আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৯

উনিশ

পল বুহের গ্লাসটা শেষ করে আকাশের দিকে তাকাল। কল্পনায় দেখল পুবাকাশে লাল একটা আলো ফুটে উঠেছে। অবশ্য ওকে আর কল্পনা করতে হবে না। দৃশ্যপট লেখা হয়ে রয়েছে অনেক আগে। এখন শুধু প্রয়োজন সঠিক দৃশ্যে সঠিক অভিনেতার অভিনয়। মানব সভ্যতা বেছে নিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ।

ড্রইংরুমে ঢুকল বুহের। আগুন নিভে গেছে। রেডিওর সুইচ অন করে আরেকটা ড্রিঙ্ক ঢালল সে।

…সমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে যে, জেরুজালেম, তেল আবিব এবং বৈরুতে পারমাণবিক হামলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আকাশ পথে শহর ত্যাগ করেছেন এ খবর ওয়াশিংটন থেকে হোয়াইট হাউজ এবং পেন্টাগন অস্বীকার করেছে। আমাদের মস্কো প্রতিনিধি কোন রিপোর্ট পাঠাতে পারছেন না, কার্যত ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রি একটি বিবৃতি দেবেন। জানা গেছে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ন্যাটোভুক্ত সমস্ত দেশের রাষ্ট্রদূতগণ দশ নম্বর ডাইনিং স্ট্রীটে উপস্থিত হতে চলেছেন…

থাবড়া মেরে রেডিওর সুইচ অফ করে দিল বুহের, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ নিজের বয়সের কথা মনে পড়ল। সত্তর চলছে। এবার মরার সময় হয়েছে।

‘তিন কুড়ি দশ’ বিড়বিড় করল বুহের, তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। হলঘরে দাঁড়ানো বাটলারের সাথে চোখাচোখি হলো তার। শ্রাগের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল দু’জনেই, যেন আর কারও কিছু বলার নেই। সিঁড়ির হাতল ধরে ওপরে উঠতে শুরু করল বুহের। চলে এল করিডরে, পা বাড়াল চ্যাপেলে। শীলার কথা ভাবছে। গেল কোথায় মহিলা?

দরজার কাছে পৌঁছার আগেই কুকুরটার গোঙানি শুনতে পেল বুহের। দরজা খোলা। তবে আলোটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে বলে ঘরের ভেতরটা ঠাহর করে নিতে সময় লাগল। দীর্ঘক্ষণ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকল বুহের, অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর যা দেখল, বিশ্বাস হতে চাইল না। চ্যাপেলের মেঝে মাখামাখি হয়ে গেছে ফ্রেডরিক আর্থারের রক্তে। ছেলেটা আর মহিলা থর্নের লাশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসা, বিড়বিড় করে কি সব বলছে, বোঝা যাচ্ছে না।

ধীর ভঙ্গিতে আগ বাড়ল বুহের, বিস্ফারিত দৃষ্টি আর্থারের দিকে, অবিশ্বাস ফুটে আছে চোখে। ড্যাগারের বাঁট স্পর্শ করল সে, রক্ত লেগে গেল হাতে। হাতটা প্যান্টে মুছে আবার বাঁটটা ধরল। ড্যাগারটাকে টেনে বের করতে চাইছে বুহের, কিন্তু শক্তিতে কুলোচ্ছে না। শেষে আর্থারের বুকে পা রেখে হ্যাঁচকা টানে ছোরাটা বের করতে হলো।

এরপর অন্য ড্যাগারগুলো একত্র করে ছেলেটার দিকে তাকাল বুহের।

‘ও আমাকে হত্যা করতে এসেছিল, পল। কিন্তু নিজেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’

মাথা ঝাঁকাল বুহের, ড্যাগার বোঝাই হ্যাভারস্যাকটা কাঁধে ফেলল। ‘চিরদিনের জন্যে এগুলোর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি আমি।’

কিন্তু ছেলেটা বুহেরের কথা শুনেছে বলে মনে হলো না।

আর্থারের দিকে তাকাল বুহের। কি নিষ্পাপ একটা মুখ, তবে সাহসী। ওরা ওকে পাগল বানানোর অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তারপর ফাঁদ পেতেছে।

ড্যাগারগুলোয় একবার হাত বোলাল বুহের তারপর শীলার দিকে ফিরল। ওর কাঁধে টোকা দিল। ঘুরল শীলা। ওর ঠোঁট ভেজা ভেজা, ছায়াময় চোখ। বুহেরের মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলোর কথা যখন টাকা দিয়ে বেশ্যা কিনতে হত তাকে। এভাবে মেয়েরা তাকাত তার দিকে। শীলার সারা শরীরে রক্ত। হাত বাড়িয়ে পোশাকটা তুলে নিল বুহের, শীলার বুক ঢাকল। শীলা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, ফেলে দিল আচ্ছাদন। অভিমানে ঠোঁট ফোলানোর ভঙ্গি করল, তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল, চোখ টিপল। শীলার নগ্ন শরীর বুহেরকে মনে করিয়ে দিল সেই রাতের কথা যে রাতে মেয়েটা তার হাত চেপে ধরেছিল, পশুর চিহ্নের ছাপ পড়েছিল তার আঙুলে।

মনে পড়ে গেল দু’বছর আগের কথা। দু’বছর আগে শীলাকে দলে টানা হয়, অন্য অনেক মেয়ের মত, সেক্সের মাধ্যমে। আর্থার সেবার কি কাজে দেশের বাইরে, শীলাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল পেরিফোর্ডে। প্রথমে শীলা অনেক ওজর আপত্তি তুলেছে, প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু শেষতক প্রলোভনের কাছে হার মেনে যায় সে। বুহেরের শিষ্যরা তাকে বলেছে, গোপন কথাটা জানার পর শীলা সাংঘাতিক উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং পৈশাচিক ধর্মান্তকরণের সময়, রিপোর্ট এসেছিল, শীলার সর্বাত্মক সহযোগিতার কারণে ওটা হয়ে ওঠে সবচে’ সফল একটা কাজ। শীলার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল বুহের। মানুষ আসলে খুব প্রেডিক্টা, সহজে যে কোন অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।

বুহেরকে আলিঙ্গনের চেষ্টা করল শীলা, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল ওকে। অশ্লীল কথা বলছে শীলা, কানে তুলল না বুহের।

শীলাকে অগ্রাহ্য করে কুকুরটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। শুয়ে আছে জানোয়ারটা, হাঁপাচ্ছে, বুজে আসছে চোখ। মৃত্যুর ছায়া চোখে।

মমি করা লাশটার পেছনে চলে এল বুহের। ইস্পাতের একটা ফ্রেমের গায়ে ঠেস দেয়া ওটা। ফ্রেমটার নাট-বল্টু খুলতে শুরু করল বুহের। ফ্রেমটা লাশটাকে নিতম্বের কাছে সাঁড়াশির মত ধরে আছে, ফলে সিধে হয়ে থাকতে পারছে ওটা।

‘পল?’ তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটা।

‘তার শেষ অনুরোধ,’ বলল বুহের। ‘আরমাগেড্ডনের সময়। শেষ উপহাস।’

কপালে ভাঁজ পড়ল ছেলেটার। ‘আমি জানতাম না তো…’

চূড়ান্ত মুহূর্তে সে তার শত্রুর জমিনে দাঁড়াতে চেয়েছিল তাকে (যীশু) বর্জন করতে।

ছেলেটা এখনও সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে বুহেরের দিকে।

ক্রুশটা নিয়ে আমার পিছু পিছু এসো।’ আদেশ করল বুহের। জবাবে সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল ছেলেটা।

শেষ বল্টুটা খুলে ফেলল বুহের, লাশটা পড়ে গেল। দ্রুত ওটাকে ধরে ফেলল বুহের। খুব ভারী নয় শরীর, কিন্তু বুহের তেমন শক্তি পাচ্ছে না ওটাকে টেনে নিয়ে যাবার জন্যে। দেয়ালে হোঁচট খেল। দৌড়ে এল শীলা, দু’জনে মিলে লাশটাকে টেনে নিয়ে চলল।

দোরগোড়ায় থেমে দাঁড়াল ওরা, বুহের পেছন ফিরে চাইল। ছেলেটা ক্রুশটাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে, ওজনের চাপে বাঁকা হয়ে গেছে। কুকুরটা বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল, অনুসরণ করল ওদের। খোঁড়াচ্ছে ওটা, ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে।

ধীর গতিতে করিডর ধরে এগোল দলটা, নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে, লাশের পা বাড়ি খেল সিঁড়িতে, ঝরে পড়ল পাউডারের মত মিহি চামড়া। বুহেরদের পেছনে, ক্রুশ কাঁধে সিঁড়ির হাতল ধরে নামছিল ছেলেটা, হঠাৎ পিছলে গেল ওটা। গুঙিয়ে উঠল সে যীশুর মুকুটের কাঁটা তার ঘাড় আর কাঁধে বিধে যেতে। গালি দিল সে যীশুকে, ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রুশটাকে দেখল, তারপর আবার নামতে লাগল। কাঁটার আঘাতে রক্ত বেরুচ্ছে তার ঘাড় আর কাঁধ থেকে, ক্ষীণ একটা ধারা ঢুকে গেল পিঠে, ভিজিয়ে দিল আলখেল্লা।

 আকাশে প্রচুর মেঘ জমেছে, ড্রাইভওয়েতে মাত্র এসেছে ওরা, বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়ল গায়ে। পশ্চিম উইং থেকে দুশো গজ দূরে, ঝোপের আড়ালে, একটা টিলার ওপর ছোট, ধ্বংসপ্রাপ্ত চার্চটা। এটা তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির সাথে। বুহের শুনেছে, ছেলেবেলায় ডেমিয়েন চার্চটাকে ভেঙে ফেলতে বলেছিল। তবে তাকে বোঝানো হয়, খ্রীষ্ট ধর্মের উজ্জ্বলতা যে ক্রমে কমে আসছে, ধ্বংসের পথে যাচ্ছে যীশু,তার চিহ্ন হিসেবে চার্চটা থাকুক। পরে, বড় হয়ে জোর করে চার্চে একবার ঢুকেছিল ডেমিয়েন নিজের ভয় দূর করার জন্যে।

কিন্তু ছেলেটা কোন দিন চার্চে ঢোকেনি। বাবার মত সাহসই তার নেই। চার্চের পঞ্চাশ হাতের মধ্যে যেতেও সে ভয় পায়।

টিলায় উঠে এল ওরা। চারদিক আশ্চর্য নিস্তব্ধ। কোন কিছু নড়ছে না, পাখির ডাক বা পোকার আওয়াজ কিছু শোনা যাচ্ছে না। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝোপ ঝাড়, যেন দেখছে ওদের, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার অপেক্ষা করছে।

চার্চের কাছে চলে এসেছে ওরা, চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা। থামতে বলছে। কিন্তু থামল না বুহের। এগিয়েই চলল। হাঁপাচ্ছে শীলা, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গা বেয়ে, মিশে যাচ্ছে রক্তের সাথে। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে ও, উল্টোপাল্টা বকছে আপন মনে আর কামুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বুহেরের দিকে। বুহের পাত্তা দিচ্ছে না ওকে, টিলার ওপর টেনে নিয়ে চলল লাশটাকে। পাঁজরের গায়ে দমাদম বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, গলায় আটকে আসতে চাইছে দম।

‘পল!’ গর্জে উঠল ছেলেটা। চার্চের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল বুহের, লাশটাকে হেলান দিয়ে রাখল গেটপোস্টে।

ক্রুশটাকে টেনে আনতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। ‘ওখানে রাখো,’ দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করল বুহের। ‘তাহলে একত্র হতে পারবে ওরা, বিজয়ী এবং বিজিত।’

বুহেরের নির্দেশ পালন করল ছেলেটা, তারপর পিছিয়ে গেল, পেরেকের আঘাতে ছড়ে যাওয়া ক্ষতে আঙুল বোলাল, চার্চের দিকে তাকাতে ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ।

‘এটাই তোমার বাবার ইচ্ছে ছিল,’ আবার কথাটা বলল বুহের। পুব দিকে তাকাল সে। পাহাড়ের ঢেউ খেলানো চুড়ো, সোডিয়াম বাতিতে ভিজতে থাকা মেইন রোড আর গ্রামটাকে চোখে পড়ল তার।

‘সময় হয়েছে,’ বলল বুহের, দেখল চার্চের কাছ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।

‘ওর কাছে যাও,’ শীলাকে ফিসফিস করে বলল বুহের। ‘তোমার শক্তি ওকে দাও। ওর জন্যে প্রার্থনা করো।’

চার্চ থেকে বিশ গজ দূরে দু’জনে বসল হাঁটু গেড়ে, দৃষ্টি মাটির দিকে। কুকুরটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে গেল ওদের পাশে, শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। বুহের এক পলক দেখল তিনজনকে, তারপর গভীর দম নিয়ে আঁকড়ে ধরল লাশটাকে, টানতে টানতে নিয়ে চলল গেটের ভেতরে। লাশের পা বাড়ি খাচ্ছে নুড়িতে। কাঠের পুরানো একটা সাইনবোর্ড পাশ কাটাল বুহের। ওতে লেখা :

দ্য প্যারিশ চার্চ অভ সেন্ট জন

হঠাৎ হোঁচট খেল বুহের, লাশটা ছুটে গেল হাত থেকে। ওটাকে আবার তুলছে, পেছন থেকে ভেসে এল ছেলেটার চিৎকার। বুহেরের নাম ধরে ডাকছে, দৌড়ে আসছে গেটের দিকে।

বেদম হাঁপাতে হাঁপাতে বুহের চার্চের দরজার সামনে চলে এল ভারী বোঝাটা নিয়ে, প্রার্থনা করল যেন ওটা খোলা থাকে। দেয়ালের গায়ে লাশটাকে দাঁড় করিয়ে দরজায় ঠেলা দিল বুহের। ক্যাচম্যাচ করে উঠল কবজা। পেছন ফিরল সে, ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে গেটে, স্থির, আবার ভয় গ্রাস করেছে ওকে।

টানতে টানতে লাশটাকে ভেতরে নিয়ে গেল বুহের, দরজার কবাট বন্ধ করল। অন্ধকারে ছিটকিনি খুঁজল মরিয়া হয়ে। পেয়েও গেল। কিন্তু জং ধরে গেছে বোল্ট, নড়াতে পারছে না।

‘প্লীজ, গড,’ মিনতি করল বুহের, বোল্ট ধরে টানাটানি করছে। হাতের চামড়া ছড়ে গেল। অবশেষে বোল্টটা লেগে গেল জায়গা মত। বুহের ছেলেটার পায়ের শব্দ শুনতে পেল, দৌড়ে আসছে। হিংস্র পশুর মত গর্জন করছে। গায়ের শক্তি দিয়ে দরজার ওপর আছড়ে পড়ল ছেলেটা, ধাক্কার চোটে লাশটা পড়ে গেল মাটিতে।

বুহের ওটার পা ধরে টানতে টানতে গির্জার মূল অংশ বা বেদির কাছে নিয়ে এল। গির্জার একটা বেঞ্চিও আস্ত নেই, শুধু পাথরের বেদি আর পাথরের মঞ্চটা অক্ষত আছে।

‘বুহের!’ ছেলেটার চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল দালানে। পায়ের শব্দ শুনে বুহের বুঝতে পারল পাগলের মত দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে সে। দেয়াল খামচাচ্ছে ইঁদুরের মত। বেদির কাছে এসে লাশটাকে বুকের কাছে ধরে খাড়া করল বুহের, তারপর ছেড়ে দিল। পাথরের ওপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল খুলি।

লাশটাকে চিৎ করে শোয়াল বুহের। মুখটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে, চেনা যাচ্ছে না। বেদির ওপর টেনে আনল সে ওটাকে, কাঁধ থেকে নামাল হ্যাভারস্যাক ড্যাগারগুলো বের করে মাটিতে রাখল।

‘বুহের,’ ছেলেটার কণ্ঠে এবার অনুনয়। বুহের মুখ তুলে চাইল। দেয়ালের ওপর ছেলেটার নখের ডগা দেখা যাচ্ছে। দেয়াল বেয়ে উঠতে চাইছে সে। হাত বাড়িয়ে একটা ড্যাগার তুলে নিল বুহের, তাকাল বেদিতে শোয়ানো লাশের দিকে।

‘তুমি নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, ডেমিয়েন। কিন্তু ছড়িয়ে দিয়েছ ধ্বংস। তুমি একটা ভুয়া প্রফেট।’

দু’হাতে ড্যাগার ধরে মাথার ওপর তুলল বুহের, তারপর চোখ বুজে সজোরে নামিয়ে আনল। পিস্তলের গুলির মত শব্দ করে ফেটে গেল চামড়া, দেয়ালের ওপাশ থেকে চিৎকার দিল ছেলেটা। পিছিয়ে গেল বুহের, বিশ্রী গ্যাস বেরুচ্ছে লাশের শরীর থেকে। দ্বিতীয় ড্যাগারটা মুঠো করে ধরল বুহের, জোর করে চোখ ফেরাল লাশটার দিকে। ক্ষত দিয়ে হিসহিস শব্দে বিকট গন্ধ নিয়ে গ্যাস বেরুচ্ছে। ড্যাগারের বাঁটে আটকানো লেবেলটা নড়ছে বাতাসে।

এবার জোর করে চোখ খুলে রাখল বুহের, দ্বিতীয় ড্যাগারটা ঢুকিয়ে দিল লাশের গায়ে। তারপর তৃতীয়টা, এবং চার নম্বরটা…প্রতিটি ফলা ঢুকে যাচ্ছে ডেমিয়েনের শরীরে আর আর্তনাদ করে উঠছে ছেলেটা। এখন আর মানুষের মত শোনাচ্ছে না তার গলা, যেন একটা শেয়াল মরণ আর্তনাদ করে চলেছে।

শেষে একটা ড্যাগার রয়ে গেল। বুহের বাঁটে, যীশুর প্রতিমূর্তির দিকে তাকিয়ে বুকে ক্রুশ আঁকল। মনে পড়ে গেল ওর ধর্মান্তকরণের কথা, এক তরুণ, নামটা মনে নেই, বলেছিল তিন কুড়ি দশের কথা, বুড়ি নার্সের জন্যে হঠাৎ মায়া লাগল তার, আতঙ্ক জাগল মরা মেয়েটার সেই ছবিটার কথা মনে করে, উপলব্ধি করল আসলে সারাটা জীবন সে কাটিয়েছে প্রতারণার শিকার হয়ে।

ড্যাগারটা সর্বশক্তি দিয়ে লাশের পেটে ঢুকিয়ে দিল বুহের। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডেমিয়েন থর্ন, খোলা মুখ দিয়ে শেষবারের মত হিস্ করে বেরিয়ে এল গ্যাস। বুহের স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লাশের দিকে। দুই সারিতে বেঁধা ড্যাগারগুলো ক্রুশের আকার পেয়েছে। চোখ বুজল সে, হতাশার দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ শুনল, চোখ মেলে দেখল লাশটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, হাড়গোড়ের মধ্যে পড়ে আছে ড্যাগারগুলো। সিধে হলো বুহের, শেয়ালের খুলি আর চোয়ালের দিকে তাকিয়ে আবার ক্রুশ আঁকল।

ঘুরল বুহের, ধীর পায়ে এগোল দরজার দিকে, বোল্ট খুলল, বেরিয়ে এল। ছেলেটা হাঁটু মুড়ে বসে আছে। জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকাল বুহের। ছেলেটাকে দেখলে মায়া লাগে। তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। মরা মানুষের দৃষ্টিতে বুহেরের দিকে তাকাল সে, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল। ছেলেটার পাশে পড়ে আছে কুকুরটা। মৃত।

শীলা গেটের সামনে দাঁড়ানো, রক্তাক্ত হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে আতঙ্ক নিয়ে, বারবার রক্ত মোছার চেষ্টা করছে, যেন এইমাত্র দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে।

রুহের শীলার কাছে গেল। নরম গলায় বলল, ‘কাপড় পরো।’

শীলা বুহেরের দিকে তাকাল, যেন চিনতে পারছে না। তারপর জামা দিয়ে বুক ঢাকল।

‘কাজ শেষ,’ বলল বুহের।

এক সাথে দু’জনে পা বাড়াল বাড়ির উদ্দেশে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, ঝিলমিল করছে তারার আলোয়। কেয়ামতের দিন শেষ, রক্ষা পেয়েছে পৃথিবী।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *