একলব্য – ১৩

১৩

ব্রাহ্মণো ভার্গবোহস্মি। 
আমি ভার্গব গোত্রের ব্রাহ্মণ। 

.

‘হ্যাঁ, সূতপুত্র বলে যাকে আপনি ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা দান করেন নি, শিক্ষার মধ্যপথে যাকে আপনি গুরুকুল থেকে অনেকটা বহিষ্কারই করে দিয়েছিলেন, সেই কর্ণকে সাদরে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন পরম গুরু পরশুরাম।’ কর্ণ বলল। 

বিস্মিত কণ্ঠে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘বহিষ্কার করে দিয়েছিলাম আমি! তোমাকে! আমার পাঠশালা থেকে! 

‘বহিষ্কারই তো করেছেন আপনি। যে গুরু সমান মেধাবান শিষ্যকে সমান শিক্ষা না দিয়ে পক্ষপাতিত্ব করেন, তাঁকে যথার্থ গুরু বলা যাবে কি না জানি না। মেধায় অর্জুনের চেয়ে আমি কোনো অংশে কম ছিলাম না। কিন্তু আপনার পক্ষপাতিত্ব ছিল অর্জুনের দিকে। নিজপুত্র বলে অশ্বত্থামাকে আর রাজপুত্র বলে অর্জুনকে আপনি ব্রহ্মাস্ত্র দান করলেন। আমাকে বিমুখ করলেন আপনি। বললেন, ব্রাহ্মণরাই এই মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকারী হতে পারে শুধু। অর্থহীন কীসব যুক্তি দিয়ে বোঝালেন, ক্ষত্রিয়রাও এই অস্ত্রের অধিকারী হতে পারে। সূতপুত্র বলে আমাকে ঘৃণা আর অবহেলায় উড়িয়ে দিলেন। দম নেওয়ার জন্য একটু থামল কৰ্ণ। 

তারপর আবার বলল, ‘এরপর কোনো শিষ্য কি ভক্তিশ্রদ্ধা নিয়ে আপনার বিদ্যালয়ে বিদ্যার্জন করতে পারে? পারে না। আপনি পরোক্ষে বলে দিলেন, সূতপুত্র হওয়া সত্ত্বেও করুণাবশে তোমাকে এতদিন অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছি আমি। মর্যাদাহীন বংশে জন্মে তুমি ব্রহ্মাস্ত্রের অধিকার চাইছ? তোমার আর আমার পাঠশালায় স্থান নেই। এরকমই তো ভাবে-ভঙ্গিতে বুঝিয়েছিলেন সেদিন আপনি আমাকে? বহিষ্কারই তো বলা যায় একে?’ 

কী বলবেন দ্রোণাচার্য বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কর্ণের কথার কোনো উত্তর তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন অস্ত্রবিদ্যা-প্রদর্শনীর ময়দানে। 

এই সময় অশ্বত্থামা বলে উঠল, ‘তুমি থামো কর্ণ। আমার পিতাকে অপমান করার সাহস পেলে কোথা থেকে তুমি?’ 

কথোপকথনস্থলে কখন অশ্বত্থামা এসে উপস্থিত হয়েছে, টের পান নি দ্রোণাচার্য। চমকে অশ্বত্থামার দিকে ফিরলেন। হাত তুলে অশ্বত্থামাকে থামতে বললেন। 

দুর্যোধন বলল, ‘অশ্বত্থামা, তুমি কথা বলবে না। এটা গুরু-শিষ্যের সমস্যা। ওঁদের সমাধান করতে দাও।’ 

কর্ণ বলে উঠল, ‘আমার সঙ্গে আপনার মতো হীন আচরণ করেন নি আচার্য পরশুরাম। সূতপুত্র জেনেও ব্রহ্মবিদ্যা দান করেছেন তিনি আমায়।’ সত্যের সঙ্গে মিথ্যেকে মিশিয়ে কথা শেষ করল কর্ণ। 

দ্রোণাচার্যের চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত। পরশুরাম বৈদিকসমাজের নীতিনির্ধারক। ব্রহ্মাস্ত্র সম্পর্কে কর্ণকে তিনি যা বলেছিলেন, তার সবটুকুই পরশুরামের কথা। তিনিই বলেছিলেন, ‘হীনজাতির কেউ ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করার অধিকার রাখে না।’ গুরুর কথাটাই বলেছিলেন তিনি কর্ণকে। সেই গুরুদেব পরশুরাম কী করে কর্ণকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন! কী করে তিনি তার হাতে মারণাস্ত্র তুলে দিলেন? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না আচার্য। 

দ্রোণাচার্যের কাছে পরশুরাম-সম্পর্কিত কর্ণের বক্তব্য ছিল পূর্বপরিকল্পিত। তার কথায় সত্যের চেয়ে মিথ্যে ছিল বেশি। দ্রোণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কর্ণ পরশুরামের কাছে উপস্থিত হয়েছিল। হাঁটু গেঁড়ে বসে করজোড়ে শিষ্যত্ব যাচনা করেছিল সে। বলেছিল, ‘আপনি ত্রিভুবন-শ্রদ্ধেয় গুরুদেব, আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করার জন্য বহু যোজনপথ অতিক্রম করে এসেছি। আমাকে গ্রহণ করুন।’ 

পরশুরাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কোন কুলে জন্ম তোমার?’ 

কর্ণ জানে,পরশুরামের মাহেন্দ্র বিদ্যালয়ে সূতপুত্রের পরিচয় চলবে না। ক্ষয়িত্রদেরও পছন্দ করেন না তিন সপ্তবার ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরাম। মিথ্যাচার করল কর্ণ। পরশুরামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, ‘আমি ভার্গব গোত্রের ব্রাহ্মণ। 

কাশ্যপ, ভরদ্বাজ অথবা মৌদ্‌গল্য ব্রাহ্মণ নয়, নিজেকে একেবারে ভার্গব ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিল কর্ণ। পরশুরাম বিগলিত হলেন। কর্ণকে তাঁর অস্ত্র পাঠশালায় স্বাগত জানালেন। কারণ তিনি নিজেই ভৃগুবংশীয় ভার্গব। 

বড় যোদ্ধা হওয়ার জন্য, নিজেকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য কর্ণ অবিরাম সংগ্রাম করে গেছে। সর্বদা পরিবেশ আর পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে তাকে। সূত অধিরথের ছেলে বলে দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় তার অভীষ্ট লাভ হলো না। নিজেকে উন্নত করার জন্য অভিমানক্ষুব্ধ কর্ণ আরও বিখ্যাত অস্ত্রগুরু পরশুরামের কাছে গেল। নিজের মিথ্যে পরিচয় দিল পরশুরামকে। 

কর্ণ যে নিজেকে ভার্গব বলে পরিচয় দিল, তার স্বপক্ষে একটা যুক্তি দাঁড় করাল মনে মনে। কর্ণ ভাবল—গুরু তো পিতার সমান। শাস্ত্র গুরুকে দ্বিতীয় পিতার স্বীকৃতি দিয়েছে। ভার্গব পরশুরামকে সে গুরু বলে মেনে নিয়েছে। সুতরাং নিজেকে ভার্গব বলে পরিচয় দিতে ক্ষতি কী? এটা তো মিথ্যে নয়। তাই নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিল কর্ণ। আর এটা যদি মিথ্যাচারও হয়, অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যই তো এরকম করেছে সে। তথাকথিত হীনবংশে জন্ম তার। অকুলীন কুলে জন্ম বলে সে কি কখনো বাঞ্ছিত সিদ্ধি অর্জন করতে পারবে না? অবিরাম অপরিসীম লাঞ্ছনার শিকার হতে থাকবে সে? না, কিছুতেই না। ব্রহ্মাস্ত্র লাভ তাকে করতেই হবে। এই বাসনায় নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না কর্ণ। 

পরশুরামের মাহেন্দ্র পাঠশালায় কর্ণের অস্ত্রশিক্ষা শুরু হলো। কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠা দিয়ে পরশুরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হলো কর্ণ। তার সেবামাধুর্যে এবং শ্রদ্ধায় পরম তৃপ্তি লাভ করলেন পরশুরাম। চোখা চোখা সকল বাণ কর্ণের হাতে তুলে দিলেন তিনি। 

এসবের অনেকটাই কর্ণের পূর্ব-অধিগত। কিন্তু পরশুরামের সম্মুখে কর্ণ এমন কৃতজ্ঞের অভিনয় করে গেল, এ অস্ত্র যেন তার নতুন করে পাওয়া। এই অভিনয় সে অতি দক্ষতার সঙ্গেই করল। গুরুর প্রতি যে সে সবিশেষ অনুরাগী, সেটা তাকে প্রমাণ করতেই হবে। গুরুর তৃপ্তিতে তার ব্রহ্মাস্ত্র পাওয়ার পথটি কুসুমাস্তীর্ণ হবে। 

শেষ পর্যন্ত পরশুরামের মন সন্তুষ্টিতে ভরে গেল। একদিন কর্ণের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দিলেন পরশুরাম। শিখিয়ে দিলেন এই মারণাস্ত্রের গ্রহণ, ধারণ এবং সংবরণের সমস্ত কৌশল। 

শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া তখনো চলছিল। প্রক্রিয়া চলাকালীন এক বিকেলে সেই দুর্ঘটনাটি ঘটে গেল। এই ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণের প্রকৃত পরিচয় উদ্‌ঘটিত হলো গুরুদেব পরশুরামের কাছে। 

সেদিন উপবাসে ছিলেন পরশুরাম। ক্লিষ্ট দেহ। ক্লান্ত পরশুরাম শিষ্য কর্ণের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। এই সময় একটি কাঁকড়াবিছে কর্ণের ঊরু ভেদ করে রক্ত খেতে লাগল। নড়াচড়া করলে গুরুর ঘুমের ব্যাঘাত হবে—এই আশঙ্কায় কর্ণ এতটুকু নড়ল না। কিন্তু কর্ণের ঊরু চুঁইয়ে-পড়া রক্ত পরশুরামের গায়ে লাগল। তিনি জেগে গেলেন। তিনি দেখলেন—নিষ্কম্প প্রদীপের মতো কর্ণ স্থির হয়ে বসে আছে। অসহ্য ব্যথা নিজে সহ্য করেছে, কিন্তু গুরুর নিদ্রায় বিন্দুমাত্র বিঘ্ন সৃষ্টি করে নি। 

পরশুরামের মনে হঠাৎ সন্দেহের উদ্রেক হলো—এই অসহনীয় ব্যথা কর্ণ সহ্য করল কী করে? একজন ব্রাহ্মণের পক্ষে এরকম কষ্টসহিষ্ণু হওয়া সম্ভব নয়। ব্রাহ্মণরা যেরকম ক্রোধপরায়ণ, তাদের পক্ষে কাঁকড়াবিছের কামড় মেনে নেওয়া অসম্ভব। হয় ওরা পোকাটিকে পিষে মারত, না হয় গোটা বিছে জাতটাকেই ধ্বংসের অভিশাপ দিত। এ দুটোর কোনোটাই করল না কর্ণ। 

তাহলে, তাহলে কি সে ব্রাহ্মণ নয়? সন্দেহ ধূম্রজাল পাকাল পরশুরামের মনে। সন্দেহতাড়িত পরশুরাম কর্ণকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে? কে তুমি? 

কর্ণ কোনো উত্তর দিল না। বিভ্রান্ত চোখে গুরুদেবের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকল।

পরশুরাম জোরগলায় আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি পরিষ্কার করে বলো, কে তুমি?’

এবার কর্ণ বলল, ‘আমি কর্ণ। আমার বড় পরিচয় আমি মহাত্মা পরশুরামের অস্ত্রশিষ্য।’ 

‘তা বুঝলাম। তুমি নিজেকে ভার্গব ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়েছ। আমার সন্দেহ হচ্ছে—তুমি ব্রাহ্মণ নও। 

এবার বিনীতভাবে কর্ণ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার এরকম সন্দেহের কারণ কী গুরুদেব?’ 

আস্থার কণ্ঠে পরশুরাম বলে উঠলেন, ‘ব্রাহ্মণের সহ্যশক্তি কতটুকু তা আমার ভালো করেই জানা। কীটের কামড় সহ্য করার মতো ধৈর্য ব্রাহ্মণের নেই। এরকম সহ্যশক্তি শুধু ক্ষত্রিয়েরই আছে। অতএব বলো তুমি কে? কী তোমার প্রকৃত পরিচয়? 

এবার কর্ণ আর লুকোচুরিতে গেল না। নিজের প্রকৃত পরিচয় জানিয়ে বলল, ‘আমি এমন দম্পতির ঘরে জন্মেছি, যাদের একজন ব্রাহ্মণ, অন্যজন ক্ষত্রিয়। 

‘মানে!’ চোখ বড় বড় করে বললেন পরশুরাম। 

কর্ণ পরশুরামকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বলল, ‘হ্যাঁ মহাত্মা, আমার মা ব্রাহ্মণকন্যা। বাবা ক্ষত্রিয়। মায়ের নাম রাধা। লোকে আমাকে রাধেয় কর্ণ বলে ডাকে।’ 

পিতার পরিচয়ে নিজের পরিচয় দিল না কর্ণ, বলল না–আমি অধিরথ পুত্র। মায়ের পরিচয়ে নিজের পরিচয় দিল এই ভেবে যে, পিতার পরিচয় যা-ই হোক, মা তো ব্রাহ্মণকন্যা। সুতরাং আমার জাত-পরিচয়ের হীনতা কোথায়? ব্রাহ্মণকন্যা রাধার একটা সামাজিক উচ্চতা আছে, সেই উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল কর্ণ, গুরু পরশুরামের সামনে। তাই সে জোরগলায় নিজেকে রাধেয় কর্ণ বলে পরিচয় দিতে দ্বিধান্বিত হলো না। 

কর্ণের কথা শুনে পরশুরাম ভেতরের ক্রোধকে বাইরে টেনে আনলেন না। জ্বলন্ত লাভাসম ক্রোধকে নিজের মধ্যে চেপে রেখে কর্ণের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলেন। 

মিথ্যে বলার ভীতিটা তখন কর্ণের কেটে গেছে। সত্যকে লুকিয়ে রেখে মিথ্যের অভিনয় করে যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে সে এখন মুক্ত। খাঁচায় বন্দি পাখিটি মুক্তাকাশে উড়াল দেওয়ার সুযোগ পেলে যেমন করে উল্লসিত হয়ে ওঠে, কর্ণেরও সেরকম অবস্থা এখন। তার মাথায় এখন মিথ্যের বোঝা নেই, হৃদয়ে নেই অসত্যের জগদ্দল পাথরের চাপ। 

ভীতিহীন চোখে স্পষ্ট গলায় সে আবার বলল, ‘আমি অস্ত্রলুব্ধ হয়েই আপনার কাছে এসেছিলাম। এই সত্যটুকু শুনে, আমার বিশ্বাস, আপনি প্রসন্ন হবেন।’ 

তার পর জোরে শ্বাস টেনে বুকে প্রচুর বাতাস ঢুকিয়ে নিল কর্ণ। এই বাতাসটুকু হয়তো তাকে আরও সাহসী করে তুলল। সাহসী গলাতেই সে বলল, ‘যে প্রশ্নটি আমাকে আপনি করেন নি, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই আমি। আপনার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করছি গুরুদেব।’ 

পরশুরাম মুখে কিছু বললেন না। আগের মতো তাকিয়ে থাকলেন কর্ণের দিকে।

কর্ণ বলল, ‘আমি হস্তিনাপুর থেকে এসেছি, আগেই বলেছি আপনাকে। হস্তিনাপুরে আচার্য দ্রোণের বসবাস। ওখানে অস্ত্রপাঠশালা আছে তাঁর। তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ না করে আপনার কাছে কেন এসেছি এরকম প্রশ্ন আপনার মনে জাগতে পারে। আচার্য দ্রোণ আপনার প্রিয় শিষ্য, খ্যাতিমান অস্ত্রবিদ্। তাঁর কাছে আমার অস্ত্রবিদ্যাভ্যাস করাই তো স্বাভাবিক ছিল।’ 

এবার কথা বললেন পরশুরাম, ‘তাই তো। এই প্রশ্নটি তো আগে ভাবি নি।’ 

‘আপনাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আচার্য দ্রোণের পাঠশালার ছাত্র ছিলাম আমি। কুরু রাজপ্রাসাদের চাপে পড়ে হোক বা অনুরাগের বশে, তিনি আমাকে শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করিয়েছিলেন তাঁর অস্ত্রপাঠশালায়। প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াও চলছিল যথানিয়মে। আচার্যের মধ্যে সন্তানবাৎসল্যের আধিক্য। আপনি তো জানেন, স্নেহ মানুষকে অন্ধ করে। বাৎসল্যাধিক্যের কারণে তিনি অশ্বত্থামার প্রতি পক্ষপাতিত্ব শুরু করলেন। এটা স্বাভাবিক। আচার্য তো একজন রক্তমাংসের মানুষ। তাঁর মধ্যে সন্তানস্নেহ থাকা অতিশয় যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু অর্জুনের প্রতি তাঁর অহেতুক পক্ষপাতিত্ব আমার ভালো লাগে নি।’ 

‘অহেতুক পক্ষপাতিত্ব? অর্জুনের প্রতি যুক্তিহীন পক্ষপাতিত্ব দেখাবে কেন দ্রোণ? গুরুর কাছে সব শিষ্যই তো সমান। একজন গুরুর কর্তব্য তো সকল ছাত্রকে সমান মর্যাদায় শিক্ষা দান করা।’ 

‘না মহাত্মা, দ্রোণাচার্য তাঁর সকল ছাত্রকে সমান মর্যাদায় অস্ত্রশিক্ষা দেন নি। পুত্র ছাড়াও অর্জুনের প্রতি তিনি গভীর পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। অন্য শিষ্যদের যে বিদ্যা শিখান নি, অর্জুনকে তা শিখিয়েছেন। সবচাইতে আপত্তির কথা—তিনি অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্র দান করেছেন।’ 

‘একজন গুরু তাঁর যে-কোনো প্রিয় শিষ্যকে ব্রহ্মাস্ত্র দিতে পারেন।’ 

‘আপনার কথা মানলাম আচার্য। কিন্তু সমান মেধার অন্য কাউকে তিনি যদি বঞ্চিত করেন, তবে সেই শিষ্যের রাগ বা অভিমান করার অধিকার আছে কি না?’ এবার উল্টো পরশুরামকে প্রশ্ন করে বসল কর্ণ। 

পরশুরাম বললেন, ‘শিষ্যটি যদি মেধাবান হয়, যদি শ্রদ্ধাশীল হয়, যদি কষ্টসহিষ্ণু হয়, যদি অধ্যবসায়ী হয়, তাহলে তো তাঁরও এই মারণাস্ত্রটি পাওয়ার অধিকার থাকে। 

‘সেই অধিকার থেকে দ্রোণাচার্য আমাকে বঞ্চিত করেছেন। একজন উপযুক্ত শিষ্যের যে যে গুণের কথা আপনি বললেন, তার সবটুকু যে আমার মধ্যে আছে, এই ক’বছরের প্রশিক্ষণে তা আপনি অনুধাবন করতে পেরেছেন।’ 

পরশুরাম বললেন, ‘অস্বীকার করবার উপায় নেই, তুমি গুণান্বিত।’ 

‘তার পরও হীনজাতে জন্ম বলে আচার্য দ্রোণ আমাকে ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা দান করেন নি। দান করলেন নিজপুত্র অশ্বত্থামাকে আর ক্ষত্রিয়জ অর্জুনকে। সূতপুত্র বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন তিনি আমাকে। বললেন, নিম্নবর্ণজাত কেউ ব্রহ্মাস্ত্র প্রাপ্তির অধিকার রাখে না।’ ক্ষোভের সঙ্গে বলল কৰ্ণ। 

ফাঁপরে পড়ে গেলেন পরশুরাম। একদিকে জাত্যাভিমান, অন্যদিকে কর্ণের যুক্তি কোনটাকে গ্রাহ্য করবেন তিনি? যুক্তিকে মেনে নিলে তাঁর বহুদিনের লালিত জাত্যাভিমান ভেসে যায়। তাতে সমাজকাঠামো, বৈদিক রীতিনীতির সমাধি ঘটবে। তিনি একজন ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের হাত দিয়ে তো ব্রাহ্মণ্যবাদের চ্যুতি ঘটতে পারে না। 

ভাবতে ভাবতে পরশুরামের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবোধ প্রবল হয়ে উঠল। কণ্ঠকিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘দ্রোণ কী পরিস্থিতিতে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তা সে-ই ভালো বলতে পারবে। তবে তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস কোরো—দ্রোণ সঠিক কাজ করেছে কী বেঠিক করেছে, আমি বলব, ব্রাহ্মণ হয়ে সে যথার্থ কাজই করেছে। মানে অক্ষত্রিয়- অব্রাহ্মণ তোমাকে ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যা না দিয়ে দ্রোণ যথার্থ কাজটিই করেছে।’ 

‘আর এইজন্যই মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছি। একজন ছাত্রের মধ্যে যদি উদগ্র উচ্চাশা থাকে, যদি সে মেধাবান আর অধ্যবসায়ী হয়, শুধু তথাকথিত হীনবংশে জন্ম বলে তার উচ্চাশার পূরণ হবে না কেন? যদি তা-ই হয়, আচার্য দ্রোণ ব্রাহ্মণ হয়ে জাতিগত পেশা ত্যাগ করে ধনুর্বিদ হলেন কেন?’ 

‘একজন ব্রাহ্মণের পেশা বদলের অধিকার আছে। ইচ্ছে করলে সমরক্ষেত্রে যুদ্ধও সে করতে পারবে।’ 

‘মানে যত কঠোর কঠিন সামাজিক শৃঙ্খল শুধু আমাদের জন্য। শূদ্র আর বৈশ্যের ঘরে জন্মায় যারা, তাদের উন্নততর জীবনযাপনের কোনো অধিকারকে অনুমোদন করে নি আপনাদের শাস্ত্রাদি!’ 

যে ছাত্রটি অধোবদনে সর্বদা তাঁর প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, মাহেন্দ্র বিদ্যালয়ের বৈদিক রীতিনীতি যে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়ে দীর্ঘদিন অস্ত্রবিদ্যা চর্চা করে গেছে, সেই কর্ণ আজ কী বলছে! এই শান্ত যুবকটির হৃদয়ে এত প্রতিবাদ, এত বেদনা জমা হয়ে ছিল! 

মৃদু কণ্ঠে পরশুরাম বললেন, ‘বহু বছরের প্রচলিত শাস্ত্রপ্রথা ভাঙার অধিকার তো আমার নেই। মেনে নিলাম-ব্রহ্মাস্ত্রবিদ্যার্জনের প্রবল বাসনা তোমার মধ্যে ছিল, ছাত্র হিসেবে তা পাওয়ার অধিকারও তুমি দাবি করতে পারো, কিন্তু সমাজবিধি বলে একটা কথা আছে।’ 

গুরুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কর্ণ বলে উঠল, ‘মানে যতই নিষ্ঠাবান বা মেধাবী আমি হই না কেন, শুধু অকুলীন বংশে জন্ম বলে ওই অস্ত্র পাওয়ার অধিকার আমার নেই। এই তো বলতে চাইছেন আচার্য?’ 

পরশুরাম বললেন, ‘তুমি যথার্থ বুঝতে পেরেছ বৎস।’ 

‘আর এই জন্যই আমার জন্মপরিচয় লুকিয়ে ভার্গব ব্রাহ্মণ বলে নিজের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আপনার শিষ্য হয়েছি। আপনি দয়াপরবশ হয়ে আমাকে নিপুণ অস্ত্রবিদে পরিণত করেছেন। শুধু তাই নয়, ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ-সংবরণের কৌশলও আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন।’ 

‘মিথ্যে বলার অপরাধের জন্য তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে।’ পরশুরামের মধ্যে ব্রাহ্মণ্যচিন্তা হঠাৎ চাগিয়ে উঠল। 

ত্রস্ত গলায় কর্ণ জিজ্ঞেস করল, ‘শাস্তি পেতে হবে আমায়?’ 

‘শাস্তি নয়, অভিশপ্ত হতে হবে তোমায়।’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এবার বললেন পরশুরাম।

বিহ্বল চোখে কর্ণ বলল, ‘অভিশপ্ত হতে হবে! আমি তো জাতবর্ণ-বিন্যাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজের বোধবুদ্ধি আর কৌশলকে প্রয়োগ করতে চেয়েছি মাত্র।’ 

‘মিথ্যে তো বলেছ। মিথ্যে বলার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।’ রোষ কষায়িত চোখে পরশুরাম বললেন। 

কর্ণের মুখে আর কোনো কথা সরল না। ভীতিময় চোখে গুরু পরশুরামের দিকে তাকিয়ে থাকল। 

এই সময় পরশুরাম আবার বলে উঠলেন, ‘মিথ্যে পরিচয় দিয়ে বিদ্যার্জন করার অপরাধে তোমাকে আমি কঠিন দণ্ড দিতে পারতাম। কিন্তু তোমার নিষ্ঠা দেখে আমি তুষ্ট হয়েছি। তাই তোমাকে আমি লঘুদণ্ড দিচ্ছি।’ 

এর পর ক্রোধ পরশুরামকে উন্মত্ত করল। তিনি ক্রোধান্বিত গলায় বললেন, ‘শুধু অস্ত্রপ্রাপ্তির লোভে তুই আমার সঙ্গে মিথ্যে আচরণ করেছিস, আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি-সংকটমুহূর্তে যখন তোর বিনাশকাল ঘনিয়ে আসবে, ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগকৌশল তুই বিস্মৃত হবি। ভুলে যাবি তুই এই অস্ত্রের নিক্ষেপণ প্রক্রিয়া।’ বলে পরশুরাম নিজের ক্রোধকে সংবরণের চেষ্টায় রত হলেন। 

পরশুরামের পা জড়িয়ে ধরে কর্ণ বলল, ‘আচার্য, আপনার ক্রোধ সংবরণ করুন। আমার অপরাধ মার্জনা করুন।’ 

পরশুরাম স্থিতধী হয়ে ধীরে ধীরে বললেন, ‘তবে হ্যাঁ, তোমাকে এই আশীর্বাদটুকু দিচ্ছি, যুদ্ধকালে তোমার সঙ্গে কোনো ক্ষত্রিয়পুরুষ এঁটে উঠবে না।’ এই বলে তিনি মৌন হলেন। 

গুরু পরশুরামের শেষ আশ্বাস বাক্যটিকে সম্বল করে কর্ণ হস্তিনাপুরে ফিরে এল। ফিরে সুহৃদ দুর্যোধনের সঙ্গে দেখা করল। প্রাসাদ-অভ্যন্তরে কয়েকদিন বিশ্রাম নিল। এবং যথাদিনে রঙ্গভূমিতে উপস্থিত হয়ে অর্জুনের মুখোমুখি হলো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *