আবার অশুভ সঙ্কেত – ৫

পাঁচ

ফ্রেডরিক আর্থারের সাথে ডিনার করার দিন তিনেক পর, এক অলস সন্ধ্যায় অফিসের এক এক্সিকিউটিভের সাথে বারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন জামশেদুর রহমান, কথায় কথায় রাষ্ট্রদূতের প্রসঙ্গ চলে এল। তিনি সন্ন্যাসীর গল্পটা বললেন এক্সিকিউটিভকে, ড্যাগার প্রসঙ্গে হা হা করে হাসলেন, মন্তব্য করলেন ব্যাপারটা নির্ঘাত কারও উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।

পরদিন অফিসে ঢুকেই এক্সিকিউটিভ এক তরুণী রিপোর্টারকে ইঙ্গিত করলেন তাঁর ঘরে আসতে। তরুণীর নাম শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড। বয়স তেইশ। মাস দুই হলো ফ্লিট স্ট্রীটে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে সংবাদিক হিসেবে বেশ নাম করে ফেলেছে। তেমন লম্বা নয় সে, তবে শরীরটা সুগঠিত, মুখখানা লাবণ্যে ঢলঢল। দু’মাসের মধ্যেই প্ৰমাণ করে দিয়েছে সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং ধারাল মস্তিষ্কের অধিকারিণী। কর্তৃপক্ষ তার ব্যাপারে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।

‘বলুন, স্যার,’ দরজা বন্ধ করে হাসি মুখে জানতে চাইল শ্যারন।

‘এখন তো সামার চলছে,’ বললেন এক্সিকিউটিভ।

‘জী।’

‘সামনের ঢিলে দিনগুলোর জন্যে কিছু গরমাগরম খবর মজুত রাখা দরকার।’

হাসিটা ধরে রেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল শ্যারন।

‘কাল জামশেদুর রহমানের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম,’ বললেন এক্সিকিউটিভ। ‘উনি একটা গল্প বলেছেন। গল্পটার সাথে লাশ, ছোরা ইত্যাদি ব্যাপার জড়িত। তুমি পুরানো খবরের কাগজ ঘাঁটলে হয়তো এ বিষয়ে তথ্য পাবে। সম্ভবত হত্যাকাণ্ডগুলোকে ‘ক্রুশিফিক্সন কিলিং’ বা এ ধরনের কিছু একটা নাম দেয়া হয়েছে। তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হলে গল্পটা আমাদের ‘আনসলভড্ ক্রাইম স্পট’ বিভাগে ছাপতে পারব। করবে কাজটা?’

মাথা দোলাল শ্যারন। করবে।

খুশি হলেন এক্সিকিউটিভ। বললেন, ‘তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই।’

তাড়াহুড়োর কিছু না থাকলেও শ্যারনের মাথায় কোন আইডিয়া একবার ঢুকলে ওটার শেষ না দেখা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। সে কাজে লেগে গেল।

কিছু ক্লিপিং জোগাড় করে ফেলল শ্যারন। কয়েকটা ক্লিপিং খুবই পুরানো, চাপ দিলে মুঠোর ভেতর গুঁড়ো হয়ে যেতে চায় কাগজ। কাগজপত্র নিয়ে নিজের ডেস্কে বসল সে। একটা সুবিধে হয়েছে শ্যারনের। লাইব্রেরীতে ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় দুই পৃষ্ঠার একটা রেডিমেড গল্প পেয়ে গেছে। ওটাতেই প্রথম চোখ বোলাল সে:

এক করুণ বংশের কাহিনী:
অভিশপ্ত থর্ন পরিবার

হেডিং-এর নিচে একটা ড্যাগারের ছবি। ড্যাগারের হাতলে যীশুর প্রতিমূর্তি। ছবিটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল শ্যারন। তারপর কলমটা টেনে নিল।

লেখাটার বেশির ভাগ জিনিস কাজে আসবে না শ্যারনের, লেখক থর্ন পরিবারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তবে কৌতূহল নিয়ে রচনাটি পড়ল শ্যারন।

গতকাল মৃত্যুবরণ করেছেন বৃটেনে নিযুক্ত তরুণ রাষ্ট্রদূত ডেমিয়েন থর্ন। বত্রিশ বছর বয়স্ক এই যুবকের মৃত্যুর মাধ্যমে যেন থর্ন পরিবারের শেষ অধ্যায় রচিত হলো। এই বিখ্যাত পরিবারটির সবই ছিল, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের সকলেই বরণ করেছেন অকাল এবং অদ্ভুত মৃত্যু।

ডেমিয়েন থর্ন মারা গেছেন নিজের বিছানায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। ব্যাপারটা এক অর্থে অস্বাভাবিক।

শ্যারন ডেমিয়েন থর্নের ছবি দেখল। পাশে ছোট ছোট আরও কয়েকটি ছবি। সবগুলোর নিচেই ক্যাপশন আছে: রবার্ট থর্ন, ডেমিয়েনের বাবা, লন্ডন চার্চের সিঁড়িতে গুলি খেয়ে মারা গেছেন, রহস্যময় খুনেকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ক্যাথরিন, ডেমিয়েনের মা, হাসপাতালের জানালা দিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর আগে, পেরিফোর্ডে, তাদের পারিবারিক নিবাসে মিসক্যারেজের শিকার হন ক্যাথরিন। ডেমিয়েনের চাচা-চাচী, রিচার্ড এবং অ্যান থর্ন, থর্ন মিউজিয়ামে আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যান। ডেমিয়েনের সৎ ভাই, মার্ক, তেরো বছর বয়সে ব্রেন হেমারেজে মারা যায়।

আর্টিকেলটাকে সাব-হেড দিয়ে আবার ভাগ করা হয়েছে। একটা হেডিং এরকম:

পেরিফোর্ড, অভিজাত ভৌতিক বাড়ি

হেডিং-এর নিচে একটা জমিদার বাড়ির ছবি। তারপর ডেমিয়েনের তরুণী ন্যানির গল্প, সে জানালায় দড়ি বেঁধে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। ন্যানির পরে যে ডেমিয়েনের দেখাশোনা করত তার কথাও আছে। সে নির্মমভাবে খুন হয়েছে রবার্ট থর্ন যে রাতে মারা গেলেন সেই সময়। আর এই সেই পেরিফোর্ড, লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের, যা ক্যাথেরিন থর্নের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যেও দায়ী

গল্পের আরেক অংশে পরিবারের বাইরের লোকজনের মৃত্যুর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আথারটন নামে এক লোক, থর্ন ইন্ডাস্ট্রির চীফ এক্সিকিউটিভ, শিকাগোতে, থর্ন ম্যানসনে আইস হকি ম্যাচে অংশ নেয়ার সময় পানিতে ডুবে মরেছে। ডেমিয়েনের তেরোতম জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি দেয়া হয়েছিল। আথারটন বরফের মধ্যে পড়ে সলিল সমাধি লাভ করে।

আরেক থর্ন এক্সিকিউটিভ, পাসারিয়ান, ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় মারা যায়। তখন ডেমিয়েন আর তার বন্ধুরা গাইড নিয়ে প্ল্যান্ট দেখতে বেরিয়েছিল। রিচার্ড থর্নের সাক্ষাৎকার নেয়ার পরপরই অদ্ভুত এক ঘটনায় মারা যায় এক মহিলা সাংবাদিক। এ জায়গাটা পড়ার সময় কেন যেন শিউরে উঠল শ্যারন, দ্রুত ক্রুশ আঁকল বুকে। তারপর আবার মনোযোগ দিল পড়ায়।

থর্ন মিউজিয়ামের কিউরেটর দুর্ঘটনায় রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে মারা গেছে। ওই একই সন্ধ্যায় শিকাগোর থর্ন মিউজিয়াম আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ মৃত্যু তালিকার যেন শেষ নেই। চোখ ঘষল শ্যারন, আবার পড়া শুরু করল…

অ্যান্ড্রু ডয়েল, লন্ডনের ইউএস এমব্যাসির রাষ্ট্রদূত, নিজের অফিসে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি…

একটি টেলিভিশন স্টুডিওতে ডেমিয়েনের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় অজ্ঞাত পরিচয় এক লোক আগুনে পুড়ে মারা যায়…

দুই লোক, এদেরও পরিচয় অজানা, কর্নওয়ালের মৃগয়াভূমিতে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় শিকারে বেরিয়েছিল ডেমিয়েন। একজনের হাতে ছিল একটা ড্যাগার, আরেকটা ড্যাগার ছিল অপর লাশটির পাশে…

নোট নিল শ্যারন। মৃত্যুর ঘটনাগুলোই শুধু তার গল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত। লেখক কোন দুর্ঘটনা সম্পর্কেই উপসংহার টানেননি, শুধু দেখাতে চেয়েছেন করুণ মৃত্যু ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়েছিল থর্ন পরিবারে। ক্লিপিংগুলোর ফটোকপি করল শ্যারন, তারপর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রেস অফিসে ফোন করল। গলা শুকিয়ে গেছে ওর। ফেদারসে ঢুকে ঠাণ্ডা কোকে গলা ভেজাল। তারপর গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।

প্রেস অফিসারের বয়স কম। সুন্দরী শ্যারনকে সাহায্য করার জন্যে সাগ্রহে এগিয়ে এল। শ্যারনের মত মেয়েদের সাথে বিয়ার পান করার সুযোগ তার কদাচিৎ ঘটে বলেই হয়তো।

শ্যারনের দেয়া ড্যাগারের ছবিগুলোয় চোখ বোলাল অফিসার, কুঁচকে উঠল ভুরু, ‘আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি অস্ত্র মনে হচ্ছে।’

‘এগুলো আপনাদের মিউজিয়ামে আছে?’

‘হ্যাঁ। পাঁচটা আছে। আচ্ছা, আমি ফাইল দেখছি।’

কয়েক মিনিট পর কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা ঘরে শ্যারনকে নিয়ে এল প্রেস অফিসার। এটার নাম ব্ল্যাক মিউজিয়াম। ড্যাগারগুলোকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। পাঁচটাই। প্রতিটি ড্যাগারের বাঁটে খোদাই করা যীশুর মূর্তি। কাঁচের ভেতর থেকে যেন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

‘তিনটে ড্যাগারের খোঁজ পাওয়া গেছে,’ তরুণ অফিসার ফাইলে চোখ বোলাল। ‘কর্নওয়ালের এক চ্যাপেলে। ওই পাঁচটা আমাদের হাতে এসেছে তদন্ত করতে গিয়ে একটা ড্যাগার ছিল লোকটার পকেটে, আর দুটো ছিল পিঠে বেঁধা।’

‘ফাইলটা একবার দেখতে পারি?’

অফিসার শ্যারনকে ফাইল দিল। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘লাঞ্চ করেছেন? চলুন, একসাথে লাঞ্চ করি?’

‘নো, থ্যাঙ্কস, মিষ্টি করে হাসল শ্যারন। ‘আমাকে এখুনি অফিসে ফিরতে হবে।’ জামশেদুর রহমানকে অফিসে নয়, এল ভিনো রেস্টুরেন্টে পাওয়া গেল। লাঞ্চ করছেন। নিজের পরিচয় দিল শ্যারন, বলল, ‘আপনার বন্ধু, আমার বস্, মি. স্টিফেন গনজালেস বলেছেন প্রয়োজনে আপনার সাথে দেখা করতে। আমি একটা ফিচার করছি। মি. স্টিফেন বললেন রোমে ফ্রেডরিক আর্থারের সাথে আপনি ডিনার করেছেন-’

‘ওটা আমাদের ব্যক্তিগত আড্ডা ছিল,’ বললেন জামশেদ।

লেখাটার একটা কপি তাঁকে দিল শ্যারন। ‘এই ড্যাগারের কথাই কি তিনি বলছিলেন?’

কাগজে চোখ বোলালেন জামশেদুর রহমান। হতে পারে। এরকম হাতলঅলা ড্যাগারের কথাই বোধহয় শুনেছিলাম। কিন্তু রাষ্ট্রদূতকে এ ব্যাপারটা নিয়ে যেন বিরক্ত করতে যেয়ো না। আমি চাই না-’

শ্যারন ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ঘাড় ফিরিয়ে ‘থ্যাঙ্কস’ বলল, তারপর পা বাড়াল দরজার দিকে।

.

পাঁচ ড্যাগারের ওপর দ্রুত ফিচার লিখে ফেলল শ্যারন। তারপর ফোন করল আমেরিকান এমব্যাসিতে। প্রেস অ্যাটাশে জানাল অ্যামব্যাসাডরের সাথে দেখা করতে চাইলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসতে হবে শ্যারনকে। লিখিত অনুরোধ সহ প্রশ্ন পাঠাতে হবে।

‘পাঠাব,’ খুশি খুশি গলায় বলল শ্যারন। কোম্পানি নোট পেপারে প্রশ্ন লিখেও ফেলল ঝটপট। এক লোককে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিল গ্রসভেনর স্কোয়ারে, আমেরিকান দূতাবাসে। তারপর হেসে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল শ্যারন। প্রটোকল ভাঙছে সে, তো কি হয়েছে? বস্ যদি অনুযোগ করেন তাঁকে না জানিয়ে কেন কাজটা করতে গেল শ্যারন কিংবা জামশেদুর রহমান রেগে যান, জবাবে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসবে শ্যারন। বলবে অনভিজ্ঞতা এবং যৌবনের উচ্ছ্বাস থেকে কাজটা করে ফেলেছে সে। তাঁরা যেন ব্যাপারটাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। আর যদি রোমের ড্যাগারের সাথে অমীমাংসিত মৃত্যুগুলোর মাঝে কোন সূত্র যোগ করতে পারে শ্যারন, তাহলে কেল্লা ফতে। দারুণ একটা গল্প হবে ওটা। ঝুঁকি নেয়াটা সার্থক হয়ে উঠবে।

.

পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ল শ্যারন। আজ ওর অফ ডে। আজ পেরিফোর্ডে যাবে ঠিক করেছে। থর্ন পরিবারের প্রাসাদ-বাড়ির ছবিতে আবার চোখ বোলাল শ্যারন। লেখক বলছেন চারশো একর জমি নিয়ে এ বাড়ি, তেষট্টিটা ঘর, দুটো উইং। ১৯৩০ সালে বাড়ির একাংশে আরেকটা বিল্ডিং তৈরি করা হয়। ওখানে মাছ ধরার পুকুর আছে, আছে টেনিস কোর্ট, সব্জি বাগান…’

ঘণ্টাখানেক লাগল জায়গাটা খুঁজে বের করতে। দূর থেকে বাড়িটাকে দেখে ড্রাকুলা আর তার ট্রানসিলভেনিয়ার ভৌতিক দুর্গের কথা মনে পড়ে গেল শ্যারনের। ঝলমলে সূর্যালোকিত দিন। ভরত পাখিরা মনের আনন্দে গাইছে। গাড়ি চালাতে চালাতে মুচকি হাসল শ্যারন ড্রাকুলার কথা ভেবে। এমন নির্জন জায়গায়, বিরাট প্রাসাদে, সত্যি ড্রাকুলা নেই তো?

রাস্তার ধারে গাড়ি থামাল শ্যারন। নেমে পড়ল। একটা মাঠ পেরোল। মাঠের পর প্রকাণ্ড বাড়িটা। চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কমপক্ষে দশ ফুট উঁচু। কয়েক জায়গায় ইট খসে পড়ে মুখ হাঁ করে আছে গর্ত। শ্যারন ভাবল, বাইরে একটা চক্কর দিয়ে ফিরে যাবে কিনা। তারপর রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করবে। কিন্তু দেয়ালের ওপাশে কি আছে দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। দেখলে ক্ষতি কি? ধরা পড়লে মিষ্টি হেসে বলবে সে ভেবেছিল এটা একটা পার্ক।

দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে এক ফুট একটা ফাটলের মধ্যে শরীর গলিয়ে দিল শ্যারন।

.

অ্যালার্ম সিস্টেম বেজে উঠতে অবাক হলো ছেলেটা। ক্লোজ-সার্কিট টিভির বোতামে চাপ দিল। পর্দায় ফুটে উঠল শ্যারনের ছবি। দুই পা ছড়িয়ে বসে আছে দেয়ালের ফাঁকে, কি যেন ভাবছে। তারপর পিছলে নেমে এল জমিনে, ঘাসের ওপর। ছেলেটার ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো সব খাড়া হয়ে গেল, কুকুরটাও নড়েচড়ে উঠল। জানালার বাইরে কটমট করে তাকাল, দাঁড়িয়ে গেছে লোম, গলার ভেতর থেকে গরগর আওয়াজ বেরিয়ে এল, নাক কোঁচকাল, বেরিয়ে পড়েছে ঝকঝকে সাদা দাঁত।

হাত বাড়িয়ে জানোয়ারটার কাঁধ ছুঁলো সে। কুকুরটা তাকাল তার দিকে, হুকুমের জন্যে অপেক্ষা করছে। ছেলেটা কুকুরটার লোমের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দিল, ধরে রাখল ওকে। কুঁচকে যাবার ভঙ্গিতে ভাঁজ পড়ল কুকুরটার কপালে, ঘুরল, তাকাল টিভি পর্দার দিকে। হাঁপাচ্ছে। জিভ বেয়ে লালা পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে কার্পেট।

ক্লোজ-আপে টিভি অ্যাডজাস্ট করল ছেলেটা, আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে শ্যারনের দিকে। শ্যারন লন ধরে হাঁটছে।

মেয়েটাকে দেখে অস্থির হয়ে উঠল কুকুর, কিন্তু ছেলেটা ছাড়ল না ওকে। শ্যারন একটা ঝোপের ধারে চলে এসেছে। হঠাৎ বাড়ি খেল লম্বা একটা ডালে। দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যারন। ছেলেটা ওর চোখে পানি দেখতে পেল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো তার। ইচ্ছে করল মেয়েটার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে দু’একটা সান্ত্বনাবাক্য শুনিয়ে আসে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সে শ্যারনের দিকে। চিবুক ডলতে ডলতে আবার রওনা হয়েছে মেয়েটা। আর কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাড়ির একশো গজের মধ্যে চলে আসবে। লাফ মেরে সিধে হলো ছেলেটা, এক ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, করিডর পেরিয়ে, দ্রুত নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। কুকুরটা তার পায়ের সাথে সেঁটে রইল। সাইড ডোর খুলে পা বাড়াল সে লনের দিকে। কুকুরটা দাঁড়িয়ে থাকল দোরগোড়ায়।

.

ঝোপের পরে সুন্দর ভাবে ছাঁটা ঘাসের লন। লনের শেষ মাথায় প্রকাণ্ড বাড়িটা। বাড়িটা খুব সুন্দর তবে জীবনের কোন চিহ্ন নেই। চাঁদনি রাতে রোমান্টিক পার্টির জন্যে দারুণ জায়গা, ভাবল শ্যারন। বাড়িতে কেউ থাকে না? মুখ তুলে চাইতেই ছেলেটাকে দেখতে পেল সে। একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে এল শ্যারনের, স্কুল ছাত্রীদের মত মুখে হাত চাপা দিল। যেন ছেলেটাকে দেখে খুব লজ্জা পেয়েছে।

এত সুদর্শন তরুণ জীবনে দেখেনি শ্যারন।

‘হ্যালো,’ কথা বলার সময় ভাঙা বাঁশির সুরের মত শোনাল গলা।

জবাবে নড় করল তরুণ; নীরবে দেখছে শ্যারনকে। ভুবন ভোলানো হাসিটি উপহার দিল শ্যারন ওকে, পা বাড়াল। ছেলেটা এগিয়ে এসে ওর পথ আটকে দাঁড়াল।

‘আপনি কে?’ জিজ্ঞেস করল সে।

উচ্চারণটা কোন্ এলাকার ধরতে পারল না শ্যারন, তবে গলার স্বর ভারী আর গভীর।

‘আমি শ্যারন। তুমি কে?’

‘এখানে কি চাই?’ থমথমে গলায় প্রশ্ন করল তরুণ।

‘কিছু না। এমনি পার্কটা ঘুরে দেখছিলাম।’ আবার হাসল শ্যারন। তবে অপরজন হাসল না। শ্যারনের বিখ্যাত হাসি দেখে এই প্রথম কোন পুরুষ মানুষের চেহারায় ভাব ফুটল না। স্রেফ পাথর চোখে ছেলেটা তাকিয়ে রইল তার দিকে

‘এটা পার্ক নয়।’

‘ওহ্, আমি ভেবেছিলাম-’

‘এটা প্রাইভেট এস্টেট।’

‘তাই?’

অনধিকার প্রবেশের অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত শ্যারন। তুমি যতই রূপবান আর শক্তিশালী হও না কেন আমাকে এড়িয়ে যাওয়া তোমার কম্মো নয়, ভাবছে ও।

‘আপনি বাড়িটা দেখতে চান?’

‘ধন্যবাদ। হ্যাঁ…’ হুট করে আমন্ত্রণটা আসবে চিন্তাই করেনি শ্যারন, কি বলবে বুঝতে পারছে না। ছেলেটা ঘুরে দাঁড়াল, তারপর হাঁটতে শুরু করল। তার পিছু পিছু এগোল ও। দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল, বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ কুকুরটাকে দেখে। বুক হিম করা ডাক ছাড়ল ওটা, গায়ের লোম খাড়া। ছেলেটা মাত্র একবার তাকাল জানোয়ারটার দিকে, সাথে সাথে থেমে গেল গর্জন।

শিউরে উঠল শ্যারন। ‘আমি এতবড় কুকুর জীবনেও—’

‘ওটা রটউইলার, ব্যাখ্যা দিল ছেলেটা। ‘একসময় মাল টানার কাজে ব্যবহার করা হত ওদের। শিকারেও পটু। কাউকে একবার বাগে পেলে…’ হাসল সে।

‘শিকার আমি ঘেন্না করি,’ বলল শ্যারন।

‘হ্যাঁ,’ সায় দিল তরুণ। আপনার করারই কথা।’

ভেতরে ঢুকল ছেলেটা শ্যারনকে নিয়ে, পেছনে নিঃশব্দে ছায়ার মত অনুসরণ করে চলল কুকুর। বোটকা গন্ধ আসছে ওটার গা থেকে। নাক কোঁচকাল শ্যারন।

হলঘরের মাঝখানে চলে এসেছে শ্যারন, চারপাশে তাকিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কি প্রকাণ্ড গ্যালারি, ঝুড়ি থেকে লতা ঝুলছে। ওখান থেকে ক্যাথেরিন থর্ন পড়ে গিয়েছিল, ভাবল শ্যারন।

‘আপনি ঘুরে-ফিরে দেখুন,’ বলল ছেলেটা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। কুকুরটা থাকল শ্যারনের সাথে।

‘অনেক ধন্যবাদ,’ বলল শ্যারন। দেখল কুকুরটা আগের মত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

এখানেই তাহলে সব ঘটনা ঘটেছে, ভাবছে শ্যারন। এটাকে এখন আর ভূতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে না। হলঘর পার হয়ে ড্রইংরুমে চলে এল, ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সিঁড়ির দিকে তাকাল। ছেলেটা কোথায় গেল? ছেলেটার সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করবে সে এখানে থাকে কিনা আর এ বাড়ির ইতিহাস সে কতটা জানে। একবার যখন ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলেছে, সব খুঁটিয়ে দেখবে শ্যারন।

হঠাৎ শ্যারন খেয়াল করল ও একা। চলে গেছে কুকুরটা।

চ্যাপেলে, তার বাবার সামনে স্থির দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, দৃষ্টি লাশের চোখের দিকে। ঠোঁট নড়ছে তার। নীরবে প্রার্থনা করে চলেছে। হাত বাড়িয়ে বাবার হাত ধরল সে।

‘ক্ষমা করো, পিতা, আমার অযোগ্যতাকে ক্ষমা করে দাও,’ মৃদু গলায় বলল তরুণ।

এক পা পিছিয়ে এল সে, ঘুরল, জ্বলন্ত চোখে তাকাল যীশুর প্রতিমূর্তির দিকে।

‘তুমি,’ ঘৃণাভরে বলল সে, ‘ভেবেছ তোমার নোংরা কৌশল দিয়ে আমার মন ভোলাবে। এজন্যে ওই সুন্দরী ছলনাময়ীকে আমার কাছে পাঠিয়েছ, তাই না? ঠিক যেভাবে আমার মাকে পাঠিয়েছিলে আমার বাবার কাছে। বাবার মত আমাকেও মিথ্যে আবেগের ফাঁদে ফেলতে চেয়েছ। আমার শক্তিকে দুর্বল করতে চেয়েছ কামনার ফাঁদ পেতে।’

ক্রুশের পেছন দিকে চলে এল সে, ড্যাগারের হাতল চেপে ধরল, চাড় দিয়ে কাঠের ভেতর ঢুকিয়ে দিল ফলা।

‘তার ফল হলো এই,’ হিসিয়ে উঠল সে, একটানে বের করে আনল ড্যাগার। এক মুহূর্ত কটমট করে তাকিয়ে রইল ওটার দিকে, তারপর চলে এল লাশের কাছে, বৃত্ত করে ঘুরল চারপাশে, শিরদাঁড়ায় হাত বোলাল। পঞ্চম ভার্টেব্রার নিচে গভীর একটা ক্ষত। আঙুল কেঁপে উঠল ওখানে ছোঁয়া লাগতে। আবার ড্যাগারের দিকে তাকাল সে।

‘ছলনাময়ীরা সবাই খুনী,’ ফিসফিস করল সে। ‘আমার বাবাকেও খুন করেছে এক ছলনাময়ী।’ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে এক মুহূর্ত, তারপর এক লাফে চলে এল যীশুর মূর্তির সামনে, দড়াম করে ঘুষি মারল মুখে, আবার ড্যাগার ঢুকিয়ে দিল মেরুদণ্ডে।

‘ভেবেছ তুমি প্রলোভন সম্পর্কে সব জানো,’ আবার মূর্তির সামনে চলে এল ছেলেটা। ‘ভেবেছ তুমি প্রলোভন জয় করতে পেরেছ। কিন্তু তোমার চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত তোমাকে কিছুই শেখায়নি। তুমি এই মেয়েটাকে পাঠিয়েছ আমার নিয়তি, আমার কর্ম থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে, তোমার রাস্তায় আমাকে নিয়ে যেতে। এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল সে। কিন্তু তুমি ব্যর্থ হয়েছ, এবং সবসময় তাই হবে।’

হাত বাড়িয়ে মুখ ছুঁলো সে তারপর ঘুরে দাঁড়াল।

.

অনেক ঘোরাঘুরি করেছে শ্যারন। সাঁঝ নামছে। বাড়ি ফেরা দরকার। নাক কুঁচকে রেখেছে ও। এ বাড়ির সব জায়গায় কুকুরটার গায়ের বমি আসা গন্ধ। তবে ছেলেটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শীত শীত লাগছে শ্যারনের। পাতলা ব্লাউজ আর সামার স্কার্ট ঠাণ্ডা বাতাস ঠেকাতে পারছে না।

হঠাৎ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে পড়ার তীব্র ইচ্ছে জাগল মনে। কেন জানি ভয় লাগছে ওর।

দরজা খুলে ড্রাইভওয়েতে পা রেখেছে শ্যারন, কিসের সাথে যেন হোঁচট খেল। বড়, নুড়ি পাথর একটা। জুতো খুলে ফেলল ও। পায়ে নুড়ির খোঁচা লাগছে। গ্রাহ্য করল না শ্যারন। বাতাসের বেগ বাড়ছে। লনের কাছে এসেছে, হঠাৎ মনে হলো কেউ আড়াল থেকে ওকে দেখছে। পেছন ফিরে তাকাল শ্যারন। ভেবেছিল কুকুরটাকে দেখবে। নেই ওটা। কেউ নেই। লন পার হয়ে ঝোপের দিকে এগোল ও, অজান্তে বেড়ে গেছে চলার গতি। কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না তবে বোটকা গন্ধটা যেন গলার ভেতর ঢুকে আছে। বমি আসছে। বাড়িটা থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে শ্যারন, গন্ধটা তত প্রবল হয়ে উঠছে

ঝোপগুলোর মাঝখানে একটা রাস্তা। ওই পথ ধরে হোঁচট খেতে খেতে ছুটল শ্যারন। দুইবার প্রায় আছাড় খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল গাছের শেকড়ের সাথে পা বেঁধে। ডালগুলো বাড়ি মারছে মুখে। এক হাতে মুখ ঢেকে দৌড়াচ্ছে শ্যারন। বারবার দেখা দুঃস্বপ্নটার কথা মনে পড়ছে। স্বপ্নের মধ্যে কে যেন ওকে তাড়া করে। কাঁপতে কাঁপতে বহুবার ঘুম থেকে জেগে উঠেছে শ্যারন। স্বপ্নটা এমনভাবে গেঁথে আছে মনে, সিনেমায় কাউকে তাড়া করার দৃশ্য দেখলেও আঁতকে ওঠে ও।

দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যারন। ঝোপগুলো এদিকে অনেকটা হালকা। এরপরে ঘাসের জমিন, তারপর দেয়াল, সবশেষে দেয়ালের ওপাশে শ্যারনের গাড়ি। আবার দৌড় শুরু করল শ্যারন। একটু পর থেমে গেল। আবারও ঝোপের রাজ্য! ব্যাপারটা কি? হতভম্ব হয়ে গেল শ্যারন। ও কি তাহলে একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরে মরছে? নিজেকে বকা দিল শ্যারন। দিক ঠিক করে কখনও চলতে পারে না ও।

আবার শিরশিরে অনুভূতিটা ফিরে এল, হাত দুটো বুকে চেপে ধরে দৌড়াচ্ছে শ্যারন। ঝোপ ঠেলে অন্ধের মত খুঁজছে খালি মাঠটা। মাঠের পরেই দেয়াল। মাঠে পৌঁছুতে পারলেই হলো। কিন্তু এ পথ যে শেষ হয় না। কত বড় এস্টেট এটা? চারশো একর না? এখন হোক আর খানিক পরে হোক, দেয়াল চোখে পড়বেই শ্যারনের। তারপর সে পেরিফোর্ড ছেড়ে চলে যেতে পারবে।

.

নিঃশব্দে মেয়েটার পিছু নিয়েছে কুকুরটা। পঞ্চাশ গজ পেছনে থেকে অনুসরণ করে চলেছে ওকে। মেয়েটা থামলে সেও দাঁড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটা যখন মাঠে চলে এল দু’জনের মাঝে দূরত্ব রইল ত্রিশ গজ। দাঁড়িয়ে পড়ল কুকুর, নাক উঁচু করে শ্বাস টানল, দেখল মেয়েটা ঘাস জমিনের ওপর দিয়ে দৌড় শুরু করেছে। সেও দৌড়াল। এবার আগের চেয়ে জোরে। চওড়া বুকটা উঠছে-নামছে, লাফ মেরে প্রতি সেকেন্ডে দূরত্ব কমিয়ে আনছে সে…

কোন শব্দ শুনতে পেল না শ্যারন, টের পেল বোটকা গন্ধটা বেড়েই চলেছে। ওটার উপস্থিতি অনুভব করল যখন জানোয়ারটা প্রায় ওর গায়ের ওপর উঠে পড়েছে, সেই সময়। ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল শ্যারন, কোমরে লোহার মত শক্ত মাথার প্রচণ্ড গোত্তা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। চিৎকার দেয়ার সময়ও পেল না, উঠতে যাচ্ছে, কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল, কামড় বসাল পায়ের গোছে। ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাচ্ছে ওটা, চোয়ালজোড়া বন্ধ হলো সশব্দে, হাড় আর মজ্জা ভেদ করে ঢুকে গেল তীক্ষ্ণ দাঁত; এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিল শ্যারন। মুখ তুলল কুকুর, কটমট করে চাইল শ্যারনের দিকে, তারপর ছেড়ে দিল ওকে। মিশে গেল অন্ধকারে।

.

তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে গেছে শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড। ফোঁপাচ্ছে। আহত পা-টায় আগুন ধরে গেছে, একটুও নড়াতে পারছে না। কুকুরটা ওর পায়ের শিরা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। জানে হাঁটতে পারবে না। তাই হামাগুড়ি দিয়ে এগোল।

ব্যথা সহ্য করতে পারছে না শ্যারন। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলল। দেয়াল পর্যন্ত যেতে পারলে সাহায্যের জন্যে চিৎকার করবে শ্যারন। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই শুনবে ওর আকুতি।

দশ গজ এগোতে এক ঘণ্টা লাগল শ্যারনের। নিচতলার জানালার ধারে বসে ছেলেটা আর তার কুকুর দেখছে ওকে। ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে বৃথাই ঘণ্টাখানেক কান্নাকাটি করল শ্যারন। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকল ঘাসের ওপর। ফোঁপাচ্ছে।

একটু পর ফোঁপানি থেমে গেল শ্যারনের। ছেলেটা চার হাত-পায়ে কুকুরের মত এগিয়ে গেল ওর দিকে। নড়ে উঠল শ্যারন, মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল কে আসছে। কিন্তু বেশিক্ষণ মাথা তুলে রাখতে পারল না, ধপ্ করে পড়ে গেল। কাউকে দেখতে পায়নি সে। ওকে নড়তে দেখে ছেলেটা ঝোপের আড়ালে চলে গেছে। ওখানেই উবু হয়ে বসে থাকল সে সকাল পর্যন্ত। ভোরের দিকে নড়াচড়া সম্পূর্ণ থেমে গেল শ্যারনের, এবার ছেলেটা এগোল তার দিকে।

.

দুঃস্বপ্ন দেখছে শ্যারন। তার স্বপ্নে ভিড় করে এল শেয়াল, হায়েনা, শকুন আর হরর ছবির বিকট জিন্দালাশের দল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ওর। উপুড় হয়ে পড়ে আছে শ্যারন। লালা শুকিয়ে আছে মাটিতে। যন্ত্রণায় মাটি খামছে ধরায় উঠে গেছে হাতের চামড়া। জ্বালা করছে। তবে পায়ে কোন সাড়া পাচ্ছে না। মাথা তুলতেই পা-টা নাড়া খেল, আগুন ধরে গেল শরীরে। এবার ছেলেটাকে দেখতে পেল শ্যারন। ন্যাংটো। চার হাত-পায়ে ভর করে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। হাসার চেষ্টা করল শ্যারন, কথা বলতে চাইল, আওয়াজ বেরুল না গলা থেকে। এটাকেও দুঃস্বপ্নের একটা অংশ মনে হলো। ছেলেটা তাকিয়ে আছে ওর চোখে চোখ রেখে। হলুদ চোখ। ওর নিশ্বাসে দুর্গন্ধ, কুকুরটার মত। শ্যারনের ওপর শুয়ে পড়ল ছেলেটা। গুঙিয়ে উঠল শ্যারন। বুঝতে পারছে না ছেলেটার মতলব। হঠাৎ ঘাড়ের পেছনে তীক্ষ্ণ ছুঁচ ফুটল, কামড় দিয়েছে ছেলেটা। মুখ হাঁ করল শ্যারন, চিৎকার দেবে, শেষ মুহূর্তে পরিতৃপ্তিসূচক ঘোঁৎ ঘোঁৎ একটা শব্দ শুনতে পেল। তারপর একটানে শ্যারনের সার্ভিকাল নার্ভ ছিঁড়ে ফেলল ছেলেটা দাঁত দিয়ে। ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল শ্যারনের চোখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *