একলব্য – ২২

২২

সভায়াং প্রাহসঃ কর্ণ ক্ব তে ধর্ম স্তদা গতঃ? 
সভায় যেদিন হাঃ হাঃ করে হেসেছিলে, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল কর্ণ? 

.

দিশেহারা দুর্যোধন। 

বিভ্রান্ত, ক্লিন্ন অবস্থা তার। অনেক সহোদর নিহত। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়যোদ্ধারা তার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। তার পক্ষের শত-সহস্র সৈন্য ক্ষয় হয়েছে। প্রাসাদাভ্যন্তরে নারীদের হাহাকার। বোন দুঃশলার দিকে তাকানো যায় না। মায়ের চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু গড়াচ্ছে। যুদ্ধ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, পিছু হটার উপায় নেই। হয় জয়, না হয় মৃত্যু। 

দুজন মহাবীর চলে গেছেন। পিতামহ ভীষ্ম আর আচার্য দ্রোণ ছিলেন কৌরবদের সবচাইতে বড় ভরসার স্থল। চক্রান্ত করে, মিথ্যে তথ্য পরিবেশন করে অপ্রতিদ্বন্দ্বী দ্রোণকে হত্যা করিয়েছে যুধিষ্ঠির। ও নাকি ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির। প্রয়োজনে মিথ্যের বেসাতি করতে দ্বিধা করল না বেজন্মাটা। লাথি মার ওরকম ধর্মাত্মার মুখে। ওরে বেটা, যে গুরুর পায়ের কাছে বসে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিস, সেই গুরুর হত্যার কারণ হলি তুই? দুরাত্মা কৃষ্ণ নিশ্চয়ই তোকে এই কথাটি শিখিয়ে দিয়েছে। বহুগামী অর্জুন নিশ্চয় তোকে প্ররোচিত করেছে। আর ওই নপুংশক নকুল-সহদেব, ওরা তো মানুষই না। আস্ত দুটো মাকাল ফল। ওই মাকাল ফল দুটোও নীরব থেকে সমর্থন দিয়েছে তোকে। কেমন করে তুই পিতার মতো দ্রোণাচার্যকে হত্যা করালি? ও হো, তোর তো আবার পিতা নেই। বেজন্মা তোরা। অন্যের সঙ্গে সহবাস করে তোদের মা পেটে ধরেছেন তোদের। তোরা কী করে বুঝবি পিতার মূল্য? 

এরকম ভাবতে ভাবতে দুর্যোধন অশান্ত হয়ে উঠল। সে আজ নিজেকে কাণ্ডারিহীন নৌকার ওপর আবিষ্কার করল। কৌরবরা যেন কাণ্ডারিহীন জলযানের আরোহী। প্রবলস্রোতে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে কৌরব তরণীটি। 

মন্ত্রণাসভায়, অন্ধকারে একা বসে ছিল দুর্যোধন। মশালচি আলো জ্বালাতে এসেছিল। দুর্যোধন বারণ করেছে। অন্ধকার কক্ষে দুর্যোধনকে একা বসে থাকতে দেখে বিস্মিত হলো কর্ণ। জিজ্ঞেস করল, ‘কী মিত্র, এরকম অন্ধকার ঘরে একা বসে আছ যে?’ 

নিজেকে লুকাতে চাইল দুর্যোধন। বলল, ‘না, এমনি এমনি।’ 

বিচক্ষণ কর্ণ। সহজেই মিত্রের মনোভাব বুঝে গেল। নরম গলায় বলল, ‘তোমার কষ্ট বুঝি মিত্র। যুদ্ধে বহু ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের। ভীষ্ম আর দ্রোণের মতো দুজন মহাবীর মারা গেছেন। দিশেহারা তুমি।’ 

‘তুমি যথার্থ ধরেছ মিত্র। দিশেহারা আমি। তুমিই আমার একমাত্র ভরসা, এই দুর্যোগের দিনে।’ 

ইত্যবসরে মশালচি কক্ষের কোণায় কোণায় আলো জ্বালিয়ে গেছে। মন্ত্রণাসভায় এক-দুজন করে আসতে শুরু করেছেন। প্রত্যেকদিন যুদ্ধশেষে, রাত্রির প্রথম প্রহরে কুরুপক্ষের মন্ত্রণাসভা বসে। সভায় সেদিনের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিচারবিশ্লেষণ হয়। আগামী দিনের যুদ্ধপরিকল্পনা নির্ণীত হয়। আজকের মন্ত্রণাসভা ব্যতিক্রম। আজ দ্রোণাচার্য নিহত হয়েছেন। আর আজকেই প্রথম বহির্দেশীয় কিছু নরপতিকে মন্ত্রণাসভায় আহ্বান করেছে দুর্যোধন। নিষাদাধিপতি একলব্য তাদের অন্যতম। 

মন্ত্রণাসভার আসন পূর্ণ হয়ে গেলে দুর্যোধন বলল, ‘আমাদের পুরোধা, ভুবনখ্যাত যোদ্ধা আচার্য দ্রোণ আজ চলে গেলেন। আমরা মর্মাহত।’ 

অশ্বত্থামা উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘চলে যান নি, মিথ্যে ছলনায় জড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে পিতাকে।’ 

‘সত্যি বলেছ তুমি অশ্বত্থামা। এর প্রতিশোধ নিতে হবে। ধৃষ্টদ্যুম্নকে যমালয়ে পাঠাতে হবে।’ উত্তেজিত দুঃশাসন। বড়ভাই দুর্যোধনের পাশের আসন থেকে বলে উঠল দুঃশাসন। 

কর্ণ সরোষে বলল, ‘ও কী প্রতিশোধ নেবে! যেখানে ওর বাপ পেরে উঠল না পাণ্ডবদের সঙ্গে, সেখানে ছেলে যাবে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে!’ কথার শেষে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল। ‘প্রতিশোধ যদি নিতে হয় আমাকেই নিতে হবে। পাণ্ডবকুলের সবাইকে সরস্বতীর জলে চুবিয়ে ছাড়ব আমি।’ কথা শেষ করল কর্ণ। 

কর্ণের দম্ভোক্তি শুনে দ্রোণাচার্যের শ্যালক কৃপাচার্য এবং পুত্র অশ্বত্থামা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। অতি প্রিয়জনকে হারিয়ে দুজনেই আজ মৰ্মাহত। 

কর্ণের অযথা আস্ফালন দেখে কৃপাচার্য হাততালি দিয়ে উঠলেন, ‘দারুণ বলেছ কর্ণ। তোমার কথা শুনে দুর্যোধন ভরসা পাবে। তবে বাছা, শুধু কথার ফুলঝুরি দিয়ে কি যুদ্ধ জয় করা যায়? তুমি বড় যোদ্ধা- আজীবন শুনেই গেলাম, দেখতে পেলাম না কখনো। অনেকবার তো অর্জুনের সঙ্গে তোমার যুদ্ধ হয়েছে। সব যুদ্ধে তুমিই তো হেরেছ। অর্জুন ক্ষমতা দেখায় ধনুকের টঙ্কারে আর তুমি মুখে।’ 

কর্ণের রাগ মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। ভদ্রতাবোধও লোপ পেল তার। সগর্জনে বলল, ‘আমার কথা শুনে তোমার এত খারাপ লাগছে কেন রে বামুনের বাচ্চা! যা বলেছি তা-ই করব আমি। পাণ্ডবদের হত্যা করে এই সসাগরা পৃথিবীটা দুর্যোধনের হাতে তুলে দেব আমি। আর শোনো কৃপ, তুমি অসংলগ্ন কথা বলা বন্ধ না করলে তোমার জিব কেটে নেব আমি।’ 

মামার অপমানে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না অশ্বত্থামা। পিতৃশোকের কথা ভুলে খড়গহস্তে কর্ণের দিকে তেড়ে গেল। 

অশ্বত্থামার কাণ্ড দেখে দুর্যোধন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। কোনো অঘটন ঘটার আগে দুজনের মাঝখানে একলব্য এসে দাঁড়াল। বলল, ‘এ কী করছেন গুরুপুত্র? নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করছেন!’ 

‘কে তুমি? তুমি কে আমাদের মাঝখানে? সরে দাঁড়াও সামনে থেকে। নইলে কোনো একটা অঘটন ঘটে যাবে এখন।’ তারপর রোষকষায়িত চোখে অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে বলল, ‘আজকাল মন্ত্রণাসভায় বাইরের লোককেও ডাকা শুরু করেছ দেখছি দুর্যোধন।’ 

একলব্য দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘বাইরের লোক কাকে বলছেন? আমি যদি বাইরের লোক হই, আপনি কোথাকার? কুরুবংশের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী? আপনি, আপনার বাবা, এই কৃপাচার্য, এমনকি মহাবীর কর্ণও তো বাইরের লোক। বাইরের লোক বাইরের লোক বলে কাকে অপমান করতে চাইছেন? আমাকে না নিজেকে?’ 

অশ্বত্থামা চুপসে গেল। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর আগের মেজাজে বলল, ‘তুমি সেই একলব্য না? অরণ্যচারী ব্যাধসন্তান না?’ 

‘হ্যাঁ, আমি সেই হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য। অরণ্যচারী সাধারণ নিষাদ নই আমি, রাজপুত্র। ও হ্যাঁ, অশ্বত্থামা, আমার আর একটা পরিচয় আছে। আমি সেই একলব্য যার ডানহাতের বুড়ো আঙুল আপনার বাবা কেটে নিয়েছিলেন। গুরুদক্ষিণার কথা বলেই নিয়েছিলেন তিনি। তিনি তো আমার গুরু ছিলেন না। তারপরও আঙুলটা নির্মমভাবে…।’ 

একলব্যের মুখের কথা কেড়ে নিল কর্ণ, ‘কাকে কী বোঝাচ্ছ একলব্য! ওরা তো একদলের। অর্জুন তার বাপের প্রিয়পাত্র ছিল, জীবন উজাড় করে সবকিছু শিখিয়ে- পড়িয়ে দিয়েছেন অর্জুনকে। আজকের যুদ্ধে সেই প্রিয়শিষ্য অর্জুন শরনিক্ষেপ করে দ্রোণের সামনে ধূম্রজাল বিস্তার না করলে, ধৃষ্টদ্যুমের মতো একজন সাধারণ যোদ্ধা মহারথী দ্রোণের মাথা কেটে নিতে পারত? কখনো না। এই কথাটাই বুঝতে পারছে না বামুনের বেটারা।’ 

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একলব্য বলল, ‘আমি গুরুদেবের পাশে পাশে থেকে যুদ্ধ করছিলাম। ভীমের মিথ্যে কথা বিশ্বাস করেন নি তিনি। সত্যবাদী যুধিষ্ঠির এল, চরম মিথ্যে ভাষণ দিয়ে গুরুদেবকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলল। আমি গলা ফাটিয়ে কত করে বললাম, বিশ্বাস করবেন না গুরুদেব। যুধিষ্ঠির মিথ্যে বলছে। আমি দেখে এসেছি অশ্বত্থামা যুদ্ধ করছেন। গুরুদেব আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, বিশ্বাস করলেন যুধিষ্ঠিরের মিথ্যে কথাকে।’ 

একটু থেমে একলব্য আবার বলল, ‘তার পরও আমি থেমে যাই নি। আপ্রাণ চেষ্টা করেও গুরুদেবকে রক্ষা করতে পারি নি। অর্জুনের সমভিব্যাহারে বহু শত পাণ্ডবসৈন্য আমাকে ঘিরে ধরল। আমি শরাঘাতে তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করলাম। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। অর্জুনের তো অনেক হিংস্র অস্ত্রের অনুসন্ধান জানা। তার সঙ্গে আমি পেরে উঠব কেন? এখন ভাবি গুরুদেব যদি সেদিন হীনজাতের অজুহাতে আমাকে তাঁর পাঠশালা থেকে তাড়িয়ে না দিতেন, যদি আমাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করে অস্ত্রশিক্ষা দিতেন, তাহলে আজকের যুদ্ধে অর্জুন আমার সঙ্গে পেরে উঠত না। আর আচার্য দ্রোণকে এইরকম অপমানজনকভাবে নিহত হতে হতো না।’ 

অশ্বত্থামা আর কৃপ নিরুত্তর রইলেন। 

দুর্যোধন বলল, ‘আজ শোকের দিন, দোষারোপের দিন নয়। তোমরা সবাই শান্ত হও। গুরুদেবের হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। পাণ্ডবধারাকে এই ভূমণ্ডল থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে।’ 

দুঃশাসন বলল, ‘দাদা, কৌরবপক্ষ এখন সেনাপতিশূন্য। এই সভায় আমাদের একজন যোগ্য সেনাপতি নির্বাচন করা প্রয়োজন।’ 

‘যথার্থ বলেছ দুঃশাসন। পরবর্তী সেনাপতি হিসেবে আমি মহাবীর কর্ণের নাম ঘোষণা করছি।’ 

তারপর মন্ত্রণাসভার উদ্দেশে বলল, ‘আপনারা কী বলেন?’ 

সবাই সমস্বরে সমর্থন জানালেও কৃপ আর অশ্বত্থামা নীরব থাকলেন। কৃপ বললেন, ‘সেনাপতি নির্বাচন সঠিক হয় নি দুর্যোধন।’ 

চমকে কৃপের দিকে তাকাল দুর্যোধন। বলল, ‘কেন?’

‘অশ্বত্থামাকেই সেনাপতি করা উচিত তোমার।’ 

‘কেন? অশ্বত্থামা কেন?’ 

‘তার যোগ্যতা ও অধিকার আছে।’ 

‘যোগ্যতা তো কর্ণেরও আছে।’ 

‘অধিকার নেই।’ 

‘অধিকার নেই মানে?’ 

‘সূতপুত্র সে। একজন হীনজাতের সেনাপতির অধীনে তোমার সৈন্যরা যুদ্ধ করবে কি না ভেবে দেখেছ?’ বললেন কৃপাচার্য। 

‘আর জাতপাতের কথা তুলছেন কেন? এই কৌরবপক্ষের সকল যোদ্ধা কি ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়? শূদ্রের সংখ্যাই তো বেশি।’ দুর্যোধন বলল। 

এবার অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল কর্ণ। দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তুমি ব্রাহ্মণ যোদ্ধার কথা বললে যে। ব্রাহ্মণের কাজ তো যজনযাজন আর গুরুগিরি করা। দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্যের মতো লোভী কয়েকজন বামুন জাতবৃত্তি ছেড়ে ক্ষত্রিয়বৃত্তি গ্রহণ করেছেন। তাঁদের দিয়ে গোটা সমাজকে বিচার করছ কেন? এ দুজন এবং এই অশ্বত্থামা ছাড়া তোমার দলে তো অন্যকোনো বামুন আছে বলে আমার জানা নেই।’ 

কৃপাচার্য উচ্চস্বরে বললেন, ‘এত বামুন বামুন করছ কেন? এই ব্ৰাহ্মণই দুর্যোধনকে জয় এনে দেবে।’ 

তারপর দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘দুর্যোধন, তুমি অশ্বত্থামাকে সেনাপতি কোরো। শ্রেষ্ঠ বীরদের একজন এই অশ্বত্থামা, দ্রোণের প্রত্যক্ষ শিষ্য। তা ছাড়া তার ভেতরে এখন পিতৃশোকের জ্বালা। এই জ্বালা নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে পাণ্ডবশিবিরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে সে।’ 

একলব্য বলল, ‘আপনি যথার্থ বলেছেন কৃপাচার্য-অশ্বত্থামা এখন শোকাহত। শোকাহতরা বিষাদগ্রস্ত থাকে, বেদনায় ম্রিয়মাণ থাকে তারা। মানসিক শৌর্য তারা হারিয়ে ফেলে। পিতা বলে কথা। গুরুভ্রাতা অশ্বত্থামা পিতাকে হারিয়ে এখন শোকে মুহ্যমান। শোকাক্রান্ত ব্যক্তি যুদ্ধে মনোনিবেশ করতে পারবেন না। তাই অশ্বত্থামাকে কয়েকদিনের বিশ্রামের সুযোগ দিন মান্যবর দুর্যোধন। আমার মতে কর্ণকে সেনাপতি করে যথার্থ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন আপনি।’ 

একলব্যের যুক্তি দুর্যোধনের মনে ধরল। সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকল— আগামীকাল থেকে কৌরবপক্ষে সেনাপতিত্ব করবে মহারথী কর্ণ। 

পিতৃশোকতপ্ত অশ্বত্থামা দেখল— হীনবংশজাত কর্ণই তার সেনাপতিত্ব নেড়ে নিল। নিজেকে সে আর ঠিক রাখতে পারল না। কর্ণকে উদ্দেশ করে বলল, ‘ওরে সারথির বেটা, হীনবংশজাত কর্ণ। তলে তলে দুর্যোধনের মন ভিজিয়ে সেনাপতিত্বটা কেড়ে নিলি তুই। সেনাপতি হওয়ার সামর্থ্য কি আমার নেই? তোর মতো লোকের অভিশাপে আমার অস্ত্রগুলো কি নিবীর্য হয়ে গেছে? আমি কি তোর মতো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোনোদিন পালিয়ে এসেছি? না তোর মতো অন্যের রথটানা সারথির ঘরে জন্মেছি?’ এই রকম মনে যা যা এল, তা-ই বলে গেল অশ্বত্থামা। 

কর্ণ আর থাকতে পারল না। বলল, ‘আমি সূত হই বা সূতপুত্র হই, আমার জন্মের ওপর তো আমার কোনো হাত নেই। মানুষের জন্ম তো দৈবায়ত্ত। মানুষের আসল পরিচয় তার পৌরুষে। সেই পৌরুষ আমার অধীন। পৌরুষ জাত্যাভিমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর হ্যাঁ, তোমরা শ্রেষ্ঠজাত শ্রেষ্ঠজাত বলে বারবার অহংকার করছ, কই তোমার পিতার মতো তো আমি যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রত্যাগ করি নি, ধৃষ্টদ্যুমের মতো অতি তুচ্ছ এক যোদ্ধার সামনে নিজের গলাটা বাড়িয়ে দিই নি।’ 

তারপর দুর্যোধনকে লক্ষ্য করে কর্ণ আরও বলল, ‘অর্জুন সম্বন্ধে প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিল দ্রোণের। জয়দ্রথ বধের সময় তিনি উদাসীন ছিলেন।’ 

দুর্যোধন অনুনয়-বিনয় করে উভয় পক্ষকে থামাল। মন্ত্রণাসভা শেষে সবাই যাঁর যাঁর শিবিরে ফিরে গেলেন। 

কুরুশিবিরে বড় একটা বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠল। একদিকে কৃপাচার্য-অশ্বত্থামা, অন্যদিকে কর্ণ-একলব্যরা। এই বিরোধ যেন ব্রাহ্মণ আর শূদ্রের। মাঝখানে কৌরবরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কৌরবরা ক্ষত্রিয় হলেও বহু বহু বছর ধরে ব্রাহ্মণ- আশ্রিত। বিশেষ করে কুরুপ্রাসাদের সমরবিভাগ বহু বছর ধরে ব্রাহ্মণ দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। কুরুবাড়ির যা কিছু অস্ত্রজ্ঞান তার সিংহভাগই কৃপাচার্য-দ্রোণাচার্য প্রদত্ত। আজ সেই অবদানকে অস্বীকার করে দুর্যোধন শূদ্র কর্ণকে সেনাপতিত্ব দিল। ফলে ব্রাহ্মণরা চটে গেল। তাতে যুদ্ধের ফল যে খুব ভালো হবে না, তা সহজে অনুমেয়। 

সূতপুত্রের কলঙ্ক, গুরু পরশুরামের অভিশাপ মাথায় নিয়ে কর্ণ সেনাপতি হলো। সে দুর্ভাগা। তখন তার কাছে দেবদত্ত কবচকুণ্ডল নেই, নেই ইন্দ্রের অমোঘশক্তি। মা কুন্তীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ—পাণ্ডব ভাইদের হত্যা করবে না সে। এত কিছুর বিরুদ্ধতা নিয়েও কর্ণের একটি মাত্র লক্ষ্য-পাণ্ডবদের হারানো, দুর্যোধনের গলায় জয়ের মালা পরিয়ে দেওয়া। দুর্যোধনকে সে বারবার বলেছে, ‘ভীষ্ম আর দ্রোণের ওপর আমার কোনো দিন আস্থা ছিল না। তাঁরা দুজনেই বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। উভয়ের বিরুদ্ধে আমার বড় অভিযোগ, তাঁরা পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতী ছিলেন। দুর্যোধন, এখন ওসবের বালাই নেই। তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। অতিসত্বর পাণ্ডুপুত্রদের আমি সরস্বতীজলে চুবাবো।’ 

দুর্যোধন কর্ণের ওপর আস্থা রেখেছে। 

এরপর অনেক যুদ্ধ হলো, অনেক লোকক্ষয় হলো। দোর্দণ্ডপ্রতাপে গোটা কুরুক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়াল কর্ণ। তারপরও ভীমের হাত থেকে প্রিয় দুঃশাসনকে বাঁচাতে পারল না কর্ণ। ভীম দুঃশাসনকে হত্যা করে প্রতিজ্ঞামতে রক্ত পান করল। এমনকি নিজের ছেলে বৃষসেনকেও বাঁচাতে পারল না কর্ণ। দুর্যোধনকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে, কিন্তু অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো। 

এইসব ব্যর্থতার মধ্যে কর্ণ আরেকটা মস্তবড় ভুল করল। সে মদ্ররাজ শল্যকে নিজের রথের সারথি নির্বাচন করল। শল্য নিঃসন্দেহে উত্তম সারথি। কিন্তু বিশ্বস্ত নয়। 

পাণ্ডবপক্ষে যোগদানের উদ্দেশে স্বদেশ থেকে যাত্রা করেছিল শল্য। মধ্যপথে দুর্যোধনের আতিথেয়তায় ভুলল। সসৈন্য কুরুশিবিরে যোগ দিল সে। কিন্তু মন পড়ে থাকল—পাণ্ডবপক্ষে। আর পড়ে থাকবেই না কেন? শল্য যে পাণ্ডু-স্ত্রী মাদ্রীর ভাই, নকুল-সহদেবের মাতুল। রক্তে তার আত্মীয়ের প্রতি অনুরাগ। তাই যুধিষ্ঠির অনুযোগ পাঠালে শল্য জানাল, ‘কৌরবপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করলেও আমি পাণ্ডবদের দলে। এখানে আমি পাণ্ডবদের হয়েই কাজ করব।’ 

সারথি হওয়ার পর শল্য তা-ই করল। কর্ণের কানের কাছে অবিরত অর্জুনের প্রশংসা করে গেল। সেনাপতি হওয়া থেকে পতন পর্যন্ত ক্রমাগত পাণ্ডবদের শৌর্যবীর্যের কথা বলে বলে কর্ণের মনের স্থিরতা বিনষ্ট করে দিল শল্য। ফলে অধৈর্য হয়ে উঠল কর্ণ। গভীর একটা আশঙ্কা তার মনে বাসা বাঁধল। 

সেদিন প্রকৃতি বড় মুখ গোমড়া করে ছিল। হেমন্তের দিনটি আলোকিত হওয়ার কথা ছিল। শীতের কণা গায়ে মেখে মৃদু বাতাস বয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সূর্য খুব তেজোদীপ্ত হওয়ার কথা ছিল না। আকাশে মেঘ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু সেদিনের শেষরাতে বেশ একটু বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। রক্তমাখানো কুরুক্ষেত্রের মাটি ভিজে গিয়েছিল। অস্ত্র আর শস্ত্রের আঘাতে এবং যোদ্ধাদের দাপাদাপিতে যুদ্ধমাঠের এখানে ওখানে ছোটোবড়ো গর্ত হয়ে গিয়েছিল। রাতের বৃষ্টিতে মাঠের সেই গর্তগুলোতে জল জমে থেকেছিল। আকাশ ছিল মেঘ মেঘ। মৃদু ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। সেই সকালে সূর্যের মুখ দেখা যায় নি। আঁধার কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধশঙ্খ বেজে উঠেছিল। ভয়াল একটা যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল সেই সকালে। 

পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধে নামল ভীম, অর্জুন, যুধিষ্ঠির। ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধে অংশ নিল। মামার পাশে পাশে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র। শিখণ্ডী আর সাত্যকি কৌরবনিধনে এগিয়ে এল। মহা কোলাহলের মধ্যদিয়ে যুদ্ধ বেঁধে গেল। 

বীর বিক্রমে পাণ্ডব-পাঞ্চালসৈন্যের জটলার দিকে কর্ণের রথ এগিয়ে গেল। বেছে বেছে বড় বড় যোদ্ধাদের হত্যা করতে থাকল সে। তার পাশে পাশে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল একলব্য। নকুলকে সামনে পেয়ে সে তার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে তীর নিক্ষেপ করে গেল। নকুল দিশেহারা হয়ে পড়ল। একলব্য তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। এই সময় সেখানে উপস্থিত হলো ভীম। বাহুবলে ভীম একলব্যকে প্রতিহত করতে থাকল। 

সামনে যুধিষ্ঠিরকে পেয়ে কর্ণ মহাপ্রলয়ে মেতে ওঠে। ক্রোধে কম্পমান হয়ে কর্ণ একেবারে শতবাণ নিক্ষেপ করে যুধিষ্ঠিরের ওপর। ক্রোধান্বিত যুধিষ্ঠিরও দশটি বাণ ছুড়ল কর্ণের দিকে। উভয়ের মধ্যে ঘোরতর রণ শুরু হয়ে গেল। যুধিষ্ঠিরের ছোড়া বিধ্বংসী এক বাণাঘাতে কর্ণ মূর্ছা গেল। পাণ্ডবপক্ষে উল্লাসধ্বনি উঠল। চেতনা ফিরে পেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে কর্ণ। সপ্তবাণে যুধিষ্ঠিরের শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ছাড়ল। যুধিষ্ঠিরের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে সেনাপতি যুধিষ্ঠির পিছু হটল। কৌরবরা ধিক্কার দিতে লাগল যুধিষ্ঠিরকে। 

দূর থেকে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের পরাভব দেখতে পেলেন। দেখলেন—যুধিষ্ঠিরের পিছু পিছু পাণ্ডবসৈন্যরাও পালাচ্ছে। আর সংকট গুনলেন কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরের পলায়নপরতা যদি গোটা পাণ্ডব আর পাঞ্চালসৈন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয়, তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য। 

অর্জুনকে উদ্দেশ করে কৃষ্ণ বললেন, ‘দেখো দেখো পার্থ। তোমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠির কর্ণহাতে পর্যুদস্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছে। তার পিছু পিছু শত শত সৈন্য। এতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে পাণ্ডবদের। যে-কোনো মূল্যে কর্ণকে রুখতে হবে।’ 

‘আপনি দ্রুত রথ চালান। প্রথমে জ্যেষ্ঠের সামনে, তারপর কর্ণের মুখোমুখি রথ রাখেন।’ অর্জুন বলল। 

রথ যুধিষ্ঠিরের নিকটে গেলে উচ্চস্বরে অর্জুন বলল, ‘আপনি পালাবেন না দাদা। যতই আপনি পর্যুদস্ত হোন, যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করবেন না। আপনি সেনাপতি। আপনি চলে গেলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যাবে। আর কর্ণকে আমি দেখছি। তার পিতৃনাম ভুলিয়ে দেব আমি।’ তারপর কৃষ্ণকে কর্ণের সামনে রথ নিয়ে যেতে বলল। 

.

কৃষ্ণ কর্ণের সামনে অর্জুনের রথ নিয়ে গেলে উভয়ের মধ্যে ঘোরতর রণ শুরু হয়ে গেল। প্রচণ্ড শব্দে শঙ্খভেরী বেজে উঠল। শরে শরে চতুর্দিকে অন্ধকার হয়ে গেল। দশবাণে কর্ণ অর্জুনকে বিদ্ধ করল। অর্জুনও ঘুরে দাঁড়িয়ে কর্ণকে লক্ষ্য করে দশটি বাণ নিক্ষেপ করল। কিন্তু এতে কারও তেমন ক্ষতি হলো না। এরপর পরস্পরের প্রতি পরস্পর নারাচ, অর্ধচন্দ্র, ক্ষুরপাদি নানা বাণ নিক্ষেপ করল। পক্ষীর মতো ঝাঁকে ঝাঁকে তীর আকাশে উড়ল। দুজনেই ভ্রূকুটি কটাক্ষে ওইসব খরশান বাণ ধ্বংস করল। 

কর্ণের বাণাঘাতে পাণ্ডবসৈন্য অস্থির হয়ে উঠল। কৃষ্ণও রেহাই পেলেন না কর্ণের অস্ত্রাঘাত থেকে। ক্রুদ্ধ অর্জুন এবার খরতর বাণ হাতে তুলে নিল। শত শত শরের আঘাতে শল্য আর কর্ণ আবৃত হলো। দ্বাদশ বাণে বিদ্ধ হলে কর্ণের শরীর থেকে রুধিরের ধারা বইতে লাগল। 

এই সময় ভয়ংকর এক সর্প কর্ণের তূণে শর হয়ে প্রবেশ করতে চাইল। যুদ্ধরত কর্ণ জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি?’ 

সর্প বলল, ‘আমি অর্জুনের যম। খাণ্ডবদহনের প্রতিশোধ নিতে এসেছি আমি। আপনি আমাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করুন। সর্পমুখ বাণ হয়ে আমি অর্জুনের বুক বিদীর্ণ করব। আপনার উদ্দেশ্য সফল হবে। আমার বুকের জ্বালা মিটবে।’ 

নতুন রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থে থাকাকালে একদিন কৃষ্ণ আর অর্জুন যমুনাতীরে পানভোজনে রত ছিলেন। পাশেই গহিন খাণ্ডব অরণ্য। ব্রাহ্মণবেশী অগ্নি খাণ্ডববন দগ্ধ করার জন্য অর্জুনকে অনুরোধ করেন। অর্জুন দ্বিধান্বিত হলে অগ্নি স্বরূপ ধারণ করে বলেন, দীর্ঘ বারো বছর শ্বেতকি রাজার যজ্ঞে ঘৃত পান করে করে অগ্নিমান্দ্য হয়েছে আমার। ব্রহ্মা বলেছেন, খাণ্ডববনের পশুপাখিদের মেদ ভক্ষণ করতে পারলে অজীর্ণতা চলে যাবে। এই অরণ্যটি ইন্দ্রের খুব প্রিয়। এর আগে অরণ্যটি পোড়াবার জন্য সাত সাতবার চেষ্টা করেছি আমি। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি। সহস্র সহস্র হস্তী, নাগ আর পাখি শুঁড় আর ঠোঁটে করে যমুনা থেকে জল এনে আগুন নিবিয়ে ফেলেছে। কৃষ্ণার্জুন যদি খাণ্ডবদহনে সাহায্য করেন, তাহলে অগ্নির অগ্নিমান্দ্য দূর হয়। 

ইন্দ্রের বাধা সত্ত্বেও অর্জুন খাণ্ডববন দহনে সাহায্য করল। বৃক্ষাদি সকল প্রাণী আগুনে ভষ্মীভূত হয়ে গেল। অরণ্যের সমস্ত জীবের মধ্যে রক্ষা পেয়েছিল দানব, তক্ষক নাগের পুত্র অশ্বসেন আর চারটি মাত্র শাঙ্গব পক্ষী। 

স্বজন হারানো সেই নাগপুত্র অশ্বসেন এসে আজ কর্ণকে অনুরোধ করছে তাকে তীর করে অর্জুনের প্রতি নিক্ষেপ করতে। 

বিপর্যস্ত অবস্থাতেও কর্ণ ক্রোধে জ্বলে উঠল। এককালে সে দুর্যোধনের দলে মিশে ন্যায়বর্জিত অনেক কাজ করেছে, কিন্তু সেনাপতি হওয়ার পর ন্যায়বোধ তার মধ্যে সর্বদা জাগরুক থেকেছে। যুদ্ধে কারও প্রতি অন্যায়ভাবে বা যুদ্ধনিয়ম লঙ্ঘন করে শর নিক্ষেপ করে নি। নিজের বাহুবলের ওপর গভীর আস্থা কর্ণের। সে যে একজন মস্ত বড় যোদ্ধা, তা সে জানে। সমরে রত অবস্থায় কারও সহযোগিতা গ্রহণ করাকে অবমাননাকর বলে মনে করে কর্ণ। 

নাগপুত্র অশ্বসেনের প্রস্তাব শুনে কর্ণ সরোষে বলল, ‘কর্ণকে এত হীন যোদ্ধা মনে করলে কী করে? তুমি কি কখনো শুনেছ কর্ণ অন্যের সাহায্যপুষ্ট হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে? একজন কেন, এক শ’ জন অর্জুনকে মারতে পারলেও তো তোমার সাহায্য কখনো নেব না আমি। তুমি ফিরে যাও অশ্বসেন।’ 

অশ্বসেন নাছোড়, ‘ফিরে যাওয়ার জন্য আসি নি আমি। প্রতিশোধ নিতে এসেছি। আমার জ্ঞাতিগোষ্ঠী সবাইকে নিধন করেছে এই অর্জুন। তার মৃত্যুর কারণ হতে না পারলে আমার জ্ঞাতিঋণ শোধ হবে না। আপনি আমাকে অস্ত্রমুখে স্থাপন করুন অঙ্গরাজ।’ 

‘তুমি কর্ণকে চেনো না নাগপুত্র। তুমি জানো না যে, পরশুরামের শিষ্য কারও করুণাপ্রার্থী হয় না।’ 

‘করুণার কথা নয়, প্রতিশোধের কথা বলছি আমি।’ 

‘অর্জুনকে ধরাশায়ী করাই তো তোমার আকাঙ্ক্ষা? তুমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখো— কীভাবে ধড় থেকে মাথাটা নামিয়ে নিচ্ছি অর্জুনের।’ 

এইসময় অর্জুন নিক্ষেপিত একটা শর এসে কর্ণের বাম বাহুকে বিদ্ধ করল। 

একটানে শরটা তুলে দূরে ছুড়ে মারল কর্ণ। রুদ্রবাণ হাতে তুলে নিল সে। বাণে বাণ নিবারণ করল অর্জুন। এরপর বাণে বাণে আকাশ ছেয়ে গেল। ধনুকের টঙ্কারে সবার কর্ণ বধির হওয়ার উপক্রম হলো। মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো দুই মহাবীর। 

দিব্য অস্ত্র হাতে নিল কর্ণ। এই অস্ত্র অমোঘ। লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করবেই। কৃষ্ণ প্রমাদ গুনলেন। রথের গতি দ্রুত করলেন। দিব্য অস্ত্র নিক্ষেপের মুহূর্তকাল আগে অর্জুনের রথচক্র জলভর্তি গর্তে পড়ে গেল। মাটির গর্তে রথটি বেশটুকু দেবে গেল। অর্জুনের ঠিক মাথার ওপর দিয়ে কর্ণের ছোড়া দিব্যাস্ত্রটি উড়ে গেল। কিন্তু লক্ষ্যভেদ না করে গেল না অস্ত্রটি। রথটি দেবে যাওয়ায় অর্জুনের শরীরটাও নিচের দিকে নেমে গেছে সামান্য। দিব্যাস্ত্রটি অর্জুনের গলায় আঘাত না করে মুকুটে আঘাত করল। অস্ত্রাঘাতে খণ্ডিত অর্জুনের কিরীটটি রথের মধ্যেই পড়ল। প্রাণে বেঁচে গেল অর্জুন। 

দ্রুত রথ থেকে নেমে গর্ত থেকে রথচক্রকে টেনে তুলতে লাগলেন কৃষ্ণ আর অর্জুন। তাঁদের দুরবস্থা দেখে হা হা করে হেসে উঠল কর্ণ। তখন তার ধনুকে অগ্নিবাণ জোড়া। চিৎকার করে বলল, ‘ওরে বহুগামী নরাধম অর্জুন, চাইলে এখনই তোকে যমালয়ে পাঠাতে পারি আমি। কিন্তু অসহায় বিপদগ্রস্তকে আঘাত করা কাপুরুষতা। তোর রথ মাটিতে দেবে গেছে বলে তুই বেঁচে গেলি এইবার। দেখ চেষ্টা করে রথটাকে টেনে তুলতে পারিস কি না। বিপদমুক্ত হলেই যুদ্ধে নামব আবার। এই আমার ধনুকে অগ্নিবাণ জোড়া রইল।’ বলে অপেক্ষা করতে থাকল কর্ণ। 

এইসময় কোথা থেকে রথ ছুটিয়ে এল একলব্য। চিৎকার করে বলল, ‘অঙ্গরাজ, ভুল করবেন না। আঘাত করুন অমানুষ অর্জুনকে। আর ওই যে কৃষ্ণ, তাঁর মতো কুচক্রী নেই এই ভূমণ্ডলে। তাঁকেও ধরাশায়ী করুন। ওদের ধ্বংস করার এই-ই সুবর্ণ সুযোগ।’ 

কর্ণ বলল, ‘আমি কাপুরুষ নই একলব্য। অস্ত্রহীন অসহায়কে আমি আঘাত করি না।’

‘ভুল করছেন মহাবীর কর্ণ। এইসময় যদি অস্ত্রাঘাতে ওদের ধরাশায়ী না করেন, তবে অনেক বড় মূল্য দিতে হবে আপনাকে। 

‘তুমি কথা থামাও একলব্য। অন্যায়ের পথে প্ররোচিত কোরো না আমাকে।’

‘এ অন্যায় নয় মহারাজ। এ যুদ্ধের নিয়ম। শত্রুকে কোনো অবস্থাতেই ছেড়ে দিতে নেই। 

‘এই নিয়ম আমি মানি না। যুদ্ধ হবে সমানে সমানে। অসহায় ব্যক্তি কখনো কর্ণের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। আমি এই মুহূর্তে কৃষ্ণার্জুনকে আঘাত করব না।’ 

অসহায় ভঙ্গিতে একলব্য আবার বলে উঠল, ‘তার জন্য অনেক মূল্য গুনতে হবে আপনাকে।’ 

ঠিক এই সময়ে অর্জুনের অগ্নিবাণ গোটা আকাশকে দগ্ধ করতে করতে কর্ণের দিকে ধেয়ে এল। কর্ণের অস্ত্রবিরতি সময়ে কৃষ্ণার্জুন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গর্ত থেকে নিজেদের রথকে টেনে তুলেছেন। 

অগ্নিবাণ দেখে কর্ণ বরুণ বাণ ছুড়ল। ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি এসে অগ্নিবাণকে অকেজো করে দিল। বায়ুবাণে মেঘ ও বৃষ্টিকে ঝেঁটিয়ে তাড়াল অর্জুন। 

এইভাবে যুদ্ধ চলল কর্ণ-অর্জুনে, যুদ্ধ চলল পাণ্ডব-কৌরবের রথী মহারথীতে। মারা যেতে লাগল শত শত সৈন্য। গোটা কুরুক্ষেত্র রক্তে স্নাত হতে থাকল। একলব্য কর্ণের পাশে পাশে থেকে যুদ্ধ করে যেতে লাগল। কর্ণ আজ পণ করেছে—যেভাবেই হোক, অর্জুনকে শেষ করবে। অর্জুনেরও একই প্রতিজ্ঞা—এই পৃথিবী কর্ণশূন্য করে ছাড়বে আজ। শল্য আর কৃষ্ণ সমরক্ষেত্রের এদিক থেকে ওদিক রথ ছুটিয়ে বেড়াতে লাগলেন। শত সহস্র বাণে প্রতিপক্ষের সৈন্যসামন্তকে হত্যা করে যেতে লাগল দুই মহাবীর। 

শল্য হঠাৎ এমন পথ দিয়ে রথ চালাল, যে পথ এবড়োখেবড়ো। ভূমি সমতল নয়। এখানে ওখানে গর্ত। সেই গর্তে জল জমে আছে। শক্ত মাটি জলস্পর্শে নরম হয়ে গেছে। হঠাৎ সেই নরম মাটির গর্তে কর্ণের রথটি আটকে গেল। বাম দিকের পেছনের চাকাটি জলভর্তি কাদামাটির গর্তে দেবে গেল। যেমন করে দেবে গিয়েছিল অর্জুনের রথ। শল্য দ্রুত রথ থেকে নেমে চাকার দিকে এগিয়ে গেল। অনেক ঠেলাঠেলির পরও রথচক্রটি গর্ত থেকে উঠল না। 

কর্ণ রথ থেকে নেমে চক্রের দিকে যেতে উদ্যোগ নিল। ওই সময় সেখানে উপস্থিত হলো অর্জুনের রথ। কৃষ্ণ উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, ‘এই সুবর্ণ সুযোগ। হত্যা কোরো অর্জুন, এই সুযোগে কর্ণকে হত্যা কোরো।’ 

‘তা কী করে হয়? অসহায় অবস্থায় কর্ণকে বধ করব কেন?’ হতভম্ব গলায় অর্জুন বলল। 

‘এটাই নিয়ম।’ ধমকের সুরে কৃষ্ণ বললেন। 

‘কর্ণ তো এই নিয়ম মানে নি। সুযোগ পেয়েও সে আমাকে হত্যা করে নি।’ 

‘ও করে নি বলে তুমি করবে না কেন? ওর নাম দানবীর কর্ণ, তোমার নামের আগে তো কোনো অভিধা নেই। কালক্ষেপণ কোরো না অর্জুন। অস্ত্র ধরো।’ 

কৃষ্ণের ধমকে অর্জুন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না সে। ধর্মের পথে স্থির থাকবে, না ধর্মের ধ্বজা বহনকারী কৃষ্ণের প্ররোচনায় অন্যায়ভাবে কর্ণকে হত্যা করবে? 

এই সময় কৃষ্ণ আবার গর্জে উঠলেন, ‘তুমি কি কৌরবদের ধ্বংস চাও না অর্জুন? নিজেদের জয় চাও না? তোমাদের জয়ের পথের প্রধান অন্তরায় এই কৰ্ণ। তাকে সরাতে পারলে তোমাদের জয়ের পথ কণ্টকমুক্ত হবে। হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসবে যুধিষ্ঠির। দেশে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবে। দিকে দিকে পাণ্ডবদের জয়গান হতে থাকবে।’ 

সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে গেল অর্জুন। অন্যায় দিয়ে কী করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবে, তা জিজ্ঞেস করার চেতনা হারিয়ে ফেলল সে। যে কর্ণ সুযোগ পেয়েও তাঁদের হত্যা করে নি, সেই কর্ণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার মধ্যে কোনো বীরত্ব আছে কি না, তাও জিজ্ঞেস করার স্পৃহা হারিয়ে ফেলল অর্জুন। তার কানে শুধু ধাক্কা মারতে লাগল কৃষ্ণের বজ্রকঠিন শব্দনিচয়—হত্যা কোরো অর্জুন, কর্ণকে হত্যা কোরো। 

অর্জুন হাতে অস্ত্র তুলে নিল। অর্জুনের প্রতি দৃষ্টি গেল কর্ণের। কর্ণ বলল, ‘এখন আমি নিরস্ত্র। আমার রথ আটকে গেছে, যেমন করে আটকে গিয়েছিল তোমারটা। রথচক্রকে টেনে তুলি আগে। তারপর দুজনে যুদ্ধ হবে।’ 

কানের কাছে চিৎকার করে উঠলেন কৃষ্ণ, ‘দুরাচারী কর্ণের কথা শুনো না তুমি অর্জুন। আঘাত কোরো ওকে।’ 

কৃষ্ণের কথা কর্ণের কানে গেল। কর্ণ বলল, ‘তুমি ওর কথায় কান দিয়ো না অর্জুন। ধর্মকে ভয় কোরো। যুদ্ধেরও একটা নিয়ম আছে। এই নিয়মকে ধর্ম বলে। অসহায় নিরন্ত্রকে আঘাত করা যুদ্ধধর্ম নয়। কূটবুদ্ধি কৃষ্ণের প্ররোচনায় তুমি ধর্মচ্যুত হয়ো না।’ 

রথচক্রের দিকে দৃঢ় পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে গেল কর্ণ। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে অর্জুনের দিকে তাকাল। বলল, ‘দৈববশে এই মুহূর্তে আমার রথের চাকা মাটিতে আটকে গেছে। অন্তত এই সময়টায় তুমি ধনুকে বাণ যোজনা কোরো না।’ বড় করুণ শোনাল কর্ণের কণ্ঠ। 

কৃষ্ণ কিন্তু ছাড়বার পাত্র নন। অর্জুনের হয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘দুষ্টমতি লোকেরা যখন বিপদগ্রস্ত হয়, তখন দৈবের দোহাই দেয়। অতীতের কুকর্মের কথা স্মরণে আনতে চায় না তারা। তুমি দুরাচারী।’ 

‘তুমিও কি কম দুরাচারী কৃষ্ণ? তুমি কৃষ্ণই তো প্রতিজ্ঞা করেছিলে, এই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে না। রেখেছ কি সেই প্রতিজ্ঞা? কতবার চক্রহাতে যুদ্ধে নেমেছ, স্মরণ কোরো তো কৃষ্ণ। তোমার কাছে প্রতিজ্ঞার কোনো বালাই আছে? প্রচার কোরো—তুমি ন্যায়ের, ধর্মের ধ্বজাধারী, কার্যত তুমি ধর্মলঙ্ঘনকারী।’ সরোষে কর্ণ বলল। 

কৃষ্ণ এবার হো হো করে হেসে উঠলেন। শ্লেষ মিশিয়ে ব্যঙ্গস্বরে কৃষ্ণ বলতে থাকলেন, ‘তুমি কর্ণ ধর্মের দোহাই দিচ্ছ! হাসালে তুমি আমায়। যেদিন দ্রৌপদীকে চুলের মুঠি ধরে কুরুসভায় টেনেহিঁচড়ে আনিয়েছিলে, সেদিন তোমার ধর্মবোধ কোথায় ছিল? যেদিন শুকুনির মাধ্যমে পাশা খেলিয়ে দুর্যোধনকে দিয়ে পাণ্ডবদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? তেরো বছর বনবাসে আর অজ্ঞাতবাসে কাটিয়ে যুধিষ্ঠিররা যখন মাত্র পাঁচখানি গ্রাম চেয়েছিল তোমার মিত্র দুর্যোধনের কাছে, সেদিন তোমার ধর্মবিবেক কোথায় ছিল? যেদিন বারণাবতে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করলে, যেদিন রজস্বলা পাণ্ডববধূকে দুঃশাসনের হাতে ছেড়ে দিয়ে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেছিলে, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় মুখ লুকিয়ে থেকেছিল কর্ণ? বিপদে পড়ে এখন ধর্ম ধর্ম করছো দুরাত্মা। আজ তোমার রেহাই নেই। তোমাকে যমালয়ে যেতেই হবে। 

তারপর অর্জুনের দিকে মুখ ফেরালেন কৃষ্ণ। বললেন, ‘আর বিলম্ব কোরো না অর্জুন। আঘাত কোরো। আঘাতে আঘাতে বিনাশ কোরো দুরাচারীকে। 

কর্ণ কৃষ্ণের কথায় কর্ণপাত না করে দেবে-যাওয়া রথচক্রের দিকে এগিয়ে গেল। ভরসা ছিল যে অর্জুনকে একই অবস্থায় পেয়েও নিরস্ত্র আর অসহায় ভেবে আঘাত করে নি, সেই অর্জুন কখনো অস্ত্রবিযুক্ত কর্ণকে আঘাত করবে না। অন্তত রথোত্তোলনের সময় দেবে। 

কিন্তু অর্জুন কর্ণকে সেই সময় দিল না। অসি হস্তে ধেয়ে এল কর্ণের দিকে। কর্ণ তখন ঘাড় নিচু করে রথ ঠেলছিল। কালবিলম্ব না করে ঘাড় বরাবর কোপ মারল অর্জুন। কর্ণের ছিন্ন মুণ্ডটি মাটিতে ঝপ করে পড়ে গেল। 

যুদ্ধ শেষের অপরাহ্ণে কর্ণের মস্তকবিচ্ছিন্ন ধরটি ধূলিতে পড়ে থাকল। ছিন্ন মুণ্ডটি মাটিতে গড়াগড়ি যেতে লাগল। কর্ণের শরীরে বিকেল-সূর্য সহস্রধারায় রশ্মি ছড়িয়ে যেতে লাগল। 

.

কর্ণের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে কৌরবদের অহংকার আর জয়াশা একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। কুরুপ্রাসাদে হাহাকার উঠল। সকল সহোদরকে হারিয়ে দুর্যোধন পাগলপ্রায় হয়ে গেল। 

এরপর মদ্ররাজ শল্য কৌরব-সেনাপতি হলো, কিন্তু অতি সহজেই তার পতন হলো। অশ্বত্থামা, কৃপাচার্যদের দিয়ে কোনোরকমে এক-দুই দিন যুদ্ধ চলল। কিন্তু সেই যুদ্ধ হলো একতরফা। পাণ্ডবসৈন্যদের সঙ্গে এঁটে উঠল না কৌরবপক্ষ। 

আঠারো দিনের সায়াহ্নে পাণ্ডবদের জয় ঘোষিত হলো। মৃত যারা, তাদের দেহ শিয়ালে-শকুনে খেতে লাগল। আহত যারা, রণক্ষেত্রে পড়ে পড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করত লাগল। অনাহত যারা রাত্রির অন্ধকারে চুপিসারে স্বদেশের উদ্দেশে রওনা দিল। 

সামান্য কিছু সৈন্য সঙ্গে নিয়ে একলব্য স্বদেশের পথ ধরল। 

দুর্যোধন কৌরবশিবির থেকে পালাল। দ্বৈপায়ন হ্রদে আশ্রয় নিল। পরে ধরা পড়ে ভীমের হাতে নিধন হলো। 

গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলো। 

যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসিয়ে আপন রাজধানী দ্বারকায় ফিরে গেলেন কৃষ্ণ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *