একলব্য – ৫

‘তদ্‌ভোগ্যং ভবিতা রাজ্যং সখে সত্যেন তে শপে।’ 
সত্য-প্রতিজ্ঞা করে বলছি, আমার রাজ্য আমার মতো তোমারও ভোগ্য হবে। 

.

এক প্রত্যুষে পিতার কাছ থেকে বিদায় নিলেন দ্রোণ। 

গোটা দিন হেঁটে পথ ফুরালেন। সাঁঝবেলায় বালক দ্রোণ অগ্নিবেশ্যের শিক্ষাশ্রমে উপস্থিত হলেন। আত্মপরিচয় দিলেন। বুকের কাছে দ্রোণকে টেনে নিলেন অগ্নিবেশ্য। শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করালেন। দ্রোণের আসার কারণ জানতে উৎসুক হলেন। কিন্তু সমস্ত দিনের কায়িক শ্রমের ক্লান্তি দ্রোণের চোখে-মুখে-দেহে। অগ্নিবেশ্য ঠিক করলেন—এখন নয়, কাল জিজ্ঞেস করা যাবে দ্রোণের আগমনের হেতু। তাঁর শোয়ার ব্যবস্থা করে নিজ কক্ষে গেলেন অগ্নিবেশ্য। 

বালক দ্রোণের আগমনের কারণ জেনে একটু বিস্মিতই হয়েছিলেন অগ্নিবেশ্য। যিনি নিজ হাতে তাঁকে অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়েছেন, তিনিই নিজ পুত্রকে পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে! সকল প্রকার অস্ত্রবিদ্যার আধার তো মহর্ষি ভরদ্বাজ। তাহলে নিজে পুত্রকে স্বহস্তে শিক্ষা না দিয়ে তাঁর কাছে পাঠালেন কেন? ভরদ্বাজ ত্রিকালজ্ঞ ঋষি। তিনি সৎবুদ্ধিসম্পন্ন। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো গূঢ় কারণ আছে। তিনি সবকিছু বিবেচনা করেই দ্রোণকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন নিশ্চয়ই। 

অগ্নিবেশ্য উচ্চবাচ্য করলেন না। দ্রোণকে শিষ্যত্বে দীক্ষা দিলেন। 

গুরুগৃহে শিক্ষার্থী দ্রোণের অবস্থান খুব সুখকর হলো না। ভরদ্বাজ-আশ্রমে তিনি ছিলেন আচার্যপুত্র। একটা বিশেষ উচ্চতায় তাঁর আদরযত্ন হতো। অগ্নিবেশ্য-আশ্রমে দ্রোণ সাধারণ শিষ্য ছাড়া আর কিছু নন। গুরুপুত্র বটে, কিন্তু শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে মুখ্য- গৌণ নেই। সবাই সমান। দ্রোণ আর অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থীকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা হতো। অপরাপর শিষ্যের মতো গুরুর সংসারের দেখভাল করতে হতো দ্রোণকে। ফলে তাঁর যথেষ্ট কায়িক পরিশ্রম হতো। 

অনেক কাল, অনেকটা বছর দ্রোণকে গুরুগৃহে থাকতে হয়েছে। বহিরিন্দ্রিয় আর অন্তরিন্দ্রিয় দমন করে সমস্ত বাহ্যসুখকে বিসর্জন দিয়েছেন দ্রোণ। ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। বিনয় শিক্ষা করেছেন। আর গুরুসেবা তো করেছেনই নিত্যদিন। তৈলহীন মলিনতায় দ্রোণের মাথার চুলে জট বেঁধেছে। তার পরও অবসাদ তাঁকে গ্রাস করে নি। কখনো কখনো বিষণ্ণতা তাঁকে বিব্রত করতে চেয়েছে, কিন্তু দ্রোণ গা-ঝাড়া দিয়ে সকল বিষণ্ণতাকে মন থেকে বের করে দিয়েছেন। তাঁকে যে আগ্নেয়াস্ত্র লাভ করতে হবে। 

অস্ত্রশিক্ষা ছিল পরিশ্রমের। অশেষ পরিশ্রমের মধ্যেও একটা ব্যাপার তাঁকে শান্তি দিত। তা হলো বন্ধুত্ব। দ্রুপদের বন্ধুত্ব তাঁর সকল ক্লান্তি-অবসাদ নিমিষেই হরণ করত। 

দ্রুপদের পিতা পৃষত। পৃষত পাঞ্চালদেশের রাজা। রাজা পৃষত ভরদ্বাজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একজন রাজার সঙ্গে ব্রাহ্মণ-ঋষি ভরদ্বাজের বন্ধুত্বের একটা কারণ ছিল। ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও অস্ত্রবিদ্যা খুব ভালোই জানতেন। রাজা পৃষতেরও অস্ত্রকৌশল জানা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু বয়স আর আভিজাত্য সমানুপাতিক হওয়ায় নিজে শিষ্য হতে না এসে রাজা পৃষত ভরদ্বাজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে নিজপুত্র দ্রুপদকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভরদ্বাজ-আশ্রমে তো ঋক সাম যজুর্বেদ পড়ানো হয়, অস্ত্রশিক্ষা তো দেওয়া হয় না। এই ত্রৈবিদ্যা পড়ার অছিলায় ভরদ্বাজের কাছে দ্রুপদের অস্ত্রশিক্ষা করানোটাই পৃষতের মূল উদ্দেশ্য ছিল। পৃষত মনে মনে জানতেন—ক্ষত্রিয়োচিত অস্ত্রশিক্ষার প্রতি ভরদ্বাজের এতটাই আগ্রহ যে, একসময়ে না একসময়ে দ্রোণকে তিনি অস্ত্রশিক্ষা দেবেনই। সেই সুযোগ দ্রুপদও নিতে পারবেন। শাস্ত্র বা অস্ত্র—পুত্ৰদ্ৰোণকে ঋষি ভরদ্বাজ যে শিক্ষাই দেন না কেন, দ্রুপদকে বাদ দিয়ে দেবেন না। সেইজন্য বালক দ্রুপদকে ভরদ্বাজ-আশ্রমে পাঠিয়েছেন রাজা পৃষত 

একটা সময়ে পৃষতের বিশ্বাস সত্যে পরিণত হলো। ভরদ্বাজ যখন দ্রোণকে অগ্নিবেশ্যের কাছে পাঠালেন, পৃষতপুত্র দ্রুপদেরও স্থান হলো অগ্নিবেশ্যের আশ্রমে। দুজনে গুরুগৃহে আবাসিক হলেন। সুখ-দুঃখ, বঞ্চনা-প্রাপ্তি, পূর্বলব্ধ কষ্ট এবং ভবিষ্যতের বাসনা—এইসব কিছু দুজনে ভাগাভাগি করেন। 

এইভাবে ব্রাহ্মণ দ্রোণের সঙ্গে পাঞ্চাল রাজপুত্র দ্রুপদের একটা নিবিড় নৈকট্য তৈরি হয়ে গেল। গুরুগৃহে একই সমতলে জীবন যাপন করলে এবং একই শিক্ষা গ্রহণ করলে মানুষের মধ্যে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ থাকে না। ধনী-দরিদ্রের প্রভেদও ঘুচে যায় আবাসিক শিক্ষার্থীদের মন থেকে। দরিদ্রপুত্র দ্রোণের প্রতি রাজপুত্র দ্রুপদ সর্বদা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখতেন। দ্রোণ খুব কৃতজ্ঞতা পোষণ করতেন দ্রুপদের প্রতি। দুই অসম পরিবারের দুই বালকের মধ্যে বন্ধুত্ব ও প্রিয়ত্ব গাঢ়তর হয়েছিল। 

এইভাবে দিন গেছে, রাত গেছে, বছর গেছে, যুগও গেছে। দ্রোণ আর দ্রুপদ বালক থেকে যুবকে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়াও সমাপনের কাছাকাছি। 

একদিন দ্রুপদ দ্রোণকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দীর্ঘদিন তোমাকে একটি প্রশ্ন করব বলে মনস্থির করে রেখেছি। কিন্তু একটা সংকোচ এসে আমাকে ঘিরে ধরে। প্রশ্নটা না করাই থেকে যায়।’ 

‘কী প্রশ্ন তোমার?’ দ্রোণ সামনের বৃক্ষরাজির দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে জিজ্ঞেস করেন। 

‘তুমি তো ব্রাহ্মণ। যজনযাজন তোমার বৃত্তি। শাস্ত্রাদি পাঠ করে নিজেকে এবং তোমার চারদিকের মানুষজনকে আলোকিত করা তোমার কাজ। এই বৃত্তি ছেড়ে অস্ত্রবিদ্যার প্রতি তুমি অনুরাগী হলে কেন?’ 

দ্রুপদের কথা শুনে দ্রোণ কোনো জবাব দিলেন না। উদাস চোখে দ্রুপদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। দ্রুপদ দ্রোণের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু দ্রোণ কোনো উত্তর দিচ্ছেন না দেখে দ্রুপদ আবার বললেন, ‘ত্যাগ আর বৈরাগ্য ব্রাহ্মণের ভিত্তি।’ 

‘দারিদ্র্যও। ব্রাহ্মণরা আজীবন দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হবে। ভিক্ষুকের মতো ক্ষত্রিয়ের দান গ্রহণ করবে। দানের অর্থ ফুরিয়ে গেলে রাজা বা রাজন্যের সামনে ধনের জন্য আবার হাঁটু গেড়ে বসবে। এই তো! এই তো ব্রাহ্মণের জীবন?’ উম্মা মিশ্রিত কণ্ঠে দ্রুত কথাগুলো বলে গেলেন দ্রোণ। 

দ্রোণের কথায় দ্রুপদ থতোমতো খেয়ে গেলেন। কোনোদিন দ্রোণকে রাগতে দেখেন নি দ্রুপদ। সর্বদা বন্ধুর সঙ্গে নরমকণ্ঠে মিষ্টি সুরে কথা বলেছেন। আজ সামান্য একটা প্রশ্নে দ্রোণ এত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কেন-বুঝে উঠতে পারছিলেন না দ্রুপদ। কী বলবেন—তাও ঠিক করতে পারছিলেন না। চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলেন। মাথা নিচু করে বন্ধুর পাশে বসে থাকলেন দ্রুপদ। 

দ্রোণ নিজকে সংযত করলেন। দ্রুত নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। বন্ধুর কাছে সরে এলেন। দ্রুপদের গলা জড়িয়ে নিজের দিকে টানলেন। মৃদুস্বরে বললেন, ‘ক্ষমা কোরো বন্ধু তুমি আমাকে। ক্রোধ আমাকে বাস্তবতা ভুলিয়েছিল। ক্রোধ বড় মারাত্মক রিপু। পৃথিবীর অধিকাংশ জীবননাশী কাজ ক্রোধের কারণে হয়ে থাকে। 

এরপর কণ্ঠকে আরও নিচু করে দ্রোণ বলতে লাগলেন, ‘আমার পিতা ভারতবর্ষের অত্যন্ত খ্যাতিমান একজন ঋষি। সবার কাছে তিনি প্রণম্য। তাঁর জ্ঞান, তাঁর বিচক্ষণতা, তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনার জন্য এই ব্রহ্মাণ্ড তাঁর সামনে ঝুঁকে আছে। কিন্তু বন্ধু, শুধু জ্ঞান আর সম্মান দিয়ে তো পেট চলে না। শিষ্যদের মাধুকরী বৃত্তির কারণে তপোবনে দুবেলা আহার জুটত। খুব ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্যকে দেখে দেখে আমার ব্রাহ্মণ্যবৃত্তির প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে।’ 

‘ঘৃণা ধরে গেছে!’ বিস্মিত দৃষ্টি দ্রুপদের। 

‘হ্যাঁ, শিশুকাল থেকে অশ্রদ্ধা করতে শুরু করি আমি এই জপ-তপ-শাস্ত্রপাঠকে। কিন্তু তা করেছি মনে মনে। বাবাকে বড় ভয় ও শ্রদ্ধা করতাম। বাবা চাইলে আমাদের তপোবনের দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দিতে পারতেন। 

‘কেমন করে পারতেন গুরুদেব দারিদ্র্য ঘোচাতে?’ 

‘বাবা যদি ধনুর্বিদ্যা শিক্ষাকে মূল বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন, তাহলে অনেক ক্ষত্রিয়শিষ্য জুটত তাঁর। অর্থ সমাগম হতো প্রচুর। তাহলে কী হতো ভেবে দেখো।’ 

‘তোমার বাবা তো ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণোচিত বৃত্তিকে অবলম্বন করাই তো তাঁর ধর্ম।’ এবার দ্রোণ বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এই ধর্মকে আমি মানি না। একজন মানুষ চাইলে তার বৃত্তি পরিবর্তন করতে পারবে না কেন? ব্রাহ্মণরা যজনযাজন আর অহংকার নিয়েই শতাব্দীর পর শতাব্দী কাটিয়ে দিল। আমার এই অহংকার নেই। আমি পরিবর্তন আনতে চাই এই প্রথার।’ 

‘পরিবর্তন আনতে চাও? কী করে?’ 

‘ব্রাহ্মণ্যবৃত্তির প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই। ব্রাহ্মণরা সারাটা কাল ধনশালী আর ক্ষমতাবানদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে—তাও মানি না। একজন ব্রাহ্মণ অস্ত্রবিদ হলে দোষের কী? আমি ধনুর্বিদ হলে আমার দারিদ্র্য ঘুচবে, আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে—এই আশা তো করতে পারি আমি, কী বলো?’ 

দ্রোণের যুক্তির সামনে দ্রুপদ অনেকটা নির্বাক হয়ে গেলেন। শাস্ত্রের কোথাও এমন করে লিখা নেই যে, একজন ব্রাহ্মণসন্তান যুদ্ধ করতে পারবে না, একজন ব্রাহ্মণসন্তান অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করে ক্ষত্রিয়োচিত অস্ত্রবিদ্যায় দক্ষ হতে পারবে না। আর ব্রাহ্মণরা সারা জীবন দারিদ্র্যে ডুবে থাকবেন কেন? তাঁদের কি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে নেই? অবশ্যই আছে। দ্রোণের যুক্তি অকাট্য। গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন দ্রুপদ। দ্রোণের উচ্চ কণ্ঠে সংবিৎ ফিরল তাঁর। দ্রোণ বললেন, ‘কিছু বলছ না যে!’ 

‘তোমার যুক্তি যথার্থ।’ 

‘সেইজন্য বাবাকে হাতেপায়ে ধরে আমি রাজি করিয়েছি। আমারই প্রবল অনুরোধে তিনি আমাকে গুরুদেব অগ্নিবেশ্যের আশ্রমে পাঠিয়েছেন। শোনো দ্রুপদ, ব্রাহ্মণের যা স্বধর্ম, সেই যজনযাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা অথবা দান প্রতিগ্রহণের যে সরলজীবন তা আমি চাই না। এই জীবনে সম্মান থাকতে পারে, মুগ্ধতা নেই।’ বললেন দ্রোণ। 

একটু মৃদু হেসে দ্রুপদ বললেন, ‘মানে তুমি তোমার জীবনের ধারাকে পাল্টে ফেলতে চাও?’ 

‘হ্যাঁ, যথার্থ বলেছ তুমি। আমি চাই উজ্জ্বল সমৃদ্ধির জীবন। যে জীবনে অর্থ, সম্মান, ভোগ, দাস-দাসী, হস্তী-অশ্ব-রথ আছে, সেই জীবনকে আমি করতলগত করতে চাই।’ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন দ্রোণ। অনেকটা স্বগত কণ্ঠে বললেন, ‘জানি না, এইরকম সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী আমি হতে পারব কি না।’ 

‘তুমি অতশত ভাবছ কেন দ্রোণ? আমি আছি না!’ 

‘মানে!’ দ্রুপদের কথার মানে দ্রোণ ধরতে পারলেন না। 

‘শোনো, তুমি কত বড় ধনুর্ধর হবে আমি জানি না। তবে তুমি যে ভবিষ্যতে একজন ধনবান হবে, মানে রাজা হবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। 

‘ঠাট্টা করছ আমাকে? যার পিতার প্রধান অলঙ্কার দারিদ্র্য, যে সারাটা জীবন অর্ধেকপেট খেয়ে, সামান্য পরিধান করে কাটিয়ে দিল, সে হবে ধনবান রাজা!’ তারপর একটু থেমে দ্রোণ বললেন, ‘রাজপুত্র তুমি। পাঞ্চালের ভবিষ্যৎ নরপতিও বটে। তোমার উপহাসটা তো রাজকীয় হওয়া চাই। হয়েছেও বটে। রাজা হব আমি!’ বলে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন দ্রোণ। 

পরম ভালোবাসায় দ্রোণের হাতটা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে টেনে নিলেন দ্রুপদ। বললেন, ‘আমি তোমাকে বিদ্রূপ করি নি বন্ধু। সত্য কথাটাই বলেছি। তুমিই তো বলেছ পাঞ্চালের ভবিষ্যৎ-রাজা আমি। আমি বাবার একমাত্র পুত্র। বাবার পরে আমিই রাজা হব পাঞ্চাল দেশের। পিতার বড় আদরের সন্তান আমি। আমি কথা দিচ্ছি—বাবা যেদিন আমাকে তাঁর রাজ্যে অভিষিক্ত করবেন, সেদিন আমার রাজ্য আমার মতো তোমারও ভোগ্য হবে।’ 

দ্রোণ দ্রুপদের কথার কোনো অর্থ বুঝলেন না। ফ্যালফ্যাল করে নিষ্পলক চোখে দ্রুপদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন শুধু। 

‘বুঝতে পারো নি তো আমার কথা?’ জিজ্ঞেস করলেন দ্রুপদ। 

দ্রোণ ডানে-বামে মাথা নাড়লেন। 

কোমল কণ্ঠে দ্রুপদ বললেন, ‘প্রথম কথা—আমি তোমাকে বড় ভালোবাসি দ্রোণ। দ্বিতীয় কথা—আমি যা বলেছি, মিথ্যে বলি নি। আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করে বলছি, তুমি নিশ্চিত থাকো…আমি রাজা হলে আমার রাজ্যের অর্ধেক হবে তোমার। ওই অর্ধেক রাজ্যের রাজা হবে তুমি। রাজা হলে তোমার বাসনার পরিপূরণ হবে। তোমার দারিদ্র্য ঘুচবে। অর্থ-বৈভব, দাস-দাসী—সবই হবে তোমার।’ 

দ্রোণ তখনো তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ কী বলছেন দ্ৰুপদ? বালসুলভ বাগাড়ম্বর, না রাজাসুলভ প্রতিজ্ঞা? দ্রুপদ শুধু ‘প্রতিজ্ঞা করছি’ বললেন না। বললেন, ‘সত্য প্রতিজ্ঞা করে বলছি।’ সত্য শব্দটির সঙ্গে তো ধর্ম জড়িত। তাহলে দ্রুপদ কি ধর্মের নামে প্রতিজ্ঞা করে বলছেন যে, ওঁর অর্থ, সুখভোগ তাঁরও অধীন হবে? 

অন্তর্দ্বন্দ্বের ছাপ দ্রোণের চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। দ্রুপদ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন দ্রোণের ভেতরে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের একটা প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব চলছে। তাঁর কথা বিশ্বাস করবেন, না উড়িয়ে দেবেন—এ নিয়ে বিপুলভাবে বিচলিত দ্রোণ। তাঁর এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো দরকার। 

স্পষ্ট ভাষায় দ্রুপদ বলে উঠলেন, ‘তদ্‌ভোগ্যং ভবিতা রাজ্যং সখে সত্যেন তে শপে।’ 

দ্রুপদের স্পষ্ট প্রতিজ্ঞাবাণী শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন দ্রোণ। সহসা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর দেখাদেখি দ্রুপদও দণ্ডায়মান হলেন। দ্রোণ হঠাৎ বুকের কাছে টেনে নিলেন দ্রুপদকে। 

.

দ্বিপ্রহর। দুপুরে অগ্নিবেশ্য সশিষ্য আহার করেন। 

তাঁকে ঘিরে শিষ্যরা বৃত্তাকারে ভোজনে বসেন। প্রত্যেকের সামনে কলাপাতা রাখা হয়। সেখানে নানা ফলমূল। একাংশে অন্ন আর ব্যঞ্জন। প্রথমে সকলে ফল খান, তারপর ব্যঞ্জনান্ন। কিন্তু সর্বপ্রথমে আচমন করেন। জলপাত্র থেকে ডান হাতে জল নিয়ে কদলিপত্রের চারপাশে ছিটিয়ে দেন। ডান হাতের বুড়ো-তর্জনী-মধ্যমা সহযোগে সামান্য ব্যঞ্জনান্ন তুলে নেন সকলে। তারপর ডান হাতটা কপালে ঠেকান। স্রষ্টার উদ্দেশে ওই ব্যঞ্জনান্ন জলসিঞ্চিত স্থানে ভক্তিভরে রাখেন। তারপর খাওয়া শুরু করেন। গুরুদেব খাদ্য মুখে নিলে অন্যরা খাওয়া শুরু করেন। এটাই আশ্রমের বিধি। খাওয়া শেষ করে অগ্নিবেশ্য গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। কয়েক ঘটিকা দিবানিদ্রায় কাটান তিনি। 

সেদিন খাওয়ার পর নিজ কক্ষে গেলেন না অগ্নিবেশ্য। উঠানের মাঝখানে একটা বৃহৎ বিল্ববৃক্ষ। তার গোড়া মাটি দিয়ে বাঁধানো। সাধারণত ওখানেই গুরুদেব গিয়ে বসেন। শিষ্যদের সঙ্গে শাস্ত্রালাপ করেন। আজকে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটালেন অগ্নিবেশ্য। অন্যদের বিশ্রামাগারে পাঠিয়ে দ্রোণ আর দ্রুপদকে থেকে যেতে বললেন। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে বিল্ববৃক্ষের গোড়ায় বাঁধানো বেদিতে গিয়ে বসলেন গুরুদেব। 

দ্রোণ-দ্রুপদ বিস্মিতই হলেন। এই ভরদুপুরে কোন কথাটা বলবেন বলে গুরুদেব দুজনকে ডেকে আনলেন এখানে! নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু। দুজনের বক্ষই দুরু দুরু। অজান্তে কোনো অপরাধ করে ফেলেন নি তো! অগ্নিবেশ্যের সামনে যোগাসনে বসলেন দুজনে। বৃক্ষের গোড়াটা ছায়াচ্ছন্ন। দুজনে প্রশ্নবোধক চোখে গুরুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। 

অগ্নিবেশ্য শিষ্য দুজনের ত্রস্ততার ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘তোমরা সন্ত্রস্ত হয়ো না। একটা বিষয় তোমাদের বলব বলে এখানে ডেকে এনেছি।’ 

তারপর মমতাভরা তৃপ্তির চোখে শিষ্য দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অগ্নিবেশ্য। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘তোমাদের বিদ্যার্জন সম্পন্ন হয়েছে। তোমরা এখন নিজ গৃহে ফিরে যেতে পারো। আমার যা কিছু জানা, তার প্রায় সবটাই তোমাদের শিখিয়ে দিয়েছি। তোমরা এখন যুবক হয়ে উঠেছ। তোমরা যেমন অসি চালনায় দক্ষ হয়ে উঠেছ, তেমনি তীর চালনাতেও। তোমরা এখন জগতের খ্যাতিমান ধনুর্ধর। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিধর হয়ে উঠবে তোমরা। তোমাদের ধৈর্য, জ্ঞানাহরণাগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমরা কষ্টসহিষ্ণু আর অধ্যবসায়ী। আর শিষ্যজীবনের সবচেয়ে বড় গুণ যেটা, সেই বিনম্র শ্রদ্ধাবোধ তোমাদের মধ্যে সম্পূর্ণত বিরাজমান। বাহুবলে, শারীরিক শক্তিতে আর অস্ত্রবিদ্যায় তোমরা পূর্ণ হয়ে উঠেছ। বৎসদ্বয়, তোমরা আমার আশীর্বাদপুষ্ট হয়েছ। তোমরা নিজ নিজ আলয়ে ফিরে যাও। আগামীকালই চলে যেতে পারো তোমরা। আজীবন তোমাদের ওপর আমার আশীর্বাদ বর্ষিত হবে।’ দীর্ঘক্ষণ কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছেন অগ্নিবেশ্য। তাঁর কপালে স্বেদবিন্দু। 

দ্রুপদ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন গুরুদেবকে। জোড়হাতে বললেন, ‘তাহলে আমি যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি গুরুদেব?’ 

‘অবশ্যই।’ অগ্নিবেশ্য দ্রুপদকে অবশ্যই বললেন বটে, কিন্তু কপালটা তাঁর সামান্য কুঁচকানো। দৃষ্টি তাঁর দ্রোণের ওপর নিবদ্ধ। 

দ্রুপদ যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেও, গুরুদেবকে প্রণাম করলেও দ্রোণ তার কিছুই করলেন না। পূর্ববৎ যোগাসনে বসে রইলেন। চোখ ইশারায় দ্রুপদকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে দ্রোণের দিকে তাকালেন অগ্নিবেশ্য। 

এ রকম অবস্থায় আশ্রম-আশ্রিত শিক্ষার্থীরা সাধারণত উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। দীর্ঘদিন পরিবার-পরিজন বিচ্ছিন্ন থাকার দরুন তাঁদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা-অস্বস্তি তৈরি হয়। পিতা-মাতার জন্য, স্বস্থানের অধিবাসীদের জন্য, সর্বোপরি পরিচিত গৃহকোণের জন্য তাঁদের ভেতর চাপা হাহাকারের সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো আশ্ৰমজীবনকে বন্দিজীবন বলেও মনে হয় তাঁদের। গুরুর এ ধরনের আশীর্বাদপুষ্ট অনুমতি পেলে সেই বন্দিজীবনে মুক্তজীবনের হাওয়া বয়। ভেতরের রুদ্ধ সব অর্গল খুলে যায় তাঁদের। স্বগৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্র আগ্রহ সৃষ্টি হয় তাঁদের মধ্যে। 

দ্রুপদের মধ্যে সেই স্বাভাবিক আগ্রহ দেখে অগ্নিবেশ্য অখুশি হলেন না, বরং তৃপ্তিবোধ করলেন। কিন্তু বিচলিত বোধ করতে লাগলেন দ্রোণের মধ্যে কোনো ভাবান্তর না দেখে। দ্রোণ তো মানুষ, স্বাভাবিক মানুষ। তাঁর মধ্যে রাগ-অনুরাগ আছে। ক্রোধ- অস্থিরতা আছে। হাস্য-পরিহাসপ্রিয়তাও কখনো কখনো অগ্নিবেশ্য দ্রোণের মধ্যে লক্ষ করেছেন। পিতা ভরদ্বাজের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভক্তি। দীর্ঘদিন সেই পিতা থেকে দ্রোণ দূরে আছেন। পিতাকে দেখার প্রচণ্ড আগ্রহ তো তাঁর মধ্যে থাকা উচিত। কিন্তু কোথায়, তাঁর কথা শুনে সে রকম কোনো ব্যগ্রতা তো দ্রোণের মধ্যে দেখা গেল না? কী কারণ? তাঁর অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা কি অসম্পূর্ণ থেকে গেছে? না কোনো গোপন কথা বলতে চান দ্রোণ? মনের ভেতর আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখলেন অগ্নিবেশ্য-দ্রোণের কোনো শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে কি না। সেরকম কোনো কিছুই খুঁজে পেলেন না নিজের মধ্যে। তাহলে দ্রোণের এই অস্বাভাবিকতার কারণ কী? কপাল কুঁচকে প্রশ্নবোধক চোখে শিষ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন গুরুদেব। 

দ্রুপদ সেস্থান থেকে অপসৃত হলে দ্রোণ করজোড়ে বললেন, ‘মহাত্মন, আমি বুঝতে পারছি, আমার অস্বাভাবিক আচরণে আপনি বিচলিত বোধ করছেন। আমার একটা নিবেদন আছে বলে দ্রুপদের মতো স্বাভাবিক আচরণ করি নি আপনার সামনে।

‘কী তোমার নিবেদন?’ অগ্নিবেশ্যের চোখ আর কপাল থেকে বিস্ময়ের চিহ্ন তখনো মুছে যায় নি। 

‘আমার অস্ত্রবিদ্যার্জন এখনো সম্পন্ন হয় নি।’

‘সম্পন্ন হয় নি!’ 

‘না, মহাত্মন! আমার শিক্ষা এখনো অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।’ 

তোমার কথা আমি ঠিকমতন বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে বলো।’ কিছুটা বিরক্তি অগ্নিবেশ্যের কথায়। 

‘আপনি সকল অস্ত্রবিষয়ে আমাকে জ্ঞান দান করেছেন, শুধু একটা অস্ত্র ছাড়া।’

‘কোন অস্ত্রের কথা বলছ তুমি?’ 

দ্রোণ মাথা নত করে নরম স্বরে বললেন, ‘ব্রহ্মাস্ত্র। ব্রহ্মাস্ত্র লাভ হয় নি আমার এখনো।’ 

অগ্নিবেশ্যের সহসা আগ্নেয় অস্ত্রটির কথা মনে পড়ে গেল। এই অস্ত্রবিদ্যাটি তিনি তো দ্রোণপিতা ভরদ্বাজের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। প্রথমে গুরুদেব ভরদ্বাজ দ্বিধান্বিত ছিলেন এই অস্ত্রটি অগ্নিবেশ্যের হাতে অর্পণ করবেন কি না। পরে তাঁর আনুগত্য, সহনশীলতা, অধ্যবসায় আর সৌম্যভাব দেখে ভরদ্বাজ মত পাল্টেছিলেন। ব্রহ্মাস্ত্রটি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। 

ব্রহ্মাস্ত্রের কথা দ্রোণ জানল কোথা থেকে? নিশ্চয়ই পিতার কাছ থেকে জেনেছেন। এই আগ্নেয় অস্ত্রটি কি দ্রোণকে দেওয়া উচিত? গুরুদেব ভরদ্বাজ বলেছিলেন—এই অস্ত্র যার-তার জন্য নয়। যে ক্রোধের অধীন, যে কষ্টসহিষ্ণু নয়, যার হিতাহিত জ্ঞান স্বল্প, সে কখনো এই অস্ত্র পাওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু দ্রোণের তো এই গুণগুলো আছে। তিনি তো অস্ত্রটি পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। 

আর একটি বিষয় অগ্নিবেশ্যের মাথায় খেলে গেল। গুরুদেব ভরদ্বাজও বোধ হয় চান যে, দ্রোণ ব্রহ্মাস্ত্রের অধিকারী হোক। সেই কারণেই হয়তো শিষ্য হিসেবে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন দ্রোণকে। নইলে অন্য কোনো অস্ত্রগুরুর কাছে দ্রোণকে পাঠাতেন তিনি। অন্য অস্ত্রগুরুরা তো ব্রহ্মাস্ত্রের সন্ধান জানেন না। 

এসব কথা ভাবতে ভাবতে অগ্নিবেশ্য বললেন, ‘বৎস, বড় দুর্দমনীয় অস্ত্র এটি। জগতের কয়েকজন মাত্র জানেন এই অস্ত্রের বিদ্যাটি। অসহিষ্ণু, ক্রোধান্বিত মানুষের হাতে এই চরম অস্ত্রটি পড়লে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছারখার হয়ে যাবে।’ 

 ‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি—ক্রোধ-লোভ-মোহ দ্বারা আমি কখনো প্রভাবিত হব না।

অগ্নিবেশ্য স্থির চোখে দ্রোণের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে পেলেন—এই যুবকটি ভবিষ্যতে অস্ত্রসাধনায় ভুবনবিখ্যাত হয়ে উঠবেন। পরবর্তী প্রজন্মের গুরু হওয়ার সকল গুণ অগ্নিবেশ্য তাঁর এই শিষ্যটির মধ্যে স্পষ্ট অনুভব করতে লাগলেন। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, ব্রহ্মাস্ত্রটি তিনি দ্রোণের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু তার আগে দ্রোণের সঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। 

অগ্নিবেশ্য বললেন, ‘বৎস দ্রোণ, এই অস্ত্রটির প্রকৃত নাম ব্রহ্মশির। এটি মারাত্মক এক অস্ত্র। বিধ্বংসী, সর্বগ্রাসী। অতি ভয়ংকর এই ব্রহ্মশির নিমিষেই শত-সহস্র মানুষকে নিধন করার ক্ষমতা রাখে।’ 

‘পিতার কাছে শুনেছি ব্রহ্মাস্ত্রের বিপুল ভয়ঙ্করতার কথা।’ বললেন দ্রোণ। 

অগ্নিবেশ্য বললেন, ‘অস্ত্র-শিক্ষার সঙ্গে অস্ত্র প্রয়োগের সংযম যার মধ্যে আছে, সে- ই শুধু এই ব্রহ্মাস্ত্রটি পাওয়ার অধিকার রাখে।’ 

দ্রোণ কথা বললেন না। একাগ্রচিত্তে অগ্নিবেশ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ‘তোমাকে আমি ব্রহ্মাস্ত্রটি প্রদান করব। কিন্তু তার আগে প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোমায়।’ বললেন অগ্নিবেশ্য। 

‘কী প্রতিজ্ঞা গুরুদেব?’ দ্রোণের দু’চোখে আনন্দ-আলো ছড়িয়ে পড়ল। 

এবার অগ্নিবেশ্য গুরুগম্ভীর গলায় আদেশের সুরে বললেন, ‘এই অস্ত্র কখনো সাধারণ মানুষের ওপর প্রয়োগ করতে পারবে না। স্বল্পশক্তির যোদ্ধাকে এই মারাত্মক অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করতে পারবে না। বলো, এই দুটো শর্ত তুমি মেনে চলবে কি না?’

‘আপনার আদেশ শিরোধার্য করে রাখব আমি।’ বিনীত কণ্ঠে বললেন দ্রোণ। 

.

গুরুগৃহে অস্ত্রচর্চার শেষ পুরস্কার পেলেন দ্রোণ। ঋষি অগ্নিবেশ্য ব্রহ্মশির অস্ত্রটির মন্ত্র এবং এটি ছোড়ার কৌশল অতিযত্নে দ্রোণকে শিখিয়ে দিলেন। 

ব্রহ্মাস্ত্র পাওয়ার পর দ্রোণ পিতৃ-আশ্রমে ফিরে এলেন। এই সময় তাঁর মনে পরম সন্তুষ্টি থাকার কথা। কিন্তু অস্ত্রবিদ্যা শেখা আর ব্রহ্মাস্ত্র প্রাপ্তির ফলে তাঁর মনে যেরকম তৃপ্তি থাকার কথা, সে রকম আনন্দ তিনি নিজের মধ্যে অনুভব করছেন না। আরও শেখার, আরও অর্জন করার জন্য প্রবল উচাটনভাব তাঁর মধ্যে বিরাজ করতে লাগল। তিনি বুঝতে পারছেন, ঋষি অগ্নিবেশ্যের কাছ থেকে অর্জিত অস্ত্রবিদ্যা শেষবিদ্যা নয়। অগ্নিবেশ্যের চেয়ে আরও মহৎ অস্ত্রশিক্ষাগুরু এই ভারতবর্ষে নিশ্চয়ই আছেন। তাঁদের কাছ থেকে বিদ্যার্জনের জন্য প্রচণ্ড একটা আকাঙ্ক্ষা দ্রোণকে আকুল করে তুলল। 

.

কার কাছে যাবেন তিনি? কোন মহৎ অস্ত্রবিদ তাঁকে শ্রেষ্ঠতমের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন? 

এই সময় তিনি পরশুরামের কথা অবগত হলেন। পরশুরাম মহাপরাক্রমশালী ঋষি। তিনি ধনুর্বেদ এবং অস্ত্রবিদ্যায় অত্যন্ত যশস্বী পুরুষ। তিনি পিতৃ-অনুরক্ত। মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করেন তিনি। বজ্রতুল্য অস্ত্রসমূহ মহাদেবের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছেন। জীবিত ও মৃত অস্ত্রবিদদের মধ্যে পরশুরাম অগ্রগণ্য। 

এসব কাহিনি শুনে শুনে পরশুরামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার প্রবল বাসনা জাগে দ্রোণের মনে। তিনি মনস্থির করেন, মহর্ষি পরশুরামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিখবার আবেদন জানাবেন। 

আরও একটা ঘটনার কথা তখন তাঁর কানে এল। এই সময় তিনি জানতে পারলেন পরশুরাম তাঁর সমস্ত ধন ব্রাহ্মণদের দান করে দিচ্ছেন। দ্রোণের মধ্যে ধনলিপ্সা জাগল। পরশুরামের এই কাহিনিটি শুনে তিনি ঠিক করলেন, যে-কোনো মূল্যে মহাত্মা পরশুরামের সঙ্গে দেখা করবেন। 

কিন্তু পরশুরামের নিকট উপস্থিত হতে হতে দ্রোণ বেশ দেরি করেই ফেললেন। পরশুরাম তখন মহেন্দ্ৰ পৰ্বতে অবস্থান করছিলেন। ভরদ্বাজ-আশ্রম থেকে মহেন্দ্ৰ পৰ্বত বহুদূরে। বহু শ্রম, অশেষ কষ্ট সহ্য করে, বন্ধুর পথ অতিক্রম শেষে পরশুরামের আশ্রমে উপস্থিত হলেন দ্রোণ। তাঁর উদ্দেশ্য—পরশুরামের কাছে মহাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রের পাঠ নেওয়া। কিন্তু পরশুরামের সামনে গিয়ে সব গুলিয়ে গেল দ্রোণের। সিদ্ধান্ত বদলালেন তিনি। 

ঋষি পরশুরামের সামনে নতজানু হয়ে দ্রোণ বললেন, ‘আমি একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তান। সারাটা জীবন অভাব-অনটনের সঙ্গে আমার বসবাস। মহাত্মন, শুনেছি আপনি দানবীর। আপনার সকল সম্পদ ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন।’ 

‘তুমি যথার্থ শুনেছো যুবক।’ নিমীলিত চোখে পরশুরাম বললেন। 

‘তাহলে আমাকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত করুন। আমাকে ধন দিন, যাতে নিত্যদিনের অভাব থেকে আমি মুক্তি পাই।’দ্রোণ করুণ কণ্ঠে বললেন। 

এবার পরশুরাম পূর্ণদৃষ্টিতে দ্রোণের দিকে তাকালেন। দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ, উন্নত নাসা, ব্যক্তিত্বশালী দ্রোণকে দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। বললেন, ‘বৎস, তোমার প্রকৃত পরিচয় দাও।’ 

‘আমি মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোণ।’ 

দ্রোণের কথা শুনে পরশুরামের অন্তরটা ব্যথায় টনটনিয়ে উঠল। 

নরম কণ্ঠে বললেন, ‘ঋষি ভরদ্বাজের পুত্র তুমি! তোমার মনোহর চেহারা দেখে আমি মুগ্ধ। কিন্তু পুত্র, আমি যে তোমার প্রার্থনার পরিপূরণ করতে অক্ষম!’ 

দ্রোণ হতাশ গলায় বললেন, ‘কেন মহাত্মন? শুনেছি—দান গ্রহণেচ্ছু ব্রাহ্মণের প্রসারিত দুটো হাত আপনি আপনার ধনৈশ্বর্য দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছেন। আমিও আমার খালি হাত দুটো ধন-প্ৰাৰ্থনায় আপনার দিকে প্রসারিত করেছি। শূন্য হাতে ফেরাবেন কেন?’ 

‘আমি যে নিরুপায় বৎস।’ 

‘অপরাধ মার্জনা করবেন। আপনার এই অসহায়তা কি শুধু আমার জন্য?’ 

‘হ্যাঁ, শুধু তোমার জন্যই। তোমার পূর্ববর্তী ব্রাহ্মণ পর্যন্ত আমি ধনসম্পদ দিতে পেরেছি। আমার যা কিছু ছিল ওসবের সবটাই আমি ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছি। তোমাকে দেওয়ার মতো কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন আমার কাছে।’

‘কোনো কিছুই নেই?’ 

দ্রোণের শেষ প্রশ্নে পরশুরাম বিহ্বল হলেন। একটু থমকে গেলেন যেন। তাঁর মধ্যে ইতস্তত ভাব জাগল। তিনি মনস্থির করে ভাবতে লাগলেন। তাঁর যা কিছু ধন-অর্থ ছিল, সবই তো দরিদ্র ব্রাহ্মণদের মধ্যে দান করে দিয়েছেন। তাহলে এই ব্রাহ্মণসন্তানকে তিনি কি কিছুই দিতে পারবেন না! একজন ব্রাহ্মণ তাঁর দরজা থেকে খালি হাতে ফিরে যাবে! তিনি কোনো কূলকিনারা খুঁজে পেলেন না। 

ম্রিয়মাণ কণ্ঠে পরশুরাম বললেন, ‘বৎস, তোমাকে দেওয়ার মতো সত্যি আমার কাছে কোনো ধনসম্পদ নেই। তবে…।’ 

পরশুরামের অর্ধসমাপ্ত কথা শুনেও দ্রোণ চুপ করে থাকলেন। পরশুরাম চিন্তায় নিমগ্ন হলেন। 

তারপর গভীর নিদ্রা থেকে জাগ্রত মানুষের কণ্ঠে বললেন, ‘তবে আমার কাছে তোমাকে দেওয়ার মতো দুটো জিনিস আছে। নানারকম অস্ত্রশস্ত্র আর আমার এই শরীরটি। এ দুটোর যেকোনো একটি আমি তোমাকে দান করতে প্রস্তুত আছি। বলো তুমি কোনটা পেতে আগ্রহী?’ 

হঠাৎ বিপুল আনন্দে দ্রোণের চোখমুখ ভেসে গেল। তিনি তো অস্ত্রের জন্যই পরশুরামের কাছে এসেছিলেন। ধনলোভে বিভ্রান্ত হয়ে তিনি সিদ্ধান্তচ্যুত হয়েছিলেন। তাই অস্ত্র বাদ দিয়ে সম্পদ চেয়ে বসেছিলেন পরশুরামের কাছে। কিন্তু ঈশ্বরের কী কৃপা! বাঞ্ছিত জিনিসই তাঁর জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন তিনি। এইজন্যই বোধহয় তাঁর আগে মহর্ষির কাছে কেউ অস্ত্রগুলো যাচনা করে নি। 

দ্রোণ পরশুরামের সামনে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসলেন। বললেন, ‘গুরুদেব, আমি আপনার কাছে অস্ত্রশস্ত্র প্রার্থনা করছি। 

তারপর বেশ কিছুদিন ধরে পরশুরাম দ্রোণকে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিলেন। একান্ত মনে দ্রোণ সেই শিক্ষা গ্রহণ করলেন। 

শেষ পর্যন্ত দ্রোণ ভারতবর্ষের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধরে রূপান্তরিত হলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *