(ক) বিশ্বের সভ্যতাসমূহ
(খ) সভ্যতার ভারসাম্যের বদল
(গ) সভ্যতার প্রকাশমান বিন্যাস
(ঘ) সভ্যতার সংঘর্ষ
(ঙ) সভ্যতার ভবিষ্যৎ

অধ্যায় ৬ – বৈশ্বিক রাজনীতির সাংস্কৃতিক অবস্থান

অধ্যায় ৬ – বৈশ্বিক রাজনীতির সাংস্কৃতিক অবস্থান 

অনির্দিষ্ট গোষ্ঠীবদ্ধতা : পরিচায়নের রাজনীতি 

আধুনিকায়নের তাড়নায় বিশ্বরাজনীতির সাংস্কৃতিক অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র সমরূপ সংস্কৃতি নিয়ে একত্রিত হচ্ছে। আবার জনগণ এবং সেইসব দেশ যাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক একাত্মবোধ নেই তারা একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মতাদর্শ ও বৃহৎশক্তিকেন্দ্রিক চেতনা ও তার ভিত্তিতে একমত হওয়ার দিনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং এখন মানুষ সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার চেতনার দ্বারা তাড়িত হয়েই কেবল একত্রিত হচ্ছে। 

রাজনৈতিক পরিসীমা ক্রমাগতভাবে নৃগোষ্ঠীক, ধর্মীয় এবং সভ্যতা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক ধাঁচে পুনঃনির্ধারিত হচ্ছে। শীতলযুদ্ধের অচলায়তন সাংস্কৃতিক চেতনার দ্বারা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এবং বৈশ্বিক রাজনীতি সাংস্কৃতিক চেতনার দ্বারা সৃষ্ট ফাটলরেখার নিরিখে নিরূপিত হয়ে তা সংঘাতের কেন্দ্রীয় স্থানে অবস্থান নিচ্ছে। 

শীতলযুদ্ধ চলাকালীন একটি দেশ জোটনিরপেক্ষ থাকতে পারত। এমন অবস্থানে বেশকিছু দেশ ছিল কিংবা একটি দেশ তার জোটগত অবস্থানের বদল ঘটাতে পারত, এসব ঘটনা বহুবার ঘটেছে। ওইসব দেশের নেতারা তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, কিংবা তাদের ভারসাম্যগত সমীকরণে অথবা তাদের আদর্শগত বিবেচনায় এমন জোটগত অবস্থানের অদলবদল ঘটাতেন। শীতলযুদ্ধবিহীন নতুন বিশ্বে সাংস্কৃতিক পরিচয়ই সকল কিছুর নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে— এ দৃষ্টিতে শত্রু এবং মিত্র নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। একটি দেশ শীতলযুদ্ধ-সম্বলিত জোট এড়িয়ে চলতে পারলেও তার পক্ষে পরিচয়বিহীন থাকা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল : ‘আপনি কোন্ পক্ষের? এই প্রশ্নটি আরও বেশি মৌলিক প্রশ্ন, যেমন ‘আপনি কে?’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। প্রত্যেক দেশেরই এ প্রশ্নের উত্তর আছে। উত্তরটি কী হবে? উত্তর হল এই যে, যে- কোনো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ই সেই দেশের শত্রু-মিত্র ঠিক করে দেয় এবং বিশ্বরাজনীতিতে তার অবস্থানও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মাধ্যমেই নির্ণীত হয়ে থাকে। 

১৯৯০-এর দশক ছিল মূলত বিশ্বব্যাপী পরিচয়সংকটের ভয়াবহ দশক। প্রায় সর্বত্রই মানুষ প্রথম সাক্ষাতেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আমরা কে?’ ‘আমরা কোথায় অবস্থান করছি!’ ‘আমাদের সঙ্গে কে বা কারা আছে বা নেই।’ এই প্রশ্ন আসলে নানা কারণে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন, কেননা মানুষ নতুন জাতিরাষ্ট্র গড়তে চায়, কিন্তু তা করতে চায় অনেক ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ করে। যেমন প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ায় তেমনটি করতে চাওয়া হয়েছিল। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে তা সাধারণভাবেও ঘটে থাকে। 

১৯৯০-এর দশকে কোনো কোনো দেশে জাতীয় পরিচয়ের প্রসঙ্গটি একটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়ে উঠেছিল, যেমন : আলজেরিয়া, কানাডা, চীন, জার্মানি, ব্রিটেন, ভারত, ইরান, জাপান, মেক্সিকো, মরোক্কো, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিরিয়া, তুরস্ক, তিউনেশিয়া, ইউক্রেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রমুখ। জাতীয় পরিচয়ের ইস্যু সেইসকল দেশের জন্য ভয়াবহ, যে সকল দেশে জাতীয়তার প্রশ্নে রয়েছে নানাপ্রকার ফাটল, কার্যত বিভিন্ন সভ্যতা থেকে আগত মানুষজনের কারণে। 

পরিচয়ের প্রশ্নে যে বিষয়গুলো মানুষের নিকট মুখ্য বলে বিবেচিত হয়, তা হল : রক্তের সম্পর্ক ও বিশ্বাসাবলি, পারিবারিক চেতনা ও ধর্মীয় বিধানাবলি, ইত্যাদি। মানুষ তাদেরই আপন মনে করে যাদের সঙ্গে তাঁর নিজের পূর্বপুরুষ, ধর্ম, ভাষা, মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠানাদির মিল খুঁজে পায়। অন্যদিকে, যাদের সঙ্গে উল্লিখিত বিষয়গুলোর তফাৎ লক্ষ করে থাকে, সেখানে সে নিজেকে বা তার বিরুদ্ধ অথবা বিপরীতগোষ্ঠীকে পৃথক মনে করে থাকে। 

অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চিমাবিশ্বের অংশ, কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল, তারা পশ্চিমাবিশ্ব থেকে পৃথক ছিল এবং শীতলযুদ্ধের সময় নিশ্চুপ বা নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল। তারা এখন আবার তাদের সাংস্কৃতিক কুটুম্ব তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। প্রাক্তন ওয়ার্শো-চুক্তির অধীনস্থ দেশসমূহের মধ্যে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবং ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। তাদের পেছনের কাতারে রয়েছে বাল্টিক প্রজাতন্ত্রের দেশগুলো। ইউরোপীয় শক্তি একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চায় যে, তাদের নিকট কোনো মুসলমানদেশ প্রত্যাশিত নয়। অতএব তুরস্ক, বসনিয়াকে ইউনিয়নভুক্ত করতে তারা রাজি নয়। উত্তরের প্রান্তে সোভিয়েট ইউনিয়নের অবস্থান কার্যত বাল্টিক রিপাবলিকসমূহকে নিয়ে। সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড নতুন উদ্দীপনায় নতুন জোট গঠনের আগমনী বার্তার জন্য প্রস্তুত হয়। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী বারংবার বলতে থাকেন যে, বাল্টিক প্রজাতন্ত্রসমূহ সুইডেনের অংশবিশেষ এবং রাশিয়াকে সাবধান করে বলা হয় যে, রাশিয়া যদি উক্ত এলাকায় আগ্রাসন পরিচালনা করে তবে সুইডেন নিশ্চুপ থাকবে না। প্রায় অনুরূপ সম্পর্ক পুনঃনির্ধারণের কাজটি বলকান এলাকায় সংঘটিত হয়। শীতলযুদ্ধকালীন গ্রিস এবং তুরস্ক ছিল ন্যাটো-জোটের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু বুলগেরিয়া ও রুমানিয়া ছিল ওয়ার্শো-জোটের আওতাধীন অবস্থানে, আর আলবেনিয়া কখনও ছিল বিচ্ছিন্ন আবার কখনও কম্যুনিস্ট চীনের সঙ্গে তাল মিলাত। এই ধরনের জটিল জোটগত অবস্থানে, অর্থাৎ শীতলযুদ্ধাবস্থায় জোটসমূহ ইসলাম এবং অর্থোডক্স সভ্যতার মতো সত্তাদুটি আমলে নেয়নি। বলকান এলাকায় নেতৃত্বে গ্রিস, সার্ব এবং বুলগেরীয়দের মধ্যে অর্থোডক্স জোটকে স্বচ্ছ করতে উদ্গ্রীব ছিল। ‘বলকানযুদ্ধ’ সম্পর্কে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন যে, ‘…উপরিভাবে এসেছিল অর্থোডক্স সম্পর্কের শেষ আশ্রয় হিসেবে এটি ছিল একটি অঙ্গীকার বিশেষ এটি ছিল নিষ্ক্রিয়, তবে বলকান এলাকার জাগরণের নিকট তা হয়ে ওঠে একটি আসল বিষয়বস্তু।’ 

একটি অতিচঞ্চল বা অস্থির বিশ্বে, মানুষ প্রতিনিয়ত আত্মপরিচয় ও নিরাপত্তা চায়। মানুষ চায় তার আদি বা মূলধারা কী তা জানতে। এই ধারণারই প্রতিধ্বনি আমরা সার্বিয়ার বিরোধীদলের নেতৃত্বের কণ্ঠে শুনতে পাই, যখন তারা বলেন : ‘…দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের দিকে দেখলে দেখা যায়, তারা শীঘ্রই অর্থোডক্স বিশ্বাসের ভিত্তিতে বলকান এলাকার জোট প্রত্যক্ষ করতে চায়। আর এরা হল সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং গ্রিস। তারা তা করতে চায় ইসলামকে প্রতিরোধ করার অভিপ্রায়ে।’ 

অর্থোডক্স সার্বিয়া ও রুমানিয়া একত্রে তাদের উভয়ের জন্য সমরূপ এমন সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে ও ক্যাথলিক হাঙ্গেরির সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে জোটবদ্ধ হয়। সোভিয়েটের পক্ষ থেকে হুমকি না-থাকার প্রেক্ষাপটে গ্রিস এবং তুরস্কের মধ্যেকার ‘কৃত্রিম’ চুক্তি অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা আজিয়ান সাগর, সাইপ্রাস, তাদের মধ্যে সামরিক শক্তির ভারসাম্য, ন্যাটো-জোটের ভূমিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কার কী ভূমিকা হবে তা নিয়ে উক্ত দেশের মধ্যে সংঘাত ও সংকট মোটামুটি অনড় অবস্থানেই রয়েছে। তুরস্ক সবসময়ই বলকান এলাকার মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় তৎপর এবং বসনিয়াকে তারা সদাসর্বদা সমর্থন জুগিয়েছে। প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ায় রাশিয়া অর্থোডক্স সার্বিয়ার পক্ষে ছিল। জার্মানি ক্যাথলিক ক্রোয়েটদের রক্ষা করতে চেয়েছে, মুসলমানদেশগুলো বসনিয়ার সরকারকে সমর্থন দেয়। সার্বরা ক্রোয়েটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল, তাছাড়া তারা বসনিয়া ও আলবেনিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। মোটের ওপর, বলকান এলাকা পুনরায় ‘বলকানাইজড’ হয়ে যায়, আর তা হয় কার্যত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। দেখা যায়, এখানে ‘দুটো ক্ষুরধার অস্ত্র পরস্পর মুখোমুখি হয়ে যায়। একদিকে থাকে বেলগ্রেড/এথেন্স ‘ক্ষুর’, অন্যদিকে থাকে আলবেনিয়া/তুরস্ক জোটের ‘ক্ষুর’। 

ইতোমধ্যে প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের বেলারুশ, মালদোভা এবং ইউক্রেন রাশিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে আরমেনিয়া ও এজারিশ পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। রাশিয়া এবং তুরস্ক নিজ নিজ জ্ঞাতিগোষ্ঠীকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে, এভাবে সেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বজায় রয়েছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনী কাজাকিস্তান ও চেচনিয়ার মুসলমান মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত মুসলমান প্রজাতন্ত্রসমূহ নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করে চলছে এবং তাদের প্রতিবেশী মুসলমানরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক, ইরান এবং সৌদিআরব নতুন মুসলিম রিপাবলিকসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়া ও সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে কাশ্মীর-ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অনবরত সংঘাত ঘটে যাচ্ছে। তারা একে অপরের সঙ্গে সামরিক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখছে, আর ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমান এবং হিন্দু-উত্থান আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

পূর্বএশিয়ার ৬টি ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাছাড়া তাদের মধ্যে সীমান্ত-সংক্রান্ত বিরোধও তুঙ্গে উঠেছে। চীন, তাইওয়ান, হংকং ও সিঙ্গাপুর এবং বিদেশে বসবাসরত চীনারা ক্রমাগত ‘নিজত্বের’ প্রতি ঝুঁকে পড়ছে, আর সেইসঙ্গে আপন শেকড় তথা নিজ ভূমির প্রতি দুর্বল হচ্ছে। দুই কোরিয়া দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংকোচের সঙ্গে হলেও দেখা যায়, ক্রমান্বয়ে ঐকতানের দিকে এগুচ্ছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় একদিকে মুসলমান জনগোষ্ঠী, অন্যদিকে চীনা এবং খ্রিস্টের অনুসারীদের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এবং হয়তো কোনো সময়ে তা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। 

দক্ষিণ আমেরিয়ার অর্থনৈতিক জোট মার্কোজার, আন্দ্রেয়ান চুক্তি, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি (মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা) মধ্য আমেরিকান সাধারণ বাজারে একটি নতুন জীবনধারা প্রবাহিত করে চলেছে। এভাবে দেখা যায়, সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে সাংস্কৃতিক মিলের বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে একটি ঐক্যপ্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রায় একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা মেক্সিকোকে আত্তীভূত করার জন্য উত্তর আমেরিকায় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছে। অবশ্য এর সাফল্য নির্ভর করবে মেক্সিকোর ওপর, কেননা সেক্ষেত্রে মেক্সিকোকে লাটিন আমেরিকার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে উত্তর আমেরিকার সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে হবে। 

শীতলযুদ্ধাবসানের পর্যায়ে সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন সম্পর্ক স্থাপন এবং নতুন জোট গঠনের কাজে ব্যাপৃত আছে। তারা অনির্দিষ্ট গোষ্ঠীবদ্ধতার নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে মিল রয়েছে এমন দেশকেই বাছাই করে নিচ্ছে। রাজনীতিবিদরাও পিছিয়ে নেই, তারা জনগণকে বৃহত্তর জাতীয় পরিচয়ে উদ্বুদ্ধ করতে নানারূপ কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘বৃহত্তর সার্বিয়া’, ‘বৃহত্তর চীন’, ‘বৃহত্তর তুরস্ক’, ‘বৃহত্তর হাঙ্গেরি’, ‘বৃহত্তর ক্রোয়েশিয়া’, ‘বৃহত্তর আজারবাইজান’, ‘বৃহত্তর রাশিয়া’, ‘বৃহত্তর আলবেনিয়া’, ‘বৃহত্তর ইরান’ এবং ‘বৃহত্তর উজবেকিস্তান’ স্লোগান আজ অহরহ উচ্চারিত হচ্ছে। 

প্রশ্ন আসে যে, সবসময়ই রাজনৈতিক ও অর্থনীতি সম্পর্কিত ইস্যুতে গড়ে ওঠা গোষ্ঠীবাদের পশ্চাতে কি সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিষয়টি কাজ করে থাকে? অবশ্যই তেমন নয়। শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে ইতিহাসে দেখা যায়, দেশগুলো বিভিন্নধর্মী সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্বলিত সত্তার সঙ্গে চুক্তি বা গোষ্ঠী গঠন করেছে। যেমন ফ্রান্সিস আই. হেপার্সবার্গের বিরুদ্ধে অটোম্যানদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তাছাড়া ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে সংকট থেকে উত্তরণের নিমিত্তে গঠিত জোট সময়-পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে নতুন অবস্থায় নতুন করে জোট ও মিত্র খোঁজার দরকারের মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব বলে কিছু নেই। গ্রিস এবং তুরস্ক নিঃসন্দেহে ন্যাটোর সদস্যভুক্ত থাকবে, কিন্তু ন্যাটোভুক্ত দেশসমূহের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নরম- গরম দু-ধরনের থেকে যাবে। একইভাবে জাপান এবং কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী, ইসরাইলের সঙ্গে তার অপ্রাতিষ্ঠানিক সখ্য, পাকিস্তানের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ক সুসম্পর্ক-এ সবই উদাহরণ হিসেবে আনা যায়। 

বিভিন্নধর্মী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন আসিয়ান, ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে ক্রমাগতভাবে হিমশিম খাচ্ছে। পাকিস্তান এবং ভারত শীতলযুদ্ধযুগে বিভিন্ন বৃহৎশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিল। কিন্তু এখন সংস্কৃতিনির্ভর রাজনীতির চাপে তারা উভয়েই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন মিত্র ও গোষ্ঠীর সন্ধানে রয়েছে, এবং পুরাতন জোটসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্গঠন করে চলেছে। আফ্রিকার দেশসমূহ যদিও মূলত শীতলযুদ্ধযুগে সোভিয়েটের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই ছিল, কিন্তু শীতলযুদ্ধাবসানের পরবর্তী পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা সংস্কৃতির বাস্তবতার আলোকে সম্পর্ক পুনঃনির্ধারণ করে চলেছে। 

কোনো কোনো সংস্কৃতিক মিল বা সমরূপতাসম্পন্ন জাতি ও সভ্যতাগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি করে বা বিপরীতভাবে অমিলের কারণে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত প্রাধান্য পেয়ে থাকে। 

প্রথমত, কারও কারও বহুশাখাবিশিষ্ট আত্মপরিচয় থাকতে পারে, যা আত্মীয়তা, পেশা, সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠান, ভৌগোলিক, শিক্ষা সম্পর্কিত, দলগত, মতাদর্শিক এবং অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে। পরিচয়ের একটি উপাদানের সঙ্গে অন্য একটি উপাদান সংঘাতের পর্যায়ে আসতে পারে এবং এর একটি ধ্রুপদী উদাহরণ হিসেবে জার্মানির এক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯১৪ সালে জার্মানিতে শ্রমিকগণ তাদের শ্রেণীপরিচয় প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে আন্তর্জাতিক সর্বহারা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেও তাদের জাতীয় পরিচয় কিন্তু জার্মানির জনগণ এবং সরকারের সঙ্গে থেকেই যায়। অধুনা বিশ্বে নাটকীয়ভাবে আত্মপরিচয় প্রশ্নে অন্যান্য উদাহরণের তুলনায় সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রাধান্যের শীর্ষে উঠে এসেছে। 

একটি একক উপাদান তাৎক্ষণিকভাবে মুখোমুখি পর্যায়ে অর্থবহ হতে পারে। পরিচয়ের সংকীর্ণ উপাদানগুলো সাধারণত বৃহত্তর উপাদানের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় না। একজন সামরিক কর্মকর্তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার কোম্পানির রেজিমেন্ট, বিভাগ এবং চাকুরির ধরনের দ্বারা পরিচিত হতে পারেন। তেমনি একজন ব্যক্তি সাংস্কৃতিকভাবে তার পূর্বপুরুষের উদ্ভব, নৃ-ভৌগোলিক, জাতীয়তা, ধর্ম এবং সভ্যতার পরিচয়ে পরিচিত হন। নিম্নপর্যায়ে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নীরবতা প্রকারান্তরে উচ্চপর্যায়েও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নীরবতাকে উৎসাহিত করে থাকে। 

দ্বিতীয়ত, সারাবিশ্বে ক্রমবর্ধমানভাবে মানুষ যেখানে সংস্কৃতিগত পার্থক্যের কারণে বিভেদায়িত হচ্ছে, সেখানে বিনাদ্বিধায় বলা যায়, সংস্কৃতিগত পার্থক্য সংঘাতপ্রবণতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সভ্যতা আসলে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক সত্তা বৈ কিছু নয়। সুতরাং, বলা চলে, বিশ্বরাজনীতিতে বিভিন্ন সভ্যতার গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘাত একটি আলোচিত ও কেন্দ্রীয় বিষয়। 

তৃতীয়ত, যে-কোনো পর্যায়ে পরিচয়ের বিষয়টি, তা সে ব্যক্তিগত, উপজাতি সংক্রান্ত, বর্ণ সংক্রান্ত, সভ্যতা সংক্রান্ত হোক না কেন, সদাসর্বদা তা ‘অন্যদের’ হিসেবে বিচার করা হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে অন্য ব্যক্তি, অন্য উপজাতি, অন্য বর্ণ, অথবা ভিন্নতর সভ্যতাই মুখ্য হয়ে ওঠে। অন্যদের ‘পর’ মনে করা হয়, যেমন বিপরীতভাবে স্বগোত্রীয় হলে ‘আপন’ বা ‘আমাদের’ ভাবা হয়ে থাকে। অবশ্য, একই সভ্যতার ভেতরেও ভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিন্যাস থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তারপরও ওই রাষ্ট্রগুলো অন্য সভ্যতার রাষ্ট্রসমূহ থেকে পৃথক সত্তা হিসেবেই বিচার্য হয়ে থাকে। মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের আচরণেও এক্ষেত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। সমগোত্রীয় হলে বলা হয়, ‘আমাদের মতো’; সমগোত্রীয় না হলে ‘আমাদের মতো নয়’ বিধায় ‘বঞ্চনা’ অনিবার্য। তাই দেখা যায়, সভ্যতা নির্বিশেষে আচরণ একরূপসম্পন্ন নয়। 

খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন প্রয়োগ ও সুবিধাদি বণ্টনের বেলায় খ্রিস্টানরা অগ্রাধিকার পেতেন এবং বিপরীতভাবে তুর্কিরা বঞ্চনার শিকার হতেন। মুসলমানেরাও ‘দারুল ইসলাম’ এবং ‘দারুল হার্ব’-এর ক্ষেত্রে দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। চীনারাও চীনদেশীয়দের সঙ্গে সুখকর আচরণ করলেও চীনে বিদেশীরা তেমন সমান তালের সুখকর আচরণ পায় না। সভ্যতার পরিমাপে ‘আমাদের’ এবং সভ্যতাবহির্ভূত ‘তাদের’-এর মনোভাবসম্পন্ন আচরণগত ভিন্নতা ইতিহাসে চলচ্ছক্তিহীন এক ধ্রুবসত্য হয়ে রয়েছে। এই ধরনের ‘সভ্যতার অভ্যন্তরস্থ’ এবং ‘সভ্যতার বহির্ভূত’ (নিজ নিজ দৃষ্টিতে) সদস্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যাত হতে পারে, যথা : 

  1. নিজ সভ্যতা বহির্ভূত মানুষজনের প্রতি মনে করা হয় তারা নিম্নমানের অথবা উচ্চমানের, অর্থাৎ যে-কোনো বিচারেই সমমানের নয়; 
  2. অন্য সভ্যতাভুক্ত মানুষের বিষয়ে আস্থাহীনতা ও তাদের বিশ্বাস না করা;
  3. ভাষাগত এবং ‘সিভিল’ আচরণগত পার্থক্য থাকার দরুন অন্য সভ্যতাভুক্ত মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগ সমস্যার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি; 
  4. অন্যসভ্যতার মানুষের আচার-আচরণ, জীবনধারা, মনন, চিন্তাচেতনা, সামাজিক রীতি সম্পর্কে অজানা থাকার দরুন সংকোচ, ইত্যাদি। 

অধুনা বিশ্বে যোগাযোগ ও যাতায়াতব্যবস্থার প্রভুত উন্নতির ফলে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার মানুষের ভেতর ঘনঘন মেলামেশা, ভাবের আদানপ্রদান ঘটে চলেছে। এ কারণে, তাদের সভ্যতা সম্পর্কিত পরিচয়টি ততটা কার্যকর নয়। ফরাসি, জার্মান, বেলজীয় এবং ডাচগণ নিজেদেরকে ইউরোপীয় ভাবতে ভালোবাসে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানেরা নিজেদেরকে বসনিয়া ও চেচেনদের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলে। পূর্বএশিয়ায় বসবাসরত চীনারা পরস্পরের মধ্যে সখ্য গড়ে তোলে মূল ভূখণ্ডের মতোই। রুশরা সার্বিয়া ও অন্যান্য অর্থোডক্সদের সঙ্গে নিজেদের একরূপভাবে এবং তাদের স্বার্থরক্ষায় উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে। এ-ধরনের মনোভাবের দুটো দিক রয়েছে; যথা, এর ফলে বৃহত্তর আঙ্গিকে সভ্যতার পরিচয় আরও সুগভীর হয় এবং ‘আমাদের’ ও ‘তাদের’ বিষয়টি সংরক্ষিত হয়। 

চতুর্থত, বিভিন্ন সভ্যতার আওতাধীন রাষ্ট্র এবং গোত্রের মধ্যে সংঘাতের বিভিন্ন দিক রয়েছে, যেমন—মানুষকে নিয়ন্ত্রণের মনোভাব, ভূখণ্ড দখল বা দখলমুক্তকরণ, সম্পদের মালিকানা, সুযোগসুবিধার দখলদার হওয়া, আপেক্ষিকভাবে ক্ষমতাশালী হওয়ার কামনা বা মানুষের নিজস্ব মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠানাদি সম্পর্কে অন্যগোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে নিজস্বধারায় কাজকর্ম করার ক্ষমতা অর্জন করা ও তা বাস্তবায়ন করতে চাওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ও দ্বন্দ্ব আসলে একটি সাংস্কৃতিক ইস্যু বৈ কিছু নয়। 

ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শ সম্পর্কে মার্কসীয়-লেনিনীয় এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যে ধারণাগত পার্থক্য বিতর্কযোগ্য, (যদি তার অবসান না ঘটে।) বস্তুগত স্বার্থের বিবাদ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রায়শ‍ই সমাধানযোগ্য হলেও সাংস্কৃতিক ইস্যুগুলোর মধ্যে সৃষ্ট পার্থক্য ওই পথে সমাধান সম্ভব নয়। ভারতে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে অযোধ্যায় একইস্থানে মসজিদ বা মন্দির স্থাপন কিংবা মসজিদ ভেঙে মন্দির স্থাপনার ইস্যুটি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা বা দুটি পথ এক্ষেত্রে একত্রে স্থাপন করা মোটেও সম্ভব নয়। একইভাবে কসোভো সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান দেয়া সহজ নয়। ইহুদি ও আরবীয়দের জেরুজালেম সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানও দুঃসাধ্য। কেননা ওইসব সমস্যা ঐতিহাসিকভাবে সংস্কৃতি ও সংশ্লিষ্ট মানুষের আবেগ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে। তেমনিভাবে ফরাসি কর্তৃপক্ষ আর মুসলমান অভিভাবকেরা মুসলমান মেয়ে-শিক্ষার্থীদের মাথায় হিজাফ পড়ার বিষয়টি পরস্পরের যুক্তিকে একত্রিত করে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করা অসম্ভব। সুতরাং, সাংস্কৃতিক ইস্যুর ক্ষেত্রে পছন্দ-অপছন্দ ‘হাঁ’ অথবা ‘না’ কিংবা ‘শূন্য-সংখ্যা’-এর নিগড়ে আবদ্ধ। এর মধ্যবর্তী কোনো রাস্তা খোলা নেই। 

পঞ্চমত, বলা যায় সাংস্কৃতিক সংঘাত সর্বব্যাপী। মানুষ এটিকে ঘৃণা করুক। নিজস্ব বিবেকে মানুষ শত্রু চিহ্নিত করে থাকে, যেমন- ব্যবসায় প্রতিযোগী, প্রাপ্তির বেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে, রাজনীতির ক্ষেত্রে থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী, ইত্যাদি। স্পষ্টতই এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব থাকে। থাকে অবিশ্বাস ও পরস্পরের প্রতি হুমকি। কেননা তারা একে অপর থেকে পৃথক এবং মনে করে একজন অন্যজনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এর সমাধান, অর্থাৎ শত্রুভাবাপন্ন অবস্থার শূন্যতা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রে নতুন প্রতিপক্ষের জন্ম দিয়ে থাকে। ‘আমাদের’ এবং বিপরীত ‘তাদের’ ধারায় চিন্তার প্রবণতাকে আলি মাজরুই বলেন, এটি আদতে রাজনৈতিক অঙ্গনে চিরন্তন বা সর্বজনীন বিষয়। 

বর্তমান সময়ে ‘তাদের’ অনুজ্ঞাটি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতরভাবে ভিন্ন সভ্যতার সদস্যদের চিহ্নিত করতেই ব্যবহৃত হচ্ছে। শীতলযুদ্ধ বা আচরণের মোহে সংস্কৃতি ও সভ্যতাসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটেনি বরং এ-বিষয়গুলো নতুন করে জাগ্রত হয়েছে এবং নতুন মাত্রা ও গতি লাভ করেছে। অন্যদিকে, একথাও সত্য যে, বিভিন্নপ্রকার আঞ্চলিক জোটের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে সাংস্কৃতিক সমরূপতা এবং সেইমতো ‘সাধারণ’ বিষয়গুলোর একত্রিতকরণ ও সাধারণ (কিছুটা সর্বজনীন) ও একাত্মবোধের অগ্রগতিও হচ্ছে। তবে, একথাটি এখনও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ইস্যুগুলির মধ্যেই সীমিত থাকছে, অন্যান্য ক্ষেত্রে এর উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি ঘটেনি। 

সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা 

১৯৯০-এর দশকে আঞ্চলিকীকরণ এবং বৈশ্বিক রাজনীতির আঞ্চলিকীকরণের বিষয়ে উচ্চবাক্য শোনা যেত। বৈশ্বিক নিরাপত্তার এজেন্ডায় আঞ্চলিক বিরোধসমূহ বৈশ্বিক বিরোধের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ওঠেছে। বৃহৎ শক্তিসমূহ, যেমন রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং সেসঙ্গে দ্বিতীয় বৃহৎশক্তিসমূহ, যেমন সুইডেন, তুরস্ক প্রমুখ দেশগুলো তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আঞ্চলিক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে। আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য, আঞ্চলিক বাণিজ্যকে ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং এটি দ্রুত ক্রমবর্ধিষ্ণু পর্যায়ে আছে। এতদ্ব্যতীত, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পারস্পরিক সহযোগিতার জোট, যেমন ইউরোপীয়, উত্তর আমেরিকা, পূর্বএশিয়াতে এবং আরও অনেক এলাকায় ‘ব্লক’ গড়ে উঠতে শুরু হয়েছে। 

‘আঞ্চলিকত্ব’ শব্দটির দ্বারা যা ঘটে চলেছে তার প্রকৃত বিবরণ লাভ করা যায় না। আঞ্চলিক শব্দটি ভৌগোলিক, কিন্তু রাজনৈতিক বা সংস্কৃতি বিষয়ক নয়। বলকান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে আন্তঃসভ্যতাসমূহ এবং সভ্যতার অভ্যন্তরস্থ সংঘাতে তারা লিপ্ত রয়েছে। ‘অঞ্চল’ কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি ভিত্তিস্বরূপ। এখানে ভূগোল ও সংস্কৃতি মিলেমিশে গিয়েছে। সামরিক জোট এবং অর্থনৈতিক ও সহযোগিতার নিমিত্তে গঠিত সংস্থার জন্য চাই বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমঝোতার মনোভাব। আর সহযোগিতার জন্য চাই বিশ্বাসযোগ্যতা। সমরূপ মূল্যবোধ এবং সভ্যতার গর্ভেই জন্ম নেয় বিশ্বাস। মোটের ওপর দেখা যায়, ‘একক’ বা ‘সমরূপ’ সভ্যতা নিয়ে গঠিত আঞ্চলিক জোট অধিকতর কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে—এক্ষেত্রে বহুসভ্যতাসম্বলিত সংগঠন ততটা কার্যকর হতে পারে না। একথাটি সকল সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক জোটের ক্ষেত্রেই সত্য। 

ন্যাটো-জোটের সদস্যরাষ্ট্রসমূহের দার্শনিক চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে মিল এবং প্রায়সমরূপ মূল্যবোধ থাকার কারণে ইউরোপের কেন্দ্রীয় নিরাপত্তার বিবেচনায় অংশত সাফল্য এসেছে। পশ্চিম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সৃষ্টি হয়েছে কার্যত ‘সাধারণত সংস্কৃতির উপস্থিতির কারণে। ইউরোপের নিরাপত্তা ও সহযোগিতার নিরিখে গঠিত সংগঠন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধ ও স্বার্থ থাকার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কেননা তার ফলে একটি একক পরিচয় গড়ে তুলে কার্যোপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠানো সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। 

একক সভ্যতাসম্বলিত প্রাক্তন ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত ১০টি ক্যারিবীয় রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত ক্যারিবিয়ান কমিউনিটি (CARICOM) অনেক ক্ষেত্রেই বিস্তারিত ও বিভিন্নমুখী সহযোগিতার দিগন্ত সম্প্রসারিত করতে পেরেছে। অন্যদিকে, বৃহত্তর ক্যারিবীয় সংগঠন যা অ্যাংলো হিস্পানিকদের মধ্যে বিভেদ ঘুচাবার জন্য বা তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিভেদরেখা দূর করতে উপর্যুপরিভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। 

১৯৮৫ সালে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রের সমন্বয়ে অনুরূপভাবে ‘সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওন্যাল কো-অপারেশন (সার্ক)’ প্রায় সর্বতোভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এমনকি তারা একত্রে বসে মিটিং পর্যন্ত করতে বাধাগ্রস্ত হয়। 

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংহতির ক্ষেত্রেও সাংস্কৃতিক প্রশ্নটি অবশ্যম্ভাবীভাবে এসে যায়। এ সম্পর্কে নিম্নে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচ্য : 

১. মুক্ত বাণিজ্য এলাকা; 

২. শুল্ক ইউনিয়ন; 

৩. সাধারণ বাজার; 

৪. অর্থনৈতিক ইউনিয়ন। 

ইউরোপীয় ইউনিয়ন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমন্বয় ঘটাবার অভিপ্রায়ে কার্যত সাধারণ বাজার ও অর্থনৈতিক সমন্বয় স্থাপনের লক্ষ্যাভিমুখী হয়ে কাজ করে চলেছে। আপেক্ষিকভাবে সমজাতীয় ‘মারকোসার’ (Marcosur) এবং ‘এনডিয়েন’ (Andean) চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৪ সালে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো শুল্ক ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যায়। এশিয়ার বহুসভ্যতাবিশিষ্ট ‘আসিয়ান’ (ASEAN) ১৯৯২ সালে মুক্তবাণিজ্য এলাকা গঠনের দিকে এগিয়ে যায়। অন্যান্য বহুসভ্যতাভিত্তিক অর্থনৈতিক সংগঠনগুলো পেছনে পড়ে থাকে। তবে ১৯৯৫ সালে এর ন্যূনতম ব্যতিক্রম ‘নাফটার’ (NAFTA) ক্ষেত্রে; এ-ধরনের কোনো সংগঠনের পক্ষেই মুক্তবাণিজ্য এলাকা গড়া সম্ভব নয়, যদি-না তারা ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সংহতির বিষয়টি গুরুত্ব না দেয়। 

পশ্চিম ইউরোপীয় এবং লাটিন আমেরিকার সমরূপ সভ্যতার উপাদানগুলো তাদের আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা ও সমন্বয়ে গড়ে তোলার বিষয়টি এগিয়ে নিয়েছে। পশ্চিম ইউরোপীয় এবং লাটিন আমেরিকানরা জানে যে, তাদের অনেককিছুই এক এবং অভিন্ন। পাঁচটি সভ্যতা (দৃঢ় হত যদি রাশিয়াকে ধরা হয়) পূর্বএশিয়ায় রয়েছে। পূর্বএশিয়া একটি পরীক্ষামূলক সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার দ্বারা গঠিত সংস্থাসমূহ কার্যকরভাবে ফলপ্রসূ হতে পারে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে ন্যাটোর তুলনায় পূর্বএশিয়ায় কোনো নিরাপত্তামূলক সংগঠন বা সামরিক জোট ছিল না। আসিয়ানের মতো বহুসভ্যতাভিত্তিক সংগঠন, যার ১৯৬৭ সালে জন্ম হয়েছিল, তাতে ছিল একটি ‘সিনিক’, একটি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, একটি খ্রিস্টানধর্মাবলম্বী, এবং দুটি মুসলমান সদস্যরাষ্ট্র। এরা সবাই কিন্তু কম্যুনিজমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে, বিশেষ করে উত্তর ভিয়েতনাম এবং চীনের ভয়ে ভীত হয়েই জোটবদ্ধ হয়েছিল। 

বহুধাবিভক্ত সভ্যতার সমন্বয়ে গঠিত আসিয়ানকে একটি সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। এটি অবশ্য (সেসঙ্গে) ওই ধরনের সংগঠন সীমাবদ্ধতারও একটি উদাহরণ। আসিয়ান কোনোপ্রকার সামরিক জোট নয়, যদিও এর সদস্যগণ কখনও কখনও দ্বিপাক্ষিকভাবে সামরিক বিষয়ে একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে থাকে। তারা প্রায় সকলেই সামরিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বা বাজেট বৃদ্ধি করছে এবং সামরিক স্থাপনা শক্তিশালী করছে, যেখানে পশ্চিম ইউরোপ ও লাটিন আমেরিকার দেশগুলো সামরিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করতে ব্রতী হয়েছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আসিয়ান শুরু থেকেই যে লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে গিয়েছে তা হল, ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা, কিন্তু অর্থনৈতিক সংহতি বিধান নয়’। এর ফলে আঞ্চলিকতার মতো বিষয়টি ‘নিরহঙ্কার পদক্ষেপে’ এগিয়ে গিয়েছে, এমনকি মুক্তবাণিজ্য এলাকা সেখানে একবিংশ শতাব্দীর আগে অবলোকন করতে চাওয়া হয়নি।’ ১৯৭৮ সালে আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহের বিদেশবিষয়ক মন্ত্রীগণ কনফারেন্স-পরবর্তী (Post Ministerial Conference– (PMC) পিএমসি তাদের উন্নয়নবিষয়ক বক্তৃতামালার সহযোগী শক্তি, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সভা-সমাবেশ করে। 

‘এই পি.এস.সি. মূলত প্রাথমিকভাবে দ্বিপাক্ষিক বিষয়সমূহ আলাপ-আলোচনার জন্য একটি ফোরাম, যা কোনোভাবেই কোনোপ্রকার নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কাজ করতে অপারগ। ১৯৯৩ সালে আসিয়ান-এর কার্যপরিধি বৃদ্ধি পায় এবং তা তাদের আলাপ আলোচনার অংশীদার হিসেবে আঞ্চলিক গণ্ডির বাইরে রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, লাওস এবং পাপুয়া নিউগিনিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সংগঠনটি যৌথ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের নীতি গ্রহণ করে। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে প্রথম সভায় মিলিত হয়, ‘তখন তারা আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে নিক্ষেপ করেন, তবে বিতর্কিত ইস্যুগুলো বাদ দিতে হয়, কেননা যেমন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিতর্কিত ইস্যু গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ লেগে যেতে পারে এবং একে অন্যকে আক্রমণ করতেও পারে। প্রকৃতপক্ষে আসিয়ান-এর এসব সংকট কিন্তু বহুধাবিভক্ত সভ্যতার দ্বারা গঠিত আঞ্চলিক জোটের সাধারণ সীমাবদ্ধতা ব্যতীত কিছু নয়। 

অর্থবহ পূর্বএশীয় আঞ্চলিক সংগঠনের আবির্ভাব হবে তখন, যখন ওই অঞ্চলে সাংস্কৃতিকভাবে সাযুজ্য আসবে, যা তাদেরকে স্থায়িত্ব দেবে। পূর্বএশীয় সংগঠনগুলোর সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে অবশ্যই কিছু সাধারণ মিল রয়েছে যা তাদেরকে পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে পৃথক করে থাকে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, যুক্তি দেখান যে, এই ‘সাধারণত্বই’ হল তাদের সংস্থার ‘শ্বাসবায়ু’ যা তাদেরকে অর্থনৈতিক সংস্থা গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছে। মায়ানমার, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ হল চীন ও জাপানকে আসিয়ানভুক্ত করে নেয়া। মাহাথির আরও যুক্তি দেখান যে, ইস্ট-এশিয়ান ইকোনোমিক ককাস—ইয়েক (East Asian Economic Caucus- EAEC)-এর শেকড় একই ধরনের সংস্কৃতি বা সাধারণ সংস্কৃতির মধ্যে গ্রথিত রয়েছে। ভাবতে হবে যে, ‘এটি কেবলমাত্র কোনো ভূগোলভিত্তিক সংগঠন নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও বটে। যদিও পূর্বএশীয় বা জাপানি, কোরীয় অথবা ইন্দোনেশীয় নয়, তথাপি সাংস্কৃতিকভাবে তাদের মধ্যে বহু মিল রয়েছে ইউরোপীয়দের ‘দল’ রয়েছে, আমেরিকানদের ‘দল’ আছে, সুতরাং আমাদের অর্থাৎ পূর্বএশীয়দেরও ‘দল’ থাকতে হবে।’ এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর একজন সহযোগী বলেন যে, ‘এ সংস্থায় 

‘এ অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ আঞ্চলিক বাণিজ্যিকে এগিয়ে নেবে, আর এর ভিত্তি হবে তাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক সাযুজ্য।’ ইয়েক (EAEC)-এর গূঢ় রহস্য হচ্ছে এই যে, অর্থনীতি কার্যত সংস্কৃতিকেই অনুসরণ করে থাকে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ সংস্থা থেকে বাদ দিতে হয়েছে, কারণ সাংস্কৃতিকভাবে তারা এশীয় নয়। ইয়েক (EAEC)-এর সাফল্য তাই সর্বতোভাবে জাপান এবং চীনের অংশগ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। মাহাথির জাপানিদের অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানান এবং বলেন যে, জাপানই হল এশিয়া। জাপান হল পূর্বএশিয়া, একথা তিনি জাপানি শ্রোতাদর্শকের সম্মুখেই বলেছেন। তিনি তাদের আরও বলেন যে, ‘আপনারা এই ভৌগোলিক- সাংস্কৃতিক বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। কেননা আপনারা এর মধ্যে বিলীন হয়ে রয়েছেন।’ জাপানি সরকার অবশ্য ইয়েক (EAEC)-এ অংশ নিতে আগ্রহী ছিল না। এর দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, তারা আমেরিকাকে চটাতে চায়নি। দ্বিতীয়ত, পুরোপুরিভাবে এশীয় হতেও তারা দ্বিধাগ্রস্ত। যদি জাপান ইয়েক (EAEC)- এ যোগদান করে, তবে সংস্থাটি তাদের পদানত হবে এবং সেক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তাদের বৈরী অবস্থা সৃষ্টি হবে। বহু বৎসর যাবৎ জাপান একটি ‘ইয়েন ব্লক’ সৃষ্টির চেষ্টায় বিভোর রয়েছে, যার দ্বারা তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং নাফটার (NAFTA) সঙ্গে ‘ভারসাম্য’ বজায় রাখতে পারবে। তবে, জাপান হল একটি ‘একাকিত্বসম্পন্ন দেশ’ যার সঙ্গে প্রতিবেশীদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ এবং সম্ভবত এ- কারণেই ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সেখানে কোনোপ্রকার ‘ইয়েন ব্লকের’ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। 

আসিয়ান খুব ধীরগতিতে সামনে এগুচ্ছে, কিন্তু ‘ইয়েন ব্লক’ এখনও স্বপ্নই রয়ে গিয়েছে। জাপানের দোদুল্যমানতা এবং ইয়েক (EAEC)-এর শক্ত ভিত্তি না-পাওয়া সত্ত্বেও পূর্বএশিয়ার অর্থনৈতিক তৎপরতা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অগ্রগতির মূলে রয়েছে পূর্বএশিয়ার চীনা সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থাপিত সাংস্কৃতিক বন্ধন। তাহলে দেখা যায়, পূর্বএশিয়ার অন্যান্য এলাকার মতো সাংস্কৃতিক সাধারণত্বই হল সকল অর্থনৈতিক সংহতি ও অগ্রগতির মূলমন্ত্র। 

শীতলযুদ্ধের অবসান, মূলত বিশ্বে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক সংগঠন গড়তে ও পুরাতন সংগঠনগুলো পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে উৎসাহ জুগিয়েছে। তবে, এসব সংগঠনের সাফল্য নির্ভর করছে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সাংস্কৃতিক মিল বা সাযুজ্যের ওপর। সিমন পেরেস (Shimon Peres) ১৯৯৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘কমন মার্কেট’-এর কথা বলেছিলেন, যাকে তিনি ‘মরুভূমির মিরেজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। একজন আরবীয় কর্মকর্তা বলেছেন যে, ‘আরবীয় জগৎ’ ইসরাইলকে তাদের প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চায় না।” ১৯৯৪ সালে গঠিত ক্যারিবীয় রাষ্ট্রসংঘ ‘কারিকম’, হেইতি ও স্প্যানিশ ভাষাভাষি মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরেও বিভিন্ন সভ্যতা দ্বারা গঠিত সংস্থার অভ্যন্তরস্থ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যসহ প্রাক্তন ব্রিটিশ কলোনির অধুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নমনীয় মনোভাব দূর করতে খুব একটি সাফল্যের পরিচয় দিতে পারছে না।

অন্যদিকে সাংস্কৃতিকভাবে মিল রয়েছে, এমন সংস্থাসমূহ দ্রুত অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে যদিও উপসভ্যতায় বিভক্ত পাকিস্তান, ইরান এবং তুরস্ক ১৯৮৫ সালে ‘রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ পুনর্গঠিত করে, যা ১৯৭৭ সালে গঠিত হয়েছিল। অবশ্য, এটির পুনঃনামকরণ হয় ‘ইকোনোমিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ (ECO) হিসেবে। তারা পরবর্তীতে বিভিন্ন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ট্যারিফ হ্রাসকরণের ব্যবস্থা নেয়। তাছাড়া, ১৯৯২ সালে ইকো (ECO) সদস্যসংখ্যা বর্ধিত করা হয়। ফলে আফগানিস্তান এবং প্রাক্তন সোভিয়েট রিপাবলিকের ৬টি মুসলমান প্রজাতন্ত্র এর অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতোমধ্যে প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের ৫টি মুসলমান-অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্র নীতিগতভাবে একটি ‘সাধারণ বাজার’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৪ সালে দুটি বৃহৎ প্রজাতন্ত্র উজবেকিস্তান এবং কাজাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে বলা হয়, ‘উভয়ের মধ্যে মুক্তভাবে পণ্য, সেবা এবং পুঁজির প্রবাহ চলবে।’ সেইসঙ্গে তারা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, উভয়ের মধ্যে আর্থিক, মুদ্রাসংক্রান্ত এবং ট্যারিফ নীতি ইত্যাদি পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে চলবে। ১৯৯১ সালে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে এবং প্যারাগুয়ে একত্রে মারকুসার ( Marcosur) – এর পতাকাতলে একত্রিত হয়ে কিছু সাধারণ অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্রতী হয়। এভাবে তাদের মধ্যে তারা অর্থনৈতিক সংহতি লাভ করতে চায়। সুতরাং, এরই ফল হিসেবে ১৯৯৫ সালে আংশিকভাবে হলেও একটি শুল্ক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালে স্থবির হয়ে থাকা পূর্বে গঠিত ‘সেন্ট্রাল আমেরিকান কমন মার্কেট’ (Central American Common Market)-এর মুক্তবাণিজ্য এলাকা গঠন করা হয় এবং ১৯৯৪ সালে অকেজো হয়ে থাকা ‘এনডেন গোষ্ঠী’ সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং একটি শুল্ক ইউনিয়ন গঠন করে। ১৯৯২ সালে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া একত্রিত হয়ে ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া’ গঠন করে এবং ১৯৯৪ সালে তারা দ্রুত কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বাণিজ্য সম্প্রসারণের দ্বারা অর্থনৈতিক সংহতি অর্জিত হয়ে থাকে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে আঞ্চলিক দেশস্থ বাণিজ্য আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের আপেক্ষিক পরিমাণের চেয়েও অধিক হয়ে দেখা যায়। ১৯৮০ সালে ইউরোপীয় কমিউনিটির অভ্যন্তরস্থ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল শতকরা হিসেবে প্রায় ৫০.৬ ভাগ, অথচ ১৯৮৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ৫৮.৯ ভাগে। উত্তর আমেরিকায় এবং পূর্বএশিয়ার ক্ষেত্রেও বাণিজ্যের এই অবস্থানের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। লাটিন আমেরিকার মার্কোসার এবং এনডেন চুক্তির পুনর্জাগরণের ফলে লাটিন আমেরিকার সবগুলো দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য গতি পায়। ফলে দেখা যায়, ১৯৯০-এর দশকে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মধ্যে বাণিজ্য তিনগুণ বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩-এর মধ্যে কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে বাণিজ্য উল্লেখ করার মতো মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৯৪ সালে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার বাণিজ্যের অংশীদার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে প্রথম স্থানে চলে আসতে সক্ষম হয়। 

নাফটা (NAFTA) গঠনের ভেতর দিয়ে মেক্সিকো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য বহুগুণ বড়ে যায়। পূর্বএশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য এশিয়া-বহির্ভূত দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে যেতে থাকে। তবে, এই সম্প্রসারণ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জাপানের নীতির কারণে। কেননা জাপান তার বাজার সীমিত ও সংকুচিত করে রাখার পক্ষপাতী। চীনের সংস্কৃতির আওতাধীন (আসিয়ান) তাইওয়ান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ১৯৭০ সালের শতকরা ২০ ভাগের স্থানে ১৯৯২ সালে শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, এক্ষেত্রে জাপানের বাণিজ্য এশিয়া এলাকায় উল্লিখিত সময়ে শতকরা ২৩ ভাগ থেকে শতকরা ১৩ ভাগে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯২ সালে চীনাদের দ্বারা অন্যান্য এলাকায় রপ্তানির পরিমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ইউরোপীয় কমিউনিটির তুলনায় ছাড়িয়ে যায়।

ভিন্নধর্মী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে জাপান পূর্বএশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের সম্পর্ক স্থাপনে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এতদ্ব্যতীত, ওই একই কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সঙ্গে জাপানের সৃষ্ট অর্থনৈতিক পার্থক্য দূরীকরণও সমস্যা হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। অন্যদিকে, জাপানের ইচ্ছা থাকলেও অন্যান্য পূর্বএশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে তারা বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক যোগাযোগ শক্তিশালী করতে পারছে না। এর কারণ সম্ভবত সংস্কৃতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। চীন ও অন্যান্য পূর্বএশীয় দেশসমূহের সঙ্গে জাপানের সংস্কৃতিগত পার্থক্যের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন অথবা নাফটা’র (NAFTA)-এর মতো পূর্বএশিয়ায় জাপানের নেতৃত্বে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগঠন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে জাপানের সাংস্কৃতিক পার্থক্য পশ্চিম, বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের সঙ্গে জাপানের ভুল-বোঝাবুঝি এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যদি অর্থনৈতিক সংহতি কার্যতই সাংস্কৃতিক সাযুজ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে, তবে বলা যায়, জাপানের সাংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য তাকে সাংস্কৃতিকভাবে একটি বিচ্ছিন্ন ও ‘একাকিত্বের’ নিগড়ে নিক্ষেপ করেছে এবং তারই সূত্র ধরে আরও বলা যায়, অর্থনৈতিকভাবেও জাপান ভবিষ্যতে অন্যান্য সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আরও একাকিত্ব এবং একঘরে হয়ে পড়তে পারে। 

অতীতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধরন অনেকাংশেই আন্তর্জাতিক জোটনির্ভর। আর যে-বিশ্ব এখন আবির্ভূত হচ্ছে, সে-বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দিনদিন সংস্কৃতিনির্ভর হয়ে পড়ছে। সংস্কৃতির ধরন মূলত বাণিজ্যের ধরন ও প্রক্রিয়ার দ্বারা নির্ধারিত হবে। ব্যাবসায়ীগণ সেই আদলে মানুষের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন করবে, যাদের তারা বুঝতে ও বিশ্বাস করতে পারবে। রাষ্ট্রসমূহ তাদের সার্বভৌমত্ব নিজ নিজ পছন্দের ও সমমনা সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্য সম্পন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, জোট বা গোষ্ঠীর ওপর অর্পণ করবে যাদের তারা সাংস্কৃতিকভাবে নিকটের এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বাস ও আস্থায় রাখতে পারবে। তাই বলা যায়, অর্থনৈতিক সহযোগিতার শেকড় সাংস্কৃতিক সাযুজ্যবোধের গভীরে গেঁথে রয়েছে। 

সভ্যতার অপরিহার্য অংশসমূহ/কাঠামো 

শীতলযুদ্ধকালীন দুটি বৃত্তের শক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ, ‘গোষ্ঠী ও জোটভুক্ত’, ‘উপগ্রহসম’, ‘ক্লায়েন্ট’, ‘নিরপেক্ষ’ এবং ‘ জোটনিরপেক্ষ’ অবস্থানে ছিল। শীতলযুদ্ধাবসানের মতো বিশ্বে ওই ধারার পরিবর্তন এসেছে এবং এখন তা সভ্যতার মাপকাঠিতে বিচার্য হচ্ছে, যেখানে বলা হয়ে থাকে, ‘সদস্য রাষ্ট্রসমূহ’, ‘কোররাষ্ট্র’, ‘একাকিত্ব রাষ্ট্র’, ‘চিড় বা ফাটলসমৃদ্ধ রাষ্ট্র’ এবং ‘ছেঁড়া বা বিক্ষত রাষ্ট্র’ ইত্যাদি। উপজাতি এবং জাতির ন্যায় সভ্যতারও রাজনৈতিক কাঠামো রয়েছে। ‘সদস্যরাষ্ট্র’ বলতে তেমন রাষ্ট্রকে বুঝায়, যে রাষ্ট্র সাংস্কৃতিকভাবে একটি সভ্যতার ধারক ও বাহক বা অংশীদার। যেমন মিশর, আরবীয় মুসলমান সভ্যতার একটি অংশ। ইটালি হল ইউরোপীয় পাশ্চাত্য সভ্যতার সদস্যভুক্ত। একটি সভ্যতা সেইসব মানুষজনকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকে, যার অন্তরস্থ সব মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য বা মিল রয়েছে। কিন্তু এমনও হতে পারে, তারা ভিন্ন সভ্যতার মানুষদের দ্বারা শাসিত বা অধীনস্থ রাষ্ট্রের সদস্য হয়ে রয়েছে। 

একটি সভ্যতা সাধারণত এক বা একাধিক স্থানে অবস্থান করতে পারে, যেখানে তার সদস্যগণ একইরূপ সংস্কৃতির ধারা বহন করে থাকে। তবে উৎস থাকে মাত্ৰ একটি স্থানের মধ্যে সীমিত। এই উৎস-সম্বলিত রাষ্ট্রকেই ‘কোররাষ্ট্র’ বা ‘সভ্যতার উৎস রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাই স্বভাবতই ‘কোররাষ্ট্র’ শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিতে কেন্দ্রীয় অবস্থানে অবস্থানকারী দেশ বিশেষ। 

সদস্যরাষ্ট্র এবং ‘কোররাষ্ট্রের’ ভূমিকা সভ্যতা ও সময়ভেদে ভিন্নরূপ হয়ে থাকতে পারে। জাপানি সভ্যতাকে দৃশ্যত একটি একক ‘কোররাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সিনিক, অর্থোডক্স এবং হিন্দুসভ্যতার প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকে সর্বতোভাবে এক-একটি প্রভাবশালী ‘কোররাষ্ট্র’ বলে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য সব হল সদস্যরাষ্ট্র, বা অন্য সভ্যতা দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র (যেমন সমূদ্রপারের চীন, নিকটের বিদেশ হিসেবে বিবেচিত রাশিয়া), শ্রীলঙ্কার তামিলগণ ইত্যাদি। 

ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমাবিশ্বে সঙ্গত কারণেই একাধিক ‘কোররাষ্ট্র’ ছিল। তবে বর্তমানে সেখানে মাত্র দুটি ‘কোররাষ্ট্র’ রয়েছে, যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে ফ্রাঙ্কো-জার্মান ‘কোররাষ্ট্র’ ব্রিটেনসহ অন্যান্য আশপাশের রাষ্ট্রগুলো ওই দুটি কোরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে রয়েছে। ইসলাম, লাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকায় কোনো ‘কোররাষ্ট্র’ নেই। এর কারণ হল, দেশগুলো বহুদিন ধরে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা শাসিত হয়েছে, যার ফলে তাদের মধ্যে ‘সৃষ্টি’ হয়েছে পারস্পরিক বিভেদ। 

একটি ইসলামি ‘কোররাষ্ট্র’ না-থাকার দরুন মুসলমান এবং অমুসলমান নির্বিশেষে সকলের জন্যই অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে (বিষয়টি অধ্যায়-৭-এ আলোচিত হবে)। লাটিন আমেরিকার জন্য স্পেনীয় ভাষাভাষিসমৃদ্ধ দেশগুলোর জন্য স্পেন একটি ‘কোররাষ্ট্র’ হতে পারত, স্পেন যদি ইউরোপে নিজেকে সে- পর্যায়ে নিতে পারত। ভৌগোলিক পরিসীমা, সম্পদ, জনসংখ্যা, সামরিক শক্তি, অর্থনীতি, দক্ষতা ইত্যাদি বিবেচনায় ব্রাজিল লাতিন আমেরিকায় ‘কোররাষ্ট্র’ হবে বলে ধারণা করা যায়। লাটিন আমেরিকার জন্য ব্রাজিলের অবস্থান তেমন, যেমন ইসলামের প্রশ্নে ইরানের অবস্থান। অন্য যে-কোনোভাবে ‘কোররাষ্ট্রের’ মর্যাদাপ্রাপ্ত হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও উপসভ্যতার পার্থক্য থাকার কারণে (ইরানের ক্ষেত্রে ধর্ম আর ব্রাজিলের ক্ষেত্রে ভাষা) তারা উভয়ে কোররাষ্ট্রের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। লাটিন আমেরিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র, যেমন ব্রাজিল, মেক্সিকো, ভেনিজুয়েলা এবং আর্জেন্টিনা প্রমুখ পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার দ্বার প্রশস্ত করছে। তবে, লাটিন আমেরিকার বিষয়টি জটিল হয়েছে এ কারণে যে, মেক্সিকো উত্তর আমেরিকার পরিচয় ধারণ করতে চায়, আর চিলি এবং আরও কিছু দেশ তাকে অনুসরণ করতে আগ্রহী। এমতাবস্থায়, লাটিন আমেরিকায় একক সভ্যতার ধারণা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। 

সাহারা-আফ্রিকার যে-কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে ‘কোররাষ্ট্রে’ উপনীত হয়ে আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টি সীমাবদ্ধতার জালে আটকে গিয়েছে মূলত একটি কারণে, তা হল, ফরাসিভাষাভাষি ও ইংরেজিভাষাভাষি আফ্রিকার দেশসমূহের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ। কিছু সময়ের জন্য আইভরি কোস্ট ‘কোররাষ্ট্রের’ মর্যাদা পেয়েছিল। তবে তা কেবলমাত্র ফরাসিভাষাভাষি আফ্রিকার মধ্যে সীমিত ছিল। যাহোক, আফ্রিকার ফরাসিভাষাভাষি ‘কোররাষ্ট্র’ স্বাধীনতা-উত্তরকালেও ফরাসিদেশ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। 

আফ্রিকায় মূলত দুটি রাষ্ট্র ‘কোররাষ্ট্র’ হওয়ার সকলপ্রকার যোগ্যতা রাখে, কিন্তু তারা দুটিই ইংরেজিভাষাভাষি আফ্রিকার দেশ। ভৌগোলিক সীমানা, সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র, অবস্থান, ইত্যাদি নাইজেরিয়াকে একটি শক্তিশালী ‘কোর’রাষ্ট্রের মর্যাদায় নিয়ে যেতে পারলেও আন্তঃসভ্যতাসংক্রান্ত অনৈক্য, ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থার সংকট, অর্থনৈতিক সমস্যা ও টানাপড়েন নাইজেরিয়াকে উক্ত পদের ভূমিকা পালন করতে দিচ্ছে না; যদিও মাঝেমধ্যে দেশটি তদ্রূপ কিছু কাজকর্ম করে থাকে। দক্ষিণআফ্রিকায় শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি, শিল্পের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও এর শক্তি, আফ্রিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় উচ্চ অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, সামাজিক শক্তি ও সামর্থ এবং সেখানকার খুবই উপযুক্ত সাদা এবং কালো নেতৃত্ব তাকে পরিষ্কারভাবে আফ্রিকার নেতৃত্বের আসনে স্থাপন করতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ- অংশের আফ্রিকা ও ইংরেজভাষাভাষি আফ্রিকার অংশের জন্য তা প্রযোজ্য হতে পারে। 

একটি ‘একাকিত্বসুলভ’ দেশ সাংস্কৃতিকভাবে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে মিল খুঁজে পায় না। উদাহরণ হিসেবে ইথিওপিয়ার নাম উল্লেখ করা যায়। এদেশটি সাংস্কৃতিকভাবে পৃথক, তাদের ভাষা এমহারিক ইথিওপীয় অক্ষরে লিখিত; এর প্রধান ধর্ম হল কোপটিক অর্থোডক্স; এর শাসনের ইতিহাস এর ধর্মীয় পার্থক্যসূচক দিক যা প্রায় মুসলমানদের দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি দেশ। অন্যদিকে, হেইতির এলিটবৃন্দ ঐতিহ্যগতভাবে ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। হেইতির ক্রেওলি ভাষা, ভোডো ধর্ম, বৈপ্লবিক উৎসসমূহের দাসত্বের চরিত্র এবং নৃশংস ইতিহাস ঐতিহাসিকভাবে এদের একাকিত্ব চরিত্রের রাষ্ট্রে পরিণত করে রেখেছে। সিডনি মিনতাজ বলেছেন যে, ‘প্রত্যেক জাতির চরিত্রই স্বতন্ত্র, কিন্তু হেইতি তার ভেতরেও একাই একটি শ্রেণী।’ ফলে ১৯৯৪ সালে হেইতির দুর্দিনে লাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো হেইতির সমস্যাকে লাতিন আমেরিকার সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেনি। এ-কারণে তারা হেইতির উদ্বাস্তুদের গ্রহণ করতে চায়নি, যদিও তারা কিউবার উদ্বাস্তুদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়নি। লাটিন আমেরিকার পানামার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘হেইতিকে আমরা লাটিন আমেরিকার দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিই না। হেইতীয়রা ভিন্নভাষায় কথা বলে থাকে। তাদের নৃগোষ্ঠীর উৎসও ভিন্ন, তাদের সংস্কৃতিও ভিন্ন। সকল বিচারে তারা সর্বতোভাবে ভিন্নতর।’ হেইতি একইভাবে ক্যারিবীয় এলাকায় ইংরেজিভাষাভাষিদের থেকেও পৃথক। হেইতীয়দের সম্পর্কে একজন মন্তব্য করেন যে, “তারা গ্রানাডা বা জ্যামাইকার মতো আগন্তুক, ‘যেমনটি আইয়া অথবা মন্তানার মানুষের ক্ষেত্রে মনে করা হয়ে থাকে।’ হেইতিকে প্রতিবেশী হিসেবে কেউই কামনা করে না। সুতরাং এটি একটি আত্মীয়-পরিজন পরিত্যাজ্য দেশ। 

জাপান হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘একাকিত্ব’সম্পন্ন দেশ। কোনো দেশের সঙ্গেই জাপানের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির মিল নেই। জাপানের অভিবাসীগণ অন্যদেশে সংখ্যায় খুব বেশি নয়, কিংবা তারা অভিবাসিত দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতেও পারে না। জাপানের ‘একাকিত্বের’ আরও একটি বড় কারণ হল জাপানের সংস্কৃতি খুবই বিশেষায়িত এবং জাপান সর্বজনীন কোনো ধর্ম (যেমন খ্রিস্টধর্ম বা ইসলাম) অথবা মতাদর্শের (উদারতাবাদ, সাম্যবাদ) দ্বারা তেমন প্রভাবিত হয়নি। 

প্রায় সকল রাষ্ট্রই কিন্তু বহুধাবিভক্ত সংস্কৃতির প্রতিভূ। প্রায় সকল দেশেই দুই বা ততোধিক নৃগোষ্ঠী, বর্ণ এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর অবস্থান থাকে। অনেক দেশেই অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত ভিন্নতা ওইসব দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাকে অস্থিতিশীল করে তোলে। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এবং সংহতির সংকট হয়ে ওঠে প্রধান। তবে সময়ের আবর্তে এসব ভিন্নতার নিরিখে সংঘাতের আকার-প্রকারও বদলায়। গভীর ধরনের বিভেদ একটি দেশের মধ্যে গুরুতর সহিংসতা ডেকে আনতে পারে। এমনকি দেশটির অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে। যদি ভৌগোলিকভাবে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল বিচ্ছিন্ন থাকে, তবে এরূপ সংঘাতের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। যদি সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থান একত্রিত না হয়, তবে সেখানে হয় গণহত্যা কিংবা জোরপূর্বক অভিবাসন প্রক্রিয়া কার্যকর হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিকভাবে ফাটলযুক্ত দেশের ক্ষেত্রে ব্যাপক ও গভীর বিভেদ আসতে পারে। কেননা সেক্ষেত্রে একটি দেশের অভ্যন্তরে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা বিরাজ করে থাকে। এসব অবস্থায় সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন, যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ভিন্নসভ্যতার হওয়ায় তারা দেশটিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে নিজেদের দৃষ্টিতে পরিচালিত করতে চায়। ফলে, অন্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার মানুষজন বঞ্চনার শিকার হলে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠদের ভাষা, ধর্ম, প্রতীকসমূহ হুমকির মধ্যে পড়ে যায়; যেমন হিন্দু, সিংহলী এবং মুসলমান এ-ধরনের কার্যকলাপ ভারত, শ্রীলংকা এবং মালয়েশিয়ায় করছে। 

ফাটলযুক্ত দেশ, যার ভূখণ্ড বিভিন্ন সভ্যতার ফাটলরেখাকে উতরিয়ে যেতে চায়, তারা ঐক্য বজায় রাখতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সুদানের গৃহযুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে উত্তরের মুসলমান এবং দক্ষিণের খ্রিস্টানদের মধ্যে চলছে। একইভাবে এবং প্রায় একই সময় ধরে একই সভ্যতার অন্তর্গত সংঘাত নাইজেরিয়ায় ঘটে চলেছে। এটি যুদ্ধ ও অত্যুত্থানপ্রবণ জাতিগত দাঙ্গা এবং সেইসঙ্গে অন্য সকলপ্রকারের সহিংসতা নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে। তানজানিয়াতেও এমন সমস্যা অহরহ পরিদৃষ্ট হচ্ছে। কেনিয়াতে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যকার বিভেদ সংঘাতময় হয়ে রয়েছে। আফ্রিকার একদিকের চাকুর ফলায় ইথিওপিয়ার খ্রিস্টান এবং ব্যাপক সংখ্যক ইরিত্রীয় মুসলমানগণদের মধ্যে সংঘাতের পরিণতিতে ১৯৯৩ সালে তারা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

ভারতেও সভ্যতা-সংক্রান্ত ফাটলরেখা সক্রিয় রয়েছে যা হিন্দু ও মুসলমান বিরোধ হিসেবে স্পষ্ট। শ্রীলংকায় সিংহলী বৌদ্ধ এবং তামিল হিন্দুদের মধ্যে সংঘাত সজীব রয়েছে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে চীনা ও মালয়া মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত অহরহ দেখা যায়, চীনে ‘হান’, চীনা তিব্বতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়, চীনে বসবাসরত তুর্কীয় বংশউদ্ভূত মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত রয়েছে। ফিলিপাইনে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নিয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে মুসলমান এবং তিমুরের খ্রিস্টানদের মধ্যে সংঘাত। 

সভ্যতার ফাটলরেখা বিভেদিত ফলাফল শীতলযুদ্ধাবস্থায় মার্কসীয় লেনিনীয় মতাদর্শের নিরিখে বৈধকৃত কর্তৃত্ববাদী কম্যুনিস্ট শাসনের ফলে সৃষ্ট চিড় থেকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়। কম্যুনিজমের পতনের ফলে সংস্কৃতি মতাদর্শের স্থলাভিষিক্ত হয়। এর ফলে বিশেষ করে যুগোস্লাভিয়া ও সোভিয়েট ইউনিয়ন সভ্যতার ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। প্রাক্তন সোভিয়েটের বাল্টিক (প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক), অর্থোডক্স, এবং মুসলমান-অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রসমূহে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ক্যাথলিক স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া, অংশত মুসলমান-অধ্যুষিত বসনিয়া- হার্জেগোভিনা এবং অর্থোডক্স সার্বিয়া-মান্টিনিগ্রো এবং মেসিডোনিয়া প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার উল্লিখিত এলাকাসমূহ সভ্যতার ধারায় নিজস্ব গতিসম্পন্ন হয়ে ওঠে। 

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা সার্বিয়া যুদ্ধের ফলে মুসলমান এবং ক্রোয়েশীয় অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। ক্রোয়েশিয়ায় সার্বিয় ও ক্রোয়াটরা একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধরত হয়ে পড়ে। স্লাভিক অর্থোডক্স সার্বিয়ায় এবং আলবেনিয়ার মুসলমানগণ কসোভোতে কতটুকু টিকে থাকবে তা একটি অনিশ্চিত বিষয়। আর্থোডক্স সার্বিয়ার টিকে থাকাটা খুবই অনিশ্চিত। তথায় আলবেনীয় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এবং স্লাভিক অর্থোডক্স মেসিডোনীয়দের মধ্যে উত্তেজনা লেগে রয়েছে। প্রাক্তন সোভিয়েট প্রজাতন্ত্রের অনেক অংশই ফাটলরেখাজনিত বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। কারণ, তৎকালীন সোভিয়েট কর্তৃপক্ষ কর্তৃত্বমূলকভাবে সীমানা চিহ্নিত করেছিল, ফলে প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। রুশ ক্রিমিয়ার ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল, আর্মেনীয় নাগারনো-কারাবাগ সংঘাত রয়েছে আজারবাইজানের সঙ্গে। রাশিয়ায় বিভিন্ন অংশে ক্ষুদ্র হলেও মুসলমান জনগোষ্ঠী (সংখ্যালঘিষ্ঠ) ছিল, যাদের বেশিরভাগেরই অবস্থান ছিল উত্তর ককেশীয় এবং ভল্গা অঞ্চলে। ইস্টোনিয়া, লাটভিয়া, কাজাকিস্তানে প্রচুর পরিমাণে সংখ্যালগিষ্ঠ রুশ বসবাস করত। ইউক্রেন আবার দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে—জাতীয় ভাষাভাষি ইউক্রেন-পশ্চিমাঞ্চল, যারা ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলত, আবার পূর্বাঞ্চলে থাকত অর্থোডক্স রুশ-ভাষাভাষি ইউক্রেনীয়। 

সভ্যতার ফাটলরেখা সম্বলিত রাষ্ট্রের প্রভাবশালী দুটি বা ততোধিক গোষ্ঠী রয়েছে। ‘আমরা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ এবং ভিন্ন অবস্থান থেকে এসেছি।’ একটি ছিনরাষ্ট্র একটি একক সভ্যতা ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। তবে তার নেতৃত্বে থাকা এলিটগণ অন্য সভ্যতার প্রতি অনুরক্ত থাকেন এবং দেশকে সে-পথে নিয়ে যেতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তারা বলেন, ‘আমরা এক জাতীয় মানুষ, একই স্থানে থাকছি, কিন্তু আমরা সেই স্থান বদলাতে ইচ্ছুক।’ সভ্যতার ফাটলসংশ্লিষ্ট দেশের মতো না হয়ে ছিন্নরাষ্ট্রের জনগণ সাধারণত একমত হন। কিন্তু ঐকমত্যে আসতে ব্যর্থ হন যে, তাদের জন্য কী ধরনের সভ্যতা মানানসই। গতানুগতিকভাবে দেখা যায় যে, তাদের নেতৃত্বের একটি বড় অংশ কেমালপন্থী কৌশল গ্রহণে উদ্‌গ্রীব থাকেন এবং সিদ্ধান্ত দেন যে, তাদের দেশ অপাশ্চাত্য সভ্যতার পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে পাশ্চাত্যমুখী হয়ে. উঠুক, পাশ্চাত্যের ধাঁচে প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে উঠুক এবং আধুনিকীকরণসহ পাশ্চাত্যকরণ সম্পন্ন হোক। পিটার দি গ্রেট-এর সময়ে রাশিয়া ছিল একটি ছিনরাষ্ট্র। এসময় তারা পাশ্চাত্যকরণ প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেননা প্রশ্ন দেখা দেয়, তারা কি পাশ্চাত্যমুখী হবে নাকি ইউরেশিয়ান অর্থোডক্স হিসেবে ভিন্নতা বজায় রেখেই সামনে এগুবে। মোস্ত ফা কেমালের দেশ তুরস্ক অবশ্যই ছিল একটি ধ্রুপদী ধরনের ছিন্নরাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রটি ১৯২০ সাল থেকে আধুনিকাভিমুখী হয়েছিল। হয়েছিল পশ্চিমামুখীও এবং বলাবাহুল্য, তা পাশ্চাত্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। 

প্রায় দুইদশক কাল অবধি মেক্সিকো লাটিন আমেরিকার দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অস্বীকার করে এসেছিল। কিন্তু এর নেতৃত্ব ১৯৮০-এর দশকে তাদের রাষ্ট্রকে একটি ছিন্নরাষ্ট্রে পরিণত করে, যখন তারা নিজেদেরকে উত্তর আমেরিকার অন্তর্গত ভাবতে শুরু করে। বিপরীতভাবে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়া তাদের দেশকে পশ্চিমা সভ্যতার অংশ হিসেবে বিবেচনা না করে এশীয় হিসেবে দেখতে শুরু করে। এর ফলে এদেশটিকে তারা একটি ছিন্নদেশ হিসেবে ফিরিয়ে নেয়। ছিন্নরাষ্ট্রকে মোটামুটি দুভাবে চিহ্নিত করা যায় : তাদের নেতারা নিজেদেরকে দুটি সভ্যতার ‘মিলন সেতু’ হিসেবে গণ্য করে থাকেন। রাশিয়া পশ্চিম এবং পূর্বপানে তাকিয়ে থাকে। তুরস্ক পূর্ব, পশ্চিমের মধ্যে যেটি উত্তম তাকেই চায়। অস্ট্রেলিয়া জাতীয়তাবাদী ধারায় বিভক্ত আনুগত্যের নিগড়ে আবদ্ধ … 

ছিন্নরাষ্ট্রসমূহ : সভ্যতা স্থানান্তকরণের ব্যর্থতা 

একটি ছিন্নরাষ্ট্রকে কৃতকার্যতার সঙ্গে তার সভ্যতা-সংক্রান্ত পরিচয় পুনঃনির্ধারণের জন্য কমপক্ষে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রথমত, দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক এলিটগণের সমর্থন লাগবে। দ্বিতীয়ত, জনগণের দ্বারা সভ্যতার ও পরিচয় পুনঃনির্ধারণ কার্যক্রম সমর্থিত হতে হবে। তৃতীয়ত, প্রভাববিস্তারকারী সভ্যতাকে (সাধারণত পাশ্চাত্য বিশ্বে) অবশ্যই পরিচয় পুনঃনির্ধারণে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করতে হবে। পরিচয় পুনঃনির্ধারণের প্রক্রিয়া সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। এটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বেদনাদায়ক ও শ্রমসাধ্য। তারপরও এর ব্যর্থতাই সত্য হয়ে ওঠে। 

রাশিয়া 

১৯৯০-এর দশকে মেক্সিকো বহু বৎসর যাবৎ ছিন্নরাষ্ট্র হিসেবে ছিল, আর তুরস্ক ছিন্নরাষ্ট্র হিসেবে ছিল কয়েক দশক। বিপরীতভাবে রাশিয়া একটি ছিন্নরাষ্ট্র হিসেবে ছিল কয়েক শতাব্দী। রাশিয়ার আরও একটি পার্থক্য রয়েছে মেক্সিকো ও তুরস্কের সঙ্গে, আর তা হল, রাশিয়া প্রধান সভ্যতাসমূহের জন্য একটি ‘কোররাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করছে। যদি মেক্সিকো ও তুরস্ক সফলতার সঙ্গে নিজেদেরকে পাশ্চাত্য সভ্যতাভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় পুনঃনির্ধারণ করতে পারে, তাহলে ইসলাম অথবা লাটিন আমেরিকার সভ্যতা গুরুত্বহীন বা নরমপন্থী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, রাশিয়া যদি পাশ্চাত্যদেশের মতো হয়ে যায়, তবে তার অর্থোডক্স ধর্ম বিলীন হয়ে যায়। সোভিয়েট ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার পর রুশদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয় এ নিয়ে যে, তারা কি রুশ হয়ে থাকবে, নাকি পাশ্চাত্য পরিচয়ে পরিচিত হবে? 

পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক চারটি স্তরে কার্যকর থাকতে দেখা যায়। প্রথম পর্যায় ১৬৮৯-১৭২৫ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ, এটি পিটার দি গ্রেট-এর পদত্যাগ পর্যন্ত বিস্তৃতি। কাইভানরাশ পৃথকভাবে থাকতে চেয়েছেন এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল খুবই ক্ষীণ। বাইজানটাইন সভ্যতার একটি উপসৃষ্টি হিসেবে রুশীয় সভ্যতার উন্নয়ন ঘটতে থাকে। তারপর প্রায় ২০০ বৎসর, অর্থাৎ ১৩শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ১৫শ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত রাশিয়া মঙ্গলদের অধীনে চলে যায়। তাই রাশিয়ার ঐতিহ্য মোটেও পাশ্চাত্য সভ্যতার ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল না। রোমান ক্যাথলিকত্ব, সামন্তবাদ, রেনেসাঁ, ধর্মীয় পুনঃজাগরণ, সুদূর বিদেশে কলোনি বিস্তার, বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষর যুগ, এবং জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব—এর কোনোকিছুই রাশিয়াকে তেমন আন্দোলিত করেনি। পূর্বনির্ধারিত পাশ্চাত্যসভ্যতার ৭ অথবা ৮টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, যেমন—ধর্ম, ভাষাসমূহ, ধর্ম থেকে রাজনীতির পৃথকীকরণ, আইনের শাসন, সামাজিক বহুত্ববাদিতা, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ইত্যাদি রুশদের নিকট ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। একটিমাত্র বিষয় সেখানে ছিল, আর তা হল, ধ্রুপদী ‘লিগাসি’ যা বাইজানটাইনের মাধ্যমে রুশদের নিকট পৌঁছেছিল। রোম থেকে পাশ্চাত্যে যেভাবে প্রত্যক্ষভাবে এসেছিল রাশিয়ায় তা সেভাবে আসেনি। তাই এর খাঁটিত্ব নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। রাশিয়ার সভ্যতার শেকড় তার নিজস্ব ঐতিহ্য তথা কাইভান-রাশ এবং মস্কোভির মধ্যে গ্রথিত রয়েছে। সেসঙ্গে মিশেছে বাইজানটাইন ধারা এবং দীর্ঘস্থায়ী মঙ্গোলীয় শাসনের ফলাফল। এ-ধরনের সমাজে পাশ্চাত্য সভ্যতার ছোঁয়া তেমন ছিল না। 

সতেরো শতকের শেষের দিকে রাশিয়া কেবলমাত্র পাশ্চাত্য থেকে পৃথকই ছিল না বরং তা ইউরোপের তুলনায় ছিল পশ্চাৎপদ। ১৬৯৭-১৬৯৮ সালে ইউরোপ ভ্রমণের সময় পিটার দি গ্রেট বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর দেশ হিসেবে রাশিয়াকে আধুনিক ও পাশ্চাত্যমুখী করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর দেশের মানুষকে যাতে করে ইউরোপীয়দের মতো দেখায় সেজন্য পিটার মস্কোতে ফিরে এসেই তাঁর পারিষদবর্গ ও অভিজাতদের দাড়ি কামিয়ে ফেলতে নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে তাদের লম্বা গাউন পরা ও লম্বা টুপি পরা নিষিদ্ধ করেন। যদিও পিটার ‘সাইরিলিক অক্ষর’ বাতিল করেননি তবুও রুশভাষায় পাশ্চাত্য শব্দাবলি ও প্রবচন সংযোজন করেন। তিনি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য মনোযোগ দেন। তিনি নৌবাহিনী সৃষ্টি করেন। সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করার বিধান জারি করেন। সামরিক শিল্প স্থাপন করা হয়। প্রযুক্তিশিক্ষা প্রসারের জন্য টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন করেন। তিনি তাঁর দেশের শিক্ষার্থীদের পাশ্চাত্যদেশে শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করেন। পাশ্চাত্যদেশ থেকে তিনি সর্বাধুনিক সামরিক ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন পুস্তকাদি আমদানির ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাহাজনির্মাণ, নোঙরবিদ্যা, আমলাতন্ত্র ও জনপ্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীর জন্য প্রয়োজন আছে এমন জ্ঞানভাণ্ডার। তিনি উদ্ভাবনীশক্তিকে উৎসাহিত করতে থাকেন। কর ও সরকারব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনেন। তিনি রাশিয়াকে ইউরোপের একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এজন্য মস্কোকেন্দ্রিক চিন্তা ও কর্ম বর্জন করেন। তাই মস্কো থেকে রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে স্থানান্তর করেন। তিনি সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এটি প্রমাণ করার জন্য যে, বাল্টিক এলাকায় রাশিয়াই শ্রেষ্ঠ এবং তার শক্তিই প্রধান এবং এভাবে ইউরোপে নিজেদের স্থান পাকাপোক্ত করতে তিনি প্রয়াসী হন। 

পিটার তাঁর দেশ রাশিয়াকে আধুনিক ও পাশ্চাত্যমুখী করতে রাশিয়ার এশীয় চরিত্রের ওপর হস্তক্ষেপ করেন। তিনি রাশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে সংস্কার আনতে চেষ্টা করেন। রাশিয়ার উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন মানুষজন জ্ঞানের দিক থেকে কখনও শক্তিশালী ছিল না। পিটার তাঁদের ক্ষমতা আরও হ্রাস করেন। শুধু বংশমর্যাদা নয়, পদপ্রাপ্তির বেলায়ও তিনি জ্ঞান ও মেধা যাচাইয়ের ব্যবস্থা করেন, তাই গতানুগতিক ধারার জন্মপরিচয় ও সামাজিক অবস্থার মানদণ্ডে পদপ্রাপ্তির প্রচলনে ছেদ পড়ল। রাশিয়ার কৃষকদের ওপর আরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হল। 

অর্থোডক্স চার্চকে তিনি রাষ্ট্রীয় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার জন্য কিছু কাঠামোগত সংস্কার করেন। পিটারের অনুসৃত পথ পরবর্তীতে রাশিয়াকে আধুনিক ও পাশ্চাত্য ধাঁচের করতে অর্থাৎ ‘পেট্রোন মডেল’ পরবর্তীতে লেনিন, স্টালিন এবং অল্প করে হলেও ক্যাথরিন এবং আলেকজান্ডার-২ অনুসরণ করতে চেয়েছেন। এর ফলে রাশিয়া মূলত পাশ্চাত্যকরণকৃত রাশিয়া এবং শক্তিশালী স্বৈরশাসনসম্পন্ন রাশিয়ায় পরিণত হতে থাকে। 

১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত দেখা যায়, যারা রাশিয়ায় গণতন্ত্র চেয়েছেন তারা এর পাশ্চাত্যকরণও চেয়েছেন। অন্যদিকে যারা পাশ্চাত্যকরণ চেয়েছেন তারা গণতন্ত্র তেমন চাননি। রাশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সেখানে শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসনকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পূর্বশর্ত মনে করা হয়। ১৯৮০-এর দশকে গর্বাচেভের সহযোগীরা তাদের ব্যর্থতাকে ‘গ্লাসনোস্ত’-এর দর্শনের দিক থেকে অর্থনৈতিক উদারতাবাদের মধ্যে দেখতে চান। 

পিটার রাশিয়াকে ইউরোপের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চাইতে বরং ইউরোপকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে বেশি সফলকাম ছিলেন। অটোম্যান সাম্রাজ্যের মতো না হয়ে রুশ-সাম্রাজ্যবাদ ইউরোপের একটি বৈধ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সেভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাশিয়া ইউরোপীয় ভাবমূর্তির অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। রাশিয়ার অভ্যন্তরে পিটার সমাজ-পরিবর্তনের লক্ষ্যে কিছু সংস্কার হাতে নিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরেও রাশিয়া একটি মিশ্রসমাজ হিসেবেই থেকে যায়, যা পুরোপুরিভাবে রুশ বা ইউরোপীয় কোনোটিই ছিল না। কেননা তারপরেও রাশিয়ার ক্ষুদ্র এলিট সম্প্রদায় এশীয় ও বাইজান্টাইন জীবনধারা ও প্রতিষ্ঠানাদি, বিশ্বাসমূহ ইত্যাদি হিসেবে থেকে গিয়েছিল। 

ডি. মিইস্ট্রি বলেন, ‘কেউ ভাবে তারা আঁচড় খাওয়া রুশ’ ‘এবং অন্যরা তাতার’। পিটার রাশিয়াকে একটি ছিন্নরাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্লাভোফিলস্ এবং পাশ্চাত্যপন্থীরা যুক্তভাবে শোকাতুর হয়ে পড়ে। কেননা তারা রাশিয়ার এ অবস্থাকে অসুখী মনে করতে থাকেন। তারা মনে করতে থাকেন, রাশিয়া এখন “না ঘরকা না ঘাটকা’—অর্থাৎ পশ্চিমাবিশ্বের মতো নয়, আবার পুরোপুরি রুশ ও নয়। তাই তারা পাশ্চাত্যকরণ প্রক্রিয়া দূর করে আবার ‘রুশ আত্মার’ ভেতরে ফিরে আসার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়েন। 

চাদায়েভের মতো পাশ্চাত্যপন্থীরা যুক্তি দেখান যে, ‘সূর্য হল পশ্চিমের অধীন, এবং রাশিয়াকে অবশ্যই ওই সূর্যের আলো ব্যবহার করে তার কালিমাযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও অভ্যাসাদি বদলাতে হবে। ডানিলেভসকি-এর মতো স্লাভোফিল বলেন যে, রাশিয়ার ইউরোপীয়করণ আসলে ‘বিকৃতকরণ এবং রাশিয়ার মানুষকে ও তাদের জীবনকে বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার নামান্তর’, ‘বিদেশী প্রতিষ্ঠান রাশিয়ায় আমদানিপূর্বক তা রাশিয়ার মাটিতে রোপণ করার মনমানসিকতা মোটেও সুস্থ নয়…। রাশিয়ার পরবর্তী ইতিহাসে দেখা যায় যে, পিটার পশ্চিমাপন্থীদের নায়কে পরিণত হন এবং বিরোধীদের নিকট ‘শয়তান’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। ১৯২০ সালে কিছু উগ্রপন্থী পিটারকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বা ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বিপরীতে পশ্চিমাদের ঘৃণাকারী হিসেবে বলশেভিকদের প্রশংসা করতে থাকে। এমতাবস্থায় তারা ইউরোপের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন এবং রাজধানী আবার মস্কোতে ফিরিয়ে আনেন। 

বলশেভিক বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার সঙ্গে পাশ্চাত্যের সম্পর্কের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়, যা ছিল দুই শতাব্দী ধরে বিরাজমান সম্পর্কের বিপরীত একটি ধারা। এই বিপ্লব একটি মতাদর্শের নামে এমন একটি রাজনীতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করে যার তাত্ত্বিক ভিত্তির উৎস পশ্চিমাবিশ্ব হলেও পশ্চিমে ওই মতাদর্শের তেমন মূল্য ছিল না। স্লাভোফিলস্ এবং পাশ্চাত্যপন্থীদের ভেতর বিতর্কের সূচনা হয় এ নিয়ে যে, রাশিয়া কি পাশ্চাত্যের তুলনায় পশ্চাৎপদ না হয়েও পশ্চিমাবিশ্ব থেকে ভিন্ন হয়ে থাকবে? কম্যুনিজম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এ বিতর্কের অবসান ঘটায়। এতে বলা হয়, রাশিয়া মৌলিক অর্থে পশ্চিমাজগৎকে অস্বীকার করে এজন্য যে, মনে করা হত, এই ব্যবস্থাটি পশ্চিমাবিশ্বের চলমান ব্যবস্থা থেকে অনেক অগ্রসর ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাটি সর্বহারা বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সূচিত হয় এবং পরবর্তীতে বিশ্বের নানা স্থানে তা ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ায় যে শুধু এশীয়সুলভ পশ্চাৎপদতার পটভূমি ছিল তাই নয়; সেইসঙ্গে ছিল সামনে এগিয়ে যাবার অমিত সম্ভাবনা। কার্যত রাশিয়া পাশ্চাত্যকে ল্যাং মেরে এগিয়ে যেতে থাকে, ‘পাশ্চাত্য আমাদের থেকে পৃথক, আমরাও তোমাদের মতো নই’, (এ যুক্তিটি স্লোভোফিলসদের দেয়া) কেননা ‘আমরা পৃথক এবং প্রত্যাশা করা যায়, তোমরাও ভবিষ্যতে আমাদের পথের পথিক হবে’। কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবাদের বাণীও কিন্তু প্রায় অনুরূপ। 

একই সময়ে কম্যুনিজম সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতৃত্বকে পাশ্চাত্য থেকে নিজেদের পৃথক ভাবতে সক্ষম করে দেয়। তবে একথাও সত্য, তারা পাশ্চাত্যের সঙ্গে একটি শক্তিশালী যোগাযোগ-বন্ধনও তৈরি করে ফেলে। মার্কস এবং এঙ্গেলস ছিলেন জার্মান জাত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তাদের অনুসারীদের মূল প্রধানবর্গের অধিকাংশেই ছিলেন পশ্চিম ইউরোপীয়। ১৯১০ সালের ভেতর অনেক শ্রমিক ইউনিয়ন এবং ‘সোশ্যাল ডিমোক্রাটস্’ এবং পশ্চিমা শ্রমিকদলসমূহ কম্যুনিজমের মতাদর্শ দ্বারা শাণিত হয়ে ওঠে এবং পশ্চিম ইউরোপের রাজনীতিতে তাদের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে ফেলে। বলশেভিক বিপ্লবের পর বামঘেঁষা দলগুলো ‘কম্যুনিস্ট’ এবং ‘সোশ্যালিস্ট’ এই দুধারায় বিভক্ত হয়ে পড়লেও তারা পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহে উভয়েই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। প্রায় সমগ্র পশ্চিমাবিশ্বব্যাপী মার্কসীয় মতবাদ বজায় থাকে। কম্যুনিজম ও সমাজতন্ত্রকে ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে এবং ব্যাপকভাবে তা যে-কোনোভাবে রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। রাশিয়ার স্লোভোফিলস্ এবং পশ্চিমাপন্থীদের মধ্যে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্কের ন্যায় পশ্চিমাবিশ্বেও বাম ও ডান ধারার মধ্যে বিতর্ক তেতে ওঠে এবং এরকম আশঙ্কা করা হয় যে, সোভিয়েট ইউনিয়ন ভবিষ্যতের জন্য ‘প্রতীক’ হয়ে উঠবে। 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধাবসানের পরে সোভিয়েট ইউনিয়ন তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হয় এবং কম্যুনিজমের আবেদন ইউরোপসহ অন্যত্র আরও বৃদ্ধি পায়। তবে অপাশ্চাত্য সমাজে এর ব্যাপ্তি ঘটে বেশি; যারা কি-না মনস্তাত্ত্বিকভাবে পশ্চিমাবিদ্বেষী। পশ্চিমাবিশ্ব কর্তৃক প্রভাবিত অপাশ্চাত্য দেশের এলিটরা পশ্চিমাবিশ্বের গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে প্রলুব্ধ হয়; অন্যদিকে আবার বিপ্লব ও জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে নামতে চায়। 

রাশিয়া পাশ্চাত্য মতাদর্শ প্রয়োগপূর্বক নিজেকে শক্তিশালী করে পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতে যে কৌশল অবলম্বন করে তা ইতিহাসে পূর্বের যে- কোনো সময়ের চেয়ে রাশিয়াকে পাশ্চাত্যের অনেক নিকটবর্তী করে। যদিও উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং কম্যুনিস্ট মতাদর্শ আকাশ-পাতাল তফাৎ, তবুও উভয়পক্ষই প্রায় একই ভাষায় কথা বলে থাকে। আর বলাই বাহুল্য, সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের মধ্যদিয়ে এহেন রাজনৈতিক মতাদর্শিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার অবসান ঘটে। 

পাশ্চাত্যবিশ্ব প্রত্যাশা ও বিশ্বাস করে যে, সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের ভেতর দিয়ে সমগ্র প্রাক্তন সোভিয়েট সাম্রাজ্যে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের জয়গান ছড়িয়ে পড়বে। তবে তা পূর্ববিহিত ছিল না। কেননা দেখা যায় যে, ১৯৯৫ সালে রাশিয়া এবং সংশ্লিষ্ট অর্থোডক্স প্রজাতন্ত্রসমূহে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। উপরন্তু দেখা দেয় আর এক সংকট, তা হল, সোভিয়েট ব্যবস্থার পতনের পর রুশরা আর মার্কসবাদের দিকে ফিরে তাকাল না সত্য, কিন্তু তারা রুশঐতিহ্য অনুযায়ী কাজকর্ম করতে থাকায় পাশ্চাত্যবিশ্বের সঙ্গে তাদের তফাৎ আরও বাড়তে থাকে। মার্কস ও লেনিনবাদের সঙ্গে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দ্বন্দ্ব ও পার্থক্য থাকলেও উভয় মতাদর্শই কিন্তু আধুনিক ও লোকায়ত এবং উভয়ই চূড়ান্তভাবে মানুষের স্বাধীনতা, সভ্যতা এবং বস্তুগত উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। একজন পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবী সোভিয়েটের মার্কসবাদের সঙ্গে বিতর্কে ঝড় তুলতে পারেন, কিন্তু রাশিয়ার অর্থোডক্স জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তার কোনো উচ্চবাচ্য করার নেই। 

সোভিয়েত যুগে স্লোভাফিলস্ এবং পাশ্চাত্যপন্থীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব স্থগিত হয়ে যায় যখন সোলজেনিৎসিনস্ এবং শাখারভ উভয়ই কম্যুনিস্ট সংশ্লেষণকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। উক্ত সংশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে গড়া সমাজের পতনের পর রাশিয়ার পরিচয় সম্পর্কিত বিতর্ক চাঙা হয়ে ওঠে। রাশিয়া কি পাশ্চাত্য মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠানাদি প্রয়োগবাদিতা ইত্যাদি গ্রহণপূর্বক পাশ্চাত্যের অংশ হবে? অথবা রাশিয়া কি তার নিজস্ব স্বতন্ত্র অর্থোডক্স এবং ইউরোপীয় সভ্যতা এগিয়ে নেবে যা কি-না সকল ক্ষেত্রেই পশ্চিমাবিশ্ব ও প্রাচ্য থেকে পৃথক? বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক এলিট এবং সাধারণ গণমানুষ এই বিশেষ ইস্যুতে গুরুতরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন। 

একদিকে পাশ্চাত্যপন্থীরা ‘কসমোপলিটান’ অথবা ‘আটলান্টিসিস্ট’ এবং অন্যদিকে স্লোভোফিলসের উত্তরাধিকারদের ‘জাতীয়তাবাদ’ ‘ইউরোএশিয়ানিস্ট’ অথবা 

‘derzhavniki’ (রাষ্ট্রের শক্ত সমর্থক)। ২০ উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলোর ভেতর মূল পার্থক্য ছিল মূলত বৈদেশিক নীতি, অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম ও রাষ্ট্রের কাঠামো সংক্রান্ত মতপার্থক্য এবং প্রায়শই তা ছিল বিপরীতমুখী। একপ্রান্তের গোষ্ঠী বলতেন, “নব চেতনা ও চিন্তার ফসল, যার গোড়ায় ছিলেন গর্বাচেভ, তাদের লক্ষ্য ছিল একটি ‘সাধারণ’ ইউরোপীয় আবাসের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া”, আর ইয়েলৎসিন-এর উচ্চতর পরামর্শকরা চাইতেন রাশিয়া একটি স্বাভাবিক রাষ্ট্রের পথে চলুক এবং ৮-সদস্য-বিশিষ্ট জি-৭-এর সদস্য হয়ে রাশিয়া অগ্রগামী, শিল্পসমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে একাত্ম হোক। 

মধ্যমপন্থী জাতীয়তাবাদের চিন্তা ছিল ভিন্ন। যেমন সেরগেই স্টেনকিভিচ (Sergei Stankevich) যুক্তি দেখান যে, রাশিয়ার উচিত হবে ‘আটলান্টিসিস্টদেরকে বাদ দিয়ে রাশিয়ার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী’ যেমন তুর্কি ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলা এবং একটি গ্রহণযোগ্য বণ্টনব্যবস্থার মাধ্যমে রাশিয়ার সম্পদাদি বিলি করা, বিভিন্ন বিকল্প খুঁজে দেখা, বিভিন্নপ্রকার সংযোগস্থাপনের ওপর জোর দেয়া, এশীয় স্বার্থের সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং পূর্বদিকে নজর ফেরানো। এ-ধরনের মতাবলম্বীরা ইয়েলৎসিনের কার্যকলাপের সমালোচনা করে যে, তিনি রাশিয়াকে পশ্চিমের অধঃস্তন করেছেন, তিনি রুশ সেনাবহিনী সংকুচিত করেছেন, তিনি রাশিয়ার পুরাতন মিত্র, যেমন সার্বিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন এবং সর্বোপরি তিনি এমন একধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন, যা রাশিয়ার জনগণকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এ ধরনের চিন্তাচেতনা পিটার স্যাটেস্কিকে পুনরায় জনপ্রিয় করে তোলে, যিনি ১৯২০-এর দশকে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, ‘রাশিয়ায় আছে একটি স্বতন্ত্র ইউরেশিয়ান সভ্যতা’। 

রাশিয়ায় চরম জাতীয়তাবাদীরা কিছু কৌশলগত প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েন। রুশ জাতীয়তাবাদী সোলজেনিৎসিন (Solzhennitsyn) যুক্তি দেখান যে, রুশসহ অন্যান্য স্লাভিক অর্থোডক্স, বেলারুশীয়, ইউক্রেনীয় ব্যতীত অন্য কাউকে না নিয়ে রাশিয়া গঠন করতে হবে। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী ভ্লাদিমির জিরিনভস্কি চান যে, রাশিয়া পুনরায় সোভিয়েট-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করুক এবং এর সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা হোক। এই গোষ্ঠীর সমর্থকেরা একদা ছিলেন সেমিটিক বিরোধী এবং সেইসঙ্গে ছিলেন, পাশ্চাত্যবিরোধী। আর তারা চাইতেন রাশিয়ার বৈদেশিক নীতি হোক পূর্ব ও দক্ষিণ ঘেঁষা, যাতে মুসলমান-অধ্যুষিত দক্ষিণকে পদানত করা যায় (যেমন জিরিনভস্কি বলেছেন), কিংবা মুসলমানদের সঙ্গে সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করতে পারা যায়। চীনের সঙ্গেও অনুরূপ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, কেননা চীনও পাশ্চাত্যবিরোধী শক্তি। এই গোষ্ঠী মুসলমানদের সঙ্গে সৃষ্ট যুদ্ধে সার্বীয়দের সমর্থন দিতে ইচ্ছা পোষণ করে। দেখা যাচ্ছে ‘কসমোপোলিটান’ এবং জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে পার্থক্যের বিষয় ছিল দুটি : বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী। 

রাশিয়ার সাধারণ মানুষও তথাকার এলিটদের মতো বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৯২ সালে একটি জনমত যাচাইয়ের নমুনায় দেখা যায়, ২০৬৯ জন ইউরোপীয় রুশদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ বলে যে, ‘পশ্চিমকে আসতে দাও’। শতকরা ১৬ ভাগ জানায় যে, ‘পশ্চিমের নিকটবর্তী হও’। শতকরা ২৪ ভাগ কোনোপ্রকার সিদ্ধান্ত দেয়নি। তারা ছিলেন সিদ্ধান্তহীন। 

১৯৯৩ সালের সংসদীয় নির্বাচনে সংস্কারবাদি পার্টিগুলো পায় শতকরা ৩৪.২ ভাগ ভোট। সংস্কারবিরোধীরা লাভ করে শতকরা ১৩.৭ ভাগ ভোট। অনুরূপভাবে ১৯৯৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রুশরা পুনরায় বিভক্ত হয়ে পড়ে, কমবেশি শতকরা ৪৩ ভাগ মানুষ পশ্চিমাসমর্থক প্রার্থীকে ভোট দেয়, এদের মধ্যে ইয়েলৎসিন এবং অন্যান্য সংস্কারবাদীরাও ছিল। শতকরা ৫২ ভাগ ভোট পায় জাতীয়তাবাদী ও কম্যুনিস্ট প্রার্থীরা। এতে ধরে নেয়া যায় যে, কেন্দ্রীয় সমস্যার বিচারে ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়া ছিল একটি ‘ছিন্নরাষ্ট্র’।

তুরস্ক 

১৯২০-এর দশকে সুবিবেচিত সংস্কারমালা গ্রহণের পর ১৯৩০-এর দশকে মোস্তফা কেমাল আতাতুর্ক তুরস্কের জনগণকে তাদের অটোম্যান এবং ইসলামি অতীত থেকে সরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। ‘কেমালিজমের মূল স্তম্ভ (৬টি তীর) যথাক্রমে : বহুত্ববাদিতা, প্রজাতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রতন্ত্র এবং সংস্কারবাদিতা। বহুজাতিক সাম্রাজ্যের ধারণাকে বাদ দিয়ে মোস্তাফা কেমাল সমজাতিক মানুষের সমন্বয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রতি নজর দেন। এরই ধারাবাহিকতায় সেখানে আরমেনীয় ও গ্রিকদের বহিষ্কার ও হত্যা করা হয়েছিল। এরপর তিনি সুলতানকে পদচ্যুত করেন এবং বহুজাতিক ব্যবস্থার ক্ষমতাকেন্দ্রে পাশ্চাত্য ধরনের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। খিলাফত ছিল ধর্মীয় অনুশাসনের কেন্দ্রীয় সংগঠন; মোস্তফা কেমাল খেলাফত বাতিল করেন। গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা তিনি বাতিল করেন এবং সেইসঙ্গে ধর্মমন্ত্রণালয় বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তিনি বিলুপ্ত করেন পৃথক ধর্মীয় স্কুলসমূহ এবং তার স্থলে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সকলের জন্য এগিয়ে নেন। তিনি বিচারালয় থেকে ধর্মীয় ‘সেল’ বাতিল করেন এবং তার বদলে নতুন পাশ্চাত্য ধারা ‘সুইস সিভিল কোড’ চালু করেন। গতানুগতিক পঞ্জিকা বাতিল করে তদস্থলে তিনি জর্জীয় পঞ্জিকা চালু করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বাদ দেন। পিটার দি গ্রেটকে ছাড়িয়ে যাবার অভিপ্রায়ে তিনি তুরস্কে বিশেষ টুপি ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, কেননা ওই টুপি ছিল ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক। তার বদলে মানুষকে ‘হ্যাট’ মাথায় দিতে উৎসাহিত করেন। তিনি তুর্কিভাষার জন্য আরবি বর্ণমালা ব্যবহারের বদলে রোমান হরফ চালু করেন। এই ধরনের সাংস্কার অবশ্য মৌলিক ও সাহসী। তবে এতে করে নতুন প্রজন্মকে গতানুগতিক পুস্তকগুলো থেকে জ্ঞান আহরণ করতে বাধাগ্রস্ত করে তোলা হয়। এছাড়া বিপরীতভাবে এ পদক্ষেপের ফলে শিক্ষার্থীরা ইউরোপীয় ভাষা আয়ত্ত করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং এর ফলে ভাষা-সাহিত্য সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। জাতীয়, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তুর্কিদের পরিচয় পুনঃনির্ধারণ করতে বলা হয় এবং মোস্তফা কেমাল ১৯৩০-এর দশকে তুরস্কের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার ফলে পাশ্চাত্যকরণ ও আধুনিকীকরণ কার্যক্রম সেখানে হাতে হাত ধরে এগুতে থাকে। 

১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধে তুরস্ক নিজেকে নিরপেক্ষ অবস্থানে রেখেছিল। তবে যুদ্ধশেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুরস্ক নিজেকে পুনরায় পশ্চিমাবিশ্বের সাথে একাত্ম করে তোলে। পাশ্চাত্য ধাঁচের রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে একদলীয় শাসন থেকে প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা চালু করা হয়। ন্যাটোর সদস্যপদ অর্জন করতে তুরস্ক ধর্না দিতে শুরু করে এবং ১৯৫২ সালে তা অর্জন করে, এভাবে মুক্তবিশ্বের সদস্যপদ নিশ্চিত করা হয়। তুরস্ক পাশ্চাত্যবিশ্ব থেকে বিলিয়ন ডলার অর্জন করতে সক্ষম হয়, যা দিয়ে তুরস্ক অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো সুনিশ্চিত করে। তুরস্কের সামরিক বাহিনীকে পাশ্চাত্য সাজে সজ্জিত করা হয় এবং তারা পাশ্চাত্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করে। ন্যাটোর মাধ্যমে সামরিক বাহিনী আধুনিকীকরণের কাজ করা হয়। তুরস্কে আমেরিকার সেনাবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। তুরস্ককে ঘাঁটি করে পাশ্চাত্যজগৎ উত্তরদিক থেকে সম্ভাব্য ভূমধ্যসাগরের দিকে সোভিয়েট আগ্রাসন রোধ করা, মধ্যপ্রাচ্য বলয়াবদ্ধ করা এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বজায় রাখার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়। এসব কারণে ১৯৫৫ সালে বেনভাগ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে পাশ্চাত্যের সঙ্গে দহরম মহরমের অভিযোগে তুরস্ককে অভিযুক্ত করা হয় এবং মুসলমান রাষ্ট্র কর্তৃক তুরস্ককে ব্লাসফেমির অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে হয়।

শীতলযুদ্ধাবসানোত্তর সময়ে তুরস্কের এলিটগণ সর্বতোভাবে তুরস্কের পাশ্চাত্য ও ইউরোপীয়করণের পক্ষে সমর্থন জোগায়। তুরস্কের জন্য ন্যাটোর সদস্যপদ বহাল রাখা খুবই জরুরি। কারণ, এর ভেতর দিয়ে তুরস্ক পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে এবং প্রতিবেশী গ্রিসের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব করে থাকে। তুরস্ক এখন আর উপরের (সোভিয়েট) সম্ভাব্য ভীতি থেকে মুক্ত থাকার জন্য পাশ্চাত্যের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ দেশ নয়। তবুও যেহেতু উপসাগরীয় (গাল্ফ) যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে, সেহেতু পশ্চিমাবিশ্বের জন্য তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা প্রকারান্তরে দক্ষিণদিকের ভয়ভীতি থেকে মুক্ত থাকার শামিল। এইসব যুদ্ধে তুরস্ক সবসময়ই সাদ্দামবিরোধী জোটের সঙ্গে একাত্ম থাকে এবং বাস্তবেও সাদ্দামবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তুরস্ক তার ভূমি দিয়ে ইরাকের গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়, যে পাইপলাইন দিয়ে ভূমধ্যসাগরের বন্দরে ইরাকি তেল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া তুরস্ক ইরাকের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য মার্কিন যুদ্ধবিমানকে তার আকাশ দিয়ে চলতে অনুমতি দেয় এবং ঘাঁটিও ব্যবহার করার অনুমতি তাদের রয়েছে। ইরাকের বিরুদ্ধে পশ্চিমাবিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করার বিরুদ্ধে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ওজালের ওপর তুর্কিরা অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর এবং তাঁর বিদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া হয়। সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল স্টাফ অফিসারের পদত্যাগ চাওয়া হয়। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নমনীয় মনোভাবের জন্য ওজালের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এসব কারণে তুর্কি প্রেসিডেন্ট ডেমিরেল এবং প্রধানমন্ত্রী সিলার ইরাকের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহারের আবেদন জানায়। সে কারণে তুরস্কের অর্থনৈতিক ক্ষতি দৃশ্যমান ছিল। 

দক্ষিণের আক্রমণের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের সঙ্গে কাজ করা তুরস্কের জন্য ততটা নিশ্চিত ছিল না, যতটা নিশ্চিত ছিল সোভিয়েট ইউনিয়নের (উত্তরের) নিকট থেকে আসা ভয়ভীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার। গাযুদ্ধের সময়ও দেখা গিয়েছে তুরস্ক দক্ষিণের আক্রমণের ভয়ে ততটা কাহিল ছিল না। শীতলযুদ্ধকালীন তুরস্কের সভ্যতার পরিচয় নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন না-আসলেও শীতলযুদ্ধপরবর্তী সময়ে তুরস্কের সভ্যতার পরিচয় যেন আরববিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চাওয়া হয়। 

১৯৮০-এর দশকের তুরস্কের পশ্চিমাপন্থী এলিটদের প্রাথমিক মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তুরস্কের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ অর্জন করা। ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনিয়নের সদস্যপদের জন্য আবেদন জানায়। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তুরস্ককে জানানো হয় যে, তার আবেদনপত্রটি ১৯৯৩ সালের পূর্বে বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে না। ১৯৯৪ সালে ইউনিয়ন অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং নরওয়ের সদস্যপদ অনুমোদন দেয় এবং প্রত্যাশা করা হয় যে, আগামী বৎসর পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং চেক প্রজাতন্ত্র এবং তারপর সম্ভবত স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া এবং বাল্টিক প্রজাতন্ত্রসমূহের জন্য সদস্যপদ প্রদান করা হবে। তুরস্ক হতাশ হয়ে পড়ে। কেননা সেন্ট্রাল ইউরোপের দেশ এবং ইউনিয়নের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য জার্মানি তুরস্কের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সক্রিয় কোনো সমর্থন প্রদান করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে তুরস্কের সঙ্গে শুল্ক ইউনিয়ন স্থাপন করলেও পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ তুরস্কের জন্য একটি স্বপ্ন এবং কিছুটা রহস্যজনকভাবেই থেকে যায়। 

তুরস্ক ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার অভিপ্রায়ে সকল সময়ই কেন লাইনের শেষ প্রান্তে অপেক্ষমাণ? প্রকাশ্যে অবশ্য ইউনিয়নের কর্মকর্তারা জানান যে, তুরস্কের আয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশসমূহের অনেক নিচে। তাছাড়া তুরস্কের মানবাধিকারের সূচকও সন্তোষজনক নয়। তবে অপ্রকাশিত কারণ হল এই যে, তুরস্কের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে গ্রিসের উপর্যুপরি বাধাদান এবং আরও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল, তুরস্ক একটি মুসলমান দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের ৬০ মিলিয়ন মুসলমানদের জন্য, যার অধিকাংশ বেকার, তাদের সীমানা উন্মোচন করে রাখতে ইচ্ছুক নয়। তাছাড়া ইউনিয়ন মনে করে, সাংস্কৃতিকভাবে তুর্কিরা ইউরোপীয় সংস্কৃতি ধারণ করে না, তাই তুর্কিরা ইউরোপীয় নয়। এমতাবস্থায় তুরস্ককে ইউনিয়নভুক্ত করা সমীচীন হবে না। 

তুরস্কের মানবাধিকার সম্পর্কে ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট ওজাল বলেন, ‘তুরস্কের মানবাধিকারের রেকর্ড ভালো নয় বলে সদস্যপদ প্রদানের অস্বীকৃতি একটি খোঁড়া যুক্তি আসল কারণ হল, আমরা মুসলমান আর তারা হল খ্রিস্টান। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা বলতে চান না যে, ইউনিয়ন হল একটি খ্রিস্টানদের ক্লাব।’ ‘… তুর্কিরা মনে করে যে, ইউরোপে মুসলমান-অধ্যুষিত তুরস্কের কোনোপ্রকার স্থান নেই।

মক্কার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে এবং ব্রাসেলস কর্তৃক বঞ্চিত হয়ে তুরস্ক সোভিয়েটবিহীন বিশ্বে তাসখন্দের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। প্রেসিডেন্ট ওজাল ও অন্যান্য তুর্কিনেতারা বিদেশে তুর্কিসম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্যকে গুরুত্ব দেন এবং নিকট প্রতিবেশী হিসেবে আড্রিয়াটিক সাগর থেকে চীনের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত তুর্কি জাতগোষ্ঠীর সঙ্গে সখ্য বৃদ্ধি করতে চান। এজন্য আজারবাইজান, তুর্কিমেনিস্তান, কাজাকিস্তান, কিরজিস্তানের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে সচেষ্ট হয়। ১৯৯১ এবং ১৯৯২ সালে তুরস্ক নতুন প্রজাতন্ত্রসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। এজন্য তুরস্ক সেখানে ১.৫ বিলিয়ন ডলার দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্পসুদে অর্থ ধার দেয়। ৭৯ মিলিয়ন ডলার খয়রাতি সাহায্য দেয়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের ব্যবস্থা করে দেয় (রুশ ভাষাভাষি চ্যানেলের বিপরীতে), টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটায়। বিমান সেবার উন্নয়ন করা হয়। ওইসব দেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তির মাধ্যমে তুরস্কে পড়ালেখার জন্য নিয়ে আসা হয়। ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক ও শত শত সামরিক কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তুরস্ক থেকে বহু শিক্ষক প্রজাতন্ত্রগুলোতে তুর্কিভাষা শিক্ষা দেবার জন্য গমন করেন। এবং প্রায় ২০০০ হাজার যৌথ অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে চাওয়া হয়। একজন তুর্কি ব্যবসায়ী যেমন বলেন, ‘আজারবাইজান এবং তুর্কেমেনিস্তানের উন্নয়নের সঠিক উন্নয়ন সহযোগী পাওয়া গিয়েছে। তুর্কিদের জন্য এটি কোনো কষ্টের কাজ নয়। তুরস্কের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি অভিন্ন, প্রায় একই ধরনের ভাষা এবং আমরা একই হাঁড়ির খাবার খেয়ে থাকি।’

ককেশীয় ও সেন্ট্রাল এশিয়ার তুর্কিঘেঁষা সম্প্রদায় ও জাতিসমূহের সঙ্গে তুরস্কের এ সখ্য যে শুধুমাত্র এলাকার নেতৃত্ব হাতে তুলে নেবার অভিপ্রায়ে করা হয়েছে তা নয়, সেসঙ্গে ওই সকল মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকায় ইরান এবং সৌদিআরবের আধিপত্য বিস্তার ও তার সাথে মৌলবাদী মতাদর্শ সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলাও এর অন্যতম কারণ। তুর্কিরা তাদের মতাদর্শকে দেখতে চায় যেমন ‘একটি ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আর সেসঙ্গে বাজার-অর্থনীতির সমর্থক দেশ হিসেবে।’ তদনুযায়ী তুরস্ক সেন্ট্রাল এশিয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়ার পুনরায় আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধেও সতর্ক থাকতে চায়। রাশিয়া এবং ইসলাম, এ দুয়ের ভেতর একটি বিকল্প হিসেবে তুরস্ক নিজেকে বিবেচনা করে এবং বলাবাহুল্য, তারা সেজন্যও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়া জরুরি বলে মনে করে। 

১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট ওজালের মৃত্যু, সুলেমান ডেমিরেলের ক্ষমতারোহণ, তার্কি প্রজাতন্ত্রগুলোর জন্য তুরস্কের অর্থবরাদ্দের সীমাবদ্ধতা এবং রাশিয়ার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে তুরস্কের ‘নিকটতম বিদেশে আধিপত্য বিস্তারের প্রারম্ভিক উদ্যোগ বেশকিছুটা ভাটা পড়ে। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর তার্কি অর্থাৎ প্রাক্তন প্রজাতন্ত্রগুলোর নেতারা প্রথমেই আঙ্কারায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন, কিন্তু পরবর্তীতে রাশিয়ার চাপে রিপাবলিকসমূহ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃনির্ধারণ করতে থাকেন এবং এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা তাদের সাংস্কৃতিক পরমাত্মীয় তুরস্ক এবং পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদের প্রভু রাশিয়ার মধ্যে একটি ভারসাম্য ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করে। অবশ্য, তারপরও প্রজাতন্ত্রগুলো তাদের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার সূত্র ধরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি নির্ধারণ করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে রিপাবলিকগুলোর তেলসম্পদ (বিশেষ করে আজারবাইজান) বিদেশে রপ্তানির নিমিত্তে তুরস্কের ভূমি ব্যবহারপূর্বক ভূমধ্যসাগরের উপকূল পর্যন্ত তা বিস্তৃত করতে উদ্যোগী হয়। 

তবে মুদ্রার অপরদিক হল, তুরস্ক যখন প্রাক্তন সোভিয়েটের মুসলমান রিপাবলিকগুলোতে যোগসূত্র স্থাপনে ব্যস্ত, তখন তার ধর্মনিরপেক্ষ কেমালপন্থী পরিচয় নিজভূমি তুরস্কের অভ্যন্তরেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। অন্যান্য দেশের মতো, শীতলযুদ্ধাবসানের পর তুরস্কে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অরাজকতার প্রধান ইস্যু হিসেবে ‘জাতীয় পরিচয় ও নৃগোষ্ঠীক পরিচিতির প্রশ্নটি সামনে এসে পড়ে। এমতাবস্থায় ধর্মের মধ্যে এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবার বিষয়টি গ্রাহ্য হতে থাকে। কেমাল আতাতুর্ক কর্তৃক প্রণীত ও তুরস্কের এলিটদের দ্বারা সমর্থিত তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় গুরুতর অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে নিপতিত হয়। বিদেশে বসবাসরত তুর্কিরা ক্রমান্বয়ে ইসলামধর্মমুখী হয়ে পড়তে থাকে এবং তাদের নিজদেশে তা অবলোকন করতে তারা আগ্রহী হয়। ‘অনেক তুর্কি জার্মানি থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং ইসলামের প্রতি জার্মানিদের ঘৃণার কথা প্রচার করতে থাকেন।’ জনগোষ্ঠীর মূলধারার চিন্তাচেতনা ও আমল ক্রমবর্ধমানভাবে ইসলামকেন্দ্রিক হতে শুরু করে। ১৯৯৩ সালে দেখা যায়, তুরস্কের রাস্তায় ইসলামি কায়দায় দাড়ি এবং নেকাব পরিহিতা রমণীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তাছাড়া মসজিদে নামাজের জন্য উপস্থিতিও পূর্বের তুলনায় বাড়তে থাকে। বইয়ের দোকানগুলো ইসলামি বইপুস্তক, অডিও-ভিডিও ক্যাসেটে পরিপূর্ণ হতে থাকে; বাড়তে থাকে ক্রেতার সংখ্যা। একটি জরিপ থেকে দেখা যায় যে, ২৯০টি প্রকাশনা সংস্থা এবং মুদ্রণ সংগঠন ও প্রকাশক, ৪টি দৈনিক পত্রিকা ইসলাম নিয়ে বইমুদ্রণ ও প্রকাশনা করতে থাকে। অ-রেজিস্ট্রিকৃত ৩০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও এবং টেলিভিশনকেন্দ্র অনবরত ইসলাম সম্পর্কে প্রোপাগান্ডা চালাতে থাকে। 

প্রথমত, তুরস্কে ধর্মীয় চেতনা ও মনোভাবের আশঙ্কাজনকভাবে উত্থান মোকাবিলা করতে তুরস্কের শাসকেরা মৌলবাদীদের সমর্থন দিতে ও বিপরীতে তাদের সমর্থন পেতে যা করা প্রয়োজন তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। 

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ধর্মবিষয়ক অফিস পরিচালনা করে মসজিদ নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ,সকল সরকারি বিদ্যালয়ে ধর্ম বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ, স্কুলসমূহে ইসলামধর্মের জন্য অর্থবরাদ্দ করে। ধর্ম বিষয়ে পড়ালেখার জন্য স্কুল স্থাপন করা হয়, এবং সেখান থেকে হাজার হাজার স্নাতক কৃতকার্য হয়ে আসতে থাকে। ফরাসি দেশের বিপরীতে তুর্কি সরকার স্কুলে মুসলমান মেয়েদের স্কার্ফ পরার অনুমতি প্রদান করে। কেমালের দ্বারা নিষিদ্ধ হওয়ার ৭০ বৎসর পরে তা আবার ফিরে এল। সরকারি এসব কার্যক্রম আসলে ইসলামপন্থীদের চাপেই করা হল। তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় ১৯৮০-১৯৯০ সালে তুরস্কে ইসলামিকরণের ঝড়ো হাওয়া কত প্রবল বেগে বয়ে গেল। 

দ্বিতীয়ত, ইসলামের পুনরুত্থান তুরস্কের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য পালটিয়ে ফেলে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যেমন তুর্গত ওজাল খুব খোলামেলাভাবেই ইসলামের প্রতীক ও আদর্শের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নেন। অন্যান্য স্থানের মতো তুরস্কেও গণতন্ত্র দৈশিককরণের শিকার হয় এবং ওই গণতন্ত্র হয় ধর্মীয় ধাঁচের গণতন্ত্র এবং এভাবে তা ধর্মের মধ্যে ফিরে আসে। জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখানোর আকাঙ্ক্ষা এবং ভোট লাভের জন্য রাজনীতিকরা এমনকি সামরিক বাহিনী, যারা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী, তারা পর্যন্ত জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে মূল্য দিতে শুরু করেন। জনপ্রিয় সরকার হতে হলে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে থাকতেই হবে। তবে এলিট ও আমলাগণ এবং সামরিক বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শী। ইসলামি ভাবধারা সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রবেশ করেছিল, ফলে ১৯৮৭ সালে সামরিক অ্যাকাডেমি হতে কয়েকশো ক্যাডেটকে ইসলামি ভাবধারার ধারক হওয়ার অভিযোগে অপসারণ করা হয়। অবশ্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পুনর্জাগরিত ইসলামি ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ইসলামি মতাদর্শীদের সমর্থন দিতে থাকে, যা আতাতুর্ক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ৩৪ ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে স্থানীয় নির্বাচনে মৌলবাদী ওয়েলফেয়ার পার্টি ও তদ্রূপ অন্যান্য সমঝোতাসম্পন্ন ৫টি দলের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তারা প্রায় শতকরা ১৯ ভাগ ভোট পায়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী সিলারের ট্রুথ পার্টি পেয়েছিল শতকরা ২১ ভাগ ভোট। অন্যদিকে, শতকরা ২০ ভাগ ভোট পায় প্রয়াত ওজালের মাদারল্যান্ড পার্টি। ওয়েলফেয়ার পার্টি তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা অর্জন করে, যথা ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারা। এর ছয়মাস পরে ১৯৯৫-এর ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচনে ওই দল ভালো করে এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে। অন্যান্য দেশের মতো তুরস্কেও মৌলবাদী সমর্থন মূলত যুবসমাজ থেকে আসতে থাকে। এদের মধ্যে ছিল ফেরত আসা অভিবাসী, সমাজের ছিন্নমূল ও অধিকারবঞ্চিত অংশ এবং শহরে নব্য আগত অভিবাসী…।

তৃতীয়ত, তুরস্কে ইসলামের পুনরুত্থান সেদেশের বিদেশ নীতিতেও প্রভাব ফেলে। প্রেসিডেন্ট ওজালের নেতৃত্বে তুরস্ক গাল্ফযুদ্ধে পশ্চিমাদের সমর্থন জুগিয়েছিল। তিনি ভাবছিলেন যে, এ-ধরনের সমর্থনদানের বিনিময়ে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ অর্জন করবে। তবে শেষপর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি; এমনকি ন্যাটো পর্যন্ত তুরস্ককে সমর্থন দিতে ইতস্তত করে। ইরাক কর্তৃক তুরস্ক আক্রান্ত হলে ন্যাটো একটি অ-রুশ দেশের দ্বারা আক্রান্ত তুরস্ককে সমর্থন দিতে চায়নি। তুর্কিরা ইসরাইলের সঙ্গে তাদের সামরিক সখ্য বজায় রাখতে থাকে, যা তুরস্কের ইসলামপন্থীরা সুনজরে দেখেনি। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৮০-এর দশকে তুরস্ক আরবের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে এবং ১৯৯০-এর দশকে বসনিয়ার মুসলমান এবং আজারবাইজানকে সমর্থন দেয়। তারপরও বলকান এলাকা, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দৃষ্টিতে বিচার করে বলা যায় যে, তুরস্কের বিদেশনীতি ক্রমাগতভাবে ইসলামপন্থী হতে থাকে। 

একটি সভ্যতাসম্পন্ন পরিচয়ে ফিরে আসার জন্য যে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়, তুরস্ক বেশ কয়েক বৎসর ধরে তার দুটি শর্ত পূরণ করে আসছে। তুরস্কের এলিটগণ সর্বতোভাবে সমর্থন জানাতে ইচ্ছুক এবং জনগণও নীরবে সমর্থন জানাতে প্রস্তুত। প্রাপক এলিট এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা যদিও তা চান না, তবুও এই ইস্যুটি ঝুলন্ত এবং ভারসাম্যাবস্থায় রয়েছে। তুরস্কের অভ্যন্তরে ইসলামি পুনঃজাগরণবাদীরা সক্রিয়ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে জনগণের মধ্যে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলছে এবং এভাবে তারা ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও পাশ্চাত্যপন্থী তুর্কি এলিটদের অবমূল্যায়ন করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বাধা হিসেবে তুরস্কের দুটি অবস্থা দায়ী; তা হল, প্রাক্তন সোভিয়েট প্রজাতন্ত্রের ওপর নেতৃত্ব গ্রহণে তুরস্কের ইচ্ছা এবং তুরস্কে ইসলামিধারার পুনঃজাগরণ, যা আতাতুর্কের উত্তরাধিকারত্বকে অস্বীকার করে থাকে। এ সবকিছুই বলে দেয় যে, তুরস্ক একটি ছিন্নরাষ্ট্র হিসেবেই থাকবে। এ সবকিছু সত্ত্বেও তুরস্কের নেতৃত্ব বরাবরই বলেন যে, তাদের দেশ একটি ‘সেতুর’ মতো যা বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে থাকে। ১৯৯৩ সালে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তানসু সিলার যুক্তি দেখান যে, তুরস্ক একই সঙ্গে দুই, অর্থাৎ ‘পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের ধারক আবার ‘মধ্যপ্রাচ্যেরও অংশবিশেষ’। 

আর এভাবেই তুরস্ক দুটি সভ্যতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে চলেছে, যা বস্তুগত ও দার্শনিকোচিত উভয় অর্থেই সত্য। জনসাধারণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সিলার সবসময়ই নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচিত করান। আবার যখন তিনি ন্যাটো-জোটে কথা বলেন, তখন তিনি যুক্তি দেখান যে, ‘ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিচারে তুরস্ক একটি ইউরোপীয় দেশ।’ প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডিমেরিলও অনুরূপভাবে বলেন যে, ‘তুরস্ক দেশটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু, যা পূর্ব-পশ্চিম এবং চীন ও পশ্চিমের মধ্যে বন্ধন রচনা করেছে।’৩৭ যদিও এই সেতুটি কৃত্রিমভাবে তৈরি, এবং এর দুপারে শক্ত ভিত্তি থাকলেও একটি অন্যটির অংশ নয়। তুরস্কের নেতৃত্ব যখন তাদের দেশকে একটি সেতুর কথা বলেন; তখন তারা নিজেরাই স্বীকার করে নেন যে, তুরস্ক একটি ছিনরাষ্ট্র বৈ কিছু নয়। 

মেক্সিকো 

১৯২০-এর দশক থেকে তুরস্ক একটি ছিন্নরাষ্ট্র হিসেবে চলে আসলেও মেক্সিকো ১৯৮০-এর দশকের পূর্বে ছিন্নরাষ্ট্র ছিল না। তবে উভয় দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকদিন থেকেই সাযুজ্য রয়েছে। তুরস্কের মতো মেক্সিকোরও ছিল সর্বতোভাবে এবং স্ফটিকের মতো পরিষ্কার অপাশ্চাত্য সভ্যতা। এমনকি বিংশ শতাব্দীতে অক্টোভিয়া পাজ তুলে ধরেন যে, মেক্সিকোর চরিত্র ‘কোর’ এবং তা ভারত-উদ্ভূত। নিঃসন্দেহে এটি অ-ইউরোপীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মেক্সিকো অটোম্যান সাম্রাজ্যের মতো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যাতে হাত লাগিয়েছিল পাশ্চাত্য বিশ্ব। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে মেক্সিকোতে নতুন জাতীয় পরিচয় ও নতুন একদলীয় রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে। তুরস্কে বিপ্লবের ধারা ছিল ইসলামি ঐতিহ্য পরিত্যাগ করা ও সেইসঙ্গে অটোম্যান সংস্কৃতি বর্জন করা এবং তার বিনিময়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জীবনধারাকে নিয়ে আসা ও তা অনুসরণ করা। অন্যদিকে মেক্সিকোতে রাশিয়ার মতো বিপ্লব ঘটেছিল সহযোগিতা ও খাপখাওয়ানোর মধ্যদিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উপাদানসমূহ গ্রহণ করা, যার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল একটি নতুন ধারার জাতীয়তাবাদ, যে জাতীয়তাবাদ পশ্চিমা গণতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রকে বাতিল করে দিয়েছিল। এভাবে প্রায় ষাট বৎসর যাবৎ তুরস্ক নিজেকে ইউরোপীয় বানাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু মেক্সিকো চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে অস্বীকার করেই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে। ১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৮০ দশক পর্যন্ত মেক্সিকো এমন অর্থনৈতিক ও বিদেশনীতি গ্রহণ করেছিল, যা সদাসর্বদা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী। 

তবে ১৯৮০ সাল থেকে অবস্থা বদলাতে থাকে। প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল ডি লে মাদ্রিদ যা শুরু করেন তা ছিল ‘উত্তরমুখী’। প্রেসিডেন্ট কার্লোস সালিনাস ডি গোরতারি যা সামনে এগিয়ে নেন, তা হল মেক্সিকোর উদ্দেশ্য, বাস্তবতা, কার্যক্রম, পরিচয়, ইত্যাদি যা ১৯১০ সালের পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে সূচনা হয়েছিল, তা এগিয়ে নেয়া। সালিনাস প্রকৃতপক্ষে মেক্সিকোর ক্ষেত্রে তুরস্কের আতাতুর্ক-এর মতো ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদকে এগিয়ে নিয়েছিলেন, যা ছিল তার সময়ে পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের মূলমন্ত্র। সেলিনাস অর্থনৈতিক উদারতাবাদকে এগিয়ে নিলেও পাশ্চাত্যের মতো রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেননি। তুরস্কের কেমাল আতাতুর্কের কার্যক্রম যেমন সেখানকার এলিটগণ সমর্থন জানিয়েছিলেন, তেমনি সেলিনাস-এর গৃহীত কার্যক্রম মেক্সিকোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটগণও সমর্থন জানায়। তাদের অনেকেই আবার সেলিনাস-এর মতোই, যুক্তরাষ্ট্রেই লেখাপড়া করেছেন। সেলিনাস নাটকীয়ভাবে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করেন, বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি মালিকানায় ফিরিয়ে দেন, বিদেশী বিনিয়োগ এগিয়ে নেন, ট্যারিফ ও ভর্তুকি হ্রাস করতে সক্ষম হন, বৈদেশিক ঋণ পুনঃবিন্যাস করেন, শ্রমিক সংগঠনগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন, উৎপাদনসীমা বৃদ্ধি করেন এবং সর্বোপরি তিনি মেক্সিকোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে উত্তর আমেরিকার মুক্ত এলাকার অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন। মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলমানদেশ থেকে পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন কেমাল আতাতুর্ক, অন্যদিকে সেলিনাস-এর সংস্কারের লক্ষ্য ছিল মেক্সিকো লাটিন আমেরিকার একটি দেশ থেকে তাকে উত্তরআমেরিকার দেশে রূপান্তরকরণ। 

অবশ্য, এটি মেক্সিকোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় ‘পছন্দ’ ছিল না। বস্তুত মেক্সিকোর এলিটগণ সদাসর্বদা মার্কিনবিরোধী মনোভাব পোষণ করতেন। তারা ধারণা করতেন, তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদী ও সংরক্ষণবাদিতার পথ পৃথিবীর বহুদেশ বহুশতাব্দী ধরে অনুসরণ করে এসেছে। অনেক মেক্সিকান মনে করেন যে, এর উৎকৃষ্ট বিকল্প হিসেবে বরং মেক্সিকো স্পেন, পর্তুগাল, দক্ষিণআমেরিকার দেশসমূহের সঙ্গে একটি ‘ইবেরিয়ন’ সম্মিলিত রাষ্ট্রসংঘ গড়ে তুলতে পারে। 

মেক্সিকো কি শেষপর্যন্ত তার উত্তরআমেরিকার প্রতি বেড়ে ওঠা ক্ষুধা মেটাতে পারবে? বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক এলিট এ-পথের সমর্থক; একথা সত্য। অন্যদিকে, উত্তর আমেরিকাও মেক্সিকোকে গ্রহণ করতে মোটামুটি রাজি, অবশ্য এক্ষেত্রে প্রচুরসংখ্যক অভিবাসীর ঢল নামার একটি বিপদজনক সম্ভাবনা রয়ে যায়। তুরস্কের বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর দিকে লক্ষ্য রেখে ইউরোপীয় এলিট ও জনগণ তুরস্ককে ইউরোপভুক্ত করতে ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। অন্যদিকে, বৈধ বা অবৈধ পথে ব্যাপক হারে মেক্সিকান অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে যাতে যেতে পারে, এরূপ একটি যুক্তি ও শর্ত সেলিনাস নাফটার (NAFTA) ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি বলেন, “হয় তোমরা আমাদের পণ্য গ্রহণ করবে, অথবা আমাদের মানুষজন নেবে।’ তুরস্ক এবং ইউরোপের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য অত্যন্ত গভীর, কিন্তু সে তুলনায় মেক্সিকো ও আমেরিকার মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য তত গভীর নয়। মেক্সিকোর ধর্ম হল ক্যাথলিকতন্ত্র। এর ভাষা হল স্প্যানীয়। এর এলিটগণ মূলত ইউরোপপন্থী (যেখানে তারা তাদের সন্তানাদিকে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়ে থাকেন)। অতিসম্প্রতি তারা তাদেরকে মার্কিন মুলুকে পাঠাতে শুরু করেছে। 

অ্যাংলো আমেরিকা, উত্তর আমেরিকান ও স্প্যানীয়, ইন্ডিয়ান মেক্সিকো পরিচয় অনেকটা গ্রহণযোগ্য, যতটা না খ্রিস্টীয় ইউরোপীয় এবং মুসলমান তুরস্ক। এতসব মিল থাকার পরও ‘নাফটা’ গঠনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাফটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় বইতে দেখা যায়। বিশেষত অভিবাসীর বানভাসা স্রোত ঠেকানো নিয়ে অনেক মার্কিনী চিন্তিত হয়ে ওঠেন। তাছাড়া কলকারখানাগুলো দক্ষিণদিকে সম্প্রসারণকেও তারা ভালোচোখে দেখেনি। তদুপরি প্রশ্ন তোলা হয় যে, আদৌ মেক্সিকো উত্তর আমেরিকীয় উদারতাবাদ এবং আইনের শাসন বাস্তবায়নের যোগ্যতা রাখে কি-না।

একটি ছিন্নরাষ্ট্র থেকে কৃতকার্যতার সঙ্গে সরে আসার আর-একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে জনগণের সাধারণ সম্মতি, যদিও সর্বতোভাবে জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন তেমন নেই। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল এই যে, দেশের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণ কী ভাবছে তা জানা। ১৯৯৫ সালের নববর্ষের দিন কয়েক হাজার সুসংগঠিত চিয়াপাস সমর্থক উগ্র গেরিলা মেক্সিকোর উত্তর আমেরিকাকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। তাদের এ কার্যক্রম মেক্সিকোর বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং জনমতের অন্যান্য বাহকের দৃষ্টি ও সহমর্মিতা অর্জন করেছিল। ফলে দেখা যায়, মেক্সিকোর এলিট ও জনগণ নাফটার সদস্য হওয়া ও মেক্সিকোর উত্তর আমেরিকাকরণের বিপক্ষে অবস্থান নেন। প্রেসিডেন্ট সেলিনাস খুব সচেতনভাবেই রাজনৈতিক সংস্কার ও গণতন্ত্রায়ণের চাইতে তাঁর সংস্কার-কর্মসূচির অগ্রাধিকারের তালিকায় অর্থনৈতিক সংস্কার ও পাশ্চাত্যকরণকে উপরের দিকে রেখেছিলেন। একথা বলা যায় যে, এভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা আসলে মেক্সিকোর রাজনৈতিক সংস্কার তথা গণতন্ত্রায়ণকে এগিয়ে নেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দেয় : মেক্সিকোর আধুনিকীকরণ ও গণতন্ত্রায়ণ কি মেক্সিকোর অপাশ্চাত্যকরণের জন্য চূড়ান্ত সহায়ক হবে, যা ক্রমান্বয়ে নাফটাকে দুর্বল করবে এবং তা আসলে কি ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে পরিবর্তন ডেকে আনবে? মেক্সিকোর উত্তরআমেরিকাকরণ কি সেখানকার গণতন্ত্রায়ণের সঙ্গে উপযুক্ত? 

অস্ট্রেলিয়া 

রাশিয়া, তুরস্ক এবং মেক্সিকোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, অস্ট্রেলিয়া শুরু থেকেই একটি পাশ্চাত্যদেশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। পুরো বিংশ শতাব্দী ধরেই দেশটি প্রথমে ব্রিটেন এবং তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। শীতলযুদ্ধকালীন অস্ট্রেলিয়া যে শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের একটি সদস্যরাষ্ট্র ছিল তাই নয়; সেসময়ে দেশটি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাশ্চাত্যের সামরিক ও গোয়েন্দা বিষয়ক একটি ‘কোর’রাষ্ট্র হিসেবে নিজের ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৯০-এর দশকে অস্ট্রেলীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্তগ্রহণ করে যে, তারা পাশ্চাত্যের সঙ্গে তাদের মিত্রতা থেকে সরে আসবে এবং একটি এশীয় দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যা-কিছু করণীয় তা করতে দ্বিধান্বিত হবে না। এরই ধারাবাহিকতায় ভৌগোলিকভাবে তারা প্রতিবেশী এশীয় দেশসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হয়। 

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী পল কিয়েটিং ঘোষণা দেন যে, ‘অস্ট্রেলিয়া সাম্রাজ্যবাদের শাখা অফিস হিসেবে আর কাজ করবে না, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজাতন্ত্র হিসেবে কাজ করবে এবং এশীয়দের সঙ্গে একাত্ম হতে শুরু করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব পরিচয় ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।’ বিশ্বের বুকে অস্ট্রেলিয়া নিজেকে একটি বহুধাবিভক্ত সংস্কৃতিসম্পন্ন জাতি হিসেবে পরিচিত করতে চায় না। অস্ট্রেলিয়া একটি এশীয় দেশ এবং সেজন্য অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং সাংবিধানিকভাবে দেশটিকে একটি ‘আহরিত’ দেশ হিসেবে বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালানো হবে। প্রধানমন্ত্রী কিয়েটিং-এর মতে বিগত দিনগুলোতে ব্রিটেনের সঙ্গে অতিসখ্য দেশটিকে অসাড় করে তুলেছে এবং ব্রিটেনের সঙ্গে এভাবে সম্পর্ক বজায় রাখলে দেশটির নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ‘এশিয়াত্ব’ আর বহাল থাকবে না। বিদেশমন্ত্রী গারেথ ইভানও অনুরূপ মত পোষণ করেন। 

অস্ট্রেলিয়ার এশীয়করণের প্রত্যয়ের ভিত্তি ছিল এই যে, ধরে নেয়া হয়েছিল, অর্থনীতি দেশের জাতীয় লক্ষ্যে পৌঁছতে সংস্কৃতিকে পদদলিত করে থাকে। মূল কারণ ছিল পূর্বএশিয়ার অর্থনীতির গতিশীল উন্নয়ন ও তার ফলে ওইসব দেশে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যের অভূতপূর্ব প্রসারের মধ্যে নিহিত। ১৯৭১ সালে পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়া অস্ট্রেলিয়ার সমগ্র রপ্তানির শতকরা ৩৯ ভাগ গ্রহণ করত। কিন্তু ১৯৯৪ সালে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানির শতকরা ৬২ ভাগ গ্রহণ করছে এবং বিনিময়ে নিজেদের শতকরা ৪১ ভাগ সামগ্রী অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি করছে। বিপরীত চিত্রে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে অস্ট্রেলিয়া তার রপ্তানির শতকরা ১১.৮ ভাগ ইউরোপীয় সমাজে, আর শতকরা ১০.১ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করছে। তাই দেখা যায়, অস্ট্রেলীয় অর্থনীতি এশীয় অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এই নির্ভরশীলতার ফলে সৃষ্ট বলয় অস্ট্রেলীয়দের মনে এরূপ একটি ধারণা সৃষ্টি করে যে, বৈশ্বিক অর্থনীতি তিনটি মূলধারার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এ ব্লকগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান এশীয় ব্লকের অভ্যন্তরে। 

এহেন অর্থনৈতিক যোগসূত্রের পরও অস্ট্রেলিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতাসম্পন্ন দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কার্যত একটি ‘ছিন্নরাষ্ট্র’ হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে। 

প্রথমত, ১৯৯০-এর দশকে অস্ট্রেলীয় এলিটগণ মোটেও দেশটিকে ছিন্নরাষ্ট্রের কবলমুক্ত করার বিষয়ে যত্নবান ছিলেন না। কোনো কোনো মাত্রায় লক্ষ্য করা যায়, প্রশ্নটি একটি দলীয় ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন লিবারেল পার্টির নেতৃবৃন্দ এক্ষেত্রে কখনও কখনও পরস্পর বিপরীত অবস্থান কিংবা এর বিরোধিতা করে থাকেন। লেবার সরকারও এ-বিষয়ে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকগণ কর্তৃক মোটারকমের সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তাই দেখা যায়, এশীয়করণের পক্ষে তেমন কোনো সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার মতৈক্য দেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। 

দ্বিতীয়ত, এ বিষয়ে জনমতও ছিল পরস্পরবিরোধী। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলীয় জনগণের শতকরা ২১ ভাগ থেকে ৪৬ ভাগ ছিল রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পক্ষে। এই ক্ষেত্রে সমর্থন ছিল দোদুল্যমান এবং ক্ষয়িষ্ণু। অস্ট্রেলীয় পতাকা থেকে ইউনিয়ন জ্যাক বাদ দেয়ার প্রশ্নে সমর্থকদের হার শতকরা ৪২ ভাগ থেকে মে ১৯৯২- তে ৩৫ ভাগে (১৯৯৩) উপনীত হয়। একজন অস্ট্রেলীয় কর্মকর্তা এ-বিষয়ে ১৯৯১ সালে বলেন, ‘জনগণের জন্য এটি উদরপূর্তি করা খুবই কঠিন। যখন আমি বলি ধাপে ধাপে অস্ট্রেলিয়া এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে, আমি তখন অনেক ঘৃণাযুক্ত পত্র প্রাপ্ত হই।

তৃতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এশীয় দেশের এলিটগণ অস্ট্রেলিয়ার এশীয়মুখিতার ক্ষেত্রে ততবেশী গ্রহণোন্মুখ নয়, যতটা ইউরোপীয় এলিটগণ তুরস্কের জন্য গ্রহণোন্মুখ। এশীয় দেশের এলিটগণ পরিষ্কার করতে চান যে, অস্ট্রেলিয়া যদি সত্যই এশিয়ার অংশ হতে চায়; তবে তাকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ও সত্যিকার অর্থে এশীয় হতে হবে, যা তার পক্ষে হওয়া সম্ভব। একজন ইন্দোনেশীয় কর্মকর্তার মতে, ‘এশিয়ার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যজনক সংহতি একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে, তা হল, এশীয় দেশসমূহ কীভাবে এ সংহতিকে স্বাগত জানায়। এশীয় দেশসমূহের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সংহতির জন্য অস্ট্রেলিয়ার জনগণ ও সরকারকে এশীয় সমাজ ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে হবে।’ অস্ট্রেলিয়ার এশীয়করণ উদ্যোগ আর পাশ্চাত্যের প্রতি তার দুর্বলতার মধ্যে একটি ফাঁক রয়েছে। ‘সাংস্কৃতিকভাবে অস্ট্রেলিয়া এখনও ইউরোপীয়।’ ১৯৯৪ সালে এরূপ মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ : ‘… এজন্য আমরা মনে করি অস্ট্রেলিয়া ইউরোপীয় এবং তাই তার পূর্বএশীয় অর্থনৈতিক ‘ককাসের সদস্য হওয়া সমীচীন হবে না। অস্ট্রেলিয়া যেহেতু সাংস্কৃতিকভাবে এখনও ইউরোপীয়, সেহেতু আমাদের ‘ফোরামে’ এসে তার ইউরোপীয় সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলার অধিকার থাকবে। অথচ, আমরা এশীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক এবং এশীয় সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। অতএব, অস্ট্রেলিয়া আমাদের গোষ্ঠীর সঙ্গে তেমন খাপ খায় না। এ কারণেই আমি অস্ট্রেলিয়াকে ‘ইয়েকের’ সদস্য হওয়ার বিষয়ে বিরোধিতা করে থাকি। সুতরাং, এটি গায়ের চামড়ার রঙের জন্য নয়, সংস্কৃতির জন্য।৪৩ সে কারণে, এশীয়রা অস্ট্রেলিয়াকে তাদের সংঘের বাইরে বের করে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ঠিক অনুরূপ কারণে ইউরোপীয়রা তুরস্ককে তাদের ইউনিয়নভুক্ত করতে পারছে না (তারা ‘আমাদের’ থেকে পৃথক বা তারা ‘আমাদের’ নয়)। 

তাহলে দেখা যায়, মাহাথির যেমন বলেছেন, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধই হল প্রধান অন্তরায় যার দরুন অস্ট্রেলিয়া এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে না। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মুক্ত সংবাদপ্রবাহ সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর নিত্য সংঘাত পরিলক্ষিত হয়। একজন অস্ট্রেলীয় কূটনীতিকের মতে, এ অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে বাস্তব সমস্যা, ‘আমাদের পতাকা নিয়ে নয় বরং তা হল সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ অনুসৃত প্রত্যয়গুলো নিয়ে। আমি সন্দেহ করি, তুমি এমন কোনো অস্ট্রেলীয়কে পাবে না, যে এশীয় অঞ্চলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সংহতির বিনিময়ে তার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের কোনো একটি বিষয়কে ছাড় দেবে।” 

এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে চারিত্রিকসহ রীতি, শৈলী, আচরণগত পার্থক্য স্পষ্ট; মাহাথির যেমনটি বলেন, এশিয়া তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অতি সূক্ষ্ম, পরোক্ষ, সমন্বিত, অ-সরল, অ-বিচারমূলক, অ-বাস্তব এবং সংঘাত-বিবর্জিত পথে এগুতে আগ্রহী। অথচ, অস্ট্রেলীয়রা বিপরীতভাবে পরোক্ষ, নীরস, দুর্বোধ্য, স্পষ্টবাদী, অসংবেদনশীল তথা ইংরেজিভাষাভাষি অপরাপর মানুষের ন্যায় লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে থাকে। সংস্কৃতির এই সংঘাত প্রধানমন্ত্রী পল কিয়েটিং-এর এশীয়দের সঙ্গে আচরণের ভেতরই ধরা পড়ে। কিয়েটিং অস্ট্রেলীয় জাতীয় চরিত্রের চরম দিক উন্মোচন করেছেন। অস্ট্রেলিয়াকে এশীয় হতে হবে, এমন খোলামেলা ও নির্দয় যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে কিয়েটিং অনবরত এশীয় নেতৃত্বের দ্বারা রুষ্ট, হতাশাগ্রস্ত এবং বিরাগভাজন হয়েছেন। কিয়েটিং-ইভানের কার্যক্রমকে অদূরদর্শী বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। তারা উভয়েই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অতিগুরুত্ব দিতে গিয়ে সংস্কৃতিক বিষয়াদিকে উপেক্ষা করেছেন। এ অবস্থাকে অস্ট্রেলিয়ার মূল আর্থিক সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর অপপ্রয়াস হিসেবে অনেকে গণ্য করে থাকেন। 

অন্যদিকে, তাদের এ প্রচেষ্টাকে একটি সুদূরপ্রসারী উদ্যোগের নিরিখে দেখা যায়, যার দ্বারা তারা উদীয়মান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু তথা পূর্বএশিয়ার সঙ্গে একাত্ম হয়ে অস্ট্রেলিয়ার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিল। এক্ষেত্রে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়া হল প্রথম পাশ্চাত্যদেশ, যে দেশ পাশ্চাত্যচ্যুত হয়ে উদীয়মান অপাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে একাত্ম হতে উৎসাহিত হয়েছিল। অনেকে দ্বাবিংশ শতাব্দীর ভবিষ্যদ্বাণী করেন এভাবে : ‘শুরুতে ঐতিহাসিকগণ হয়তো পেছনে ফিরে তাকিয়ে কিয়েটিং-ইভানের এশীয়করণ প্রচেষ্টাকে পাশ্চাত্যের পতনের একটি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করবেন।’ যদি এই পথ অস্ট্রেলিয়া এখন অনুসরণ করে, তবে বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ার পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাবে না এবং এই সৌভাগ্যবান দেশটি চিরস্থায়ীভাবে একটি ছিন্নরাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হবে এবং এটি একই সঙ্গে ‘সাম্রাজ্যবাদের শাখা অফিস’ (যেমনটি পল কিয়েটিং মন্তব্য করেছেন) এবং ‘এশিয়ার নব্য শ্বেত আবর্জনা হিসেবে গণ্য হবে’ যেমনটি লি কুন ইয়েই চিহ্নিত করেছেন। 

অস্ট্রেলিয়ার জন্য এটি একটি অ-পরিহারযোগ্য পরিস্থিতি নয়। ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বাসনা, অস্ট্রেলিয়াকে একটি এশীয় শক্তি হিসেবে গণ্য করার পরও অস্ট্রেলীয় নেতৃত্ব দেশটিকে একটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ হিসেবে গণ্য করতে চায়। এমনকি কিয়েটিং-এর পূর্বসুরী প্রধানমন্ত্রী রবার্ট হাওয়াকও তেমনটি করতে আগ্রহী হয়েছিলেন। যদি অস্ট্রেলিয়া নিজেকে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র থেকে অবমুক্ত করে একটি পৃথক প্রজাতন্ত্র হিসেবে দেখতে চায়, তবে এটি হবে তেমনধারার সারিতে বিশ্বের প্রথম দেশ, যে দেশটি ব্রিটেন থেকে উদ্ভূত, একটি অভিবাসীসম্পন্ন দেশ, যার আকার মহাদেশের ন্যায়, যার অধিবাসীর ভাষা ইংরেজি, যে দেশটি তিনটি যুদ্ধের ‘মিত্র’ হিসেবে পরিচিত, যে দেশটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ইউরোপীয়, যদিও মনে হয় জনসংখ্যার বিচারে দেশটি এশীয়দের দ্বারা ভরপুর হতে চলেছে। 

সাংস্কৃতিকভাবে এ মূল্যবোধের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জুলাই ৪, ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার ঘোষণায় অস্ট্রেলীয় মূল্যবোধেরই প্রতিফলন রয়েছে; এশীয় মূল্যবোধের নয়। অর্থনৈতিকভাবে দেখা যায়, দেশটি যেসব দেশের সঙ্গে সংযুক্ত, তার থেকে পৃথক থাকতে চায়। তারা নাফটার সম্প্রসারণ চায় এবং উত্তর আমেরিকা-দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল যুক্ত করতে চায়, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড হবে অংশীদার। এ-ধরনের জোট সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সমন্বয় ও বোঝাপড়াপূর্বক অস্ট্রেলিয়ার উন্নয়নের একটি শক্ত ভিত্তি ও তার পরিচয়-সংক্রান্ত সংকট দূর করতে সহায়ক হবে। অপরদিকে, অস্ট্রেলিয়াকে এশিয়া বানানোর প্রচেষ্টা হবে বোকার মতো কাজ। 

পাশ্চাত্যের সংক্রমণ ও সাংস্কৃতিক ভগ্নমনস্কতা 

যখন অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্ব দেশটিকে এশীয়করণের ধ্যানে মগ্ন, তখন অন্যান্য ছিন্নরাষ্ট্র, যেমন তুরস্ক, মেক্সিকো, রাশিয়া তাদের দেশকে পাশ্চাত্যকরণের কাজে ব্যস্ত। তাদের অভিজ্ঞতা গভীরভাবে বিবেচ্য, এজন্য যে, এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। কেননা এ- বিষয়ে ক্ষমতা কতটুকু আছে, যা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসা এবং দেশীয় সংস্কৃতির সম্মান রক্ষা করার প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে নিজত্ব রক্ষা করে নিজেকে নবায়ন করার প্রশ্ন দেখা দেয়। নতুনত্ব ধারণ করা এবং পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ হজম করা অত সহজ কাজ নয়। প্রত্যাখ্যানপন্থীরা পাশ্চাত্যের কোনোকিছুই গ্রহণ করতে নারাজ, আবার মোস্তফা কেমালীয় ধারাও ব্যর্থ হয়েছে। যদি অপাশ্চাত্য সমাজকে আধুনিক করতে হয়, তবে তাদেরকে নিজস্ব পথেই এগুতে হবে, পাশ্চাত্যের পথে নয়। জাপানকে ছাড়িয়ে যেতে হলে নিজস্ব ধারায়, নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানাদি ও মূল্যবোধের চর্চা করার প্রয়োজন রয়েছে। 

রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিজস্ব সংস্কৃতির অহংকারে অনুপ্রাণিত হয়ে উপলব্ধি করতে হবে যে, তাদের সংস্কৃতির কোনোপ্রকার মৌলিক পুনঃস্থাপনের মতো কাজ কার্যত হবে নিয়তির দ্বারা পূর্বলিখিত ব্যর্থতার মতো। যখন তারা পাশ্চাত্য সভ্যতার উপাদানগুলো তাদের সমাজে খাপ খাওয়াতে চাইবে, তখন তারা কখনোই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল বা ‘কোর’ বিষয়গুলোকে পদদলিত, কিংবা চিরদিনের জন্য বিদায় করে দিতে পারে না। বিপরীতভাবে দেখা যায়, অপাশ্চাত্য সমাজে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংক্রমণ সবসময়ই উল্টো ফল ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে থাকে। তবে এই সংক্রমণ নাছোড়বান্দার মতো বজায় থাকলেও তা বিধ্বংসী নয়। রোগী বেঁচে থাকলেও পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকে না। রাজনৈতিক নেতারা ইতিহাস সৃষ্টি করলেও তারা ইতিহাস থেকে নিজেদেরকে পিছুটান দিতে পারেন না। তারা তাদের দেশকে একটি ছিন্নরাষ্ট্র তৈরি করলেও পাশ্চাত্যরাষ্ট্র বানাতে পারবেন না। তারা সাংস্কৃতিক ভগ্নমনস্কতার মাধ্যমে তাদের সমাজকে দূষিত করতে পারলেও তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো কিন্তু চলমান থেকেই যায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *