোলে, তাহলে দ্রুপদকে ভালোরকমে শায়েস্তা করা যাবে। তাই দ্রোণকে রাজপুত্রদের শিক্ষাগুরু নিযুক্ত করলেন ভীষ্ম। 

ভীষ্ম রাজপ্রাসাদের সকল রাজকুমারকে জড়ো করলেন। তাদের দেখিয়ে দ্রোণকে বললেন, ‘এরা আপনার শিষ্য। আপনি এদের দায়িত্ব নিন।’ 

তারপর দ্রোণকে রাজবাড়ির বিধিমতো আচার্য পদে বরণ করে নিলেন ভীষ্ম বললেন, ‘আজ থেকে এই ভারতবর্ষে আপনি দ্রোণাচার্য নামে সম্বোধিত হবেন। সসাগরা পৃথিবী আপনাকে অস্ত্রগুরু হিসেবে সম্মান জানাবে। 

দ্রোণের উল্লসিত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু দ্রোণ তেমন উৎফুল্লতা প্রকাশ করলেন না। তাঁর মনে ভীষণ একটা দ্বিধা কাজ করছে তখন। তিনি এই বাড়ির আচার্য পদে বরিত হলেন। এখন শ্যালক কৃপাচার্যের কী হবে? সে তো এই বাড়ির পূর্বতন আচার্য তিনি এই বাড়ির আচার্য হওয়ায় কৃপের বৃত্তি তো লোপ পেয়ে গেল। এ বড় অন্যায়। 

দ্রোণ হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আমার কারণে কৃপের সর্বনাশ হয়ে গেল।’ 

‘কেন?’ মৃদু হেসে ভীষ্ম জিজ্ঞেস করলেন। 

‘কৃপাচার্যের প্রাপ্তি যে রহিত হয়ে যাবে।’ দ্বিধান্বিত কণ্ঠ দ্রোণের। 

ভীষ্ম বললেন, ‘এই বাড়ির সঙ্গে কৃপের কী সম্পর্ক আপনি জানেন না আচার্য। তিনি ঘরের লোক। আপনি আচার্য হওয়ায় কৃপের কোনোরূপ ক্ষতি হবে না। কৃপ থাকবেন কৃপের জায়গায়। তাঁর ভরণপোষণের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। তাঁর প্রতিষ্ঠা এতটুকু ক্ষুণ্ণ হবে না।’ একটু থেমে ভীষ্ম আবার বললেন, ‘আমার পৌত্রদের শিক্ষার ভার আপনি গ্রহণ করুন আচার্য।’ 

দ্রোণাচার্য প্রশান্ত চোখে পিতামহ ভীষ্মের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *