নয়
প্রকাণ্ড বোয়িং ৭৭৭ জাম্বো হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে লম্বা দৌড় শেষ করে উঠে পড়ল শূন্যে, উড়াল দিল পশ্চিমে। নিকোলাস ওয়াল্টার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেঁধিয়ে গেল নরম সীটের ভেতরে। প্রীস্টকে দেয়া কথা সে রেখেছে। দেখা করেছে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে। তবে ওয়াল্টারের সন্দেহ হচ্ছে অ্যামব্যাসাডর আদৌ তার পাঠানো প্যাকেজটাকে গুরুত্ব দেবেন কিনা। অবশ্য সে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের সাথেও কথা বলতে পারে। দু’একজন সাংবাদিকের সাথে তার পরিচয় আছে। এরা কিভাবে গপপো বানায় ভালই জানে ওয়াল্টার। থর্ন সাম্রাজ্য নিয়ে সাংবাদিকদের যথেষ্ট কৌতূহল আছে শুনেছে সে। আর এ ব্যাপারটা নিয়ে যদি সাড়া পড়ে যায় তাহলে বেচারা টমাস ডুলানের অপঘাত মৃত্যু অন্তত বৃথা যায়নি ভেবে সান্ত্বনা পাবে ওয়াল্টার।
লালচুলো স্টুয়াড্রেসকে ডেকে মার্টিনি দিতে বলল সে। মেয়েটার নাম ক্লেয়ার। হাসিটা চমত্কার, মেকি মনে হয় না। ট্রেটা দেয়ার সময় ওয়াল্টারের কাঁধে ক্লেয়ারের নরম স্তন ঘষা খেল। ওয়াল্টারের মনে হলো ইচ্ছে করে কাজটা করেছে মেয়েটা। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নিজেকে চোখ রাঙাল-বুড়ো বয়সে ভিমরতিতে ধরেছে, না?
ফিল্ম চলার সময় ওয়াল্টারের পাশের খালি সীটে বসে পড়ল ক্লেয়ার। দ্বিতীয়বার জানতে চাইল ওয়াল্টার ভ্রমণটা উপভোগ করছে কিনা এবং সে তার জন্যে আর কি করতে পারে?
‘কিছুই করতে হবে না,’ ফিসফিস করে জবাব দিল ওয়াল্টার। ‘সব ঠিক আছে।’ এক সাথে ছবিটা দেখল দু’জনে। ওয়েস্টার্ন ছবি। তবে পর্দায় মন দিতে পারল না ওয়াল্টার। তার আবার সন্দেহ হতে শুরু করেছে মেয়েটা ইচ্ছে করে তার সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি করছে। এই তো একটু আগে উরু ছুঁইয়ে দিল। মনে মনে নিজেকে আবার ধমক দিল ওয়াল্টার। আসলে অমন কিছুই ঘটছে না, সবই তার কল্পনা। আর মেয়েটা তার মত বুড়োর সাথে রংঢং করতে যাবে কেন? প্লেনে তো তরুণ যাত্রীর অভাব নেই। তামাশা করতে মন চাইলে তাদের সাথে করবে।
পর্দায় ধুমধাম মারপিট চলছে, ক্লেয়ার সরে এল ওয়াল্টারের কাছে, ফিসফিসিয়ে বলল তাকে এখন কফি দিতে যেতে হবে। ওয়াল্টার গ্যালিতে চলে আসুক না। তাহলে ক্লেয়ার তাকে ককটেল বানিয়ে খাওয়াতে পারবে। অর্থপূর্ণ হাসি হেসে চলে গেল স্টুয়ার্ডেস। ফাঁকা দৃষ্টিতে পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল নিকোলাস ওয়াল্টার। গ্যালিতে গেলে ক্ষতি কিসের? কিসের ক্ষতি?
.
ক্লেয়ার জ্যাকেট আর মাথার ক্যাপ খুলে ফেলেছে, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে কেবিনের দেয়ালে। ভদকার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে, ওয়াল্টারকে বলছে ডিউটি চলাকালীন পান করার অনুমতি তাদের নেই। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখছে কেউ এল কিনা। আরেক স্টুয়ার্ডেস, সিন্ডি ক্লেয়ারের হয়ে প্রক্সি দিচ্ছে। ক্লেয়ার জানাল তার বাড়ি ডেনভারে। ওয়াল্টারের বাড়ি কোথায়? সে কি করে? ইউরোপ এসেছে ব্যবসার কাজে নাকি স্ফূর্তি করতে?
যতদূর সম্ভব ক্লেয়ারের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করছে ওয়াল্টার। মেয়েটার দিকে প্রায় তাকাচ্ছেই না, ভাবলেশহীন থাকার চেষ্টা করছে। পান করতে করতে পোর্ট হোলের দিকে তাকাচ্ছে, যেন এমন করেই সে অভ্যস্ত।
‘আপনি আকাশ ভ্রমণ পছন্দ করেন?’ জানতে চাইল স্টুয়ার্ডেস।
‘নাহ্,’ জবাব দিল ওয়াল্টার। ‘একটা ধাতব টুকরো কি করে আকাশে উড়ে বেড়ায় বুঝতে পারি না আমি।’
‘আমিও,’ খিলখিল হাসল ক্লেয়ার।
‘একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় ঢোকে না আমার,’ বলল ওয়াল্টার। ‘প্লেন চলার সময় চাকা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে কেন?’
‘নামিয়ে রাখলে প্লেন চালানো সম্ভব নয় বলে,’ জবাব দিল মেয়েটা।
‘কিন্তু আসল সময় যদি চাকা পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে না আসে তখন?’ ওয়াল্টারের প্রশ্ন শুনে হিহি করে হেসে উঠল ক্লেয়ার, ওর হাত ধরে এগোল গ্যালির মাঝ দিয়ে। তারপর উঠে পড়ল ছোট একটা লিফটে।
‘চাকা সবসময় নেমে আসে,’ বলল স্টুয়ার্ডেস। ‘চলুন, জিনিসটা দেখাই আপনাকে। আন্ডার ফ্লোর গ্যালিতে আছে ওটা…এই তো এসে পড়েছি।’ নেমে পড়ল ক্লেয়ার, তার পেছনে ওয়াল্টার। হাতে এখনও ড্রিঙ্কের গ্লাস।
ওভেন, বার বক্স আর ট্রলির মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলল ক্লেয়ার, মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ওয়াল্টারকে। ইশারা করল ওর পেছন পেছন আসতে। দুটো ট্রলির মাঝখানে আটকা পড়ে গেল ওয়াল্টার। হেসে ওকে উদ্ধার করল ক্লেয়ার, টুসকি মারল নাকে, তারপর নাচের ভঙ্গিতে সরে গেল। এগোল ভারী একটা দরজার দিকে।
ক্লেয়ারের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়েছে ওয়াল্টার। বেড়ে গেছে পালস রেট, পাঁজরে দমাদম বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত সে।
‘ওখানে চাকা রাখা হয়,’ বলল ক্লেয়ার। ‘সেন্টার হোল্ডে। লাল একটা বাতির দিকে ইঙ্গিত করল। ‘প্রেসারাইজেশন লেভেল নিচে নেমে গেলে আমরা সবুজ সংকেত পাই, মানে আলোটা সবুজ হয়ে ওঠে। তখন নামার জন্যে প্রস্তুত হই।’
‘সেটা কখন ঘটবে?’ জিজ্ঞেস করল ওয়াল্টার।
প্রার্থনা করল যেন ঘটনাটা অনেক পরে ঘটে।
‘সময় হয়ে এল বলে,’ জবাব দিল ক্লেয়ার। ধাক্কা মেরে দরজা খুলল, তার পিছু পিছু সেন্টার হোল্ডে ঢুকল ওয়াল্টার। ভেতরে ভীষণ ঠাণ্ডা। শিরশির করে উঠল গা। মদের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ওয়াল্টার, ক্লেয়ারের সাথে চলে এল ইস্পাতের প্রকাণ্ড একটা কন্টেইনারের সামনে। হোল্ডের পুরো জায়গা দখল করে আছে এটা।
‘আসুন,’ কন্টেইনারের গায়ে লাগানো সিঁড়ি বাইতে শুরু করল ক্লেয়ার। পেছন পেছন যথারীতি ওয়াল্টার। ওপরে উঠে এল ওরা।
‘এটাকে বলে হুইল ওয়েল বে,’ একটা হ্যাচ টেনে খুলল ক্লেয়ার।
‘দেখুন।’
উঁকি দিল ওয়াল্টার হ্যাচের মুখে। ওর নাকের কয়েক ইঞ্চি নিচে শুয়ে আছে দানব চাকাগুলো।
‘মোট ষোলোটা,’ জানাল ক্লেয়ার। ‘প্রতি চারটে চাকার জন্যে একটা বগি। প্রতিটি চাকা পাঁচ ফুট উঁচু।’
চেষ্টাকৃত হাসি দিল ওয়াল্টার, ভোঁতা চোখে তাকিয়ে আছে চাকাগুলোর দিকে। ক্লেয়ার বলে চলেছে কিভাবে হাইড্রলিক কাজ করে। যদি কাজ না করে, যদিও তা কখনোই ঘটেনি, তবু অমন ঘটলে নিচের হুইল ওয়েল ডোর হাত দিয়ে টানলেই খুলে যাবে, চাকাগুলো নিজে থেকে নেমে যাবে ঝপ করে।
‘মাধ্যাকর্ষণের কারণে, না?’
‘ঠিক ধরেছেন,’ নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে ওয়াল্টারের। মেয়েটা যখন চাকা দেখাতে চাইল সে বুঝতে পারেনি সত্যি স্টুয়ার্ডেসটা তাকে এসব বিশ্রী জিনিস দেখাতে নিয়ে আসবে।
‘ঘটনাটা এখুনি ঘটবে,’ বলল মেয়েটা ওয়াল্টারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। এয়ারক্রাফটের পেটের ভেতরের দরজা খুলে গেল, হিসিয়ে উঠল হাইড্রলিক। দমকা হাওয়ার ঝাপটায় ওয়াল্টারের শার্ট পতপত করে উড়তে লাগল, বাতাসের চাপে বন্ধ হয়ে আসতে চাইল নিশ্বাস।
‘দেখছেন, চাকাগুলো নড়তে শুরু করেছে। তবে ভয়ের কিছু নেই।’
ইঞ্জিনের কান ফাটানো শব্দে আর বাতাসের গর্জনে মেয়েটার গলা প্রায় শুনতেই পেল না ওয়াল্টার। নিচে তাকাল ও। চাকার ফাঁক দিয়ে নিউ ইয়র্কের শহরতলি, বাড়ি-ঘর দেখা গেল।
আবার শিউরে উঠল ওয়াল্টার, ধরে ফেলল হ্যাচের কিনারা। পিছিয়ে আসতে শুরু করেছে, মেয়েটার হাতের স্পর্শ পেল কাঁধে। মনে মনে হাসল ওয়াল্টার। অদ্ভুত একটা সময় নির্বাচন করেছে মেয়েটা…পরক্ষণে ধাক্কা খেল সে, ছিটকে গেল সামনে। গলায় চাবুক কষাল বাতাস, হাত জোড়া বাড়ি খেল চাকায়, খামচে ধরল খাঁজ, মুখটা খুব জোরে ঘষা লাগল রাবার টায়ারের সাথে, ব্যথায় ককিয়ে উঠল ওয়ালটার, একটা পা হ্যাচের সাথে আটকে গেছে। টায়ার ধরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে। ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে ক্লেয়ার, হাসছে। হাসতে হাসতে বন্ধ করে দিল হ্যাচ।
হামাগুড়ি দিয়ে সামনে বাড়ল ওয়াল্টার, খামচে ধরে আছে রাবার। আর এগোতে পারল না। নাকটা ঠেকে আছে টায়ারের গভীর খাঁজে, গোবরের গন্ধ আসছে।
টেকঅফের সময় নিশ্চয়ই চাকায় গোবর লেগেছিল। গুলিয়ে উঠল গা।
সামনে-পেছনে কোথাও যেতে পারছে না ওয়াল্টার। ভয়ানক আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বাতাসের ধাক্কায় একটা চোখ বুজে গেছে, আরেকটা চোখ দিয়ে দরদর ধারায় পানি পড়ছে। নিচে তাকাতে কেনেডি এয়ারপোর্ট এক ঝলক দেখতে পেল ওয়াল্টার। ওর স্ত্রী বলেছে এয়ারপোর্টে থাকবে সে। ওয়াল্টারকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। এ মুহূর্তে হয়তো সে অবজার্ভেশন এলাকায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, খুঁজছে স্বামীর প্লেন।
টায়ারের সাথে মুখ ঘষল ওয়াল্টার। মনে পড়ে গেল ক্লেয়ার বলেছিল কখনও কখনও এত বেগে ল্যান্ড করে প্লেন যে টায়ারের এক ইঞ্চির মত রাবার পুড়ে যায়।
ওয়াল্টারের দৃষ্টি হঠাৎ স্বচ্ছ হয়ে এল। রানওয়ে দেখতে পাচ্ছে। নামতে যাচ্ছে প্লেন। আস্তে আস্তে, তীব্র যন্ত্রণা সয়ে মাথা তুলল সে। তারপর চিৎকার দিল।
.
ডানার ওপর, জানালার ধারে ছোট্ট রকিব তার মা’র সাথে বসেছিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে। এক স্টুয়ার্ডেস এগিয়ে এল ওদের দিকে। হেসে জানতে চাইল কি হয়েছে।
‘জীবনে এই প্রথম প্লেনে উঠেছে ও,’ বললেন রকিবের মা।
‘আবার,’ শিউরে উঠল রকিব।
‘আমার বাচ্চাটা বলছে ও শুনেছে কে নাকি চিৎকার করছে,’ ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন মিসেস হাসান। ‘ওকে বলেছি ওটা বাতাসের শব্দ।’
‘মা ঠিকই বলেছেন,’ রকিবের থুতনি নেড়ে দিল স্টুয়ার্ডেস আদর করে। ‘আমরা ঘণ্টায় দুশো মাইল বেগে উড়ে চলেছি। আর প্লেন নামার সময় বাতাসে অনেক অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়।’
রকিব কিছু বলল না, জানালায় খাড়া করে রাখল কান। প্লেন রানওয়েতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে, চোখ বুজে কানে আঙুল ঢুকিয়ে রাখল ও। ভয়ঙ্কর চিৎকারটা আর শুনতে চায় না। দুম করে শব্দ হলো, কংক্রিটের সাথে ঘষা খেয়েছে রাবার। একটু পর কমে এল এঞ্জিনের শব্দ, তারপর শুধু মৃদু গুঞ্জন তুলল টার্মিনাল গেটের দিকে এগোবার সময়।
প্লেন না থামা পর্যন্ত চোখ খুলল না রকিব। চোখ মেলে দেখল এক মেকানিক চাকার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তীব্র আতঙ্কে মুখের সমস্ত রক্ত সরে গেছে তার, চাকার সাথে দলা-পাকানো মাংসের টুকরোগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই কিছুক্ষণ আগেও ওটা ছিল নিকোলাস ওয়াল্টার। ‘চিৎকারটা এখন থেমে গেছে,’ মা’র দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল রকিব।