আঠারো
অপরূপ সেজেছে শীলা। চোখ ফেরাতে পারছে না আর্থার। বিয়ের পর ছ’বছর হয়ে গেল, এখনও শীলাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজতে দেখলে অদ্ভুত কামনা অনুভব করে সে। এ মুহূর্তে, বিভিন্ন জায়গা থেকে টেলেক্স আসছে, টিভিতে খবর হচ্ছে, সব ভুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে আর্থার। শীলা একটা টুলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।
অনেক কষ্টে ওর ওপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে টিভির প্রতি নজর দিল আর্থার। সংবাদ পাঠক আসন্ন এক ঝড়ের কথা বলছে। ঝড় শুরু হতে যাচ্ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। সিরিয়ানরা নেসেটের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে, রাশান অ্যামবাসাডরকে তুলে নেয়া হচ্ছে তেল আবিব থেকে। ডিপ্লোম্যাটিক টেলেক্সগুলোয় চোখ বুলাল আর্থার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।
‘কি ঘটবে বলে তোমার ধারণা?’ উঠে দাঁড়াল শীলা, শরীরে ঢেউ তুলে ঘুরল, বড় বড় চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।
ঢোক গিলল আর্থার। শীলাকে এত আকর্ষণীয় এর আগে আর কখনও মনে হয়নি তার। ওর সাথে এক্ষুণি, এখানে প্রেম করার অদম্য বাসনা জাগল মনে।
‘অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না,’ শীলার দিকে এগিয়ে গেল আর্থার। কি ঘটবে ভালই জানা আছে তার। কিন্তু আসল কথা বলে ওকে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না। স্ত্রীর গা ঘেঁষে দাঁড়াল আর্থার। কিন্তু শীলার তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে, ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষতে শুরু করল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর্থার। ‘আবার বলো তো পল কবে আমাদের দাওয়াত দিয়েছে।’
‘গত হপ্তায়। বললামই তো। একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিল। তোমাকে বলেওছিলাম। তুমি শুধু মুচকি হেসেছ।’
শ্রাগ করল আর্থার। ব্যাপারটা মনে পড়ছে না। তবে শীলা যখন বলছে তখন তা সত্যি হবারই কথা।
‘তুমি রেডি?’ বলল আর্থার। ‘আমি গাড়িতে গেলাম।’
জবাবে মাথা ঝাঁকাল শীলা।
ওর ঠোঁটে হালকা চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়ল আর্থার। ঘর থেকে বেরিয়েই ছুটল সিঁড়ির দিকে। একবার পেছন ফিরে দেখল শীলা ওকে অনুসরণ করছে কিনা। স্টাডিতে ঢুকল আর্থার। ড্রয়ার খুলে হ্যাভারস্যাকটা বের করল। উল বোনার কাঁটার মত ড্যাগারের ডগা ফুটে আছে কাপড়ে। সদর দরজা খোলার আগে আবার তাকাল সিঁড়ির দিকে। স্যাঁতসেঁতে বাতাস ধাক্কা মারল নাকে। খুক খুক কাশল আর্থার। পুবাকাশ থেকে ভারী মেঘ ছুটে আসছে, কুকুরের মত বাতাসের গন্ধ শুঁকল ও। মনে পড়ে গেল বাবার কথা। বাবা বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন বৃষ্টি হবে কিনা। বলতেন বজ্রপাতের শব্দটা আসলে কিছু না-ঈশ্বর তাঁর আসবাবপত্র সরানোর সময় অমন আওয়াজ হয়। আজ রাতে ঈশ্বর অনেক আসবাব সরাবেন, গম্ভীর হয়ে ভাবল আর্থার।
কাঁকর বিছানো রাস্তা ধরে এক ছুটে গ্যারেজে পৌঁছে গেল ও, দেখল না শীলা জানালার ফাঁক দিয়ে লক্ষ করছে ওকে।
গাড়ি স্টার্ট দিল আর্থার, হ্যাভারস্যাকটা চালান করল ড্রাইভিং সীটের নিচে 1 পোশাকের কোনা উঁচু করে ধরে ছুটতে ছুটতে এল শীলা। গাড়িতে ঢোকার আগ মুহূর্তে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল গায়ে।
নুয়ে দরজা খুলে দিল আর্থার, খেয়াল করল হ্যাভারস্যাকের স্ট্র্যাপ পেঁচিয়ে গেছে গিয়ার স্টিকের সাথে। দ্রুত প্যাঁচ খুলে ওটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল শীলা দেখে ফেলার আগে। ‘কি খুঁজছ?’ সীটে বসে জানতে চাইল শীলা।
‘কিছু না,’ আর্থার চুমু খেল ওর গালে। ‘তোমাকে দারুণ লাগছে।’
‘ধন্যবাদ,’ বলে আয়না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শীলা। বৃষ্টিতে মেকআপ নষ্ট হয়ে গেল কিনা দেখার জন্যে।
নির্জন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল গাড়ি, ক্যাসেট প্লেয়ারে রিকি মার্টিনের গান বাজছে। রিকি শীলার প্রিয় গায়ক। ‘মারিয়া’ গানটার সুরে তাল মেলাতে লাগল সে। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল আর্থার। একটুও বাড়িয়ে বলেনি ও। সত্যি দারুণ লাগছে শীলাকে। ইচ্ছে করল ওকে জড়িয়ে ধরে রাখে শক্ত করে, কেউ যেন ওর ক্ষতি করতে না পারে।
গান শেষ হয়ে গেল। আর্থার সুযোগ বুঝে প্রশ্নটা করল, ‘আমি যদি আজ রাতে কিছুক্ষণের জন্যে অদৃশ্য হয়ে যাই, পলকে ব্যস্ত রাখতে পারবে তুমি?’
হাসল শীলা। ‘মানে? আমাকে বেশ্যা সাজতে বলছ তুমি? একটা ভুরু কপালে উঠে গেল কৌতুকের ভঙ্গিতে।
‘আমি কি অমন কথা বলতে পারি?’
সীটে গা এলিয়ে দিল শীলা। ‘আচ্ছা, বলো তো সত্তর বছরের বুড়োর জিনিসের সাইজটা কেমন হবে?’
‘চিনেবাদামের মত,’ বলল আর্থার। ‘বড় জোর আখরোটের সমান।’ ভাবল, ইদানীং কত স্বচ্ছন্দে এসব শব্দ উচ্চারণ করছে শীলা। অথচ বিয়ের পর ও গুষ্টি মারি’ বললেও লজ্জায় লাল হয়ে যেত মেয়েটা।
খিক খিক হাসল শীলা, হাত বাড়িয়ে চালু করে দিল ক্যাসেটের উল্টোপিঠ। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল আর্থার। ভাগ্যিস শীলা জানতে চায়নি কেন সে বাড়িটাতে চক্কর দিতে চায়। জানতে চাইলে মুশকিল হত আর্থারের। বানিয়ে কি বলত সে?
মোটরওয়ে এক্সিট সাইনটা দেখা গেল, মোড় ঘুরল আর্থার। ঘড়ির দিকে চাইল, তারপর টেপ বন্ধ করে খবর শুনল।
…মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের আশঙ্কা আরও বেড়ে গেছে জানার পর তেল আবিবে রাশান ডেলিগেশনরা তাদের এমব্যাসী ত্যাগ করেছেন। আমাদের পলিটিকাল এডিটর ক্লেয়ার ম্যাকডালি বলেছেন…
খবর শুনতে শুনতে আর্থারের মনে পড়ে গেল ছেলেটার কথা। কল্পনায় ভেসে উঠল মরা চোখ দুটো। জানে না ছেলেটার মুখোমুখি হবার সুযোগ তার হবে কিনা। তবে চেষ্টার ত্রুটি করবে না আর্থার। শুধু মুখোমুখি হয়েই তার দায়িত্ব শেষ। এরপরের কাজ ডি কার্লোর ঈশ্বর যা করার করবেন।
‘এদিকে আগে এসেছ কখনও?’ শীলার গলা শুনে বাস্তবে ফিরে এল আর্থার।
মাথা নাড়ল। ‘কেন?’
‘যেভাবে গাড়ি চালাচ্ছ মনে হচ্ছে এদিকের পথঘাট সব তোমার চেনা।’
‘আসার আগে ম্যাপে চোখ বুলিয়ে নিয়েছি।’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের ঝোপঝাড়ের দিকে তাকাল শীলা। খানিক পর পেরিফোর্ডের অট্টালিকার প্রকাণ্ড গেটের সামনে হাজির হয়ে গেল ওরা। জানালা নামিয়ে হাত বাড়াল আর্থার, টিপে দিল গেট পোস্টের বোতাম। বলল নিজের নাম। খুলে গেল গেট। গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা।
দরজায় ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল পল বুহের। তাকে দেখে খিলখিল হাসল শীলা। বলল, ‘চিনেবাদাম।’
গাড়ি থামাল আর্থার, নামার সময় জুতোর ডগায় টান লাগল হ্যাভারস্যাকের স্ট্র্যাপ, ঠুন শব্দ হলো। তবে শীলা লক্ষ করল না ব্যাপারটা। বুহের হেঁটে এল ওদের কাছে, শীলার দিকের দরজা খুলে ধরল। শীলা নামতে চুমু খেল ওকে, তারপর ঘুরল আর্থারের দিকে।
‘তুমি এসেছ খুব খুশি হয়েছি,’ হাত মেলাতে মেলাতে বলল বুহের। ভাবিনি এমন পরিস্থিতিতে আসতে পারবে।’
মোবাইলে টোকা দিল আর্থার। ‘আশা করি ডিনারের মজা এ জিনিসটা নষ্ট করবে না।’
শীলার হাত ধরে নিয়ে চলল বুহের, ওদের পিছু পিছু এগোল আর্থার।
ওরা হলঘরে ঢুকল। বাটলারের সালামের জবাবে মাথা ঝাঁকাল আর্থার। তাকাল গ্যালারির দিকে। সিঁড়ি এঁকেবেঁকে উঠে গেছে দোতলায়। করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে চাইছে ও, বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছে ছেলেটা কোথায় থাকতে পারে। শ্বাস টানল ও, লিভিংরুমে ফায়ারপ্লেসের ধোঁয়ার গন্ধ পেল শুধু।
ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর সামনে ওদের নিয়ে গেল বুহের। এখান থেকে বাগানটা পরিষ্কার দেখা যায়। ফ্লাডলাইটের আলোতে ঝলমল করছে লন আর বাগান।
‘পরে তোমাদের বাগানে নিয়ে যাব,’ বলল বুহের।
শীলাকে খুঁজল আর্থার। দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিংগুলো দেখছে সে ঘুরে ঘুরে। হাত তুলে ডাকল স্বামীকে। দাঁড়িয়ে পড়েছে একটা পোর্ট্রেটের নিচে। ওদিকে পা বাড়াল আর্থার। ডেমিয়েন থর্নের ছবি। নিচে লেখা ইউ.এস অ্যামব্যাসাডর।
‘তোমাকে বলেছিলাম না ও খুব সুন্দর দেখতে,’ ফিসফিস করে বলল শীলা, চোখ টিপল।
বুহের যোগ দিল ওদের সাথে, হাসল শীলার কথা শুনে। ‘মেয়েদের সহজেই আকর্ষণ করতে পারত ডেমিয়েন,’ বলল সে।
‘কিন্তু ওর বাচ্চাকাচ্চা হয়নি?’ প্রশ্ন করল আর্থার।
অবাক চোখে স্বামীকে দেখল শীলা। ‘ও কথা বললে কেন তুমি? কিসের মধ্যে কি!
আর্থার শ্রাগ করে ফিরল বুহেরের দিকে। ‘ভদ্রলোক বংশ রক্ষার ব্যবস্থা করে যাননি জেনে অবাক লাগছে।’
‘মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মারা যায় সে,’ বলল বুহের।
‘শুনেছি। ওঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখেছি।’
হঠাৎ নীরবতা নেমে এল ঘরে। কেউ কিছু বলছে না। নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল দরজা খোলার শব্দে। বাটলার জানাল ডিনার রেডি।
আবার শীলার হাত ধরল বুহের, বো করল। ‘তোমাদের বোধহয় খিদে পেয়েছে।’ বলে দু’জনকে নিয়ে বেরিয়ে এল সে ঘর থেকে।
হল পার হয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকল ওরা। বাটলার যার যার চেয়ার দেখিয়ে দিল। টেবিলের মাঝখানে, সুদৃশ্য মোমদানিতে ছ’টা কালো মোম জ্বলছে। লনের দিকে মুখ ফেরানো ফ্রেঞ্চ উইন্ডোগুলো খোলা। তারাজ্বলা আকাশ দেখা যাচ্ছে মেঘের ফাঁকে।
বসার সময় আর্থারের ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করে আর কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে কিনা। ডিনার পার্টিতে নারী সঙ্গ ছাড়া বুহেরের জমে না। তবে আজ বোধহয় আর কাউকে দাওয়াত দেয়নি সে। তিনটে প্লেট দেখা যাচ্ছে শুধু।
শীলার দিকে ফিরল আর্থার। আবার অনুভব করল ওকে ছাড়া তার চলবে না। এত অপরূপ লাগেনি কখনও শীলাকে। কালো, গা খোলা পোশাকটা ফর্সা শরীরে মানিয়ে গেছে দারুণ। শুধু আকর্ষণীয় বা অপরূপ বললে কম বলা হবে। বলা উচিত আগুনের মত জ্বলছে শীলা। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসল আর্থার। জবাবে শীলাও মিষ্টি হাসল। বুহেরকে ছোট বেলার গল্প বলছে সে। হাসছে বুহের।
পাঁচ ‘কোর্সের ডিনার। গল্প-গুজবে জমে উঠল বেশ। গল্প আসলে বলছে শীলা, ওরা শ্রোতা মাত্র। আকাশে মেঘ জমেছে, ঘরে আঁধার যেন ঘনিয়ে এসেছে আরও। মোমবাতির আলোয় সত্যি জ্বলছে শীলা। ও খানিকটা প্রগলভ হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত মদ পানের ফল।
পাঁচ নম্বর কোর্স পরিবেশন করা হলো ভিলের সাথে। খিদে নেই তবু জোর করে গিলছে আর্থার। ওদের গল্পে মন দিতে পারছে না। কেটে পড়ার কথা ভাবছে। বাড়িটা ঘুরে দেখা দরকার। ছেলেটার খোঁজ পাওয়া দরকার। টেবিল ছাড়ার মওকা করে দিল মোবাইল ফোন। বেজে উঠল হঠাৎ।
‘এক্সকিউজ মি,’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আর্থার।
‘ড্রইংরুমে বসে কথা বলতে পারো,’ বলল বুহের।
ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল আর্থার, দরজা বন্ধ করার সময় চাইল একবার পেছন ফিরে। বুহের এবং শীলার গল্প থেমে গেছে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে নীরবে।
এ ফোনটার অপেক্ষায় ছিল আর্থার। বার দুই হুঁ হাঁ করল ও, তারপর অফ করে দিল মোবাইল। তাকাল আয়নার দিকে। ভালই লাগছে দেখতে। বিষণ্ণ লাগছে না। বুকও ধড়ফড় করছে না। পালস স্বাভাবিক। জানালা দিয়ে আকাশ দেখল। তারপর দৃঢ় পায়ে ফিরে এল ডাইনিং রুমে।
বুহের এবং শীলা আগের মতই চুপচাপ বসে আছে। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল আর্থার, হাত রাখল স্ত্রীর কাঁধে
‘ঘটনা শুরু হয়ে গেছে,’ বলল সে। ‘তেল আবিব এবং জেরুজালেমে বোমা পড়েছে।’
মুখ তুলে চাইল ওরা, কিছু বলল না।
‘স্যাটেলাইটে দৃশ্যটা ধরা পড়েছে,’ বলল আর্থার। ‘নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। বৈরুত থেকে কোন প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পাওয়া যাবে। ইসরায়েলে হামলা হবার মানে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ শুরু।’
‘চোখের বদলে চোখ,’ বলল শীলা। তার দিকে তাকাল আর্থার। এক কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপ খসে পড়েছে, বুক প্রায় উন্মুক্ত। তবে সেদিকে খেয়াল নেই শীলার। মোমের আলোয় চকচক করছে চোখ। মাতাল হয়ে গেল নাকি, ভাবল আর্থার।
অন্যদিকে মনোনিবেশের চেষ্টা করল আর্থার। মধ্যপ্রাচ্য এখন উত্তপ্ত তাওয়া, মিসাইল হামলা হয়তো শুরু হয়ে যাবে শীঘ্রি। কি ঘটবে বুঝতে পারছে আর্থার। এর জন্যে প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি শুরু হয়ে যাবার পর মনে হচ্ছে এত চাপ সে সহ্য করতে পারবে না।
উঠে দাঁড়াল বুহের, ধাক্কা লেগে একটা মদের গ্লাস পড়ে গেল মেঝেতে। রক্তের মত ছড়িয়ে পড়ছে তরল পদার্থটা, ওদিকে ফিরেও চাইল না সে।
‘যারা জেরুজালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে,’ একঘেয়ে সুরে বলল সে। ‘তাদের মাংস পচে গলে খসে পড়বে।’
চেয়ার সরিয়ে সিধে হলো শীলাও, দাঁড়াল বুহেরের পাশে। তার দিকে স্থির তাকিয়ে বলল, ‘তাদের চক্ষু পচে যাবে কোটরের মধ্যে। তাদের জিভ পচবে মুখের ভেতর।’
আর্থার নাম ধরে ডাকল শীলার, হাত বাড়াল। ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল শীলা।
‘ইসরায়েল প্রচণ্ড নাড়া খাবে,’ বলল বুহের। ‘একই ঘটনা ঘটবে সমুদ্রের মাছ, স্বর্গের পাখি, মাঠের পশু এবং পৃথিবীর বুকে হামাগুড়ি দিয়ে চলা সমস্ত প্রাণীর ‘ভাগ্যে…’ বলে চলল শীলা
‘… এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষ,’ আগের গলায় বলল বুহের। ‘আমার উপস্থিতিতে ধাক্কা খাবে, ভেঙে পড়বে পাহাড়, এবং সমস্ত দেয়াল।’
‘শীলা!’ চেঁচিয়ে উঠল আর্থার। ওকে ধরতে গিয়ে প্রচণ্ড ছ্যাঁকা খেল হাতে। প্রচণ্ড গরম শীলার শরীর, যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আর্থার বুঝতে পারছে ওরা বাইবেল থেকে ‘কোট’ করছে। ওরা বলে চলল:-
‘প্রতিটি মানুষের তরবারি ঝলসে উঠবে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে,’ একযোগে চেঁচাল দু’জনে। ‘আমি মহামারী এবং রক্ত ছড়িয়ে দেব তার বিরুদ্ধে, আমি তার ওপর বর্ষণ করব বৃষ্টি, তার শিষ্য এবং লোকদের ওপর প্রবল বৃষ্টি ঝরাব এবং ছুঁড়ে মারব শিলাখণ্ড, আগুন ও গন্ধক।’
তীক্ষ্ণ গলায় হেসে উঠল শীলা, ওর কাছ থেকে সরে গেল আর্থার। দরজার দিকে পা বাড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতে দেখল ওরা পরস্পরের হাত ধরে আছে, শীলার কথাটা মনে পড়ে গেল আর্থারের: ‘তুমি আমাকে বেশ্যা সাজতে বলছ?’
‘এবং যখন দেখবে জেরুজালেম ভরে গেছে সৈন্যতে, জানবে ধ্বংস সমাগত,’ বলল বুহের।
তরুণ সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ে গেল আর্থারের। মনে হলো অনেক আগের ঘটনা ওটা, অন্য সময়ের, যখন সামান্য আশা তখনও প্রজ্জ্বলিত ছিল।
‘এ হবে প্রতিশোধের দিন,’ বলল শীলা, ‘যে সব ঘটনার কথা লেখা আছে তা সব ঘটবে।’
হলওয়ের দিকে যাচ্ছে আর্থার, ওদের গলা পরিষ্কার শুনতে পেল।
‘অ-ইহুদিদের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে জেরুজালেম, যত দিন না পর্যন্ত অ- ইহুদিদের শাসনকাল পূর্ণ হয়…’
দরজায় হোঁচট খেল আর্থার, কি করছে বুঝতে পারছে না। শুধু জানে এখান থেকে চলে যাবার আগে ড্যাগারসহ ছেলেটাকে খুঁজে পেতে হবে।
গাড়ির দরজা খুলল ও, হ্যাভারস্যাকটা বের করে কাঁধে ঝোলাল। পিঠে ড্যাগারের ছুঁচাল ডগার খোঁচা খেয়ে ‘আউ!’ করে উঠল।
বুড়ো সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ে গেল আর্থারের: ‘জাগ্রত যীশু আপনাকে সাহায্য করবেন।’ কথাগুলো মনে মনে আওড়াল ও। ব্যাপারটা এখন তাঁর ওপর নির্ভর করছে। এটা তাঁর কর্তব্য। আর্থারের দায়িত্ব ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া। তারপর ডি কার্লোর ঈশ্বরের হাতে সব ছেড়ে দেবে সে। তিনি যা করার করবেন।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, মুখ তুলে চাইতে কুকুরটাকে দেখতে পেল আর্থার। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঘুরে দাঁড়াল ওটা, করিডর ধরে নিঃশব্দে হাঁটা দিল, যেন পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে আর্থারকে। দ্রুত ওপরে উঠে এল আর্থার, অনুসরণ করল জানোয়ারটাকে। ওর মন জুড়ে এখন ছেলেটার ভাবনা। তাকে যেমন করে হোক খুঁজে পেতে হবে।
করিডর অন্ধকার। শেষ মাথায় কালো একটা দরজা, ভেজানো। দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল কুকুরটা, আর্থারকে যাবার পথ করে দিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা, সামনের দৃশ্যটা দেখেই বুঝতে পারল তাকে এতদিন যা বলা হয়েছে তার মধ্যে অতিরঞ্জন নেই একরত্তি, সব সত্যি।
কালো একটা আলখেল্লা পরনে ছেলেটার, ঝুঁকে আছে লাশের পাশে, নিঃশব্দে ঠোঁট নড়ছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে। দু’কদম বাড়ল আর্থার, ঠং শব্দ তুলল হ্যাভারস্যাকের ড্যাগার। তবে শব্দ শুনেও ঘুরল না ছেলেটা। যেন তাকে সম্মোহন করা হয়েছে।
যীশুর প্রতিমূর্তির দিকে নিঃশব্দে এগোল আর্থার, শিরদাঁড়ায় বেঁধা ড্যাগারটা দেখল। সব খাপে খাপ মিলে গেছে। খামোকাই ফাদারকে এতদিন সন্দেহ করেছে সে। যীশুর চোখের দিকে চাইল সে, তারপর নজর ফেরাল লাশটার দিকে। ওর মেরুদণ্ডে শীতল একটা স্রোত নেমে এল।
চোখ বুজে প্রার্থনা করল আর্থার। যীশুর সাহায্য চাইছে। চোখ খুলল। এখন ও জানে ওকে কি করতে হবে। তবে সেই শক্তি ওর মাঝে আছে কিনা ভেবে সন্দেহ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখান থেকে কেটে পড়ে, শীলার হাত ধরে, গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। কিন্তু যীশুর যন্ত্রণাকাতর চেহারার দিকে চোখ যেতে সে ইচ্ছেটা মরে গেল। কি জীবন্ত একটা মুখ!
যীশুর মূর্তির পেছনে চলে এল আর্থার, পিঠ থেকে টান মেরে ছুরি খুলল। মোমবাতির আলোয় ঝিলিক দিল ধারাল ফলা। যীশুর মুখ, মাথার কাঁটার মুকুট ইত্যাদি ছুঁলো ও। তারপর হ্যাভারস্যাকটা মেঝেতে নামিয়ে ছ’টা ড্যাগার বের করল।
ছেলেটা লাশের পায়ের কাছে এখনও হাঁটু গেড়ে বসে আছে, ক্রুশ থেকে ছুটিয়ে আনা ড্যাগারের বাঁটটা চেপে ধরল আর্থার দুই হাতে। তাকাল ছেলেটার দিকে। সুঠামদেহী ছেলেটার পাতলা আলখেল্লা ফুটে বেরিয়ে আছে পিঠের হাড়। পিঠে ছুরি বসিয়ে দিলেই হলো। কিন্তু এভাবে চোরের মত পিঠে ছুরি বসানো আর্থারের পক্ষে সম্ভব নয়।
‘ক্ষমা করো, বিড়বিড় করল সে, হাত বাড়িয়ে ছেলেটার কাঁধ ধরে চাপ দিল যাতে সে আর্থারের দিকে ঘুরে বসে।
ঘুরল ছেলেটা, আর্থারের দিকে চাইল মুখ তুলে। মুখটা সাদা, চোখ দুটো হলুদ। জ্বলজ্বল করছে। হাসল সে।
আবার ড্যাগার তুলে নিল আর্থার, জোর করে তাকিয়ে রইল হলুদ চোখ জোড়ার দিকে, গভীর দম নিল। এবার…
খুলে গেল দরজা। আলোর একটা ঝলক ঢুকল ঘরে। সাথে সাথে আক্রান্ত হলো আর্থার। বোটকা একটা গন্ধ নাকে বাড়ি মারল, সেই সাথে প্রবল ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মেঝেতে, হাত থেকে ছুটে গেল ড্যাগার। দেখল ওর টুটি কামড়ে ধরতে যাচ্ছে কুকুরটা।
প্রকাণ্ড মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরল আর্থার, বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে দিল চোখে, কনুই দিয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে, তারপর কাত হয়ে জানোয়ারটার নিচের চোয়াল ধরে ফেলল এক হাতে।
মাথা ঝাঁকাল কুকুরটা, কামড় বসাল আর্থারের হাতে। আর্তনাদ করে উঠল আর্থার যন্ত্রণায়, পশুটা ওকে যেন মেঝের সাথে গেঁথে ফেলেছে। মাথা ঝাঁকাচ্ছে কুকুরটা, লালা পড়ছে মুখ বেয়ে, আর্থারের হাঁ করা মুখে ঢুকে গেল। শ্বাস বন্ধ হয়ে এল আর্থারের, থুথু ছিটাল হলুদ চোখে। এক মুহূর্তের জন্যে ওটার শক্ত আলিঙ্গন শিথিল হলো। ওই এক সেকেন্ডেই গড়ান মেরে খালি হাতটা দিয়ে ড্যাগারটা মুঠো করে ধরে ফেলল আর্থার। এদিকে কুকুরটা আবার ওর হাত কামড়ে ধরেছে, মেঝের সাথে ঠেসে ধরছে। হঠাৎ ওটা হাত ছেড়ে কামড়ে ধরল কাঁধ, ডানে-বামে ঝাঁকি খেল মাথা, খরগোশের মত আর্থারের ঘাড় মটকে দিতে চাইছে। ব্যথায় আবার চিৎকার দিল আর্থার, টের পেল কাঁধের কাছটায় ছিঁড়ে গেছে মাংস, হাতটা অবশ হয়ে পড়েছে। মোচড় খেল আর্থার, ছুরি ধরা হাতটা দিয়ে কোপ মারল। গায়ে লাগল না কুকুরটার, বাতাস কাটল শুধু।
আবার ড্যাগার চালাল আর্থার, এবার কুকুরটার গায়ে কোথাও লাগল ওটা, পশম ভেদ করে ফলা ঢুকে গেল মাংসে। ‘ঘাউ!’ করে উঠে ছেড়ে দিল আর্থারকে। হাঁটু ভাঁজ করে চিবুকের কাছে এনে গড়ান দিল ও, ক্রুশের পায়ের কাছে ধাক্কা খেল। জানোয়ারটার চাপ থেকে মুক্ত হয়ে মাত্র ও মুখ তুলেছে, দেখল ওটা লাফিয়ে পড়ছে ওর গলা লক্ষ্য করে। এবার রক্ত মাখা লালা পড়ল আর্থারের মুখে।
এক মুহূর্তের জন্যে আহত প্রাণীটার জন্যে মায়া লাগল আর্থারের, ইচ্ছে করল আদর করে। তা না করে গলায় বসিয়ে দিল ছুরি। এত জোরে ছুরি বসিয়েছে, মুঠো থেকে ছুটে গেল ওটা। পর মুহূর্তে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল আলো কুকুরটা ওর গায়ে এলিয়ে পড়তে। দড়াম করে শব্দ হলো পেছনে, পড়ে গেছে ক্রুশ। গোঙাচ্ছে কুকুরটা, রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে আর্থারের মুখ।
লাথি মেরে জানোয়ারটাকে গায়ের ওপর থেকে ফেলে দিল আর্থার, গড়ান দিয়ে সরে গেল একপাশে। যীশু পড়ে আছেন মেঝেতে, স্থির চেয়ে আছেন আর্থারের দিকে। পতনের কারণে শিরদাড়ায় চিড় ধরেছে। উঠে বসার চেষ্টা করছে আর্থার, ছেলেটা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। হাসছে। কুকুরটাকে আবার আসতে দেখে লাথি মারল আর্থার। মুখে ড্যাগার বেঁধাতে পারেনি ও। কাঁধে বিধে আছে দেখে আফসোস হলো আর্থারের। ধীরে ধীরে শরীরটাকে টেনে তুলল আর্থার, ক্রুশের গায়ে হেলান দিল। তাকাল ছেলেটার দিকে। ছেলেটাকে হাসতে দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে ও। ওকে এখানে কেন আনা হয়েছে, কেন বুহের দাওয়াত দিয়েছে সব এখন পরিষ্কার আর্থারের কাছে। ওকে ওরা মেরে ফেলতে চেয়েছে। শেষ বোঝাপড়া করতে চেয়েছে ওরা। ড্যাগারগুলো চেয়েছে ওরা যাতে শয়তান-পুত্র চিরতরে বিপদ মুক্ত হতে পারে।
অনেক কষ্টে হাঁটু মুড়ে বসল আর্থার। ডান হাতটা অকেজো, অসাড় ভঙ্গিতে ঝুলছে শরীরের পাশে। আঙুল নাড়াতে চেষ্টা করল, সাড়া পেল না কোন। ঘাড় বেয়ে পিঠে নামছে রক্ত স্রোত, হঠাৎ খুব ঘুম পেল আর্থারের। ইচ্ছে করল চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে, ভুলে যায় সব কিছু।
ছেলেটা ঝুঁকে দেখল আর্থারকে, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। করিডরে কেউ এসেছে। আর্থার দেখল শীলা এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়ায়। আধো আলো, আধো ছায়ায় মনে হলো ও নগ্ন।
শীলা এগোল আর্থারের দিকে। ওকে দেখে খুশি হয়ে উঠল আর্থার। অক্ষত হাতটা বাড়িয়ে দিল যাতে শীলা ওকে টেনে তুলতে পারে। কিন্তু আর্থারকে অগ্রাহ্য করে ছেলেটার দিকে ঘুরল শীলা। চোখ পিটপিট করল আর্থার, মাথা ঝাঁকাল। আবার সে হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়েছে। ডি কার্লোর কথা মনে পড়ে গেল: ‘কল্পনা শক্তির ওপরেও রয়েছে তার ক্ষমতা…’
ও নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন দেখছে, যেমন ক্রুশের ওপর শিশুকে দেখেছে, সেরকম। ওর স্ত্রী ওই জঘন্য প্রাণীটাকে কিছুতেই আদর করতে পারে না। সবই আসলে দৃষ্টিবিভ্রম।
চোখ বুজল আর্থার, গলার কাছে জমাট বাঁধল চিৎকার। চোখ মেলল ও, বিশ্বাস হলো না দেখে শীলা আস্তে আস্তে কুকুরটার কাঁধ থেকে ছুরিটা বের করে নিচ্ছে, বিশ্বাস করতে মন চাইল না দু’হাতে ছুরি ধরে তাকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, অবিশ্বাস্য লাগল তারপরও শীলা হাসিমুখে ছুরিটা ওর বুকেই বসাতে যাচ্ছে দেখে।
এটা হ্যালুসিনেশন ভেবে মাথা ঝাঁকাল আর্থার, সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতে শেষ সময় হাতটা উঠে গেল শীলাকে বাধা দেয়ার জন্যে। তীব্র ব্যথার ঢেউটা যখন ওকে আঘাত করল তখনও ব্যাপারটা অস্বীকার করতে চাইল মন। চিৎ হয়ে পড়ে গেল আর্থার, হাঁ হয়ে গেল মুখ, গলার কাছে জমাট বাঁধা চিৎকারটা বেরিয়ে এল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ঘাড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া ড্যাগারের বাঁটের দিকে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও বিশ্বাস হতে চাইল না জুগুলার ভেইন থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা লাল স্রোতটা ওরই শরীরের রক্ত। পৃথিবী আঁধার হয়ে যাবার আগ মুহূর্তে আর্থার দেখল ড্যাগারের বাঁটে, যীশুর মুখটা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, যেন ওরই যন্ত্রণা ধারণ করে।
.
খিঁচুনি খেতে থাকা শরীরটার পাশ থেকে সরে গেল শীলা, তাকাল নিজের রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়া পোশাকের দিকে। মরে গেছে আর্থার, তারপরও ধমনী দিয়ে গল গল ধারায় রক্ত পড়ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে চ্যাপেলে, রক্ত রঞ্জিত করে তুলছে ভাঙা যীশু মূর্তিকে।
হাত বাড়িয়ে শীলাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ছেলেটা, তারপর মমি করা লাশের সামনে নিয়ে গেল।
‘হাঁটু গেড়ে বসো, নির্দেশ দিল সে। আদেশ পালন করল শীলা। মুখ তুলে দেখল লাশের চোখে মোমের আলো পড়েছে, যেন হাসছে ডেমিয়েন ওর দিকে তাকিয়ে। যেন জ্যান্ত সে, আশীর্বাদ করছে শীলাকে তার কাজে খুশি হয়ে।
‘তার শক্তি আমার ভেতর,’ শীলার মনের কথা যেন পড়ে ফেলল ছেলেটা। ‘এবার সময় এসেছে ধ্বংসের।’
‘আমেন,’ ফিসফিস করল শীলা 1
ঘুরল ও, কুকুরটা অনেক কষ্টে উঠে বসেছে, জিভ দিয়ে চাটছে আহত কাঁধ। টেনে টেনে এগোল জানোয়ারটা শীলার কাছে। ডানে আর বামে একবার চোখ বুলাল, তারপর লাশের হাত চেটে দিল। রক্ত লেগে গেল আঙুলে।
ছেলেটা শীলাকে টেনে তুলল। তার শক্তি অনুভব করো,’ বলল সে।
লাশটাকে জড়িয়ে ধরল শীলা। হঠাৎ একটা শব্দ হতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ছেলেটা ভাঙা ক্রুশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যীশুর দিকে।
‘তারপর নাজারিন,’ মুখ বাঁকাল ছেলেটা, ‘তোমার শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটল। তুমি, যে মানবতার কথা বলতে, সেই তুমি এখন কোথায়?’
শীলার দিকে আঙুল তুলল সে।
‘দেখো,’ বলল ছেলেটা। ‘একে দেখো। স্বামীর রক্তে রঞ্জিত সে, আমার বাবার প্রতি কামার্ত সে। তার স্বামী আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই নারী তার স্বামীকে ধ্বংস করেছে। তোমার এই পরাজয়ের লজ্জা কোথায় রাখবে, নাজারিন?’
যীশুর মাথার মুকুটের কাঁটাগুলো খামচে ধরল সে দু’হাতে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুখের দিকে।
‘পৃথিবী এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় অস্থির। ভবিষ্যদ্বাণীগুলোও ফলে যাবার পথে। সবকিছুর অবসান ঘটবে শীঘ্রি।’
সিধে হলো ছেলেটা, হাসল। চ্যাপেলে শুধু শোনা গেল শীলার মৃদু বিড়বিড়ানি আর কুকুরটার গোঙানি। এছাড়া গোটা চ্যাপেল নীরব, নিস্তব্ধ।