দুই
নিজের স্যুইটে বসে নাস্তা সারার পর খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছে পল বুহের, এমনসময় বেজে উঠল ইন্টারকম।
‘অ্যামব্যাসাডর এসেছেন, স্যার।’
‘ওঁকে আসতে বলো,’ বলল বুহের।
প্রায় সাথে সাথে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল ইউএস অ্যামব্যাসাডর ফ্রেডরিক আর্থার। মধ্য পঁয়তাল্লিশ চলছে তার, দীর্ঘদেহী, গায়ের রঙ গাঢ়, ঠোঁটে ফুটে আছে একটুকরো বাঁকা ছেলেমানুষী হাসি। এই হাসি নারী-পুরুষ উভয়কে আকর্ষণ করে, সেইসাথে কূটনৈতিক নানা সমস্যার সমাধানও করে সে বাঁকা হাসি হেসে।
হ্যান্ডশেক করল ওরা, বুহের কফির কাপ ধরিয়ে দিল অ্যামবাসাডরের হাতে। টিভি চলছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে আর্থার বলল, ‘স্টিভেনসনের বক্তৃতা শুনেছেন? নতুন কিছু বলেছেন?’
রবার্ট স্টিভেনসন ফরেন সেক্রেটারি। খানিক আগে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন টিভিতে।
‘সেই গৎ বাঁধা বুলি,’ কাঁধ ঝাঁকাল বুহের।
‘মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাটা গৎ বাঁধাই,’ মন্তব্য করল মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
তারপর দু’জনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠল। মিনিট বিশেক পর আর্থার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল এবার তাকে উঠতে হবে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আবার হাত মেলাল ওরা।
‘লন্ডনে লম্বা সময়ের জন্যে এসেছেন?’ জিজ্ঞেস করল আর্থার।
‘নাহ্। স্রেফ ফ্লাইং ভিজিট। দেখতে এসেছি কর্মচারীরা কেমন কাজকর্ম করছে। শুক্রবার চলে যাব। ভাল কথা, শুনলাম সিনেটে দাঁড়াবার পরিকল্পনা করেছ।’
হাসল আর্থার। ‘এ ব্যাপারটা তো কারও জানার কথা নয়।’
‘ঠাট্টা রাখো। কাজটা ভালই করছ তুমি। হোয়াইট হাউজে যাবার সমস্ত যোগ্যতাই তোমার আছে।’
জবাবে সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল আর্থার। সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা তার রয়েছে।
‘ক্যাম্পেইনের জন্যে টাকা দরকার,’ বলল বুহের। ‘আর থর্ন কর্পোরেশনের টাকার অভাব নেই।’
‘জেনে খুশি হলাম, পল। তবে ব্যাপারটা স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে না? আমি ডেমোক্রাট। আর প্রেসিডেন্ট, যাঁকে আপনি সমর্থন দিচ্ছেন, তিনি রিপাবলিকান।’
‘প্রেসিডেন্ট দুর্বল মানুষ, বলল বুহের। ‘আশা করা হয়েছিল তিনি তাঁর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবেন।’
‘এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব হলো না।’
হাসল বুহের। ‘ওটা প্রশ্ন ছিল নাকি?’
দরজা খুলল আর্থার, পা রাখল চৌকাঠে।
‘কফির জন্যে ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে।’
আর্থার চলে যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে রইল বুহের। তারপর বন্ধ করল দরজা। আর্থার বেশ অদ্ভুত, অত্যন্ত চতুর একজন ডিপ্লোম্যাট, তার কোন শত্রু নেই, মানুষ হিসেবেও খুব সৎ। তবে তার সততা কখনও কখনও পাগলামির পর্যায়ে পৌছে যায়। এ ধরনের লোকদের নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তবে আর্থারের ব্যাপারে যাবতীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আগে করে রেখেছে পল বুহের। সে আর আর্থারকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইল না। ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে।
.
সবে সন্ধে নেমেছে। অক্সফোর্ড রোডের দিকে ছুটে চলেছে পল বুহেরের বিলাসবহুল লিমোজিন। সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে বুহের। ঝিমুচ্ছে। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ক্লান্ত লাগছে। কাজের যত চাপই থাক, তিন/চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিলেই সে চাঙা হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ইদানীং একটু সমস্যা হচ্ছে মনে হচ্ছে। ডাক্তার দেখানো দরকার। ঝিমুতে ঝিমুতে নিজের জন্মদিনের কথা ভাবছিল পল বুহের। মনে পড়ছে বাবা বলত: ‘১৯৫০ সালের জুন মাসে তুমি কুড়িতে পা দেবে। আশা করব ততদিনে নিজস্ব স্বকীয়তা অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর ১৯৭০ সালের জুনের মধ্যে তোমাকে অর্জন করতে হবে অনেক অনেক কিছু।’
বাবার আশা পূরণ করেছে বুহের। থর্ন কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট যে সে-ই হতে যাচ্ছে এটা সূর্য পুব দিকে ওঠার মতই নিশ্চিত ছিল। সবাই চমৎকার পরিকল্পনা মাফিক চলছিল। মাঝখানে থর্ন রাজ্যের শেষ বংশধর ডেমিয়েন থর্নের আকস্মিক মৃত্যু তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। ডেমিয়েনের মৃত্যুর পরে আঠারো বছর চলে গেছে। এখনও তার মৃত্যুর কথা মনে পড়লে শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে।
ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠে চোখ মেলল বুহের, দেখল রিয়ার ভিউমিরর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে ড্রাইভার। বুহের পকেট হাতড়ে ভিটামিন বড়ির শিশিটা বের করল, এক সাথে কয়েকটা মুখে পুরল। পেটের মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। গুলিয়ে উঠতে চাইছে। এমন হয়। ছেলেটার সাথে দেখা করার সময় হলেই এমন পেট গোলাতে থাকে বুহেরের। আসলে টেনশনে এমনটা হচ্ছে। ছেলেটা সতেরোতে পা দিয়েছে, প্রাপ্ত বয়স্ক হতে চলেছে। শিষ্যরা বলেছে ছেলেটা নাকি লম্বা হয়েছে বেশ, গায়ে গতরে মাংসও লেগেছে।
ঢেকুর তুলল বুহের। পেট ব্যথাটাই তাকে মারবে। আর ছেলেটার সাথে দেখা হবার সময় হলেই পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায় তার। কোন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রতিপক্ষ এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে নিয়েও এতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয় পল বুহের। শুধু ছেলেটাই তার ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বুহের। পাকা রাস্তা ছেড়ে সরু, মেঠো পথ ধরেছে লিমোজিনের ড্রাইভার। রাস্তাটা পেরিফোর্ডের দিকে গেছে। তীক্ষ্ণ বাঁকগুলোতে সতর্কতার সাথে মোড় নিল ড্রাইভার। রাস্তার পাশে ঘন ঝোপ, খরগোশ দৌড়ে পালাচ্ছে, ঢুকে যাচ্ছে ঝোপের আড়ালে। উইন্ডশিল্ডে ধাক্কা খাচ্ছে উড়ন্ত পোকা, দু’একটা মরে আঠালো শরীর নিয়ে সেঁটে থাকল কাঁচে।
‘এসে গেছি, স্যার।’ ইন্টারকমে খড়খড় করে বেজে উঠল ড্রাইভারের গলা। গেটের বাইরে গাড়ি থামাল সে। ডেমিয়েনের মৃত্যুর পরে এখানে সিকিউরিটি সিস্টেম বসানো হয়েছে। জংধরা, বিশাল লোহার গেট বিদ্যুৎশক্তিতে খোলে, বন্ধ হয়। ড্রাইভার ড্যাশ বোর্ডের একটা বোতামে চাপ দিল, ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেল গেট। ড্রাইভওয়ের আধা মাইল দূরে বিশাল প্রাসাদটার পশ্চিম উইং দেখা যাচ্ছে। ওখানে বুহেরের জন্যে সবচে’ দামী ব্রান্ডি অপেক্ষা করছে, ড্রইংরুমের ফায়ার প্লেসে জ্বলছে আগুন। বুহের এবার একটু আরাম করতে পারবে।
কাঁকর বিছানো রাস্তা পার হয়ে লিমোজিন থেমে দাঁড়াল প্রাসাদের সামনে। বাটলার অপেক্ষা করছিল দোরগোড়ায়; বুহেরকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে গেল।
বুহের সোজা ঢুকল ড্রইংরুমে, একটা গ্লাসে মদ ঢেলে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে লাগল।
ঘরটা অত্যন্ত দামী আসবাবে সাজানো। ওক কাঠের প্যানেলে হাত বোলাল বুহের, মখমলের ভারী পর্দা টেনেটুনে দেখল, তারপর তাকাল পোর্ট্রেটগুলোর দিকে। রবার্ট থর্ন; তার ভাই, রিচার্ড; এবং ছেলে ডেমিয়েনের ছবি। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল বুহের। এগোল ফায়ার প্লেসের দিকে। বেশ গরম পড়েছে আজ, তবু ফায়ার প্লেসে কাঠ দাউ দাউ জ্বলছে। ওদিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বুহের। অপেক্ষা করছে।
খানিক পরে আবার এল বাটলার। ‘বিশ মিনিটের মধ্যে ডিনার রেডি হয়ে যাবে, স্যার।’
মাথা ঝাঁকাল বুহের। ‘কেমন আছে সে?’
‘ভাল আছেন, স্যার।’
‘ওর সঙ্গে দেখা করা যাবে?’
‘চেষ্টা করে দেখতে পারেন, স্যার।’
বুহের আবার মাথা ঝাঁকাল, মদের গ্লাস হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হলঘর পার হয়ে, পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এল, তারপর একটা গ্যালারি ধরে ঢুকল অন্ধকার এক করিডরে। এটা বাড়ির পশ্চিম উইং-এ গিয়ে মিশেছে। বুহেরের বুকে ধুকধুকানি শুরু হয়ে গেছে, পেটটা আবার মোচড় দিয়ে উঠল। ছেলেটার বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় মৃদু টোকা দিল বুহের, কান পাতল। ভেতরে কোন সাড়া নেই। আবার নক্ করল সে, তারপর দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
ঘরে সরু একটা বিছানা ছাড়া কিছু নেই, দেয়াল আর ছাদের রঙ গাঢ় তামাটে। সুইচ টিপে বাতি জ্বালানোর জন্যে হাত বাড়াল বুহের। অবাক হয়ে দেখল ঘরে কোন বাল্ব নেই। বিছানার দিকে এগিয়ে গেল সে, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কোলাজ করা কতগুলো নিউজপেপার ফটোগ্রাফের দিকে। পাশে দুটো বড়, বাঁধানো ছবিও আছে। একটা ডেমিয়েন থর্নের পোর্ট্রেট, তার মাথা আর কাঁধ দেখা যাচ্ছে শুধু। অন্যটা সমাধি স্তম্ভের ছবি। ঝোপঝাড়ে কবরের মাথায় লাগানো পাথরের টুকরোটা প্রায় ঢেকে গেছে। তবু কষ্ট করে পড়া যায়:
ক্যাথেলিন রেনল্ডস
প্রিয়তম কন্যা
১৯৪৯-১৯৮২
সশব্দে দম ফেলল পল বুহের, হাঁটু ভাঁজ করে বসল বিছানার পাশে, কোলাজটা দেখছে। ওয়ারশ ইহুদিদের দেখা যাচ্ছে ছবিতে, বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে, অসউইজ ক্যাম্পে পাঠানো হবে হতভাগ্য লোকগুলোকে। হিটলার, ইদি আমিন, মুসোলিনি, জোসেফ স্ট্যালিনের ছবিও আছে। হ্যারী ট্রুম্যান হাসছেন, হিরোশিমা ধ্বংস হয়েছে, ধোঁয়ার মধ্যে তাঁর মুখ। কোলাজে সিগার মুখে চার্চিল আছেন। আছেন হেনরী কিসিঞ্জার, এমনকি পলপটও। পলপট অসংখ্য খুলি আর হাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন।
কোলাজের ওপর লাল কালিতে, বড় বড় অক্ষরে লেখা:
পুনরাবৃত্তি চাই
হঠাৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল বুহেরের, দ্রুত এক ঢোক ব্রান্ডি গিলে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। বাইরে এসে স্বস্তি অনুভব করল।
প্রাসাদের পশ্চিমাংশের আরও ভেতরে ঢুকে গেল বুহের দ্বিতীয় করিডর দিয়ে। ঠিক তখন বোটকা গন্ধটা ঝাপটা মারল নাকে। এক সেকেন্ড পরে ওটাকে দেখতে পেল সে। করিডরের শেষ মাথায় বসে আছে বিশাল আকারের জানোয়ারটা। ওটার হলুদ চোখ যেন আগুনের গোলা, জ্বলছে ধকধক করে। প্রকাণ্ড মাথাটা তুলল সে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, নিঃশব্দে এগিয়ে এল বুহেরের দিকে, প্রকাণ্ড দেহী, বিরাট চোয়াল, ঘাড় আর কাঁধের পেশীতে যেন জমাট বেঁধে আছে সমস্ত শক্তি। ওটার নিশ্বাসে বিকট গন্ধ। থেমে দাঁড়াল প্রাণীটা, তাকাল বুহেরের দিকে, মাথাটা বুহেরের পেটের সমান উচ্চতায় পৌঁছেছে। এক মুহূর্ত মানুষ এবং কুকুর পরস্পরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, নাক উঁচু করে টেনে নিল বাতাস, মাথা দোলাল, যেন গন্ধ চেনার চেষ্টা করছে, তারপর গলা দিয়ে ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরিয়ে এল ওটার, সরে দাঁড়াল একপাশে, প্রহরী যাবার অনুমতি দিচ্ছে।
করিডরের শেষে, কালো একটা দরজার দিকে নিঃশব্দে পা বাড়াল বুহের, নক করার জন্যে হাত তুলল, তারপর কি ভেবে আস্তে ধাক্কা মেরে খুলে ফেলল দরজা।
ঘরটা গোল, কালো রঙ করা, ছয়টা স্তম্ভের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ছাদ। ঘরে কোন জানালা নেই, একটা বেদীর ওপর রাখা একটি কালো মোমবাতি কোনমতে দূর করেছে আঁধার।
মোমবাতির কাঁপা আলো গিয়ে পড়ছে কাঠের তৈরি যীশুর লাইফ-সাইজ প্রতিমূর্তির ওপর। একটা ক্রুশের গায়ে দাঁড় করানো যীশুর সারা গায়ে পেরেক বসানো, নগ্ন। শিরদাঁড়ায় আমূল ঢুকে আছে একটা ড্যাগার। ড্যাগারের বাঁটে যীশুর ছবি খোদাই করা।
ক্রুশ থেকে ছয় ফুট দূরে একটা মমি করা লাশ। এই লাশের গায়েও কাপড়- চোপড়ের বালাই নেই, শুধু একটা ইস্পাতের ফ্রেমের অবলম্বন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার হাত দুটো সামনের দিকে বাড়ানো, তালু ছড়ানো। মোমের আলো নাচছে তার খোলা চোখে, মনে হচ্ছে জ্যান্ত। মুখে ভয়ঙ্কর, বিকৃত এক টুকরো হাসি ফুটে আছে তার, যেন ক্রুশবিদ্ধ যীশুর যন্ত্রণাকাতর চেহারা দেখে মজা পাচ্ছে।
লাশের পায়ের কাছে বসা কালো আলখেল্লা পরা এক তরুণ, লাশের হাত চেপে ধরে আছে এত জোরে যে তার আঙুলের গাঁটগুলো সাদা হয়ে গেছে।
মৃদু, নিচু গলায় সে প্রার্থনা করে চলেছে। বুহের শুনতে পেল তার আর্তি
‘বাবা, আমাকে শক্তি দাও, তোমার সমস্ত বল আমার মধ্যে সঞ্চার করো। আমাকে শক্তি দাও হে মহান পিতা…’
একটানা, একভাবে প্রার্থনা করেই যেতে লাগল সে। সামান্য সময়ের জন্যেও বিরতি দিল না, দম যেন নিচ্ছেই না। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল বুহের, তারপর চাইল ডেমিয়েন থর্নের মরা মুখের দিকে। তারপর, যেন সহজাত প্রবৃত্তিতে ক্রুশের বিপরীত চিহ্ন আঁকল সে বুকে, পিছিয়ে এল, নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল দরজা।
কুকুরটা ঠাণ্ডা চোখে তাকে দেখল, কান পেতে শুনল বুহেরের ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসা পায়ের শব্দ, শেষে আবার গার্ড নিয়ে বসল সে, কান দুটো সেঁটে আছে মাথার পেছনে, গভীর মনোযোগে শুনতে লাগল ছেলেটার প্রার্থনার গুনগুন শব্দ।
.
ছেলেটির জন্যে ডাইনিংরুমে অপেক্ষা করছে বুহের। মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে, শূন্য দৃষ্টি টেলিভিশন পর্দায়, দেখছে না কিছুই। হঠাৎ মুখ তুলে দেখল ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। পরনে শার্ট আর জিনস। শিষ্যরা ঠিকই বলেছে অনেক বড় হয়ে গেছে সে। এখনই লম্বায় তার মৃত বাবার মত, চেহারায় মিলও রয়েছে অনেক। ‘আপনাকে ক্লান্ত লাগছে,’ বলল ছেলেটা। গলার স্বর জোরাল, গভীর।
‘ও কিছু না,’ জবাব দিল বুহের। ‘বয়স হয়েছে না।’
‘নারী সঙ্গ বর্জন করা উচিত আপনার।’
হাসল বুহের। ‘আগে ব্যাপারটা উত্তেজিত করে তুলত আমাকে। এখন আর করে না।’
ছেলেটা বসল। প্রায় সাথে সাথে জর্জ হাজির হয়ে গেল ডিনার ট্রলি নিয়ে।
‘রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন?’ বাটলারের দিকে ফিরেও তাকাল না সে।
মাথা ঝাঁকাল বুহের, পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে ছেলেটার হাতে দিল। এক নিঃশ্বাসে রিপোর্টটা পড়ে ফেলল সে। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বুহেরের দিকে।
‘লিবিয়ানরা আশা করে ডি ফল্ট হবে না। হবে কি?’
মাথা নাড়ল বুহের। ‘ওদের সব কটার লেজ বেঁধে দিয়েছি এক সুতো দিয়ে। কোথাও আর যাবার জায়গা নেই।’ ছেলেটা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা দোলাল, কাগজের তাড়াটা ভাঁজ করে ফিরিয়ে দিল বুহেরকে।
‘বেশ। তাহলে সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছে?’ প্রশ্ন করল সে।
‘ব্রিটিশরা জেরুজালেমে নিজেদের ক্যাম্প ডেভিডকে সুসংহত করতে চাইছে। কিন্তু কাজ হবে না।’
‘বেশ,’ কোলে ন্যাপকিন বিছাল ছেলেটা, তারপর খাওয়া শুরু করল।
খাওয়ার সময় তেমন কথা হলো না ওদের মধ্যে। ছেলেটা ক্ষুধার্তের মত খাচ্ছে, চুমুক দিয়ে সাবাড় করছে ওয়াইন, দ্রুত চোয়াল নড়ছে তার, মাঝেমধ্যে মুখে খাবার নিয়েই নানা প্রশ্ন করে গেল সে বুহেরকে।
‘শুনলাম ইহুদ বারাক নেসেট নিয়ে সমস্যায় পড়েছে…’
‘ব্রাডলি হোয়াইট হাউজ চালাচ্ছেন কেমন?’
‘জিম্বাবুয়েতে কবে ক্যু হবে?’
বুহের তার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেল ধৈর্যের সাথে। ছেলেটা হয়েছে তার বাপের মতই, তবে ডেমিয়েন থর্নের আকর্ষণ করার শক্তি নেই ওর মধ্যে। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই মোহিনী জাদুও এসে যাবে।
ডিনার শেষে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে দু’জনে, বাটলার এসে এক টুকরো কাগজ দিল বুহেরকে, ছেলেটার দিকে ফিরে বলল:
‘সেই বুড়ি আবার এসেছে, স্যার।’
হাই তুলল ছেলেটা, বুহের তাকাল চিরকুটের দিকে। ‘মহিলা বলছে সে নাকি তোমার দাইমা ছিল,’ বলল বুহের।
কাঁধ ঝাঁকাল বাটলার। ‘গত এক হপ্তা ধরে মহিলা এখানে ঘুর ঘুর করছে, স্যার।’
বুহের ছেলেটার দিকে চাইল। ‘তোমার কাছ থেকে শেষ আশীর্বাদটুকু পেতে চায় সে।’
আবার হাই তুলল ছেলেটা।
বুহের কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারল ফায়ার প্লেসে। ‘ওকে আসতে বলো,’ বলল সে। ‘তবে নিশ্চিত হয়ে নিও এই মহিলা সে-ই মহিলাই কিনা।’
‘জ্বী, স্যার।’
‘ব্রাডলির ব্যাপারে আপনি শিওর তো?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল বুহের। ছেলেটা বড্ড একগুঁয়ে আর ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝে না। বাইরের কোন ব্যাপারে তার আগ্রহ নেই। বিশেষ করে এ বয়সের ছেলেরা যেসব কাজ করে আনন্দ পায়। তবে এটাও অস্বীকার করার জো নেই সে অন্য দশটা ছেলের মত সাধারণ নয়।
দরজাটা আবার খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল লোলচর্ম এক বৃদ্ধা। হুইল চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসা, পা ঢাকা কম্বলে, কাঁধে শাল। হাত দুটো কোঁচকানো, আঙুলগুলো যেন আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে পরস্পরের সাথে। বুড়ির ওজন টেনেটুনে আশি পাউন্ড হবে। চেয়ারের একটা বোতাম টিপল সে, হিসিয়ে উঠল মোটর, টায়ারের শব্দ তুলে হুইল চেয়ার এগিয়ে আসতে লাগল বুহেরদের দিকে। টেবিলের ধারে এসে থেমে গেল বৃদ্ধা, স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। হাত বাড়িয়ে ক্রাচ তুলে নিল সে, আস্তে আস্তে সিধে হলো। বুড়িকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে যাচ্ছিল বুহের, মানা করল সে।
‘পারব আমি,’ ভাঙা, ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল বৃদ্ধা। ওঠার সময় তার গায়ের হাড় ফুটল মটমট করে, সোজা হয়ে দাঁড়াবার পরে দেখা গেল প্রায় ছেলেটার মতই লম্বা সে।
‘আমার নাম সিনথিয়া অ্যাবট,’ বলল সে। ‘আমি একজন নার্স। তোমাকে জন্মাতে দেখেছি আমি।’
ছেলেটা চুপ করে রইল। ‘তোমার যেদিন জন্ম হলো, সেদিন সন্ধ্যায় বাত রোগে আক্রান্ত হলো আমার হাত। তারপর থেকে সারা শরীরে যন্ত্রণা আমার। প্রচুর ওষুধ খেয়েছি। কাজ হয়নি কোন। বরং আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার ধারণা, ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন।
‘দিতেই পারেন,’ বলল ছেলেটা।
‘তীব্র এই যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না। আত্মহত্যা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখার বড় শখ ছিল আমার। দেখতে চেয়েছিলাম কাকে আমি পৃথিবীতে আনতে সাহায্য করেছি।’
ছেলেটা দু’হাত বাড়িয়ে দিল, উঁচু করল চিবুক।
‘আশা করি এখন খুশি হয়েছ।’ বলল সে।
‘আমাকে তোমার আশীর্বাদ দেবে না?’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, উঠে দাঁড়াল, মাথা নিচু করে তাকাল অত্যন্ত রোগা শরীরটার দিকে। হাত বাড়িয়ে বুড়ির কপাল ছুঁলো সে, চোখ বুজল বুড়ি। হঠাৎ কেঁপে উঠে চোখ মেলে চাইল।
‘আমি সবসময় দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। তোমার জন্মের সময় আমি হাজির ছিলাম আর তোমার বাবার জন্যে একটা শিশুকে হত্যা করেছি আমি।’
ছেলেটা চেপে ধরল বুড়ির মাথা, চেহারা কঠোর হয়ে উঠল, দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা। ‘ঈশ্বর পুত্রের পুনর্জন্মের দিন তোমার বাবা আমাদের বলেছিল ওই দিন যে সব শিশু জন্ম নেবে তাদের সবাইকে হত্যা করতে। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি এ আশায়-’
‘কি আশায়?’ রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তরুণ বুড়ির দিকে।
‘আশা করেছিলাম যীশু-পুত্রকে ধ্বংস করতে পারব।’
‘কিন্তু পারোনি,’ গর্জে উঠল ছেলেটা, পিছিয়ে এল এক পা, হাত মুছল শার্টে যেন ময়লা লেগেছে।
‘তোমরা ওকে মারতে পারোনি। তোমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছ। ঈশ্বরের পুত্র বেঁচে আছে এখনও। তার উপস্থিতি প্রতিদিন টের পাই আমি। প্রতি ঘণ্টায় তার শক্তি বেড়ে চলেছে। সে আছে সর্বত্র, অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।’ আরেক পা পিছিয়ে গেল সে, কথা বলার সময় থুথু ছিটল, বুড়ির মুখে লাগল। ‘তোমরা আমার বাবাকে বাঁচাতে পারোনি, আমাকেও পারবে না।’
নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল মহিলা, গাল বেয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে মুখে। হাতের চেটো দিয়ে পানি মুছছে, ছেলেটা এগিয়ে এল সামনে, রাগে চোখে আগুন জ্বলছে।
‘তুমি ভেবেছ তোমাকে ঈশ্বর ব্যথা দিচ্ছেন,’ বলল সে, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। ‘ভুল। তিনি মানবতাকে শাস্তি দেন, যেটাকে তিনি পাপ বলে মনে করেন। আমার বাবা কাউকে শাস্তি দেন না। ব্যর্থতা ছাড়া কাউকে তিনি শাস্তি দেননি। ব্যর্থতা ক্ষমা করতে পারেন না তিনি।’
হাহাকার করে উঠল বৃদ্ধা। ‘কিন্তু আমাকে যা যা করতে বলা হয়েছিল সবই আমি করেছি। আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। আমি আর কি…?’
ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটা। ‘চলে যাও তুমি। আর যেন কখনও না দেখি তোমাকে।’ পিছিয়ে গেল বুড়ি, বসে পড়ল হুইল চেয়ারে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘দয়া করে ক্ষমা করো।’
কিন্তু ছেলেটা বুড়ির দিকে ফিরেও চাইল না। বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। নীরবতা নেমে এল ঘরে। বুহের ছেলেটার দিকে তাকাল।
‘তোমার কি মনে হয় না…?’
বুহেরকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল ছেলেটা, ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল, গনগনে মুখ নিয়ে বেরিয়ে গেল ইনহন করে।