ছয়
শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের ড্যাগার বিষয়ক লেখাটি ছাপা হলো পত্রিকায়। এর দিন কয়েক পরে, শিকাগোর এক বাড়িতে, লেখাটা পড়ার সময় কফির কাপ হাত থেকে পড়ে গেল এক বুড়োর।
দ্রুত পড়া শেষ করল সে, তারপর তার প্রীস্টকে ফোন করল। নিজের স্টাডিরুমে ঢুকল বুড়ো, বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ পর উত্তেজিত বৃদ্ধ লন্ডনে, ফ্লিট স্ট্রীটের নাম্বারে ফোন করল।
‘আমার নাম নিকোলাস ওয়াল্টার,’ বলল সে। শিকাগো থেকে বলছি। আপনাদের এক সাংবাদিক, শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের সাথে একটু কথা বলতে চাই।’
‘দুঃখিত,’ ভেসে এল একটি পুরুষ কণ্ঠ। ‘মিস ফেয়ারচাইল্ড এক হপ্তা ধরে নিখোঁজ। তাকে খুঁজছেন কেন জানতে পারি?’
নিকোলাস ওয়াল্টার কথা বলছে, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। উঁকি দিলেন ছোটখাট, রোগা একজন মানুষ। পরনে ধূসর কোট। ওয়াল্টার লোকটিকে ইশারা করলেন ভেতরে আসতে। ফোনের আলাপ সেরে ঘুরল সে, হাত মেলাল প্রীস্টের সাথে। পত্রিকাটি দিয়ে ইঙ্গিত করল শ্যারনের লেখাটি পড়তে।
প্রীস্ট ধীরে ধীরে পড়লেন। ‘ব্যাপারটা অদ্ভুত, না?’ মন্তব্য করলেন তিনি পড়া শেষে।
‘খুব,’ বলল ওয়াল্টার।
এরপর দু’জনে মিলে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ চলল। ওয়াল্টার বলল কিভাবে এক নিলামে সে ড্যাগারগুলো পেয়েছিল আর প্রীস্ট সেগুলো নিয়ে ইটালিতে, সুবিয়াকোর এক মনাস্টেরিতে গিয়েছিলেন।
‘ব্যাপারটা যদি আগে জানতাম,’ বললেন প্রীস্ট। ‘তাহলে যেখানের জিনিস সেখানে ফেলে রাখলেই ভাল হত।’
‘ভেবে দেখুন,’ বলল ওয়াল্টার। ‘ইটালিয়ান লোকটা কিন্তু একবারও বলেনি সে ওগুলো দিয়ে কি করতে যাচ্ছে।’
‘কেউ বলেনি।’ এদিক-ওদিক
মাথা নাড়ছে নিকোলাস ওয়াল্টার অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে। পত্রিকায় কয়েকজন লোকের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। ওদের মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে ওয়াল্টারের।
‘ডি কার্লো বেঁচে আছে কিনা জানেন?’
কাঁধ ঝাঁকালেন প্রীস্ট। ‘জানি না। তবে মনাস্টেরিতে ফোন করে দেখতে পারেন।’
‘যদি বেঁচে থাকে, যাবেন আমার সাথে ওকে দেখতে?’
‘কেন? তাতে লাভ কি?
‘আমার কৌতূহলের নিরসন হবে।’
মাথা নাড়লেন প্রীস্ট। ‘আমার অত কৌতূহল নেই। তাছাড়া, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।’
‘তবে আমি যাব,’ বলল ওয়াল্টার। ‘আমার হাতে অঢেল সময়। আর রোমের মত জায়গায় ছুটি কাটানোর জন্যে এটা হলো সবচে’ উপযুক্ত সময়।’
নিকোলাস ওয়াল্টার তার ষাট বছরের জীবনে নিজের শহর ছেড়ে খুব কমই বাইরে গেছে। সারাটা জীবন সে কাটিয়ে দিয়েছে বইপত্রের মাঝে, প্রাচীন ইতিহাস আর বাইবেল পড়ে। বাইবেলের বিষয়ে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ বলা যায়। সে পণ্ডিত মানুষ, সন্দেহ নেই। তবে আধুনিক জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা সামান্যই।
প্লেন ভ্রমণটা উপভোগ করল নিকোলাস ওয়াল্টার। নিজেকে বেশ সজীব আর তরুণ লাগছে। মদ পান না করার বহুদিনের অভ্যাস সে ভেঙে ফেলল স্টুয়ার্ডেসের কাছ থেকে ককটেলের গ্লাস নিয়ে।
রোমে পৌঁছে সময় নষ্ট করল না ওয়াল্টার। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া করে সোজা পুবে, সুবিয়াকোর উদ্দেশে ছুটল। শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করার অনেক সময় পাবে সে। আগে ফাদার ডি কার্লোর সাথে দেখা করা দরকার। ম্যাপে রাস্তা দেখে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ডি কার্লোর মঠে পৌঁছে গেল ওয়াল্টার।
ওটাকে মঠ না বলে মঠের ধ্বংসাবশেষ বললেই মানায়। পাহাড়ের ওপর, কালো পাথরে তৈরি জরাজীর্ণ একটা দালান। সন্ধ্যা নেমেছে। অথচ দালানের কোথাও আলো জ্বলছে না। জানালা-টানালাও চোখে পড়ল না। গা-টা হঠাৎ শিরশির করে উঠল ওয়াল্টারের।
গাড়ি থামাল সে, বন্ধ করল ইঞ্জিন। চারপাশ আশ্চর্য নীরব। খোয়া ওঠা রাস্তা ধরে ভারী ওক কাঠের দরজাটার দিকে এগোল ওয়াল্টার, নীরব প্রার্থনার ভঙ্গিতে ঠোঁট নড়ছে। যে লোক তার জীবন কাটিয়েছে লাইব্রেরীর চৌহদ্দিতে, সে আজ শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসকে দেখছে চোখের সামনে। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র আর গুরুত্বহীন মনে হতে লাগল ওয়াল্টারের।
পাথরের ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল সে, কানে ভেসে এল নীচু গলার প্রার্থনা সঙ্গীত। লোহার ভারী কড়া ধরে নাড়া দিল। শব্দটা প্রতিধ্বনি তুলল দালানে, তবে প্রার্থনাকারীদের মনোযোগ নষ্ট হলো না তাতে। এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর খুলে গেল দরজা। এক সন্ন্যাসী, আলখেল্লায় মুখটা প্রায় ঢাকা, নীরবে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নিজের পরিচয় দিল ওয়াল্টার, সন্ন্যাসী সরে দাঁড়াল ওকে ভেতরে আসতে দেয়ার জন্যে।
‘আপনি এসেছেন, আমরা খুশি হয়েছি,’ পরিষ্কার ইংরেজীতে বলল সন্ন্যাসী। ‘আশা করি আপনাদের বিরক্ত করছি না।’
‘ফাদার ডি কার্লো আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আজকাল কেউ আসে না তাঁকে দেখতে।’
‘কেমন আছেন উনি?’
‘তাঁর অন্তর বড়ই বিক্ষিপ্ত।’
ওয়াল্টার সন্ন্যাসীর পিছু পিছু একটা প্যাসেজ ধরে এগোল, তারপর ঢুকল একটা সরু করিডরে। জায়গাটা স্যাঁতসেঁতে, বাতাসে নোনা গন্ধ। আবার শিউরে উঠল ওয়াল্টার।
একটা দরজার সামনে দাঁড়াল সন্ন্যাসী, টোকা দিল, তারপর ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল। ছোট একটা ঘরে ঢুকল ওয়াল্টার, দেখল সরু একটি চৌকিতে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। ফাদার ডুলান বলেছিলেন ডি কার্লো লম্বা-চওড়া মানুষ, প্রকাণ্ড মুখ, চওড়া চোয়াল, ঈগলের মত নাক। বয়সের কারণে ডি কার্লোর চেহারায় পরিবর্তন আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এ কি দশা হয়েছে মানুষটার? খুলির চারপাশে কুঁচকে আছে চামড়া, নড়া-চড়া অত্যন্ত ধীর। বিছানা থেকে উঠে বসার সময় যন্ত্রণার ছাপ ফুটল চেহারায়।
‘আমি জানতাম না আপনি অসুস্থ-’ ইতস্তত করে বলল ওয়াল্টার।
‘আমি ভালই আছি,’ জবাব দিলেন ডি কার্লো। ‘পৃথিবীটাই বরং অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
‘তা ঠিক,’ সায় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল ওয়াল্টার, তরুণ-সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে হাসল। সে একটা চেয়ার নিয়ে এসেছে। চেয়ারের এক কোনায় বসল ওয়াল্টার, পকেটে হাত ঢোকাল শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের লেখাটা বের করার জন্যে।
‘আমার চিঠি পেয়েছেন?’
মাথা দোলালেন প্রীস্ট। ‘ড্যাগারগুলো যখন পেলেন, জানতেন ওগুলোর গুরুত্বের কথা?’
‘শুধু জানতাম ওগুলো প্রাচীন নগরী মেগিড্ডোতে পাওয়া ছুরির মত দেখতে। মেগিড্ডোর ড্যাগারের ছবি দেখেছি।’
‘ওগুলো মেগিড্ডোর ছুরিই। জেরুজালেমের কাছে, মাটির নিচের একটা শহর ছিল ওটা। এক সময় বলা হত আরমাগেড্ডন।’
‘শয়তানের আত্মা তাড়ানোর কাজে ছুরিগুলো ব্যবহার করা হত বলে শুনেছি, ‘ বলল ওয়াল্টার।
হাসলেন ডি কার্লো। না। ওগুলোর কার্যকারিতা আরও বেশি।’
ওয়াল্টার পত্রিকাটি বাড়িয়ে দিল ফাদারের দিকে। ‘আমি ছুরিগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এ লেখাটা পড়ার পর আবার মনে পড়ে গেল।
ডি কার্লো ভুরু কুঁচকে তাকালেন লেখাটার দিকে, তারপর পড়তে লাগলেন। তাঁর চোখ ভরে গেল পানিতে। জামার আস্তিন দিয়ে চোখ মুছে তাকালেন ওয়াল্টারের দিকে।
‘আমি এখন যে কথাগুলো বলব আপনি চুপচাপ শুনে যাবেন। আর কথার মধ্যে কোন প্রশ্ন করবেন না।’
রাজি হলো ওয়াল্টার। নড়েচড়ে বসল। প্রীস্ট ধীরে ধীরে তাঁর গল্প বলে গেলেন।
বললেন সেই ঘরের কথা, যেখানে শিক্ষানবিস হিসেবে স্পিলেট্টো নামের এক প্রীস্টের মৃত্যুর সময় স্বীকারোক্তিতে তিনি হাজির ছিলেন। ওই প্রীস্ট ছিলেন শয়তানের শিষ্য, এক পৈশাচিক জন্মগ্রহণে তিনি সাহায্য করেছিলেন। শয়তানের সাথে শেয়ালের মিলনে জন্ম নিয়েছিল এক প্রাণী।
ওয়াল্টার চোখ পিটপিট করল তবে কোন মন্তব্য করল না।
প্রাণীটাকে মানব শিশুর মত চেহারা দেয়া হয়। মার্কিন সিনেটর রবার্ট থর্ন এবং তার স্ত্রী ক্যাথেরিনের সদ্যেজাত সন্তানকে মেরে তার জায়গায় ওই প্রাণীটাকে বিকল্প হিসেবে হাজির করা হয়। স্পিলেট্টো রবার্টকে বুঝিয়েছিলেন তাঁর বাচ্চা মরে গেছে, আর ঈশ্বরের ইচ্ছায় এতিম একটি শিশুকে তিনি পেতে যাচ্ছেন নিজের সন্তানের মত। ক্যাথেরিন থর্নের এর আগে কয়েকবার গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে। মা হবার ওটাই ছিল তার শেষ সুযোগ। রবার্ট থর্ন রাজি হয়। বিকল্প শিশুটিকে নিজেদের সন্তান বলে স্ত্রীকে জানায় রবার্ট। শিশুটির নাম রাখে ডেমিয়েন।
‘শিশুটি ছিল ধ্বংসের প্রতীক,’ বললেন ডি কার্লো।
‘রবার্ট থর্ন শেষ মুহূর্তে সত্য উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি মেগিড্ডো চলে যান। তাঁকে সাতটি ড্যাগার দেয়া হয়। কিন্তু শয়তান পুত্রকে হত্যা করার আগে নিজেই খুন হয়ে যান।
চোখ ঘষল ওয়াল্টার, ডি কার্লো সন্ন্যাসীকে ইঙ্গিত করলেন ওকে এক গ্লাস পানি দিতে। তারপর আবার গল্প শুরু হলো। বললেন ডেমিয়েন থর্ন কিভাবে থর্ন কর্পোরেশনের প্রধান ব্যক্তিতে পরিণত হলো। থর্ন কর্পোরেশন এমন এক কোম্পানি যারা বিশ্বের বেশিরভাগ জনগণকে খাদ্য যুগিয়ে চলছে। বললেন কিভাবে ডেমিয়েনের শিষ্য তৈরি হতে লাগল, সেই সাথে বেড়ে চলল তার শক্তি এবং প্রভাব…
‘তারপর, আমার প্রার্থনার জবাব পেলাম,’ বলে চললেন ডি কার্লো। ‘আপনি ড্যাগারগুলোর খোঁজ পেলেন। আপনার প্রীস্ট ওগুলো আমার কাছে নিয়ে এলেন। এ ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছে। ঈশ্বরের অনুষঙ্গ হিসেবে আপনি কাজ করেছেন।
পানি পান করছিল ওয়াল্টার, বিষম খেল। তবে কিছু বলল না।
‘আমার ছয় ভাইকে নিয়ে ইংল্যান্ডে গেলাম ডেমিয়েন থর্নকে ধ্বংস করতে।’ কটের নিচ দিয়ে একটা ড্যাগার বের করলেন তিনি। নিজের অজান্তে চেয়ারের সাথে সেঁটে গেল ওয়াল্টার। ঝলমল করছে ইস্পাত, ড্যাগারের বাঁটে অসম্ভব সুন্দর শিল্পকর্ম। এটা সেই ড্যাগার। এই পাগল সন্ন্যাসী যা বলছে তাহলে কি তা সব সত্যি? ভাবল সে।
‘আপনি একজন প্রীস্ট হয়ে মানুষ খুন করতে যাচ্ছিলেন?’ অবিশ্বাস ওয়াল্টারের কণ্ঠে।
‘সে মানুষ, ছিল না,’ স্বাভাবিক গলায় বললেন ডি কার্লো। সে ছিল অ্যান্টিক্রাইস্ট-যীশুর শত্রু।’
মুচকি হাসল ওয়াল্টার। ডি কার্লো ওর মুখের সামনে ড্যাগারটা তুলে ধরলেন। ‘জানি, ব্যাপারটা মেনে নিতে আপনার মন সায় দিচ্ছে না,’ বললেন তিনি। ‘যদিও আপনি একজন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ। রবার্ট থর্নও মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হন তিনি। কেট রেনল্ডস নামে একটি মেয়েও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে চায়নি। পরে সে-ই এই ড্যাগার ডেমিয়েন থর্নের পিঠে ঢুকিয়ে দেয়।’ ড্যাগারটা ফেলে দিলেন ওয়াল্টারের কোলে। সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল যীশুর মুখের দিকে।
‘ভেবেছিলাম আমরা সফল হয়েছি, তাকে ধ্বংস করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের ধারণা ছিল ভুল।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডি কার্লো, শুয়ে পড়লেন কটে।
ওয়াল্টার ফলায় আঙুল ছোঁয়াল। ইচ্ছে করছে চলে যায়। কিন্তু উঠে দাঁড়াবার শক্তি পাচ্ছে না।
‘বুক অভ রেভেলেশনের কথা তো জানেনই,’ বললেন প্রীস্ট।
মাথা ঝাঁকাল ওয়াল্টার।
‘ওখানে এক জায়গায় আছে,’ বললেন ডি কার্লো। ‘ “এবং ওটা তাহাকে দেয়া হইল সন্ন্যাসীদের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্যে, জেতার জন্যে। এবং শক্তি দেয়া হইল তাকে, তাহার সকল আত্মীয়স্বজন, এবং জিভ এবং জাতিকে।” বিরতি দিলেন প্রীস্ট। “শক্তি দেওয়া হইল তাকে।’” পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। ‘আর পৃথিবীতে থর্ন কর্পোরেশনের চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই।’
ওয়াল্টার বলল, ‘বাইবেলকে আপনি যেভাবে খুশি ব্যাখ্যা করতে পারেন।’
‘অ্যান্টিক্রাইস্টের শিষ্যরাও নিজেদের মত ব্যাখ্যা দিয়েছে,’ বললেন ডি কার্লো। ‘ট্যাসোন নামে এক লোক ছিল। পৈশাচিক জন্মে সে সাহায্য করেছিল। পরে অনুতপ্ত হয়ে সে রবার্ট থর্নের কাছে যায়। বলে শয়তানকে ধ্বংস করার সময় উপস্থিত।’ বিরতি দিলেন তিনি। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘বাইবেলের ব্যাখ্যা সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবগত আছেন আপনি। জানেন, শেষের সেদিনে যীশু আবার জন্ম নেবেন এবং মুখোমুখি হবেন অ্যান্টিক্রাইস্টের। আর আরমাগেড্ডনের লড়াই হবে ইসরাইলে।’
জবাবে মাথা দোলাল ওয়াল্টার।
‘তিনি আবার জেগে উঠেছেন। আমি তাঁকে দেখেছি।’
ওয়াল্টার কপাল চেপে ধরল হাত দিয়ে। উঠে পড়বে কিনা ভাবছে, কিন্তু বসে রইল মন্ত্রমুগ্ধের মত। ‘থর্ন তার শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিল যীশুর পুনর্জন্মের দিন যে সব পুরুষ শিশু জন্মগ্রহণ করবে তাদের সবাইকে মেরে ফেলতে। শতশত শিশু হত্যা করা হয়। কিন্তু শিশু যীশুর কোন ক্ষতি হয়নি।’
চোখ ঘষছে ওয়াল্টার, প্রীস্ট ওর গায়ে হাত রাখলেন। ‘বুঝতে পারছি,’ বললেন তিনি। ‘এ ব্যাপারগুলো হজম করা কঠিন, বিশেষ করে আপনার মত মানুষের জন্যে যাঁর সারাদিন কেটে যায় লাইব্রেরীতে। তবু অনুরোধ, আমার কথা শুনে যান।’
বিছানার পাশে একটা শেলফ, ওখান থেকে দুটো খাম বের করলেন ডি কার্লো, একটা দিলেন ওয়াল্টারের হাতে।
‘এই চিঠিখানা আগে পড়ন। অসুস্থ অবস্থায় এক সাহসী মহিলা লিখেছে ওটা। পড়ন এবং কথাগুলো বিশ্বাস করুন।’
প্রেরকের ঠিকানা উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের। ওয়াল্টার চিঠির শেষ পাতা উল্টে সই দেখল। নামটা অচেনা।
‘পড়ুন,’ নির্দেশের মত শোনাল ডি কার্লোর কণ্ঠ।
পড়তে শুরু করল নিকোলাস ওয়াল্টার:
আগামী হপ্তায়, ফাদার, আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হবে পেটের একটা অপারেশনের জন্যে। আমাকে বলা হয়েছে সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং যন্ত্রণাদায়ক হবে। তবে কথাটা বিশ্বাস করিনি আমি। মনে হয় না আমি আর বাঁচব। আমাকে তো আপনি চেনেনই, ফাদার। ভয়ঙ্কর ঘটনাটাও একমাত্র আপনিই জানেন। তাই আপনাকে বিশ্বাস করে লিখছি।
আপনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করার কয়েক হপ্তা পর যন্ত্রণাটা শুরু হয়ে যায়। প্রথমে ব্যাপারটাকে পাত্তা দিইনি। তারপর লক্ষ করলাম পেটটা ফুলতে শুরু করেছে। আমার ডাক্তার আমাকে এক স্পেশালিস্টের কাছে পাঠালেন। তিনি ফোলাটা বাড়ার সাথে নিয়মিত নানা পরীক্ষা করে যেতে লাগলেন। ‘ক্যান্সার’ শব্দটা তিনি উচ্চারণ করেননি T এখনও শব্দটা আমাদের কাছে অচ্ছুৎ কিনা। তিনি শুধু মাঝে মাঝে ‘ফোলা’ নিয়ে কথা বলতেন আর এক্স-রে রিপোর্ট দেখাতেন।
তবে ‘ফোলা’টা যে টিউমার নয় সে আমি জানি। আর এক্স-রেগুলো যে অন্য লোকের তাতেও আমার সন্দেহ নেই। ফাদার, কি বলব, হারামজাদা ফোলাটা আমাকে লাথি মারে। এটা যদি দুঃস্বপ্ন হয় তাহলে বলব আমি জীবন্ত দুঃস্বপ্ন দেখে চলেছি।
আমি জানি না ক্লিনিক থেকে বেরুতে পারব কিনা। যদি না পারি তাই আগেভাগে চিঠিটা লিখে রাখলাম। ধরে নিন এটা আমার স্বীকারোক্তির বিকল্প। তবে আমার মৃত্যুর আগে এ লেখা পড়তে পারবেন না।
আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই, তাই ডেমিয়েন সম্পর্কে আপনার তথাকথিত প্রমাণ আমাকে বিচলিত করতে পারেনি। ব্যাপারটা এখনও মেনে নিতে পারিনি আমি। ডেমিয়েন আমার কাছে আমার সন্তানের হত্যাকারী ছাড়া কিছু নয়। ও আমার ছেলে পিটারকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তাই ওকেও আমি খুন করেছি। পিটারের পিঠে বেঁধা ছুরিটা হ্যাঁচকা টানে বের করার সেই অশ্লীল শব্দটা এখনও আমার কানে বাজে। দেখতে পাই ডেমিয়েনের শিরদাঁড়ায় ছুরি ঢুকিয়ে দেয়ার সেই দৃশ্যও।
ডেমিয়েন আপনার কাছে অ্যান্টিক্রাইস্ট। আমার কাছে আকর্ষণীয় একজন পুরুষ, যার শরীরে ছিল এক অদ্ভুত জন্মদাগ-এর বেশি কিছু নয়।
যাহোক, মাঝে মাঝে রাতের বেলা যখন ওসব কথা মনে পড়ে যায় সেই সময় আমার শরীরের ভেতরে এই শয়তানটা আমাকে…থাক, এ নিয়ে আর কথা বাড়াব না। আমাকে আর ক’দিনের মধ্যে ক্লিনিকে যেতে হবে। আমার জন্যে প্রার্থনা করবেন, ফাদার। আপনার প্রার্থনায় আমার কোন ক্ষতি হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।’
পড়া শেষ করল ওয়াল্টার। মাথা নেড়ে বলল, ‘বেচারী। ক্যান্সারের প্রতিষেধক কি কোনদিন তৈরি হবে না?’
‘ওটা ক্যান্সার ছিল না।’
ওয়াল্টার বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল প্রীস্টের দিকে।
‘মেয়েটা ছিল ডেমিয়েন থর্নের শেষ শিকার। আমার ধারণা, সে ডেমিয়েনের সন্তানের জন্ম দিয়েছে।’ দ্বিতীয় চিঠিটা ওয়াল্টারকে দিলেন ডি কার্লো।
কোন কথা না বলে চিঠি পড়তে লাগল ওয়াল্টার: ‘ক্ষমা করুন, ফাদার, যে পাপ আমি করেছি…’
পড়া শেষ হলে ডি কার্লোর দিকে আবার তাকাল সে। চেহারা থেকে সমস্ত রং মুছে গেছে।
‘এ অবিশ্বাস্য,’ বলল ওয়াল্টার।
‘মহিলা মিথ্যা বলবে কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন ডি কার্লো।
‘এ পাগলের প্রলাপ।
‘ভুল। মহিলা এক বর্ণ মিথ্যা কথা লেখেনি।’
ওয়াল্টার কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন ডি কার্লো। ‘সেই ভয়ঙ্কর রাতে আমি আর কেট রেনল্ডস তার সন্তানকে কবর দিই। ডেমিয়েনের লাশ ফেলে চলে আসি। ড্যাগারটা নিয়ে এসেছিলাম সাথে। স্বপ্ন দেখেছিলাম নতুন প্রভাতের। কিন্তু ভুল স্বপ্ন দেখেছিলাম। শয়তানের শিষ্যরা ডেমিয়েনের লাশ খুঁজে বের করে। রটিয়ে দেয় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে। ওদের নিজেদের ডাক্তারের এ ব্যাপারে সায় ছিল। শিকাগোতে, ওদের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয় লাশ।’
‘জানি,’ বলল ওয়াল্টার। ‘টিভিতে দেখেছি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন ডি কার্লো। ‘আমরা শুধু অ্যান্টিক্রাইস্টের শরীরটাই ধ্বংস করতে পেরেছি। তার আত্মা বা শক্তির কোন ক্ষতি হয়নি, তার ছেলে হয়ে উঠেছে আরেক ডেমিয়েন।’ চোখ বুজলেন তিনি, ফিসফিসে শোনাল কণ্ঠ। ‘আমি ব্যর্থ হয়েছি, আমার ভাইদের মৃত্যু বিফলে গেছে। গত মাসে এই চিঠি পাবার পর নতুন করে ব্যাপারটা উপলব্ধি করে ভীষণ হতাশ হয়ে উঠি। বুঝতে পারি আমাদের গলদ কোথায় ছিল। অজ্ঞতাই আমাদের ডুবিয়েছে।’
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ওয়াল্টার, হাঁটু কাঁপছে, মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে হঠাৎই যেন খুব বুড়িয়ে গেছে সে।
চোখ মেললেন ডি কার্লো। ‘আপনাকে যা বললাম সব লিখে রেখেছি। আমার নোট আর চিঠিগুলো নিয়ে যান। লন্ডনে গিয়ে আমেরিকান অ্যামব্যাসাডরের সাথে দেখা করুন। উনি আপনাকে সাহায্য করবেন।’
‘কেন?’ জিজ্ঞেস করল ওয়াল্টার। ‘তিনি সাহায্য করবেন কেন?’
‘তিনি সৎ মানুষ। তাঁর ক্ষমতা এবং প্রভাব আছে। উনি যা করতে পারবেন আপনার পক্ষে তা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাছাড়া রাষ্ট্রদূতের বয়স কম। আমরা তো বুড়িয়ে গেছি। ইচ্ছে থাকলেও আর…’ হাসলেন ডি কার্লো, হঠাৎ উঠে বসলেন, টেনে নিলেন বাইবেল।
‘আমাকে কথা দিন,’ বললেন তিনি।
ওয়াল্টার কথা বলার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু কোন শব্দ বেরুল না। ডি কার্লো ওয় হাতটা ধরে বাইবেলের ওপর রাখলেন।
‘ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে কথা দিন।’
মাথা দোলাল ওয়াল্টার। ‘কথা দিলাম।‘
‘তাহলে আসুন প্রার্থনা করি।’
দু’জনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করলেন। ল্যাটিন ভাষায় প্রার্থনা করলেন ডি কার্লো। তারপর সিধে হলেন। ওয়াল্টারের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘অ্যামবাসাডরের পিছু ছাড়বেন না। উনি প্রস্তুত হলে ড্যাগারটা পাঠিয়ে দেব।’ হাসি ফুটল তাঁর মুখে। ‘পুনর্জন্ম নেয়া যীশু আপনাকে পথ দেখাবেন। তাঁকে বিশ্বাস করুন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন। পৃথিবীতে আবার আগমন ঘটেছে তাঁর। আমি জানি। আমি তাঁকে দেখেছি।’
ওয়াল্টার নোট আর চিঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওর শরীর কাঁপছে। মঠ থেকে দূরে সরে আসার পর কাঁপুনিটা থেমে গেল আর সেই সাথে মনের ভেতর জেগে উঠল রাজ্যের সন্দেহ।