একলব্য – ১৭

১৭

যে-কিছু মাগিবা প্রভু সকলি তোমার। 
আজ্ঞা কর গুরু করিলাম অঙ্গীকার।।

.

‘আমি এই রহস্যের কিছুই বুঝি নি।’ 

‘কোন রহস্যের? 

‘যে রহস্য আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে গুরুদেব।’ 

‘তুমি তোমার বক্তব্য স্পষ্ট কোরো অর্জুন। তোমার কথার রহস্যময়তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’ বললেন দ্রোণাচার্য। 

‘আমি একলব্যের কথা বলছি গুরুদেব। আপনার শিষ্য বলে দাবি করেছে সে নিজেকে। বলেছে…।’ 

অর্জুনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আচার্য বললেন, ‘কী বলেছে সে?’ 

‘বলেছে—এই অদ্ভুত, বিচিত্র ক্ষমতাসম্পন্ন বাণগুলোর সবটাই গুরুদেব দ্রোণ থেকে পাওয়া। যে-তীর দিয়ে তোমাদের কুকুরের মুখ বিদ্ধ করেছি, তাও তো গুরুর পাদদেশে বসে পাওয়া। বলেছে—এই অভূতদর্শন তীরের মতো আরও ক্ষিপ্র তীক্ষ্ণ বাণ আমার তূণে জমা আছে।’ অর্জুন ধীরে ধীরে বলল। 

‘যুদ্ধকামী যে-কোনো তীরন্দাজের কাছে এরকম তীর থাকতেই পারে। 

‘তাহলে আমার আপত্তি ছিল না।’ 

‘তোমার আপত্তিটা কোথায়?’ 

‘একলব্য আপনার শিষ্যত্ব দাবি করার মধ্যেই আমার আপত্তি।’ 

‘একলব্য তো আমার শিষ্য নয়। তাকে তো আমি শিক্ষার্থী হিসেবে গ্রহণ করি নি।’ 

‘ও নিজেকে আপনার শিষ্য বলে দাবি করছে।’ 

‘ভুল বলেছে অথবা মিথ্যে। 

‘একজন মিথ্যেবাদী কখনো এরকম তীব্র তীক্ষ্ণ বাণের অধিকারী হতে পারে না। একমাত্র একনিষ্ঠ গুরুমুখী শিষ্যের পক্ষেই সম্ভব শুধু। সে আপনার শিষ্য। অবশ্যই আপনার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।’ শেষের কথাগুলো অনেকটা আনমনেই শেষ করল অর্জুন। 

দ্রোণাচার্য ফাঁপরে পড়ে গেলেন। একলব্যের নামটি সামান্যই মনে করতে পারছেন তিনি। সেই কবে, বহু বছর আগে, কালাকোলা বাবড়ি চুলের একজন তরুণ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সেই সকালের কথা একটু একটু করে মনে পড়ছে তাঁর। 

সরাসরি পায়ের কাছে হত্যে দিয়ে পড়েছিল তরুণটি। শিষ্য হতে চেয়েছিল তাঁর। রাজপুত্রদের মাঝখানে তরুণটিকে বড় বেমানান লাগছিল। নিজের নাম একলব্য বলেছিল সে। নিষাদপুত্র বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। কী একটা যেন সেদিন বলেছিল। ভালো করে তরুণটির কথা শোনেন নি আচার্য। শুনবার তেমন ইচ্ছেও জাগে নি। শুধু এইটুকু স্পষ্ট মনে পড়ছে— সে তাঁর অস্ত্রশিষ্য হতে চেয়েছিল। গভীর আগ্রহ ছিল একলব্যের মধ্যে। 

আচার্য স্বীকার করেন নি একলব্যকে। বলেছিলেন, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়-ইতর কাউকে তিনি অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেন না। যাওয়ার আগে সে তার অধীতবিদ্যা দেখাতে চেয়েছিল। রাজি হয়েছিলেন তিনি। এক অভূতপূর্ব অস্ত্রনিক্ষেপণ-চমৎকারিত্ব দেখিয়েছিল একলব্য, সেই সকালে। ক্ষণকালের জন্য মনটা তাঁর দয়ার্দ্র হয়ে উঠেছিল। পরমুহূর্তে ব্রাহ্মণ্যদর্প তাঁকে দখল করে ফেলেছিল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অস্ত্রপাঠশালা থেকে একলব্যকে বিদায় করেছিলেন। 

এতদূর পর্যন্তই তো মনে পড়ে দ্রোণাচার্যের। অর্জুনের বলা কথার কিছুই তো মনে পড়ছে না তাঁর। এরপর একবারের জন্যও তো একলব্যের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় নি। তাহলে একলব্য যে দাবি করছে—সে তাঁর ছাত্র। তাঁর হাত দিয়ে তার সকল শিক্ষণ- প্রশিক্ষণ। শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের জন্য তো শিষ্য আর গুরুর সম্মিলনের প্রয়োজন। কিন্তু একলব্য-দ্রোণাচার্যের সম্মিলন তো, সেই প্রথমবার ছাড়া আর কখনো হয় নি। তাহলে একলব্যের দাবি অলীক? যদি অলীক হয়, তাহলে অর্জুনরা যে তার অস্ত্রদক্ষতা দেখে এল তার কী ব্যাখ্যা? ভীষণ রহস্যময়। কোনটা সত্য? একলব্যের মিথ্যাচার, না তার হস্তলাঘব রহস্য? ব্যাপারটি গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলল আচার্যকে। 

রাজকুমাররা রাজপ্রাসাদে ফিরে অনতিবিলম্বে গুরু দ্রোণের সঙ্গে দেখা করেছিল। কুকুরের মুখে শরপতন থেকে আরম্ভ করে একলব্যের শিষ্যত্ব দাবি পর্যন্ত সবকিছুর অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছিল রাজপুত্ররা। নীরবে সব শুনেছিলেন আচার্য। কথা শেষে সবাই একে একে স্থান ত্যাগ করলেও অর্জুন থেকে গিয়েছিল। গুরুকে একান্তে নির্জনে পেতে চায় সে। পেয়েও গিয়েছিল। আচার্যের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছিল অর্জুন। আচার্যকে মৌন দেখে অর্জুন বলতে শুরু করছিল। তবে এবারে তার কণ্ঠে অভিযোগের স্পর্শ, ‘আমার লক্ষ্যভেদ-দক্ষতা দেখে, সেই রাতে, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন— বৎস, তুমি হবে আমার শ্রেষ্ঠতম শিষ্য। তোমার জন্য আমি গৌরবান্বিত। আজ প্রতিজ্ঞা করছি, তোমার চেয়ে বেশি জানবে এমন অস্ত্রশিষ্য আমার আর কেউ থাকবে না।’ 

‘ঠিকই তো বলেছিলাম। এবং এখনো তোমার তুল্য কোনো শিষ্য আমার নেই।’ স্পষ্ট গলায় বললেন দ্রোণ। 

‘আগে হলে আপনার এই কথাকে বেদতুল্য পবিত্রজ্ঞানে বিশ্বাস করতাম। একলব্যের কথা শুনে আমার সেই বিশ্বাস টলে গেছে। আমি ছাড়া আপনার আরেকজন শিষ্য আছে, যে আমার চেয়ে অনেক বড় তো বটেই, পৃথিবীর অনেক খ্যাতিমান অস্ত্রবিদের চেয়েও সে অনেক বেশি দক্ষ। 

দ্রোণাচার্য তাঁর ঘটনাবহুল জীবনে বহু বিপরীত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু এরকম অবস্থার মুখোমুখি হন নি কোনোদিন। অবশ্যই সেরাতের কথা মনে আছে তাঁর, অর্জুনকে আলিঙ্গন করে সেরাতে তিনি বলেছিলেন, তোমার চেয়ে বড় কোনো শিষ্য আমার থাকবে না। কিন্তু এটা একেবারেই বুঝতে পারছেন না যে, নৈষাদি একলব্য তাঁর শিষ্য হলো কখন থেকে? শুধু শিষ্যত্ব দান নয়, অর্জুনের চেয়ে অধিক চৌকষ অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন নাকি তিনি তাকে! 

একদিকে একলব্যের অস্তিত্ব যেমন সত্য, অন্যদিকে অর্জুনের অভিমানও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। 

দ্রোণাচার্য অর্জুনকে উদ্দেশ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘চলো।’ 

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় গুরুদেব।’ 

‘একলব্য সকাশে। তোমার ক্ষেদ বা অভিমান যে মিথ্যে, তা প্রমাণ করতে হবে যে আমায়।’ বলে দৃঢ় পদক্ষেপে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন আচার্য 

অর্জুন তাঁকে অনুসরণ করল। আর এ দুজনকে অনুসরণ করল কর্ণ। 

সবাই চলে গেলেও কর্ণ সেই স্থান ত্যাগ করে নি। অর্জুন গুরুর কাছে থেকে গেলে তার ভেতর দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়েছিল-অর্জুন থেকে যাওয়ার কারণ কী? আড়াল থেকে গুরু-শিষ্যের সকল কথোপকথন শুনেছিল সে। এই ঘটনার পরিণতি কী—তা জানার জন্য কর্ণের মধ্যে গভীর ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই অর্জুন-আচার্যের পিছু নিয়েছিল সে। গুরু আর শিষ্য রথে উঠলে ঘোড়ায় চেপে তাঁদের অনুসরণ করেছিল কর্ণ। 

যেতে যেতে দ্রোণ ভাবলেন–প্রতিপক্ষের দুর্ভাবনায় অর্জুন এখন প্রবলভাবে উত্তেজিত। সেই উত্তেজনার কিছুটা নিজের মধ্যেও টের পেলেন আচার্য। শুধু অর্জুনের কেন, নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকেও যেন তিনি নিজের সামনে দেখতে পেলেন। যে অস্ত্রের কথা অর্জুনাদির মুখে শুনেছেন তিনি, তার অন্ধিসন্ধি তো তাঁর জানা নেই। শুধু একটি কেন এরকম আরও অনেক অস্ত্রের সুলুকসন্ধান তার জানা, এরকমই তো দাবি করেছে একলব্য। যদি তা-ই হয়, অর্জুন তো কোন ছাড়, তাঁর চেয়েও দক্ষ ধনুর্ধর একলব্য। 

ভাবতে ভাবতে উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন দ্রোণাচার্য। যে করেই হোক জংলি নিষাদটাকে থামাতে হবে। নইলে একলব্যের সঙ্গে সঙ্গে ওই বর্বর ব্যাধরাও একদা অস্ত্রনিপুণ হয়ে উঠবে। পৃথিবীর দখল নিতে চাইবে তারা। তখন কোথায় যাবে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, ক্ষত্রিয় জৌলুস আর বিপুল সুখৈশ্বর্য! একলব্যের উত্থানকে ঠেকাতে হবে, যে-কোনো মূল্যে। কিন্তু অর্জুনের মতো উত্তেজিত হলে চলবে না। শান্তভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে। কূটবুদ্ধিই তো ব্রাহ্মণের সম্বল। 

দ্রোণাচার্য সশিষ্য একলব্যের কুটিরে উপস্থিত হলেন। গুরুকে সামনে দেখতে পেয়ে বিপুলভাবে আন্দোলিত হয়ে উঠল একলব্যের হৃদয়। কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে এল তার মাথা। অদ্ভুত এক শিহরণে তার আপাদমস্তক কম্পিত হতে লাগল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্থির পলকে গুরুর দিকে তাকিয়ে থাকল একলব্য। তার মুখখানি প্রদীপের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর তার সমস্ত চেতনার ওপর বিহ্বলতা নেমে এল। আজন্ম সাধনার আদর্শ যে গুরু, তিনি আজ তার পর্ণকুটিরের আঙিনায়! এই গুরু প্রত্যক্ষভাবে তাকে শিক্ষা দেন নি বটে, কিন্তু তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই তো আজ সে ধনুর্বিদ হতে পেরেছে। গুরুর কাছে কায়মনোবাক্যে আত্মসমর্পণ করতে হয়, এই কথাই বাল্যকাল থেকে তাকে শিখিয়ে এসেছেন পিতামহ অনোমদর্শী। এই মুহূর্তে পিতামহের কথাটি মনে পড়ল- গুরুর কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। 

একনিষ্ঠ শিষ্যের নম্রতায় একলব্য দ্রোণাচার্যের চরণে অবনত হলো। গুরুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল একলব্য। দ্রোণের পায়ে মাথা ছোঁয়াল। গুরুর চরণস্পর্শে একলব্যের মনে হলো—তার জীবনে যত বেদনা-ক্লান্তি, যত হতাশা-নিরানন্দ সবই এক নিমিষে উধাও হয়ে গেছে। সে যেন যমুনাজলে সদ্য স্নান করে তীরে উঠল। 

সাষ্টাঙ্গ প্রণাম সমাপ্ত করে উঠে দাঁড়াল একলব্য। করজোড়ে দণ্ডায়মান থাকল দ্রোণাচার্যের সামনে। সে আশা করেছিল, আচার্য আশীর্বাদমূলক কিছু একটা তার উদ্দেশে বলবেন। কিন্তু কিছুই বললেন না তিনি। কী রকম কঠিন কঠিন মুখ তাঁর। সারা মুখে স্নেহকোমলতার বিন্দুমাত্র স্পর্শ নেই। 

দ্রোণ হঠাৎ ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘তুমি আমার শিষ্য?’ 

একলব্য মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ গুরুদেব, আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছি।’

‘মিথ্যে। মিথ্যেবাদী তুমি। দীক্ষিত না হয়ে শিষ্যত্ব দাবি করছ কোন সাহসে?’

‘আমি তো আপনাকে গুরুর আসনে বসিয়েছি সেই কবে থেকে। আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার বহু আগে, যখন আমি বালক থেকে কিশোরে পদার্পণ করছি, সেই সময় থেকে আপনাকে আমার অস্ত্রগুরু বলে বরণ করেছি।’ বিনম্র শ্রদ্ধায় বলে গেল একলব্য। 

‘তোমার এসব নাটক বন্ধ কোরো। অনেক ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়েছ তুমি। তোমার স্পর্ধা আমাকে অবাক করছে। আমার নাম ভাঙিয়ে তুমি নিজেকে জাহির করছ। তুমি তো আমার শিষ্য নও।’ 

গুরুর এরকম কথা শুনে একলব্যের বুকের ভেতর থরথর করে কেঁপে উঠল। 

দ্রোণাচার্য আবার বলে উঠলেন, ‘তোমাকে শিষ্য বলে স্বীকার করি না আমি। কোনোদিন তোমাকে অস্ত্রবিদ্যার কোনো পাঠও দিই নি আমি। 

তারপর অর্জুনকে কাছে টেনে বললেন, ‘আমার যত বাসনা এই অর্জুনকে ঘিরে। এই অর্জুনই আমার শিষ্য, সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্য। আমি শুধু কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু, তোমার মতো নিষাদের নই। আমি কখনো তোমার গুরু ছিলাম না, এখনো নই।’

দু’হাত জোড় করে একলব্য বলল, ‘আপনিই আমার অস্ত্রগুরু। আপনি স্বীকার করেন বা না করেন, আপনিই আমার দীক্ষাগুরু। আমার যা কিছু অস্ত্রবিদ্যাজ্ঞান, সবই আপনার কল্যাণে। আপনার পদতলে বসে অবিরত শ্রদ্ধায় আপনার কাছ থেকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত অস্ত্র প্রয়োগ ও সংবরণের প্রক্রিয়াগুলো আমি শিখেছি। নতুন কিছু যদি শিখে থাকি তাও আপনার অনুগ্রহে।’ 

‘আমি তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।’ দ্রোণ বললেন। 

এই সময় অর্জুন বলে উঠল, ‘আপনার মন জয় করার জন্য ভড়ং দেখাচ্ছে সে। ওর কথা বিশ্বাস করবেন না গুরুদেব।’ 

এবার বাম হাত প্রসারিত করে অর্জুনকে থামতে বলল একলব্য। তারপর গুরুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই দেখুন।’ 

অনতিদূরে, উঠানের পূর্বপার্শ্বে আচার্যের মৃন্ময় মূর্তিটি দেখিয়ে একলব্য বলে উঠল, ‘ভড়ং নয়, কোনোরূপ ফাঁকিও নয়, মিথ্যে তো নয়-ই। ওই দেখুন আচার্য, আপনার কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এই নিবিড় অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমি। আপনার প্রত্যাখ্যান, আপনার অবহেলা আমাকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারে নি। আন্তরিক শ্রদ্ধায় আপনার মৃন্ময় মূর্তি নির্মাণ করেছি আমি। ওই মূর্তিরই পদতলে বসে আমার যত শিক্ষা। এখন বলুন আপনি আমার গুরু কি না?’ 

‘আমার মৃন্ময় মূর্তির পদতলে বসে তুমি অস্ত্রসাধনা করেছ!!’ 

‘হ্যাঁ গুরুদেব। দিনের পর দিন রাতের পর রাত গভীর অধ্যবসায়ে তা-ই আমি করে গেছি।’ 

‘কিন্তু অস্ত্রনিক্ষেপণ মন্ত্র! তীর নিক্ষেপণের আগে তো মন্ত্রোচ্চারণ করতে হয়। সেই মন্ত্র কোত্থেকে শিখলে তুমি? কার কাছেই বা শিখলে তুমি?’ 

একলব্য বলল, ‘মন্ত্রোচ্চারণ করেছি আমি। আপনার মূর্তির পদতলে বসে তীর নিক্ষেপের আগে মুখে যা এসেছে ভক্তিভরে তা-ই উচ্চারণ করে গেছি আমি।’ 

‘এবং তা-ই মন্ত্র হয়ে গেছে, তাই না একলব্য?’ শ্লেষের সঙ্গে বলল অর্জুন।

‘যথার্থই বলেছ তুমি অর্জুন। যা বলে তীরটি নিক্ষেপ করেছি, তাতেই তীরটি তীব্র গতিসম্পন্ন হয়েছে, লক্ষ্যভেদী হয়েছে।’ সহজ কণ্ঠে বলল একলব্য। 

‘কী বলছ তুমি অর্বাচীনের মতো?’ রূঢ় ভঙ্গিতে বললেন দ্রোণাচার্য। 

গুরুর প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিল না একলব্য। বলল, ‘ভক্তিই আমার মূলধন গুরুদেব। আমার সমস্ত অন্তর জুড়ে বিরাজ করছেন আপনি। আমার পৃথিবীর সকল অণু-পরমাণুতে আপনি ছড়িয়ে আছেন। আমার অন্তরের শ্রদ্ধাই আমাকে প্রণোদিত করেছে। রক্তমাংসের আচার্যকে এড়িয়ে এই মৃন্ময় মূর্তির মধ্যে আমি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছি। ভক্তি দিয়ে তুষ্ট করেছি আমি এই মাটির মূর্তিকে। আমার কাছে বাস্তবের গুরুর সঙ্গে কল্পনার গুরু একাকার হয়ে গেছে। আমি গুরুর অনুকম্পা পেয়েছি। তাই হয়তো অদ্ভুত, বিচিত্রগামী, প্রবল শক্তিসম্পন্ন কিছু অস্ত্র আমার হস্তগত হয়েছে।’ অনেকক্ষণ কথা বলে হাঁপিয়ে উঠল একলব্য। দম নেওয়ার জন্য থামল। 

একলব্যের কথা শুনে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন দ্রোণাচার্য। কী চমৎকার যুক্তি দিল ছেলেটি! কথার কী মনোহর ধূম্রজাল সৃষ্টি করল! আমার নাম ভাঙিয়ে কী কৌশলে নিজেকে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পথ তৈরি করে নিয়েছে সে! নিজের প্রতিভা প্রকাশের জন্য সে শঠতার আশ্রয় নিয়েছে। সে এমন কৌশলে কথাগুলো প্রচার করেছে, যার সঙ্গে আমার নামটাও যুক্ত হয়ে গেছে। একলব্যের শঠতার কারণে শিষ্যদের মনে আমার সম্পর্কে সন্দেহ জেগেছে। অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছে আজ অর্জুন। একজন অর্ধশিক্ষিত বর্বর নিষাদ তার শিক্ষার সঙ্গে আমার নাম মিশিয়ে প্রাপ্যের অধিক সম্মান পেতে চাইছে। 

আচার্য কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি শঠতা করেছ আমার সঙ্গে।’ 

বিস্ফারিত চোখে একলব্য গুরুর দিকে তাকাল। গুরুর কথা শুনে মর্মাহত হলো সে। মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘নিষাদের ঘরে জন্মেছি আমি। এজন্য আমার দুঃখ যাতনার অবধি ছিল না। গভীর একটা ক্ষোভ আমার মধ্যে তো ছিলই। নিজের চেষ্টায় মানুষের মধ্যে স্থান করে নেওয়া কি অপরাধ? আপনার দক্ষতা আর সুখ্যাতিতে মুগ্ধ হয়েই আপনার মূর্তি নির্মাণ করেছি আমি। অস্ত্রসাধনাও করেছি। কোনো ছলচাতুরি বা শঠতার আশ্রয় নিই নি কখনো। 

একলব্যের এই মানবিক যুক্তি শুনে থমকে গেলেন দ্রোণাচার্য। বুঝলেন, যুক্তি দিয়ে একলব্যকে কব্জা করা যাবে না। তাকে শৃঙ্খলিত করতে হবে ভক্তির বেড়াজালে। অধিকতর যুক্তিতে অধিকতর দুর্বল হওয়ার আগে দ্রোণ একলব্যকে বললেন, ‘তাহলে তুমি দাবি করছ—তুমি আমার শিষ্য? 

‘অবশ্যই গুরুদেব।’ 

‘তাহলে বাছা, তার জন্য তো তোমাকে গুরুদক্ষিণা দিতে হবে।’ 

একলব্যের হৃদয় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। যে গুরু এতক্ষণ তাকে শিষ্য বলেই স্বীকার করেন নি, সেই গুরু তার কাছে দক্ষিণা চাইছেন। একথার অর্থ তো পরিষ্কার । আচার্য দ্রোণ তাকে শেষ পর্যন্ত শিষ্য বলে স্বীকার করলেন। শিষ্য বলে স্বীকার না করলে তো তার কাছে গুরুদক্ষিণা চাইতেন না। হীনবর্ণের বলে যে-একলব্যকে তিনি শিষ্যত্ব দেন নি, আজ তাকে শিষ্য বলে মেনে নিলেন। কী আনন্দ! কী অদ্ভুত শিহরণ একলব্যের সর্বাঙ্গে! 

অভিভূত কণ্ঠে একলব্য বলে উঠল, ‘বলুন আচার্য, কী চান আপনি আমার কাছে? কী দক্ষিণা পেলে আপনি তৃপ্তি পাবেন?’ 

.

একলব্যের এই কথা শুনে কর্ণের ভেতরটা প্রবলভাবে কম্পিত হলো। কী বোকা! কী অর্বাচীন এই একলব্য! দ্রোণাচার্যের ছলনায় আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি হয়ে পড়ছে সে। দ্রোণের আপাত সহজতার মধ্যে কী কঠিন নির্মমতা অবস্থান করছে, বুঝতে পারছে না অর্বাচীনটা। ওরে মূর্খ, ব্রাহ্মণ্যছলনায় ভুলিস না। দ্রোণের এই নিরীহ চাওয়ার মধ্যে তোর সর্বনাশ লুকিয়ে আছে। ভক্তিতে আর আপ্লুত হোস না, নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করিস না। 

এই রকমই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কর্ণ। দ্রোণ আর অর্জুন একলব্যের আঙিনায় ঢুকে গেলে কর্ণ একটি বড় বৃক্ষের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকেই সবার কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিল কৰ্ণ। 

দ্রোণাচার্যের গুরুগম্ভীর অথচ নির্মম কণ্ঠ ভেসে এল, ‘দেবে তো তুমি, যা চাইব?’

‘বলুন আচার্য, কী চান আপনি আমার কাছে? কী আমায় দিতে হবে আপনাকে? যা চাইবেন, তা-ই দেব।’ 

ক্রূর হাসি ছড়িয়ে পড়ল দ্রোণের সমস্ত মুখে। ‘যা চাইব তা-ই দেবে তুমি আমাকে?’ জিজ্ঞেস করলেন দ্রোণ। 

‘আপনার কাছে আমার কোনো কিছুই অদেয় নয়। প্রাণ চাইলে প্রাণও দেব।’ সংশয়হীন গলায় বলল একলব্য। 

‘এ তোমার আবেগ। তরুণ তুমি। আবেগের বশে কথাগুলো বলছ তুমি।’ 

‘ভক্তি আমার আবেগকে সংহত করেছে। আমার মূলধন আমার ভক্তি। আবেগ দ্বারা পরিচালিত নই আমি। আপনি আমাকে আদেশ করুন, কী গুরুদক্ষিণা দেব।’ অত্যন্ত শান্ত সংযত গলায় কথাগুলো বলে গেল একলব্য। 

এই সময় গাছের আড়াল থেকে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠল কর্ণ। ‘থাম, ওরে অর্বাচীন, থাম তুই।’ সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংযত করল কর্ণ। তার কথা গোঙানি হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। গোঙানোর শব্দ আচার্য আর অর্জুনের কানে পৌঁছাল। একলব্য শুনতে পেল না। সে ভক্তির ঘোরে ছিল। আচার্য উৎকর্ণ হয়ে পরবর্তী শব্দ শুনতে চাইলেন। অর্জুন ইতিউতি তাকাতে লাগল। কর্ণ গাছের আড়ালে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকল। একসময় অর্জুন-দ্রোণ নিশ্চিত হলেন যে আশপাশে কেউ নেই। যা শুনেছেন, তা মানুষের কণ্ঠধ্বনি নয়। গভীর বনমধ্যে কত কিছুরই তো আওয়াজ হতে পারে। 

কর্ণ ভেবে চলেছে–ভক্তিরসে ডুবন্ত এই মূর্খটাকে বাঁচানো উচিত। নইলে তার সমূহ বিপদ। ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় মিলে এই নিষাদের যে ক্ষতিটা করবে, জীবন দিয়ে তার শোধ দিতে হবে তাকে। কর্ণ নিশ্চিত যে, দ্রোণ একলব্যের প্রাণ নেবে না, কিন্তু এমন কিছু একটা চেয়ে বসবে, যার জন্য চরম মূল্য দিতে হবে একলব্যকে 

কর্ণ আরও ভাবল-অরণ্যচারী এই মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে সহজ-সরলই থেকে গেল। ব্রাহ্মণ্যকূটবুদ্ধির মারপ্যাচ আর ক্ষত্রিয়ের বাহুবলের স্বরূপ বুঝল না কোনোদিন। মানুষকে বিচার করতে শিখল মানবিক মূল্যবোধের নিরিখে। প্রয়োজনে এবং স্বার্থে আঘাত লাগলে এই ক্ষত্রিয় আর ব্রাহ্মণরা যে কতটুকু হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, তা জানল না এই বনভূমির মানুষগুলো। দ্রোণের দাবি মেটাতে গিয়ে তুমি যে একেবারে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে যাবে একলব্য। তুমি ওভাবে রাজি হয়ো না। যা চান, তা দিতে সম্মত হয়ো না তুমি নিষাদপুত্র। 

কর্ণের এই ভাবনাগুলো কথা হয়ে নৈষাদি একলব্য পর্যন্ত পৌঁছাল না। কর্ণের ভাবনাগুলো তারই মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল। নিরুপায় কর্ণ চিৎকার করে উঠতে পারছে না, পাছে তার উপস্থিতি টের পেয়ে যান দ্রোণ। এই মুহূর্তে কুরুরাজপ্রাসাদে দ্রোণাচার্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিধর মানুষ। রাজপ্রাসাদের পরবর্তী উত্তরাধিকারীরা তাঁর বশীভূত। পিতামহ ভীষ্ম তাঁকে সমীহ করেন, ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে মূল্য দেন। সুতরাং এইসময় দ্রোণের কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া মানে যমদূতকে ডেকে আনা। গাছের আড়ালে নিজে নিজেই নিষ্পেষিত হতে থাকল কর্ণ। 

দ্রোণাচার্য সহজ গলায় বললেন, ‘তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না বস। গুরুদক্ষিণার নামটি শুনে তুমি যদি পিছিয়ে যাও। যদি বলো—তা কী করে সম্ভব গুরুদেব! অন্যকিছু চান আপনি আমার কাছে।’ 

বিনীতভাবে একলব্য বলল, ‘নিষাদদের কাছে আর কিছু না থাকুক, কথার মূল্য আছে। জীবন দিয়ে কথার মর্যাদা রাখে তারা। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, যা চাইবেন, তা-ই দেব আমি।’ 

‘তুমি প্রতিজ্ঞা না করলে আশ্বস্ত হতে পারছি না আমি। অল্প বয়স তোমার। আমার দাবি শুনে তুমি ভড়কে গিয়ে আবার পিছিয়ে না পড়ো।’ অর্জুনের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন দ্রোণ। 

অর্জুন বুঝল-আচার্য কূটপথ ধরেছেন। জোরের পথে গেলেন না তিনি। এইসব হীনজাতের মানুষদের যা বললে নিতান্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, তা-ই বলতে চাইছেন গুরুদেব। ভক্তির নেশায় আপ্লুত করে চরম ক্ষতি করতে চাইছেন একলব্যের। 

গুরুর কথাকে সমর্থন করে অর্জুন বলে উঠল, ‘গুরুদেব ঠিকই বলেছেন, তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও আগে, তারপর তিনি গুরুদক্ষিণার নাম উল্লেখ করবেন।’ 

এবার একলব্য দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল, ‘মা-বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু জীবনে যাঁর কাছে আমি সর্বতোভাবে ঋণী, তিনি আমার পিতামহ অনোমদর্শী। সেই অনোমদর্শীর নামে শপথ করে বলছি-গুরুদক্ষিণা হিসেবে আপনি আমার কাছে যা চাইবেন, বিনা দ্বিধায় তা-ই দেব আমি আপনাকে।’ 

দ্রোণাচার্য আর অপেক্ষা করলেন না। ত্বরিত বললেন, ‘তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি আমায় দিতে হবে। সেটাই হবে তোমার গুরুদক্ষিণা।’ 

সেকালে গুরুরা শিষ্যদের কাছে গুরুদক্ষিণা চাইতেন। এটাই প্রথা। কিন্তু তাঁরা এমন কিছু চাইতেন, যা পূরণ করতে শিষ্যদের অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হতো, অনেক কায়িক শ্রম করতে হতো। কিন্তু গুরুরা এমন কিছু চাইতেন না, যা পূরণ করতে গিয়ে শিষ্যদের সাংঘাতিক কিছু ক্ষতি হয়ে যেত, জীবন সংশয় হতো। 

কিন্তু গুরু দ্রোণ এমন দক্ষিণা চাইলেন, তা পূরণ করতে গিয়ে একজন তীরন্দাজের জন্য সবচাইতে দরকারি প্রত্যঙ্গটি হারাতে হবে। দ্রোণ একদিনের জন্যও একলব্যকে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেন নি, অথচ একলব্য তাঁকে গুরুর সম্মান দিচ্ছে বলে তার সমূহ ক্ষতি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হলেন না দ্রোণ। 

একলব্য দ্রোণাচার্যের গুরুদক্ষিণাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারত, কিন্তু ও যে দাদুর নামে প্রতিজ্ঞা করেছে। তাও না হয় উড়িয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু ও যে অস্ত্রগুরুকে কথা দিয়েছে। যাকে সারাটা জীবন মনে মনে ভক্তি করে এসেছে, সেই গুরুকে কী করে প্রত্যাখ্যান করবে একলব্য! না, কিছুতেই না। বুড়ো আঙুলটি কর্তন করতে গিয়ে যদি তার প্রাণও যায়, তাতেও ঠিক আছে। নিজেকে কিছুতেই মলিন করা চলবে না। 

অবিচলিতভাবে স্থির চোখে সে দ্রোণের মুখের দিকে তাকাল। তাকিয়েই থাকল কিছুক্ষণ। আচার্যের চোখে তখন নিষ্ঠুরতা খেলা করছে, অর্জুনের চোখ চকচকে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তার প্রবল প্রতিপক্ষ ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এর চেয়ে আনন্দের ও লোভের আর কী হতে পারে? 

কোমরে গোঁজা টাঙ্গিটা টেনে বের করল একলব্য। তারপর উঠানের একপ্রান্তে দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে গেল। কদলিবৃক্ষের নিকটেই গেল সে। একটা নবীন কদলিপত্রের অগ্রভাগ সেই টাঙ্গি দিয়ে কেটে নিল। তারপর গেল জলভর্তি কলসির কাছে। পত্রআগাটি ভালো করে ধুয়ে নিল সে। অপরিষ্কার কোনো পত্রের ওপর তো আর গুরুদক্ষিণা দেওয়া যায় না। আস্তে আস্তে দ্রোণাচার্যের পায়ের কাছে এগিয়ে গেল একলব্য। হাঁটু গেড়ে বসল। কদলিপত্রটি পায়ের কাছে রাখল। 

তারপর তীক্ষ্ণ টাঙ্গিটি দিয়ে একটানে নিজের ডানহাতের বুড়ো আঙুলটি কেটে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। কলাপাতাটি ঘন লাল রক্তে ভরে উঠল। সেই রক্তের মাঝখানে একলব্য তার কর্তিত আঙুলটি রাখল। অবিচলিত মুখ তার, স্থির চোখ। তার শরীরটি থিরথির করে কাঁপছে। 

হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল অর্জুন। দ্রোণাচার্য একপলকের জন্যও একলব্যের কর্তিত আঙুলটির দিকে তাকালেন না। হনহন করে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলেন তিনি। 

উঠানের মাঝখানে, সারা গায়ে সূর্যকিরণ মেখে, নিজের কর্তিত রক্তাক্ত বুড়ো আঙুলটির সামনে, নির্বাক হয়ে বসে থাকল একলব্য। 

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না কর্ণ। হা হা করে বৃক্ষের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। দ্রোণ-অর্জুনের পথ আগলে দাঁড়াল। 

‘বাঃ! বাঃ! কী চমৎকার বিচার আপনার গুরুদেব! ধুত্তুরি, বিচার বলছি কেন, এ তো আপনার গুরুদক্ষিণা। দীক্ষা না দিয়েও গুরুদক্ষিণা নিলেন আপনি! আপনি না নিজেকে সত্যপ্রিয় ন্যায়বিচারক বলে দাবি করেন? সব্রাহ্মণ বলে আপনার সে-কী অহংকার! এই কি সব্রাহ্মণের গুরুদক্ষিণা? যে তরুণটিকে আপনি হীনবংশের বলে একদিন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, একদিনের জন্যও যাকে আপনি অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেন নি, সেই তরুণটির কাছ থেকে দক্ষিণার দোহাই দিয়ে তার দামি প্রত্যঙ্গটি কেড়ে নিলেন? আপনি তো অবিরাম বলে গেলেন—নিষাদ, তুমি আমার শিষ্য নও, তোমাকে আমি কখনো দীক্ষা দিই নি। তাহলে শিষ্য নয় এমন একজন সহজসরল তরুণের কাছ থেকে দক্ষিণা নিলেন কী করে? আর নিলেন যদি, কী নিলেন? তীর নিক্ষেপণে যে প্রত্যঙ্গটি সবচাইতে জরুরি, সেটাই কেড়ে নিলেন আপনি? গুরুর তো উচিত গুরুদক্ষিণা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। আপনি তো দক্ষিণা সঙ্গে নিচ্ছেন না, ফেলে রেখে যাচ্ছেন। ভুলে বোধ হয় ফেলে যাচ্ছেন। দাঁড়ান, আমি রক্তভেজা আঙুলটি আপনার কাছে এনে দিই।’ কখনো রুষ্ট, কখনো শোকার্ত গলায় বলে গেল কৰ্ণ। 

এতক্ষণে কথা বললেন দ্রোণ, ‘পথ ছাড়ো কর্ণ। আমাকে যেতে দাও। বাতুলতা কোরো না।’ 

‘তা তো হয় না গুরুদেব। আমি অত সহজে তো আপনাকে যেতে দেব না। একলব্যের কাটা আঙুলটি আপনাকে নিয়ে যেতেই হবে।’ বলে হু হু করে কেঁদে উঠল কর্ণ। অনেকক্ষণ কাঁদল সে। 

তারপর অর্জুনের দিকে মুখ ফেরাল কর্ণ। তীব্র রোষে জ্বলে ওঠা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তুমি তৃপ্ত হয়েছ তো অর্জুন? কল্পিত প্রতিদ্বন্দ্বীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতটি ধ্বংস করতে পারায় তোমার তো খুশি হওয়ারই কথা। একজন নিষাদের ভয়ে তুমি কম্পিত হলে? তুমি না দ্রোণের শ্রেষ্ঠ শিষ্য? অসহায় কাউকে নির্মূল করার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের কী-ই বা আছে? উত্তম ছাত্রের দোহাই দিয়ে আচার্যকে অন্যায় কাজে প্ররোচিত করেছ তুমি। তোমারই উস্কানিতে উত্তেজিত হয়ে জগদ্বিখ্যাত অস্ত্রগুরু ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করলেন। না গুরুদেব?’ দ্রোণের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করল কর্ণ 

‘তুমি সূতপুত্র। তোমার সঙ্গে অযথা তর্ক করতে রাজি নই আমি।’ দ্রোণাচার্য 

বললেন। 

অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল কর্ণ। বলল, ‘হাসালেন গুরুদেব, ভীষণ হাসালেন আমায়।’ একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল কর্ণ, ‘সূতপুত্র বলে নিন্দা করছেন আমাকে। এ আপনার নতুন কথা নয়, পুরনো কথা। জিজ্ঞেস করি-সূতপুত্র বড় না নিষাদপুত্র? জানি, ব্রাহ্মণ্যচিন্তায় উদ্বেলিত হয়ে আপনি বলবেন—কেন, সূতপুত্র নিষাদপুত্রের চেয়ে বড়। মানে নিষাদরা সূতের চেয়েও হীন, নিকৃষ্ট। জিজ্ঞেস করি, সেই নিকৃষ্ট মানুষটির কাছ থেকে দান গ্রহণ করতে কেমন লাগল আপনার? গুরু না হয়েও যিনি গুরুদক্ষিণা নেন, তা তো তখন দক্ষিণা থাকে না আর। তা হয়ে যায় অনুগ্রহের দান। আজ সেই অনুগ্রহের দানই গ্রহণ করলেন আপনি তথাকথিত সেই হীন জাতের নিকৃষ্ট তরুণটির কাছ থেকে।’ 

দ্রোণের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না। অর্জুন বলল, ‘তুমি চুপ থাকো কৰ্ণ।’

‘আমি চুপ থাকলে কী হবে? ভবিষ্যতের পৃথিবী একদিন তোমাদের দুজনকেই নিন্দা জানাবে। ধিক্কার দেবে তোমাদের নামে। শোনো অর্জুন, বিনা অপরাধে একলব্যের বুড়ো আঙুলটি কেটে নিলে তোমরা। এর জন্য সর্বাংশে তুমি দায়ী। ভবিষ্যতে তোমাকে এর জন্য মস্ত বড় মূল্য দিতে হবে। কে জানে, হয়তো এই একলব্যের সামনেই, প্রাণভিক্ষার জন্য একদিন হাঁটু গেড়ে বসতে হবে তোমায়।’ 

তারপর কর্ণের কী হলো কে জানে, খুব বিচলিত দেখাল তাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর কড়া দুটো চোখ দ্রোণের দিকে ফেরাল। কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘আমি অধিরথ-পুত্র। গোটা জীবনে আমি যদি সামান্য ভালো কাজ করে থাকি, তার দোহাই দিয়ে বলছি—এমন একদিন আসবে সেদিন এই অসহায় একলব্যের মতো আপনি নিরুপায় ভঙ্গিতে বসে থাকবেন। একলব্যের বুড়ো আঙুলের মতো আপনার শরীরের কোনো প্রত্যঙ্গ কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে নিয়ে যাবে। এই আমার অভিশাপ হলে অভিশাপ, ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা হলে প্রার্থনা, এ দুটোর যে- কোনো একটি বা দুটোই ধরে নিতে পারেন।’ 

বলতে বলতে আকুলিত কান্নায় ভেঙে পড়ল কর্ণ। তার তূণ, তার ধনুক মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। ধুলার ওপর দুমড়ে মুচড়ে বসে পড়ল কর্ণ। 

মাথা নিচু করে দ্রোণাচার্য আর অর্জুন একলব্যের কুটিরাঙ্গন ত্যাগ করলেন। 

পেছনে পড়ে থাকল কর্ণ। পড়ে থাকল কর্তিত আঙুলের একলব্য, পড়ে থাকল রক্তভেজা একলব্যের বুড়ো আঙুলটি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *