আবার অশুভ সঙ্কেত – ৭

সাত

রোম থেকে আসা একটা ফোনের অনুরোধে কাজটা করতে রাজি হয়েছেন ফাদার টমাস ডুলান। তবে খচখচ করছে মন। এ এক ধরনের অপবিত্র কর্ম, আইন-বিরোধী। কিন্তু ওয়াল্টার তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুই শুধু নয়, চার্চের প্রতি নিবেদিত প্রাণও বটে।

ওয়াল্টার একটা নাম্বার দিয়েছে। সেই নাম্বারে যোগাযোগ করলেন ডুলান। ফাদারের কণ্ঠ শুনে অপর পক্ষ সানন্দে তাঁকে সাহায্য করার কথা বলল। ঘণ্টাখানেক লাগল তাঁর ঠিকানা খুঁজে, মেশিন জোগাড় করে নর্থ সাইডের কবরখানায় ফিরে আসতে। ট্যাক্সিঅলা ভাড়া নিয়ে বিদায় হলো, ডুলান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াল্টারের বন্ধুর দেয়া মেশিনটার প্রতি মনোযোগ দিলেন। বড় একটা চামচের মত যন্ত্রটা, তিন ফুট লম্বা একটা শ্যাফট, হাতলে ডায়াল সহ রঙিন টিভি পর্দাও আছে। ওয়াল্টারের বন্ধু গর্ব করে বলেছে এরচে’ কার্যকরী এবং সর্বাধুনিক টেকনোলজির জিনিস আর নেই। জুলজিস্ট এবং অ্যামেচার প্রসপেক্টরদের জন্যে অপরিহার্য যন্ত্র এটা।

ছয় ফুটে ডায়াল অ্যাডজাস্ট করে সুইচ অন করলেন ফাদার। মৃদু গুঞ্জন তুলল মেশিন। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলেন তিনি। তারাজ্বলা নির্মেঘ আকাশ।

সুইচ অফ করে দিলেন ফাদার। গোরস্থানের গেট ঠেলে ঢুকলেন ভেতরে। যন্ত্রটাকে সামনে ধরে রেখেছেন ঘাস কাটা নিড়ানির মত। গোরস্থানটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ধনী মানুষদের এখানে কবর দেয়া হয়।

থর্ন সমাধিটি লেকের পাশে। গ্রানিট পাথরের তৈরি গোল একটা বিল্ডিং, চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। ডাবল ওকের ভেজানো দরজা, ডুলান ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।

ঘরটা গোলাকার, কতগুলো পাথরের ফলক বা ট্যাবলেট দাঁড় করানো, দেয়ালের গায়ের চোর-কুঠুরিতে একটি মাত্র মোমবাতি জ্বলছে।

ঘরের চারপাশ ঘুরে দেখলেন ফাদার, পাথুরে ফলকে লেখা থর্ন পরিবারের চার জেনারেশনের বংশ লতিকা পড়লেন। সবচে’ বড় ট্যাবলেটটি স্মারক-ফলক।

‘রবার্ট এবং ক্যাথেরিন থর্নের স্মৃতির উদ্দেশে,’ পড়লেন তিনি। ‘এক সাথে তাঁরা শুয়ে আছেন নিউ ইয়র্ক নগরীতে। এবং রিচার্ড ও অ্যান থর্নের স্মৃতির প্রতিও। তাঁদের আত্মা শান্তিতে ঘুমাক।’

কয়েক পা পিছিয়ে এলেন ডুলান, ঘুরলেন, তাকালেন বড় একটা মার্বেল স্ল্যাবের দিকে। ঘরের মাঝখানে ওটা। স্ল্যাবের মাথায় লেখা:

ডেমিয়েন থর্ন
১৯৫০-১৯৮২

কোন এপিটাফ লেখা নেই, শুধুই নাম। মৃত্যুর পরেও যেন জায়গাটাতে ডেমিয়েনের কর্তৃত্বের ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা মনে পড়ে গেল ডুলানের। টিভিতে দেখেছেন অনুষ্ঠানটি। এখনও চোখে ভাসে। কফিন বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সমাধির দিকে, তারপর বন্ধ হয়ে যায় দরজা। তখনও সংবাদ ভাষ্যকার বলে চলছিল ডেমিয়েনের করুণ মৃত্যুর কথা।

ডুলান মেশিনের সুইচ অন করলেন, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঢেউ নিচে নেমে গেল শিরশিরে অনুভূতি তুলে। এই জীবনে বহু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজির থেকেছেন তিনি, বহু লোককে নিজের হাতে কবর দিয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁর মনে হচ্ছে কবরটা ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল, লাশটা শান্তিতে থাকুক। অথচ মনের অজান্তেই হাতল চেপে ধরে রেখেছেন তিনি, কাজ শুরু করে দিয়েছে মেশিন। কাজটা করতে বেশি সময় লাগবে না, তারপর চলে যাবেন, বললেন তিনি মনে মনে।

পর্দার দিকে তাকিয়ে আছেন ফাদার। বাদামী মাটি দেখা যাচ্ছে। ডায়াল পাঁচ ফুটে অ্যাডজাস্ট করতে দৃশ্যটা পরিষ্কার হয়ে ফুটল। কাদা মাটির এক্স-রে বলা যায় ওটাকে। চকোলেট বারের মত দেখতে।

স্ল্যাবের দিকে এগোলেন ডুলান, কবরের পাশে দাঁড়ালেন। লাশের প্রস্তরখচিত নামের ওপর পা রেখে। আবার চোখ ফেরালেন পর্দায়। মাটির চেহারা বদলে গেছে। মাটির সাথে এবার নুড়ি উঠছে। যন্ত্রটা দুই হাঁটুর মাঝখানে রেখে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলেন। শর্ট রেঞ্জের ফোকাস করছেন। তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল পর্দায় কফিনের মেহগনি কাঠের ঢাকনা দেখে। অজান্তে হাত উঠে এল বুকে, ক্রুশ আঁকলেন। ডুলান শুনেছেন মৃত্যুর পরেও লাশের চুল আর নখ বাড়তে থাকে। যদি দেখেন মুখ ভর্তি দাড়ি আর হাতে মস্ত বাঁকানো নখ নিয়ে লাশটা তাঁর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে! তখন?

চোখ বুজে ফেললেন ডুলান, ভয়ে ভয়ে ডায়ালের দিকে হাত বাড়ালেন। জোর করে আবার চোখ মেললেন। পর্দায় পাথরের আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর। ডায়াল নিয়ে নড়াচড়া শুরু করলেন: দু’ইঞ্চি ওপরে, আরও পাথর; চার ইঞ্চি নিচে, কফিনের মেঝে দেখা গেল; আট ইঞ্চি ওপরে, পর্দা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল, তারপর দুটো শব্দ ঝলসে উঠল ওখানে: AIR VENT.

দ্রুত নড়ে উঠলেন ডুলান, স্ল্যাবের চারপাশে বারবার স্ক্যানার ঘুরিয়ে দেখলেন। কিন্তু পাথর ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। ডেমিয়েন থর্নের কবর সম্পূর্ণ খালি। মেশিন বন্ধ করে দিলেন ঝট্ করে, হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলেন পাথরে খোদাই করা নামের দিকে। ডানে-বামে মাথা নাড়তে নাড়তে সরে এলেন স্ল্যাবের সামনে থেকে।

‘আমার এখন দরকার, জোরে জোরে বললেন তিনি, ‘বড়সড় একটা ড্রিঙ্ক।’

.

সমাধি থেকে অনেক দূরে, পুবে, ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে চ্যাপেলে, বাবার হাত মুঠো করে ধরে রেখেছে, নীরবে ঠোঁট নড়ছে তার; কপাল থেকে ঘাম বেয়ে নামছে, ঢুকে যাচ্ছে চোখে, ঘাম পড়ছে হাতে, ডেমিয়েন থর্নের হাত ভিজে গেল। ছেলেটার চেহারা কুঁচকে আছে মনোসংযোগের ভঙ্গিতে, কপালে শিরা ফুটে উঠেছে টানটান তারের মত, ওদিকে পেরিফোর্ডের জঙ্গলে প্রকাণ্ডদেহী কুকুরটা মুখ তুলে চাইল পশ্চিম আকাশের দিকে, তারপর ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ল…

.

নর্থ শিকাগো সেমিট্রি’র কাছের একটা বার, লিন্ডসে’তে ঢুকলেন ফাদার টমাস ডুলান। ঢকঢক করে মদ গিললেন। বারটেন্ডার তাঁকে দেখল বার দুই ফোন বুদে ঢুকতে। দুইবারই হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এলেন। রোমে খবরটা পৌঁছুনো খুব জরুরী। কিন্তু লাইন পাচ্ছে না অপারেটর। তিন বারের বার লাইন পাওয়া গেল। কিন্তু অপারেটর জানাল অপর পক্ষ ফোন ধরছে না। টেনশনে ফাদারের হার্টবিট বেড়ে গেল। অবশেষে ফোন ধরল ওয়াল্টার। ডুলান তাকে ঘটনাটা বললেন। ধন্যবাদ দিল ওয়াল্টার। কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল ঘটনা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।

ফাদারের দায়িত্ব শেষ। এবার তিনি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরতে পারবেন।

রাস্তায় নামার সাথে সাথে বাতাসের ঝাপটা খেলেন ডুলান। আবহাওয়া বদলে গেছে। লেকের পানিতে ঢেউ উঠছে, পুবের আকাশে জমতে শুরু করেছে মেঘ। ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে যাচ্ছে চাঁদের দিকে। গোরস্থানের গেট খুললেন ডুলান। বারটেন্ডার বলেছে কাছের ক্যাব স্ট্যান্ডে যাবার এদিক দিয়ে শর্টকাট রাস্তা আছে। ইন্ডিয়ানদের রাইফেল ধরার মত মেশিনটা বুকের সাথে চেপে হোঁচট খেতে খেতে এগোলেন ফাদার। বেশি মদ খাওয়া হয়ে গেছে, ভাবছেন তিনি। মাথা ঝিমঝিম করছে। থুথু আসছে। মদ পানে অভ্যস্ত নন ডুলান।

থর্ন সমাধির দিকে এক নজর তাকালেন ফাদার। মনে হলো কিছু একটা নড়াচড়া করছে ওখানে, হলুদ দুটো বিন্দুও যেন দেখতে পেলেন এক মুহূর্তের জন্যে। গা শিরশির করে উঠল তাঁর, দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। বাতাসের বেগ বেড়েছে। মাথা নিচু করে হাঁটতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু ঠিকমত হাঁটতে পারছেন না। টলছেন। হঠাৎ একটা পাথুরে ফলকের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। মৃদু গুঞ্জন শুনে তাকালেন মেশিনের দিকে। হাঁ করে দেখলেন চালু হয়ে গেছে ডিটেকটর। অন্ধের মত হাতড়ে বেড়ালেন সুইচ, বন্ধ করবেন যন্ত্র। কিন্তু খুঁজে পেলেন না সুইচ। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন পর্দার দিকে। কবর খুঁড়ছে ডিটেকটর, একটা খুলি দাঁত বের করে হাসল ফাদারের দিকে চেয়ে। চোখ মিটমিট করলেন ডুলান, ঢোক গিললেন, তারপর সিধে হয়েই দৌড় দিলেন মেশিনটাকে পেছনে টানতে টানতে।

এক দৌড়ে গেটে পৌঁছে যাবেন ভেবেছিলেন ডুলান। কিন্তু শক্তি পাচ্ছেন না শরীরে। খকখক কেশে উঠলেন, দেবদূতের একটা মূর্তির গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। বমি আসছে তাঁর। তেতো ঢেকুর উঠছে। থুক্ করে তেতো থুথু ফেললেন মাটিতে। গুঙিয়ে উঠলেন ডুলান, জামার আস্তিনে মুখ মুছলেন। ডিটেকটরের অবিরাম গুঞ্জনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকালেন পর্দার দিকে।

এবারেরটা প্রাণীর কঙ্কাল। কুকুর, বা হায়েনা হতে পারে, শেয়াল হওয়াও বিচিত্র নয়। সিধে হয়েছেন তিনি, মনে হলো কঙ্কালটার হাড়গুলো নড়ে উঠল, পেছনের পা জোড়া লাথি ছুঁড়ছে। ওদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না তাঁর, তারপরও সম্মোহিতের মত চেয়ে রইলেন। বাতাসে বোটকা একটা গন্ধ। ডুলান রুমাল বের করে নাক চাপা দিলেন।

দেবমূর্তির কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগলেন ডুলান, এগোচ্ছেন গেটের দিকে। এদিকে শুধু কবর আর কবর। প্রার্থনার শ্লোক আওড়াতে আওড়াতে কবরগুলোর মাঝ দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে ছুটছেন তিনি। যন্ত্রটা ধরে আছেন দু’হাতে। দুটো সমাধি ফলকের গায়ে আটকে গেল ওটা। ডিটেকটরের ওপর হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগলেন ফাদার। সমাধি ফলকে লেখা:

জোনাথন এবং মারিয়া ফোরসাইথ;
এঁরা এক সাথে, শান্তিতে আছেন অনন্তকালের জন্যে।

পর্দায় লাশ দুটোকে দেখা গেল। পাঁজরের হাড়ের ভেতর কিলবিল করছে পোকা, মাছি উড়ছে মুখের ওপর। পাশাপাশি শুয়ে আছে দু’জনে। ডুলান বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখলেন মারিয়া ফোরসাইথের ফাঁক হয়ে যাওয়া খুলি তার স্বামীর কাঁধের ওপর থেকে বিকট ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। মারিয়ার মুখের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে জিভ, লকলক করছে। গলা চিরে তীক্ষ্ণ, ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরিয়ে এল ফাদারের, পড়িমরি করে দৌড় দিলেন। এখনও মেশিনটা ধরে আছেন মুঠিতে। অন্ধের মত ছুটছেন। বার কয়েক পড়ে গেলেন আছাড় খেয়ে। তবে ভয়ের চোটে ব্যথা টের পেলেন না।

দৌড়াচ্ছেন, হোঁচট খাচ্ছেন আর চিৎকার করে একটা শব্দ বারবার আউড়ে চলেছেন: ‘অপবিত্রকরণ!’ শব্দটা প্রতিধ্বনি তুলছে যেন গাছের ফাঁকে। মাথাটা বারবার দু’পাশে নাড়াচ্ছেন ফাদার, ভুলে থাকতে চাইছেন ফাঁক হয়ে যাওয়া খুলির কথা। কিন্তু মগজের সাথে আঠা দিয়ে যেন সেঁটে দেয়া হয়েছে দৃশ্যটা, ভুলতে পারছেন না। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন বলে খোলা কবরটা খেয়াল করেননি ডুলান। ডিগবাজি খেয়ে দড়াম করে ওটার মধ্যে পড়ে গেলেন তিনি।

প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখলেন ডুলান। মাথা তোলার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। থুথু ফেললেন। মুখ দিয়ে কাদা বেরিয়ে এল। পা-ও নড়াতে পারছেন না। গোটা শরীর অসাড়। প্রচণ্ড ভয় গ্রাস করল তাঁকে। প্রাণপণে চেষ্টা করলেন ভয় তাড়াতে। হাতে সবচে’ ব্যথা পেয়েছেন ফাদার। মনে হচ্ছে প্যারালাইজ্‌ড় হয়ে গেছে হাত। তবে অসাড় ভাবটা বেশিক্ষণ থাকবে না, নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন তিনি। একটু পরে পায়েও সাড়া ফিরে পাবেন। হাতটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বেঁকে আছে। এর আগে কোনদিন শরীরের হাড়-টাড় ভাঙেনি ডুলানের। আবার ব্যথার ঢেউ উঠল, চোখ বুজে ফেললেন তিনি। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে লাগলেন। চোখ মেলে তাকাতেই কবরের ওপর একটা কাঠামো দেখতে পেলেন তিনি। চোখ কুঁচকে আরও ভালভাবে দেখার চেষ্টা করলেন ওটাকে। একটা কুকুর, প্রকাণ্ড মাথা, হলুদ চোখে চেয়ে আছে তাঁর দিকে। শিউরে উঠলেন তিনি। থর্ন সমাধিতে নাইট গার্ড নেই কেন ভাবছিলেন ফাদার। এবার জবাবটা পেয়ে গেছেন। এরকম বিশালদেহী কুকুররাই হয়তো নাইট গার্ডের কাজ করে।

কুকুরটার চোখে চোখ রেখে মৃগী রোগীর মত হেসে উঠলেন ডুলান। নিজেকে তাঁর হিমবাহের কবলে পড়া পর্বতারোহীর মত লাগছে। আবার চোয়া ঢেকুর উঠল। থুথু ফেলার চেষ্টা করলেন, ঠোঁটের কোনা গড়িয়ে পড়ল কষ। বিশ্রী গন্ধ। মাথা হেলিয়ে গন্ধটার হাত থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করলেন খামোকাই। মস্তিষ্ক তাঁর নির্দেশ শুনছে না। মাথা হেলানো গেল না।

ডুলান দেখলেন কুকুরটা মাথা নিচু করছে, নাক দিয়ে কবরের পাশে উঁচু হয়ে থাকা মাটির স্তূপে ধাক্কা মারল। একরাশ মাটি ঝুরঝুর করে পড়ল ডুলানের নাকে- মুখে। একটা নুড়ি ঠকাশ করে বাড়ি মারল ভুরুতে। ‘হেই,’ গুঙিয়ে উঠলেন তিনি।

কুকুরটা আবার মাটির স্তূপে নাক দিয়ে ধাক্কা মারল। ‘না…’ চেঁচিয়ে উঠলেন ফাদার, হাঁ করা গলার মধ্যে ঢুকে গেল এক দলা কাদা। আর কথা বলতে পারলেন না। শুনতে পেলেন একটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ, তারপর দ্বিতীয় কুকুরটাকে দেখা গেল কবরের পাশে। এরপর আরও একটা। কবরের মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে সবাই। ওদের বিশাল শরীরের পেছনে তারাজ্বলা আকাশটাকে দেখা গেল এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল আকাশ তার ওপর মাটি-বৃষ্টি শুরু হতে। কুকুরগুলো নখ দিয়ে খামচে মাটি তুলছে, ছুঁড়ে ফেলছে কবরে।

একটা পাথরের টুকরো ঢুকে গেল ডুলানের নাকে, রক্ত বেরিয়ে এল। মুখ হাঁ করে চিৎকার দিলেন, গাঁক গাঁক আওয়াজের সাথে মাটি বেরুল শুধু। শক্ত করে চোখ বুজে থাকলেন তিনি, পাপড়ির ওপর মাটি পড়ছে। নীরবে প্রার্থনা করে চলেছেন ডুলান, মুখের ওপর মাটির স্তূপ বেড়েই চলেছে, একসময় বুজে গেল নাকের ফুটো।

.

পরদিন সকালে, কবর খননকারী লোকটা দৃশ্যটা দেখে প্রথমে ভাবল নতুন কবরটার ভেতরে বুঝি গোলাপী রঙের ঝোপ গজিয়েছে। সে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল ওদিকে, হাত বাড়াল-ছোঁবে। সাথে সাথে ঝাঁকি খেয়ে পিছিয়ে গেল, গুঙিয়ে উঠল। ডিগবাজি খেয়ে আরেকটু হলে পড়ে যাচ্ছিল সে ঘাস নিড়ানির মত যন্ত্রটার গায়ে। কবরের পাশে পড়ে আছে যন্ত্রটা, মোটর ঘুরছে, পর্দায় ফুটে আছে চোখ বোজা টমাস ডুলানের কাদা মাখা মুখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *