একলব্য – ১০

১০

হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য নাম।
দ্রোণের চরণে আসি করিল প্রণাম। 

.

ঊষাকালে যাত্রা শুরু করেছে একলব্য। 

ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড়টি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে সে। বাতাসে শীতের ছোঁয়া। উত্তুরে বাতাস হিমালয় থেকে শৈত্য নিয়ে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সমতলে শীত জাঁকিয়ে না নামলেও পাহাড়ি অঞ্চলে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তবে শীতের প্রকোপ তেমন নয়। শুধু প্রত্যুষে এর অস্তিত্ব ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। 

একলব্য বসনভূষণত্যাগী তরুণ। সে একাগ্রচিত্ত। সে গন্তব্যগমনে স্থিরমনস্ক। ফলে অনেকটা বাহ্যজ্ঞানশূন্য সে। তাই শৈত্য বা গরমের প্রকটতা তাকে তেমন করে কাহিল করতে পারছে না। সাধারণ একটা বসনে গা ঢেকে সে এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে, হস্তিনাপুরলগ্ন দ্রোণাচার্যের অস্ত্রাশ্রমের দিকে। ঋষি জৈমিনীর আশ্রমের কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়েছে একলব্য। সে যখন রওনা দিয়েছে, আশ্রমের কেউ জাগে নি তখনো। 

মহর্ষি জৈমিনীর কাছ থেকে গতরাতেই বিদায় নিয়ে রেখেছিল একলব্য। বলেছিল, ‘মহাত্মন, খুব ভোরে যাত্রা শুরু করব আমি। সূর্যদেব তেজোময় হয়ে উঠার আগে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে চাই। আপনার কাছে যাত্রার আগাম অনুমতি প্রার্থনা করছি। যাওয়ার সময় আপনাকে আর বিরক্ত করব না আমি।’ বলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিল একলব্য। 

মহর্ষি জৈমিনী গত ক’দিনে একলব্যকে দেখে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। উনিশ-বিশ বছরের এক নিষাদপুত্রের মধ্যে কী গভীর সুবিবেচনা! কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব নেই তার মধ্যে। নিজ গোত্রের মানুষদের সে যেভাবে বশীভূত করেছে, তা সত্যি প্রশংসার। সেখানেই থেমে যায় নি একলব্য। নিষাদদের দিয়ে তাঁর তপাশ্রম পুনর্নির্মাণ করিয়ে নিয়েছে। রাজপুত্র সে। কিন্তু কোনো অহংকার নেই তার। মহর্ষি তো অনেক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র দেখেছেন। তাদের ঐশ্বর্যপ্রীতি, তাদের অহংবোধ বারবার বিরক্ত করেছে তাঁকে। একলব্যও নিষাদ রাজপুত্র। অথচ সে যেন বিনয়ের অবতার, যেন নিরহংকারের জ্বলন্ত উদাহরণ। 

একলব্যের যাত্রার অনুমতি প্রার্থনার উত্তরে ঋষি জৈমিনী বলেছিলেন, ‘তোমার যাত্রা শুভ হোক বস। তোমার মনস্কামনা পূৰ্ণ হোক।’ 

একলব্য হাঁটছিল আর দেখছিল। অরণ্যসন্তান সে। বয়সও তার বিশের কাছাকাছি। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে রাজপ্রাসাদের চেয়ে অরণ্যভূমি তার ভালো লাগত। ঘুরে ঘুরে বৃক্ষ-লতা-গুল্ম দেখত। গাছেদের বেড়ে ওঠা, তাদের ফল-ফুল-বীজ—এসবকে গভীর অভিনিবেশে লক্ষ করত একলব্য। পাখি-প্রজাপতির উড়াউড়ি, তাদের ফলে-ফুলে ঘুরে বেড়ানো তীক্ষ্ণ চোখে দেখে যেত সে। আর দেখত পিঁপড়েদের। কত রকমের যে পিঁপড়ে। কেউ দল বেঁধে, কেউ একা একা পথ ফুরাত পিঁপড়েরা। তাদের আকার আর গায়ের রঙও ভিন্ন ভিন্ন। কেউ ছোট, কেউ মাঝারি, কেউবা ঢাউস। কোনোটা লালমুখো, কিছু আবার কুচকুচে কালো। 

আজ অরণ্যের মধ্যদিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার কালো পিঁপড়েদের কথা খুব করে মনে পড়ল। আরে, পিঁপড়েরা যেমন কালো-ধলো, মানুষরাও তো তেমনি! আর্যরা কী ফর্সা! দীর্ঘ নাসা তাদের, কাঁধ ঝুলানো লালচে চুল! নীল চোখো আর্যরা এক একজন দিব্যপুরুষ যেন। দীর্ঘদেহী সবাই। আর নিষাদরা! আর্যদের বিপরীত তাদের গায়ের রং, দৈহিক গঠনও। 

আচ্ছা, আমাদের নাম নিষাদ হলো কেন? জিজ্ঞেস করেছিল একদিন পিতামহ অনোমদর্শীকে। অনোমদর্শী বলেছিলেন-’তাহলে একটা গল্প শোন। এ গল্প আমার বানানো নয়। আর্যদের পুরাণেই এই কাহিনি আছে। গল্প শোনার আগের গল্পটি শুনে রাখো একলব্য। যে আর্যরা আজ আমাদের ঘৃণা করছে, অস্বীকার করছে আমাদের জাতিত্ব, মুছে দিতে চাইছে নিষাদগোষ্ঠীর অস্তিত্ব এই পৃথিবী থেকে, সেই আর্যদের প্রাচীন সংহিতাগ্রন্থে মর্যাদার সঙ্গে আমাদের উল্লেখ আছে। ওই যে তৈত্তিরীয় সংহিতা, কাঠক সংহিতা, মৈত্রায়ণী সংহিতা অথবা বাজসনেয়ী সংহিতা—এগুলোর সবটাতে নিষাদগোষ্ঠীর নাম বারবার সম্মানের সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। আর রামায়ণ; যে রামায়ণের কথা বারবার তোমাকে বলি, সেই রামায়ণেও তুমি নিষাদদের কথা পাবে।’

‘দাদু, গল্প। কী একটা গল্প শুনাবেন বলেছিলেন।’ একলব্য পিতামহকে মনে করিয়ে দেয়। 

‘আমাদের নাম কেন নিষাদ হলো, সেই কাহিনি শোনাতে চেয়েছি তোমাকে।’ খেই ধরিয়ে দেওয়া নাতির উদ্দেশে বললেন অনোমদর্শী। 

‘কেন নিষাদ হলো আমাদের নাম? অন্যকিছু হলো না কেন?’ গল্পানুরাগী কণ্ঠ একলব্যের। 

‘এটা নিয়েও আর্যদের মানে বামুনদের গল্প বানানোর শেষ নেই।’ তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন অনোমদর্শী। যেন নাতিকে কাহিনিটা কীভাবে শোনাবেন সেটা গুছিয়ে নিলেন মনের ভেতর অথবা এই কাহিনিতে ব্যাধদের প্রতি যে গভীর তুচ্ছতা আছে, তার জন্য তাঁর মধ্যে যে মর্মযাতনা, তা সংহত করে নিলেন নিজের মধ্যে। 

চিন্তা করতে দাদু যে সময়টুকু নিলেন, তার জন্য উতলা হলো না একলব্য। একাগ্রমনে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। 

অনোমদর্শী বললেন, ‘নিষীদ শব্দ থেকে নিষাদ কথাটি এসেছে। নিষীদ মানে বসে থাকো। 

এবার অবাক গলায় একলব্য জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের সঙ্গে বসে থাকার সম্পর্ক কী? আমরা তো বরং ছোটাছুটিই করি। এই যেমন জীবন নির্বাহের জন্য বনের পশুপাখি নিধন করে নিষাদরা। পশুপাখিরা তো ব্যাধদের হাতে আর এমনি এমনি ধরা দেয় না। ধরতে বা মারতে ওদের পেছনে তো কত দৌড়াদৌড়ি করতে হয় নিষাদদের। তাহলে নিষাদরা বসে থাকল কোথায়? 

নাতির এই সহজ-সরল কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন অনোমদর্শী। দাদুর উচ্চহাস্য শুনে একলব্য একটু বিব্রত হলো। সে ভেবে পাচ্ছে না তার কথার মধ্যে এমন কী রম্যতা আছে যে, দাদু উচ্চহাস্যে গড়িয়ে পড়লেন। 

এই সময় অনোমদর্শী বলে উঠলেন, ‘আরে দাদু, এই বসে থাকা মানে সেই বসে থাকা নয়। এই বসে থাকার অন্য একটা মানে আছে।’ 

‘কী মানে?’ আবার সহজ-সরল প্রশ্ন একলব্যের। 

‘পৃথিবীর প্রথম রাজা ছিলেন বেণ। বেণের পিতার নাম অঙ্গ। অঙ্গ বিয়ে করেন মৃত্যুর অধিপতি যমের কন্যা সুনীথাকে। এই সুনীথার গর্ভেই জন্মায় বেণ। বেণ যখন উপযুক্ত হলেন, ঋষিরা তাঁকে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করলেন। কিন্তু বেণ সুশাসক ছিলেন না। অনেক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় তিনি প্রচণ্ড অত্যাচারী হয়ে উঠলেন। ধীরে ধীরে বললেন অনোমদর্শী। 

একলব্য বলে উঠল, ‘কেন, কেন দাদু? পৃথিবীর প্রথম রাজা তিনি! পুরো ব্যাপারটা কত সম্মানের! তাঁর তো সুশাসক হওয়ারই কথা!’ 

‘ওই যে কথায় বলে—ক্ষমতা মানুষকে মহৎ যেমন করে আবার নীচও করে। ক্ষমতা বেণকে দ্বিতীয়টাই করেছিল। যত বেশি ক্ষমতাবান হলেন বেণ, তত বেশি নীচতা আর হীনতায় ভরে গেল তাঁর মন। রাজা হওয়ার পর তিনি আদেশ দিলেন তাঁর রাজ্যে কোনো দেবদেবীর পুজো করা চলবে না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঈশ্বর বলে কেউ নেই। ঈশ্বর যদি মানতেই হয়, তাহলে আমাকেই ভগবান বলে মানবে। পুজো দেবে আমার উদ্দেশে। রাজা মানে ঈশ্বর। তাই তোমরা পুজো-অর্চনা যা কিছু কোরো, আমার মূর্তির সামনেই করবে। অন্য কোনো দেবদেবীর সামনে নয়।’ 

‘তার পর দাদু?’ 

‘তার পর রাজ্যের সবাই ক্ষেপে গেল। একজোট হয়ে আক্রমণ করল রাজাকে। রাজা নিহত হলেন।’ অনোমদর্শী বললেন। 

খুব চিন্তিত মুখে একলব্য জিজ্ঞেস করল, ‘রাজা বেণের কোনো সন্তান ছিলেন না?’

‘সেখানেই তো গল্পের মূল রহস্য। নিহত হওয়ার আগে আগে বেণ দু’জন পুত্রসন্তানের জনক হলেন। একজন খর্বমুখ এবং হ্রস্বকায়। অন্যজন অপূর্ব সুন্দর। দীর্ঘদেহী এই পুত্রের চেহারা বড়ই মনোহর। দ্বিতীয় জনের নাম পৃথ্বী, মানে পৃথিবী। প্রথমজনের নাম কী জানো?’ 

একলব্য ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’ 

‘প্রথম পুত্রের নাম নিষীদ। মানে বসে থাকো। বসেই থাকতে বলা হলো প্রথম পুত্রকে। বলা হলো—অধার্মিক বেণের পাপের অংশ তুমি। এই রাজ্যে তোমার কিছুই করার নেই। তোমার এক স্থানে বসে থাকা কর্তব্য। নড়াচড়া কোরো না তুমি।’ 

‘আর দ্বিতীয় সন্তান?’ 

‘পৃথ্বীর চেহারা তো অতি মনোহর। গায়ের রঙও স্বর্গীয়। সুতরাং পৃথ্বী কখনো বেণের পাপাংশজাত নয়—বললেন ঋষিরা। তাঁরা পৃথ্বীর পক্ষে আরও মজার যুক্তি দিলেন। বললেন, নিষীদের জন্মের পর বেণের পাপ ক্ষয় হয়ে গেছে। সুতরাং বেণের পাপবিহীন শরীর থেকে জাতপুত্র পৃথ্বী নিষ্পাপ। তাই তাঁকে এই পৃথিবীর রাজা বানানো হোক। এবং তাই করলেন ঋষিরা। ঋষিরা যাঁকে সমর্থন করলেন, প্রজারাও তাঁকে মেনে নিলেন।’ বললেন অনোমদর্শী। 

‘আর নিষীদের কী অবস্থা হলো?’ গভীর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল একলব্য। 

অনোমদর্শী বললেন-আর কী হবে! বসিয়েই রাখা হলো তাঁকে। তাঁকে সম্মান দেওয়া হলো না। বড়ভাই হওয়া সত্ত্বেও রাজত্ব দেওয়া হলো না। তাঁকে বলা হলো— পৃথ্বীর রাজধানীতে তুমি থাকতে পারবে না। আমি কোথায় যাব—অসহায় চোখে জিজ্ঞেস করলেন নিষীদ। ঋষিরা করুণায় বিগলিত হয়ে বললেন–আহা! তোমাকে তো আমরা আর ফেলে দিতে পারি না। হাজার হলেও এই ভারতবর্ষের প্রথম রাজা বেণের জ্যেষ্ঠপুত্র আর আমাদের বর্তমান নৃপতি পৃথ্বীর ভাই তো তুমি। তুমি খর্বাকৃতি। মুখটা তোমার মানুষের মতো নয়, কেমন জানি বুনো বুনো। আর তোমার গায়ের রং তো তুমি দেখছই। তা তুমিই বলো এই রকম বিদ্‌ঘুটে চেহারা নিয়ে তোমার রাজপ্রাসাদে এমনকি রাজধানীতেও থাকা উচিত কি না? 

নিষীদকে উত্তরের সুযোগ না দিয়ে ঋষিরা ত্বরিত বলে উঠলেন—থাকা উচিত নয়। এই তো বলবে তুমি। কী আশ্চর্য, দেখো তো তোমার ভাবনার সঙ্গে আমাদের ভাবনাটা কী অদ্ভুতভাবে মিলে গেল! তারপর ঋষিপ্রধান টিকলিতে তাঁর ডান হাতের তালুটা আলতো করে বুলিয়ে বললেন-সবচাইতে মঙ্গল হয় এই প্রাসাদ ছেড়ে, এই রাজধানী ছেড়ে তুমি অন্যত্র চলে গেলে। কোথায় যাব আমি? কোন অজানা জায়গায় যাব আমি পিতৃরাজ্য ছেড়ে—বিষণ্ণ চোখে জিজ্ঞেস করেছিলেন নিষীদ। ঋষিপ্রধান বলেছিলেন— আরে, তুমি এত বিষণ্ণ হচ্ছ কেন? তোমার মঙ্গলামঙ্গলের কথা কি আমরা ভাবি না! অবশ্যই ভাবি। ভাবি বলেই তোমার গন্তব্য ঠিক করে রেখেছি আমরা। 

গন্তব্য! অসহায় নিষীদ বলেছিলেন। হ্যাঁ, গন্তব্য। এখন থেকে তুমি থাকবে ওইখানে। দিগন্তের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলেছিলেন ঋষিপ্রধান। ওই যে দেখছ বিন্ধ্যপর্বতের শৈলভূমি। ওখানেই থাকবে তুমি। ওটা তো রাজধানীর বাইরে অরণ্যময় শ্বাপদসংকুল জায়গা, ওখানে জীবন কাটাব কী করে আমি! আমরা নিরুপায়। তোমার মতো হীন চেহারার একজন মানুষ এই রাজধানীতে থাকতে পারবে না। এই রাজ্যের প্রতি আমাদের একটা ইতিকর্তব্য আছে। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই বলছি-তোমাকে এই রাজ্যে থাকতে দিতে পারি না আমরা। তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। 

নিষীদ বললেন, আপনার প্রথমে বললেন রাজধানীতে থাকতে পারব না, এখন বলছেন দেশেই থাকতে পারব না। আরে বেটা, মুখে মুখে এত তর্ক করছ কেন? প্রাণে তো মারছি না তোমাকে। তোমার বাবাকে যেমন করে নিধন করেছি। তেমন করে তো তোমাকে হত্যা করছি না আমরা। বাঁচিয়ে তো রাখছি। এজন্য তোমার তো আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বলো, উচিত কি-না? ঋষিদের মারমুখী চেহারা দেখে নিষীদ বলেছিলেন—উচিত। তাহলে কালই তুমি দেশত্যাগ করবে। চলে যাবে বিন্ধ্যপর্বতের শৈলভূমিতে। আর হ্যাঁ, ওখানেই মানাবে ভালো তোমাকে। 

শেষে অনোমদর্শী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে এই নিষীদ জানো একলব্য?’ 

একলব্য এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল। দাদুর মুখে নিজের নাম শুনে সংবিতে ফিরল একলব্য। মুখে বলল, ‘জানি না। এই নিষীদের ভিন্ন কোনো পরিচয় আছে নাকি দাদু?’

কোনো ভূমিকা না করে অনোমদর্শী বললেন, ‘এই নিষীদ আমাদের পূর্বপুরুষ। তাঁর নিষীদ নাম থেকে নিষাদগোষ্ঠীর সৃষ্টি। আমাদের প্রণম্য তিনি।’ বলে কপালে হাত ঠেকিয়েছিলেন দাদু। 

হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল একলব্য। তার কথা শুনে দাদু যেমন করে সেদিন হেসে উঠেছিলেন। হস্তিনাপুরের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই হেসে উঠল একলব্য। এই নিষীদই তাহলে তাদের পূর্বপুরুষ। খর্বাকৃতি, অসুন্দর চেহারার মানুষটির মাধ্যমেই তাহলে নিষাদগোষ্ঠীর সূচনা হয়েছে এই পৃথিবীতে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে একলব্য— সেই ফর্সা চেহারার পৃথ্বী বা আর্যরা, ঋষিরা এটা কি কখনো ভেবেছেন নিষাদ নামের জনগোষ্ঠী মানবসভ্যতার সমবয়সী? যতই হেলা-অবহেলা দেখান না কেন আর্যরা, এটা তো আজ সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, নিষাদদের অস্তিত্ব অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই। আর্যদের মতো তারাও ভারতবর্ষের নানা অংশে রাজত্ব করছে। ওদের মতো তাদেরও শিক্ষা-সংস্কৃতি আছে। ভাববার জন্য উন্নত মস্তিষ্ক আছে, ভালোবাসবার জন্য হৃদয় আছে, যুদ্ধ করার জন্য দৈহিক বল আছে। কঠিন সমরে অস্ত্রধারণের দক্ষতা আছে তাদের। হ্যাঁ, হয়তো ওদের মতো অস্ত্রকৌশল এখনো তাদের জানা হয়ে ওঠে নি। সেই ঘাটতি পূরণের জন্যই তো সে দ্রোণাচার্যের কাছে যাচ্ছে। তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা পেলে নিষাদগোষ্ঠীর অনেক খামতি মিটিয়ে দিতে পারবে সে। আর্যদের মতো নিষাদদেরও নাম খ্যাতকীর্তি ধনুর্ধরের নামের তালিকায় লিপিবদ্ধ হবে। 

.

‘এই দেখো দেখো। কী অদ্ভুতুড়ে চেহারা না? একেবারে রাজপথের মধ্যিখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বর্বর বলেই মনে হচ্ছে।’ অপরিচিত কণ্ঠ শুনে একলব্যের ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল। 

কখন এবড়েখেবড়ো পাহাড়ি পথ শেষ হয়ে গেছে, কখন অরণ্য ছেড়ে বৃক্ষহীন সমতলভূমিতে চলে এসেছে, খেয়াল করে নি একলব্য। নিষীদের কথা ভাবতে ভাবতে, দাদুর গল্পকথা চিন্তা করতে করতে, সর্বোপরি কৌশলী অস্ত্রবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে এতটা বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এসেছে সে। তার পায়ের তলার মাটি কখন সমতল হয়ে গেছে, মাথার ওপর থেকে বৃক্ষের নিবিড় আচ্ছাদন কখন শেষ হয়ে গেছে, নারীকণ্ঠটি তার কানে না পৌঁছালে বুঝতেই পারত না একলব্য। 

কণ্ঠটি তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। প্রথমেই সে রাজপথের মধ্যখান থেকে কিনারায় সরে এল। রাজপথের মাঝখান দিয়ে যে হাঁটতে নেই—সেটা একলব্য সঠিকভাবেই জানে। ও যে রাজার ছেলে। নিষাদ রাজ্যের রাজধানীতেও রাজপথ আছে। শুধু রাজধানীতে কেন, রাজধানীলগ্ন স্থানগুলোতে ঝকঝকে সমতল রাজপথ আছে। ভাবনার ঘোরে আবৃত ছিল বলে রাজপথের মাঝখানে হাঁটার ভুলটা করে ফেলেছে সে। রাজপথ দিয়ে রাজা-রাজন্য-রাজপরিবারবর্গ যাতায়াত করবেন, সাধারণ মানুষ চলাচল করবে কিনারা ঘেঁষে—এই তো নিয়ম। রাজপুত্র হিসেবে একলব্যের এই প্রথা না জানার কথা নয়। নারীটির অভিযোগ শুনে দ্রুত নিজের চলার পথকে সংশোধন করে নিল। 

তারপর বক্তার দিকে তাকাল একলব্য। দেখল, দুজন নারী গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হেঁটে যাচ্ছে। মধ্যবয়সি তারা। বসনভূষণ দেখে অনুমান করা কঠিন নয় যে, ওরা নিম্নবিত্তের মানুষ। দু’জনের মাথাতেই ঝাঁকা। সেই ঝাঁকাতে ভারী কিছু। ঝাঁকার ভারে কুঁজো হয়ে হাঁটছে তারা। 

হ্যাঁ, তার চেহারা, পোশাক কিছুটা অদ্ভুতুড়ে তো বটেই। তার চেহারা কালো। মধ্যমাকৃতি তার। শারীরিক গঠন ক্ষত্রিয়দের মতো তো নয়ই। তা ছাড়া কত দিন আগে পথ হাঁটা শুরু করেছে সে! কত দিন হলো? তা তো ঠিকঠাক মনে নেই এখন। দশ দিন, বিশ দিন, এমনকি ত্রিশ দিনও হতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে দিনের হিসেব, রাতের গণনা ভুলে গেছে একলব্য। এই দীর্ঘদিনের পথচলাতে কত রকমের ধুলোবালি তার চেহারায় পড়েছে। কখনো স্নান করেছে, কোনো কোনো দিন জলাভাবে স্নানই করতে পারে নি। তার চেহারায় যে ঔজ্জ্বল্য ছিল, তা এখন আর নেই। ধূলিমলিন চেহারা এখন তার। তার সারা মুখমণ্ডলে বিষণ্নতাও যে নেই, এমন তো নয়। অনাহার, অর্ধাহার আর দীর্ঘদিন পাহাড়ি বন্ধুর পথচলার ক্লান্তি তার শরীর ঘিরে। 

মাঝেমধ্যে অবসাদ তাকে কাহিল করে নি, বললে ভুল হবে। গুরুদর্শন তার সুখকর হবে কি না—এই ভাবনায় একলব্য মাঝে মাঝে আকুল হয়েছে। এই আকুলতা তাকে অবসাদগ্রস্ত করেছে। কিন্তু একলব্য যে অন্য ধাতুতে গড়া। কোনো বিষণ্ণতা বা অবসাদ তাকে গ্রাস করতে পারে নি। মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে সে সব কিছুকে। কিন্তু মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলে কী হবে, দেহ থেকে তো ফেলে দিতে পারে নি। বিষণ্ণতা আর অবসাদ তার চোখেমুখে গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তাই তার চেহারা এই মুহূর্তে অদ্ভুতুড়ে হওয়া স্বাভাবিক। হয়েছেও তা-ই। তাই নারীটির কথায় রাগ করার কোনো কারণ নেই। 

কিন্তু ওরা বর্বর বলল কেন তাকে? বর্বর কথার মানে তো অসভ্য জাতি। অমার্জিত, অশিষ্ট, পশুত্বব্যঞ্জনাও তো বোঝায় শব্দটি দিয়ে। তাকে দেখে কি অমার্জিত মনে হচ্ছে? পশুর মতো লাগছে তাকে? তার চেহারায়, তার দেহসংগঠনে, তার চলনভঙ্গিতে অসভ্যতার কী চিহ্ন আছে? তার মুখমণ্ডল শ্মশ্রুমণ্ডিত। বিশ বছরের যুবকের মুখে পাতলা দাড়িগোঁফ। থাকতেই পারে। আর্যসমাজে শ্মশ্রু তো স্বীকৃত। মুনিঋষিরা দাড়িগোঁফ রাখেন। এমনকি অনেক রাজা-রাজপুত্রও দাড়িগোঁফ রাখেন। এটা ঋষিত্বের এবং উচ্চ বংশমর্যাদার চিহ্ন। কই তাঁদের তো কেউ বর্বর বলে না! তাহলে তাকে কেন বর্বর বলল নারীটি? গায়ের রঙই কি দায়ী এজন্য? বুঝে উঠতে পারছে না একলব্য। 

নারী দুজন তার একটু আগে আগে চলছে। একলব্যের ভেতরের অগ্নিসম ক্রোধ ঘূর্ণিত হতে হতে মস্তিষ্কের দিকে ধাবমান হলো। আক্রোশে সে ফেটে পড়তে চাইল। কিন্তু তার ভেতরের আরেকজন একলব্য বলে উঠল—শান্ত হও একলব্য। ক্রোধকে দমন কোরো। ক্রোধ তোমাকে আদর্শচ্যুত করবে। গন্তব্য থেকে ছিটকে পড়বে তুমি। তোমার অমৃতপ্রাপ্তি হবে না। গুরুদর্শন থেকে বঞ্চিত হবে তুমি। এই নারীরা আর্য শ্রেণিভুক্ত। তুমি অনার্য। ওরা নারী, তুমি পুরুষ। তুমি যদি রাগান্বিত হয়ে ওদের মন্তব্যের কৈফিয়ত চাও, তাহলে একটা গণ্ডগোল লাগবে। তুমি যে আর্যগোষ্ঠীভুক্ত নও, তা তো ওরা বুঝে গেছে। তুমি যদি কৈফিয়ত চাও, স্বভাবগুণে ওরা তোমার সঙ্গে কোন্দল বাধাবে। পেরে উঠবে না তুমি তাদের সঙ্গে। উষ্ণ কথোপকথন শুনে পথের মানুষ জড়ো হবে। নারীদের পক্ষ নেবে ওরা। নারীদের অপমান করার অজুহাত দেখিয়ে প্রহরীদের খবর দেবে। প্রহরীরা বন্দি করে রাজবিচারের মুখোমুখি করবে তোমায়। দণ্ডিত হবে তুমি। কারাগারে নিক্ষেপিত হবে তুমি একলব্য। তোমার দ্রোণাচার্য দর্শন, তোমার অস্ত্রশিক্ষা—সবকিছুরই জলাঞ্জলি হবে। সুতরাং সাবধান একলব্য। মাথা ঠান্ডা রাখো। হাঁটতে থাকো গন্তব্যের উদ্দেশে। 

একলব্যের মন শান্ত হয়ে এল। ক্রোধ তাকে ত্যাগ করল। প্রাপ্তির আগাম প্রশান্তিতে তার দেহমন ভরে গেল। নারীদের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল একলব্য। জিজ্ঞেস করল, ‘হস্তিনাপুর আর কতদূর? 

পূর্বে মন্তব্যকারী নারীটি বলল, ‘হস্তিনাপুর দিয়ে কী হবে? ওখানে রাজা থাকেন, রাজন্য থাকেন। আর থাকে আর্যরা। তুমি হস্তিনাপুর গিয়ে কী করবে?’ 

‘আহা সুশীলা, তুমি এত বাঁকা কথা বলছ কেন ছেলেটির সঙ্গে? প্রথমেও ওকে দেখে তুমি বাজে মন্তব্য করেছ। এখন ছেলেটা হস্তিনাপুরের সন্ধান চাইছে, তুমি তাকে অপমান করছ। এটা ঠিক নয় সুশীলা।’ দ্বিতীয় নারীটি বলল। 

সুশীলা গালে ডান হাত ছুঁইয়ে বলল, ‘অ ভগবান! আমি আবার কী অপমান করলাম ওকে? চেনা নেই, জানা নেই, সহসাই ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলছ দিদি?’ 

দিদি বলল, ‘পক্ষবিপক্ষের কথা নয়, মান-অপমানের কথা বলছি। যাক গে, তা বাছা, তুমি কি কুরুরাজ্যের নও?’ 

‘না মাসি। আমি নিষাদরাজ্য থেকে এসেছি।’ শান্ত কণ্ঠে একলব্য বলল। 

‘তা-ই বলো। আমার অনুমান ঠিক। আমি ভেবেছি, বাইরের কোনো দেশের তুমি। কুরুপ্রজা হলে তো হস্তিনাপুরের পথঘাট চিনতে তুমি।’ দিদি মমতাভরা গলায় বলল। একটা ঢোঁক গিলে দিদি আবার বলল, ‘তা কী জন্য যাচ্ছ তুমি রাজধানীতে?’ 

‘তা বলা যাবে না মাসি। আপনি শুধু আমাকে পথের সন্ধান দিন। 

‘ও আচ্ছা বাছা।’ বলে থমকে দাঁড়াল দিদি। তার দেখাদেখি সুশীলাও। তারপর বাম হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ‘এই যে রাজপথটা সোজা চলে গেছে, গঙ্গাপারে গিয়ে তা থেমেছে। গঙ্গা পার হলেই আবার রাজপথ। তবে সে পথ এ পথের মতো মলিন নয়। অনেক বড়, অনেক সুন্দর হস্তিনাপুরের রাজপথ। তুমি বোধহয় বুঝে গেছ, গঙ্গা পেরোলেই হস্তিনাপুর। মানে আমাদের রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রাজধানী।’ 

হঠাৎ নিজের অজান্তে একলব্যের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘আর গুরু দ্রোণের আশ্রম? ‘কী বললে বাছা? বুঝতে পারলাম না।’ দিদি বলল। 

একলব্য দ্রুত বুঝে গেল—সে ভুল জনকে প্রশ্ন করে ফেলেছে। এরা খেটে খাওয়া সাধারণ নারী। এরা কীভাবে জানবেন দ্রোণাচার্যের আশ্রমের সন্ধান? রাজার নাম জানা স্বাভাবিক। পিতামহ ভীষ্মের নামও জানতে পারেন। কিন্তু বহিরাগত একজন অস্ত্রগুরুর নাম তো ওঁদের জানার কথা নয়। তাই তাড়াতাড়ি একলব্য বলে উঠল, ‘ঠিক আছে মাসি। আর কিছু জানতে চাই না।’ বলে হাত জোড় করে দুই নারীকে প্রণাম জানাল একলব্য। তারপর দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল। তাকে যে অনেক দূর যেতে হবে। সূর্য ডোবার আগে গঙ্গাতীরে উপস্থিত হতে হবে তাকে। 

সূর্যাস্তের সামান্য আগে একলব্য গঙ্গানদীর পশ্চিম তীরে পৌঁছাল। নদীর পূর্বপার থেকেই রাজধানীর শুরু। পশ্চিম তীরে বনভূমি। শ্রমজীবী মানুষের বসবাস এ তীরে এখানে-ওখানে ফসলি ক্ষেত। খেটে খাওয়া মানুষরা নানা কৃষিজদ্রব্য নিয়ে রাজধানীতে চলে যায়। বেচাকেনা শেষ করে শ্রমজীবী-কৃষিজীবী এই মানুষরা পশ্চিম তীরে ফিরে আসে। 

পশ্চিম তীর থেকে শেষ খেয়াটি ছেড়ে যাচ্ছে তখন। মাঝি হাঁক দিচ্ছে, ‘শেষ খেয়া চলে যাচ্ছে ওপারে। এরপর আর খেয়া নেই। যেতে না পারলে এপারেই রাত কাটাতে হবে বাপুরা। যারা যাবেন চলে আসুন চটজলদি। নৌকা ছেড়ে দিলাম বলে।’ 

মানুষরা নৌকায় উঠে বসতে লাগল। নৌকার খোল ভরে উঠতে লাগল নারী- পুরুষে। ঠেলেঠুলে পনেরো-বিশজন ধরে নৌকায়। কিছুক্ষণ পর সুশীলা আর তার দিদিও নৌকায় উঠে বসল। একলব্যও তো ওপারে যাবে। পার বেয়ে ধীরে ধীরে নৌকার কাছে নেমে এল সে। যেই নৌকায় উঠতে যাবে, অমনি হাঁক দিল মাঝি, ‘ওই ব্যাটা, পারানি আছে তো কোঁচড়ে!’ 

ভীষণ চমকে মাঝির দিকে তাকাল একলব্য। পারানি? পারানি তো নেই তার কাছে! মূল্যবান যা কিছু তার কাছে ছিল সবই তো সৈন্যসামন্তদের বিলিয়ে দিয়ে এসেছে। এখন দু’প্রস্থ কাপড়, একটি শরভর্তি তূণ, একটা ধনুক, আরেকটা টাঙ্গিই তার সম্বল। কোনো কড়ি তো তার কাছে নেই। 

মাঝির প্রশ্নের উত্তরে একলব্য ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে নিচু স্বরে বলল, ‘পারানি তো নেই আমার কাছে। 

‘দূরে যাও, দূরে যাও। নৌকায় উঠো না তাহলে।’ শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে মাঝি বলল। 

‘ওপারে যাওয়া যে আমার খুবই দরকার।’

‘তোমার দরকার তাতে আমার কী? আমি কি দানছত্র খুলে বসেছি এই ঘাটে?’

‘পথে যে কড়ি লাগবে জানতাম না। আমাকে ওপারে যেতেই হবে দাদা।’ 

‘দাদা! আরে, দাদা ডাকছ কাকে? দেখে তো মনে হচ্ছে অরণ্যচারী। শবর, ব্যাধ বা ডোম। আমি আর্য। তোমার সঙ্গে আমার আবার দাদার সম্পর্ক তৈরি হলো কবে? যাও যাও, দূরে যাও।’ 

‘তাহলে কীভাবে আমি ওপারে পৌঁছাব?’ 

‘কেন? সাঁতরে পার হবে! ও, তুমি আবার সাঁতরে পার হবে কীভাবে? থাকো তো পাহাড়ে-পর্বতে। সেখানে নদী-জলাশয় কোথায়?’ 

‘আমাদের দেশে নদী আছে, সরোবরও আছে।’ 

‘এই দেখো, মুখে মুখে আবার তর্ক করছে। হাতে নাই আধা কড়ি, মুখে বড় বড় কথা।’ 

এই সময় সুশীলা কথা বলে উঠল, ‘মাঝির পো, তুমি ছেলেটাকে ওভাবে অপমান করছ কেন? সবাই তো কড়ি দেব, একজন না দিলে কী এমন ক্ষতি হবে তোমার? পূর্বতন অপরাধবোধের তাগিদে কথাগুলো বলল সুশীলা। 

সুশীলারা নিত্য পারাপার করে এই ঘাট দিয়ে। মাঝির চেনা-জানা তারা। সুশীলার কথা শুনে একটু থমকে গেল মাঝি। নরম সুরে বলল, ‘এই দিয়েই তো আমার সংসার চলে সুশীলাদি। ঘরে গণ্ডা গণ্ডা ছেলেপুলে।’ দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে এল মাঝির বুক চিড়ে। 

‘আচ্ছা আচ্ছা, তোমাকে এত হা-পিত্যেশ করতে হবে না। ওর পারানিটা আমিই দেব। ওকে নৌকায় তুলে নাও তো দাদা।’ বলে একলব্যের দিকে একবার তাকাল সুশীলা। 

মাঝি একলব্যকে নৌকায় তুলে নিল। নৌকা চলতে শুরু করল। আবছা আঁধারে নদীবুক অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মাথা নিচু করে নৌকার পেছন গলুইয়ের দিকে চুপটি করে বসে আছে একলব্য। ভাবছে—যে নারীটি প্রথমে তাকে এমনভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন, তিনিই বিপদে সাহায্যের হাত বাড়ালেন তার দিকে। কী অদ্ভুত না? এককালের শত্রু, চিরকালের শত্রু নয়। যে নারীটি এককালে তার সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করেছেন, সেই নারীটিই মিত্র হয়ে বিপদে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ভিজে আসতে চাইল। গায়ে জড়ানো কাপড় দিয়ে দু’চোখের কোণা মুছে নিল একলব্য। তারপর সুশীলার দিকে তাকাল। কিন্তু তার দৃষ্টি সুশীলা পর্যন্ত পৌঁছাল না। গঙ্গাবক্ষের সমস্ত কিছু তখন অন্ধকারে ঢেকে গেছে। শুধু শোনা যাচ্ছে দাঁড়ের ছলাৎছল শব্দ। 

.

পূর্বপারে রাতটা কাটিয়ে দিল একলব্য। নৌকা কূলে ভিড়লে সবাই যে যার মতো করে চলে গেল। সুশীলারা বসেছিলেন আগার দিকে, একলব্য পেছনের দিকে। কূলে নেমে একলব্য অনেক খুঁজল সুশীলাদের। কিন্তু পেল না। আগেই ভাড়া মিটিয়ে নৌকা থেকে নেমে গেছে তারা। হয়তো তাদের গন্তব্য অনেক দূরে অথবা তার মুখোমুখি হয়ে তাকে লজ্জায় ফেলতে চায় নি বলে সুশীলারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছে। 

সবাই চলে গেলে চারদিক শুনশান হয়ে গেল, মাঝিও খুঁটিতে নৌকাটি বেঁধে চলে গেল বাড়িতে। শুধু পড়ে থাকল বিস্তৃত শানবাঁধানো ঘাট। এই নির্জন জায়গাটি আগামীকাল প্রত্যুষে হয়তো আবার জনকোলাহলময় হয়ে উঠবে। 

পথ অচেনা, স্থান অজানা, গন্তব্য অচিহ্নিত। কোথায় যাবে এখন একলব্য? ঠিক করল—শানবাঁধানো ঘাটেই শয্যা পাতবে সে। ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড়টি বিছিয়ে শুয়ে পড়ল একলব্য। সে ক্ষুধার্ত। কিন্তু সারা দিনের ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে যাচ্ছে তার। তাই শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সে। 

.

বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রবীণ-প্রবীণা আর মুনিঋষিদের মন্ত্রধ্বনিতে ঘুম ভেঙে গেল একলব্যের। চোখ মেলে দেখল—পৃথিবীর বুক থেকে সবেমাত্র আঁধার কাটতে শুরু করেছে। দূর- অরণ্য থেকে পাখিরা উড়াল দিয়েছে। আকাশ বেয়ে এদিক-ওদিক উড়ে যাচ্ছে তারা। 

শোয়া থেকে উঠে বসল একলব্য। ক্ষুধা নিয়ে ঘুমিয়েছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য, এখন তার কোনো ক্ষুধাই লাগছে না। গভীর ঘুমের কারণে তার দেহ এই মুহূর্তে ক্ষুধাবিযুক্ত হয়ে গেছে বলে, না কাঙ্ক্ষিত স্থানে আসতে পারার আনন্দে তার মনপ্রাণ ভরে আছে বলে? বুঝতে পারছে না একলব্য। 

এবার বিশাল বিস্তৃত গঙ্গাঘাটের দিকে দৃষ্টি ফেরাল সে। দেখল—শত শত পুণ্যার্থী গঙ্গাজলে নেমেছে। কেউ স্নানের উদ্যোগ নিচ্ছে, কেউ স্নান সেরে বুকজলে দাঁড়িয়ে পূর্বমুখী হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। কেউবা স্নান আর মন্ত্রপাঠ শেষ করে ভিজে কাপড়ে সিঁড়ি ভেঙে পারের দিকে উঠে আসছে। কোনো কোলাহল নেই; নেই কোনো হইচই। শুধু গম্ভীর একটা মন্ত্রধ্বনি মৃদুলয়ে ধ্বনিত হচ্ছে। ফলে গঙ্গাঘাটকে ঘিরে অপূর্ব এক স্নিগ্ধ বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। ধীরলয়ে সঞ্চরমান মানুষগুলোকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না একলব্যের। তারা যেন স্বর্গীয় কেউ। 

একটা অপার্থিব সৌরভে একলব্যের মনটা ভরে উঠল। এতদিনের পথচলার কষ্ট, অনাহার-অর্ধাহারের যন্ত্রণা, ঐশ্বর্যবিচ্ছিন্ন হয়ে কৃচ্ছ্র সাধনের ক্লান্তি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল তার দেহমন থেকে। একটা ঘোরের মধ্যে সেও নেমে গেল গঙ্গাজলে। তার হঠাৎ মনে পড়ল—গত তিন-চার দিন সে স্নান করে নি। ঐকান্তিক নিষ্ঠায় সে হস্তিনাপুরের দিকে শুধু হেঁটেছে। 

ঝাঁপিয়ে স্নান করল সে। ডুব দিয়ে, দূরে কাছে সাঁতার কেটে, জলে তুমুল দাপিয়ে কাটাল অনেকক্ষণ। গঙ্গাজল স্পর্শে তার দেহ শীতল হলো, মন শান্ত হলো। আর্যদের মতো তার ধর্মে সেরকম কোনো মন্ত্র নেই জলপূজার বা সূর্য প্রণামের। তাই ঈশ্বরের প্রতি নিবিড় একটা প্রণাম জানিয়ে জল থেকে উঠে এল একলব্য। ভিজা বসনেই থাকল সে। তীর-ধনুকে সজ্জিত হলো পূর্বের মতো। ততক্ষণে পুবাকাশে সূর্য উঠে গেছে অনেকদূর। 

এবার ক্ষুধা চাগিয়ে উঠল একলব্যের। ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। একটু দূরে মলিন বসনের দরিদ্র মানুষরা কলাপাতায় কী যেন খাচ্ছে সারিবদ্ধভাবে বসে। ধনী লোকেরা দরিদ্র মানুষদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করছে। একলব্য কোনো দ্বিধা না করে সারির একপ্রান্তে বসে পড়ল। উদর পূর্তি করে খেল সে। 

তারপর রওনা দিল দ্রোণাচার্যের অস্ত্রাশ্রমের দিকে। যাত্রা শুরুর আগে এক বয়োবৃদ্ধের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে আচার্যের আশ্রমে যাওয়ার অন্ধিসন্ধি। 

ধৃতরাষ্ট্রের রাজপ্রাসাদ থেকে ক্রোশ সাতেক দূরে আচার্য দ্রোণের অস্ত্র পাঠশালা। শিষ্যদের একাগ্রতা দরকার, দরকার কষ্টসহিষ্ণুতা। প্রাসাদসংলগ্ন থাকলে ছাত্রদের একাগ্রতা নষ্ট হবে। একনিষ্ঠ না হলে অস্ত্রবিদ্যা অর্জন যথার্থ হবে না। তাই দ্রোণাচার্যের আশ্রম লোকালয়বিচ্ছিন্ন, প্রাসাদের তদারকিবিযুক্ত। শুধু তা-ই নয়, ধনাঢ্যের ঐশ্বর্য যাতে ছাত্রদের কাছ ঘেঁষতে না পারে সেদিকেও কড়া নজর রেখেছেন গুরুদেব। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের মতো কঠোরতা এখানে। বিলাসিতা নেই, মাত্রাতিরিক্ত আহার করার সুযোগ নেই, দুগ্ধফেননিভ শয্যায় ঘুমানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। একটা বড় ধরনের কক্ষে সবাই সারিবদ্ধভাবে সাধারণ মানের শয্যায় ঘুমায়। অতি প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ ও রাত্রির নির্ধারিত প্রহরে ঘুমাতে যেতে হয় তাদের। 

আশ্রমের উত্তর দিক ঘেঁষে অরণ্যের শুরু। এই অরণ্য ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। স্থানক্রমে বিশাল বৃক্ষের সংখ্যা বেড়েছে। লতাগুল্মের আধিক্যে ভেতরের দিকের অরণ্য দুরধিগম্য হয়ে উঠেছে। হিংস্র শ্বাপদের সংখ্যাও কম নয় এই বনভূমিতে। এই ভূমি যে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, তা কেউ জানে না। কেউ জানে না বললে ভুল হবে। আচার্য দ্রোণ জানেন। কারণ দ্রুপদরাজ্য থেকে সাভিমানে তিনি যখন হস্তিনাপুরে আসেন, এই ভীষণাকার অরণ্য অতিক্রম করেই আসেন। ওই একবারই তিনি এই বনভূমি অতিক্রম করেছেন, দ্বিতীয়বার নয়। শিষ্যদের অস্ত্রজ্ঞান পরীক্ষার জন্য মাঝেমধ্যে তিনি ওই অরণ্যে প্রবেশ করেন বটে। তবে তা এক দুই বা ক্রোশ তিনেক পর্যন্ত। তার অধিক নয়। এই অরণ্যভূমির গভীরতর অংশ এমনভাবে নানা বৃক্ষ-লতায় ঢাকা যে, সূর্যের আলোও সেই অরণ্যাভ্যন্তরে যথাযথভাবে প্রবেশ করতে পারে না। 

সেই সকালে গুরু দ্রোণ প্রশিক্ষণকক্ষে শিষ্যদের অর্ধবৃত্তাকারে বসিয়েছেন। তাদের সামনে যোগাসনে বসেছেন তিনি। মাথার মাঝখানে চূড়া করে চুল বাঁধা। শ্মশ্রু বক্ষ পর্যন্ত লম্বিত। গৈরিক রঙের বসন পরিধান করেছেন তিনি। ঊর্ধ্বাঙ্গ বসনবিহীন। কাঁধ বেয়ে শুভ্র পৈতে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। গৌরবর্ণ শরীর তাঁর। সেই গৌরাঙ্গে শুভ্র পৈতেটি অপূর্ব এক গাম্ভীর্য তৈরি করেছে। 

আজকের শিক্ষা ব্যবহারিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক। কোন শিষ্যের মানসিক শক্তি কী রকম, তা মাপতে বসেছেন গুরুদেব। সমরকালে যুদ্ধক্ষেত্রের এক একটা সংকটের কথা বলছেন আর ওই সময় কে কীভাবে মোকাবেলা করবে, জানতে চাইছেন। শুধু তা-ই নয়, মানুষে মানুষে বা রাজায় রাজায় যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করছেন আচার্য। যুদ্ধের কথা এলে অস্ত্রের প্রসঙ্গ আসে। তিনি তো ধনুর্ধর। তীর-ধনুকের গঠনকৌশল, এদের প্রকারভেদ এসব কিছুর একটা পটভূমি তৈরি করছেন। 

দ্রোণাচার্য কৌরব-পাণ্ডব এবং ভিনদেশের শিষ্যদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ঋগ্বেদ সমরসাহিত্যে সমৃদ্ধ। এই বেদেই ইন্দ্রকে বজ্রধারী যুদ্ধদেবতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।’ 

‘গুরুদেব কী কারণে মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়?’ মৃদু কণ্ঠে যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করে। 

আচার্য বললেন, ‘যথার্থ প্রশ্ন করেছ তুমি যুধিষ্ঠির। যুদ্ধ বিষয়ে জানার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের কারণ জানাও যথার্থ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য। তোমার প্রশ্নের উত্তর যদি সংক্ষেপে দিই, তাহলে বলতে হবে আত্মসংরক্ষণ আর আত্মসমৃদ্ধির প্রয়োজনেই মানুষ যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে। তোমাদের চেহারা দেখে আমার কথার মাহাত্ম্য যে বুঝতে পারো নি, অনুমান করছি। দাঁড়াও বুঝিয়ে বলছি।’ সমবেত শিষ্যদের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে কথা শেষ করলেন দ্রোণাচার্য। 

এই সময় ভীম বলে উঠল, ‘যথার্থ বলেছেন গুরুদেব। আপনার কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারি নি।’ 

‘বুঝবে কী করে, খাদ্যদ্রব্যের কথা নেই যে গুরুদেবের কথায়!’ পাশ থেকে দ্রুত বলে উঠল দুর্যোধন। 

দুর্যোধনের কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। আচার্যও না হেসে পারলেন না। তবে সে হাসি গুরুদেবসুলভ। শিষ্যদেরকে নিয়মের কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখেন তিনি। তবে মাঝে মাঝে হাস্যরসকে প্রশ্রয় দেন। হাস্য মানুষের ভেতরটাকে স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল করে তোলে। দুর্যোধনের কথায় আর শিষ্যদের হাস্যে তাই কিছু মনে করলেন না আচার্য। 

গাম্ভীর্য বজায় রেখে তিনি বললেন, ‘যুদ্ধের মূল কারণ লুব্ধতা-সম্পদের অপরিমিত কামনা আর অন্যের ওপর প্রভুত্ব করার অযৌক্তিক বাসনা।’ তারপর তিনি কী যেন একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা এখন বড় হয়েছ। তোমাদের কাছে একটা বিষয় গোপন করা ঠিক হবে না। যুদ্ধের আরেকটা প্রধান কারণ আছে।’ 

শূরসেন দেশের রাজকুমার বলল, ‘আচার্য, আরেকটা প্রধান কারণ কী? 

“কোনো সুন্দরী নারীকে অধিকার করার লালসার জন্যও দুই বা বহু রাজ্যের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধে। ‘রামায়ণে’র সীতাকাহিনি তোমাদের অজানা নয়।” বললেন আচাৰ্য। 

এরপর তিনি আরও বললেন, ‘একজন যথার্থ যোদ্ধাকে আয়ুধ-বিজ্ঞান, আয়ুধ উৎপাদনের প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রহরণ প্রয়োগ ও প্রত্যাহারের কুশলতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হয়। একজন যোদ্ধা তখনই জয়ী হয়, যখন সে নিঃসংশয়ে উপলব্ধি করে যে, সে যে-যুদ্ধটি করছে তা কোনো বৃহত্তম স্বার্থের জন্য, কোনো মহত্তর আদর্শের জন্য।’ শেষের কথাটি বলতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠ গাঢ় হয়ে এল। তিনি ইচ্ছে করেই নিজের কণ্ঠে গভীর আবেগ ঢেলে দিলেন। 

কৌরব-পাণ্ডব শিষ্যদের অস্ত্রকৌশলী করে গড়ে তোলার পশ্চাতে তো তাঁর গূঢ় একটা উদ্দেশ্য আছে। তা হলো—রাজা দ্রুপদকে পরাজিত করা এবং তা প্রশিক্ষিত এই ছাত্রদের দিয়েই করানো। তার জন্য দরকার শিষ্যদের আবেগায়িত করে তোলা। বিচক্ষণ দ্রোণাচার্য জানেন—শিক্ষক আবেগায়িত হলে শিষ্যরাও সহজে আবেগাপ্লুত হয়। 

অর্জুন বলে উঠল, ‘গুরুদেব, আপনার আদর্শ আমাদের পাথেয়, আপনার নির্দেশনা আমাদের চলার পথের মূলপাঠ।’ 

স্মিত হাসলেন দ্রোণ। অর্জুনের মুখে এই কথাটিই আশা করেছিলেন তিনি। কারণ তাঁর দীর্ঘদিনের সংগুপ্ত বেদনা যদি কেউ উপশম করতে পারে, তবে তা পারবে এই অর্জুন। অর্জুনই দ্রুপদকে পরাস্ত করে তাঁর পদতলে ফেলতে পারবে। 

‘এবার তোমাদের যুদ্ধাস্ত্র বিষয়ে ধারণা দিতে চাই। আগেও বহুবার এ বিষয়ে তোমাদের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। তবে তা ছিল ভূমিকামাত্র। শিক্ষা গ্রহণের প্রাথমিক অবস্থা সেই সময়। তাই কঠিন কথা তোমাদের মনে রাখা দুরূহ হতো। এখন তোমরা অনেকটা পরিপক্ব। এখন আমার কথা বুঝতে তোমাদের বেগ পেতে হবে না।’ দম নেওয়ার জন্য একটু থামলেন আচার্য। একাগ্র মনে আবার বলতে শুরু করলেন। সমবেত শিষ্যদের শিরদাঁড়া সোজা, চক্ষু গুরু-নিবদ্ধ, কর্ণ গুরুবচনমুখী। 

আচার্য বললেন, ‘চার ধরনের আয়ুধ আছে—মুক্ত, অমুক্ত, মুক্ত-অমুক্ত এবং যন্ত্রমুক্ত। যে হাতিয়ার ছুড়ে মারা যায়, তা মুক্ত আয়ুধ, হাতে ধরে রেখে যে হাতিয়ার ব্যবহার করতে হয়, তা অমুক্ত আয়ুধ। আবার মুক্ত-অমুক্ত যুদ্ধাস্ত্র হলো যা ছুড়ে মেরে বা হাতে ধরে ব্যবহার করা যায়। যেসব অস্ত্র প্রক্ষেপ করার জন্য যন্ত্রের সাহায্যের প্রয়োজন, তা যন্ত্রমুক্ত আয়ুধ। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত আয়ুধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—তীর-ধনুক, চক্র, জাঠি, জাঠা, গদা, শূল, ত্রিশূল, বর্শা, কুঠার, খড়গ, অসি, হল্ ইত্যাদি।’ 

ভীম বলল, ‘গদা সম্পর্কে বলুন আচার্য।’ 

‘ভীম আমার প্রিয় শিষ্য। তার যুদ্ধাস্ত্র গদা। গদা সম্পর্কে তো প্রথমেই বলা উচিত ছিল আমার।’ আচার্য বললেন। 

এই সময় দ্বিতীয় সারি থেকে কঠোর কণ্ঠে দুঃশাসন বলল, ‘গদা শুধু বৃকোদরের ব্যবহার্য অস্ত্র হবে কেন গুরুদেব? আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহাবীর দুর্যোধনও কি গদাযুদ্ধে দক্ষ নয়? শুধু ভীমই কি আপনার প্রিয় ছাত্র? দাদা দুর্যোধন অর্থাৎ আমরা শত ভ্রাতারা কি আপনার প্রিয়পাত্র নই?’ 

দুঃশাসনের কথা শুনে দ্রোণাচার্যের চোখের কোণায় ক্রোধ ঝিলিক দিয়ে উঠল তবে তা ক্ষণকালের জন্য। আচার্য সংযমী পুরুষ এবং বিচক্ষণ। ক্রোধকে দ্রুত সংযত করলেন তিনি। বললেন, ‘গুরুর কাছে কোনো ছাত্রই অপ্রিয় নয়। তবে কেউ কেউ একটু বেশি প্রিয়। যাক, গদা সম্পর্কে বলছিলাম। গদা দু’ধরনের। শুধু লোহা দিয়ে তৈরি গদাকে জাঠা বলে। ‘রামায়ণে’ এই হাতিয়ারটিকে বলা হয়েছে জাঠাস্ত্র। আর কাঠ ও লোহা দিয়েও গদা তৈরি হয়। এদের আকার ভিন্ন ভিন্ন, তাদের ওজনও ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের এই অস্ত্রাশ্রমে ভীম আর দুর্যোধনই সবচাইতে বড় আর ভারী গদা ব্যবহার করে।’ 

দুর্যোধনের নাম উল্লেখ করায় কৌরব-ভ্রাতারা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। আচার্য ডান হাত উঁচিয়ে তাদের থামতে বললেন। ‘আকৃতি ও প্রকৃতি অনুসারে গদার আলাদা আলাদা নাম–শেল, মুষল, মুদগর এসব।’ 

তারপর তিনি অনেকক্ষণ সেই কক্ষের কড়িকাঠের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলেন। যেন শিষ্যদের উদ্দেশে গভীর কোনো কথা বলবেন, এ জন্য নিজের মধ্যে বক্তব্যকে সাজিয়ে নিচ্ছেন। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলতে শুরু করলেন, ‘এই ভারতবর্ষে আমার যেটুকু সুনাম, তা ধনুর্ধর হিসেবে। আমার এই অস্ত্রাশ্রমের প্রধান পাঠব্য বিষয় তীর-ধনুক। এখন এই তীর-ধনুক বিষয়ে তোমাদের দু’চারটি কথা বলব।’ 

দ্রোণাচার্যের কথা শুনে অর্জুন আর অশ্বত্থামা নড়েচড়ে বসল। তারা উৎকর্ণ। 

আচার্য বললেন, ‘আকার অনুসারে ধনুক দু’রকম—ছোট আর বড়। তোমরা দেখবে যুদ্ধক্ষেত্রে অধিকাংশ সৈন্য ছোট ধনুক ব্যবহার করে। তবে কেউ কেউ বড় ধনুক ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। যেমন অর্জুন, যেমন কর্ণ। কর্ণ এখানে নেই, তারপরও বলি কর্ণও বড় ধনুক সহজেই ব্যবহার করতে পারে, যেমন পারে অর্জুনও। যোদ্ধারা সাধারণত শাঙ্গ ধনুক ব্যবহার করে। ছোট বলে হাতি বা ঘোড়া বা মহিষের পিঠে চড়ে এই অস্ত্র ব্যবহার করা সহজতর। বিভিন্ন প্রাণীর শৃঙ্গ দিয়ে তৈরি বলে এর নাম শাঙ্গ। চন্দন, বেতস, শাল, শিমুল, ধবল, অর্জুন এবং বাঁশগাছের কাণ্ড দিয়ে সাধারণত ধনুক তৈরি হয়। তবে মনে রেখো, সবচেয়ে ভালো ধনুক তৈরি হয় হেমন্ত ঋতুতে সংগৃহীত পাকা বাঁশ দিয়ে। ধনুকাভ্যাস করতে গিয়ে তোমরা তো লক্ষ করেছ— ধনুকের বিভিন্ন অংশে লোহা, পিতল ও সোনার বড়ো ছোটো পাত মুড়ে দেওয়া হয়। এই ধাতব অংশগুলো ধনুকের শক্তি ও কার্যকারিতা বাড়ায়।’ 

‘এবার তীর সম্পর্কে কিছু বলুন পিতা।’ অশ্বত্থামা বলল। 

‘বহু রকমের তীর আছে। তবে তীরের ফলা তৈরি হয় লোহা দিয়ে। তীরদণ্ড তৈরি হয় বাঁশ ও লোহা দিয়ে। ফলার আকৃতির ওপর তীরের নাম নির্ভর করে। যেমন সূচিমুখ, সিংহদণ্ড, বজ্রদণ্ড, অশ্বমুখ, অর্ধচন্দ্র ইত্যাদি।’ বলতে বলতে হঠাৎ আচার্যের চোখ পড়ল পাঠদান কক্ষের দ্বারপ্রান্তে। তীব্র কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘কে, কে ওখানে?’ 

অস্পষ্ট মানুষটি একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। কোনো কথা বলল না। 

আচার্য বিরক্ত কণ্ঠে উচ্চস্বরে আবার বললেন, ‘কে দাঁড়িয়ে আছ ওখানে? উত্তর দিচ্ছ না কেন?’ 

এবার মানুষটি এক পা দু’পা করে করে দ্রোণাচার্যের দিকে এগিয়ে এল। তার জোড়হস্ত। আচার্য ভালো করে তাকালেন আগন্তুকের দিকে। দেখলেন নিকষ কালো শরীরের এক যুবা। মেদহীন দেহ। মলিন বসন। সর্বাঙ্গ ধূলিধূসরিত। 

তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন আচার্য। দেখলেন—তার উজ্জ্বল দুটো চোখ। মুখটা শ্রমে মলিন। তীব্র একটা ভয়ের চিহ্ন গোটা মুখাবয়বজুড়ে। দ্রোণাচার্যের নিকটে এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করল যুবাটি। করজোড়ে উঠে দাঁড়াল। 

যুবকটিকে ভালো করে পরখ করার পর আচার্যের কণ্ঠ নরম হয়ে এল। কিন্তু তার পরিচয় জানার আগ্রহ কমল না। আচার্য বললেন, ‘কে তুমি যুবক? দেখে মনে হচ্ছে তুমি হস্তিনাপুরের নও। আর্যও নও তুমি।’ 

বিনীত কণ্ঠে যুবকটি এবার উত্তর দিল, ‘আপনি যথার্থ বলেছেন গুরুদেব। আমি আর্য নই।’ আচার্যের প্রশ্নের শেষাংশ থেকে উত্তর দেওয়া শুরু করল যুবকটি। বলল, ‘আমি কুরুরাজ্যের অধিবাসী নই। আমার বাড়ি নিষাদরাজ্যে।’ তারপর আরও মৃদুগলায় বলল, ‘রাজা হিরণ্যধনু আমার পিতা। একলব্য আমার নাম।’ 

আচার্য পলকহীন চোখে একলব্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভেবে পাচ্ছেন না কেন একলব্য এখানে এসেছে! সে কি তাঁর কাছে এসেছে? যদি তাঁর কাছে এসে থাকে, তাহলে আসার উদ্দেশ্য কী? সঙ্গে তো তীর-ধনুকও দেখা যাচ্ছে। কাউকে আক্রমণ করতে আসে নি তো? অথবা…। 

ভাবনাকে অসম্পূর্ণ রেখে দ্রোণাচার্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কেন এসেছ তুমি?’ 

একলব্য পুনরায় মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আচার্যকে প্রণাম করল। অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘আপনার কাছে ধনুর্বিদ্যা শিখতে এসেছি আমি। গুরুদেব, আমাকে আপনার শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করুন।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *