একলব্য – ২০

২০

সেনাপতিস্ত্বহং রাজন্ সময়েনাপরেণ তে। 
আমাকে সেনাপতি করলে একটা শর্ত তোমায় মেনে নিতে হবে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। 

দিকে দিকে আহ্বান গেল। দুর্যোধন নানা দেশে গুরুত্বপূর্ণ অমাত্য আর দূতদের পাঠাল। দ্রুপদ আর পঞ্চপাণ্ডবরাও পিছিয়ে থাকলেন না। তাঁরাও নানা দেশে তাদের পক্ষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগদানের জন্য সন্দেশ পাঠালেন। উভয়পক্ষের আহ্বানে ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলের রাজারা সসৈন্যে যুদ্ধে যোগদান করতে লাগলেন। কুরুদের পক্ষে যুদ্ধ করতে এলেন সিন্ধুসৌবীর, গান্ধার, ত্রিগর্ত, কেকয়, মদ্র, কম্বোজ, মাহিষ্মতী, প্রাগজ্যোতিষপুর, কোশল, অম্বষ্ঠ, বাহিক, ক্ষুদ্রক, বিদর্ভ, অবস্তী, বিদেহ, বৎস্য, কলিঙ্গ, অঙ্গ, পূর্ব মগধ, পুণ্ড্র-বঙ্গ, অহিচ্ছত্র, ভোজ, কুকুরদেশ, শূরসেন এবং অশ্বক দেশের নৃপতিরা। পাণ্ডবদের ডাকে খুব বেশি কেউ সাড়া দিলেন না। মাত্র ছয়টি দেশের নৃপতি পাণ্ডবদের পক্ষে যোগদান করলেন। তাঁরা হলেন পাঞ্চাল, মৎস্য, চেদী, করুষ, কাশী আর পশ্চিম মগধের অধিপতি। এ ছাড়া কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করতে এল মারণান্তক নারায়ণী সেনা। বিভিন্ন নিষাদগোষ্ঠীও দুভাগে বিভক্ত হয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগদান করল। 

উভয়পক্ষ থেকে আহ্বান পাওয়ার পরও একলব্য এল না। সে দ্বিধান্বিত। কোন দলে যোগদান করবে ভেবে ঠিক করতে পারছে না একলব্য। তার জীবনশত্রু দুজন— দ্রোণাচার্য আর অর্জুন। দুজন দুই শিবিরের যোদ্ধা। কার পক্ষে আর কার বিপক্ষে যুদ্ধ করবে সে? দ্রোণাচার্য তার জীবনের সকল স্বপ্ন সাধ কেড়ে নিয়েছেন। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি তাকে। আর অর্জুন? তাকে বিকলাঙ্গ করার জন্য দ্রোণকে প্ররোচিত করেছে সে। মূলত স্বার্থান্ধ অর্জুনের কুপরামর্শেই দ্রোণাচার্য তার অঙ্গচ্যুতি ঘটিয়েছেন। কে বড় অপরাধী? নির্ধারণ করতে পারছে না একলব্য। 

এক বিকেলে পিতা হিরণ্যধনুর সঙ্গে দেখা করে একলব্য। মনের দ্বিধার কথা পিতাকে খুলে বলে। পিতার কাছে সে সিদ্ধান্ত চায়। 

হিরণ্যধনু বলেন, ‘হীন জাতের বলে দ্রোণ তোমাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন নি। 

‘যথার্থ বলেছেন বাবা।’ 

‘তুমি বনে এসে তাঁরই মূর্তি গড়ে শরসাধনা করেছ এবং সার্থক হয়েছ।’

‘সার্থকতা অর্জন করেছি কি না জানি না, তবে বেশ কিছু দূর এগিয়েছিলাম।’ 

‘সে তোমার সৌজন্যবোধ। তুমি ঈর্ষণীয় ধনুর্ধর হয়ে না উঠলে অর্জুন সন্ত্রস্ত হতো না। এবং দ্রোণাচার্যকে হস্তিনাপুর থেকে ডেকে এনে তোমার মুখোমুখি দাঁড় করাত না। শুধু দাঁড় করিয়েই ছাড়ে নি অর্জুন, আমার বিশ্বাস, তোমা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে নানারকম মন্তব্য করে চরমভাবে উত্তেজিত করেছে দ্রোণাচার্যকে। তারই ফলশ্রুতি তোমার বুড়ো আঙুল কর্তন। কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি দায়ী কোরো?’ 

‘পিতা, বুঝে উঠতে পারছি না। তাই আপনার কাছে এসেছি।’ একলব্য বলল। হিরণ্যধনু বললেন, ‘একজন কাঠুরে কুড়াল দিয়ে গুঁড়ি কাটছে, গাছ যদি কাউকে দোষারোপ করতে চায়, কাকে বেশি দোষারোপ করবে, কুড়ালকে না কাঠুরেকে? 

একলব্য বলে উঠল, ‘অবশ্যই কাঠুরেকে। কুড়াল তো নিমিত্ত মাত্র।’ 

‘তোমার আঙুল কর্তনের ক্ষেত্রে দ্রোণাচার্য কুড়াল ছাড়া আর কিছুই নন, তিনি নিমিত্ত মাত্র। কলকাঠি নেড়েছে তো অর্জুন।’ 

‘আমি বুঝে গেছি বাবা।’ বলে পিতাকে প্রণাম করে নিজ কক্ষে ফিরে এল একলব্য। 

.

পরদিন কর্ণের একটি পত্র নিয়ে একজন দূত এল একলব্যের রাজসভায়। কর্ণ লিখেছে— একলব্য, আমার আশীর্বাদ জেনো। আমাকে তোমার মনে থাকার কথা। মিত্র দুর্যোধন তোমার কাছে কিছুদিন আগে একজন দূত পাঠিয়েছিল। তুমি সাড়া দাও নি। তুমি তো জানো, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নেমেছে কুরুরা। অধিকারের যুদ্ধ এটি। দুর্যোধনের রাজা হওয়াকে অস্বীকার করছে পাণ্ডবরা। রাজার ছেলেই তো রাজা হবে, যেমন তুমি হয়েছ। হস্তিনাপুরের মহারাজা ধৃতরাষ্ট্র, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্রের পরে রাজা হওয়ার সর্বাধিকার মিত্র দুর্যোধনের। পাণ্ডবরা এতে বাধা দিচ্ছে। এইজন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। অর্জুনের নির্মমতার কথা নিশ্চয়ই এখনো ভোলো নি তুমি। প্রতিশোধ নেওয়ার এটাই মোক্ষম সময় এবং সুযোগ। তাকে যুদ্ধে নিহত করে প্রমাণ কোরো—নিষাদরা অবহেলার নয়। আশা করি, আমার পত্রের মর্মার্থ বুঝতে পেরেছ। পত্রবাহককে তোমার মতামত জানাইও। 

ইতি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী 
সূতপুত্ৰ কৰ্ণ 

.

কর্ণের চিঠি পেয়ে একলব্যের সকল সংশয় কেটে গেল। ‘আমি আসছি’ লিখে দূতের হাতে দিয়ে যুদ্ধপ্রস্তুতিতে লেগে গেল একলব্য। 

কুরুক্ষেত্র বিশাল উষর ভূমি। গোটা ভূমিই সমতল। এর উত্তরে সরস্বতী আর দক্ষিণে দৃষদ্বতী নদী। এই দুই নদীর মধ্যবর্তী কুরুক্ষেত্র নামের সমতল ভূমির দুইদিকে কুরু শিবির আর পাণ্ডবশিবির স্থাপিত হলো। উভয় পক্ষের আঠারো অক্ষৌহিণী যোদ্ধা সমবেত হলো কুরুক্ষেত্রে। দুই লক্ষ আঠারো হাজার সাত শ যোদ্ধা নিয়ে এক একটা অক্ষৌহিণী। চতুর্দিকে ধুন্ধুমার কাণ্ড। 

যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। পাণ্ডবপক্ষের সেনাপতি নির্বাচিত হয়েছেন যুধিষ্ঠির। কুরুপক্ষের সেনাপতি কে হবেন, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিল। ভীষ্ম হবেন না দ্রোণ হবেন, না কর্ণ হবে—এ নিয়ে অনেক মতান্তর হলো। শেষ পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত দিলেন—পিতামহ ভীষ্মই প্রথমত সেনাপতি হওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু ওঁর তো মতামতের প্রয়োজন। 

দুর্যোধনকে ডেকে বললেন, ‘পুত্র, তুমি পিতামহের কাছে যাও। সসম্মানে তাঁকে সেনাপতিত্ব গ্রহণ করার প্রস্তাব দাও। শোনো, যে-কোনো মূল্যে তাঁকে রাজি করাতে হবে। তাঁর সমকক্ষ যোদ্ধা ভূভারতে নেই। তিনি সেনাপতি হলে জয় আমাদের নিশ্চিত।’ 

দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হলো। সঙ্গে অনুগামী রাজা মহারাজারা। দুর্যোধন জোড় হাতে বলল, ‘পিতার আদেশে এবং নিজের শ্রদ্ধায় আপনার কাছে এসেছি পিতামহ।’

‘কী প্রয়োজনে এসেছ এই বৃদ্ধের কাছে?’ অর্ধনিমীলিত চোখে জিজ্ঞেস করলেন ভীষ্ম। 

‘আগে বলুন—ফেরাবেন না।’ 

‘উদ্দেশ্য না জেনে কথা দিই কী করে?’ 

দুর্যোধন ভীষ্মের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিল না। সশ্রদ্ধায় বলল, ‘পর্বতের মধ্যে যেমন সুমেরু, পক্ষীদের মধ্যে গরুড়, দেবতাদের মধ্যে যেমন কার্তিক, এই কুরুবংশে আপনি তেমনই। আপনি সর্বদা আমাদের মঙ্গল কামনা করেন। 

ভীষ্ম দুর্যোধনের এই প্রশংসাবাক্যের সারকথা বুঝতে পারেন। প্রাজ্ঞ তিনি। আসল কথা শুনবার জন্য তিনি চুপ করে থাকলেন। 

দুর্যোধন মূল কথায় ফিরে আসে। বলে, ‘এই পৃথিবীর কোনো যোদ্ধা সমরে আপনাকে হারাতে পারবে না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আপনি কুরুপক্ষের প্রধান সেনাপতি হবেন, এই কামনা আমার।’ 

‘বয়স হয়ে গেছে আমার। যুদ্ধ করার স্পৃহা আর শক্তি আমার ফুরিয়ে গেছে।’

‘ওরকম করে বলবেন না পিতামহ। তাহলে আমরা সরস্বতীর জলে ভেসে যাব।’ বিগলিত হয়ে বলল দুর্যোধন। 

‘যুদ্ধের সময় কার্তিক দেবতাদের আগে আগে যান, আপনি তেমনি কুরুসৈন্যের সামনে সামনে যাবেন। আমাদের কাছে আপনি কার্তিকের চেয়েও অধিক।’ আরও বলল দুর্যোধন। 

দুর্যোধন যুবক হয়ে ওঠার পর থেকে কোনোদিন ভীষ্মকে মূল্যায়ন করে নি। আজ তাঁকে কার্তিক, গরুড়, সুমেরু পর্বতের সঙ্গে তুলনা করছে। কৌতুক বোধ করলেন পিতামহ। তবে তিনি অবাক হন না। তিনি জানেন, যুদ্ধ তাঁকে করতেই হবে এবং পাণ্ডবদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলে নিতে হবে হাতে। 

দুর্যোধনকে প্রত্যাখ্যান করলেন না তিনি। তবে জানালেন—তিনি যুদ্ধ করবেন বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের গায়ে হাত দেবেন না। নাতিদেরকে কখনো অস্ত্রাঘাত করবেন না। তবে এটা সত্যি যে, পাণ্ডবরা ছাড়া অন্য সবাইকে যমালয়ে পাঠাবেন তিনি। 

এরপর দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে রাগতকণ্ঠে ভীষ্ম বললেন, ‘একটা শর্ত আছে আমার।’ 

ত্রস্ত চোখে ভীষ্মের দিকে তাকাল দুর্যোধন। তার চোখ বলছে—কী শর্ত? 

‘আমি সেনাপতি থাকাকালে কর্ণ যুদ্ধ করতে পারবে না। হয় তাকে আগে সেনাপতি কোরো, আমি যুদ্ধ করব না, না হয় আমি সৈন্য পরিচালনা করি, সে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকুক।’ 

কর্ণও দুর্যোধনের সঙ্গে ভীষ্মকে অনুরোধ করতে এসেছিল। ভীষ্মের কথা শুনে তার মাথা গরম হয়ে গেল। সরোষে বলল, ‘মিত্র, তোমাদের পিতামহ এই ভীষ্ম বেঁচে থাকা অবস্থায় আমি মুহূর্তকালও যুদ্ধ করব না, এই আমার প্রতিজ্ঞা।’ 

দুর্যোধন নরমকণ্ঠে বলল, ‘আহা মিত্র, উত্তেজিত হচ্ছ কেন?’ 

কর্ণ দুর্যোধনের কথাকে কানে না তুলে উচ্চকণ্ঠে বলল, ‘ভীষ্ম মারা যাওয়ার পর আমি হাতে অস্ত্র তুলে নেব। এবং প্রথমে অর্জুনকেই নিধন করব আমি।’ 

দুর্যোধন কর্ণকে সামলে স্থান ত্যাগ করল। 

ভীষ্মের সেনাপতি পদে বরিত হওয়ার সংবাদ পাণ্ডবশিবিরে ত্বরিত পৌঁছে গেল। যুধিষ্ঠির সহোদর, কৃষ্ণ, দ্রুপদ, দ্রুপদেব অপর পুত্র শিখণ্ডী প্রমুখকে নিয়ে মন্ত্রণাসভায় বসল। ওই সময় শকুনির ছেলে উলূক সেখানে উপস্থিত হলো। শুধু পাণ্ডবদের গালাগাল দেওয়ার জন্যই দুর্যোধন উলূককে পাণ্ডবশিবিরে পাঠিয়েছিল। পাণ্ডবদের যথেষ্ট কটুকাটব্য করল উলূক। সেখানেই অর্জুন বলল, ‘দুর্যোধনকে গিয়ে বলো উলূক। কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মকে যুদ্ধক্ষেত্রেই বধ করব আমি। 

এই বার্তা শুনে দুর্যোধন ত্রস্ত পায়ে ভীষ্মের কাছে গেল। সব শুনে পিতামহ ভীষ্ম বললেন, ‘দেখো বৎস, সেনাপরিচালনা, ব্যূহরচনা, যুদ্ধপরিকল্পনা—এসব বিষয়ে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। আর প্রতিপক্ষের অস্ত্রনিবারণের ক্ষেত্রেও আমার জ্ঞান দেবগুরু বৃহস্পতির তুল্য। তোমার জন্য প্রাণ দেব আমি। তুমি ভয় পেয়ো না। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি তোমাকে, কোনো নারীকে অস্ত্রাঘাত করব না আমি।’ 

 এত অস্থিরতার মধ্যেও হেসে উঠল দুর্যোধন। বলল, ‘রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে কোন নারী যুদ্ধ করতে আসবে পিতামহ?’ 

‘বলে রাখলাম বস। কথাটা মনে রেখো।’ চিন্তান্বিত কণ্ঠে বললেন ভীষ্ম। 

ভীষ্ম বলেছিলেন—পাণ্ডবদের বিশাল বাহিনী ধ্বংস করতে এক মাস লাগবে। দ্রোণও বলেছিলেন—পাণ্ডবদের বিনাশ করতে তারও একমাস লাগবে। কর্ণ দর্পের সঙ্গে বলেছিল—এই যুদ্ধ শেষ করতে তার লাগবে মাত্র পাঁচ দিন। কিন্তু অসংখ্য জীবনবিনাশী এই যুদ্ধ চলেছিল মাত্র আঠারো দিন। উভয়পক্ষের আঠারো অক্ষৌহিনী সৈন্য মাত্র আঠারো দিনেই বিনাশ হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের ইঞ্চিপরিমাণ জমিও রক্তস্নাতহীন ছিল না। আঠারো দিনের যুদ্ধের দশ দিনের সেনাপতি ছিলেন পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর সেনাপতিত্বকালে কুরুসৈন্য ক্ষয় তেমন হয় নি, যেমন হয়েছে পাণ্ডবদের পক্ষের। দশ দিনের মাথায় কুরুপক্ষে সেই ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে এসেছিল। সেই বিপর্যয়ের আগের কথা অন্যরকম। 

যুদ্ধ শুরুর দিন উভয়পক্ষের সেনানায়করা মুখোমুখি দাঁড়াল। কুরুসৈন্যের সামনে পিতামহ ভীষ্ম আর পাণ্ডবদের সামনে যুধিষ্ঠির। হঠাৎ যুধিষ্ঠিরের কী হলো কে জানে। রথ থেকে নেমে এল যুধিষ্ঠির। বুকে আঁটা বর্মটি খুলে ফেলল। কৌরব সেনানায়কদের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। তার পিছু নিল অর্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব ও কৃষ্ণ। 

তাঁদের কাণ্ড দেখে কুরুসৈন্যদের মধ্যে উল্লাসধ্বনি উঠল। উচ্চস্বরে হেসে তারা বলল, ‘দেখ দেখরে, মহারাজ যুধিষ্ঠির ভয় পেয়ে গেছেন। ভীষ্মের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন তিনি।’ 

কাছে গিয়ে ভীষ্মের পা জড়িয়ে ধরল যুধিষ্ঠির। করুণ কণ্ঠে বলল, ‘আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে হবে আমাদের, ভাবি নি। দুর্ভাগ্য আমাদের, যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। যুদ্ধ করার অনুমতি দিন পিতামহ।’ 

প্রীতির চোখে পাণ্ডবপুত্রদের দিকে তাকালেন ভীষ্ম। একমাত্র তিনিই বুঝতে পারছেন এই মর্যাদার মর্মার্থ। কতটুকু শ্রদ্ধাবান হলে প্রতিপক্ষের সেনাপতির কাছে যুদ্ধারম্ভের অনুমতি চায় মানুষ। একমাত্র পাণ্ডবদের পক্ষেই সম্ভব এটা। উদ্ধত কৌরবদের পক্ষে এইরকম বিনয়প্রদর্শন কিছুতেই সম্ভব নয়। অত্যন্ত খুশি হলেন ভীষ্ম। 

সস্নেহে বললেন, ‘তুমি জয়লাভ করবে বৎস। এই যুদ্ধে পাণ্ডবদের পরাজয় হবে না। যুদ্ধের ঠিক পূর্বমূহূর্তে যে এরকম বিনয়ী ব্যবহার করতে পারে, তার কখনো পরাজয় হয় না। তোমাকে আমি কিছু একটা দিতে চাই, বলো কী চাও তুমি আমার কাছে?’ 

ওই সময় যুধিষ্ঠিরের পেছন থেকে ভীম বলে উঠল, ‘জ্যেষ্ঠ যা চাইবে, তা-ই দেবেন পিতামহ?’ 

ভীষ্ম বললেন, ‘মানুষ অর্থের দাস, অর্থ কারও দাসত্ব করে না। কৌরবরা আমাকে ভরণপোষণ করে। তাদের কাছে আমি অর্থের দায়ে আবদ্ধ। ওই দায়ের কারণে যুদ্ধ আমাকে করতেই হবে। যুদ্ধ না করার অনুরোধ কোরো না তোমরা আমাকে। এ ছাড়া, যা চাইবে, তা-ই পাবে তোমরা আমার কাছ থেকে।’ 

যুধিষ্ঠির বলল, ‘এই যুদ্ধে কীভাবে আপনাকে জয় করব পিতামহ? যুদ্ধে তো আপনি অজেয়। আমাদের পরামর্শ দিন, আপনাকে জয় করার উপায় কী।’ 

ভীষ্ম এখনই যুধিষ্ঠিরকে তাঁর মৃত্যুর উপায় বলে দিতে চান না। দুর্যোধনকে কথা দিয়েছেন— হাজার হাজার পাণ্ডবসৈন্য নিধন করবেন তিনি। একটুকুও যুদ্ধ না করে মরতে চান না তিনি। মৃদু হেসে নরম কণ্ঠে ভীষ্ম বললেন, ‘এই বেলাতেই মরতে চাই না আমি। কৌরবদের প্রতি আমার দায় আছে। কিছুদিন যুদ্ধ করে সে দায় মিটাতে চাই আমি। তা বৎস, তুমি আরেকবার এসো আমার কাছে। তখন আমার মৃত্যুর উপায় বলে দেব তোমাকে।’ 

যুধিষ্ঠিরাদি ভাইয়েরা পিতামহ ভীষ্মকে প্রণাম করে স্বস্থানে ফিরে গেল। 

.

যুদ্ধ শুরু হলো। মৃত্যু তার সকল সহচর নিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। শত সহস্র সৈন্য নিহত হতে থাকল। যুদ্ধরত সৈন্যরা আপনপর ভুলে গেল। তাদের মনে একটাই শপথ—প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে। পিতা পুত্রসম যোদ্ধাকে অস্ত্রাঘাত করতে লাগল, পুত্রসম ব্যক্তিও পিতাসম যোদ্ধাকে ছাড়ল না। মাতুল ভাগনেকে, ভাগনে মাতুলকে, ভাই ভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে, আত্মীয় আত্মীয়কে আঘাত করে যেতে লাগল। পিতামহ এরকম প্রাণঘাতী হানাহানি দেখে ইতিকর্তব্য ভুলে গিয়ে মর্মযাতনায় বিদ্ধ হতে থাকলেন। 

পরের দিনের যুদ্ধে ভীষ্ম সংহার মূর্তি ধারণ করলেন। শরাঘাতে শরাঘাতে সম্মুখবর্তী যোদ্ধাদের যমালয়ে পাঠাতে লাগলেন। তাঁর অদূরে যুদ্ধ করে যেতে লাগল একলব্য। পাণ্ডবসৈন্যদের হত্যায় পেয়ে বসেছে তাকে। কখনো তীরাঘাতে, কখনো গদাঘাতে, কখনো বা অসি চালিয়ে শত্রুসৈন্য নিধন করে গেল সে। তার মনে হলো- সে নাম না জানা পাণ্ডবসৈন্যকে হত্যা করছে না, হত্যা করছে এক একজন অর্জুনকে। নিষাদসৈন্যরাও রণোন্মত্ত হয়ে উঠল সেদিন। 

এই ভয়ংকর যুদ্ধ ক্রমাগত আট দিন চলল। সৈন্যক্ষয় হলো অগণিত। তুলনামূলকভাবে পাণ্ডবদের সৈন্য ধ্বংস হলো বেশি। তবে ভীমের হাতে দুর্যোধনের কয়েকজন সহোদর মারা গেল। ভীমপুত্র ঘটোৎকচের হাতে দুর্যোধন নাজেহাল হলো। ধীরে ধীরে যুদ্ধক্ষেত্রে পাণ্ডবদের আধিপত্য বিস্তৃত হতে থাকল। এতে দুর্যোধনের ক্ষোভের অন্ত থাকল না। ক্ষোভের সঙ্গেই বলল, ‘এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্য আমার। আর পাণ্ডুপুত্রদের মাত্র সাত অক্ষৌহিণী। তাদের সঙ্গে আমার সৈন্যরা এঁটে উঠছে না কেন?’ 

উপহাস করে কর্ণ বলল, ‘এত বিচলিত হচ্ছ কেন মিত্র? যুদ্ধের ফলাফল তো আমার আগেই জানা। একজন বুড়োকে সেনাপতি করেছ। শরীরের মতো মনও তো বুড়িয়ে গেছে তাঁর। বুড়ো মন থেকে বিচক্ষণ যুদ্ধপরিকল্পনা বের হবে? যুদ্ধ তো করব আমি। তোমাদের পিতামহকে মরতে দাও আগে। তারপর দেখো কীভাবে আমি পাণ্ডবদের নাস্তানাবুদ করি।’ 

কর্ণের কথায় উত্তেজিত হয়ে ভীষ্মের কাছে গিয়ে দুর্যোধন বলল, ‘যুদ্ধের কোনো ভালো ফলই তো পাচ্ছি না আমি। যদি আপনি মনে মনে ঠিক করেন যে, পাণ্ডবদের ছোঁবেন না, তাহলে আর সেনাপতি থাকা দরকার কী আপনার? ছেড়ে দিন সেনাপতিত্ব। কর্ণ যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নিক। সে পাণ্ডবদের কচুকাটা করুক।’ 

দুর্যোধনের কথায় ভীষ্ম একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। প্রচণ্ড ক্রোধ জন্মাল তাঁর। চক্ষু রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। অতিকষ্টে নিজেকে দমন করলেন তিনি। শান্তস্বরে বললেন, ‘অর্জুন দুর্দমনীয়। অর্জুনকে যুদ্ধে পরাস্ত করবে, এমন যোদ্ধা তোমার সৈন্যবাহিনীতে কোথায়? তাকে এমন একজন সাহায্য করছেন, সেই কৃষ্ণকে অতিক্রম করবে কে?’ 

তারপর রাগত কণ্ঠে বললেন, ‘মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে মানুষ পাগলের মতো আচরণ করে। তুমি পাগলপ্রায়। তুমি ভাবছ—কর্ণ সর্বজিৎ অর্জুনকে হত্যা করতে সক্ষম হবে, তা কখনো সম্ভব হবে না। আর এই যুদ্ধ বাঁধিয়েছ তুমি, তুমি একা পাণ্ডব- পাঞ্চালদের শেষ কোরো না কেন? দুর্যোধন, তুমি ঘরে ফিরে যাও, ভালো করে ঘুমাও। কাল যুদ্ধক্ষেত্রে আমার ভয়ংকর রূপ দেখবে।’ 

পরদিন শেষবেলার দিকে ভয় জাগানিয়া যুদ্ধ করলেন ভীষ্ম। সর্বক্ষণ তাঁর পাশে পাশে থাকল একলব্য। ভীষ্ম ভয়ংকর প্রাণঘাতী সব শর নিক্ষেপ করে করে পাণ্ডবসৈন্যদের বিনষ্ট করতে থাকলেন। 

অর্জুন অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল। ভীষ্মের দোর্দণ্ড প্রতাপের সংবাদ তার কাছে পৌঁছালে সারথি কৃষ্ণকে ভীষ্ম বরাবর রথচালনার নির্দেশ দিল। কিন্তু পথিমধ্যে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াল একলব্য। বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ অর্জুন? আমাকে কি মনে পড়ছে তোমার? সেই আঙুলকাটা একলব্য আমি। যার আঙুল দ্রোণাচার্যকে দিয়ে নির্মমভাবে কেটে নিয়েছিলে তুমি, সেই ভয়ংকর ধনুর্ধর একলব্য আমি। আগে আমাকে জয় কোরো। তারপর পিতামহকে বাধা দিতে যেয়ো।’ 

একবল্যকে লক্ষ্য করে চোখা চোখা গোটা কয়েক বাণ নিক্ষেপ করল অর্জুন। সব বাণই অর্ধপথে নিস্তেজ করে দিল একলব্য। তারপর অর্জুনের মস্তক লক্ষ্য করে শরের পর শর নিক্ষেপ করে গেল একলব্য। কিছু বাণ কাটতে পারল অর্জুন, কিছু পারল না। এক একটা বাণের আঘাতে অর্জুনের রথের ধ্বজা কাটা গেল, একটা শর অর্জুনের কান ঘেঁষে পেছনে চলে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখল অর্জুন। 

কৃষ্ণ উচ্চস্বরে বললেন, ‘মাথা কেটে নামিয়ে নাও নিষাদের। দাঁড়াও তুমি অর্জুন, আমি নামি। সুদর্শন চক্র দিয়ে মাথা কেটে আনি একলব্যের।’ 

প্রত্যুত্তরে কড়াকণ্ঠে একলব্য বলল, ‘মাথা তো কাটবেনই। আপনি তো প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী। বলেছিলেন-আপনি শুধু অর্জুনের রথ চালাবেন, যুদ্ধের সময় কখনো হাতে অস্ত্র তুলে নেবেন না। সুদর্শন চক্র অস্ত্র নয় বুঝি? পিতামহ ভীষ্মের প্রলয়ঙ্করতা থামানোর জন্য একবার তো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন, আরেকবার করলে ক্ষতি কী।’ বলে অর্জুনকে লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ একটা বাণ নিক্ষেপ করল একলব্য। 

এই সময় একলব্যকে পাণ্ডবসৈন্যরা ঘিরে ধরল। নিষাদসৈন্য আর পাণ্ডবসেনাদের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ বেঁধে গেল। অর্জুনের রথ ভীষ্মের সমীপে এগিয়ে গেল। অর্জুন- ভীষ্মের যুদ্ধ খুব বেশিদূর এগোল না। সূর্যাস্ত হলো। সূর্যাস্তে যুদ্ধ নিষিদ্ধ। 

নিরুপায় যুধিষ্ঠির কৃষ্ণার্জুনকে নিয়ে অতিগোপনে ভীষ্মশিবিরে গেল সেই রাতে। ভীষ্মের পায়ের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ল যুধিষ্ঠির, ‘আর যে পেরে উঠছি না পিতামহ। আপনার ভয়ংকর অস্ত্রের সামনে আমরা অসহায়। যুদ্ধজয়ের উপায় বলুন আমাদের 

‘একমাত্র আমার মৃত্যুই তোমাদের যুদ্ধজয় নিশ্চিত করবে।’ 

‘কী উপায়ে আপনার মৃত্যু হবে?’ নিচের দিকে চেয়ে কৃষ্ণ প্রশ্ন করলেন। 

উদার কণ্ঠে ভীষ্ম বললেন, ‘স্ত্রীলোক অথবা স্ত্রী নামধারী কারও ওপর অস্ত্রাঘাত করব না আমি।’ 

তারপর স্মিত মুখে কী যেন ভাবলেন তিনি অনেকক্ষণ। তারপর মুখ তুললেন, সেই মুখে স্বৰ্গীয় হাসি। ভীষ্ম বললেন, ‘ধৃষ্টদ্যুম ছাড়া দ্রুপদের আর একজন পুত্র শিখণ্ডী। সে আগে স্ত্রীলোক ছিল। স্ত্রীলোক আমার কাছে স্বর্গসমান পবিত্র, মাতৃসম মর্যাদাময়। সুতরাং তার গায়ে অস্ত্রাঘাত করব না আমি। অর্জুন তাকে সামনে রেখে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুক, শরে শরে ছিন্নভিন্ন করে দিক আমাকে।’ বলে মৌন হলেন ভীষ্ম। যুধিষ্ঠিরের শত প্রশ্নেও আর কোনো কথা বললেন না তিনি। 

.

যুদ্ধের দশম দিন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃদঙ্গ, ভেরি আর দুন্দুভি বেজে উঠল। আজকে পাণ্ডবসেনাদের সামনে থাকল শিখণ্ডী। তার পেছনে অর্জুন। শিখণ্ডীর সঙ্গে ভীষ্মের চোখাচোখি হলো। ভীষ্ম চোখ নামিয়ে নিলেন। অস্ত্র ত্যাগ করে রথের ওপর বসে থাকলেন তিনি। ক্রোধান্বিত শিখণ্ডী ভীষ্মের বুক লক্ষ্য করে তিনটি বাণ নিক্ষেপ করল। এরপর বাণের পর বাণ নিক্ষেপ করে গেল শিখণ্ডী। সামনে শিখণ্ডী পেছনে অর্জুন। আর প্রতিপক্ষে ভীষ্ম। শিখণ্ডী আর অর্জুনের যৌথবাণ নিক্ষেপণে পিতামহ জর্জরিত হলেন। অর্জুনের কঠিন বাণে শরবিদ্ধ কুরুপিতা ভীষ্ম আপন রথ থেকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেন। 

পাণ্ডবপক্ষে আনন্দধ্বনি আর কৌরবপক্ষে কান্নাধ্বনি উঠল। আনন্দ আর কান্নার মিশ্রিত ধ্বনি কুরুক্ষেত্রের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। 

চক্ষু নিমীলিত করে শরশয্যা গ্রহণের আগে ভীষ্মের চোখে জননী সত্যবতীর চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তাঁর কানে যেন ভেসে এল মা গঙ্গার আহ্বান ‘আয় ভীষ্ম, আয়। দীর্ঘদিন তোকে ছাড়া দিন কাটছে না আমার। তুই এসে আমার বুক ভরিয়ে তোল।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *