আবার অশুভ সঙ্কেত – ১২

বারো

শত শত, হাজারে হাজারে দল বেঁধে ওরা এল র‍্যালিতে যোগ দিতে। লন্ডনের পুব থেকে পশ্চিমে স্লোন স্কোয়ার পর্যন্ত জ্যাম বেঁধে গেল। অক্সফোর্ড স্ট্রীটের দক্ষিণ থেকে এমব্যাঙ্কমেন্ট এবং সবগুলোর কেন্দ্র বিন্দু, ট্রাফালগার স্কোয়ারে সব যেন স্থির হয়ে রইল। জনসভায় যোগ দিতে কত লোক এসেছে প্রেস এবং মিডিয়া দু’পক্ষই অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যত দূর চোখ যায় শুধু মানুষের মাথা। স্কোয়ারের দিকে এগোচ্ছে সবাই, প্রতি মিনিটে বেড়ে চলেছে লোকসংখ্যা। ঘোড়ার পিঠে এবং রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পুলিশ নীরবে দেখছে তাদেরকে।

বক্তৃতা শুরু হবার কথা দুপুর তিনটায়। কিন্তু দেড়টার সময়ই পিমলিবোতে পল বুহেরের লিমোজিন জ্যামে আটকা পড়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পিঁপড়ের মত পিলপিল করে লোকজন তাদের গন্তব্যে চলেছে। বেশিরভাগের পরনে কঙ্কালের ছবি আঁকা আলখেল্লা, অনেকে কাফনও পরে আছে।

বুহের কনসোলের একটা বোতাম টিপল।

‘কি ব্যাপার?’

ভেসে এল ড্রাইভারের কণ্ঠ, ‘জ্যাম, স্যার। পুলিশ বলছে এখান থেকে আর গাড়ি যাবে না।’

‘ধ্যাত্তেরি, বেজায় বিরক্ত হলো বুহের। বেশি রাগ লাগছে ছেলেটার ওপর। ওর জন্যেই এই র‍্যালিতে আসা। মাঝে মাঝে কি যে বাই চাপে ছেলেটার মাথায়। অথচ ব্যাপারটা তাকে মানায় না। খুব কম ব্যাপারেই সে কৌতূহল প্রকাশ করে।

‘চলুন, নেমে পড়ি,’ বলল ছেলেটা।

‘কিন্তু অনেকটা পথ হাঁটতে হবে,’ আপত্তি জানাল বুহের।

ছেলেটা কিছু না বলে দরজা খুলে নেমে পড়ল। তার পিছু পিছু কুকুরটাও। অগত্যা বুহেরকেও উঠতে হলো। নামার আগে ড্রাইভারকে বলল কোথায় গাড়ি পার্ক করতে হবে। ওখানে থাকবে ওরা।

ভিড়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল ওরা। একটা জার্মান শেফার্ড ওদের আগে আগে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, ছেলেটা আর কুকুরটাকে দেখে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চাউনি, দ্রুত ফুটপাথে উঠে পড়ল সে, কান দুটো সেঁটে গেছে মাথার সাথে।

খুব গরম পড়েছে। ঘামছে জনতা। ঘামের গন্ধে নাক কোঁচকাল ছেলেটা কুকুরটার মাথায় আলতো হাত রাখল। বুহের ওদের ঠিক পেছনে। বারবার ঘড়ি দেখছে সে। হোয়াইট হল-এ মীটিং শুরু হবার কথা এখন। তার কর্মচারীরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবে হেডকোয়ার্টারে। তার অফিসে থাকা দরকার ছিল। এ সব গোঁয়ার্তুমির কোন মানে হয় না। মুখ অন্ধকার করে সে ছেলেটার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। ভিক্টোরিয়া পার হয়ে, মল ধরে ট্রাফালগার স্কোয়ারের কাছাকাছি এসে পড়ল ওরা। লাউড স্পিকারের কর্কশ আওয়াজ আর জনতার চেঁচামেচি শোনা গেল পরিষ্কার। মাথার ওপর পুলিশের হেলিকপ্টার উড়ছে। রোটর ব্লেডের গর্জনে জনতার চিৎকার চাপা পড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

স্কোয়ারে পৌছে দেখল জনতা গাদাগাদি করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা তার কুকুর সঙ্গীকে নিয়ে ভিড় ঠেলে এগুতে লাগল। অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করল। তবে কুকুরটাকে দেখে কেউ কেউ আড়ষ্ট হয়ে গেল। এক লোক রাস্তা ছাড়ছিল না বলে কুকুরটা বিরাট মাথা দিয়ে তাকে ঢুস দিল। রেগেমেগে কিছু বলার জন্যে নিচে তাকিয়েছে লোকটা, তাকে লক্ষ্য করে দাঁত মুখ খিঁচাল কুকুর। সভয়ে একপাশে সরে গেল লোকটা। নেলসন্স কলামের নিচে এসে দাঁড়াল তিনজনের দলটা। পাথরের একটা সিংহাসনের পাশে ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিল। তাকাল দশ গজ দূরের প্ল্যাটফর্মের দিকে। মাটি থেকে অন্তত বিশ ফুট উঁচুতে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। প্ল্যাটফর্মের দু’পাশে, পনেরো ফুট উচ্চতায় দুটি ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন, ক্লোজ- আপে ধরে রেখেছে এক তরুণ, জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের মুখ। রাজনীতিবিদটি এ আন্দোলনের অন্যতম এক প্রতিষ্ঠাতার দৌহিত্র। তার কণ্ঠ স্পিকারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা স্কোয়ারে।

‘বন, প্যারিস, হেগ, রোম, দিল্লী, ঢাকা সহ আরও অনেক শহরে এই আন্দোলন একই সাথে সূচিত হতে চলেছে।’

জনতা সায় দিল তার কথায় গর্জে উঠে

‘আর পাঁচ ঘণ্টা পর ওয়াশিংটনের উদ্দেশে একটি মার্চ শুরু হবে। কাল পালা দূর প্রাচ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার। মস্কো, প্রাগ, বুদাপেস্ট এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আমাদের অন্যান্য বন্ধুরা আমাদের প্রচেষ্টার কথা জানতে পারবে এবং উৎসাহিত হয়ে উঠবে তাদের সংগ্রামে শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে…

হাই তুলল বুহের।

‘এবার,’ বলল তরুণ রাজনীতিবিদ, ‘আসছেন জ্যাক বিকহ্যাম।’

জনতার উল্লসিত চিৎকারে কানে তালা লেগে গেল। কানে হাত চাপা দিল বুহের, তাকাল ছেলেটার দিকে। সে নেলসন্স কলামের সিঁড়ির ওপর উঠে বসেছে। চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে, কাউকে খুঁজছে বোধহয়। চঞ্চল দৃষ্টি স্থির হলো সাদা চুলো, লম্বা, রোগা এক লোকের ওপর। হেঁটে যাচ্ছেন প্ল্যাটফর্মে, তাঁকে নিয়ে আসছে সোনালি রঙের একটা ল্যাব্রাডর। মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কুকুরটা, যেন সুতোয় বেঁধে টেনে আনা হয়েছে তাকে। তারপর তাকাল বুড়ো লোকটির দিকে। নাক দিয়ে ধাক্কা মারল হাতে; বুড়োকে বুঝিয়ে দিল মাইকের অবস্থান। তিনি দু’হাত তুললেন জনতার উদ্দেশে, তাঁর বাম হাতে বাঁধা কুকুরটার বেল্ট।

ভিড়ের ওপর নজর বোলাল বুহের। হাততালি দিচ্ছে জনতা, চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কেউ কেউ শিসও দিল। ডেমিয়েন থর্নের কথা মনে পড়ল বুহেরের। নিজের শিষ্যদের ওপর এরকম প্রভাব ছিল তার। তবে পার্থক্য একটাই- তার শিষ্যরা ছিল এদের চেয়ে সৎ। এই লোকগুলো জ্যাক বিকহ্যামের জন্যে জীবন দিতে পারবে? তারচে’ও বড় কথা তারা তাদের নেতার জন্যে মানুষ খুন করতে পারবে? বুহেরের সন্দেহ হলো পারবে না।

পর্দায় বুড়ো লোকটার চেহারা ফুটে উঠল। চোখে গাঢ় রঙের চশমা। মানুষটা অন্ধ। ল্যাব্রাডরটা তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। জ্যাক বিকহ্যামকে বলা হয় বারট্রান্ড রাসেলের যোগ্য উত্তরসুরি। তিনি একজন দার্শনিক, একজন মানবতাবাদী, রাজনীতিবিদদের চেয়ে তাঁর জ্ঞান প্রখর, অসাধারণ বাগ্মীতার কারণে বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমিক শ্রেণীকে একই ছাতের তলায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে তাঁর পক্ষে।

আবার ছেলেটার দিকে ফিরল বুহের। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জ্যাক বিকহ্যামের দিকে। পাথুরে স্তম্ভের ওপর বসে কুকুরটাও সম্মোহিতের মত চেয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্মের দিকে।

জ্যাক বিকহ্যাম হাত নামালেন। সাথে সাথে থেমে গেল জনতার চেঁচামেচি, যেন হঠাৎ সুইচ অফ করে দেয়া হয়েছে। গলা খাঁকারি দিলেন তিনি, বজ্রের মত শোনাল শব্দটা। ল্যাব্রাডর কান খাড়া করে তাকাল প্রভুর দিকে, যেন সব ঠিক আছে কি না দেখছে।

‘বন্ধুগণ,’ বৃদ্ধের কণ্ঠ গভীর এবং জোরাল। শুনেছি আজকের মত জন সমাবেশ এই শহরে আগে কোনদিন হয়নি।

জনতা আবার চিৎকার করে তাঁকে সায় দিতে যাচ্ছিল, এক হাত তুলে তাদেরকে থামালেন বিকহ্যাম।

‘এক, মহান ব্যক্তি, সাংবাদিক মেন্ডাল জনসন, যিনি আমাদের আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের মত একটি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বলেছিলেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, অক্সফ্যাম বলে কোন কিছুর যেন অস্তিত্ব না থাকে।’ বিরতি দিলেন তিনি। তারপর শুরু করলেন, ‘আমিও তাঁর কথার প্রতিধ্বনি তুলে বলতে চাই, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলনের যেন আর প্রয়োজন না হয়, ঈশ্বর।’

সাগরের ঢেউ’র মত গর্জন উঠল এবার, থামতেই চায় না। বিকহ্যাম ডান থেকে বামে একবার মাথা ঘোরালেন, যেন জনতার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছেন।

আবার একটা হাত তুললেন তিনি। আবার নীরব হয়ে গেল জনতা।

‘আজ বিকেলে, অনুমান করি প্রায় এক মাইল লম্বা লাইন সৃষ্টি হয়েছে আপনাদের আগমনে। আপনারা এসেছেন এমন একটি সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যেটি গত পঞ্চাশ বছর ধরে গোটা বিশ্বে হুমকির সৃষ্টি করে চলেছে। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দিন কাগজে-কলমে শেষ হলেও পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কিন্তু থেমে নেই। অর্ধেক পৃথিবী আজও যুদ্ধের উন্মাদনায় অস্থির। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা, আমাদের সামরিক শাসকরা তা দেখেও না দেখার ভান করছেন। আমরা রাজনীতির নামে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, সন্ত্রাস এবং ভণ্ডামি চাই না। আমরা চাই সারল্য, জবাবদিহিতা। দলগত রাজনীতির এখন কোন প্রয়োজন নেই। এখন প্রয়োজন নিজেদেরকে, বিশ্ব মানবতাকে বাঁচানোর প্রশ্নে একত্র হওয়া। আমরা চাই অস্ত্র মুক্ত, হানাহানি মুক্ত একটি বিশ্ব।

পুরো এক মিনিট হাততালি চলল। বুহের তার বাম পাশে দাঁড়ানো পুলিশদের জনতার সাথে তাল মিলিয়ে হাততালি দিতে দেখে অবাক হলো।

‘একটা পতিত জমির জন্যে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের কি মানে আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন বিকহ্যাম।

‘কোন মানে নেই,’ গর্জে উঠল জনতা।

‘যে গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার জন্যে বিকল্প সমাজ ব্যবস্থার কথা বলার কতটুকু দরকার আছে?’

আবার গর্জে উঠল জনতা: কোন দরকার নেই।

বুড়ো মানুষটি দুই হাত ওপরে তুললেন, গলার বেল্টে টান পড়ায় উঠে দাঁড়াল কুকুরটা।

‘আপনারা অনেকেই জানেন,’ বললেন বিকহ্যাম, ‘আমি ধর্মভীরু নই। তবু টিমোথিকে বলা পলের দ্বিতীয় চিঠি থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃতি করে শোনাচ্ছি,’ আবার গলা খাঁকারি দিলেন তিনি। কুকুরটা তাকাল ভিড়ের দিকে, একটা থাবা দিয়ে প্ল্যাটফর্মে আঁচড় কাটছে।

বুহের লক্ষ করল ছেলেটা এবার ল্যাব্রাডরটার দিকে নজর ফিরিয়েছে, চোখের পলক পড়ছে না।

‘কেয়ামতের দিন,’ শুরু করলেন বিকহ্যাম, ‘ভয়ঙ্কর এক সময় উপস্থিত হইবে। মানুষ হইয়া উঠিবে অহঙ্কারী, অর্থ লোলুপ, ঈশ্বর-নিন্দুক, অকৃতজ্ঞ, পিতা-মাতার অবাধ্য, অপবিত্র, আত্মসংযমহীন, অসচ্চরিত্র, দয়া-মায়াহীন, শাস্তি ভঙ্গকারী, ক্রোধোন্মত্ত, বিশ্বাসঘাতক, সমস্ত ভালর নিন্দাকারী।’

ল্যাব্রাডর এবার পেছনের পায়ে ভর করে দাঁড়াল, সামনের থাবা দুটো আড়াআড়ি রাখল মুখের ওপর, নাক উঁচু করে বাতাসে কিসের যেন গন্ধ শুঁকল। বুহেরের মনে হলো ওটা সরাসরি ছেলেটার দিকে তাকাল।

‘আমি আপনাদের আহ্বান করছি যাদের মনে বিশ্বাস আছে তারা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন,’ বললেন বিকহ্যাম। ‘আর যাদের বিশ্বাস নেই তারা নিজেদের বিবেক ও বুদ্ধিমত্তার ওপর ভরসা রাখুন।’

পলকহীন চোখে ল্যাব্রাডরের দিকে চেয়ে আছে ছেলেটা। প্ল্যাটফর্মে আঁচড় কাটছে ওটা, মুখ বেয়ে লালা পড়ছে। পর্দায় দেখতে পাচ্ছে ওটাকে জনতা।

‘আমার থীম,’ বলে চললেন বৃদ্ধ, ‘নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে…’

লাফ দিল ল্যাব্রাডর, প্রভুর মুখে কামড় বসাল। হোঁচট খেয়ে পেছন দিকে হেলে গেলেন তিনি, মাইক্রোফোনের তার বেঁধে গেল পায়ে, তাঁর পতন-চিৎকার অ্যামপ্লিফায়ারে প্রতিধ্বনি তুলল স্কোয়ারে। কেউ এক চুল নড়ছে না। প্ল্যাটফর্মের পাশে দাঁড়ানো ভলান্টিয়াররা যে যার জায়গায় জমে গেল, নড়তে ভুলে গেছে।

পিছিয়ে এল কুকুরটা, বিকহ্যাম টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন, কুকুর-বাঁধা রশি বা বেল্টটা এখনও তাঁর কব্জিতে বাঁধা।

‘ওহ্, মাই গড,’ ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি, গোঙানির শব্দ ছড়িয়ে পড়ল জনারণ্যে। এক হাতে মুখ চাপা দিলেন বিকহ্যাম। কাছের লোকজন পরিষ্কার দেখতে পেল তাঁর আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। টেলিভিশন পরিচালক চট করে ক্লোজ-আপে ধরল মুখটা, জনতা বিকহ্যামের রক্তাক্ত চেহারা পর্দায় দেখে শিউরে উঠল। চশমাটা ঝুলে আছে এক কানের ওপর, চোখের শূন্য কোটর রক্তাক্ত হাতে চেপে ধরে আছেন তিনি। ভলান্টিয়াররা এবার ছুটল তাঁর দিকে; কুকুরটা ঘুরে দেখল তাদেরকে, তারপর ফিরল ভিড়ের দিকে, এগোল প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায়, বুড়ো মানুষটাকে পেছনে টানতে টানতে।

কুকুরটার মতলব বুঝতে পেরে চিৎকার দিল এক মহিলা। ঠিক সেই সময় শূন্যে লাফ দিল ল্যাব্রাডর জ্যাক বিকহ্যামকে নিয়ে। বাতাস খামচালেন বৃদ্ধ বৃথা অবলম্বনের আশায়। ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন, ক্যামেরা অনুসরণ করল তাঁকে, মাইক্রোফোনে ধরা পড়ল তাঁর অন্তিম চিৎকার, সাউন্ড সিস্টেম নিখুঁতভাবে কাজ করল, বিশ ফুট নিচে কুকুরটা ছিটকে পড়ল; তার হাড় ভাঙার আওয়াজ সেই সাথে জ্যাক বিকহ্যামের খুলি ফেটে যাবার শব্দও স্পষ্ট শোনা গেল। তাঁর মরণ আর্তনাদ শুনে গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল সবার।

ছুটে আসা ভলান্টিয়ারদের চিৎকারও শোনা গেল মাইক্রোফোনে। বিস্ময়ে স্তম্ভিত জনতার বিড়বিড়ানিও পরিষ্কার তুলে ধরল মাইক্রোফোন। ওটার তার প্ল্যাটফর্মের মাথায় ঝুলে আছে।

সবার আগে প্রতিক্রিয়া ঘটল ছেলেটার মধ্যে। ঘুরল সে, তাকাল ত্রিশ গজ দূরে চেস্টনাট পুলিশ-ঘোড়ার দিকে। ওদিকে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে মোট দশজন অশ্বারোহী পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল হোয়াইট হল-এ যাবার রাস্তা পরিষ্কার রাখতে। মাথা ঘোরাল ঘোড়া, আরোহী তার আকস্মিক চাঞ্চল্যে অবাক হলো। বলগা ধরে টান দিল সে। কিন্তু ঘোড়াটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়েই থাকল ছেলেটার দিকে। ওটার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, ঠোঁট কাঁপছে, বেরিয়ে পড়ল দাঁত, মৃদু গোঙানি বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। শব্দ শুনে অন্য ঘোড়াগুলো ফিরল তার দিকে। তারপর দৃষ্টি অনুসরণ করে নেলসন’স কলামে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে তাকাল এক সাথে।

প্রকাণ্ড ঘোড়াটা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে, শুধু চোখ জোড়া বিস্ফোরিত হলো আতঙ্কে, তারপর পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হলো, ঝাঁকি খেল মাথা, পরক্ষণে সবেগে সামনের দিকে ছুটল দলের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে। ঝাঁকির চোটে তিন পুলিশ পড়ে গেল ঘোড়ার পিঠ থেকে, অন্যরা কোনমতে ঝুলে রইল বলগা ধরে। বলগায় টান মেরেও ঘোড়াগুলোকে থামাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো তারা। ব্যানার হাতে এক তরুণ দম্পতি হঠাৎ খেপে ওঠা ঘোড়াদের শিকার হলো প্রথমে। বিশালদেহী চেস্টনাটের খুরের নিচে পড়ে নিমিষে রক্তাক্ত হয়ে গেল তারা। তাদের আর্তনাদ শোনা গেল অ্যামপ্লিফায়ারে।

আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো ভিড়ের মাঝে আরও সেঁধিয়ে গেল। বাকিগুলো ভয়ে এবং মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে আক্ষরিক অর্থেই উন্মাদ হয়ে উঠল। কলামের সাথে সেঁটে গেল বুহের একটা ঘোড়াকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে। ওটার পায়ের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে পুরুষ আর নারীরা। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোড়াটা, ঘুরল, এক লাফে পার হলো একটা ব্যারিয়ার, ছুটল এক দল তরুণকে লক্ষ্য করে। চারটে খুরের আওয়াজ যেন বুলেটের শব্দ তুলল কংক্রিটের রাস্তায়।

ঘোড়াগুলোর হামলায় দিশেহারা লোকজন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। ধাক্কাধাক্কিতে অনেকেই ছিটকে পড়ছে রাস্তার ওপর, তাদেরকে পায়ে মাড়িয়ে অন্যরা ছুটছে। চিৎকার-চেঁচামেচি-কান্নায় নরক হয়ে উঠল জায়গাটা। বুহের দেখল একটা ঘোড়া তার আরোহীকে পিঠ ঝাঁকিয়ে দড়াম করে ফেলে দিল। কাঁধে কার যেন হাতের কঠিন চাপ অনুভব করে ঘুরল সে। ছেলেটা। তার কাঁধে হাত রেখে নারকীয় দৃশ্যটা দেখছে। জ্বলজ্বল করছে চোখ, জিভ বোলাচ্ছে ঠোঁটে।

ক্যামেরা আগের মতই কাজ করে চলেছে। বিশাল পর্দায় রাস্তার নারকীয় দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এক মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, দেখল বুহের। বাচ্চাটাকে দু’হাতে শূন্যে তুলে ধরল সে। ঠিক তখন একটা ঘোড়া ছুটে এসে বাচ্চা এবং তার মাকে শক্ত খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে গেল। বুহের শুনল ছেলেটা চাপা উল্লাসে বিড়বিড় করছে, বিশুদ্ধ নৈরাজ্য নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে।

শিউরে উঠল বুহের, পাথরের সিংহের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

লোকজনের চিৎকার আর আর্তনাদ ক্রমে চড়া হয়ে উঠল, তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল। যেন কেউ পর্দায় ফ্রিজ করে দিয়েছে দৃশ্যটা, নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে। স্কোয়ারের দক্ষিণ-পুব কোণে, হোয়াইট হলের সেফটি ব্যারিয়ার ভেঙে সবাই ওদিকে সরে গেছে, পেছনে ফেলে রেখে গেছে আহতদের। স্কোয়ার প্রায় ফাঁকা। শুধু নিহতদের লাশ আর আহতরা পড়ে আছে রাস্তায়। তারা যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে, কাঁদছে।

কলাম বা খিলানের নিচ থেকে বেরিয়ে এল পল বুহের। তার সামনে, কয়েক গজ দূরে একটা ঘোড়া মরে পড়ে আছে, নিচে তার আরোহীর বিধ্বস্ত লাশ।

পাথরের সিংহগুলোর একটার বেদির নিচে স্তূপ হয়ে আছে আরও কতগুলো লাশ। ছুটন্ত মানুষের পায়ের নিচে পড়ে ভর্তা হয়ে গেছে তারা। ইতিমধ্যে এসে . পড়েছে অ্যাম্বুলেন্স। তারা লাশ সরাচ্ছে, গাড়িতে তুলছে আহতদের। সাংবাদিকরা ছবি তুলছেন।

কঙ্কালের জামা পরা এক তরুণকে দেখা গেল নিশ্চল পড়ে আছে। বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে গেছে তার। আরেকটা ঘোড়া একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছিল লাশের দঙ্গলের মাঝে। আহতরা ঘোড়াটাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ভয়ের চোটে কান্না থেমে গেল অনেকের।

ছেলেটা খিলান থেকে লাফিয়ে নামল। বুহেরের হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের গাড়ি কোথায় থাকবে?’

মাথা নাড়ল বুহের। মনে করতে পারছে না।

ছেলেটা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল একগাদা লাশের পাশে, কুকুরটা তার সাথেই আছে, নাক উঁচু করে বাতাস টানল, তারপর ঘুরে দেখল বুহেরকে।

‘বেচারা শান্তি রক্ষাকারীদের আত্মা শান্তি পাক,’ মুচকি হাসল ছেলেটা। তারপর বুহেরের হাত ধরে ভিড়ের মাঝ থেকে পথ করে হাঁটা শুরু করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *