আবার অশুভ সঙ্কেত – ৩

তিন

ট্যাক্সিটা গেটের সামনে অপেক্ষা করছিল বুড়ির জন্যে। বুড়ি অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে, চেষ্টাকৃত হাসি দিল ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে। তারপর উঠে পড়ল ট্যাক্সিতে। বাড়ি যাবে। চলার পথে কোন কথা বলল না সে। বাড়ি পৌঁছে সোজা ঢুকে পড়ল নিজের ঘরে, লিভিংরুম থেকে হুইল চেয়ার চালিয়ে বেডরুমে এল। এ ঘরে কারও প্রবেশাধিকার নেই।

পুরো ঘর কালো রঙ করা। দেয়ালে দুটো ছবি ঝুলছে। একটা ডেমিয়েন থর্নের, অন্যটা তরুণী এক মেয়ের। ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটা খাট, লেখার টেবিল এবং চেয়ার। দুটো বুকশেলফও আছে, একটাতে বাইবেল সম্পর্কিত নানা বই, অন্যটাতে পর্নোগ্রাফি। শেলফের সামনে গিয়ে বইগুলো ছুঁয়ে দেখল বৃদ্ধা, তারপর টেবিল থেকে একটা পেপার ওয়েট তুলে ছুঁড়ে মারল ডেমিয়েনের ছবি লক্ষ্য করে। গায়ে শক্তি একেবারেই কম। দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছল না ওটা, পড়ে গেল মেঝেতে। সামান্য পরিশ্রমেই হাঁপাতে লাগল বুড়ি। ধীরে ধীরে শরীরটাকে টেনে তুলল চেয়ার থেকে, হাত বাড়িয়ে দেয়াল থেকে ছুটিয়ে আনল দ্বিতীয় ছবিটা, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিছানার কাছে গেল, রীতিমত কাঁপছে, ওটা রেখে দিল বিছানার ওপর। নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। ছবিটা তার বাবা তুলেছিল সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার মাস কয়েক আগে। ওই সময় সে ছিল সাংঘাতিক একা, ভীতু আর সরল।— তারপর একদিন বেলিয়াল নামে সেই পাগলা ছোঁড়ার সাথে পরিচয় হলো…তারপর কি হতে কি হয়ে গেল ঠাহর করতে পারেনি সে।

শুরুতে লোভ দমন করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু হেরে গেছে। নার্স ছিল বলে ওরা তাকে নিজেদের দলে টেনে নিতে কসুর করেনি। সবকিছু কেমন বিশৃঙ্খল মনে হত নিজের কাছে। রাত আর দিনের মাঝে যেন কোন ফারাক ছিল না। তাকে অত্যন্ত শক্তিশালী ড্রাগস খাওয়ানো হয়েছিল। একদিন সকালে তার ঘুম ভাঙে, মনে হয় এতদিন দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু ওটাই ছিল চরম বাস্তবতা। একটা কুকুরের সাথে মিলিত হতে বাধ্য করেছিল ওরা, অবচেতন অবস্থা থেকে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ঘাড়ে শুকিয়ে থাকা লালা দেখতে পায় সে। শুকনো জিনিসটা ঘষে ওঠাতেই চোখে পড়ে একটা দাগ-লবঙ্গপাতার আকারে আঁকা তিনটে ছোট ছয়-আর তার বিছানার পাশের দেয়ালে লেখা ছিল বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি:

যাহার বোঝার ক্ষমতা আছে
সে পশুর সংখ্যা দেখিলেই চিনিতে পারিবে:
ইহা একটি মানুষের সংখ্যা
সংখ্যাটি হইল ছয়শো ছেষট্টি।

ওই ঘটনা তাকে ভীষণ আতঙ্কিত করে তোলে, সে ছুটে যায় বাবা-মা’র কাছে, হাতজোড় করে ক্ষমা চায়। যদিও নিজের জীবনের অনেক ঘটনাই সে গোপন করেছিল তাদের কাছে। কিন্তু নীতিবান বাবা-মা ঘর পালানো মেয়ের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলেন। মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাননি তাঁরা। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে। তবে যাবার আগে পুরো গল্প বলে যায় সে। রেলিয়াল এবং তার দলের কাছে ফিরে গিয়েছিল সে। ওরা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছে, সেই সাথে বলেছে সে এখন তাদেরই লোক।

চোখ বুজল বৃদ্ধা, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে পড়ছে ডেমিয়েন থর্নের নির্দেশের কথা, কিভাবে নবজাতক শিশুকে ইনকিউবেটরের মধ্যে হত্যা করেছিল তার কথা। কাজটা করতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি তাকে। অল্প সময়ের জন্যে অক্সিজেনের লাইনটা খুলে রেখেছে। বাচ্চাটার নামও মনে আছে তার: মাইকেল থমাস, খুদে একটা শিশু।

আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে…

চোখের সামনে ভেসে উঠল নানা দৃশ্য…

বেঁটে একটা লোক, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ। তাকে ভীষণ বিশ্বাস করত সে। তার কাছেই প্রথম সতীত্ব খুইয়েছিল সে। লোকটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে ঠেসে ধরেছিল তার হাতে, যন্ত্রণায় সে চিৎকার করছে, ওদিকে লোকটা তার কানে কানে বলছিল: ‘পাপ ক’রলে কি হবে তার একটু স্বাদ নাও…’

প্রীস্টকে দেখতে পেল সে এবার। কামাতুর একটা মুখ। তার গালে ঠোঁট ঘষছে, একটা হাত পিষছে বুক। ‘যন্ত্রণা অবিনশ্বর। যে ত্বক জ্বলে কিন্তু শেষ হয়ে যায় না…’

টের পাচ্ছে কর্কশ একজোড়া হাত তাকে নির্মমভাবে নিষ্পেষণ করে চলেছে। চিৎকার করে উঠল সে। চোখ মেলে চাইল। দেখল এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, সুদর্শন ছেলেটির নাম মাইকেল থমাস। হাসছে সে, তার হাসিতে করুণা আর দয়া যেন ঝরে পড়ছে। তার পাশে একটা মুখ দেখা গেল, অস্পষ্ট, চেহারা চেনা যাচ্ছে না, এগিয়ে এল সে তার দিকে, অগ্নিদগ্ধ হাতটা ধরল পরম মমতায়, কথা বলল সে। তাকে ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলছে, বলছে পিতার রাজ্যে তার জন্যে এখনও খালি আছে জায়গা…

ঘুম থেকে জেগে উঠল সে, ঘৃণার দৃষ্টিতে চাইল ডেমিয়েন থর্নের ছবির দিকে। কিন্তু ওখানে থর্নের বদলে সেই অস্পষ্ট মুখটিকে দেখা যাচ্ছে, মনে হলো এখনও স্বপ্ন দেখছে সে আর যেন ঘুমের মধ্যে থেকে তার কণ্ঠ ভেসে আসছে: ‘অনুতাপ করো। অনুতাপের দ্বার সবসময়ই খোলা।’

বিছানায় উঠে বসল বৃদ্ধা, খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোল টেবিলের দিকে। কলম আর কাগজ টেনে নিল। তারপর লেখা শুরু করল। ধীরে ধীরে লিখল সে, কলমটা ধরে আছে শক্ত হাতে। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠল মুখ।

‘ক্ষমা করুন, ফাদার, যে পাপ আমি করেছি…’

কোন বিরতি ছাড়াই টানা দু’ঘণ্টা লিখে গেল সে, কাগজের ওপর ধীর গতিতে অক্ষর সৃষ্টি করে চলল কলম, যেন ওটা জীবন ফিরে পেয়েছে। লেখা শেষ করে কাগজের তাড়াটা ভাঁজ করে একটা খামে ঢোকাল সে, তারপর ঠিকানা লিখল:

‘ফাদার ডি কার্লো, মনাস্টেরি অভ সান বেনেদেতো, সুবিয়াকো, ইটালি।’

ফাদার ডি কার্লো ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করে না সিনথিয়া। আর কারও কাছে স্বীকারোক্তি দেয়ার কথা ভাবতেও পারেনি সে। ফাদারই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন, ওকে বুঝতে পারবেন। বাইরে তাকাল বৃদ্ধা। ভোর হয়ে গেছে। ফোন টেনে নিল সে, ট্যাক্সি ডাকবে।

পুব দিকে ছুটে চলেছে ট্যাক্সি, ভেতরে বসে বৃদ্ধা ভাবছে ফাদার ডি কার্লো সত্যি তাকে ক্ষমা করবেন কিনা। এমনও হতে পারে তিনি তার অনুতাপের বিষয়টিকে শেষ মুহূর্তের হতাশা ভেবে পাত্তা দেবেন না। শালের নিচে চিঠিটি খামচে ধরল সে জোরে, আবার চোখ বেয়ে গড়াতে শুরু করেছে পানি। এবার নিজের কথা ভেবে কাঁদছে সিনথিয়া, কাঁদছে নষ্ট, অন্ধকার জীবনটার কথা ভেবে, যে বাচ্চাটাকে সে নিজের হাতে হত্যা করেছে তার কথা ভেবে।

‘এসে পড়েছি,’ ড্রাইভারের উঁচু গলা শুনে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছল বুড়ি। দেখল যেখানে কনভেন্টটা ছিল সেখানে এখন অফিস উঠেছে। বুক কাঁপিয়ে নিশ্বাস ফেলল সে। যাক, এখানে অন্তত একটা মেইল বক্স আছে।

‘বুড়ি মা, চিঠিটা দিন। আমি ডাকে ফেলে আসি,’ বলল ড্রাইভার। কিন্তু বুড়ি রীতিমত সংগ্রাম করে ক্রাচে ভর দিয়ে নামল গাড়ি থেকে। কাউকে দিয়ে চিঠি পোস্ট করতে দিতে রাজি নয় সে। নিজেই ডাকে ফেলে এল চিঠি।

‘কাজ শেষ,’ বলল বৃদ্ধা। ‘এবার একটু বায়ে ঘোরাও, বাবা।’

চার্চটা আছে। তবে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ওটা। ছাদ-টাদহীন স্রেফ একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে, ভাঙাচোরা সাইন বোর্ড পড়ে বোঝা যায় এটা সেন্ট লিউকাস চার্চ। এখানে তাকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দেয়া হয়েছিল, তার বাবা এবং দাদুকেও।

আবার ক্যাব থেকে শরীরটাকে টেনে নামাল বৃদ্ধা, দাঁড়াল পেভমেন্টে। ফুটপাথ কাঁপছে হাতুড়ির বাড়িতে। চার্চ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কাছের একটা সাইন বোর্ডে তা. লেখাও আছে।

চার্চের দরজার দিকে পা বাড়াল বুড়ি। রশিতে পা বেধে গেল, হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল। শরীরের হাড়গুলো ফুটল মটমট করে। পেছন ফিরে তাকাল বৃদ্ধা। ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজের সীটে বসে ঝিমুচ্ছে।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল বৃদ্ধা। বিশাল ওক কাঠের দরজাটা ‘নেই’ হয়ে গেছে। ভেতরে পা রাখল সে, মুখ তুলে চাইল। ভাঙা ছাদ। ওপরে ভাঙচুর চলছে। হাতুড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। গোটা জায়গা কাঁপছে থরথর করে, জুতো ভেদ করে কাঁপুনিটা ঢুকে যাচ্ছে গায়ে। চার্চের ভেতরে একটাও বেঞ্চি নেই, শুধু বেদীটা আছে। বেদীর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল বুড়ি। ওপরে তাকাতেই ফুটো ছাদ থেকে ঝুরঝুর করে বালি পড়ল চোখে-মুখে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অন্ধ হয়ে গেল সে। চোখ ডলে খানিক পরে ধাতস্থ হলো। তাকাল যীশুর মুখের দিকে। ছেলেবেলায় এখানে কত এসেছে সে। এখানে দাঁড়িয়ে যীশুর দিকে তাকিয়ে থাকত।

যীশুর দাড়িঅলা মুখখানা অদ্ভুত শান্ত, সোজা তাকিয়ে আছেন চার্চের বারান্দার দিকে। আজ ওখানে কোন দর্শক বা উপাসনাকারী নেই। যীশু প্রার্থনার ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। বুড়ি তাঁর সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসল, শুরু করল প্রার্থনা। প্রার্থনা সঙ্গীত সম্পূর্ণ মনে আসছে না, কিন্তু সে নীরবে প্রার্থনা করে যেতে লাগল। হঠাৎ একটা প্রার্থনা সঙ্গীত মনে পড়ে গেল তার, মাথা তুলে গানটা গাইতে শুরু করল বৃদ্ধা।

হাতুড়িগুলোও যেন প্রার্থনা সঙ্গীতে যোগ দিল, একই ছন্দে বাড়ি পড়তে লাগল; নড়ে উঠল যীশুর মূর্তি, ধুলোর ঘন একটা মেঘ তার মুখটাকে ঢেকে দিল।

বুড়ি অনেক কসরত করে উঠে দাঁড়াল, হাত ছোঁয়াল ঘাড়ে। দাগটা নেই। ও জায়গার চামড়া আশ্চর্য মসৃণ। ফুঁপিয়ে উঠল সে, তবে এ তার আনন্দের কান্না।

‘আমি মুক্তি পেয়েছি, ফিসফিস করল সে।

ঠিক তখন হাতুড়ির আঘাতে তার পেছনের দেয়ালে চিড় ধরল, বেদীর ওপর দুলতে শুরু করল মূর্তি। প্রাণপণ চেষ্টায় সটান দাঁড়িয়ে গেল বৃদ্ধা, দু’হাত ছড়িয়ে দিল যীশুর দিকে।

‘এসো, প্রভু, তোমার রাজ্যে আমাকে ঠাঁই দাও।’

শেষ দৃশ্যটা সে দেখল যীশু তার ওপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছেন। ছুঁচাল দাড়ি তার খুলি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল, পাথরের আঙুলের চাপে হাড্ডিসার বুকের সবগুলো পাঁজর ভেঙে গেল মটমট করে। শেষ মুহূর্তে উল্লাসের চিৎকার দিল বৃদ্ধা।

তার লাশ আবিষ্কার করল এক রাজ মিস্ত্রী। সিনথিয়ার মরণ চিৎকার শুনতে পেয়েছিল সে। ব্যাপারটা কি জানার জন্যে ভাঙা দেয়াল টপকাল সে, দেখল যীশুর মূর্তির নিচে চাপা পড়ে আছে এক বুড়ি। মূর্তির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা একটা পা তখনও প্রবল আক্ষেপে মোচড় খাচ্ছে। বুড়ির মুখ রক্তে মাখামাখি, যীশুর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখে জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তে রাজ মিস্ত্রীর মনে হলো বুড়ি যেন হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *