একলব্য – ১১

১১

দ্রোণ বলিলেন তুই হোস্‌ নীচ জাতি।
তোরে শিক্ষা করাইলে হইবে অখ্যাতি।।

‘ধনুর্বিদ্যা শিখতে এসেছ তুমি! আমার কাছে!’ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন দ্রোণাচার্য। 

‘হ্যাঁ গুরুদেব।’ একলব্য আগের মতো জোড়হস্ত। 

‘আমি কে যে তুমি আমার কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে এসেছ?’ আচার্যের কথায় হেঁয়ালি। 

একলব্য বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলল, ‘আপনি ভুবনবিখ্যাত। এই ভারতবর্ষে আপনার সুনাম কে না শুনেছেন! আপনি মহর্ষি পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ধনুর্বিদ্যায় আপনি পৃথিবীতে বর্তমানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।’ 

চোখ বড় বড় করে আচার্য বললেন, ‘বাব্বা, আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেই দেখি তুমি এসেছ!’ 

গুরুদেবের কথা শুনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল একলব্য। সমবেত শিষ্যরা নিবিড় চোখে তাঁকে আগাগোড়া পরখ করতে লাগল। তাদের কারও চোখেমুখে কৌতূহল, কারওবা উপহাসের ছটা। 

এই সময় দ্রোণাচার্য বললেন, ‘কিন্তু বাবা, আমি যে রাজপুত্র ছাড়া অন্য কাউকে অস্ত্রশিক্ষা দিই না।’ 

কোমল চোখে একলব্য বলল, ‘ক্ষমা করবেন গুরুদেব। আমি একটুক্ষণ আগে বলেছি, নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র আমি।’ 

‘ও, বলেছ নাকি? খেয়াল করি নি। আচ্ছা, তুমি প্রথম থেকেই আমাকে গুরুদেব গুরুদেব বলে সম্বোধন করছ, কেন? তুমি তো আমার শিষ্য নও।’ 

‘আমি আপনার শিষ্য না হলেও আপনি আমার গুরু।’ বলতে বলতে একলব্যের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল 

উদ্ভাসিত চোখে সে আবার বলল, ‘আমি যখন নিষাদ রাজপ্রাসাদের শিক্ষকের কাছে অস্ত্রবিষয়ে পাঠ নিতে শুরু করলাম, সেই শিক্ষকের মুখ থেকেই আপনার কথা প্রথমে শুনেছি। সেই থেকে মনে মনে আপনাকে গুরুদেব বলে মানতে শুরু করেছি।’ 

দ্রোণাচার্য হালকা চালে যুবকটির সঙ্গে কথোপকথন শুরু করেছিলেন। ভেবেছিলেন—একসময় হতাশ হয়ে পেছন ফিরবে সে। এরকম অনেকে আসে। আচার্যের কঠিন কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে একসময় বিদায় নেয়। কিন্তু একলব্যের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, সে অন্য ধাতুতে গড়া। 

‘ও, তুমি প্রাথমিক শিক্ষাও গ্রহণ করেছ নাকি?’ প্রশ্ন করলেন আচার্য। 

‘হ্যাঁ, করেছি। কিছুক্ষণ আগে আয়ুধ বিষয়ে আপনার বক্তব্য শুনে আমার মনে হচ্ছে, আমার শিক্ষার মধ্যে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে।’ 

‘তুমি আমার কথাগুলো শুনেছ নাকি?’ 

‘বেশ কিছুক্ষণ আগে আমি দরজার কাছে এসে পৌঁছেছি। তখন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে নানা অস্ত্রের আকার-প্রকার সম্পর্কে বলছিলেন। আমি একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। তা ছাড়া, আপনার অনুমতি ছাড়া কক্ষে প্রবেশ করা অন্যায় হবে। সেই থেকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি। আমার বিশ্বাস ছিল—একটা না একটা সময়ে আপনার কৃপাদৃষ্টি আমার ওপর পড়বে।’ একটা তৃপ্তির হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে শেষে বলল, ‘পড়েছেও।’ 

একলব্যের অভিব্যক্তি সাবলীল। প্রতিটি শব্দ আলাদা করে স্পষ্টত সে উচ্চারণ করে গেল। কোনো ভনিতা নেই। তার বিশ্বাসের প্রতিটি কণা পর পর সাজিয়ে বলে গেল একলব্য। 

কিন্তু দ্রোণাচার্য একলব্যের উপস্থাপনায় যতই মুগ্ধ হোন, তাকে শিষ্যত্ব দিতে পারেন না। কুরুরাজার কাছে তাঁর যে হাত-পা বাঁধা। দৃঢ় গলায় আচার্য বললেন, ‘আমার কৃপাদৃষ্টি তোমার ওপর বর্ষিত হবে না।’

অপার বিস্ময় নিয়ে একলব্য গুরুদেবের দিকে তাকিয়ে থাকল। আচার্যের কথার মর্মোদ্ধার করতে চেষ্টিত হলো। 

দ্রোণাচার্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘একলব্য, তুমি বোধহয় আমার কথা বুঝতে পারো নি।’ 

একলব্য বলল, ‘আপনার এই পাঠশালায় নানা রাজ্যের রাজপুত্ররা পাঠ গ্রহণ করেন। আমি কেন আপনার কৃপা পাব না, বুঝে উঠতে পারছি না গুরুদেব।’ 

একলব্যের এই প্রশ্নের উত্তর দ্রোণাচার্যের জানা। একজন শিক্ষকের দৃষ্টি সূর্যরশ্মির মতো। সকলের ওপর সমভাবে পতিত হয়। আচার্যও তার ব্যতিক্রম নন। কত শত শিষ্য তাঁর এই অস্ত্রপাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করছে আবার শিক্ষা গ্রহণ সমাপন করে নিজালয়ে চলেও যাচ্ছে। একলব্যেরও অধিকার আছে তাঁর শিক্ষাশ্রমে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু দ্রোণাচার্য নিরুপায়। 

তিনি একলব্যকে কিছুতেই শিষ্য হিসেবে বরণ করতে পারেন না। একলব্য যে নিষাদ, ও যে অনার্য! একজন অনার্য আর্যাধিকারের অস্ত্রবিদ্যা অধিগ্রহণ করবে কীভাবে? তা ছাড়া তাঁর পাঠশালার সবাই সুসংস্কৃত আর্যপরিবারের সন্তান। মার্জিত, শীলিত একদল আর্যসন্তানের সঙ্গে একজন কালোদেহের অনার্য সন্তান পাঠ নিতে পারে না। হঠাৎ করে কেন জানি দ্রোণাচার্যের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ টগবগিয়ে উঠল। 

দ্রোণাচার্য ভাবলেন—এই একলব্য একেবারেই পৃথক এক জনগোষ্ঠীর মানুষ। তার আচার-ব্যবহার, তার শুচিবোধ-সদাচার সবটাই আর্যজনজাতি থেকে আলাদা। 

তাকে কৌরব-পাণ্ডবদের সঙ্গে বসিয়ে শিক্ষাদান করা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তিনি হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে অস্ত্রশিক্ষার গুরু হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। যতই তাঁর স্বাধীনতা থাকুক, একজন নিষাদপুত্রকে রাজকুমারদের সঙ্গে একত্রে শিক্ষাদানের স্বাধীনতা তাঁর নেই। তিনি যে রাজবাড়ির অর্থপুষ্ট শিক্ষক। ভাবতে ভাবতে তাঁর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য অহংকার জেগে উঠল। 

দ্রোণাচার্য ভাবলেন—আর্য সমাজ যে চতুর্বর্ণীয় বিভাজনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে, তা অবশ্যই মানবজাতির জন্য কল্যাণকর। এই বিভাজন সমাজকাঠামোকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। এই শৃঙ্খল রাজ্যশাসন, প্রজাশোষণ ও ধর্মমার্গের পক্ষে বিশেষভাবে অনুকূল। 

ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র শ্রেণিপ্রথা সমাজে বিরাজমান না থাকলে আর্য সমাজব্যবস্থা কবেই ভেঙে পড়ত। ব্ৰাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়রা স্বাধীন। ব্রাহ্মণ্যমস্তিষ্ক আর ক্ষত্রিয়-বাহুবলের সম্মিলনে এমন একটা কেন্দ্রশক্তি তৈরি হয়েছে, যা অতিপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপ্রতিরোধ্য। ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের সমন্বয়কে অব্যাহত রাখতে হলে এসব ছোটোজাতের শূদ্রদের মাথা তুলতে দেওয়া যাবে না। 

ব্যাধ-ডোম-নিষাদদের মস্তিষ্ক বড় উর্বর। এই উর্বর মস্তিষ্কে যদি অস্ত্রবিদ্যা আর রণকৌশল ঢুকে যায় তাহলে পৃথিবীকে ওরা একদিন পদানত করে ছাড়বে। একজন ব্রাহ্মণ হয়ে কী করে তিনি ছোটোজাতের এই নিষাদপুত্রকে প্রশ্রয় দিতে পারেন? তাঁর কি একলব্যকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করা উচিত? কখনো নয়। এসবই আপন মনে ভাবছিলেন দ্রোণ। 

এ ছাড়া দ্রোণাচার্যের মনে আরেকটি কথা বারবার উঁকি দিচ্ছিল। কৌরব আর পাণ্ডবসন্তানরা বিশেষ এক বাতাবরণে বড় হয়ে উঠছে। তারা সুসংস্কৃত। তারা আর্য। তাদের গায়ের রং গৌর। রুচি উন্নত। একটা বিশেষ পরিমণ্ডলে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে তারা। এই কালাকোলা, মলিন বসন পরিহিত আর্যসমাজে বেমানান চেহারার একলব্যকে ওদের সঙ্গে পাঠাভ্যাসে বসিয়ে দিলে, ওরা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়বে। 

এই অস্বস্তির কথা একটা সময়ে তারা পিতামহ ভীষ্মকে বলবে। ভীষ্ম যদি ক্ষেপে গিয়ে তাঁকে চাকরিচ্যুত করেন, তাহলে তাঁর কী গতি হবে? এই সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য, কৃপীর মুখের হাসি আর অশ্বত্থামার বিপুলানন্দ—সবই ভেসে যাবে। আবার পথে এসে দাঁড়াতে হবে তাঁকে। তখন দ্রুপদের ওপর প্রতিশোধের কী হবে? তিনি যে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলেন-দ্রুপদকে সিংহাসন থেকে টেনেহিঁচড়ে নামাবেন। তাঁর চাকরি গেলে এসব কিছুই তো আর হবে না। দরকার নেই একলব্যকে শিষ্যত্ব দেওয়া। যে করেই হোক, তাকে এখান থেকে বিতাড়িত করতে হবে। 

ক্ষুব্ধ গলায় আচার্য একলব্যকে উদ্দেশ করে বলে উঠলেন, ‘হীনবংশে তোমার জন্ম। নীচ জাতি তুমি। অপাঙ্ক্তেয় কোনো জনগোষ্ঠীর সন্তানকে আমি অস্ত্রশিক্ষা দিই না।’ 

বহুবাসনার চির-আকাঙ্ক্ষিত গুরু দ্রোণাচার্যের মুখে এ রকম জাতিবিদ্বেষমূলক বর্ণবাদী কথা শুনে নিষাদপুত্র একলব্য একেবারেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার দেহের সকল শিরা-উপশিরা কিছু সময়ের জন্য অসাড় হয়ে গেল। তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে উঠল। কপালে, গণ্ডদেশে, নাকে ফোঁটা ফোঁটা স্বেদবিন্দু। তার চক্ষুদ্বয় পলকহীন। 

কিছুক্ষণ পর তার সংবিৎ ফিরল। আচার্যের দিকে তাকাল একলব্য। দেখল— গুরুদেবের চক্ষু তার ওপর নিবন্ধ। নিষ্পলক। চাহনিতে করুণা বা ভালোবাসার অথবা স্নেহের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেল না একলব্য। কী রকম যেন ক্রোধান্বিত চেহারা। ঠিক ক্রোধযুক্ত নয়। যেন আচার্যের চাহনিতে ঘৃণার ছোঁয়া। বর্ষাকালে কালো মাটির ওপর দিয়ে একটা কেঁচোকে এগিয়ে যেতে দেখলে মানুষ যেমন করে ঘৃণা আর অবহেলায় নাকচোখ কুঁচকে কেঁচোটির দিকে তাকায়, দ্রোণাচার্যও সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন একলব্যের দিকে। 

এখন একলব্য কী বলবে গুরুকে উদ্দেশ করে? যে গুরুর চরণ আবাল্য ধ্যান করে এসেছে, যে গুরুর সান্নিধ্য তার বহু আকাঙ্ক্ষিত, যে গুরুর শিক্ষা তাকে উজ্জ্বল আলোর জগতে নিয়ে যাবে বলে তার একান্ত বিশ্বাস, সেই গুরু এ কী বললেন? সে বোধ হয় ভালো করে শোনে নি। যা শুনেছে, আচার্য সেরকম করে বলেন নি। তার শুনতে অবশ্যই ভুল হয়েছে। নিজের অজান্তেই কানের পাশে হাত চলে এল একলব্যের। ভালো করে কান রগড়ে সে আবার উৎকর্ণ হলো। 

এই সময় দ্রোণাচার্য পুনরায় বলে উঠলেন, ‘তুমি বোধ হয় আমার কথার মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারো নি। আমি উঁচু জাতের অস্ত্রগুরু। হীন শূদ্রবংশে জন্ম তোমার। ব্রাহ্মণ আমি। ব্রাহ্মণ হয়ে নীচ জাতির নিষাদকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারি না আমি। তুমি ফিরে যাও।’ বলে সম্মুখে সমবেত শিষ্যদের দিকে মুখ ফেরালেন আচার্য। 

একলব্য আর একটি কথাও বলল না। পূর্বের মতো মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে গুরুদেবকে প্রণাম করল। তারপর ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল একলব্য। গভীর মগ্নতায় কী যেন ভাবল। তারপর পেছন ফিরল। গুরুর নিকটে গেল। জোড়হাতে বলল, ‘একটা নিবেদন ছিল গুরুদেব।’ 

একলব্যের দিকে না তাকিয়ে দ্রোণাচার্য বললেন, ‘বলো।’ 

‘আমার বাসনার মৃত্যুর কথা বলব না। বলব আমার প্রাথমিক অস্ত্রশিক্ষার কথা। অস্ত্রবিদ্যার কিছুটা সাধন আমি করেছি। যাওয়ার আগে তার কিছুটা কৌশল আপনাকে দেখাতে পারলে তৃপ্তি পাব। আপনি অনুমতি দিন গুরুদেব।’ 

একলব্যের দিকে ধীরে ধীরে মাথা ঘোরালেন আচার্য। তার চোখেমুখে রাগ না অনুরাগ বোঝা যাচ্ছে না এখন। ‘কী প্রদর্শন করবে তুমি?’ জিজ্ঞেস করলেন দ্রোণাচার্য। 

‘যা শিখেছি।’ সংক্ষেপে বিনীত কণ্ঠে বলল একলব্য। 

‘তথাস্তু।’ বলে সমবেত ছাত্রদেরকে অস্ত্রকৌশল প্রদর্শনী মাঠে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন। আসন ছেড়ে নিজেও উঠলেন। একলব্য তাঁকে অনুসরণ করল। 

.

একলব্য অতি নিপুণতায় তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। অন্যান্য শিষ্যের পক্ষে দূরবর্তী যে লক্ষ্যবস্তু ভেদ করা অসম্ভব, অতি সহজেই একলব্য সেই বস্তু ভেদ করল। তার শরচালনার নিপুণতা আর ক্ষিপ্রতা দেখে সবাই উচ্চস্বরে বাহবা দিতে লাগল। কৌরব ভ্রাতারা সবচাইতে বেশি উচ্ছ্বসিত হলো। একজন ছাড়া অন্য পাণ্ডবরা পরিমিত আনন্দ প্রকাশ করল। একজন শুধু কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল না। সে অর্জুন। 

বিষবৎ একটা ঈর্ষা অর্জুনের মধ্যে ফেনায়িত হয়ে উঠল। হীনম্মন্যতাজাত ক্রোধ তাকে আবৃত করতে উদ্যত হলো। কিন্তু বুদ্ধিমান সে। মুখে কিছু বলল না। নির্লিপ্ত উদাসীন চোখে একলব্যের শরনিক্ষেপণ দক্ষতা অবলোকন করে গেল শুধু। 

একলব্যের তীরচালনা দক্ষতা দেখে আরেকজন বিশেষভাবে মুগ্ধ হলেন। তিনি অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য। কী অবলীলায়, কী অপূর্ব দক্ষতায় লক্ষ্যবস্তুতে শরনিক্ষেপ করে গেল একলব্য! তাঁর অস্ত্র পাঠশালার দু’জন ছাত্র, অশ্বত্থামা আর অর্জুনই শুধু সক্ষম এই রকম তীর নিক্ষেপণে। 

কঠোর সংযমে নিজের আবেগকে গলাটিপে হত্যা করলেন দ্রোণাচার্য। ভাবলেন– এই পৃথিবীতে একলব্যের মতো কত প্রতিভার যে অহরহ মৃত্যু হচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। একজন একলব্যের জন্য আকুলিত হয়ে লাভ কী? 

অস্ত্রকৌশল প্রদর্শনী শেষ করল একলব্য। প্রবল আগ্রহে গুরুদেবের দিকে তাকাল। উদ্দেশ্য—যদি গুরুদেব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। কিন্তু গুরুদেবের অভিব্যক্তি নির্মোহ। সংক্ষেপে বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি আসো এখন।’ অন্যদিকে মুখ ঘোরালেন দ্রোণাচার্য। 

.

এক অদ্ভুত ভঙ্গি করে হাসল একলব্য। তীর-ধনুক যথাস্থানে রাখল। তারপর চোখ যেদিকে গেল, সেই দিকে এগিয়ে গেল সে। 

একলব্য এগিয়ে গেল অরণ্যের দিকে। দ্রোণাচার্যের আশ্রমের উত্তর দিকে যে গহিন অরণ্য সেদিকে অগ্রসর হলো একলব্য। একদিন উত্তর দিক থেকে গঙ্গা পেরিয়ে, এই গহিন বনভূমি অতিক্রম করে পুত্র অশ্বত্থামার হাত ধরে সস্ত্রীক কুরু রাজধানী হস্তিনাপুরে এসেছিলেন দ্রোণাচার্য। সেদিন বুকভরা বেদনা নিয়েই এসেছিলেন তিনি। হৃদয় ছিল অপমানে চুরচুর। কিন্তু হস্তিনাপুর, পিতামহ ভীষ্ম তাঁকে সপরিবারে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করে একটা সচ্ছল স্বস্তির জীবন দান করেছেন। অর্জুনদের পেয়ে তাঁর ভেতরের অপমানের জ্বালা আপাতত প্রশমিত হয়েছে। তাঁর ভবিষ্যৎ লক্ষ্য স্থির করে রেখেছেন দ্রোণাচার্য। 

আজ সেই কামনা পূরণের হস্তিনাপুর থেকে একলব্যকে চলে যেতে হচ্ছে শূন্য হাতে। প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় যে অরণ্য অতিক্রম করে একদা আচার্য এই হস্তিনাপুরে এসেছিলেন, অপ্রাপ্তির বুকভরা কষ্ট নিয়ে সেই অরণ্যের দিকেই পা বাড়াল একলব্য। কষ্ট ভুলবার জন্য মানুষ জনসান্নিধ্য খোঁজে, কিন্তু একলব্য খুঁজে নিল জনবিচ্ছিন্ন শ্বাপদময় গহিন অরণ্য। একলব্যের কাছে এই জনকোলাহল, এই ঐশ্বর্য, এই বাসনা, এমনকি মাতা-পিতা-পিতামহের মতো নিকটাত্মীয়-সান্নিধ্যও অসহ্য মনে হলো। প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য নিজের মধ্যে প্রবল একটা আকুলতা অনুভব করল সে। 

একলব্য ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর অরণ্যের ভেতরে ঢুকে গেল। 

দ্রোণাচার্য একবারের জন্যও ভাবলেন না, তিনি এই নিষাদজাত যুবাটির সঙ্গে কী অমানবিক আচরণ করেছেন! ব্রাহ্মণ্য অহংকারে উদ্দীপিত হয়ে, কুলগর্বে গর্বিত হয়ে তিনি একলব্যের প্রতি যে হীন আচরণ করলেন, এজন্য তাঁর মধ্যে কোনো অনুশোচনা হলো না। শিষ্যত্বকামী, তীর চালনায় দক্ষ একলব্য লোকালয়ের দিকে না গিয়ে কেন অরণ্যানির দিকে গেল, সে বিষয়ে ভাববার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দ্রোণাচার্যের ভেতরে জাগল না। তিনি নিত্যদিনের মতো শিষ্যদের নিয়ে অস্ত্র পাঠদানে মশগুল হয়ে পড়লেন। 

একলব্যের আগমন এবং নির্গমন যেন অতি সাধারণ একটা ঘটনা। একটি বুদ্বুদ জেগে ওঠা আর বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো যেন একলব্যের আবির্ভাব এবং তিরোধানের ঘটনাটি। 

বিতাড়নের বেদনা সহ্য করতে না পেরে একলব্য কি প্রাণ বিসর্জন দেবে, না আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবে-বর্ণগর্বী গুরু দ্বারা অবহেলিত হলেও একলব্যরা বিলীন হয়ে যায় না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *