একলব্য – ৪

ক্ষমার দীপ্তি দেয় স্বর্গের আলো 
প্রেমের আনন্দেরে— 
ভালো আর মন্দেরে। 

.

পূর্বাহ্ণ। 

গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একলব্য। 

সকালে বাতাসে শৈত্যভাব ছিল। এখন বাতাস তেতে উঠেছে। তবে তেমন করে গরম লাগছে না একলব্যের। কিছুক্ষণ আগে সে খাড়া পাহাড় অতিক্রম করে এসেছে। এখন হাঁটছে ঢালু পথ দিয়ে। পাহাড়ের শীর্ষাঞ্চল থেকে নিচের দিকে নামছে। পূর্বদিকেই হাঁটছে সে। ডঙ্ক আর লখা বলেছে, সর্বদা পূর্বমুখ করে চলতে হবে। হস্তিনাপুর সোজা পূর্বদিকে। পথের বাঁকের জন্য কখনো কখনো উত্তরে দক্ষিণে হাঁটতে হচ্ছে তাকে। হাঁটতে হাঁটতে পূর্বদিকে হাঁটার পথ খুঁজে নিচ্ছে সে। সূর্যই তার নিশানা। সকালে সূর্য পূর্ব গগনে থাকে, বিকেলে পশ্চিমে। দ্বিপ্রহরে সমস্যা হয় তার। 

কখনো কখনো ব্যাধপল্লির দেখা পায়। ওই ব্যাধপল্লিতে দ্বিপ্রহরের আহার সারে। নিজের পরিচয় দেয় না কখনো একলব্য। রাজপুত্র জানলে ব্যাধদের সমীহ-শ্রদ্ধা বেড়ে যাবে। মানুষরা তার সঙ্গে মিশবে না। দূরত্ব বজায় রেখে তাকে আপ্যায়ন করবে। একলব্য তা চায় না। সে সাধারণ ব্যাধদের সঙ্গে সাধারণ হয়েই মিশতে চায়। তাদের কাছে পথের সন্ধান জেনে নেয়। কেউ কেউ কয়েক ক্রোশ তার সঙ্গে এগিয়ে যায়। বিনয়ে বিগলিত হয়ে একলব্য তাদের বিদায় করে। 

রাতে কোনো ঋষি-তপস্বীর আশ্রমে আশ্রয় নেয়। অধিকাংশ রাতই বিশাল বৃক্ষের ডালে চড়ে কাটায়। ফলমূলই তার আহার্য। কোন ফল খাদ্য আর কোন ফল অখাদ্য— সেটা একলব্যের ভালো করে জানা। সে যে অরণ্যসন্তান। তরুলতা-বৃক্ষাদি তার আবাল্য চেনা। 

শাণ্ডিল্য মুনির আশ্রম ছেড়ে এসেছে আজ সপ্তম দিন। পথে এক ব্যাধের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। ও বলেছে, আর বেশি দূরে নয় হস্তিনাপুর। আর একটা দিন হাঁটলেই রাজপথের সন্ধান পাবে। ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল হঠাৎ করে। কেন এ কাঁপন? বহু কাঙ্ক্ষিতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বলে, না মা-বাবা-পিতামহ—এঁদের কাছ থেকে অনেকানেক যোজনক্রোশ দূরে চলে এসেছে বলে? এ কাঁপনের মাহাত্ম্য ভালো করে বুঝে উঠতে পারছে না একলব্য। 

মায়ের কথা মনে পড়ে গেল একলব্যের। মায়ের জলেভাসা করুণ মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। কী বেদনা-চুরচুর চোখেই না তাকিয়ে থেকেছিলেন মা! পিতা আর পিতামহের চরণে প্রণাম সেরে মাকে প্রণাম করতে গিয়েছিল একলব্য। পুত্রকে কঠিনবাহুতে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বিশাখা। তাঁর দু’ চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পর মায়ের বুক থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও পারছিল না। বিশাখা যেন কিছুতেই বুকের আশ্রয় থেকে পুত্রকে ছাড়তে চাইছিলেন না। অনেকক্ষণ পরে অনেক চেষ্টায় মাতৃবক্ষ-বিচ্ছিন্ন হতে পেরেছিল একলব্য। ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল তখন তার। মায়ের দিকে পেছন ফিরেছিল সে। বেশ কিছুদূর এসে মায়ের দিকে ফিরেছিল একলব্য। দেখেছিল—মা চোখ মুছছেন। সেই সময়ের অশ্রু-ভাসানো মায়ের মুখটা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। এখন হাঁটতে হাঁটতে মায়ের সেই মুখটাই ভেসে উঠল একলব্যের চোখের সামনে। তার বুকটা ভারী হয়ে গেল। বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠল।

ব্যাধ পরিবার সন্তানবহুল। কমপক্ষে সাত-আটজন করে বাচ্চাকাচ্চা প্রত্যেক পরিবারে। রাজন্য আর সাধারণ ব্যাধের মধ্যে তফাৎ নেই এ ব্যাপারে। যেন সন্তান উৎপাদনের প্রতিযোগিতা চলে ব্যাধসমাজে। খাওয়াতে পারবে কি না, পরাতে পারবে কি না—এ চিন্তা করে না নিষাদদম্পতি। সন্তানধারণের ক্ষমতা না হারানো পর্যন্ত সন্তান প্রসব করে যায় ব্যাধনারী।

ব্যতিক্রম শুধু রাজপরিবারে। অনোমদর্শীর বংশলতিকায় একজন করে পুত্র। অনোমদর্শীর বাবাও ছিলেন পিতার একমাত্র সন্তান। অনোমদর্শীর ঘরে অবশ্য দুটো সন্তান—এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটি বিবাহযোগ্য হয়ে উঠলে পার্শ্ববর্তী কুন্তলা নিষাদরাজ্যের রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। আর পুত্র হিরণ্যধনু বর্তমানে নিষাদরাজ্যের মহারাজা। 

ক্ষত্রিয় রাজাদের মতো ব্যাধরাজের ঘরে বহু নারী নেই। কোনো রক্ষিতা নেই। তেমন কোনো দাসী নেই, যাদের সঙ্গে রাজারা অবাধে সঙ্গম করেন। ক্ষত্রিয় রাজাদের মধ্যে একনিষ্ঠতা বলে কোনো ব্যাপার নেই। তাঁরা বহুগামী। যথেচ্ছাচারী। কোনো একজন নারীকে এককভাবে হৃদয়ে স্থান দেন না ক্ষত্রিয়রাজরা। 

ব্যাধসমাজ এর ব্যতিক্রম। এই সমাজে বহুবিবাহ প্রথা নেই, স্ত্রীত্যাগের কোনো নিয়ম নেই, পণপ্রথা নেই। মহারাজ থেকে সামান্য প্রজা পর্যন্ত সবারই ঘরে একজনই পত্নী। ফলে এই সমাজ সপত্নী-কোন্দলমুক্ত। তবে প্রত্যেকটি পরিবারে বহুসন্তানের সমাবেশ। কিন্তু সন্তানবাহুল্য থেকে নিষাদ রাজপরিবারটি মুক্ত। কন্যা যতটাই হোক, পুত্র কিন্তু একজন। অনোমদর্শীর বহু ঊর্ধ্বতন পুরুষ থেকে একেবারে হিরণ্যধনু পর্যন্ত এই নিয়ম প্রবহমান। এরও হয়তো একটা কারণ আছে। ক্ষত্রিয়দের ভ্রাতৃবিরোধের কথা ব্যাধরাজাদের না জানার কথা নয়। যুগে যুগে নারী ও ভূমির জন্য ক্ষত্রিয় রাজপুত্রদের মধ্যে হানাহানি লেগেই আছে। সেই সত্য যুগ থেকে এই দ্বাপর যুগ পর্যন্ত। ‘রামায়ণ’ কাহিনিও এই ব্যাধ রাজপরিবারটিকে সতর্ক করেছে। 

বাল্মীকির ‘রামায়ণে’ ভ্রাতৃপ্রেমের গাঢ়তার কথা যেমন আছে আবার ভ্রাতৃবিরোধের কথাও তো আছে। রাম-লক্ষ্মণ-ভরতের কাহিনির মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের কথা আছে, সুগ্রীব- বালীর কাহিনি তো রক্তপাতের। রাম-লক্ষ্মণের ওই যে অযোধ্যা ত্যাগ, রাম কর্তৃক বালী নিধন—এসবের মাঝখানে তো দাঁড়িয়ে আছে ওই ভূমি আর নারী। আর রাম-রাবণের যুদ্ধ! সীতার জন্যই তো হলো। এক লক্ষ পুত্র আর সোয়া লক্ষ নাতি যে রাবণের, সেই রাবণের বংশে শেষ পর্যন্ত বাতি জ্বালাবার কেউ থাকল না। ওই সীতার জন্যই তো। রাবণরা তিন ভাই—রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ। এই বিভীষণই তো রাবণবংশের ধ্বংসের কারণ হলো। একাধিক ভাইয়ের কারণেই তো হলো এরকম। এই সকল ঘটনা থেকেই হয়তো নিষাদ রাজপরিবারটি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। ব্যাধরাজারা এক পুত্রেই সন্তুষ্ট থেকেছেন বংশানুক্রমে। 

একজন পুত্রসন্তান হলে মাতা-পিতার হৃদয়টি ওই সন্তানে নিবদ্ধ থাকে। মা-বাবার সকল ভাবনা-চিন্তা-আকাঙ্ক্ষা-ভালোবাসা ওই একজনাতেই জড়িয়ে থাকে। এই প্রাণধনটি যতক্ষণ চোখের সামনে থাকে, ততক্ষণ মনটা প্রশান্তিতে ভরে থাকে। চোখের আড়াল হলেই যত উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ। হৃদয়টা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে চায়। হাহাকারে ভেতরটা শ্মশানে পরিণত হতে চায়। 

মহারানি বিশাখার বেলায়ও তা-ই হয়েছে। একমাত্র পুত্র একলব্য বহুদূরের অজানা রাজ্যে যাত্রা করেছে। দুর্গম পথ, শ্বাপদসংকুল অরণ্য, উত্তুঙ্গ পর্বতমালা, হিংস্র নিষাদ- এসব অতিক্রম করেই তো একলব্যকে হস্তিনাপুরে পৌঁছাতে হবে। সদ্য তরুণ, কোমল দেহ, অভিজ্ঞতাশূন্য একলব্য। ঠিকঠাকমতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে তো? বিশাখার অন্তরটা তাই কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। অজানা শঙ্কায় মাতৃহৃদয় উদ্বেগাকুল হয়ে পড়েছিল। তাই তো মহারানির দু’চোখজুড়ে অশ্রু। এই অশ্রুসিক্ত মুখমণ্ডলই বারবার একলব্যের চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। 

হঠাৎ জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল একলব্য। চোখের সামনে থেকে মায়ের কোমল মুখটি সরিয়ে দিতে চাইল সে। এই মুহূর্তে মায়ের মুখচ্ছবিটি চোখের সামনে ভাসতে দিলে চলবে না। তাতে তার সংকল্প নড়বড়ে হয়ে পড়বে। চলার গতি কমে আসবে। নিষ্ঠা হারাবে সে। তাই ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে পেছনের স্মৃতিগুলো মন থেকে বের করে দিতে চাইল একলব্য। 

হঠাৎ প্রচণ্ড হাহাকার ধ্বনিতে সংবিৎ ফিরে পেল একলব্য। সামনে তাকাল সে। দেখল একটা এলাকায় আগুনের লেলিহান শিখা। ধোঁয়ায় আকাশ ঢাকা পড়েছে। দ্রুত সেদিকে পা চালাল একলব্য। যত নিকটে যাচ্ছে-আর্তনাদ, হিংস্র কণ্ঠের হুংকার স্পষ্ট হয়ে উঠছে একলব্যের কানে। বাতাসে ভেসে আসা লতাগুল্ম, বৃক্ষ-পত্রের পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে তার। বহ্নিদগ্ধ স্থানের দিকে আরও দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল সে। 

নিকটে গিয়ে দেখল—একটা তপোবনের পর্ণকুটিরগুলো দাউদাউ করে জ্বলছে। সেই আগুন তপোবনের চারদিকের বৃক্ষ-লতায় ছড়িয়ে পড়েছে। গোটা উঠানজুড়ে জলপাত্র, ফলাধার, শয্যাসামগ্রী, পাদুকা, কুশাসন এসব। কয়েকজন ঋষির মাথা, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। কিছু ঋষি বৃক্ষ-শাখা হস্তে আত্মরক্ষা করে যাচ্ছেন। জটাজুটধারী বল্কল পরিহিত একজন তপস্বী একটু দূরের একটা বৃহৎ আম্রবৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন। চক্ষু তাঁর বিস্ফারিত। কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে মণি দুটো তাঁর মনে বেদনা না উল্লাস, হাহাকার না বিস্ময় সঠিক বোঝার উপায় নেই। সারা মুখ দীর্ঘ দাড়িতে আবৃত। তবে তিনি যে বেশ উত্তেজিত, ভয়ংকর ক্রোধ যে তার সমস্ত দেহজুড়ে, সেটা তপস্বীর নেত্রদ্বয় দেখে অনুধাবন করা যাচ্ছে। 

আর এই আশ্রমের চারদিক জুড়ে এক দঙ্গল নিষাদের উল্লম্ফন। তাদের দেহ কুচকুচে কালো। কারও দেহ দীর্ঘ, কারও মাঝামাঝি। পরিধানে স্বল্প কাপড়। ছোট করে ছাঁটা চুল সবার। শুধু একজনের বাবরি চুল। তার দেহ সুঠাম। শালপ্রাংশু। ক্রোধান্বিত চোখমুখ। ডানহাতের তর্জনী উঁচিয়ে সঙ্গীদের নির্দেশ দিচ্ছে। তার কণ্ঠ উত্তেজিত। 

একলব্য এই দহন, এই আক্রমণ, এই উত্তেজনার পেছনে যে কারণ, তার কিছুই বুঝল না। তবে ঘটনা-সংঘটনের স্থানে দ্রুতপায়ে যেতে যেতে এইটুকু অনুধাবন করতে পারল যে, একদল হিংস্র ক্রোধমত্ত নিষাদ একটা তপোবন আক্রমণ করেছে। তপস্বীরা নিরস্ত্র। ক্রোধজিৎ তাঁরা। এবং সংখ্যায় অল্প। তাই নিষাদ-আক্রমণে তপোবন লণ্ডভণ্ড, অগ্নিদগ্ধ। রক্তাক্ত, লাঞ্ছিত ঋষিরা শুধু প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

নিষাদ-নেতাটির একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে বজ্রকঠিন কণ্ঠে একলব্য জিজ্ঞেস করল, ‘কারা তোমরা? নিরস্ত্র ঋষিদের আক্রমণ করেছ কেন?’ 

দলনেতা বামহাত বাড়িয়ে তার সামনে থেকে একলব্যকে সরিয়ে দিতে চাইল। তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। কিন্তু বামহাতের ধাক্কায় একলব্যকে সরিয়ে দিতে পারল না মেঘা। অবহেলায় হালকাভাবে ধাক্কাটা দিয়েছিল সে। ভাবে নি, তার বজ্রহাতের ঠেলায় সামনে দাঁড়ানো তরুণটিকে সরাতে পারবে না। হাতটা যেন পাষাণে ধাক্কা খেল। এবার সামনে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে ভালো করে চোখ ফেরাল মেঘা। 

মেঘার চোখে চোখ রেখে এবার বরফশীতল গলায় একলব্য জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি? কেন সদলে মুনিঋষির আশ্রমে তাণ্ডব চালাচ্ছ? 

‘তুমি কে যে, তোমাকে আমার পরিচয় দিতে হবে? আর কারণ বলতে হবে এই যুদ্ধের?’ 

‘একে যুদ্ধ বলে? যুদ্ধ হয় সশস্ত্র দুইজনাতে অথবা অস্ত্রসজ্জিত দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলে। তাকিয়ে দেখো ওঁদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। ওঁরা নিরীহ, ওঁরা শান্ত, শান্তিপ্রিয়। এরকম কিছু মানুষকে আক্রমণ করেছ কেন?’ 

‘তার ব্যাখ্যা কি তোমাকে দিতে হবে? তুমি এমন কী রাজাগজা যে, আমার কাছে কারণ জানতে চাইছ?’ 

‘আমি যে-ই হই, উত্তর না দিয়ে ওঁদের দিকে আর অস্ত্র তুলতে পারবে না।’ 

‘দেখে মনে হচ্ছে—আমাদেরই গোত্রের তুমি। তোমার কথা, দেহগঠন এর প্রমাণ বহন করছে। তাই বলছি—তোমাকে আঘাত করার আগে আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। নইলে তোমার দেহে মাথা থাকবে না।’ 

এবার হুংকার দিয়ে উঠল একলব্য, ‘কত বড় ধনুর্ধর তুমি, প্রমাণ কোরো আমার সামনে। এখনই যদি এই ঋষিদের ওপর আক্রমণ না থামাও, সবাইকে যমালয়ে পাঠাব আমি।’ 

একলব্যের বজ্রনিনাদি কণ্ঠ শুনে আক্রমণরত ব্যাধরা বিরত হলো। দ্রুতবেগে মেঘা আর একলব্যের নিকটে চলে এল। ব্যাধরা একলব্যকে বৃত্তাকারে ঘিরে ধরল। 

একলব্যের গুরুগম্ভীর কর্তৃত্বযুক্ত কণ্ঠ শুনে মেঘা ঘাবড়ে গেল। নিজের অজান্তে দু’পা পিছিয়ে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে সংবিৎ ফিরে পেল। ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ‘যুদ্ধ করতে চাও আমার সঙ্গে? খেঁকশেয়াল বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে আস্ফালন করছ? কাঁধে তীরধনুক আর কোমরে গোঁজা একটা টাঙ্গি। কী নিয়ে যুদ্ধ করবে? অসিযুদ্ধ জানো?’

‘তীরধনুক, টাঙ্গি, অসি দিয়ে বা খালি হাতে যেভাবেই যুদ্ধ করতে চাও তুমি, আমি সম্মত।’ একলব্যের মুখমণ্ডলে অবহেলা ঝিলিক দিয়ে উঠল। 

সহজন থেকে একটা অসি নিয়ে একলব্যের দিকে ছুড়ে দিল মেঘা। 

কয়েক মুহূর্তমাত্র টিকে থাকতে পারল মেঘা, একলব্যের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে। মেঘার কণ্ঠনালিতে অসির অগ্রভাগ চেপে ধরল একলব্য। তারপর হেলায় তরবারিটি দূরের ভূমিতে নিক্ষেপ করল। ইশারায় মেঘাকে উঠে দাঁড়াতে বলল। 

মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘আমি একলব্য। নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র।’

সবাই উপুড় হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকাল I 

‘জয়, যুবরাজ একলব্যের জয়।’ সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল সবাই। 

সবাইকে নিয়ে ঋষির সামনে উপস্থিত হলো একলব্য। ততক্ষণে যা জ্বলার, তা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জোড় হাতে একলব্য ক্ষমা প্রার্থনা করল ঋষির কাছে। একলব্য ঋষি জৈমিনীর সামনে হাঁটুগেড়ে বলল, ‘মহাত্মন, আমি ওদের হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। ওরা অবোধ। মহাত্মা দুরাত্মা চেনবার ক্ষমতা ঈশ্বর ওদের দেন নি। নইলে কেন ঈশ্বরসাধনায় মগ্ন ঋষিদের ওরা আক্রমণ করে?’ 

‘তুমি কে যুবা? ক্রোধে উন্মত্ত, হিংসায় জ্বলন্ত এই মানুষগুলোর মধ্যে তোমাকে তো চেনা যাচ্ছে না।’ জৈমিনীর কণ্ঠস্বরে বেদনার ছোঁয়া টের পাওয়া যাচ্ছে। 

একলব্য করজোড়ে বলল, ‘আমার নাম একলব্য। নিষাদরাজ্যে আমার বসবাস। হিরণ্যধনু আমার পিতা। অপরাধ মার্জনা করবেন—আপনার যথার্থ পরিচয় আমার জানা নেই। 

ম্লান মৃদু হাসি তপস্বী জৈমিনীর চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা বা পিতামহ আমার যথার্থ পরিচয় জানে। তোমার বয়স অল্প, আমার নাম বোধহয় তোমার শ্রবণগত হয় নি। আমি জৈমিনী। 

নামটা শোনামাত্র একলব্য জৈমিনীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণতি জানাল। তার দেখাদেখি অন্য নিষাদরাও। ঋষি জৈমিনী দুই হাত বাড়িয়ে একলব্যকে মাটি থেকে টেনে তুললেন। বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘তোমার পরিচয় পেয়ে এবং তোমার ভক্তিশ্রদ্ধা দেখে আমি তৃপ্ত হয়েছি। আমি ওদের অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম।’ আক্রমণ-উন্মত্ত নিষাদদের দিকে তর্জনী প্রসারিত করে কথা শেষ করলেন ঋষি। 

একলব্য বলল, ‘আমি আক্রমণের কারণ জানি না। তবে এইটুকু বুঝছি—ওরা অপরাধী। কারণ তপোবনবাসী ঈশ্বরধ্যানে মগ্ন ঋষিরা কোনোরকম অন্যায় করতে পারেন না।’ 

এবার সুমন্ত কথা বলে উঠলেন। সুমন্ত ঋষি জৈমিনীর পুত্র। একলব্যের মতোই তরুণ। গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী। তবে একলব্যের মতো সুঠামদেহী নন। তপস্যা আর স্বল্পহারের কারণে তাঁর দেহ শীর্ণ। কিন্তু কণ্ঠ ভরাট ও সুললিত। 

সুমন্ত বললেন, ‘এই তপোবনের চারদিকে নানা গাছ। নানা ফলের-হরিতকি, দাড়িম্ব, আম্র, কামরাঙা, কলা এসবের। নানা ফুলের—কদম্ব, চাঁপা এবং নানা কাঠের। বিশেষ করে ছোটোবড়ো নানা আকারের চন্দন গাছ এই তপোবন ঘিরে। তুমি তো জানো—পূজা-আর্চার উপকরণের মধ্যে চন্দনকাষ্ঠ বিশেষভাবে মূল্যবহ। এরা নানা সময়ে এসে ওই চন্দনবৃক্ষ কেটে নিয়ে যায়। শাখা-প্রশাখা কাটলে আমাদের তেমন আপত্তি ছিল না। কিন্তু ওরা চন্দনবৃক্ষের মূলোৎপাটন করে নিয়ে যায়। তাদের এই দুষ্কর্মে আমরা বাধা দিয়েছি। তাতেই এই বিপত্তি, এই অগ্নিকাণ্ড, জীবননাশী আক্রমণ।’ 

একলব্য মেঘার দিকে ফিরে বলল, ‘আমি তোমাকে ধিক্কার জানাচ্ছি। তোমার সঙ্গে যারা এই দুষ্কর্মে সহযোগী হয়েছে, তাদের অপরাধের সীমা নেই। আমি ওদের হয়ে সমস্ত তপোবনবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনারা আমাদের ক্ষমা করুন।’ 

তারপর একটু থেমে আবার বলল, ‘ওরা নিজ হাতে এই তপোবন আবার গড়ে দেবে। যত সময় লাগুক, পুনর্নির্মাণ কাজ শেষ না করে ওরা লোকালয়ে ফিরে যাবে না। আর কোনো দিন এই রকম দুষ্কর্ম ওরা করবে না।’ মেঘা এবং সমবেত নিষাদদের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করল একলব্য। 

সবাই সমস্বরে বলল, ‘যুবরাজ, আপনার নির্দেশ আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। জয় হোক যুবরাজের। ঋষি, আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন।’ 

নিষাদরাজ্য যেখানে শেষ কৌরবরাজ্যের সেখানে শুরু, সেই সন্ধির স্থানে ঋষি জৈমিনীর তপাশ্রম। সরস্বতী নদীর তীরে এই আশ্রম। পঞ্চনদীর দেশ ছেড়ে আর্যগোষ্ঠী ভারতবর্ষের এই স্থানে প্রবেশ করেছিল একদা। কোন স্থানে বসতি স্থাপন করবে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে ইতস্ততা ছিল। নদী এদের কাছে পূজনীয়। বহু বিবেচনার পর সরস্বতী আর দৃষদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী ভূমিকে বসবাসের জন্য বেছে নিল আর্যরা। 

কালক্রমে রাজ্যলোভ এবং ধনলোভ দ্বারা তাড়িত হয়ে ভারতবর্ষের নানা জায়গা ছড়িয়ে পড়ল আর্যরা। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লেও তারা আদিবাসস্থানকে ভুলল না। ভূমি আর জলাধার তাদের সাহিত্যে-ধর্মে-সংস্কৃতিতে বড় জায়গা নিয়ে থাকল। তাদের কাছে সরস্বতী হয়ে গেল দেবনদী। এই নদী ও তার পরিপার্শ্ব ঋষি-তপস্বীদের কাছে পবিত্রতম স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকল। এই নদীর পারে নানা মুনিঋষি তাদের তপাশ্রম গড়ে তুললেন। ঋষি জৈমিনী তাঁদের একজন। 

তপস্বী জৈমিনী প্রতি প্রাতে সরস্বতীজলে স্নান সেরে সূর্যপ্রণাম সম্পন্ন করে সশিষ্য আশ্রমে বসে সামগান করেন। 

ঋষি জৈমিনীর আশ্রম মনোহর। শান্ত সৌম্য পরিবেশ চারদিকে। উন্মত্ত ব্যাধদের দ্বারা তপোবনের পরিবেশ বিঘ্নিত হলেও কয়েকদিনের আপ্রাণ চেষ্টায় তপোবনটি আগের চেহারায় ফিরে এল। মেঘা ও তার অনুসারীদের নিজেদের গাঁয়ে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিল একলব্য। মহাত্মা জৈমিনীর কাছে বিদায় যাচনা করলে ঋষি বললেন, ‘আর দুটো দিন থেকে যাও বৎস। এ কয়টি দিন তোমার ভীষণ কায়িক পরিশ্রম গেছে। ওদের সঙ্গে তুমিও এই তপোবন পুনর্গঠনের জন্য যথেষ্ট খেটেছ।’ 

‘এটা আমার কর্তব্য ছিল মহাত্মন। ওদের অপরাধের অংশীদার আমিও। ওরা আমার গোত্রভুক্ত।’ একটু থেমে একলব্য আবার বলল, ‘আমার অভীষ্ট অনর্জিত। ভবিষ্যৎ অজানা। গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমার হৃদয় অশান্ত। আমাকে যাত্রার অনুমতি দিন মহাত্মন।’ 

এ কয়দিনে ঋষি জৈমিনী একলব্যের অভীষ্ট সম্পর্কে জেনে নিয়েছেন। প্রথম যেদিন শুনেছিলেন, গম্ভীর হয়ে থেকেছিলেন। কী যেন নিবিষ্ট মনে ভেবেছিলেন। কী যেন বলতে চেয়েছিলেন একলব্যকে। তারপর সংযতবাক হয়েছিলেন। কিন্তু একটা বিচলিত ভাব তাঁর চোখে কপালে ছড়িয়ে পড়েছিল। বলেছিলেন, ‘আচার্য দ্রোণকে আমি চিনি। তিনি পৃথিবীশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর। তাঁর শিষ্য হতে পারা শ্লাঘার ব্যাপার। তবে তিনি একটু লোভী প্রকৃতির।’ শেষ পঙ্ক্তিটির শব্দ শুধু ঋষির আপন কান পর্যন্ত পৌঁছেছিল। 

আজ যাত্রার জন্য একলব্যের অনুমতি প্রার্থনা শুনে ঋষি জৈমিনী একটু থমকে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলেছিলেন, ‘তোমার শুভযাত্রায় বাধা দেব না একলব্য। আজকের দিন ও রাতটা থেকে যাও। কাল প্রত্যুষে যাত্রা কোরো। মনে রেখো শ্রদ্ধাবানই জ্ঞান লাভ করে।’ বলে মৌন হয়েছিলেন ঋষি জৈমিনী। 

.

সূর্যাস্তকাল। 

সরস্বতীর জলে সূর্যের শেষ রশ্মি। স্বর্ণাভ জল। মৃদু লয়ে সরস্বতী বহমান। এ অংশটি সরস্বতীর শেষ প্রান্ত। সামান্য এগিয়ে গিয়েই দেবনদী সরস্বতী অদৃশ্য হয়ে গেছে। এরপর ধু-ধু মরুভূমি। মরুভূমিটি নিষাদরাজ্যের অন্তর্গত। এই মরুভূমিতেই সরস্বতীজলধারা অন্তর্ধান হয়ে গেছে। এটাকে বলে সরস্বতীর বিনশন। কেন এখানে সরস্বতী তার গতি থামাল? 

পৃথিবীতে বহু বহু নদী আছে, যারা সামনের মরু-প্রান্তর, উত্তুঙ্গ পর্বতমালা হেলায় অতিক্রম করে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। তাহলে সরস্বতীর মতো গতিমান নদীটি সামান্য মরুভূমির কাছে হার মানল কেন? গোধূলির ম্লান আলো গায়ে মেখে সরস্বতীর তীরে বসে ভাবছিল একলব্য। হঠাৎ পিতামহ অনোমদর্শীর কথা মনে পড়ে গেল একলব্যের। 

সেদিন বিকেলে কোপবতী নদীতীরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন অনোমদর্শী। পুত্রের হাতে রাজ্যভার তুলে দেওয়ার পর মাঝেমধ্যে একলব্যকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। কোপবতী নদীর তীরেই চলে আসতেন বেশির ভাগ সময়। প্রহরীরা দূরে অবস্থান নিত। অনোমদর্শী নাতির হাত ধরে জললগ্ন পার ঘেঁষে দাঁড়াতেন। নদীকে নিয়েই তিনি বেশির ভাগ কথা বলতেন। নদীকথার সঙ্গে আসত বহিরাক্রমণকারীদের কথা পূর্বপুরুষদের শৌর্যবীর্যের কথা, ফসল-বৃক্ষদের কথা। নদী যে মানবজীবনের অমূল্য বান্ধব-সে কথা বারবার করে বলতেন অনোমদর্শী। 

সেদিন বিকেলে হঠাৎ সরস্বতীর কথা বললেন। বললেন, আমাদের রাজ্যে খুব বেশি নদী নেই। হাতেগোনা চার-পাঁচটা। তাও আবার সব নদী নাব্য নয়। এই কোপবতী আর পাবনী নিষাদরাজ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই নিষাদরাজ্যের ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালিত হয় এই দুই নদী দিয়ে। এইটুকু বলে অনোমদর্শী কোপবতীর ওপার পর্যন্ত দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দিয়েছিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল তাঁর বুক চিড়ে। 

তার পর বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশ আরও সুজলা-সুফলা হয়ে উঠত, ধনধান্যে সমৃদ্ধ হতো যদি স্রোতস্বিনী সরস্বতী আমাদের রাজ্য পর্যন্ত পৌঁছাত। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, বিনশনে এসে সরস্বতী থেমে গেল। সামনে মরুভূমি দেখে স্রোতবেগ থামিয়ে দিল নদীটি। আসলে অনেক দূর পর্যন্ত চলতে চলতে সরস্বতী ক্ষীয়মাণ হয়ে এসেছিল। বিনশন অংশটি সরস্বতীর পরিণতি স্থল। দুর্বল গতি আর স্বল্পধারার জলের জন্য মরুভূমিটি অতিক্রম করতে পারল না নদীটি। কিন্তু প্রকৃতির এই স্বাভাবিকতাকে ঘৃণার গল্পে মুড়িয়ে প্রচার করল আর্যরা।’ 

এতক্ষণ অবাক হয়ে দাদুর কথা শুনছিল একলব্য। একটু ফাঁক পেয়ে বলে উঠল, ‘ঘৃণার গল্প!’ 

‘হ্যাঁ, ঘৃণার গল্প।’ উত্তেজিত গলায় অনোমদর্শী বলে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘সরস্বতী আর্যদের প্রধানতম নদী, পবিত্রতমও বটে। এই নদীকে নিয়ে ওদের অনেক গর্ব। ওদের পুরাণে, মণ্ডলে, সূক্তে, মন্ত্রে সরস্বতীর অশেষ গুণগান। তারা বলছে, হে জননী সরস্বতী, আমাদের ত্যাগ করে তুমি কোথাও যেয়ো না। তুমি আমাদের বন্ধুভাবে গ্রহণ কোরো। অধিক জলপ্রবাহ দিয়ে আমাদের দুঃখ দিয়ো না। এই যে নদী সরস্বতী, তাকে নিয়ে আমরা নিষাদরা গর্ব করতে পারলাম না। কারণ সে আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করল না। এই প্রবেশ না করাকে আর্যরা ঘৃণার গল্পের সঙ্গে মিশিয়ে দিল। ওরা বলল, পবিত্র নদী সরস্বতী নিষাদদের ঘৃণা করে। সরস্বতী ওদের স্পর্শকে এড়াবার জন্য বিনশনে থেমে গেল। নিষাদরা যদি এর জল স্পর্শ করে, তবে তা অপবিত্র হয়ে যাবে। তাই নিষাদদের ছোঁয়া এড়াবার জন্য নিষাদরাজ্যের একটু আগেই সরস্বতী পৃথিবীর বিবরে প্রবেশ করেছে। এখন তুমিই বলো কাহিনিটি কি ঘৃণার নয়? এ রকম করে করেই ক্ষত্রিয়রা আমাদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছে। তাদের সঙ্গে মিশেছে ব্রাহ্মণরা। ব্রাহ্মণদের মেধা আর ক্ষত্রিয়দের বাহুবল মিলে ওরা এমন একটা শক্তিবৃত্ত তৈরি করেছে, যার সঙ্গে আমরা পাল্লা দিতে পারছি না। এমন একটা সময় আসবে যখন পৃথিবীর কাছে আমরা বর্বর, অশিক্ষিত, দুরাচারী জাতি হিসেবে নির্ণীত হব আর ওরা নন্দিত হবে দেবতার মতো গুণান্বিত হয়ে।’ 

দাদুর সেদিনের সেই আক্ষেপের কথা আজ বড় বেশি করে মনে পড়ছে একলব্যের। দুপুরের আহার শেষে সরস্বতীপারে এসে বসেছে সে। ঋষি জৈমিনী তার সঙ্গে শিষ্য দিতে চেয়েছিলেন কয়েকজন। একলব্য বলেছিল, ‘একা যেতে চাই আমি। জীবনে প্রথমবার এই নদী দেখা। এ নদীর সৌন্দর্যকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে চাই মহাত্মন।’ 

‘তথাস্ত্র’ বলে ঋষি জৈমিনী বিরত হয়েছিলেন। 

.

আঁধার ঘনায়মান। তপোবন অনতিদূরে। একলব্য অরণ্যচারী। আঁধার, শ্বাপদ–কোনো কিছুতেই ত্রাস নেই একলব্যের। সরস্বতীতীরে বসে ভাবছে একলব্য-এ কী অসহনীয় ব্যাখ্যা নদীটির গতি হারিয়ে যাওয়ার! সেদিন দাদুর বলা কাহিনিটি মনে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু কাহিনিটি তাকে তেমন করে ভাবায় নি সে সময়। আজ সরস্বতীতীরে বসে অন্তর্গত ভাবনায় একলব্য আকুল হয়ে উঠল। 

একলব্য শুধু অস্ত্রদক্ষ হয়ে ওঠে নি, শাস্ত্রজ্ঞানও তার ছিল। দাদুর প্রণোদনায় সে সগোত্রের শাস্ত্রাদি পাঠ করেছে। নিবিষ্ট মনে অধ্যয়ন করেছে আর্যশাস্ত্রাদি। ইতিহাস- ভূগোলের প্রতি তার দুর্বার আকর্ষণ। বিশেষ করে নিষাদদের বিষয়ে তার জানার আগ্রহ প্ৰবল। 

একলব্য জানে—আতের গোষ্ঠীর মধ্যে নিষাদরা সবচেয়ে পুরাতন। ভারতবর্ষের প্রায় প্রত্যেক জায়গাতে ছড়িয়ে ছিল তারা। আর্যরা নিষাদদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখত। তবে তা শুধু প্রয়োজনের তাগিদে, নিজেদের স্বার্থের জন্য। ‘রামায়ণে খুব ফলাও করে বলা হয়েছে—রাম সপরিবারে পান্থজনের সখার মতো চণ্ডালরাজ গুহকের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন, এক রাতের জন্য। রামের অনার্যপ্রীতির কথা খুব বড় করে অঙ্কন করেছেন বাল্মীকি। কিন্তু এ-ও তো সত্যি যে, গুহক সে রাতে ভোজনের আহ্বান জানিয়েছিলেন রাম-লক্ষ্মণ-সীতাকে, তা যে কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে রাতটা অনাহারে কাটিয়ে দিয়েছিলেন রাম, তা সামান্যভাবে হলেও উল্লেখ আছে ‘রামায়ণে’। চণ্ডালবাড়িতে ভোজন না করার কারণ কী? শুধু ঘৃণা, শুধুই স্পর্শদোষ। এই তো? 

আরেকটি কথা মনে পড়ছে একলব্যের। তাও দাদু অনোমদর্শী বলেছিলেন নদীপারে নয়, তাঁর শয্যাগৃহে। সেদিনের বিকেলটা অলসভাবেই কেটেছিল অনোমদর্শীর। প্রত্যহ বিকেলের দিকে হিরণ্যধনু একবার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যান; বিশাখাও খোঁজখবর নেন শ্বশুরের। তাঁর বিকেলের জলখাবারের তদারক করার দায়িত্ব বিশাখার। সেদিন পরিচারিকা জলখাবার পরিবেশন করতে করতে জানাল-রাজমহিষীর শরীরটা আজ খারাপ যাচ্ছে। তাই মা আমাকে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছেন। 

তাতে অনোমদর্শী কিছু মনে করেন নি। সাময়িক বা দীর্ঘকালীন—কত রকমের অসুখবিসুখ নারীদের হতে পারে। পুত্রবধূ নিশ্চয় সেরে উঠবেন। কী কারণে সেই বিকেলে হিরণ্যধনুও এলেন না। ক’দিন আগেই অনোমদর্শী সংবাদ পেয়েছেন, নিষাদরাজ্যের উত্তর সীমানায় আর্যরা হানা দিয়েছে। এ নিয়ে হিরণ্যধনু বোধ হয় ব্যস্ত। ওদের মোকাবিলার প্রস্তুতিতে যথাসম্ভব তিনি মগ্ন। কেউ না আসায় মনটা বড় অবসন্ন লাগছিল অনোমদর্শীর। বার্ধক্যে মানুষ সঙ্গ চায়। একটা বেলা কারও সঙ্গে কথা বলতে না পেরে প্রাণটা তাঁর হা-হুতাশ করছিল। 

হঠাৎ করেই সেই সন্ধ্যায় একলব্য উপস্থিত হয়েছিল দাদুর ঘরে। চৌদ্দ বছরের একলব্যকে চোখের সামনে দেখে ভেতরটা নেচে উঠেছিল অনোমদর্শীর। এই যে তাঁর উত্তরপুরুষ, যার মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন। এই সেই একলব্য, যার মধ্যে তাঁর বহু পূর্বপুরুষের রক্তধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এই একলব্যের মধ্যদিয়ে নিষাদবংশ বিস্তারিত হবে অনাদি ভবিষ্যতের দিকে। 

‘কী দেখছেন দাদু অমন করে? আমার দিকে এ রকম করে তাকিয়ে আছেন কেন?’ 

একলব্যের প্রশ্ন শুনে বাস্তবে ফিরলেন অনোমদর্শী। ‘কিছু না’ বলে ভাবনাটাকে মন থেকে সরিয়ে দিলেন। ‘এসো এসো, কাছে বসো। আমার পাশ ঘেঁষে এই বিছানায় বসো।’ নিজের শয্যা দেখিয়ে একলব্যকে কাছে আহ্বান করলেন তিনি। 

সেই সন্ধ্যায় নানা কথা হয়েছিল উভয়ের মধ্যে। অনোমদর্শী সুযোগ পেলেই রাজরাজড়া, যুদ্ধকাহিনি, ধর্মকাহিনি, শাস্ত্রগল্প—এসব শোনান নাতিকে। তিনি নিষাদদের দেবতার কথা যেমন বলেন, তেমনই বলেন আর্য দেবদেবীর কথা। বেশি করে বলেন আর্যদের বৈষম্যনীতির কথা। বলেন, ‘আর্যরা এদেশে এসেছে উন্নত ভাষা-সাহিত্য, উন্নত অস্ত্র আর পোষমানা ঘোড়া নিয়ে। এই তিনটির বদৌলতে তারা প্রায় বিনা বাধায় ভারতবর্ষকে নিজেদের করতলগত করতে পেরেছে। বিজিত মানুষদের শাস্ত্র-সংস্কৃতিকে তারা অবনমিত করেছে। সর্বদা বলে বেড়িয়েছে—সসাগরা পৃথিবীতে আর্যরা হলো শ্রেষ্ঠতম জাতি। তাদের এই হুঙ্কার-চেঁচামেচিতে কেউ বাধা দেয় নি। একমাত্র আমরা ছাড়া।’ 

‘সে কেমন দাদু?’ একলব্য জিজ্ঞেস করেছিল। 

‘আর্যদের আসার আগে ভারতবর্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বাস করত। তাদের শক্তি সামর্থ্য ছিল নগণ্য। তারা সহজেই আর্যশক্তির সামনে মাথা নত করেছে। আমরা করি নি।’ 

‘আমরা করিনি!’ অবাক চোখে আবার প্রশ্ন করেছিল একলব্য। 

অনোমদর্শী যেন একলব্যের প্রশ্ন শুনতে পান নি। আপনমনে বলে চলেছেন, ‘ভারতবর্ষে নিষাদরা ছিল প্রবল শক্তিধর। নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিল তারা। তাদের সংঘশক্তি দুর্দমনীয়। নানা যুদ্ধে আমাদের কাছে পরাস্ত হয়েছে আর্যরা। একসময় তারা যখন বুঝতে পারল—নিষাদরা বশীভূত হবার নয়, তখন সহাবস্থান শুরু করল আর্যরা। এরা শক্তিতে আমাদের সঙ্গে পেরে না উঠলেও সংস্কৃতিতে ভীষণ একটা মার দিল আমাদের।’ 

‘মানে!’ বলল একলব্য। 

‘সাহিত্য আর শাস্ত্র নির্মাণ তো ওদের হাতে। তাই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে নিষাদদের অপদস্থ করল তারা। ঋষি বাল্মীকির কথাই ধরো। ‘রামায়ণে’র কাহিনি তো তোমাকে শুনিয়েছি। ‘রামায়ণ’ নির্মাণের মূলসূত্রের কথা তোমাকে জানাই নি। আজ সেই কাহিনিই শোনো।’ অনোমদর্শী গলা খাঁকারি দিলেন। পালঙ্কের একপাশে হেলান দিয়ে বসলেন। 

নাতির দিকে সোজা তাকিয়ে আবার বললেন, ‘তোমাকে তো আগেই একদিন শুনিয়েছি, বাল্মীকি জীবনের প্রথমদিকে রত্নাকর দস্যু ছিলেন। একদিন নারদের কথায় তাঁর ভাবান্তর হলো। বহু বছর তপস্যা করে নিজেকে পরিবর্তন করলেন। এমন সাধনা যে, উইয়ের ঢিবি তাঁকে ঢেকে ফেলেছিল। উইয়ের ঢিবিকে বল্মীক বলে। এইজন্য পরিবর্তিত রত্নাকরের নাম হয়ে গেল বাল্মীকি।’ তারপর নাতির দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। বললেন, ‘আমার কথা বুঝতে পারছ তো তুমি?’ 

একলব্য ডান দিকে মাথাটা কাত করল। 

‘বাল্মীকি একদিন স্নান করতে গেলেন সরোবরে। জলে ডুব দিয়ে উঠলে তাঁর কানে ক্রৌঞ্চির ক্রন্দন ভেসে এল। ক্রৌঞ্চ বোঝো তো? ক্রৌঞ্চ হলো কোঁচবক। সরোবরে ডুব দেওয়ার ফলে বাল্মীকির দিব্যজ্ঞান লাভ হয়ে গেছে। তিনি তখন পাখিদের কথা বুঝতে পারছেন। ক্রৌঞ্চির ক্রন্দনের কারণ কী? এক ব্যাধ মানে নিষাদ ক্রৌঞ্চিসঙ্গী ক্রৌঞ্চকে তীরবিদ্ধ করেছে। মারা গেছে ক্রৌঞ্চ। তাই সঙ্গী-বিরহে আকুল হয়ে কাঁদছে কৌঞ্চি। 

ক্রৌঞ্চর বিরহব্যথায় ভীষণ নাড়া খেল বাল্মীকির ভেতরটা। প্রথমে আকুলিত হলেন, পরে হলেন ক্রোধান্বিত। তিনি নিষাদকে অভিশাপ দিলেন—তুই কোনোকালেই সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাবি না। তুই না শুধু, তোর পরবর্তী বংশধারাও আমার এই অভিশাপে অভিশপ্ত থাকবে। বাল্মীকির উচ্চারিত অভিশাপ বাক্যটি এ রকম—’মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।’ 

অনোমদর্শীর কথার মাঝখানে এবার কথা বলে উঠল একলব্য, ‘দাদু, পশুপাখি শিকার করাই তো ব্যাধদের কাজ। সেটাই তাদের খাদ্য সংগ্রহের প্রধান উপায়, জীবন ধারণের একমাত্র পথ। বাঘ-সিংহ যেমন বেঁচে থাকার জন্য ইতর প্রাণীদের হত্যা করে, নিষাদরাও তো তা-ই করে। এতে ব্যাধের অপরাধ কী? বাল্মীকির অভিশাপ দেওয়ার কারণ কী? 

‘ওখানেই আমার বলার বিষয়। বাল্মীকির এই অভিশাপ কি অহেতুক আর পক্ষপাতমূলক নয়?’ উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই উত্তর দিলেন অনোমদর্শী, ‘বাল্মীকি ছিলেন আর্য প্রতিনিধি। সচেতনভাবে হোক বা অচেতনভাবে, অভিশাপটা কিন্তু বৈষম্যমূলক। কালে কালে ‘রামায়ণ’ পঠিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। যুগান্তরের মানুষদের কাছে এই বৈষম্য-প্রণোদিত অভিশাপের কথা পৌঁছে যাবে এবং আমরা মানে নিষাদরা নিন্দিত হতে থাকব আবহমানকাল ধরে।’ অনোমদর্শী একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। তার মুখমণ্ডল বিষণ্নতায় ছেয়ে গেছে। সেই বিকেলে আর কোনো কথা বলেন নি অনোমদর্শী। 

আজকের গোধূলিতে, এই সরস্বতী নদীপারে বসে এসব কথা ভাবছে একলব্য। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে নিষাদদের জন্য কোনো মমতা নেই তাহলে? শুধু ক্ষত্রিয় কেন, ব্রাহ্মণদের মধ্যেও কি আছে? যদি থাকত তাহলে বাল্মীকির এই হীন অভিশাপ কেন? তিনি তো ব্রাহ্মণ। পাশাপাশি দুটো জাতি দীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষে বাস করছে। নিষাদরা আদি জনগোষ্ঠী, আর্যরা বহিরাগত। ভারতবর্ষের ওপর আদি জনগোষ্ঠীর অধিকারই তো সর্বপ্রথম। কিন্তু সেটা মানতে রাজি নয় আর্যরা। যুদ্ধকালে ক্ষত্রিয়রা নিষাদশক্তিকে কাজে লাগিয়েছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। বাইরে বন্ধু বন্ধু, ভেতরে ভেতরে বৈষম্যের একটা লক্ষ্মণরেখা ওরা দাগিয়ে রেখেছে উভয় জাতির মাঝখানে। তাই যখনই সুযোগ পেয়েছে, ছলে-কৌশলে নিষাদদের দাবিয়ে রাখার পথ অবলম্বন করেছে। সরস্বতী নদী আর বাল্মীকির ঘটনা তা-ই তো প্রমাণ করে। 

তাহলে তার বাসনার কী হবে? আচার্য দ্রোণ তো ক্ষত্রিয়-আশ্রিত ব্রাহ্মণ। তিনি কি উদারতা দিয়ে একলব্যকে বুকে টেনে নেবেন? 

অবশ্যই নেবেন। তিনি যে গুরু। গুরুদের চোখে কোনো বিদ্বেষ-বৈষম্য থাকে না। পৃথিবীকে আঁধার ঘিরে ধরলে একলব্য ঋষি জৈমিনীর আশ্রমে ফিরে এল। 

অনুরাগে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব থাকে, 
ভক্তি তারও বড়ো। তাতে আবেদন নেই, নিবেদন আছে। 

.

অযোনিসম্ভূত। 

দ্রোণ। 

ভরদ্বাজতনয়। অযোনিজ। ভরদ্বাজও অযোনিজাত। উতথ্য ঋষির স্ত্রী মমতা। মমতা গর্ভবতী। উতথ্যের ভাই বৃহস্পতি। গর্ভবতী মমতার সঙ্গে সঙ্গম প্রার্থনা করেন বৃহস্পতি। দেবরের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় মমতা। মমতাকে বলাৎকার করে বসে বৃহস্পতি। বৃহস্পতির বীর্য মমতার যোনির বাইরে নিক্ষেপিত হয়। ভূমিতে পতিত এই বীর্য থেকে এক পুত্রের জন্ম হয়। তাঁর নাম ভরদ্বাজ। ভরদ্বাজ উতথ্যের ক্ষেত্রপুত্র আর বৃহস্পতির প্রত্যক্ষপুত্র। যোনি-অভ্যন্তরে লালিত হয় নি বলে ভরদ্বাজ অযোনিসম্ভূত। দুইজন দ্বারা উৎপন্ন বলে তিনি দ্বাজ। 

দ্রোণও স্খলিত বীর্যোৎপন্ন সন্তান। তপ-জপ-শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করে একদা ভরদ্বাজ ঋষিতে পরিণত হন। হরিদ্বার আশ্রমে ভরদ্বাজের বেড়ে ওঠা 

পিতা ভরদ্বাজই দ্রোণের প্রথম গুরু। বেদ-বেদাঙ্গ পিতার কাছেই অনুশীলন করেছিলেন দ্রোণ। দ্রোণের অস্ত্রগুরু অগ্নিবেশ্য। অগ্নিবেশ্য অগ্নিপুত্র এবং ভরদ্বাজশিষ্য অগ্নিবেশ্যের নিকট অস্ত্রশিক্ষার সময় দ্রোণের সহপাঠী ছিলেন পাঞ্চালরাজ পৃষতের পুত্র দ্রুপদ। উভয়ের পিতা পরস্পরের বন্ধু ছিলেন। দ্রোণ ও দ্রুপদের মধ্যেও গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। 

দ্রোণ সৌম্যদর্শন। দীর্ঘবাহু, মহাতেজা ও শক্তিমান। তিনি বৃহস্পতির মতো শাস্ত্রজ্ঞ, শুক্রাচার্যের মতো বুদ্ধিমান। ক্ষমা, দয়া, সত্য ও সরলতার প্রতি তাঁর গভীর পক্ষপাতিত্ব। ব্রাহ্মণোচিত বহুবিধ গুণের আধার তিনি। জপতপ ব্রাহ্মণের একমাত্র কাজ। ব্রাহ্মণ হয়েও দ্রোণ শস্ত্রজীবী। কারণ তিনি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। 

দ্রোণ সমরে অপরাজেয়। কৌরবরাজপুত্রদের অস্ত্রগুরু হিসেবে নিযুক্তি পান দ্রোণ। ভীষ্মই তাঁকে এই পদে নিয়োগ করেন। তিনি ভারতবর্ষে অতুলনীয় অস্ত্রগুরু ছিলেন। মুগ্ধ হয়ে পিতামহ ভীষ্ম দ্রোণকে ভারতাচার্য উপাধি দেন। কুরুবংশের সঙ্গে দ্রোণের একটা অচ্ছেদ্য সুসম্পর্ক তৈরি হয়। শুভানুধ্যায়ী হিসেবে রাজসভায় তিনি সম্মানিত স্পষ্ট বক্তা তিনি। অন্যায় আর অধর্মের বিরুদ্ধশক্তি। ভবিতব্যে বিশ্বাসী। 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে তাঁর মৃত্যুর উপায় বলে দিয়েছিলেন। দ্রোণও তাঁর পরোক্ষ হত্যাকারীকে বহু আগে চিনতে পেরেও তাকে অস্ত্রদক্ষ করে তুলেছিলেন। তিনি জানতেন—তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে ধৃষ্টদ্যুম্ন। সে কথা সেনাপতি হবার পর দুর্যোধনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন আচার্য দ্রোণ। 

এসব বহু পরের কাহিনি। তারও আগে কথা আছে, ঘটনা আছে। 

ব্রাহ্মণদের ধনলিপ্সা নেই, ভূম্যধিকারী হওয়ার বাসনাও নেই তাঁদের; অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা তো দূরের কথা। ওটা তো ক্ষত্রিয়দের কাজ। ব্রাহ্মণ হিসেবে তাঁদের কাজ তো বেদ-বেদাঙ্গ পাঠ করা, শাস্ত্রানুশীলন করা। কিন্তু দ্রোণের ক্ষেত্রে এসব হয়ে ওঠে নি দারিদ্র্যের কশাঘাতে ব্রাহ্মণ হয়েও দ্রোণ একসময় ধনলোভী হয়ে উঠেছিলেন। গ্রন্থ ত্যাগ করে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র আর শস্ত্র। 

দ্রোণাচার্যের জন্মের মধ্যে কোনো মহিমা নেই; নেই কোনো গৌরব। সেকালে কোনো ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়গৃহে কোনো পুত্রসন্তান জন্মালে যে আনন্দধ্বনি শোনা যেত, দ্রোণের জন্মলগ্নে তেমন করে কোনো শঙ্খধ্বনি বা রমণীকুলের জয়ধ্বনি ওঠে নি কোনো গৃহকোণে। 

মাতা-পিতার ক্ষণিক উৎসুকতা আর বাধাবন্ধনহীন চপলতার ফসল দ্রোণ। মহর্ষি ভরদ্বাজ সংযমরুদ্ধ একজন মানুষ। সমস্ত বাহ্যসুখ থেকে নিজেকে গুটিয়ে তপে-জপে ব্যাপৃত থাকতেন তিনি। সেদিন আশ্রমের হবিধান-মণ্ডপে যজ্ঞক্রিয়া অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। যজ্ঞকার্য কিছুটা এগিয়ে দেওয়ার পর স্নানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন তিনি। গঙ্গাদ্বারের শীতল জলে স্নান করার জন্য কলস হাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। 

ধীরেসুস্থে স্নানও সেরেছিলেন ভরদ্বাজ। নির্জন স্থানে স্নান সমাপন শেষে হঠাৎ সম্মুখে তিনি স্বর্গের শ্রেষ্ঠ অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখতে পেলেন। উন্মুক্ত প্রকৃতি, স্নিগ্ধ- সৌরভ-অন্বিত নদীপার, উতল হাওয়া, অসাধারণ রূপবতী রমণী—এসব ভরদ্বাজকে চঞ্চল করে তুলল। এই সময় প্রকৃতি বুঝি মহর্ষির ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলো। শুধু মহর্ষি ভরদ্বাজ নন, উল্টো দিক থেকেও সাড়া মিলল।

ঘৃতাচী ভরদ্বাজকে দেখে এমন সরস আপ্লুত ভাব প্রকাশ করতে লাগলেন, যাতে মুনির সংযম বিঘ্নিত হয়। মুনিকে দেখিয়ে দেখিয়ে তিনি তাঁর অতি সূক্ষ্ম পরিধেয় বসনখানি পরিবর্তন করা আরম্ভ করে দিলেন। ওই সময় উন্মুক্ত স্থানে উতলা হাওয়া বইল। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গেলেন ঘৃতাচী। 

ভরদ্বাজ নগ্নবক্ষা উদোম শরীরের ঘৃতাচীকে দেখতে পেলেন এবং তাঁর সংযম বিঘ্নিত হলো। ভরদ্বাজ ও ঘৃতাচীর মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি। দ্রোণ ওঁদের মানসিক সম্মিলনের সন্তান। স্খলিত বীর্য যজ্ঞীয় কলসিতে রেখেছিলেন ভরদ্বাজ। সেখানেই জন্ম দ্রোণের। ভরদ্বাজ দ্রোণকে লালনপালন করেছিলেন। 

শৈশব থেকে জননী পরিত্যক্ত দ্রোণ। মায়ের স্নেহযত্নহীন অবস্থায় দ্রোণের শিশুকাল কেটেছে পিতা ভরদ্বাজের আশ্রমে। ধ্যানে-যজ্ঞে ব্যাপৃত মহর্ষি কোনোদিন দ্রোণকে কোলে বসিয়ে বাৎসল্য প্রকাশ করেন নি। 

ভরদ্বাজ আশ্রমের আচার্য ছিলেন। শিশুপুত্রটিকে আর কিছু দিতে না পারলেও বৈদিক ব্রাহ্মণের উত্তরাধিকারটুকু দিয়েছিলেন। দ্রোণকে ভালো করে বেদ-বেদান্ত পড়তে হয়েছিল। কিন্তু এই বহুতর অধ্যয়ন তাঁর ভালো লাগছিল না। অধ্যয়ন- অধ্যাপনা, যজনযাজন অথবা দানপ্রতিগ্রহ—এগুলো দ্রোণের ওপর ভারী পাথর হয়ে চেপে বসেছিল। যজনযাজন আর দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে জীবন চালানোর মধ্যে ব্রাহ্মণের যে ত্যাগের মহিমা, তার প্রতি দ্রোণ কিছুতেই আকৃষ্ট হতে পারছিলেন না। এর জন্য দায়ী তাঁর পিতা ভরদ্বাজ। 

ভরদ্বাজের বৃত্তিবৈচিত্র্য দ্রোণকে যাজনবৃত্তি থেকে অস্ত্রবিদ্যামুখী করেছিল। মহর্ষি ভরদ্বাজ যাজযজ্ঞ নিয়ে ব্যাপৃত থাকলেও অবসর সময়ে ধনুর্বাণ চালনা অভ্যাস করতেন। তবে তিনি শখের ধনুর্ধর ছিলেন না। তাঁর অস্ত্রবিদ্যাজ্ঞান ছিল সমীহ জাগানোর মতো। পিতার অস্ত্রচালনা গুণটি বালক দ্রোণের মনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। মহর্ষির কাছে অস্ত্রচালনা গৌণবৃত্তি, কিন্তু দ্রোণমনে তা মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাই দ্রোণ অস্ত্রবিদ্যায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। 

একদিন পিতার সামনে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে দ্রোণ বলেছিলেন, ‘আমি আপনার শিষ্য হতে চাই।’ 

‘শিষ্য তো আছই। তুমি আমার কাছে বেদ-বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করছ। আমি পিতা হলেও তোমার শিক্ষাগুরু।’ অবাক চোখে তাকিয়ে পুত্রকে বলেছিলেন ভরদ্বাজ। 

‘আমার শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।’ 

‘অসম্পূর্ণ থেকে গেছে!’ তারপর সংযত কণ্ঠে ভরদ্বাজ বললেন, ‘আমি যতদূর বুঝি, শাস্ত্রজ্ঞান তোমার সম্পূর্ণত অর্জিত হয়েছে। একজন ঋষিপুত্রের যা যা অধ্যয়ন করা প্রয়োজন, তা তা তোমার অধীত হয়ে গেছে। তোমার শিক্ষার তো কিছু বাকি নেই আর।’ 

‘আছে।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দ্রোণের। 

‘আছে! কী বাকি আছে তোমার গ্রহণের? 

‘অস্ত্রবিদ্যা। অস্ত্রবিদ্যা অর্জিত হয় নি বাবা এখনো আমার। 

এবার ভরদ্বাজের চোখ কপালে উঠল। ‘তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান। যজনযাজন, পুজোআর্চা তোমার কাজ। অস্ত্রবিদ্যা তো ক্ষত্রিয়ের জন্য। ওরা যুদ্ধবাজ জাতি। অবিরাম শত্রুবেষ্টিত থাকে তারা। আত্মরক্ষার জন্য বা পরস্ব লুণ্ঠন করার জন্য অস্ত্রচালনা- কৌশলকে করায়ত্ত করে তারা। তুমি কী করবে অস্ত্রবিদ্যা অর্জন করে?’ 

‘পিতা, আপনি ব্রাহ্মণ হয়েও কি এই বিদ্যাচর্চা করছেন না?’ 

ভরদ্বাজ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ করছি। তবে তা তো আমার দ্বিতীয় বিদ্যা। প্রথম কাম্য তো ধ্যানযজ্ঞ।’ 

‘ধরে নিন—আমিও শখের বশে এই দ্বিতীয় বিদ্যাটি লাভ করতে চাইছি। আপনি আমাকে বিমুখ করবেন না পিতা। আমাকে অস্ত্রশিক্ষায় দীক্ষিত করুন।’ 

দোটানায় পড়ে গেলেন মহর্ষি ভরদ্বাজ। ঋষি ব্রাহ্মণ হয়ে তিনি যদি নিজ পুত্রকে অস্ত্রশিক্ষা দেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কথা উঠবে। বলা হবে—নিজে ব্রাহ্মণ হয়ে পুত্রকে স্বধর্ম ত্যাগ করতে শেখাচ্ছেন, ব্রাহ্মণের বৃত্তি পরিত্যাগ করতে প্ররোচিত করছেন। 

ভরদ্বাজ একটি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। পরম মমতায় ছেলেকে কাছে টানলেন। নিচুস্বরে বললেন, ‘তোমাকে অস্ত্রবিদ্যা দান করা আমার পক্ষে অসুবিধা আছে। তুমি এক কাজ কোরো, তুমি অগ্নিবেশ্যের কাছে যাও।’ 

দ্রোণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘অগ্নিবেশ্য কে?’ 

ভরদ্বাজ বললেন, ‘তার প্রথম পরিচয়—সে অগ্নির পুত্র, দ্বিতীয় পরিচয় সে আমার শিষ্য—আমার কাছে অস্ত্রচালনা কৌশল শিখেছে সে। তৃতীয় পরিচয়-অগ্নিবেশ্য একজন খ্যাতিমান ধনুর্ধর। সে-ই তোমাকে যথোপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে।’ 

আনন্দের একটা পাতলা আভা দ্রোণের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। অন্যত্র গমনোদ্যত হলেন দ্রোণ। ভরদ্বাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ার ভঙ্গি করে বললেন, ‘তোমাকে একটি দরকারি কথা বলা হয় নি পুত্র, অগ্নিবেশ্যের কাছে একটা অমোঘ অস্ত্র আছে।’ 

‘কী নাম সে অস্ত্রের?’ 

‘আগ্নেয় অস্ত্র।’ বলে কিছুক্ষণ নীরব রইলেন ভরদ্বাজ। তার পর দ্রোণের দিকে কোমল চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘অসাধারণ একজন শিষ্য এই অগ্নিবেশ্য। তার অস্ত্রচালনা-প্রতিভায় আমি ভীষণ প্রীত হয়েছিলাম। সে আমাকে এতই মুগ্ধ করেছিল যে, সর্বোত্তম আগ্নেয় অস্ত্রের বিদ্যাটি আমি তাকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম। যদি পারো এই বিদ্যা তুমি অগ্নিবেশ্যের কাছ থেকে শিখে নিয়ো। গুরুকে প্রীত করার জন্য একটা জিনিসের খুব প্রয়োজন।’ 

উৎসুক কণ্ঠে দ্রোণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী জিনিসের প্রয়োজন বাবা?’ 

‘বিনয়। ব্রহ্মচর্য, অধ্যবসায়, মনোযোগ এবং বিনয়—এই চারটি গুণ যে শিষ্যের থাকবে, সে সর্বোত্তম শিষ্য হতে পারবে। তবে মনে রাখবে, সবার ওপরে থাকা চাই বিনয়। আমি আশা করছি-বিনয় দ্বারা তুমি অগ্নিবেশ্যের মন জয় করতে পারবে। অগ্নি- অস্ত্র তোমার অধিগত হবে।’ ধীরে ধীরে মহর্ষি ভরদ্বাজ কথা শেষ করলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *