একলব্য – ১৯

১৯

বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। 

.

অনেকগুলো বছর কেটে গেল। 

বনমধ্যে নির্জনে একাগ্রমনে শরসাধনা করে গেল একলব্য। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ চলে যাওয়ার পর একলব্য বোঝার চেষ্টা করেছে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে তার। অবশিষ্ট আঙুলগুলো দিয়ে কতদূর এবং কত শিগগির বাণমোচন করা যায়, তার সাধনা করে গেছে সে। আঙুল হারানোয় তার বাণের গতি কমে গিয়েছিল। কিন্তু মনের জোরে আর কঠোর অধ্যবসায়ে একলব্য ধীরে ধীরে পূর্বের দক্ষতা অর্জন করল। একনিষ্ঠ অভ্যাসে চার আঙুল ব্যবহার করেই বাণমোক্ষের নিজস্ব উপায় উদ্ভাবন করল একলব্য। একদিন সে পরিপক্ব সমর্থ ধনুর্বিদে পরিণত হলো। 

মাথা উঁচু করে একলব্য ফিরে এল নিষাদরাজ্যে। বিপুল সম্ভারে সম্ভাষিত হলো সে রাজধানীতে। 

কালক্রমে অনোমদর্শী পরলোকে গেলেন। হিরণ্যধনু আর বিশাখাকে বার্ধক্য ঘিরে ধরল। গোশৃঙ্গরাজ্যের রাজকন্যাকে পুত্রবধূ করে আনলেন তাঁরা। তারপর এক শুভদিনে একলব্যকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন হিরণ্যধনু। পুত্র একলব্য রাজসিংহাসনে বসলে সস্ত্রীক ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করলেন তিনি। সুশাসক হিসেবে, সুদক্ষ যোদ্ধা হিসেবে একলব্যের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। 

মথুরার কৃষ্ণ তখন প্রবল প্রতাপশালী। উত্তর-পশ্চিম ভারতে নিজের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে তিনি মনোযোগী। কিন্তু কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠাপথের প্রধান অন্তরায় মগধরাজ জরাসন্ধ। জরাসন্ধের মিত্রগোষ্ঠী তার সহযোগী। কৃষ্ণের উত্থান তারা মেনে নিতে নারাজ। জরাসন্ধের মিত্রদের অন্যতম একলব্য। স্বাভাবিকভাবে একলব্য কৃষ্ণের প্রতিপক্ষ।

জরাসন্ধের জামাতা কংসকে কৃষ্ণ কৌশলে হত্যা করলেন। জরাসন্ধ ক্ষেপে গেল। কৃষ্ণকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করল জরাসন্ধ ও তার মিত্রগোষ্ঠী। এই মিত্রগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল চেদিরাজ শিশুপাল, সৌভপতি শাল্ব, পুণ্ড্রবর্ধনের অধিপতি পরাক্রান্ত পৌণ্ড্রক বাসুদেব, প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরকাসুর এবং নিষাদরাজ্যাধিপতি একলব্য। 

জরাসন্ধের ভয়ে কৃষ্ণ পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। মথুরা থেকে রাজধানী দ্বারকায় স্থানান্তরিত করলেন। এইসব ডামাডোলের মধ্যে তিনি পাণ্ডব-কৌরবের জ্ঞাতিবিরোধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। এবং শক্ত সমর্থ একটা রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করতে সমর্থ হলেন। 

তীক্ষ্ণ কূটকৌশলের আশ্রয়ে জরাসন্ধকে হত্যা করান কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞকালে জরাসন্ধমিত্র শিশুপালকে খুন করেন কৃষ্ণ। এই হত্যাগুলোর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পৌণ্ড্রক বাসুদেব কৃষ্ণকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে সসৈন্যে অংশ নেয় একলব্য। ইত্যবসরে সৌভপতি শাল্বের সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শাল্ব মারা যায়। 

ওদিকে এদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে পৌণ্ড্রক বাসুদেব রাতের অন্ধকারে দ্বারকা আক্রমণ করে বসে। এই যুদ্ধে কৃষ্ণের সঙ্গে একলব্যের মুখোমুখি দেখা। একলব্য তখন মহাকাল অন্তক যমের মতো ভয়ংকর। ভীষণদর্শন এক ধনুক হাতে যুদ্ধ শুরু করল একলব্য। এক এক বারে শতাধিক বাণে যাদবসৈন্য মানে কৃষ্ণের সৈন্য নিধন করতে থাকল সে। যাদবদের মধ্যে সেদিন এমন যোদ্ধা ছিল না, যে নিষাদ একলব্যের বাণবৰ্ষণে আহত হয় নি। 

কৃষ্ণ এই যুদ্ধেই বুঝে গিয়েছিলেন—নিরঙ্গুষ্ঠ অবস্থাতেও একলব্য কত ভয়ংকর। পঁচিশ-ত্রিশটি তীর এক-একজনের ওপর নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল সে। তার শরাঘাত থেকে কৃষ্ণও মুক্ত থাকেন নি। 

সেই রাত্রির যুদ্ধে কৃষ্ণসৈন্যরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। অবিরাম বাণবর্ষণে একলব্য যাদবদেরকে রণক্ষেত্র থেকে ঝেঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যাদবসৈন্যদের এই বিধ্বস্ত অসহায় অবস্থা দেখে একলব্য বেশ গর্ববোধ করেছিল। কৃষ্ণপক্ষের বড় বড় যোদ্ধাদের নিজের নাম শুনিয়ে উচ্চস্বরে বলেছিল, ‘ওরে পলায়মান শিয়ালের দল, শুনে রাখ আমার নাম। আমি একলব্য, মহাবীর একলব্য আমার নাম। তোদের ওই যে কৃষ্ণবন্ধু অর্জুন, নিজেকে খুব শক্তিমান ভাবে। আরে, ও কীসের বীর! ও তো একটা ধুরন্ধর ধান্ধাবাজ। আজকে পেলে হতো তাকে। যমালয়ে পাঠাতাম। তাকে বলে দিয়ো–আমার হাত থেকে বাঁচোয়া নেই তার। যতই দ্রোণাচার্যের পদলেহন করুক না কেন, একদিন না একদিন আমার হাতে মৃত্যু হবে তার।’ 

তারপর কৃষ্ণের দাদা বলরামের ওপর চোখ পড়ল একলব্যের। গলায় তীব্র শ্লেষ ছড়িয়ে বলল, ‘আরে হলধর বলরাম, অন্ধকারের দিকে কোথায় যাচ্ছ তুমি? মুখ লুকাতে যাচ্ছ বুঝি? তুমি না মস্তবড় বীর? অহংকারে তো মাটিতে পা পড়ে না তোমার। এখন কাঁধে হাল নিয়ে ওদিকে কোথায় পালাচ্ছ তুমি?’ 

একলব্যের সিংহনাদে ঘুরে দাঁড়ালেন বলরাম। দুজনের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হলো। একলব্য ক্ষিপ্রহাতে প্রথমে দশটা নারাচ তীর নিক্ষেপ করল। তার বাণাঘাতে বলরাম দিশেহারা হয়ে পড়লেন। বলরাম সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে একলব্যের রথের ধ্বজাটুকু কাটতে সমর্থ হলেন মাত্র। 

যুদ্ধ চলতে থাকল। এবার একলব্য এমন একটা ধনুক হাতে নিল, যার ছিলাটি অত্যন্ত সুদৃঢ় এবং লম্বায় সাড়ে চার হাত। বলরাম বুঝলেন—সংকটকাল উপস্থিত। এই ধনুক থেকে ক্ষিপ্রবাণগুলো নিঃসৃত হতে থাকলে ধড়ে আর মুণ্ড থাকবে না। তাই আগেভাগেই একলব্যের ধনুকটা কেটে ফেললেন তিনি। মুঠো করে ধরতে হয় যে জায়গায়, ঠিক ওখানটায় কেটে ফেললেন বলরাম। 

একটা সময়ে বলরামের হলাঘাতে মাটিতে বসে পড়ল একলব্য। সে মাটিতে পড়ে গেলে বলরাম তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু নিমিষেই সেখানে উপস্থিত হলো শত শত নিষাদসৈন্য। সৈন্যরা বলরামকে ছেঁকে ধরল। এদিকে একলব্য উঠে দাঁড়াল। গদাহস্তে দ্রুত এগিয়ে গেল বলরামের দিকে। গদাযুদ্ধে অতিকৌশলী বলরাম একলব্যকে এতটুকু টলাতে পারলেন না। তুমুল গদাশব্দের অভিঘাতে চতুর্দিকের সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে উঠল। সে শব্দ সমুদ্রের তরঙ্গের অভিঘাতের মতো, সে শব্দ প্রলয়ংকরী অন্তিমকালের মতো। 

ঠিক এইসময় চিৎকার শোনা গেল—কৃষ্ণের হাতে পৌণ্ড্রক বাসুদেব নিহত হয়েছে। এই ঘোষণায় বাসুদেবের সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হলো। ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারল পালাতে লাগল সৈন্যরা। একলব্য গদাযুদ্ধ থামিয়ে নিজ সৈন্যদলে মিশে গেল। অক্ষত অবস্থায় নিজরাজ্যে ফিরে এল সে। পালিয়ে আসার গ্লানিটা একলব্যের মধ্যে গুমরে মরতে লাগল। 

.

ওইদিন দ্রোণের হাতে অপমানিত হয়ে, অর্ধেক রাজ্য হারিয়ে দ্রুপদ ফিরে এসেছিলেন। তাঁর মধ্যে মরণান্তক প্রতিশোধস্পৃহা। দ্রোণ-হত্যার প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি। একমাত্র দ্রোণ হত্যার মধ্যদিয়েই দ্রুপদের বুকের জ্বালা মিটতে পারে। কিন্তু তিনি তো ক্ষীণশক্তি দ্বিখণ্ডিত তাঁর রাজ্য। এইসময় একা অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব নয়। শুধু একজন পুত্রের মাধ্যমে তার প্রতিশোধবাসনা চরিতার্থ হতে পারে। একদিন সেই আকাঙ্ক্ষিত পুত্রের আবির্ভাব হলো। তিনি সেই পুত্রের নাম রাখলেন—ধৃষ্টদ্যুম্ন। ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে জন্মাল দ্রৌপদী। ধৃষ্টদ্যুম্ন তার আবির্ভাবের কাল হতে দ্রোণহন্তা বলে চিহ্নিত হলো, অন্যদিকে কৌরবকুলের ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত হলো দ্রৌপদী। দ্রোণ এবং দ্রোণের আশ্রয়দাতা কৌরবদের সকলেই পাঞ্চাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। দ্রোণের কারণে নিজের এবং কৌরবদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠল। 

কালক্রমে পাণ্ডব আর কৌরবদের মধ্যে জ্ঞাতিবিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। একদিকে পঞ্চপাণ্ডব অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনাদি। বিরোধ বাঁধল ধৃতরাষ্ট্র-পরবর্তী রাজা নিয়ে, শত্রুতা প্রবল আকার নিতে থাকল সুচ্যগ্র মেদিনী নিয়ে। জ্ঞাতিশত্রুতা কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠল। দুর্যোধনরা পাণ্ডবদের বারণাবতে পুড়িয়ে মারতে চাইল। সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচল যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুনরা। 

কুরুকুলের জ্ঞাতিশত্রুতার সংবাদ দ্রুপদ রাখেন। এই শত্রুতার সুযোগ নিতে চাইলেন তিনি। সেই বংশের মুখ্যতম ধানুষ্ক অর্জুনের সঙ্গে নিজকন্যা দ্রৌপদীর বিয়ে দিতে মনস্থ করলেন দ্রুপদ। যে অর্জুনকে দিয়ে দ্রোণাচার্য দ্রুপদের চরম অপমান করেছেন, দ্রোণের সেই প্রিয়তম শিষ্যকে জামাই করে নিজের দলে টানতে চাইলেন তিনি। কৃতকার্যও হলেন শেষ পর্যন্ত। লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে জিতে নিল অর্জুন। মা কুন্তীর কারণে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব—এই পঞ্চপাণ্ডবদের স্ত্রী হয়ে গেল। 

বিবাহ-সংবাদে সবচাইতে বেশি ভাবিত হলেন দ্রোণাচার্য। দ্রোণের যশোভাবনা, অহংকার-সবকিছু যেন লণ্ডভণ্ড হতে চলল। পুত্রাধিক প্রিয়তম শিষ্য দ্রুপদের দলে মিশে গেল! 

দ্রুপদ যেমন দ্রোণের খবর রাখতেন, দ্রোণও দ্রুপদের সংবাদ রাখতেন। তাঁর নিধনের জন্য যে দ্রুপদ পুত্র কামনা করেছেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদী নামে যে তাঁর দুটো সন্তান লাভ হয়েছে—এ সংবাদ দ্রোণের অগোচরে থাকে নি। ঠান্ডা মাথায় তিনি ভাবলেন। কিছুতেই অর্জুনকে হাতছাড়া করা যাবে না। তাই পাণ্ডবদের বিবাহ সংবাদ যখন কৌরবসভায় পৌঁছাল, তখন দ্রুপদ-বিরোধিতা মিটিয়ে ফেলতে তৎপর হলেন দ্রোণাচার্য। 

কৌরব রাজসভায় ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রকে পাণ্ডবদের রাজ্যভাগ ফিরিয়ে দিতে উপদেশ দিলেন। দ্রোণাচার্যও চুপ থাকলেন না। বললেন, ‘মহাত্মা ভীষ্মের সঙ্গে আমিও একমত। পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতার আর দরকার নেই। উপরন্তু আমি আরও বলতে চাই, ওদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দ্রুপদ-রাজসভায় এখনই একজন দূত পাঠান। দূত গিয়ে যেন বলে— এই বিয়েতে আপনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। আপনি তাদের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করছেন। এই বিবাহ সম্বন্ধে পাঞ্চাল আর কৌরবদের মধ্যে একটা গভীর প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে—এইসব কথা দ্রুপদকে বলতে যেন ভুল না করে আপনার দূত।’ 

ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণের কথায় খুব কর্ণপাত করলেন বলে মনে হলো না। তিনি উদাসীন থাকলেন। 

কর্ণ বলে উঠল, ‘কী গুরুদেব, ভয় পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে? চিরশত্রুকে শুভসন্দেশ পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছেন মহারাজকে! রাতারাতি বোল পাল্টে গেল আপনার!’ 

দ্রোণাচার্য কিছু বলবার আগে বিদুর বলে উঠলেন, ‘তুমি সংযতবাক হও কর্ণ। মাননীয়কে সম্মান দিতে শেখো।’ 

এরই মধ্যে কুরুমুখ্যদের মন্ত্রণাসভায় বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ধৃতরাষ্ট্রের পাশের আসনে জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন বসা শুরু করেছে, যথামর্যাদার আসনে বসে কর্ণ। ভীষ্ম, বিদুর, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য— এঁদের পরামর্শ আর আগের মতো মর্যাদা পায় না মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। আজকাল দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ আর শকুনিকে মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দেন তিনি। তাতে সভামুখ্যরা সংকুচিত হয়ে থাকেন। 

কর্ণ সহর্ষে বলল, ‘আপনি থামুন খুল্লতাত। আচার্যের মতো ক্রূর মানুষরা মহারাজকে কুপরামর্শ দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন, আর মর্যাদার দোহাই দিয়ে আপনি আমাকে চুপ থাকতে বলছেন! যে পরামর্শ দিলেন আপনি, তা যদি মহারাজ পালন করেন তাহলে কুরুবংশের মর্যাদা ধুলায় মিশে যাবে। কোথায় প্রবল প্রতাপী মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আর কোথায় খণ্ডিত রাজ্যের ক্ষুদ্র রাজা দ্রুপদ। দ্রুপদকে রাজা বলতেই আমার সংকোচবোধ হচ্ছে।’ 

একটু দম নিয়ে কর্ণ আবার বলল, ‘আমার মিত্র দুর্যোধনের কপাল ভাঙার পরামর্শ দিচ্ছেন আপনি। পাণ্ডবদের সম্ভাষণ জানিয়ে ঘরে আনুন, তাদের অর্ধেক বা গোটা সাম্রাজ্য ছেড়ে দিন—এই তো আপনার পরামর্শ গুরুদেব?’ শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে কথা শেষ করল কর্ণ। 

কর্ণের রাগের কারণ দ্রোণের অজানা নয়। তাঁর কাছ থেকে ব্রহ্মাস্ত্র না পাওয়ার ক্ষোভ কর্ণের মধ্যে। তাই বলে রাজসভায় দাঁড়িয়ে অপমান করা! দ্রোণের মর্যাদা এই রাজসভায়, এই হস্তিনাপুরে কি কম? দ্রুপদের সঙ্গে তো তাঁর ব্যক্তিগত শত্রুতা। তারপরও হস্তিনাপুরের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে সৎপরামর্শ দিয়েছেন। 

কর্ণের কটু কথার প্রত্যুত্তরে দ্রোণ বললেন, ‘ওরে দুষ্টমতী কর্ণ, তোর অসৎ চিন্তার কথা কে না জানে? পাণ্ডবদের ওপর তোর চিরকালের রাগ। তাই আমার সৎপরামর্শের বিরোধিতা করছিস তুই।’ 

তারপর সভার উদ্দেশে বললেন, ‘আমার কথা না শুনলে কুরুবংশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ 

এবার দুর্যোধন আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সরোষে বলল, ‘আপনি থামুন গুরুদেব। সর্বনাশ হয়ে যাবে..আপনি ত্রিকালজ্ঞ ঋষি নাকি? ভবিষ্যৎ দেখতে পান আপনি?’ 

ধৃতরাষ্ট্র যথাপূর্বং মৌন রইলেন। বাকবিতণ্ডার সবকিছু শোনার পরও নির্বাক রইলেন তিনি। বিদুর দেখলেন, বড় অপমান হয়ে যাচ্ছে দ্রোণাচার্যের। কণ্ঠকে একটু উঁচুতে নিয়ে গিয়ে তিনি বললেন, ‘পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণ, কৃপাচার্য—এঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কুরুপ্রাসাদে দ্রোণাচার্যের অবস্থিতি পরম মর্যাদার আসনে। পিতামহ ভীষ্মের মতো দ্রোণাচার্যও কখনো কুরুদের অমঙ্গলকর কথা বলেন নি। কোনোদিন রাজপ্রাসাদের অপকারও করেন নি। দুর্যোধন, কর্ণ–তোমরা আচার্যের প্রতি কটূক্তি কোরো না।’ 

তিনি আরও বললেন, ‘কৃষ্ণ এসে পাণ্ডবদের সঙ্গে মিশেছে। ভীম পরাক্রমশালী গদাযোদ্ধা, অর্জুন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর, যুধিষ্ঠির ধীরস্থির, উত্তম পরামর্শক। তাদের সঙ্গে যদি দ্রুপদের রাজশক্তি যুক্ত হয়, সেই সম্মিলিত শক্তির প্রাবল্য সম্পর্কে এখনই ভাবা উচিত। এই সুযোগে পরম শত্রু দ্রুপদকে যদি কাছে টানা যায়, তাহলে জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে রাজ্যশাসন সহজতর হবে। আরও বলছি—যে দ্রুপদের জামাই পঞ্চপাণ্ডব, যার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, তাঁকে ক্ষুদ্র শক্তিধর মনে করবেন না মহারাজ। এটাও ভুলবেন না যে, কৃষ্ণ দ্রুপদের মিত্র।’ 

বিদুরের কথায় কাজ হলো। কর্ণ-দুর্যোধনের পরামর্শ উপেক্ষা করলেন ধৃতরাষ্ট্র। দ্রুপদকে প্রীতি সম্ভাষণ জানাবার জন্য বিদুরকেই তিনি পাঞ্চালে পাঠালেন। কুন্তী আর দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবকে ফিরিয়েও আনলেন রাজধানীতে। 

পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে এলে মন্ত্রী-অমাত্যদের চাপে ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যভাগ করে দিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রদের। নির্গুণ ভূমিগুলোই পাণ্ডবদের ভাগে পড়ল। পাণ্ডবরা ময়দানব দিয়ে রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণ করাল। রাজা যুধিষ্ঠিরের মানমর্যাদা ভারতবর্ষের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। যুধিষ্ঠিরের মর্যাদা ও ধনসম্পদ যত বাড়ল, দুর্যোধনের ঈর্ষা বাড়ল ততোধিক। দুর্যোধনের অসূয়া দ্বারা ধৃতরাষ্ট্র সংক্রামিত হলেন। রাজসভায় বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের প্রভাব কমে গেল। স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের প্রত্যেকটি কথায় সায় দিতে লাগলেন। 

এরই ফলে পাশাখেলার আসর বসল। সবকিছু হারানোর পর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি ধরল। শকুনির চালে দ্রৌপদীকেও পাশায় হারাল যুধিষ্ঠির। রাজসভায় সবার সামনে কৃষ্ণা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো অসভ্যতাও সংঘটিত হলো। 

দ্বিতীয়বারের পাশাখেলায় বাজি ছিল-হারলে বারো বছরের বনবাসে এবং এক বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে হবে পাণ্ডবদের। যথারীতি হারল যুধিষ্ঠির। বনবাসে যেতেই হলো পাণ্ডবদের। যাওয়ার আগে পাণ্ডবরা প্রতিজ্ঞা করল—কুরুবংশ ধ্বংস করবে তারা। কর্ণ ও শকুনিও এই প্রতিজ্ঞার বাইরে থাকল না। 

পাণ্ডবদের বনবাসের সময় অতিক্রান্ত হলো। শেষ হলো অজ্ঞাতবাসের বছরটিও। তারা তাদের রাজধানীতে ফিরে এল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *