একলব্য – ২

গুরুর পথ গুরুর আঙিনাতেই যাওয়ার পথ। 

অপরাহ্ন। 

রোদের গায়ে পাতলা কুয়াশার আস্তর।

নৃপাসনে বসে আছেন অনোমদর্শী। 

অনোমদর্শী মহারাজ হিরণ্যধনুর পিতা। দীর্ঘদেহী। বয়োভারে কিছুটা ন্যুব্জ। পক কেশ। চামড়া সামান্য কুঁচকে গেছে। সবল পেশি এখনো অনোমদর্শীর শরীরে বর্তমান। কুচকুচে কালো শরীরে অপরাহ্ণের ছেঁড়া রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। পুত্র হিরণ্যধনু রাজকার্যে দক্ষ হয়ে উঠলে একদিন পুত্রহস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করলেন তিনি। 

প্রবীণ পারিষদরা বাধা দিয়েছিলেন, ‘মহারাজ, এখনো আপনার শরীরে নদীর খরস্রোত, আপনাকে সামনে দেখে পশুরাজ এখনো লেজ গুটিয়ে পালায়। আপনার শাসনে এই অরণ্যরাজ্যের সকল প্রজা পরম সুখে আছে। আপনি এখনো একজন সক্ষম বিচক্ষণ বিচারক। আপনি কেন এখন রাজ্যভার যুবরাজ হিরণ্যধনুর হাতে তুলে দেবেন? আপনি আরও কিছু বছর রাজ্য শাসন করুন।’ 

অনোমদর্শী পারিষদদের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। তারপর বললেন, ‘হিরণ্যধনু যুবক হয়ে উঠেছে। তার রাজকার্যদক্ষতা প্রশংসনীয়। কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান দিতে শিখে গেছে হিরণ্যধনু। তাকে বিয়ে করিয়েছি। ও আমার একমাত্র পুত্র। আমার বয়স হয়ে গেছে। রাজকার্য পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ দম আর বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন, এখন তার কিছুটা ঘাটতি আমি আমার মধ্যে লক্ষ করছি। তা ছাড়া…।’ 

সেনাধ্যক্ষ মহারাজ অনোমদর্শীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘তা ছাড়া! তা ছাড়া কী মহারাজ?’ 

‘বলছি। পুত্র উপযুক্ত হয়ে উঠলে মাতা-পিতার মন তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। হিরণ্যধনু উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। তাকে রাজ্যভার দিয়ে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে, সে একজন সুবিবেচক এবং সুশাসক। তাই আমার সকল ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকতে থাকতে হিরণ্যকে রাজা ঘোষণা করে তার রাজ্যশাসন প্রণালিটা আমি দেখে যেতে চাই। তোমরা আমাকে বাধা দিয়ো না। মৃত্যুর আগে এই তৃপ্তিটুকু পেতে চাই—হিরণ্যধনু ব্যাধসমাজের একজন খ্যাতিমান রাজা।’ 

তাঁর কথা শুনে সেদিনের রাজসভার সকল পারিষদ আর কথা বাড়ান নি।

শুভক্ষণে অনোমদর্শী হিরণ্যধনুকে রাজসিংহাসনে বসিয়েছিলেন। 

 .

রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরের একটি কক্ষকে রাজকীয়ভাবে সুসজ্জিত করিয়েছেন হিরণ্যধনু। রাজসভার আদলে এই কক্ষটি নির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই অনোমদর্শীর শয্যাকক্ষ। একা থাকেন তিনি ওই কক্ষে। বেশ ক’বছর আগে রাজমাতার মৃত্যু হয়েছে। পুত্রকে রাজ্যভার অর্পণের পর রাজপিতা এই কক্ষে বাস করা শুরু করেছেন। রাজার শয্যাকক্ষটি পুত্র হিরণ্যধনুর অনুকূলে ছেড়ে দিয়েছেন অনোমদর্শী। কারণ এখন তিনি মহারাজা নন, রাজপিতা মাত্র। 

রাজপিতা হলে কী হবে, রাজকার্য পরিচালনায় অথবা পরিবারকেন্দ্রিক কোনো সংকট দেখা দিলে হিরণ্যধনু পিতার পরামর্শ গ্রহণ করেন। পিতার শয্যাকক্ষের পাশের রাজকীয় কক্ষে এসে বসেন। পিতা এসে নৃপাসনে বসেন, পুত্র সাধারণ একটা আসন গ্রহণ করে পিতার পায়ের কাছে বসেন। 

আজ হিরণ্যধনুর পরিবারে সংকটকাল উপস্থিত। একলব্য হস্তিনাপুর গমনে উদ্যত। সে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখবার জন্য বেপরোয়া। পুত্রকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন বটে, তারপরও মনটা বড় খচখচ করছে। পিতার পরামর্শই শিরোধার্য। তাই আজ অপরাহ্ণে পিতার কাছে এসেছেন হিরণ্যধনু; উপদেশের জন্য, পরামর্শের জন্য। হিরণ্যধনু এই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। 

পিতা কক্ষে প্রবেশ করলে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন হিরণ্যধনু। অনোমদর্শী বললেন, ‘বসো, বসো।’ নিজে আসন গ্রহণ করে পুত্রের দিকে তাকালেন। দেখলেন— ভীষণ একটা উদ্বিগ্নতা হিরণ্যধনুর চোখেমুখে। কী রকম যেন বিপর্যস্ত অবস্থা তার! কঠিন সমস্যাতেও বিচলিত হয় না যে, তাকে বিষণ্ণ-বিচলিত দেখে অনোমদর্শী নিজের মধ্যেও চঞ্চলতা অনুভব করলেন। নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘তুমি কি কোনো সংকটে পড়েছ হিরণ্য?’ 

হিরণ্যধনু বিব্রতমুখে বললেন, ‘হ্যাঁ, বাবা।’

‘রাজ্যসংক্রান্ত কিছু কি?’ 

‘না বাবা।’ 

‘তাহলে!’ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন অনোমদর্শী। 

‘পরিবারসংক্রান্ত।’ মাথা নিচু করে উত্তর দিলেন হিরণ্যধনু। 

‘পরিবারসংক্রান্ত! তোমার পরিবারে আবার কী সংকট? তোমার মা নেই, মানি। বাবা তো আছি। তোমার ঘরে কোনো যুবতি কন্যা নেই। যুবতি কন্যারা পারিবারিক সংকট তৈরি করে। তা ছাড়া, তোমার তো একটিমাত্র সন্তান—একলব্য। কৈশোর ছাড়িয়ে তরুণ হয়ে উঠেছে সে। বিশ বছরের যুবা। বিদ্যার্জন সমাপন করেছে সে। ধীর, স্থির। তবে আবেগটা তার একটু বেশি।’ ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে গেলেন অনোমদর্শী। 

‘ওই আবেগই কাল হয়েছে। একলব্যের আবেগই পারিবারিক সংকট তৈরি করেছে।’ পিতার মুখের কথা অনেকটা কেড়ে নিয়ে বললেন হিরণ্যধনু। 

‘খুলে বলো।’ পুত্রের চোখে চোখ রেখে বললেন অনোমদর্শী। 

‘একলব্য বলছে-তার অস্ত্রবিদ্যার্জন অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। সে দক্ষ ধনুর্ধর হতে চায়। ধনুর্বিদ্যার জগৎশ্রেষ্ঠ আচার্য হলেন দ্রোণাচার্য। কুরুকুলগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে সে ধনুর্বিদ্যার্জনের জন্য যেতে চায়।’ 

অনোমদর্শীর বুক থেকে ভারী একটা পাথর সরে গেল। তিনি ভেবেছিলেন দুর্বিষহ কোনো সংকট বুঝি। এ তো পিতার উদ্বিগ্নতা আর পুত্রের আবেগের সাংঘর্ষিক সংকট। এ সংকট অনতিক্রম্য নয়। 

হালকা চালে অনোমদর্শী বললেন, ‘পুত্র তোমার যুবক হয়ে উঠেছে। অস্ত্রবিদ্যার্জনে উন্মুখ সে। শুনে যা বুঝছি—নিষাদরাজ্যের অস্ত্রগুরুর কাছে যা শেখার, তা শিখে ফেলেছে একলব্য। তার ভেতর আরও নিপুণভাবে অস্ত্রচালনা শিক্ষার বাসনা কাজ করছে। মানি— বর্তমানে দ্রোণাচার্যের বাড়া এই ভারতবর্ষে আর কোনো ধনুর্ধর নেই। তাঁর কাছেই ধনুর্বিদ্যা শিখা উচিত, যদি একলব্য আরও শিখতে চায়। তাকে যেতে দাও।’ বলে মৌন হলেন অনোমদর্শী। 

‘বাবা, আপনি কি সব বুঝেশুনে এই কথা বলছেন? আর্য-অনার্যের ব্যাপারটি…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন হিরণ্যধনু। 

‘আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বের চেয়ে তোমার মধ্যে পুত্র একলব্যের জন্য প্রবল উৎকণ্ঠা কাজ করছে। এই নবীন বয়সে একমাত্র পুত্র বহির্দেশে যাবে, তার নিরাপত্তা নিয়ে তুমি উদ্বেগাকুল। যদি তার কিছু হয়, সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমার, একমাত্র উত্তরাধিকারী হারাবে তুমি। তোমার মধ্যে বাৎসল্য প্রবল; যেটা রাজাদের মধ্যে থাকতে নেই।’ ধীরে ধীরে বলে গেলেন অনোমদর্শী। 

পিতা যেন পুত্রের অন্তচিত্র স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। নইলে হুবহু তাঁর মনের কথাটা পিতা কীভাবে বলে গেলেন! তবে এটাও তো মিথ্যে নয় যে, আর্যরা প্রথম থেকেই অনার্যদের ধ্বংস চেয়েছে। তারা অবিরত চেষ্টা করে গেছে ভারতবর্ষের আদিবাসীদের পদানত করে রাখবার জন্য। তাদের শাস্ত্রে, সাহিত্যে, সংহিতায়, পুরাণে সর্বত্র কুৎসিতভাবে অনার্যদের রূপায়িত করেছে। তাদের কাছে অনার্যরা মানুষ নয়; তারা দানব, তারা অসুর। তারা সংস্কৃতিহীন। 

‘রামায়ণে’র কাহিনির দিকে তাকালে এই কথার প্রমাণ মিলে। সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর রাবণ। তাঁর দোর্দণ্ডপ্রতাপে ত্রিভুবন কাঁপত। সেই রাবণকে কী বীভৎসভাবেই না আঁকলেন বাল্মীকি! বাল্মীকি ব্রাহ্মণ বলে তাঁর হাতে রাবণ হয়ে গেলেন রিরংসাপরায়ণ হিংস্র একজন রাজা। তাঁর মধ্যে কোনো ন্যায়পরায়ণতা নেই, কোনো ভ্রাতৃবাৎসল্য নেই। রাম কি ন্যায়পরায়ণ? রাম যদি ন্যায়পরায়ণ হন, তাহলে নিরপরাধ বালীকে হত্যা করলেন কেন? অপাপবিদ্ধা সীতাকে গর্ভবতী অবস্থায় চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে বনবাসে পাঠালেন কেন? শাস্ত্রজ্ঞ শম্বুক মুনিকেই হত্যা করলেন কেন রাম? 

শম্বুক শূদ্র বলে তাঁকে নির্মমভাবে নিধন করলেন রামচন্দ্র। কারণ আর্যশাস্ত্র বলেছে—শূদ্রদের আর্য শাস্ত্রাদি পাঠ অপরাধ। ব্রাহ্মণরা রামের কাছে দাবি করেছে— শূদ্রের আর্যশাস্ত্র পাঠ করার পাপে এক ব্রাহ্মণপুত্র মরেছে। ব্রাহ্মণের অভিযোগকে যুক্তি দিয়ে বিচার করলেন না রামচন্দ্র, বিচার করলেন আর্যশাস্ত্রের অন্ধ সংহিতার আলোকে। এত বড় একজন নৃপতি হয়ে ব্রাহ্মণদের যুক্তিহীন যুক্তিতে ভেসে গেলেন রাম। হত্যা করলেন ধ্যানমগ্ন শাস্ত্রজ্ঞ শম্বুক মুনিকে। 

এই-ই তো আর্যধর্ম, এই-ই তো আর্য অভিব্যক্তি। দ্রোণাচার্য আর্য-নৃপতি লালিত ব্রাহ্মণ। তিনি কি আর্য-সংস্কার থেকে বিচ্ছিন্ন? কখনো নন। একজন ক্ষত্রিয়পুষ্ট আচার্য কোনোক্রমেই স্বাধীনচেতা হতে পারেন না। পিতা যা বলেছেন তা যেমন সত্যি, আবার অনার্যদের প্রতি আর্যদের নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাপারটিও অস্বীকার করবার উপায় নেই। 

পিতা অনোমদর্শী বহুদর্শী। জীবনের বহু বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এসেছেন তিনি। বহুবার আর্যদের বিরুদ্ধে সমরে লিপ্ত হতে হয়েছে তাঁকে। এর পরও আর্য-নির্মমতার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন কেন? এর পশ্চাতে পিতার নিজস্ব কোনো ভাবনা কাজ করছে কি? 

‘তুমি বোধহয় ভাবছ—আর্য-হিংস্রতা এড়িয়ে তোমার সামনে সন্তানবাৎসল্যকে বড় করে তুলছি কেন? কেনইবা তোমার পুত্রের বাসনাকে বেশি মূল্যায়ন করছি।’ বলে হিরণ্যধনুর মুখের দিকে তাকালেন অনোমদর্শী। পুত্রের উত্তরের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। 

হিরণ্যধনু মুখে কিছু না বলে পিতার দিকে প্রশ্নাতুর চোখে তাকিয়ে থাকলেন। 

অনোমদর্শী নৃপাসনে গা এলিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আর্যরা এদেশে বহিরাগত। যাযাবর তারা। ঊষর দেশ থেকে তারা এই ভারতবর্ষে এসেছে। এ দেশের শস্যশ্যামল রূপ দেখে, ফুলে ফুলে পূর্ণ মাঠ দেখে, জলপূর্ণ নদী দেখে উৎফুল্ল হয়েছে তারা। উল্লাস একটু স্তিমিত হয়ে এলে তারা বুঝেছে—এ ফসল, এ উর্বর জমি, এ নদী, বৃক্ষ-অরণ্য তো তাদের নয়। এগুলোর মালিক তো এ দেশেরই আদিবাসীরা। সুতরাং ওদের মেরেকেটে এগুলো দখল কোরো। হিংস্রতা দেখিয়ে, বর্বরতার আশ্রয় নিয়ে নগর- ফসলিমাঠ নিজেদের অধিকারে আনো। এটা সত্য যে, ভারতবর্ষের আদিবাসীরা যুদ্ধে তেমন দক্ষ নয়। প্রতিবেশী রাজাদের সঙ্গে ছোটোখাটো যুদ্ধ ছাড়া তো বড় কোনো যুদ্ধ তাদের করতে হয় নি। আর্যরা ঘোড়াকে পোষ মানিয়ে নিজেদের বাহন করেছে। নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করেছে। অসি চালনায় অত্যন্ত দক্ষ তারা। আমরা নিষাদ। আমাদের বিশ্বাস ছিল, তীর চালনায় নিষাদরা বুঝি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আর্যদের বিরুদ্ধে সমরে লিপ্ত হয়ে বুঝেছি, তীর চালনায় অতুলনীয় দক্ষ তারা। তারাই শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ।’ দম ফুরিয়ে এল অনোমদর্শীর। থামলেন তিনি। 

তারপর ধীরে ধীরে আবার বললেন, ‘তীর চালনার প্রকৃত বিদ্যে ওরা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। আমরা যে ধনুর্বিদ্যা অর্জন করেছি, তাতে খাদ আছে। ওই খাদযুক্ত বিদ্যে নিয়েই আমাদের অহংকার। কিন্তু এ অহংকার যথার্থ নয়। যুদ্ধে আর্যদের কখনো যদি হারাতে চাও তাহলে ওদের তীর নিক্ষেপণজ্ঞান দখলে আনতে হবে। বর্তমান ভারতবর্ষে দ্রোণাচার্যের চেয়ে বড়ো কোনো অস্ত্রগুরু নেই। তোমার ছেলে একলব্য যদি তাঁর কাছ থেকে ধনুর্বিদ্যা অর্জন করে আসতে পারে তাতে আমাদের লাভ। একলব্য এই বিদ্যা নিষাদদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে। একটা সময়ে ব্যাধসমাজে অসংখ্য ধনুর্বিদ তৈরি হবে। অস্ত্রবিদ্যায় আর্যদের সমকক্ষ হয়ে উঠব আমরা।’

একটু থেমে আবার বললেন, ‘আমি বলি কী, একলব্যকে দ্রোণাচার্যের কাছে যাবার অনুমতি দাও তুমি। শুধু অনুমতি নয়, উৎসাহ জোগাও তাকে।’ 

এতক্ষণে কথা বললেন হিরণ্যধনু, ‘নিষাদপুত্রকে কি দ্রোণাচার্য শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন? 

‘ওটা একলব্যের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দাও। ভাগ্য প্রসন্ন হলে শিষ্য হিসেবে একলব্যকে গ্রহণ করতেও পারেন আচার্য। আর ভাগ্য অপ্রসন্ন হলে হারানোর তো কিছু নেই।’ 

‘না পিতা, বলছিলাম-একলব্য সেই ছোটবেলা থেকে আবেগতাড়িত। প্রত্যাখ্যানের বেদনা যদি সইতে না পারে? যদি বিহ্বল হয়ে কিছু একটা করে বসে?’ 

‘তুমি প্রত্যাখ্যানের কথা ভাবছ কেন? গ্রহণের আনন্দের কথা ভাবছ না কেন? দ্রোণাচার্য উদার মানুষ। তোমার পুত্রকে বুকে টেনেও তো নিতে পারেন।’ 

‘তারপরও একলব্যের ভাবাবেগের কথা ভাবছিলাম। তরুণ বয়স। চিন্তাশক্তি তত পরিপক্ব হয় নি। বাস্তবতা তো বড় কঠিন বাবা।’ চিন্তান্বিত কণ্ঠে হিরণ্যধনু বললেন। 

অনোমদর্শী বললেন, ‘ওটাই আমার ভরসার জায়গা। তারুণ্যই একলব্যকে জাগিয়েছে। দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষাগ্রহণের ব্যাপারটি তোমার মাথায় তো আসে নি। এই যে আমার এত বয়স হলো, আমিও তো ভাবি নি—একলব্য ভুবনবিখ্যাত অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে ধনুর্বিদ্যা শিখে আসুক। আমারই তো উচিত ছিল—তোমাকে আর তোমার ছেলেকে প্রণোদিত করা দ্রোণাচার্যের কাছে যাওয়ার জন্য। সেই প্রণোদনা একলব্যের ভেতরে আপনাতেই স্ফুরিত হয়েছে। তার প্রণোদনাকে উৎসাহিত করা উচিত আমাদের, যাতে সে আরও বেশি উদ্দীপিত হয়ে ওঠে।’ 

হিরণ্যধনু মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তাঁর চোখেমুখে রোদমেঘের খেলা। উদ্দীপনা আর হতাশা তাঁর সমস্ত অবয়ব ঘিরে। ছেলে যদি দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যার্জন সম্পন্ন করে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসতে পারে তাহলে নিষাদকুলে মস্তবড় একটা ঘটনা হয়ে যাবে। এর আগে কোনো নিষাদ আর্যগুরুর কাছে বিদ্যার্জন করার সৌভাগ্য লাভ করে নি। একলব্যই প্রথম সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। সে যে কত বড় উল্লাসের ব্যাপার হবে, ভাবতেই শিহরণ বোধ করছেন হিরণ্যধনু 

আর যদি ব্যর্থ হয়? যদি দ্রোণাচার্য ঘৃণায় ফিরিয়ে দেন একলব্যকে? তাহলে, তাহলে একলব্যের কী হবে? কিচ্ছু হবে না। বাবা বলছেন, আচার্য দ্রোণ অসাধারণ একজন মানুষ। তাঁর হৃদয় আকাশের মতো বিশাল। সেই বিশাল হৃদয়ে একলব্যের মতো একজন নিষাদ সন্তানকে অবশ্যই স্থান দেবেন তিনি। কিন্তু যদি একলব্যকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ না করেন তিনি, যদি দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন? অস্থির মনে এসব ভাবতে থাকেন হিরণ্যধনু। তিনি খেয়াল করেন নি পিতা অনোমদর্শী পলকহীন চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। পিতার দিকে চোখ পড়তেই বিব্রত হলেন হিরণ্যধনু। মাথা অবনত করলেন তিনি। 

অনোমদর্শী নরম গলায় বললেন, ‘দ্বিধা ঝেড়ে ফেলো হিরণ্য। বড় কিছু পেতে হলে, ছোট কিছু ত্যাগ করতে হয়। দ্রোণাচার্যের কাছে একলব্যের অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করা বিরাট একটা ব্যাপার। আর তোমার সন্তানবাৎসল্য ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার। একটা ব্যক্তিগত আর অন্যটা সামষ্টিক। ও আর্যশিক্ষা সমাপ্ত করে এলে এই রাজ্যের মর্যাদা অনেক বেড়ে যাবে। অন্যান্য নিষাদ রাজারা তোমার পুত্রকে সমীহের চোখে দেখবে। আর আমাদের মধ্যে তো হানাহানি লেগেই আছে। তোমার পুত্রের ধনুর্শক্তি ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়ে গেলে ব্যাধবংশের কোনো রাজা হিরণ্যধনুর রাজ্যাক্রমণে সাহস করবে না। দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলো পুত্র। একলব্যের যাত্রার আয়োজন কোরো। 

হিরণ্যধনু কী যেন একটা বলতে চাইলেন। দ্বিধান্বিত চোখে পিতার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। 

অনোমদর্শী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বলতে চাইছ?’ 

‘হ্যাঁ বাবা, আপনার অনুমতি ছাড়া, মনে সাংঘাতিক দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও একলব্যকে আমি আশ্বস্ত করেছি যে, তার যাত্রার ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই।’ 

‘এই তো যথার্থ বুদ্ধিমানের কাজ করেছ।’ 

‘কিন্তু বাবা, আপনার অনুমতি না নিয়ে…।’ 

হিরণ্যধনুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অনোমদর্শী বললেন, ‘এ বিষয়ে আমার অনুমতি নেওয়াটা বাহুল্যের ব্যাপার। পুত্র তোমার। একলব্যের ওপর তোমার পূর্ণ অধিকার। আর এটা তো হিতকর কাজ। রাজ্যের হিত, একলব্যের মঙ্গল। দ্রোণাচার্যের কাছে একলব্যের অস্ত্রশিক্ষার ব্যাপারটি তোমার বংশগৌরব বাড়াবে। আর হ্যাঁ, তুমি তো একলব্যকে একেবারে যাত্রা করিয়ে দিয়ে আমার অনুমতি প্রার্থনা করছ না।’ 

‘তা করি নি বাবা। কিন্তু সম্মতি তো দিয়েছি। এমনভাবে চাপাচাপি করছিল সে…।’ 

‘সম্মতি দিয়ে তুমি ভালোই করেছ। আমার সঙ্গে পরামর্শের কথা ভেবে যদি তুমি একলব্যকে তাৎক্ষণিক সম্মতি প্রদান না করতে, তাহলে সে মুষড়ে পড়ত। হতাশা তাকে ঘিরে ধরত। ভাবত, তুমি তার উচ্চাশার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছ। তুমি তাৎক্ষণিক সম্মতি দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছ।’ একটু দম নিয়ে অনোমদর্শী আবার বললেন, ‘তা ছাড়া একলব্যের আকাঙ্ক্ষা আর তোমার সিদ্ধান্ত বিষয়ে আমার তো কোনো দ্বিমত নেই।’ 

পিতার কথা শুনে সেই অপরাহে হিরণ্যধনুর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পিতার অনুমতি ছাড়া পুত্রকে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণের আদেশ দিয়ে একধরনের অপরাধবোধে বিব্রত ছিলেন হিরণ্যধনু। অনোমদর্শীর উদ্দীপনা আর সম্মতিতে তাঁর ভেতরের সকল দ্বিধা এবং অপরাধবোধ কেটে গেল। 

হিরণ্যধনু পিতার কাছে গৃহান্তরে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। 

স্মিত হেসে পুত্রের দিকে তাকালেন অনোমদর্শী। মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিশাখার সঙ্গে আলোচনা করেছ কি? একলব্যের ওপর তারই সর্বাধিকার।’ 

‘আজ সকালে একলব্যের সঙ্গে আলাপের সময় বিশাখা উপস্থিত ছিল। আশা করি তার সম্মতি আছে। আর যদি না-ই থাকে, আপনার কথাগুলো তাকে বোঝালে সানন্দে রাজি হবে বলে আমার বিশ্বাস।’ হিরণ্যধনু বললেন। 

‘তোমাদের সবার মঙ্গল হোক। অবিলম্বে একলব্যের যাত্রার আয়োজন কোরো।’ অনোমদর্শী বললেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *