অধ্যায় ১২ – পাশ্চাত্য সভ্যতা, সভ্যতাসমূহ এবং সামগ্রিক সভ্যতা
পাশ্চাত্যের নবায়ন?
সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেক সভ্যতার ইতিহাসেরই অন্তত একবার বা প্রায়শই পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে। সভ্যতা যখন সর্বজনীনভাবে উদয় হয়, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন বিবেকশূন্যভাবে মনে করে যে, যেন তাদের এ সভ্যতার ক্ষয় নেই, (টয়েনবি যাকে বলেছেন— ‘অমরত্বের বাসনার মরীচিকার ঘোর’)। তারা আরও মনে করে যে, তাদের সভ্যতাই চূড়ান্ত— এটিই মানবসমাজের জন্য অমর ও চূড়ান্ত সভ্যতা। এ ধারণা রোমান সভ্যতার ক্ষেত্রেও পোষণ করা হত। পরবর্তীতে এটি আব্বাসীয় খেলাফত, মোঘল সাম্রাজ্য, এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যেও বেলাতেও প্রযোজ্য ছিল। এ-ধরনের সভ্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন একটি নির্মম সত্যকে অবজ্ঞা করে থাকে। তারা আগ্রহী থাকে, এমন নয় যে, তা তাদের অন্ধকারের আলো বিশেষ, বা জনমানবহীন প্রান্তরে নিশিযাপনের আশ্রয়স্থল; আসলে তারা এটিকে একটি মিশন মনে করে থাকে, যা মানুষের প্রচেষ্টার দ্বারা প্রতিশ্রুত জগৎ অর্জনের অপরিসীম আকাঙ্ক্ষা পূরণার্থে কাজ করে। প্যাক্স ব্রিটানিকার সর্ব্বোচ সময়ে এর কিছুটা সত্যে পরিণত হয়েছিল।
ইংরেজ মধ্যবিত্তরা ১৮৯৭ সালে দেখল যে, ‘তাদের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছে এজন্য তাদের পরস্পরকে আলিঙ্গন করার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল, কেননা তারা তাদের ইতিহাসের পরিসমাপ্তির ঘটনাকে পরমতৃপ্তির বিষয় মনে করল।” সমাজ মনে করে যে, তাদের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে; আসলে কিন্তু তা সাধারণত পরিসমাপ্তি নয়, বরং বলা চলে তাদের ইতিহাসের অবনতি বা পতনের মতো পরিস্থিতি। পশ্চিমা দুনিয়া কি এ প্রক্রিয়া বা ধারার বাইরে? এ সম্পর্কে মেলকো দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন :
প্রথমত, পাশ্চাত্য সভ্যতা কি একটি বিশেষ ধরনের প্রজাতি, নিজেই একটি স্বতন্ত্র শ্রেণি, যা অন্যান্য সভ্যতার সঙ্গে তুলনাবিহীন?
দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্য সভ্যতার বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্তি কি বিশ্বেও অন্যান্য সভ্যতার অগ্রগতি, উত্থান এবং স্থায়িত্বের জন্য হুমকি হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে?
পশ্চিমের প্রতি অনুরক্তরা স্বভাবই দুটি প্রশ্নের ‘ইতিবাচক’ উত্তর দিয়ে থাকেন। সম্ভবত তারা সঠিকই বলেন। অতীতে অন্যান্য সভ্যতার মানুষও তেমনিভাবেই চিন্তা করতেন, এবং তাদের চিন্তা নির্ভুল ছিল না। স্পষ্টতই পাশ্চাত্য সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে নিজেকে পৃথক করেছে, আর এ সভ্যতা বিগত ১৫০০ সাল থেকে অন্যান্য সভ্যতার ওপর প্রভাব রেখে চলেছে, একথাও সত্য। পাশ্চাত্য সভ্যতা আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার উদ্বোধন করেছে। এ দুটি বিষয় আজ বিশ্বজুড়ে গৃহীত হয়েছে, ফলে অন্যান্য সভ্যতাভুক্ত সমাজগুলো পাশ্চাত্য অনুসৃত ধারার মাধ্যমে সম্পদ ও আধুনিক জীবন পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার এই বৈশিষ্ট্য কি এ-অর্থ বোঝায় যে, তাদের সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও গতিশীল মূলগতভাবে অন্যান্য সভ্যতার ধারার চেয়ে সম্পূর্ণভাবে পৃথক?
ইতিহাসের পদচিহ্নসমূহ এবং তুলনামূলক সভ্যতার ইতিহাসের বিশ্লেষক বিজ্ঞজনেরা কিন্তু অন্যসুরে কথা বলেন। পাশ্চাত্যের সভ্যতার অদ্যাবধি অগ্রগতির ধারা পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা থেকে নিজেকে পৃথক করতে পারেনি। অর্থাৎ, এ ধারাটি পৃথিবীর সকল সময়ে সকল সভ্যতার ইতিহাসের একটি ‘সাধারণ ধারা’।
ইসলামি পুনঃজাগরণতৎপরতা এবং এশিয়ার অর্থনৈতিক গতিশীলতার মধ্যে যে সভ্যতা আত্মপ্রকাশ করে চলেছে, এবং সেসঙ্গে অন্যান্য স্থানে চলমান রয়েছে, সে সকল সভ্যতা আজ পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্য সম্ভাবনাত্মক ও ভীতিকর বটে। পাশ্চাত্যের সভ্যতার সঙ্গে অন্যান্য সভ্যতার ‘কোররাষ্ট্রের’ একটি যুদ্ধ খুব প্রয়োজনীয় নয়। তবে এটি ঘটেও যেতে পারে। বিকল্পভাবে, পাশ্চাত্যে সভ্যতার ক্রমাগত এবং অনিয়মিত অবনতিশীলতা, যা বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আরম্ভ হয়েছে, তা চলমান থাকবে দশকের পর দশক এবং পতনপ্রক্রিয়া সম্ভবত পরবর্তী শতাব্দীতেও অব্যাহত থাকবে। অথবা, পশ্চিমা সভ্যতা পুনঃজাগরণ একটি প্রক্রিয়া অতিক্রম করে তার ধ্বংসকে ঠেকিয়ে স্বর্ণযুগ পুনরুদ্ধার করে এগিয়ে যাবে, যার ভেতর দিয়ে আবার বিশ্বনেতৃত্বে একক আধিপত্য বিস্তার করবে। এবং অন্যান্য সভ্যতা পাশ্চাত্যকে অনুসরণ ও অনুকরণ করবে।
ইতিহাসে সভ্যতার ক্রমবিকাশের স্তরসমূহ সম্পর্কে সবচেয়ে ব্যবহারযোগ্য একটি প্যাটার্ন ক্যারল কুইগলি উপস্থাপন করেছেন (অধ্যায়-২ দ্রষ্টব্য)। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতা ধীরে ধীরে ৩৭০ এ.ডি. থেকে ৭৫০ এ.ডি. পর্যন্ত সময়ের মধ্যে একটি ‘আকার’ অর্জন করে। এ দীর্ঘপথ পরিক্রমায় পাশ্চাত্য সভ্যতা ধ্রুপদী পর্যায় থেকে শুরু করে তৎকালীন চলমান বিভিন্ন সভ্যতাকে নিজেদের মতো করে তাদের সভ্যতার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটায়। এ প্রক্রিয়ায় সিমেটিক সভ্যতা স্যারাসিন এবং বাববারীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ছিল। এই সভ্যতার গর্ভধারণকাল ৮ম শতাব্দী থেকে শুরু করে ১০ শতাব্দীর শেষ অবধিকাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এ সময়টি সোজাসাপ্টা ছিল না। এখানে ছিল সংঘাত, নড়াচড়া, সভ্যতাগুলোর মধ্যে অসঙ্গতির অবস্থা, সম্প্রসারণ, সামনে গমন কিংবা পশ্চাদপসরণ। কুইগলির ভাষায়, ‘যেহেতু অন্যান্য সভ্যতা সম্মুখে এসে পড়েছে তাই পাশ্চাত্য সভ্যতা তার সংঘাতকাল অতিক্রম করছে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার এলাকা হল একটি নিরাপত্তাসংক্রান্ত এলাকা, পাশ্চাত্যের মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্র যুদ্ধ অবশ্য একটি সাময়িক শীতলযুদ্ধ ব্যতীত ছিল অচিন্তনীয়। পাশ্চাত্য (অধ্যায়-২-এ আলোচিত) সামনে এগিয়ে যাচ্ছে; পাশ্চাত্যের সর্বজনীনতা, যা রাজনৈতিক দিক থেকে জটিল ধরনের মিত্রসংঘ, চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রসমাজ যুক্ত হয়ে একটি সভ্যতার ধারা তৈরি করেছে- যে সভ্যতার মূল ভিত্তি হচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাজনীতি।’ পাশ্চাত্যের সমাজ এমন একটি সাবালক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে থেকে পরবর্তী প্রজন্ম সভ্যতাকে পৌনঃপুনিক হিসেবে চিহ্নিত করবে। কেননা কুইগলি মনে করেন, বর্তমান সময়টিতে পাশ্চাত্য আর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে না, বা কোনো বহিঃবিশ্বেও যুদ্ধরত নেই। সুতরাং, এ সময়টি শান্তির কাল বৈ কিছু নয়। উপরন্তু, এ সময়কাল প্রগতি, উন্নতি ও অগ্রগতির যুগ- এজন্য যে, তা অভ্যন্তরীণ ধ্বংসাত্মক শক্তিকে জাগতে দিচ্ছে না, নিজেদের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যের শর্ত তুলে নিচ্ছে, পরিমাপকের জন্য সাধারণত মানদণ্ড ব্যবহার করছে। মাপকাঠি, মুদ্রা এবং সকল সরকার মিলেমিশে এমন একটি সরকারব্যবস্থার দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে, যা পাশ্চাত্যকে একটি সর্বজনীন সাম্রাজ্যে রূপ দিতে চলেছে।’
পূর্বের সভ্যতার ‘স্বর্ণযুগ’ এবং তার অমরত্বের বিষয়গুলো সমাপ্ত হয়েছে নাটকীয় ও দ্রুততালে। বাহ্যিক অন্য সভ্যতার আক্রমণ ও জয়ের মাধ্যমে অথবা ধীরে ধীরে ওই সভ্যতার বেদনাদায়ক অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অসংহতির কারণে। যখন কোনো সভ্যতা বাহ্যিক শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিজে তা প্রতিরোধ করতে অক্ষম থাকে এবং অভ্যন্তরীণ কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, তার ফলাফল প্রায় একই রকম হয়ে থাকে। ১৯৬১ সালে কুইগলি বলেন যে, ‘সভ্যতা বেড়ে ওঠে, কেননা সভ্যতার সম্প্রসারিত হওয়ার মতো শক্তি থাকে (হাতিয়ার),’ আর তা হল সামরিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অথবা অর্থনৈতিক শক্তি, যা উদ্বৃত্ত ও উৎপাদনশীল আবিষ্কার বা বিনিয়োগসম্পর্কিত হয়ে থাকে। সভ্যতা পতনোন্মুখ হয় তখন, যখন তারা তাদের উদ্বৃত্ত নতুনভাবে বিনিয়োগ করতে রাস্তা খুঁজে না পায়। আধুনিককালে দেখা যায়, বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমহ্রাসমান। এটি ঘটে চলেছে, কারণ সামাজিক গোষ্ঠীসমূহ এখন উদ্বৃত্ত নিয়ন্ত্রণ করছে এবং একটি কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি সেই উদ্বৃত্ত অনুৎপাদনশীল খাতে অহং ও লালসা নিবৃত্ত করতে যত্রতত্র খরচ করে চলেছে, যা কি-না ভোগে যত ব্যয় হচ্ছে, বিনিয়োগে তত নয়। এমতাবস্থায় জনগণ তাদের পুঁজি হারাচ্ছে, বিনিয়োগ হচ্ছে না, আর সভ্যতা একটি সর্বজনীন ধ্বংসের নিমিত্তে পঙ্কিলতা ও বদ্ধতার গর্তে পতিত হয়ে পড়েছে। এ সময়টি হল : তীব্র অর্থনৈতিক বিষাদগ্রস্ততা, যা মানুষের জীবনযাত্রার মানকে নিম্নগামী করে তুলছে। বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থের মধ্যে যেন গৃহবিবাদ শুরু হয়েছে। সমাজ ক্রমে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। নিষ্ফল কাজকর্ম থামাতে বৃথাই আইনকানুন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু মোটেরওপর কথা হল পতনের নিম্নগতি বেড়েই চলেছে। ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে সমাজ ক্রমান্বয়ে মেধাহীন হয়ে পড়ছে, জনগণের বিশ্বস্ততার মানও কমছে। সমাজকে এগিয়ে নিতে নতুন ধর্মীয় আন্দোলন শুরু করতে হবে। সমাজকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে সৈনিক হতে, মানুষের মধ্যে দারুণ অনীহা কাজ করছে। এমনকি মানুষ কর পর্যন্ত দিয়ে আজ সমাজকে সমর্থন দিতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
সমাজের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতি অন্যের দ্বারা সমাজ দখল হয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে উৎসাহিত করে থাকে। যখন সভ্যতা আর নিজেকে সংরক্ষণ করতে পারে না, বা নিজেকে সংরক্ষণ করতেও চায় না, তখন সমাজ ও সভ্যতা অন্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। বারবারিয়ান বহিঃআক্রমণকারীরা তখন চলে আসে, যারা প্রায়শই আসে অন্য সভ্যতা থেকে, আসে যুবশক্তি নিয়ে, এবং আসে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী সভ্যতা নিয়ে।” ইতিহাসে বারবার ঘটা এমন বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হল এই যে, মনে হয় অনেককিছুই এখানে সম্ভাবনাময় থাকে, যদিও কিছুই অত্যাবশকীয় নয়। সভ্যতা নিজেই নিজেকে সংশোধিত, পরিমার্জিত করে, নবায়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে।
পশ্চিমাবিশ্বের জন্য কেন্দ্রীয় ইস্যু হচ্ছে, তা কি সর্বতোভাবে যে-কোনো বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াই সভ্যতার অভ্যন্তরীণ ক্ষয়প্রবণতা হ্রাস করে তাকে মেরামতপূর্বক পুনরায় গাত্রোত্থান করতে সক্ষম? পশ্চিমা সভ্যতা কি নিজেকে নবায়ন করে নিজেকে দীর্ঘস্থায়ী করতে অভ্যন্তরীণ অপশক্তি দমন করে ঐতিহ্যকে এগিয়ে নেবে, নাকি তা অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যার দিক থেকে বাইরের কোনো গতিশীল সভ্যতার অধীনস্থ হয়ে পড়ছে? *
[* হয়তো ভবিষ্যদ্বাণীটি যথার্থ, কিন্তু পর্যবেক্ষণ ও বাস্তব উপাত্ত ও তত্ত্ব এ-বক্তব্যকে সমর্থন করে না। কুইগলি বলেন, পশ্চিমা সভ্যতা ৫০০ এডিতে অস্তিত্ববিহীন ছিল, এই সভ্যতাটি ১৫০০ এডি থেকে পুনঃবিকশিত ফুলের মতো জাগ্রত ছিল, এবং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বর্তমানের সংকট কাটিয়ে এ সভ্যতা সামনে এগিয়ে যাবে, সম্ভবত এ অগ্রগতি এডি ২৫০০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। নতুন সভ্যতার প্রতিনিধি চীন ও ভারতীয় সভ্যতা পশ্চিমাসভ্যতাকে হটিয়ে দিয়ে তার স্থান দখল করবে, অথচ পশ্চিমা সভ্যতার দ্বারা উক্ত দুটি সভ্যতাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তিনি বলেছেন, এই দুটি সভ্যতা কালক্রমে পশ্চিমা সভ্যতা ও অর্থোডক্স সভ্যতা দুটিকেই ধ্বংস করে দেবে। (Karroll Quigley, the Evolution of civilizations : an introduction to Histroical Analysis (Indianapolics library press 1979 1st pub. Macmillan in 1961 pp127.164-66.]
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমাবিশ্বের সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যা কুইগলি চিহ্নিত করেছেন, তেমন একটি পরিপূর্ণ স্বাভাবিক সভ্যতা ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমাবিশ্ব এখনও অন্যান্য সভ্যতার চাইতে যোজন যোজন গুণ অগ্রবর্তী বা ধনবানের পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নিম্নগামী; সঞ্চয়, বিনিয়োগের হার বিশেষ করে পূর্বএশিয়ার তুলনায় নিচে। সম্মিলিত এবং ব্যক্তিগত ভোগের মাত্রা সর্বাগ্রে বিবেচিত হচ্ছে, ফলে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নতির জন্য পুঁজির সংকট দেখা দেবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিম্নগামী, বিশেষ করে মুসলমানবিশ্বের তুলনায়। অবশ্য এসব সমস্যার যে-কোনোটিই কিন্তু অবশ্যাম্ভাবীভাবে পশ্চিমা সভ্যতাকে আকস্মিক বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে পারবে না। পাশ্চাত্যের অর্থনীতি এখনও বিকাশমান, কমবেশি পাশ্চাত্যের মানুষ এখনও ধনবান হচ্ছেন। পশ্চিমাবিশ্ব এখনও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার ও গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।
নিম্ন-জন্মহার সরকারিভাবে সংশোধন করা সম্ভব নয়। অভিবাসন মূলত দুটি চাহিদা পূরণ করছে : প্রথমত, অভিবাসন গ্রহণকারী দেশ তার চাহিদা অনুযায়ী প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী, পরিশ্রমী জনশক্তি লাভ করতে পারে। দ্বিতীয়ত ভালো হয়, যদি অভিবাসিত মানুষ ও তার সন্তানের আত্তীকৃত হয়ে যান। তাহলে সাংস্কৃতিক সমস্যা অনুভূত হবে না। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম শর্তটি পূরণের বেলায় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আর ইউরোপীয় দেশগুলো দ্বিতীয় শর্তপূরণে বেলায় সমস্যার মধ্যে নিপতিত হচ্ছে। তবে, সুসমন্বিত নীতির দ্বারা উৎস, বৈশিষ্ট্য, এবং আত্তীকরণের সুষ্ঠু নীতিমালা প্রয়োগ করার মাধ্যমে পাশ্চাত্য সরকারগুলো প্রয়োজন মেটাতে পারে।
অর্থনৈতিক এবং জনসংখ্যা সম্পর্কিত সমস্যার চেয়েও আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে নৈতিক অবক্ষয়জনিত সমস্যা। ‘সাংস্কৃতিক আত্মহত্যা’ রাজনৈতিক অনৈক্য আজ পাশ্চাত্যের নৈমিত্তিক ঘটনা। নৈতিক অবক্ষয়ের বিষয়টি নিম্নরূপ :
১. সমাজবিরোধী শক্তির আশঙ্কাজনক উত্থান; যেমন মাদকাশক্তি ব্যবহার, সাধারণ সহিংসতা বৃদ্ধি
২. পারিবারিক বিপর্যয় ও পারিবারিক বন্ধনের অবক্ষয়; বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি, অবৈধ যৌনসম্পর্কের ঘটনা বেড়ে যাওয়া, কিশোরী মাতৃত্ব এবং এক-সন্তান- সম্পন্ন পরিবারের হার বেড়ে যাওয়া;
৩. অন্ততঃপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ‘সামাজিক পুঁজির অভাব অনুভূত হচ্ছে। অর্থাৎ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোতে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া আন্তঃব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্রমাবনতির লক্ষণ। আর এসবই কুলক্ষণ।
৪. কর্মক্ষেত্রে; কর্মনীতির ক্ষেত্রে, সাধারণ কর্মনীতির দুর্বলতা ও অভাব এবং ব্যক্তিপুঁজির সংখ্যা ও ব্যক্তিক প্রভাবে প্রভাবিত।
৫. মেধা, মনন, বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞান এবং বিদ্যার প্রতি অবহেলা ও তা অর্জনে অবহেলা। যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে, জ্ঞানোচিত অর্জনের মাত্রা হ্রাস পেতে বসেছে।
পশ্চিমাজগতের ভবিষ্যতের চেহারা এবং অন্যান্য সমাজ ও সভ্যতার ওপর তার প্রভাব অনেকাংশেই নির্ভর করবে পাশ্চাত্যবিশ্ব কীভাবে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সমাধান করে তার ওপর। বিশেষ করে মনে থাকা প্রয়োজন যে, নৈতিক বিচারে মুসলমান ও এশীয়রা পাশ্চাত্যের ওপরে অবস্থান করছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি পাশ্চাত্য সমাজের মধ্যথেকেই চ্যালেঞ্জপ্রাপ্ত হচ্ছে। এর একটি দিক হল অভিবাসন-সংক্রান্ত। অন্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে আসা অভিবাসীরা আত্তীকৃতির প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে, এবং তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আচার-অভ্যাস বদলাতে চায় না। এই সত্তাটি অধুনা ইউরোপের মুসলমান অভিবাসীদের ভেতর অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। যদিও তারা এখনও একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালগিষ্ঠ গোষ্ঠী।
একথা মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকায় হিস্পানিক সম্প্রদায়ই হল বেশিসংখ্যক অভিবাসী। যদি তাদের বেলায় আত্তীকরণ কাজ না করে বা তা ব্যর্থ হয়, তবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র একটি চিড়সম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এবং অনৈক্য ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। ইউরোপে পাশ্চাত্য সভ্যতা তোপের মুখে পড়বে, যদি সেখানে পাশ্চাত্য সভ্যতার কেন্দ্রীয় ও মৌল উপাদান খ্রিস্টধর্ম দুর্বল হয়ে যায়। কেননা, ইউরোপে ধর্মপালনের বিভিন্ন দিকের… প্রতি অনীহা লক্ষ্য করার মতো। তবে, এটি কিন্তু ধর্মের প্রতি যতটা না বৈরি মনোভাব থেকে উৎসারিত, তার চেয়ে বেশি হল ধর্ম ও ধর্মপালনের প্রতি উদাসীনতা। বলাবাহুল্য, খ্রিস্টীয় ধর্ম, বিশ্বাস, এর ধারণা, মূল্যবোধ এবং বাস্তবায়ন ইত্যাদি হল পাশ্চাত্য সভ্যতার স্তম্ভস্বরূপ। ‘সুইডিসীয়রা সম্ভবত ইউরোপের সবচেয়ে ধর্মে কম-পরিমাণে বিশ্বাসী মানুষ, কিন্তু তোমাদের জানা উচিত যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানাদি, সামাজিক কার্যকারিতা, পরিবার, রাজনীতি এবং জীবনযাপন পদ্ধতি এসবই কিন্তু মৌলভাবে লুথারের চিন্তার দ্বারা পরিণতি লাভ করেছে।’ তাই বলা চলে, আমরা লুথারীয় ঐতিহ্য ধারণ করে রয়েছি’— এমনটি বলেন একজন সুইডিশ বুদ্ধিজীবী। ইউরোপীয়দের তুলনায় আমেরিকানরা অধিকমাত্রায় ও সংখ্যায় ঈশ্বরবিশ্বাসী। তারা মনে করে যে, যারা ধার্মিক মানুষ, তারা ব্যাপভাবে গির্জায় প্রার্থনার নিমিত্তে অংশ নেয়। তবে, ১৯৮০-এর দশকে আমেরিকায় কোনো ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। তার পরবর্তী দশকে ধর্মীয় কার্যক্রমের মাত্রা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।৬ খ্রিস্টধর্মের প্রতি অনীহার মনোভাব প্রকারন্তরে ইউরোপের সভ্যতার স্বচ্ছতার ওপর একটি ভীতি ও ক্ষত সৃষ্টি করবে।
আমেরিকার জন্য তাৎক্ষণিক এবং সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকার জাতীয় পরিচয় পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। আর রাজনৈতিকভাবে অধিকাংশ আমেরিকান যা ধারণ করে বা যার প্রতি তাদের আগ্রহ, এবং যা তারা লালনপালন বা রক্ষা করতে চায়, তা হল : উদারতা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আইনের চোখে সকলের সমতা, সাংবিধানিকতা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বিংশ শতাব্দীর শেষের পর্যায়ে এই উভয় দিকই খুব কম করে হলেও ক্ষুদ্র; কিন্তু ক্ষমতাশীল বৃদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর দ্বারা চ্যালেঞ্জপ্রাপ্ত হয়েছিল। ‘বহুধা সংস্কৃতির’ নামে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের পরিচয়ের ওপর আক্রমণ করেছিল। এ-কাজের দ্বারা প্রকৃতপক্ষে তারা আমেরিকায় ‘আমেরিকীয় সাধারণ সংস্কৃতি’কে অস্বীকার করেছিল, এবং এতে করে বর্ণবাদ, নৃগোষ্ঠীক চেতনা, এবং অন্যান্য উপজাতীয় উপাদানগুলো চাঙা হওয়ার সুযোগ প্রাপ্ত হয়েছিল। তারা ইউরো-আমেরিকার সংস্কৃতির প্রতি পর্যায়ক্রমিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উত্থাপন করে। তারা আরও বলেন যে, শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে ইউরোপ- আমেরিকার একক সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করছে। এই বহুধাসংস্কৃতিপন্থীরা, যেমন আর্থার এম. স্পেসিংগার জুনিয়ার বলেন, ‘এরা নৃগোষ্ঠীভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী, যারা পাশ্চাত্যের ঐতিহ্য খুবই কম দেখতে পায়। তারা শুধু পাশ্চাত্যের অপরাধজগৎকেই বড় করে দেখে। তাদের মনোভাব পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি ক্ষতিকর ও অশুভ। ৭
বহুসাংস্কৃতিক প্রবণতা বিভিন্ন আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬০- এর দশকের ‘সিভিল রাইটস্ অ্যাক্ট’ এবং ১৯৯০-এর দশকের ক্লিনটন-প্ৰশাসন কর্তৃক ‘বহুত্বকরণ নীতি’ এর উদাহরণ। অতীতের সঙ্গে বৈপরীত্য সত্যিই বিস্ময়কর। জাতির পিতাও বিষয়টির বাস্তবতা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। এ সমস্যা সম্পর্কে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে : এটি ‘কমিটি অব দি কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসের’ মাধ্যমে গৃহীত হয়েছিল যেখানে ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, টমাস জেফারসন এবং জন এডামস্। পরবর্তীতে অনেক রাজনৈতিক নেতাই বর্ণবাদ, সংকীর্ণতাবাদ, নৃগোষ্ঠীক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বহুত্বকরণ (যা বাস্তবে ১৪১৫ এবং ১৯১৪ সালে বৃহত্তর যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছিল) নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন এবং তারা ‘সবাইকে একত্রীকরণের’ নীতির প্রতি সাড়া দেন, আর জাতীয় ঐক্যকে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। থিওডোর রুজভেল্ট সতর্ক দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘এ জাতির ধ্বংসের একটি একক শক্তিশালী কারণ হতে পারে সেই পথে, যে-পথে জাতীয়বোধকে এগিয়ে নেবার চলাচলপ্রক্রিয়াকে বাধা প্ৰদান করা হয় এবং জটপাকানো ও ঝগড়াটে পরিস্থিতির মধ্যে জাতীয়তাবোধকে নিক্ষেপ করা হয়।” ১৯৯০-এর দশকে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নেতৃত্বশাসিত জনের মধ্যে ‘ঐক্যের’ বদলে ‘বহুত্বকে’ শুধুমাত্র স্বীকার করেই নিলেন না, সেসঙ্গে তাকে নিষ্ঠার সাথে এগিয়েও নিতে উদ্যোগী হলেন।
অন্যান্য দেশের নেতাদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে, তারা তাদের সংস্কৃতিক ঐতিহ্য অস্বীকার করে নিজেদের দেশের পরিচয় একটি সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এ-ধরনের কার্যকলাপ দ্বারা কেউই সফল হতে পারেনি বরং তারা তাদের দেশকে একটি ‘ছিন্নরাষ্ট্রে’ পরিণত করেছেন। আমেরিকার বহুত্বসংস্কৃতির পক্ষের নেতারা একইভাবে স্বদেশী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেছেন। আমেরিকার সংস্কৃতির বদলে তারা অন্য সভ্যতার কথা বলছেন, যার দ্বারা তারা দেশটিকে বিভিন্ন সভ্যতার দেশে পরিণত করতে চাইছেন। যাকে বলা যায়, সেই ধরনের দেশ বানাতে চায়; যে দেশ প্রকৃতপক্ষে কোনো সভ্যতার ধারক ও বাহক হবে না, এবং এর ‘কোর চরিত্র’ আর অবশিষ্ট থাকবে না। ইতিহাস বলে যে, কোনো দেশই দীর্ঘদিন একটি সুসংবদ্ধ সমাজ হিসেবে নিজেকে ধারণ করে রাখতে পারে না। বহুসভ্যতাবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে আর ‘যুক্তরাষ্ট্র থাকবে না’ এবং ‘সম্মিলিত জাতিসংঘে’ পরিণত হবে।
বহুত্ব সংস্কৃতিবাদীরা আমেরিকানদেরসংশ্লিষ্ট অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয় ‘ধর্মীয় বিশ্বাস’ পরিবর্তনেরও কথা বলেন। আর একথা বলেন ওই সূত্রটিকে ব্যবহার করে যেখানে বলা হয়, ব্যক্তি তার ইচ্ছা অনুযায়ী সংগঠন করার, সংগঠিত হওয়ার অধিকার রাখে যা বৰ্ণ, নৃগোষ্ঠীক পরিচয়, লৈঙ্গিক এবং যৌনসাথি বেছে নেয়ার অধিকারবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে ১৯৪০-এর দশকে গুনার মিরডেল বলেন, যা তিনি একজন বিদেশী পরিদর্শক হিসেবে হেক্টর সেন্ট জোন ডি ক্রিভেকিউর এবং এলেক্সি ডি টকভিল পর্যন্ত সময় ধরে বলেছিলেন, ‘এই মহান জাতীয় জীবনের ধর্ম গাঁথুনিতে সিমেন্টের মত রিচার্ড হবসৃষ্টার যুক্তি দেখান যে, ‘এটি আমাদের জাতীর ভাগ্যস্বরূপ…’। যদি এই মতাদর্শকে জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘অস্বীকার করে বসে তখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে? সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাগ্যের কি পুনরাবৃত্তি হবে? মার্কসবাদের ব্যর্থতার সামগ্রিক ভাগ্যে … এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের নাটকীয় পতন। ইত্যাদি বিষয়ে জাপানের দার্শনিক তাকেসি উমেহারা উপদেশ দেন যে, ‘এ অবস্থা পাশ্চাত্যের উদারতাবাদ ও আধুনিকতাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে, আর বর্তমান কার্যকলাপ সেই ইঙ্গিত বহন করছে। বলা যায়, মার্কসীয় দর্শনের পতনের পর এর বিকল্প হিসেবে নয় বরং এর পরের লক্ষ্য হচ্ছে প্রভাবশালী মতাদর্শ হিসেবে ইতিহাসের সমাপনী পর্বে উদারনীতিবাদ পতনের পালা।’ এটি এমন একটি সময়, যখন মানুষ সর্বত্র নিজেদেরকে সাংস্কৃতিক পরিচয়ে পরিচিত করতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, একটি ‘কোর সংস্কৃতি’ ব্যতীত শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমাজ কতদূর এগিয়ে যাবে? রাজনৈতিক নীতিসমূহ দ্রুত পরিবর্তনশীল। এজন্য স্থায়ী ও সুদৃঢ় সমাজ গঠনে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট নয়। বহুসভ্যতাবিশিষ্ট বিশ্বপরিমণ্ডলে সংস্কৃতিকে গণনা করা হচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্র হবে সম্ভবত সর্বশেষ, যে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিবর্ণ পাশ্চাত্যের মধ্যথেকে মতাদর্শ ধরে রাখতে চাইবে।
পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রত্যাখ্যান করার আর এক অর্থ হল, যুক্তরাষ্ট্রের সমাপ্তি—এটি জানা কথা। আরও বলা যায়, এর অর্থ এভাবেও মনে করা যায় আর তা হল, পাশ্চাত্য সভ্যতার সমাপ্তি। যদি যুক্তরাষ্ট্র অপাশ্চাত্যে পরিণত হয়, তাহলে পাশ্চাত্য শুধুমাত্র ইউরোপের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়বে এবং এর মধ্যে সংযুক্ত থাকবে যৎসামান্য কিছু মানুষ যারা অন্য সভ্যতা থেকে ইউরোপে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত পাশ্চাত্য হয়ে পড়বে অতিক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আর ক্ষয়িষ্ণু, হয়ে পড়বে গুরুত্বহীন একটি ভূমি মাত্র।
বহুসংস্কৃতির নেতৃত্ব এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারার রক্ষকগণের মধ্যে সংঘাত ও আমেরিকার মনোভাব, যেমন কুর্দ-এর প্রবচনের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়, তিনি বলেন, ‘এটি একটি সত্যিকার সংঘাত’, যা পাশ্চাত্য সভ্যতার আমেরিকার অংশে ঘটে চলেছে আমেরিকানরা এ ইস্যুটিকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমরা কি পাশ্চাত্যের অধিবাসী, না অন্য কোনো জায়গার অধিবাসী? আমেরিকার ও পাশ্চাত্যের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমেরিকার পাশ্চাত্য সভ্যতা সংরক্ষণের প্রত্যয় ও পুনর্জাগরণের দৃঢ় মনোভাবের ওপর। অভ্যন্তরীণভাবে এর অর্থ দাঁড়ায় বহুত্বসংস্কৃতিবাদীদের দাবি নাকচ করে দেয়া। আর আন্তর্জাতিকভাবে এর অর্থ হল একটি অলীক ভাবনা ও উদ্ভট আহ্বান, যে আহ্বানের মাধ্যমে আমেরিকাকে এশিয়ার মধ্যে এক করে ‘পরিচিত করতে’ চাওয়া হয়। উভয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক যাই থাকুক না কেন, তাদের মধ্যেকার মৌল সাংস্কৃতিক প্রভেদ উভয়ের সম্মিলিত সমাজ মিলেমিশে একটি ‘সাধারণ’ বাসস্থান গঠনের চিন্তা অবাস্তব। আমেরিকানরা সাংস্কৃতিকভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার পরিবারভুক্ত। বহুত্বসংস্কৃতিবাদী চিন্তা সেই সম্পর্কের ক্ষতি, এমনকি তা ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু তারা কখনও তার পরিপূরক বা প্রতিস্থাপক হতে পারবেন না। আমেরিকানগণ যখন তাদের সংস্কৃতির শেকড়ের সন্ধান করে, তখন তারা তার গোড়া ইউরোপের মাটির মধ্যে খুঁজে পান।
১৯৯০-এর দশকে পাশ্চাত্যের প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন নতুন আলোচনার সূত্রপাত হতে দেখা যায়, যেখান থেকে এই স্বীকৃতি আসে যে, বিশ্বব্যবস্থা আগের নিয়ম বজায় রেখেই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবে। এই অংশটিতে অবশ্য পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠান ন্যাটোর বলিষ্ঠ ভূমিকা ও সম্প্রসারণের ওপর জোর দেয়। এজন্য ন্যাটোর পূর্ব- ইউরোপের সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারণ এবং সাংঘাতিক ও বিপজ্জনকভাবে বিভক্ত এবং ভেঙে যাওয়া যুগোস্লাভিয়া নিয়ে ভাবতে হবে। সেসঙ্গে সোভিয়েটবিহীন বিশ্বে পাশ্চাত্যের ঐক্য নিয়ে উদ্বিগ্নতাও দূর করতে হবে। এক্ষেত্রে ইউরোপ নিয়ে আমেরিকার প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন হতে হবে। যেহেতু ক্রমবর্ধিষ্ণু ও শক্তিশালী অপাশ্চাত্য দেশ ও সভ্যতাসমূহের সঙ্গে পাশ্চাত্যকে প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেহেতু পাশ্চাত্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক সাধারণ ও কোর-বিষয়গুলো এগিয়ে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্য বলিষ্ঠ করতে হবে।
আটলান্টিকের উভয়পাড়ের নেতাদের নবতেজোদ্দীপ্ত হয়ে উঠতে হবে এবং আটলান্টিক কমিউনিটিকে জাগ্রত করতে হবে। ১৯৯৪ এবং ১৯৯৫-এর সময়ে জার্মানি ও ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ হেনরি কিসিঞ্জার এবং অন্যান্য নেতাগণ এই ইস্যুটি জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ম্যালকম রিফকিন্তু বিষয়টি সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেন যে, ‘আটলান্টিক কমিউিনিটি ৪টি স্তম্ভের উপর দাঁড়াবে’, যেমন : প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা যা ন্যাটোর ওপর বর্তাবে; অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আইনের শাসন এবং সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা; উদারনৈতিক ধনতন্ত্র, মুক্ত বাণিজ্য; এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যা গ্রিস থেকে রোম; রেনেসাঁ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং যার মধ্যে রয়েছে শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধ, বিশ্বাসাবলি ও আমাদের বর্তমান শতাব্দীর সভ্যতার মূলমন্ত্র
১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় কমিশন, ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক নবায়ন করতে একটি প্রকল্প হাতে নেয়, যা ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি বিস্তারিত চুক্তি স্বাক্ষরের পর্যায়ে চলে আসে। একই সঙ্গে অনেক ইউরোপীয় রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নেতৃত্ব ট্রান্সআটলান্টিক মুক্তবাণিজ্য গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যদিও এএফএল-সিআইও (AFL-CIO) নাফটা এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক উদারীকরণ পদক্ষেপের বিরোধিতা করে। কিন্তু তারপরও তার প্রধান নেতৃত্ব ট্রান্সআটলান্টিক মুক্তবাণিজ্যচুক্তিকে জোরালোভাবে সমর্থন দেন এবং এটি সেসঙ্গে রক্ষণশীল ইউরোপীয় মার্গারেট থেচার এবং আমেরিকান (নেট গিনগ্রিস) ও কানাডীয় ও ব্রিটিশ নেতারা সমর্থন দেন।
অধ্যায়-২-এ পাশ্চাত্য সম্পর্কে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, পাশ্চাত্য প্রথমে ইউরোপীয় পর্যায়ে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, তৎপর বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ যদি তাদের নৈতিক জীবনে উন্নয়ন ঘটাতে পারে, যদি তাদের সংস্কৃতির সাযুজ্যকে ‘সাধারণ রূপ’ দিতে পারে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংহতি জোরদার করে তা ন্যাটো জোটের পরিপূরক পর্যায়ে আনতে পারে, তাহলে তারা তৃতীয় পর্যায় সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে, যা হবে পাশ্চাত্যের তথা ইউরো-আমেরিকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সচ্ছলতার একটি সফল পর্যায় অর্থবহ রাজনৈতিক সংহতির মাধ্যমে পাশ্চাত্য তার সম্ভাব্য অবনতিশীল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় পাশ্চাত্যের জনসংখ্যা হ্রাসপ্রবণতা রোধ করার কিছু পদক্ষেপ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করা, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা এবং অন্যান্য সভ্যতায় ও সমাজের নিকট পাশ্চাত্যের শক্তিকে তুলে ধরতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, পাশ্চাত্য তাদের ফলপ্রসূ বাণিজ্যিক ক্ষমতার দ্বারা (ইউ-নাফটা কনফেডারেশন) বাদবাকি বিশ্বকে খবরদারি করতে চায়।’
পাশ্চাত্য বিশ্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একত্রিত হয়ে এগিয়ে আসতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাশ্চাত্যসভ্যতার প্রতিভূ হিসেবে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হতে পারবে কি-না এবং তারা পাশ্চাত্যসভ্যতার প্রতিনিধি ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে কি-না তার ওপর।
বিশ্বে পাশ্চাত্যের অবস্থান
পৃথিবীতে এখন সাংস্কৃতিক, নৃগোষ্ঠীক, জাতীয়, ধর্মীয়, সভ্যতা-সংক্রান্ত পরিচয়ই মূল কেন্দ্রীয় ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে। সাংস্কৃতিক মিল এবং পার্থক্যর ওপর নির্ভর করেই বিভিন্ন সংঘ, জোট, সংঘাত, শত্রুতা, মিত্রতা, এবং রাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ অবস্থায় তিনটি বড় আকারের বিষয় সাধারণভাবে পাশ্চাত্য ও বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
প্রথমত, দেশদরদী নেতৃত্ব গঠনমূলকভাবে কিছু বাস্তব বিষয়ে পরিবর্তন ঘটাতে পারেন, যদি তারা সঠিকভাবে তা চিহ্নিত ও আত্মস্থ করতে সক্ষম হন। সদ্য আবির্ভূত রাজনীতিক সংস্কৃতি, অপাশ্চাত্য সভ্যতার দ্রুত বিকাশ, এবং ব্যাপকভাবে অপাশ্চাত্য সমাজে নবউত্থিত সভ্যতার গ্রহণযোগ্যতা ও তা সামনে এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়— এসবই সাম্প্রতিক বাস্তবতা। ইউরোপীয় নেতৃত্ব বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, সাংস্কৃতিক শক্তিই মানুষকে একত্রিত করে ও মানুষকে অন্যান্যদের থেকে পৃথকদিকে চালিত করে থাকে। আমেরিকার এলিট, বিপরীতভাবে এই বাস্তবতা বুঝতে সময় নিচ্ছেন অথবা বুঝতেই চাইছেন না। বুশ এবং ক্লিনটন প্রশাসন বহুধাবিভক্ত সভ্যতাসম্পন্ন সোভিয়েট ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া, বসনিয়া এবং রাশিয়ার ঐক্য মেনে নিয়েছিলেন— এই ভেবে যে, তার দ্বারা শক্তিশালী নৃগোষ্ঠীক ও সাংস্কৃতিক শক্তির মাধ্যমে চালিত অনৈক্যকে ঠেকানো সম্ভব হবে— কিন্তু বলাবাহুল্য, এ ধারণা ছিল অরণ্যে রোদনের মতো। কেননা, তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
তারা বহুসভ্যতাবিশিষ্ট অর্থনৈতিক সংহতির পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা উৎসাহিত করেছিলেন, যা ছিল নিরর্থক; যেমন এপিইসি (APEC)-এর ভাগ্যে ঘটেছিল। অথবা, অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূল্য গুনতে হয়েছে, যা নাফটা ও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। আমেরিকানরা বিশ্বের অন্য সভ্যতার কোররাষ্ট্রসমূহ যেমন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যথাক্রমে ‘বৈশ্বিক অংশীদার’ এবং ‘গঠনমূলক কার্যক্রমে’ প্রত্যাশার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তখন, যখন সেখানে প্রকৃতিগতভাবে উভয়শক্তির সঙ্গে আমেরিকার সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। অথচ, একই সময়ে ক্লিনটন-প্রশাসন বসনিয়ায় শান্তি খুঁজতে গিয়ে রাশিয়ার আন্তরিক কোনো সমর্থন ও সহযোগিতা পেতে অকৃতকার্য হয়। বিপরীতভাবে রাশিয়া অর্থোডক্স রক্ষামুখী সংকীর্ণ চিন্তা থেকে কোররাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে এগিয়েছিল
বুঝে না-বুঝে ক্লিনটন-প্রশাসন অর্থহীন দানবরূপী বহুধাসংস্কৃতিসম্পন্ন দেশ এগিয়ে নিতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। এই ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে সার্বিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছিল। তাছাড়া ওই নীতি গ্রহণ করার ফলে ইরান বলকান-এলাকায় একদলীয় ইসলামিক অংশীদারিত্বে পরিণত হয়েছিল। একই ধারায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অর্থোডক্সদের নিকট মুসলমানদের অধীনস্থ করার মতো অন্যায় কাজও সমর্থন ছিল তখন, যখন বলা হল ‘প্রশ্নাতীতভাবে চেচনিয়া রুশ ফেডারেশনের অংশ।
যদিও ইউরোপীয়রা সর্বজনীনভাবে স্বীকার করে যে, পাশ্চাত্য খ্রিস্টধর্মত্ব একদিকে, আর অন্যদিকে অর্থোডক্স ও ইসলাম-এভাবে ভাগ করে দেখার কিছু মৌল বাস্তবতা ও গুরুত্ব রয়েছে, তবে এ বিষয়ে আমেরিকা অন্যভাবে চিন্তা করে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেক্রেটারি অব স্টেট’ বলেন যে, তারা ইউরোপ অংশে ক্যাথলিক, অর্থোডক্স ও ইসলামের মধ্যে কোনোপ্রকার মৌল ভাগাভাগির স্বীকৃতি দেয় না; যারা তা মানেন না তারা ভাগ্যনির্ধারিত হতাশায় পতিত হবেন। ক্লিনটন-প্রশাসন শুরুতে স্পষ্টত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পূর্বএশিয়ার মধ্যে একটি পরিবর্তনমুখী ভারসাম্য পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিলেন, কিন্তু সময় খেয়ায় বিভিন্ন ইস্যু, যেমন বাণিজ্য, মানবাধিকার, পরমাণুবিস্তারসহ অন্যান্য বিষয়ে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে আসার কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মোটের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সাংস্কৃতিক এবং সভ্যতার জোয়ার-ভাটার কিনারে দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক রাজনীতির খেলায় দাবার গুটি চালতে গিয়ে নানাধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে বলেই মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, আমেরিকার বিদেশ নীতিনির্ধারণী চিন্তায় শীতলযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতির নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। কী রাখতে হবে, কী বদলাতে হবে, কোটি বাতিল করতে হবে- এসবই গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করার বিষয়ে তারা কিছুটা হলেও উদাসীন বলে মনে হয়। তারা এখনও মনে করে যে, পুনর্জাগরিত (যদি হয়) সোভিয়েট ইউনিয়ন আবার তাদের জন্য হুমকি বয়ে আনবে। জনগণ এখনও শীতলযুদ্ধকালীন চুক্তি, অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, জোট, ইত্যাদি পবিত্র জ্ঞানপূর্বক বজায় রাখার পক্ষপাতী। ন্যাটোকে শীতলযুদ্ধাবস্থার মতোই থাকতে হবে। জাপান-আমেরিকার নিরাপত্তা চুক্তিটি পূর্বএশিয়ার নিরাপত্তার কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এবিএম (ABM) চুক্তিটি অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। সিএফই চুক্তিটি চোখে চোখে রাখতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। স্পষ্টত শীতলযুদ্ধকালীন কোনো লিগ্যাসিই হালকাভাবে বাদ দেয়া যাবে না।
তবে, আমেরিকা বা ইউরোপের জন্য তার কোনোটিই পুরোনো ধারায় চালানো বা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা যাবে না। বহুধা সভ্যতার ধারায় বিভক্ত বিশ্ব বলে দেয় যে, ন্যাটোর সম্প্রসারণ প্রয়োজন। তাই অপরাপর ইউরোপীয় দেশের মধ্যে ন্যাটোর সদস্যপদ বণ্টন করা দরকার। এক্ষেত্রে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন ও সাংস্কৃতিকভাবে বিভক্ত এমন দুটি দেশের ক্ষেত্রে উভয়কেই সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এবিএম চুক্তি শীতলযুদ্ধকালীন এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল, যাতে করে সোভিয়েট ইউনিয়ন, আমেরিকা উভয়েই বিপদজনক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে। অর্থাৎ, এর দ্বারা উভয় দেশকে পরমাণুযুদ্ধে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ চুক্তির দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সমাজ নিজেদেরকে কোনো সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর দ্বারা হঠাৎ পরমাণু-আক্রমণ থেকে রক্ষা করা ও কোনো অযৌক্তিক স্বৈরশাসনের খামখেয়ালিপনা থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রশ্নে বাধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাপান-আমেরিকার নিরাপত্তাচুক্তিটি কার্যত সোভিয়েট আগ্রাসন থেকে জাপানকে রক্ষা করার জন্য প্রণীত হয়েছিল।
তবে শীতলযুদ্ধোত্তর সময়ে তা এখন কী উদ্দেশ্য মিটাবে বলে মনে হয়? তা কি চীনকে প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করার জন্য রাখা হবে? তা কি জাপান ও উদীয়মান চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের ও সহযোগিতার সম্ভাবনাকে ধীরগতিসম্পন্ন করার জন্য বজায় রাখা হবে? তা কি জাপানের পুনরায় সামরিকীকরণের সম্ভাবনাকে গলাটিপে ধরার অভিপ্রায়ে বজায় থাকবে? জাপানে আমেরিকার সৈন্যসমাবেশ নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে, সেসঙ্গে মার্কিনিদের জাপানের নিরাপত্তা আক্রান্ত হলে পাশে দাঁড়াবার প্রত্যয়েরও অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেন্ট্রাল ইউরোপের স্বার্থে ইউরোপে ন্যাটো এবং ওয়ার্শ চুক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। তবে, এতে করে দক্ষিণের মুসলমানদের আক্রমণের শঙ্কা রাশিয়াকে ভাবিত করে তুলছে।
তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক এবং সভ্যতার বহুমুখিতা প্রকারান্তরে পাশ্চাত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে এ আঘাত আমেরিকার গায়ে বেশি লেগেছে। কেননা, এতে করে পাশ্চাত্য সভ্যতার সর্বজনীন দিকগুলো সম্পর্কে আমেরিকার বিশ্বাসের ওপর গুড়েবালি পড়েছে। তাদের এই বিশ্বাসসমূহ বর্ণনায় এবং ভাবগত—এ দুইভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণনায় এটি প্রত্যাশা করে যে, অন্যান্য সমস্ত সমাজে পাশ্চাত্য মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং প্রায়োগিক দিক গ্রহণ করুক ও নিজেদের দেশে খাপ খাইয়ে নিক। যদি তারা তা না করে, তাদের নিজেদের সভ্যতা নিজস্ব সংস্কৃতিমুখী হয়, তবে বলতে হবে যে, তারা ‘মিথ্যা সচেতনতার শিকার’, যেমন মার্কস সেইসব প্রোলেতারিয়েটদের ভাবতেন ‘বোকা’ যারা ধনতন্ত্রকে সমর্থন জানাতেন। আর ভাবগত দিক থেকে এজন্য যে, পশ্চিমাবিশ্ব মনে করে তাদের মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি সর্ব্বোচ এবং আলোকিত; সবচেয়ে বেশি উদার, সবচেয়ে বেশি যৌক্তিক, সবচেয়ে বেশি আধুনিক, সবচেয়ে বেশি ‘সভ্য’ যা মানবসন্তান চিন্তায় ও ভাবনায় পোষণ করে থাকে।
সদ্যআবির্ভূত বিশ্বে নৃগোষ্ঠীক এবং সভ্যতাভিত্তিক সংঘাত এবং পাশ্চাত্যের বিশ্বাস যে তাদের সভ্যতা সংস্কৃতিই কেবলমাত্র সর্বজনীন-এ চেতনা তিনটি রোগে রোগাক্রান্ত : এটি ভ্রান্ত, এটি অমর, এবং এটি সাংঘাতিক বিষয়। এই পুস্তকের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়ই মিথ্যা হয়ে যায়; সেই প্রত্যয় যা মাইকেল হাওয়ার্ড কর্তৃক সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। তা হল পাশ্চাত্যের সাধারণ ধারণা হল এই যে, ‘সাংস্কৃতিক ভিন্নতা একটি ঐতিহাসিক আবেগাপুত আগ্রহ যা দ্রুতক্ষয় হয় মূলত পাশ্চাত্যমুখী, অ্যাংলোফোনি বিশ্বসভ্যতা, যা আমাদের মৌল স্তরের মূল্যবোধ… তা মোটেই সাবলীলভাবে সত্য নয়। পাঠক এখনও স্যার মাইকেল হাওয়ার্ড-এর বক্তব্য দ্বারা যারা এখনও সন্তুষ্ট হতে পারেনি, সেই সম্পর্কে তিনি বর্ণনা করেছেন বইতে এবং যেগুলো দূর করা খুব কঠিনও বটে।
অপাশ্চাত্যের মানুষ পাশ্চাত্যের যেসব বিষয় নিজেদের জন্য গ্রহণপূর্বক খাপ খাওয়াতে পারে, তা হল : মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠানাদি এবং সংস্কৃতি—এ সবই অমর, কারণ এগুলো তাই, যা সবসময়ের প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। ইউরোপ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবিস্তার ঊনবিংশ শতাব্দীতে সর্ব্বোচ স্থানে পৌঁছে গিয়েছিল এবং বিংশ শতাব্দীর শেষে আমেরিকা কর্তৃক বিশ্বের সর্বত্র প্রভাববলয় স্থাপন; মূলত পাশ্চাত্যসভ্যতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। ইউরোপের বৈশ্বিকরণ অবশ্য আর অবশিষ্ট নেই। আমেরিকার আধিপত্য এখন ক্রমহ্রাসমান, এজন্য যে সোভিয়েট ইউনিয়নের হাত থেকে আর তাকে বাঁচাবার তাগিদ নেই; শীতলযুদ্ধ চলাকালে যে তাগিদ প্রতিয়িনত অনুভূত হত। এখন সোভিয়েটে তার ভীতিও নেই, প্রতিক্রিয়ার আধিপত্যও নেই। আমরা আলোচনা করে দেখেছি যে, সংস্কৃতি সবসময়ই ক্ষমতার অনুগামী। যদি অপাশ্চাত্য সমাজ পুনরায় আবার পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বারা আকারপ্রাপ্ত হয় তবে তা হবে সম্প্রসারণ, সৈন্যসমাবেশকরণ এবং পাশ্চাত্য ক্ষমতার দৌড় দেখানোর মতো বিষয়। সাম্রাজ্যবাদ হল সার্বজনীনতার যৌক্তিক কার্যকর ফলাফল বিশেষ। তদুপরি, একটি বয়োবৃদ্ধ সভ্যতা হিসেবে পাশ্চাত্যের আর জনসংখ্যাবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষুরধার নেই, যা অন্য সমাজে নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেবার আসল হাতিয়ার। অবশ্য, বিষয়দুটো আবার পাশ্চাত্য মূল্যবোধের দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক-গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। যেহেতু এশীয় ও মুসলমান সভ্যতা অধিক থেকে অধিকতর মাত্রায় নিজেদের প্রদর্শন ও দাবি করা শুরু করেছে যে, তাদের সংস্কৃতির সর্বজনীনতা রয়েছে; সেহেতু এ পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যকে অধিকতরভাবে সর্বজনীন ও সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে হবে।
পাশ্চাত্যের সর্বজনীনতা বিশ্বের জন্য বিপদজ্জনক। কারণ, এটি প্রধান প্রধান আন্তঃসভ্যতার মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে, কোররাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। এ অবস্থা ইউরোপের জন্যও সাংঘাতিক বিপজ্জনক। কেননা, এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের পরাজয়ের ঝুঁকি থাকবে। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর পাশ্চাত্যবিশ্ব ভেবেছিল এখন থেকে তাদের সভ্যতাই সবকিছু এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, এবং একই সময়ে তারা ভেবেছিল এশিয়া দুর্বল হয়ে যাবে। মুসলমানেরাসহ অন্যান্য সমাজ শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এমতাবস্থায়, তারা ব্রুটাসের সেই পরিচিত এবং শক্তিশালী যুক্তি প্রয়োগ করতে পারবে :
আমাদের সৈন্য সংখ্যা কানায় কানায় পূর্ণ
আমাদের গতি- সেও পরিপক্ব।
আমাদের শত্রু নিয়ত বর্ধিষ্ণু
আমরা অবস্থান করছি উঁচু স্থানে,
কিন্তু, পতনের জন্যও প্রস্তুত।
মানুষের জীবনপ্রবাহে থাকে জোয়ার-ভাটা;
যা তাকে টেনে নেয় প্লাবনের পানে:
নিয়ে যায় ভাগ্যের পরিণতির প্রান্তে;
বিরত রাখে জীবনের অজানা সমুদ্রযাত্রা।
বাধ্য করে অগভীরবোধ আর মর্মপীড়ায় ডুবে যেতে।
আমরা তেমনি টইটুম্বুর সমুদ্রে ভাসমান,
আগত স্রোতকে করতেই হবে বরণ-
যখন তা আমাদের পানে আসে ধেয়ে;
অথবা আমাদের সাহস যাবে খোয়া।
এই যুক্তির ফলাফল কিন্তু ব্রুটাসের ভাগ্যে ফিলিপির যুদ্ধে পরাজয় ডেকে এনেছিল। আর পাশ্চাত্যের বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে-এর অর্থ যেন না হয় যে, ক্ষমতার বদল ঘটাতে হবে, বরং শিখতে হবে কীভাবে অগভীরবোধকে অস্বীকার ও অমান্য করতে হয়, এককভাবে দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়। কর্মপন্থাকে নরম ও সহনশীল করতে হয় এবং কীভাবে সংস্কৃতিকে শঙ্কামুক্ত রাখতে হয়।
প্রত্যেক সভ্যতাকেই প্রায় একই ধরনের প্রক্রিয়ায় আবির্ভূত, বর্ধিত ও পতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তবে, পাশ্চাত্য অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে ভিন্ন। এজন্য নয় যে, এটি কীভাবে গড়ে উঠেছে, বরং মূল পার্থক্য হল, অন্যান্য সভ্যতা থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতার স্বতন্ত্র চরিত্র, অর্থাৎ এর মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে যা আছে তা হল : খ্রিস্টধর্ম, বহুত্ববাদিতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং আইনের শাসন, যা পাশ্চাত্যকে সম্ভব করে তুলেছে আধুনিক হতে। সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা এবং অন্যান্য সমাজের জন্য বার্তাবহ হতে। বলাবাহুল্য, এসব বৈশিষ্ট্যই একমাত্র পশ্চিমের সম্পত্তি এবং তা পাশ্চাত্যবিশ্বকে বিশেষ সাজে সজ্জিত করে তুলেছে। আর্থার এম স্কেলসিংগার জুনিয়ার বলেছেন যে, ‘এর উৎস হল অদ্বিতীয়, যা ধারণ করে ব্যক্তিস্বাধীনতা, রাজনৈতিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা …। এসবই ইউরোপীয় ধারণা, এশীয় নয়, নয় তা আফ্রিকার ধারণা, এমনকি এগুলো মধ্যপ্রাচ্যেরও নয়, তারা এটি গ্রহণপূর্বক নিজেদের সমাজে প্রয়োগ করতে পারে। তারা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে অদ্বিতীয় করে তুলেছে। পাশ্চাত্যসভ্যতা অমূল্য এজন্য নয় যে, তা সর্বজনীন, আসলে তা অমূল্য, কারণ এটি ‘অদ্বিতীয়’। পাশ্চাত্যের নেতাদের প্রধান দায়িত্ব হল অন্য সভ্যতাকে পাশ্চাত্যের অনুকরণে আকার প্রদান করা, যা তাদের ক্রমক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতার বাইরে, বরং তারা তাদের সভ্যতা সংরক্ষণ, ধারণ এবং নবায়নপূর্বক অদ্বিতীয়ত্বকে রক্ষা করতে পারে। এটিই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে। কেননা, পাশ্চাত্যের খুবই শক্তিশালী দেশ হিসেবে দায়দায়িত্বের সিংহভাগ বর্তায় যুক্তরাষ্ট্রের কাঁধে। পাশ্চাত্যের পতনের যুগে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মূল কাজ হবে :
- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সংহতি ও সমন্বয় জোরদার করতে হবে; যাতে করে অন্যসব রাষ্ট্র তাদের মধ্যেকার পার্থক্যের কারণে কোনো সুযোগ নিতে না পারে;
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো জোটে সেন্ট্রাল ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে একাত্ম করে নিতে হবে, যেমন বাল্টিক রিপাবলিকসমূহ, শ্লোভাকিয়া এবং ক্রোয়াশিয়া;
- লাটিন আমেরিকায় ‘পাশ্চাত্যকরণকে’ জনপ্রিয় করে তুলতে হবে এবং মানুষকে পাশ্চাত্যমুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে হবে। লাটিন আমেরিকার সঙ্গে আমেরিকা ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়াতে হবে;
- জাপানের পাশ্চাত্য বিমুখতার প্রবণতাকে ধীরগতিসম্পন্ন করতে হবে এবং চীনের সঙ্গে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করতে হবে;
- অর্থোডক্স রাষ্ট্রগুলোর ওপর একটি ‘কোররাষ্ট্র’ হিসেবে রাশিয়ার কর্তৃত্ব মেনে নিতে হবে এবং দক্ষিণে রাশিয়ার নিরাপত্তাসংক্রান্ত বৈধতার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে;
- অন্যান্য সভ্যতার ওপর পশ্চিমাজগতের সামরিক ও প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা ও আধিপত্য বজায় রাখতে হবে;
- গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে, বহুধাবিশিষ্ট বর্তমান সভ্যতার জগতে অন্যান্য সভ্যতার ওপর পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপ সম্ভবত বর্তমান বিশ্বের সংঘাতের অন্যতম মূল উৎস। বিষয়টি স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
শীতলযুদ্ধের পরবর্তী অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র তার বিদেশনীতির প্রতি সাড়া দিয়ে প্রচুর ধার কর্জ করে ফেলেছে। আজকালকার বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর বিশ্বকে পদানত করার বা বিশ্বব্যবস্থা থেকে দূরে যাবার কোনোটিই করতে পারে না। আন্তর্জাতিকতাবাদ কিংবা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা, বহুপাক্ষিকত্ব অথবা একপক্ষীয়ত্ব—এর কোনোটিই আজ আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না।
সভ্যতার যুদ্ধ এবং এর সুবিন্যস্ততা
বিশ্বের ‘কোররাষ্ট্রসমূহের’ মধ্যে সভ্যতার যুদ্ধ শুরু হওয়ার বিষয়টি অভাবনীয় হলেও অসম্ভব—একথা বলা চলে না। আমরা আগেই আলোচনা করছি, এ-ধরনের যুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে বিভিন্ন সভ্যতার ফাটলরেখা বরাবর থেকে। এটি মুসলমান এবং অ-মুসলমানদের মধ্যে ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। আর এক্ষেত্রে ফাটলরেখা বরাবর অবশিষ্ট কোররাষ্ট্র, মুসলমান, তাদের যুদ্ধবাজ সমধর্মাবলম্বীদের সমর্থনে শুরু করতে পারে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের রাষ্ট্রগুলোরও যুদ্ধে সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যে থাকবে না, তা বলা যায় না। সবচেয়ে বিপদজনক দিক হচ্ছে এই যে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বহুসভ্যতাসম্পন্ন দেশের যুদ্ধে শক্তির ভারসাম্যের ব্যাপক অদলবদল ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এতে কোররাষ্ট্র ও সভ্যতাসমূহের ভেতর নতুনভাবে শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হতে পারে। যদি এ-ধরনের যুদ্ধ চলতে থাকে, “বিশ্বের ইতিহাসে রাজনীতির খেলায় সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়’ হিসেবে চীন আবির্ভূত হয়ে আন্তর্জাতিক সুস্থিরতার ক্ষেত্রে ওলটপালট ঘটিয়ে দিতে পারে। আর এটি একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে পূর্বএশিয়ার আবির্ভাব আমেরিকার স্বার্থের জন্য বিপরীতমুখী হবে। কেননা ঐতিহাসিকভাবেই দেশদুটি বিপরীত স্বার্থমুখী।
আমেরিকার স্বার্থকে মনে রেখে প্রশ্ন করা যায়, তাহলে কীভাবে চীনের সঙ্গে তার যুদ্ধমঞ্চে আগমন হবে? ২০১০ সাল ধরে নিয়ে কল্পনা করা যায়, আমেরিকার সৈন্যবাহিনী কোরিয়া থেকে বের হয়ে এসেছে, ধরা যাক দুই কোরিয়া একত্রিত হয়েছে; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি জাপানেও হ্রাস পেয়েছে। তাইওয়ান ও মূলভূমি চীনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্থাপিত হয়ে গিয়েছে। তাইওয়ান একটি ‘ডি ফ্যাক্টো’ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বহাল থাকল, কিন্তু সর্বতোভাবে চীনের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব তাইওয়ানের ওপর বজায় থাকল। চীনের দায়দায়িত্বে তাইওয়ান জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন করল, যেমন করে অর্জন করেছিল ১৯৪৬ সালে ইউক্রেন এবং বেলারুশ। দক্ষিণ চীনের সমুদ্রে তেলসম্পদ দ্রুত উত্তোলনের ব্যবস্থা নেয়া হল, আর এটি হল প্রধানত চীনের কর্তৃত্বে। তবে, সেখানে ভিয়েতনামের অংশে আমেরিকার কোম্পানি কাজ পেল। এমতাবস্থায়, চীন তার আত্মবিশ্বাস থেকে ঘোষণা দিয়ে বসল যে, সমগ্র দক্ষিণ-সমুদ্রের তেল-এলাকা সে একা নিয়ন্ত্রণ করবে, যেমনটি সে বরাবরই দাবি করে আসছিল। এ অবস্থায় ভিয়েতনাম ছাড় দেবে না, উভয় দেশের মধ্যে সমুদ্রে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। চীন ১৯৭৯ সালে তাদের অপমানের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠল; ভিয়েতনাম জয় করতে চাইল। ভিয়েতনাম আমেরিকার সহায়তা চেয়ে বসল। চীন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধবলয়ের বাইরে অবস্থানের সতর্কবার্তা পাঠাল। জাপানসহ অন্যান্য এশীয় দেশগুলো থাকল ভীত-সন্ত্রস্ত, অথবা দ্বিধাদ্বন্দ্ব্বগ্রস্ত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলল যে, চীন কর্তৃক ভিয়েতনাম-অভিযান সে মেনে নেবে না। অতএব, চীনের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ নেমে এল এবং সেসঙ্গে একটি ক্ষুদ্র কর্মীবাহিনী প্রেরণ করে তা দক্ষিণ-চীন সমুদ্র এলাকায় পাঠিয়ে দিল। চীন বলল, এটি আমেরিকা কর্তৃক তার জলসীমা লঙ্ঘন। অতএব, সে কর্মীবাহিনীর ওপর বিমানহামলা শুরু করল। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ও জাপানের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি আনা গেল না; কার্যত পূর্বএশিয়ার সর্বত্র যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হল। জাপান তার দেশে মার্কিন ঘাঁটি ব্যবহার করে চীনের সঙ্গে মার্কিনীদের যুদ্ধ করার অনুমতি দিল না। যুক্তরাষ্ট্র উক্ত সিদ্ধান্ত ‘থোরাই কেয়ার করল’। জাপান নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দিল এবং জাপানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি আলাদা করে ফেলল।
চীনের সাবমেরিনগুলো এবং ভূমিবাহিনী মূল চীন ও তাইওয়ানের মাটি ব্যবহার করে আমেরিকান সৈন্যদের ওপর তুমুল আঘাত হানল। এতে আমেরিকার জাহাজ ও অন্যান্য সামগ্রীর অপরিমিত ক্ষতি হল। ইতিমধ্যে চীনে ভূবাহিনী হ্যানয়ে প্রবেশ করে তা নিজেদের দখলে নিয়ে এল, সেসঙ্গে ভিয়েতনামের বিরাট অংশ দখল করে বসল। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের হাতেই পরমাণুঅস্ত্র বহনে সক্ষম এমন ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। তবে যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হল না। এই ধরনের আক্রমণের ভীতি উভয় সমাজের মধ্যে দেখা দিলেও, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে উক্ত ভীতির পরিমাণ স্বভাবতই বেশি দেখা দিল। এ অবস্থায় অনেক মার্কিনীর নিকট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল; তারা কেন এ- ধরনের ভয়ভীতিকর পরিস্থিতির শিকার হতে যাবে? যদি চীন দক্ষিণচীনের সমগ্র এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে তাহলে আমেরিকার ক্ষেত্রে তার কী এমন বাড়তি প্রভাব পড়বে? দক্ষিণ পূর্বএশিয়ার উপরই বা তার কী প্রভাব পড়তে পারে?
যুদ্ধের বিরুদ্ধে হিস্পানিক-অধ্যুষিত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকাতে বেশি আতঙ্ক ও অবস্থান দেখা দিল। জনগণ এবং সরকার (আঞ্চলিক) বলতে লাগল যে, ‘এ যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ নয়’ এবং ১৯১২ সালের নিউ ইংল্যান্ডের (মডেল) পদাঙ্ক অনুসরণের প্রস্তুতি নিল। চীন প্রাথমিকভাবে তার জয় সুনিশ্চিত করার পর মার্কিন মুল্লুকের আদলে ১৯৪২ সালের জনমতের ধারায় এগুতে লাগল। আধিপত্যকারী একটি দেশের জন্য পরাজয়ের গ্লানি ও মূল্য গগনস্পর্শী। তাহলে এখন একটি পারস্পরিক সমঝোতায় আসা যাক! ততক্ষণে, বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ অথবা ‘এই নকল যুদ্ধ’ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে প্রধান প্রধান সভ্যতার অন্যান্য রাষ্ট্রের উপর এই যুদ্ধের একটি প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল বর্তাতে শুরু করে দিয়েছে। যেহেতু চীন ব্যস্ত ও ক্লান্ত; ভারত এ সুযোগে তার চিরশত্রু পাকিস্তানের উপর আক্রমণের মরণকামড় বসাল এবং সেক্ষেত্রে দেশটির পরমাণু ও প্রচলিত সামরিক শক্তি সর্বোচ্চ প্রয়োগের সংকল্প নিল। প্রাথমিকভাবে এ প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখলেও পাকিস্তান, ইরান ও চীনের মধ্যে স্থাপিত জোট নড়েচড়ে বসল এবং চাঙা হয়ে ইরান সর্বাগ্রে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বাধুনিক অস্ত্র নিয়ে হাজির হল। এ অবস্থায় ভারত হঠাৎ করেই যেন প্যাকের মধ্যে আটকে গেল। ইরানি বাহিনী ও পাকিস্তানের গেরিলা বিভিন্ন নৃ- গোষ্ঠী থেকে এসে পাকিস্তানের হাতকে শক্তিশালী করে তুলল। পাকিস্তান ও ভারত উভয় শক্তিই তখন আরবরাষ্ট্রগুলোর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করল। ভারত উপমহাদেশে ইরানের আধিপত্যের সম্ভাব্য বিপদজনক দিক তুলে ধরল। অন্যদিকে, প্রাথমিক পর্যায়ে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে চীনের সাফল্য মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব আরও শক্ত করল। এ অবস্থায় একের-পর-এক মার্কিনপন্থী আবর দেশ ও তুরস্কে ইসলামি শক্তি জাগ্রত হয়ে আন্দোলন আরম্ভ করে দিল এবং এ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করল উচ্চ জন্মহার জনিত জমে ওঠা যুবশক্তি (রিজার্ভ আর্মি)।
ইসলামপন্থীদের কোপানলে পড়ে ও তাড়নায় আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলে একটি ‘মরণকামড়’ আক্রমণ করে বসল। এ অবস্থায় ইতিমধ্যে সীমিতভাবে ৬ষ্ঠ মার্কিন রণতরীকে অভিযান থেকে ঠেকানো গেল না। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই তাদের সমর্থনে প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সমাবেশ ও জোট গঠনে তৎপর হল। যেহেতু চীন সামরিক সাফল্য বয়ে আনতে পেরেছে, সেহেতু জাপান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চীনের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে দিল। জাপানের পরিবর্তিত এই পদক্ষেপ অর্থাৎ প্রচলিত নিরপেক্ষতা থেকে চীনপন্থী হওয়ার দরুন জাপানকে সহযোদ্ধা হিসেবে পাওয়ার জন্য চীন প্রচেষ্টা চালাতে লাগল। জাপানি সৈন্যরা জাপানে মার্কিন ঘাঁটি দখল করে বসলো এবং যুক্তরাষ্ট্র রাগান্বিতভাবে তার সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে নিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন জাপানের উপর অবরোধ আরোপ করল। আর জাপানি ও আমেরিকান জাহাজগুলো পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসগরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হল। যুদ্ধের প্রারম্ভে চীন রাশিয়ার সঙ্গে একটি পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তির জন্য প্রস্তাব প্রেরণ করেছিল (তা যেন হিটলার-স্টালিন চুক্তির কথাই মনে করিয়ে দেয়)। চীনের সাফল্য রাশিয়ার নিকট উল্টোভাবে আসল, যা তারা জাপানের ক্ষেত্রে করেছিল। চীনের সম্ভাব্য বিজয় এবং কার্যত পরবর্তীতে পূর্বএশিয়ার একক অধিপত্য বিস্তারে ভাবনা প্রকৃতপক্ষে মস্কোকে আতঙ্কিত করে তুলল। রাশিয়া তার সৈন্যদের চীনের বিরুদ্ধে সমাবেশের চিন্তা থেকে সাইবেরিয়ায় সৈন্য মোতায়েন করল। চীন তখন সেখানে তার স্বজাতিদের রক্ষার্থে সৈন্য পাঠাল এবং ভালদিভোস্টক দখল করে ফেলল। এ ছাড়া আমুর নদীর পাদদেশসহ সাইবেরিয়ার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা চীনের দখলে চলে এল। চীন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে চীনের সৈন্যরা মধ্য-সাইবেরিয়ায় গেল। এমতাবস্থায় মঙ্গোলিয়ায় গণবিদ্রোহ সৃষ্টি হল, এটি ছিল পূর্বে চীনের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র।
তেলক্ষেত্র দখল ও তা সংরক্ষণ করাই ছিল যুদ্ধরত দেশগুলোর মূল লক্ষ্য। জ্বালানির জন্য পরমাণুশক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলেও জাপান এখনও প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এজন্য আমদানি-উৎস হিসেবে তাকে পারস্য উপসাগর, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণচীনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। যুদ্ধের সময় আরবদেশগুলো যেমন ইসলামি উগ্র শক্তির দখলে চলে যায়, সেহেতু ইসলামি দেশসমূহ থেকে পশ্চিমা দেশে তেলরপ্তানি হ্রাস পাওয়ার দরুন পশ্চিমাবিশ্ব তেলের জন্য রাশিয়ার দিকে ঝুকে পড়তে বাধ্য হয়। এজন্য রাশিয়াকে সমর্থন দান করা পশ্চিমের জন্য একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াল, যাতে রাশিয়া দক্ষিণদিকে মুসলমান এলাকায় তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণ উদ্যেমে তার ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন পেতে চাইল। অবশ্য, ইউরোপ আমেরিকাকে কূটনৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতা দিতে চাইলেও সামরিক শক্তি দিয়ে সাহায্য করতে রাজি হল না। চীন এবং ইরান উভয় দেশই ভীত ছিল এই ভেবে যে, ইউরোপীয় শক্তিগুলো বুঝি আমেরিকার পেছনে জড়ো হয়ে যায়; কেননা, যুক্তরাষ্ট্র শেষপর্যন্ত বিগত দুটি মহাযুদ্ধে ইউরোপের মূল দুটি শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সমর্থন অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। এজন্য বসনিয়া এবং আলজেরিয়ায় চীন ও ইরান গোপনে পরমাণুঅস্ত্র সরবরাহ করে ইউরোপকে চাপে রাখল এবং যুদ্ধে না জড়াতে সতর্ক করে দিল। কিন্তু বিধি ছিল বাম, তাই চীন যা চাইল, হল ঠিক তার উল্টো। ন্যাটো-জোটের গোয়েন্দা মারফত তারা গোপন তৎপরতা জেনে গেল এবং অবিলম্বে পরমাণুশক্তিবাহী ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিল। এই অবস্থায় সার্বিয়া তুর্কিদের হাত থেকে খ্রিস্টত্বকে রক্ষা করার তার ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধ থেকে বসনিয়া দখল করে ফেলল। ক্রোয়েশিয়াও এ অভিযানে যোগদান করল। আর দুটি দেশ মিলে বসনিয়া ভাগ করে নিল। তারা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দখলে নিয়ে নিল এবং ১৯৯০-এর দশকে শুরু হওয়া অসমাপ্ত নৃগোষ্ঠীক নিশ্চিহ্নকরণ কার্যক্রম পূর্ণউদ্যেমে শুরু করল। আলবেনিয়া ও তুরস্ক বসনিয়াকে সাহায্য করতে সক্রিয় হল। গ্রিস ও বুলগেরিয়া তুরস্কের ইউরোপিয় অংশ আক্রমণ করে বসল। ইস্তাম্বুলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল এবং তুর্কীরা বসফরাস প্রণালী দিয়ে সরে গেল। ইতোমধ্যে পরমাণু অস্ত্রবাহী একটি ক্ষেপণাস্ত্র আলজেরিয়া ব্যবহার করে বসল যা মারসেইলিস-এর বাইরে বিস্ফোরিত হল। আর ন্যাটো বিভৎস এক বিমান হামলা চালাল উত্তরআফ্রিকার লক্ষ্যবস্তুর উপর।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া এবং ভারত, সত্যিকারভাবে চীন, জাপান এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল। কীভাবে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল? উভয়পক্ষের নিকট ছিল পরমাণুঅস্ত্র। যদি তারা খুব কম মাত্রাতেও তা ব্যবহার করত তা হলে উভয় পক্ষের প্রধান শক্তি ধ্বংস হয়ে যেত। যদিও আলাপ-আলোচনায় মাধ্যমেও সমাধান এগুলো না, যা ঘটল তা হল, পূর্বএশিয়ায় চীনের আধিপত্যের মৌল অবসান ঘটল না। বিকল্পভাবে পশ্চিমাবিশ্ব গতানুগতিক অস্ত্র ব্যবহার করে চীনকে পরাস্ত করতে চেষ্টা করে। চীনের সঙ্গে জাপানের জোটবদ্ধতা চীনকে আমেরিকার নৌসেনাদের হাত থেকে চীনের মধ্যভাগে ও সমুদ্রপাড়ে অবস্থিত জনগণ ও শিল্প এলাকাকে রক্ষা করতে সাহায্য করল। তা যেন ইনস্যুলার কার্বন সেনিটারির মতো কাজ করল। আরও একটি বিকল্প হল চীনের প্রতি পাশ্চাত্যের এগিয়ে যাওয়া। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধে ন্যাটো রাশিয়াকে জোটের একজন সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে সাধুবাদ জানিয়ে দেয়। এবং ন্যাটো রাশিয়ার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে একসাথে কাজ করে, যাতে রাশিয়া মুসলমান-নিয়ন্ত্রিত সেন্ট্রাল এশিয়ার তেল ও গ্যাস এলাকার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। তারা একত্রে তিব্বত, মঙ্গোলিয়া ও ইউগহার্স-এ চীনাশাসন অবসানের লক্ষ্যে সেখানে কাজ করার কথা বলে। এতদ্ব্যতীত, পাশ্চাত্য ও রাশিয়ার সম্মিলিত বাহিনী সাইবেরিয়ায় সমাবেশ ঘটাতে চাওয়া হয়, যাতে করে চীনের গ্রেট প্রাচীর ভেদ করে বেজিং মাঞ্চুরিয়ায় ও হান হার্টল্যান্ডে যাওয়া যায়।
বিশ্বব্যাপী সভ্যতার এই যুদ্ধের যে কলাকৌশল আসুক না কেন, রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের সম্মিলিত সামর্থ্যে তারা তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে যাবে কি-না তার চেয়েও বড় কথা হল, যুদ্ধের ফলে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশের অর্থনীতি, সামরিক ও জনসংখ্যা হ্রাস পাবে। ফলে, এ যাবৎকালে কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে বৈশ্বিক ক্ষমতার যা শতাব্দীর-পর-শতাব্দী ধরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, আবার পশ্চিম থেকে পূর্বে গিয়েছে, তা এখন নতুন মোড় নিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী হয়েছে। এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় লাভবান হচ্ছে তারাই যারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নাই। পাশ্চাত্য, রাশিয়া, জাপান, চীন কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভারতের জন্য রাস্তা এখন পর্যন্ত খোলা থাকল—যদি তারা একটি অংশগ্রহণকারী হিসেবে ছিল, যদি তারা ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়, তবে তারা হিন্দুধারায় বিশ্ব পুনঃনির্মাণে মুনশিআনা দেখাতে সমর্থ হবে।
আমেরিকার জনগণের একটি বড় অংশ, যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার জন্য তাকে দোষারোপ করল, বিশেষ করে সংকীর্ণভাবে প্রণোদিত ওআএসপি-এর এলিট সম্প্রদায়। হিম্পনিক নেতৃত্বে হয়তো ‘মার্শাল পরিকল্পনার’ আদলে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে। তাছাড়া লাটিন আমেরিকার অর্থনীতি অত্যন্ত চাঙা হয়ে উঠবে, কেননা যুদ্ধে অংশ না নেয়ার জন্য তাদের কোনোপ্রকার ক্ষতি হয়নি। আফ্রিকার পক্ষে ইউরোপের পুনঃনির্মাণে তেমন কিছু দেবার নেই, তারা বরং ‘যাযাবরত্ব ও শিকার’ নিয়েই থাকবে। এশিয়ার চীন, জাপান এবং কোরিয়া যদি যুদ্ধের দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে, তাহলে ক্ষমতার কেন্দ্র দক্ষিণদিকে হেলে যাবে। হয়তো ইন্দোনেশিয়া (নিরপেক্ষ ছিল) হবে প্রভাববিস্তারকারী দেশ, তা হবে অস্ট্রেলিয়ার পরামর্শে ও নেতৃত্বে, সে অবস্থায় নিউজিল্যান্ড থেকে পশ্চিমে মায়ানমার এবং শ্রীলঙ্কা উত্তরে ভিয়েতনাম পর্যন্ত এর প্রভাববলয় বিস্তৃত হবে। যা হবে, তা হল, চীনের সঙ্গে ভারতে পুরাতন শত্রু সম্পর্ক আবার জেগে উঠবে।
যেভাবেই হোক না কেন, বিশ্বের পরবর্তী নেতৃত্ব ও রাজনীতি হবে দক্ষিণমুখী। যদি এই দৃশ্যাবলি পাঠকের নিকট বন্য ও আবেগপ্রবণ কল্পকাহিনী বলে মনে হয়, তাহলে সেই ভালো তা বলতে হবে। তাহলে আসুন আমরা প্রত্যাশা করি, এর চাইতে যেন বেশি বন্য-আবেগপ্রবণ সভ্যতার যুদ্ধ পৃথিবীতে না হয়। তবে, এ দৃশ্যাবলির সবচেয়ে জ্বালাময় সত্য-প্রতিম হল, যুদ্ধে কোনো সভ্যতার কোররাষ্ট্রের (আমেরিকা) ‘হস্তক্ষেপ’, যখন অন্য কোনো সভ্যতার কোররাষ্ট্রের সঙ্গে (চীন) একই সভ্যতার অন্যরাষ্ট্রের (ভিয়েতনাম) যুদ্ধ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ-যুদ্ধে হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয়, কেননা এতে করে আন্তর্জাতিক আইন রক্ষা করা যায়, এর ভেতর দিয়ে আগ্রাসী মনোভাব ও কর্মকাণ্ড ভাগিয়ে দেয়া যায়, সমুদ্রসীমার স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়, দক্ষিণচীনের তেলক্ষেত্রের অংশীদারদের অংশীদারিত্ব রক্ষা করা যায়, এবং সবচেয়ে বড় কথা পূর্বএশিয়ায় একক শক্তির আধিপত্য প্রতিরোধ করা যায়। চীনের দৃষ্টিতে এই হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে অসহনীয়। কেননা এ যুদ্ধ মূলত চীনবিরোধীদের চীনের বৈধতার প্রতি কর্তৃত্ব প্রকাশ করার ওপর হস্তক্ষেপকে উৎসাহিতকরণ এবং বৈশ্বিক রাজনীতি বিষয়ে চীনের ভূমিকাকে অস্বীকারকরণ।
সামনের দিনগুলোতে প্রধান প্রধান আন্তঃসভ্যতাসংক্রান্ত যুদ্ধ এড়াতে হলে কোর দেশগুলোকে অন্য সভ্যতার যুদ্ধের মধ্যে নাকগলানো থেকে বিরত থাকতে হবে। অবশ্য এই সত্যটি গ্রহণ করতে অনেক রাষ্ট্র, বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মেনে নেয়া খুবই কঠিন। এই বর্জনীয় আইন; অর্থাৎ কোররাষ্ট্রকে অবশ্যই অন্য সভ্যতার মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধে নাকগলানো চলবে না। প্রকৃতপক্ষে, এই বহুধাবিভক্ত সংস্কৃতিসম্পন্ন এবং বহুঅক্ষবিশিষ্ট বিশ্বে বড় ধরনের যুদ্ধ ও সংঘাত এড়াবার প্রথম ও প্রধান শর্ত। দ্বিতীয় কাঙ্ক্ষিত শর্ত হচ্ছে, যুক্ত মধ্যস্থতাকারী আইন প্রয়োগ করা, অর্থাৎ কোররাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ফাটলরেখা বরাবর অন্য সভ্যতার রাষ্ট্র ও তাদের সভ্যতার যুদ্ধ থামানো যায়। এই আইনগুলো মেনে নিয়ে সভ্যতাগুলোর মধ্যে বৃহত্তর সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া পাশ্চাত্য কিংবা অন্যান্য সভ্যতার জন্য খুব সহজ কাজ নয়। কেননা, পাশ্চাত্য যেমন মনে করে, অন্যান্য সভ্যতার প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি অন্যান্য সভ্যতারও পাশ্চাত্যের কর্তৃত্বমূলক মনোভাবকে সুনজরে দেখে না। কোররাষ্ট্রগুলো মনে করে থাকে যে, বর্তমান বিশ্বে পরমাণুঅস্ত্র রাখা তার অধিকার এবং তারা আরও মনে করে যে, অত্র সভ্যতার অধীন অন্য কোনো সদস্যরাষ্ট্রের পরমাণুঅস্ত্র রাখা চলবে না। উদাহরণস্বরূপ পেছনে ফিরে দেখা যায়, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ পরমাণু অস্ত্র অর্জনের সময় জুলফিকার আলী ভুট্টো এভাবে তখন তার কার্যক্রমকে সিদ্ধ করতে চাইলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি ইসরায়েল ও দক্ষিণ- আফ্রিকার পরিপূর্ণ পরিমাণ পরমাণুঅস্ত্রের সঙ্গতি আছে। খ্রিস্টান, ইহুদি এবং হিন্দু সকল সভ্যতাই যে ক্ষমতা অর্জন করেছে শুধুমাত্র ইসলামি সভ্যতার হাতে সে ক্ষমতা নেই; সুতরাং, এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতেই হবে।
একটি সভ্যতার মধ্যে কোনো কোররাষ্ট্রের অনুপস্থিতির কারণ হলো নেতৃত্বের জন্য প্রতিযোগিতা, এবং পরমাণুঅস্ত্রের জন্যও তা প্রতিযোগিতা তৈরি করতে পারে। খুব উত্তম সম্পর্ক থাকার পরও পাকিস্তান পরমাণুঅস্ত্র অর্জনের পর ইরান পরিষ্কারভাবে অনুভব করে যে, পাকিস্তানের যদি থাকতে পারে তার কেন পরমাণুঅস্ত্র থাকবে না। অন্যদিকে, দেখা যায়, ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা এ লক্ষ্যে তাদের কার্যক্রম পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণআফ্রিকা তার পরমাণু শক্তি ধ্বংস করে দিয়েছে। অবশ্য, এটি সত্য, যদি নাইজেরিয়া পরমাণু অস্ত্র লাভ করতে উদগ্রীব হয় কিংবা অর্জন করে ফেলে, তবে দক্ষিণ আফ্রিকা আবার তার পরমাণুশক্তি ফিরিয়ে আনতে সময় নেবে না। পরমাণুঅস্ত্রের সম্প্রসারণ একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। স্কট সাগান এবং অন্যান্যরা যেভাবে বলেন, ‘যদি বিশ্বে মাত্র একটি বা দুটি কোররাষ্ট্রের হাতে পরমাণুঅস্ত্র স্থির থাকত, তাহলে সেই বিশ্ব থাকত যৌক্তিকভাবে সুস্থিত বা সুস্থির।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর থেকে অদ্যাবধি অধিকাংশ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাশ্চাত্য দেশের চাহিদা ও ইচ্ছামাফিক কাজ করছে। তারা পশ্চিমা স্বার্থ, মূল্যবোধ এবং তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যখন পাশ্চাত্যশক্তি অন্যান্য সভ্যতার আপেক্ষিক শক্তির বিচারে নিম্নগতিসম্পন্ন হবে, তখন স্বভাবতই ওইসব প্রতিষ্ঠানকে খাপখাওয়ানোর মতো করে ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ, সেসব প্রতিষ্ঠানকে তখন উঠতি সভ্যতাসমূহের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। খুবই স্পষ্ট, খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভবত খুবই বিতর্কিত ইস্যু হল : জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ নিয়ে চলা বিতর্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওই পদগুলো বিজয়ীপক্ষের নেতৃত্বের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছিল এবং বর্তমান বিশ্বে তাদের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার দরুন নতুন বিশ্ববাস্তবতার সঙ্গে তা অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যার আবর্তে হয় সদস্যপদে পরিবর্তন ঘটাতে হবে, নতুবা অন্যান্য কম প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রথাসিদ্ধ প্রক্রিয়া বের করতে হবে, যাতে করে নতুন নতুন নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কাজ করা যায়। যেমন জি-৭ সংগঠন বিশ্বের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করে থাকে।
বহুধাবিভক্ত সভ্যতাসম্পন্ন বর্তমান বিশ্বে আদর্শিক দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি প্রধান সভ্যতার একটি স্থায়ী আসন নিরাপত্তা পরিষদে থাকা দরকার। বর্তমানে এ দৃষ্টিতে মাত্র তিনটি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে জাপান এবং জার্মানির সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য কাজ করতে পারে। তবে, একথা সত্য, তাদের জন্য সদস্যপদ দিতে হলে অন্য কিছু দেশকেও তা দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যাবে। ব্রাজিল ৫টি নতুন সদস্যপদ প্রদানের কথা জানিয়েছে (যদিও তাদের হাতে কোনো ভেটোক্ষমতা দিতে বলা হয়নি), যথা- জার্মানি, জাপান, ভারত, নাইজেরিয়া এবং ব্রাজিলের নিজের জন্য। যদি এমনটি হয়, তবে বিশ্বে ১ বিলিয়ন মুসলমান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিনিধিহীন থাকবে— যদি সেক্ষেত্রে নাইজেরিয়া ওই দায়িত্ব বহন করতে পারে, তবে তা অংশত মিটে যাবে। সভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে, পরিষ্কারভাবে জাপান এবং ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়া উচিত এবং আফ্রিকা, লাটিন আমেরিকা ও মুসলমান বিশ্বের স্থায়ী আসন থাকা দরকার। তবে, এটি রেশনিং বা পর্যায়ক্রমে দেয়া যায়। এ বিষয়ে ওআইসি, ওএইউ এবং আমেরিকাবিহীন অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস থেকে প্রস্তাব ও চক্র-দায়িত্বের রুটিন আসতে পারে। এমনটি হলে সেক্ষেত্রে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের আসনকে এক করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নামে আসন সৃষ্টি করে রেশনিং-এর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে তা বণ্টিত হতে পারে। তাহলে, ৭টি সভ্যতার মধ্যে দেখা যাবে পাশ্চাত্যবিশ্ব পাবে ২টি, আর অন্যান্যরা পাবে ১টি করে। আর বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বৃহত্তর জনসংখ্যা, সম্পদের ভিত্তিতে ক্ষমতার বণ্টন নিশ্চিত করতে পারা সম্ভব হবে।
সভ্যতার সাধারণ বা এজমালি দিকসমূহ (Commonalities)
কিছু আমেরিকান নিজদেশে বহুধাসংস্কৃতি প্রসারে কাজ করছে; কেউ বা বিদেশে সর্বজনীন বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। আবার কেউ কেউ দুটো কাজ একত্রে করে যাচ্ছে। পূর্বে আলোচনা করে দেখা গেছে, বহুধাসংস্কৃতি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে দেয়া যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের জন্য সুফল বয়ে আনবে না, বরং তা শঙ্কার কারণ হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, সর্বজনীনতাও বিদেশে বিশ্ব ও পশ্চিমাদের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে। কেননা, উভয়ই পশ্চিমাবিশ্বের সংস্কৃতির অদ্বিতীয়ত্বকে অস্বীকার করে। সারা বিশ্বের জন্য এক ও অভিন্ন সংস্কৃতির কথা বলেন তারা, যারা আসলে বিশ্বকে আমেরিকার মতো বানাতে চান। অন্যদিকে, আমেরিকার অভ্যন্তরে যারা বহুধাসভ্যতা ও সংস্কৃতি ডেকে আনতে চান, তারা আসলে চান যে, আমেরিকা বিশ্বের মতো হোক। বহুধাসংস্কৃতিসম্পন্ন আমেরিকা সম্ভব নয়, কারণ অপাশ্চাত্য আমেরিকা মোটেও আমেরিকা নয়। একটি বহুধাসংস্কৃতিবিশিষ্ট বিশ্ব এড়ানো সম্ভব নয়। কেননা ‘বৈশ্বিক সাম্রাজ্য’ অসম্ভব ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রকে ও পশ্চিমাবিশ্বকে রক্ষা করার নিমিত্তে প্রয়োজন উভয়ের পরিচয়ের ‘নবায়ন’। বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য বৈশ্বিক বহুধাসংস্কৃতিকে মেনে নেয়া ব্যতীত অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
পাশ্চাত্যের সর্বজনীনতার শূন্যগর্ভ এবং বিশ্বের সংস্কৃতির বহুধাবিভক্ততার বাস্তবতা কি অত্যাবশ্যকীয় এবং অবশ্যাম্ভাবীভাবে বিশ্বে নৈতিক ও সংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ বয়ে নিয়ে আসছে? যদি সর্বজনীনতা প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদকে বৈধতা প্রদান করে, তাহলে আপেক্ষিকতাবাদ কি অত্যাচার ও নিপীড়নকে বৈধতা দেয়? এ প্রশ্নসমূহের উত্তর হবে ‘হাঁ’ অথবা ‘না’।
সংস্কৃতি নিজেই একটি আপেক্ষিক ধারণা, তবে নৈতিকতা সম্পূর্ণ বা অবিমিশ্র। মাইকেল ওয়ালজার যুক্তি দেখান যে, সংস্কৃতি হল নিবিড় ও প্রশস্ত। একটি সমাজে সংস্কৃতি মানুষ ও প্রতিষ্ঠান বিশেষ ধারায় চলতে বা আচরণের ধারা নির্দেশ করে। বিশেষ করে সমাজ-উপযোগী পরিশুদ্ধ রাস্তাই সংস্কৃতি প্রদর্শন করে থাকে। ‘অধিকতর’ ‘পেরিয়ে’ এবং মার্কসীয় তত্ত্ব থেকে বেড়ে ওঠা নৈতিকতা প্রকৃত প্রস্তাবে ‘সংকীর্ণ বা সরু’ ন্যূনতম নৈতিকতাপন্থীদের মত প্রকাশ, পূর্ণব্যক্তকৃত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিশেষ নিবিড় বা প্রশস্ত বা সর্বোচ্চ স্তরের ‘নৈতিকতা’। সত্য এবং ন্যায়বিচারসম্পন্ন ন্যূনতম নৈতিকতার ধারণা প্রায় সকল নিবিড় বা প্রশস্ত নৈতিকতার মধ্যে বজায় থাকে এবং তাকে বাদ দেয়া যায় না। ন্যূনতম নৈতিকতা হল, সেসঙ্গে কর্তৃপক্ষীয় নেতিবাচক আদেশ, যেমন খুনের বিরুদ্ধে আইন, কপটতা, অত্যাচার-নিপীড়ন, নির্যাতন এবং স্বৈর বা জুলুমবাজ শাসন, যা মানুষের জন্য সাধারণ সংস্কৃতিবোধে ও তার বাস্তবায়নের আজ্ঞার চাইতে শত্রু সম্পর্কে সাধারণবোধ (শয়তান) অনেক বেশি কার্যকর। মানবসমাজ সর্বজনীন, কারণ তা মানুষের দ্বারা গঠিত; বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে হয় এটি ‘সমাজ’। একসময়ে আমরা অন্যের সঙ্গে ছুটে যাই, তখন আসলে আমরা একাই ছুটে যাই। তবুও ‘সংকীর্ণ বা সরু’ ন্যূনতম নৈতিকতা মানুষের সাধারণ অবস্থা থেকে ব্যুৎপত্তি বা অবয়ব লাভ করে থাকে এবং ‘সর্বজনীন বিন্যাস’ সকল সংস্কৃতির ভেতরই দৃশ্যমান। ২° কোনো সভ্যতা ধরে নেয়া বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রসারতার চিন্তার চাইতে বরং সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের চাহিদা পূরণ করা বাঞ্ছনীয়, আর এজন্য চাই সকলপ্রকার সংস্কৃতির মধ্যে ‘সাধারণ দিকগুলো’ সফলভাবে উন্মোচিত করে তার প্রসার ঘটানো। বহুমুখীসংস্কৃতিসম্পন্ন ধরাধামে গঠনমূলক কাজ হবে আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীনতাকে পরিত্যাগপূর্বক তা ভিন্নতাকে গ্রহণ করা এবং ভিন্নতার মধ্যে সাধারণ বিষয়গুলো বের করে এনে তা চর্চা করা ও তার মধ্যে একত্রীকরণ বা সাধারণবোধের উন্মেষ ঘটানো, অর্থাৎ “ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য’ আনা।
সাংস্কৃতিক সাধারণত্বের পরিচয় পাওয়ার প্রকৃত কার্যক্রম ১৯৯০-এর দশকে সিঙ্গাপুরে ক্ষুদ্রস্থানে পরিদৃষ্ট হয়েছিল। সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭৬ ভাগ হল চীনাবংশোদ্ভূত, শতকরা ১৫ ভাগ মালয় এবং মুসলমান; আর শতকরা ৬ ভাগ ভারতীয় হিন্দু ও শিখ। অতীতে সরকার সেখানে ‘কনফুসীয় মূল্যবোধ’ প্রয়োগ করতে চেয়েছিল, সেসঙ্গে সবাইকে শিক্ষিত ও ইংরেজিভাষায় দক্ষ করার পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট উই কিম উইই পার্লামেন্টে তাঁর এক ভাষণে বলেন যে, সিঙ্গাপুরের ২.৭ মিলিয়ন মানুষকে বাইরের সংস্কৃতির প্রভাব, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের ভালোদিক গ্রহণ করতে হবে। কেননা সেখান থেকে নতুন প্রযুক্তির ধারণা ও জ্ঞান লাভ করা যায়, কিন্তু সেইসঙ্গে তিনি একথাও বলেন যে, ওই সংস্কৃতি আমাদের জীবনযাত্রা ও মূল্যবোধকে বিদেশী করে দিতে পারে। আমাদের এশীয়ঐতিহ্য আমাদের এমন নৈতিকতা শিক্ষা দেয় যা কর্মমুখর এবং এমন এক সমাজকে নির্দেশ করে, যে সমাজ আমাদেরকে অতীত থেকে এখানে নিয়ে এসেছে।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘অধিকতর পাশ্চাত্যের হাওয়া ঢুকবার রাস্তা ছেড়ে দিলে তা হবে সমাজকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করা’ এবং ‘স্বার্থমুখী এক জীবনপদ্ধতিকে বরণ করে নেয়া।’ তাই আমাদের উচিত হবে, সিঙ্গাপুরের সংস্কৃতির ‘কোর’-মূল্যবোধসমূহ বের করে আনা, যে মূল্যবোধগুলো হল সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মূল্যবোধের মধ্যে ‘সাধারণ দিকসম্পন্ন মূল্যবোধ’-এর রক্ষণ ও প্রতিপালন। আর এভাবেই আমরা সিঙ্গাপুরের মূল ঐক্যের সুর খুঁজে পাব।’
প্রেসিডেন্ট উই চারটি মূল্যবোধ নির্দেশ করেছেন, অর্থাৎ ‘সমাজ’ কে ‘আত্ম’-এর উপর স্থান দেয়া; ‘পরিবারকে’ সমাজের মৌলকাঠামোর ভিত্তি হিসেবে উপরে তুলে ধরতে হবে; ঐকমতের ভিত্তিতে প্রধান ইস্যুসমূহের সমাধান খুঁজে নিতে হবে, এক্ষেত্রে প্রতিরোধ যেন গুরুত্ব না পায়; ধর্মীয় ও বর্ণবাদী চিন্তাচেতনার মধ্যে সহনশীলতা এবং ঐকতান আনতে হবে।
তাঁর বক্তব্যে তিনি সিঙ্গাপুরের মূল্যবোধ তুলে ধরেন সঠিকভাবে। এর দুই বৎসর পরে প্রেসিডেন্ট-এর বক্তব্য শ্বেতপত্রের মাধ্যমে তুলে ধরে সরকারের অবস্থান জানানো হয়। উক্ত শ্বেতপত্রে প্রেসিডেন্টের সমগ্র ৪টি নির্দেশ গ্রহণ করা হয় এবং তার সঙ্গে ৫ম আর একটি বিষয়যুক্ত করা হয়, যা ব্যক্তিকে সমর্থন করে রচিত। মূলত এটি করা হয়েছিল ব্যক্তির মেধাকে সমর্থন ও উৎসাহিত করার নিমিত্তে। আর তা ছিল নিঃসন্দেহে কনফুসীয় মূল্যবোধসম্বলিত পদসোপান সম্বলিত পারিবারিক মূল্যবোধের বিপরীত। কেননা, উক্ত ঐতিহ্যমণ্ডিত মূল্যবোধ সেখানে স্বজনপ্রীতির জন্ম দিয়েছিল। শ্বেতপত্রে সিঙ্গাপুরের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রাপ্ত মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শুনতে পাওয়া যায় : জাতি (নৃগোষ্ঠীক), সম্প্রদায় ও সমাজআত্ম বা নিজের উপরে স্থান পাবে; পরিবার হবে সমাজের মূল ভিত্তি; সম্প্রদায় ও সমাজ ব্যক্তিকে সমর্থন প্রদান করবে; প্রতিরোধ নয়, ঐকমত্য হবে সংঘাত এড়ানোর উপায়; বর্ণ ও ধর্মের মধ্যে সমন্বয় ও সহিষ্ণু মনোভাবের বিস্তার, সংসদীয় গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা এবং সরকারের সক্ষমতা নীতি গ্রহণ করতে যেয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রাপ্ত মূল্যবোধের সঙ্গে খাপখাওয়ানোর প্রয়োজনে রাজনৈতিক মূল্যবোধ অংশত বর্জন করা হয়।
সরকার ঘোষণা দেয় যে, ‘সিঙ্গাপুর এশীয় সমাজের ভেতর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। এবং এটি ধরে রাখতে হবে। সিঙ্গাপুরীয়গণ আমেরিকান বা এ্যাংলোস্যাক্সন নয়, যদিও আমরা ইংরেজিতে কথা বলি ও পাশ্চাত্য পোশাক পরিধান করি। যদি আমরা আমেরিকান, ব্রিটিশ অথবা অস্ট্রেলিয়দের থেকে নিজেদেরকে পৃথক করতে না পারি, তবে আমরা খারাপ পরিস্থিতিতে নিপতিত হব। কেননা তা হবে নিছক নকলবাজি এবং মতভেদও সৃষ্টি হবে (আর তা হল একটি ছিন্নরাষ্ট্র)। পাশ্চাত্যের সমাজ থেকে আমাদের ‘নিজেদের সীমানা’ ধরে রাখতে হবে, এভাবে আমরা নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হব।
সিঙ্গাপুর-প্রকল্পটি উচ্চাশাসম্পন্ন এবং সেসঙ্গে তা আলোকিত প্রচেষ্টা, যা সিঙ্গাপুরের সংস্কৃতিক পরিচয়, এর অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মধ্যে সমন্বয় আনার ডাক দেয়। অবশ্যই এ প্রচেষ্টা তাদেরকে পাশ্চাত্য থেকে আলাদা করে। পাশ্চাত্য বা বিশেষ করে আমেরিকার মূল্যবোধ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। ওই সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে ‘ব্যক্তির অধিকার’ সম্প্রদায়সমূহের অনেক উঁচুতে মনে করা হয়। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে প্রকৃত নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি হয়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ এবং আইনের শাসন কিন্তু প্রকারান্তরে “বিশেষজ্ঞ জ্ঞানী ও দায়িত্বশীল শাসনকর্তার ধারণাকে’ নাকচ করে দেয়। অর্থাৎ প্রথমটি গণতান্ত্রিক আর শেষের ধারণা হচ্ছে এলিটসুলভ। যাই হোক, তারা সিঙ্গাপুরের মূল্যবোধকেই ঊর্ধ্বে স্থান দেয় এবং পাশ্চাত্য মূল্যবোধকে নিম্নে স্থান দেয়। কিছুসংখ্যক পশ্চিমা চিন্তাবিদ প্রজ্ঞাসুলভ নয়, বিধায় তা প্রত্যাখ্যান করে বসেন। মোটের ওপর কমপক্ষে মৌল, সংকীর্ণ বা সরু নৈতিকতার স্তরের হলেও পশ্চিমা মূল্যবোধ ও এশীয় মূল্যবোধের ভেতর কিছু বিষয় রয়েছে নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান (সাধারণ)। উপরন্তু, অনেকেই দেখান যে, মানবতাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভক্ত করা, যেমন বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর দ্বারা তা করা হয়েছে। (পাশ্চাত্যের) খ্রিস্টধর্ম, অর্থোডক্স, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, ইসলামধর্ম, কনফুসীয়, টইজম, ইহুদিবাদ ইত্যাদির মধ্যে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা নির্বিশেষে সব ধর্মের মধ্যে সমানভাবে রয়েছে- এটি হল ‘সাধারণ’। যদি মানুষ কোনোদিন সত্যিকারভাবে সর্বজনীন সভ্যতার জন্ম দিতে সক্ষম হয়, তবে তা আসবে মূলত ওইসব মতভেদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সাধারণ বা এজমালি বিষয়গুলোকে ভিত্তি করেই। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন মেধা ও মনন দিয়ে বিভেদের ভেতর থেকে সাধারণ বিষয়গুলো টেনে নিয়ে এসে সেমতো মানুষকে আলোকিত করা।
এভাবে ‘বর্জন শাসন’ এবং ‘যৌথ মধ্যস্থতার শাসন’-এর বাইরে তৃতীয় ধারায় সংঘাত এড়িয়ে ‘শান্তিমুখী শাসন হচ্ছে বহুধাবিভক্ত সংঘাতময় সংস্কৃতির যুগে সাধারণত্বের শাসন (Commonalities rule)। রাষ্ট্র-সমাজের সকল নাগরিক খুঁজে নেবেন এবং ধারণা করবেন বর্ধিষ্ণু সেই মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠান এবং তা বাস্তবায়নের কলাকৌশল যা তাদের বিভিন্ন সভ্যতার ভেতর ‘সাধারণ’ হয়ে অবস্থান করছে। এই ধারায় এগিয়ে গেলে, তা যে শুধু বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে সংঘাতকে সীমিত করবে তাই নয়, তার সাথে তা সভ্যতার একমুখীকরণ প্রক্রিয়াকেও এগিয়ে নেবে। এই একমুখী সভ্যতা হল প্রকৃতপক্ষে একটি মিশ্র অবস্থা যা উচ্চতর মানসিকতা, নৈতিকতা, ধর্মীয়, শিক্ষাপ্রক্রিয়া, কলাকৌশল, দর্শন, প্রযুক্তি, বস্তুগত উন্নতি এবং সম্ভবত অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে ধারণা ও চেতনাসম্পৃক্ত। এ-ধরনের অবস্থা একটি থেকে অন্যটিকে কোনোভাবেই পৃথক করার সুযোগ পাবে না। পণ্ডিতজনেরা সহজেই সভ্যতার স্তর ও ধরন সম্পর্কে সভ্যতার ইতিহাসে এর ভেতর থেকে উচ্চমাত্রিকতা’ এবং ‘নিম্নমাত্রিকতা’ সম্পর্কে নির্দেশ করতে সক্ষম হবেন।
এখন প্রশ্ন আসে : কীভাবে একটি তালিকার মাধ্যমে সভ্যতার ক্ষেত্রে মানবতার উত্থান-পতনের অবস্থা প্রদর্শন করা যায়? সেখানে কি কোনো সাধারণ, ধর্মনিরপেক্ষ প্রবণতা ইত্যাদি বিশেষ সভ্যতাকে উতরিয়ে গিয়ে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য উচ্চস্তরের সভ্যতা নিয়ে আসবে? যদি সেখানে এ-ধরনের কোনো প্রবণতা কাজ করে, তবে তা কি আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার ফলাফলের মাধ্যমে ঘটবে— কেননা, আধুনিকতা মানুষের মধ্যে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, যা তাদেরকে উচ্চ থেকে উচ্চপর্যায়ে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বস্তুগত সামগ্রীর প্রসারের ভেতর দিয়ে জীবনে প্রাচুর্য বয়ে আনতে সক্ষম করে। বর্তমান সময়ে উচ্চমাত্রিক আধুনিকতার মাধ্যমে কি উচ্চমাত্রিক সভ্যতা অর্জন করা যায়? অর্থাৎ উচ্চমাত্রিক আধুনিকতা কি উচ্চমাত্রিক সভ্যতার পূর্বশর্ত? অথবা বিশেষ সভ্যতা কি সভ্যতার ইতিহাসে প্রাথমিকভাবে একটি থেকে অন্যটি পৃথক করে? এই ইস্যুটি আরও একটি বিতর্কিত ইস্যু, যা ইতিহাসে রৈখিক বা চক্রাকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাধারণত উচ্চতর আধুনিকতা এবং মানুষের নৈতিক উন্নয়ন উচ্চতর শিক্ষা, সচেতনতা এবং মানবসমাজ সম্পর্কে ধারণা একটি প্রাকৃতিক পরিবেশ উপহার দেয়, যার ভেতর দিয়ে উচ্চতর সভ্যতার দিকে ছুটে যাওয়া সম্ভব হয়। অন্যভাবে দেখলে বলা যায়, সভ্যতার স্তর আসলে সভ্যতার বিবর্তনের প্রক্রিয়ার পর্যায়েরই প্রতিফলন বিশেষ।
যখন সভ্যতা প্রথম অবির্ভূত হয়েছিল, তখন তার মানুষ ছিল তেজস্বী, গতিশীল, নৃশংস, চলমান এবং সম্প্রসারণবাদী। আপেক্ষিক দৃষ্টিতে তারা ছিল “অসভ্য”। সভ্যতা যত এগিয়ে যেতে শুরু করল, মানুষ ততই স্থায়ী হতে থাকল এবং এমন কিছু করতে থাকল, যার মাধ্যমে তারা কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা লাভ করে তাকে আরও সামনে নিয়ে যেতে লাগল। যখন সভ্যতার মধ্যে প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘটবে তখন সর্বজনীন রাষ্ট্রের উদয়ের ফলে নাগরিকেরা সর্বোচ্চ মাত্রায় সভ্যতার সন্ধান পাবে, যাকে ‘সভ্যতার স্বর্ণযুগ’ বলা যাবে, যার মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে নৈতিকতা, কলা, সাহিত্য, দর্শন, প্রযুক্তি এবং অর্থনীতি, আর রাজনৈতিক সক্ষমতা। যদি এটি একটি সভ্যতা হিসেবে নিম্নগামী হতে থাকে, তবে তা ধ্বংসের দিকেই যাবে, এবং হবে নিশ্চিহ্ন, আর তার স্থলে আসবে নিম্নস্তরের সভ্যতা।
আধুনিকতা সাধারণভাবে সভ্যতার বস্তুগত চাওয়া-পাওয়াকে এগিয়ে নেয়। কিন্তু আধুনিকতা কি সভ্যতার নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার উন্নতি আনতে পারে? কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ঘটতে পারে। দাসত্ব, অত্যাচার, মানুষের ওপর বিবিধ নির্যাতন ও অপব্যবহার, বর্তমান বিশ্বে ক্রমাগতভাবে কম গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। এটি কি সাদামাটাভাবে অন্য সভ্যতার ওপর পাশ্চাত্যসভ্যতার ফলাফল হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে? তা হলে কি বলা যায়, পাশ্চাত্য সভ্যতা শক্তিহীন হয়ে পড়লে পৃথিবীব্যাপী নৈতিকতাও সংকটে পড়বে? ১৯৯০-এর দশকে অনেক উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বিশ্বব্যবস্থায় ছিল ‘ডাহা অরাজকতা’। বিশ্বব্যাপী আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যর্থ রাষ্ট্রের আধিক্য, নৈরাজ্যজনক অবস্থার অগ্রায়ন, বিশ্বব্যাপী অপরাধের ব্যাপকমাত্রায় জাগরণ, আন্ত জাতিক মাফিয়া-চক্রের তৎপরতা, মাদকদ্রব্যের অবৈধ লেনদেন, মাদকাশক্তির আশঙ্কাজনক বিস্তার, পরিবারের দুর্বলাবস্থা, সমাজে বিশ্বাস, আস্থা এবং সামাজিক বোধের অভাব, নৃগোষ্ঠীক, ধর্মীয় এবং সভ্যতাসম্পৃক্ত সহিংসতা, এবং বন্দুকের শাসনের ক্রমবর্ধমানতা এখন বিশ্বকে ঘিরে ধরেছে। শহরের পর শহর, যেমন মস্কো, রাও দি জানেরিও, ব্যাংকক, সাংহাই, লন্ডন, রোম, ওয়ার্শ, টকিও, জুহান্সবার্গ, দিল্লি, করাচি, শিকাগো, বোগটা, ওয়াশিংটনে অপরাধচক্র যেন সভ্যতাকে গলাটিপে ধরেছে। মানুষ সর্বত্র ‘সুশাসনের অভাব’ ও ‘সংকটের কথা’ বলতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক কর্পোরেশন অর্থনৈতিক ও ভোগ্যসামগ্রী উৎপাদন করছে, সেসঙ্গে পাশাপাশি আন্ত র্জাতিক অপরাধচক্র মাফিয়া আকারেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংগঠিত অপরাধ, মাদক দ্রব্য প্রভৃতি প্রতিনিয়ত মানুষকে বিব্রত ও অপমানিত করে চলেছে। আইন ও শৃঙ্খলা হল সভ্যতার প্রধান শর্ত, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? আফ্রিকা, লাটিন আমেরিকা, সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়ন, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, প্রভৃতি যেন দিনের-পর-দিন বাষ্পীভূত হয়ে চলেছে। চীন, জাপান এবং পশ্চিমা জগৎ আজ অপমানগ্রস্ত। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী সভ্যতা যেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্বরতা, নজিরবিহীন অরাজকতা, মাদক যুগের সূত্রপাত করে চলেছে। আর এসবই মানবতাকে ধ্বংসের গহ্বরে টেনে নামাচ্ছে।
১৯৫০-এর দশকে লেসটার পার্সন সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষ এমন একটি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ পাশাপাশি দ্বিধাদ্বন্দ্বহীনভাবে বসবাস করবে, একে অন্যের নিকট থেকে শিক্ষা নেবে, একে অন্যের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞাত হবে, একে অপরের মধ্যে আদর্শ, মূল্যবোধ সংস্কৃতির আদান-প্রদান করবে, আর এভাবে প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিকট থেকে লেনদেনের ভিত্তিতে জীবনযাত্রাকে উন্নত করে তুলবে। আর এর বিকল্প হবে ধ্বংসাত্মক, ভুল-বোঝাবুঝি, অস্থিরতা, সংঘাত এবং সর্বধ্বংসমুখিনতা। শান্তি ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ দুটিই নির্ভর করছে বোঝাপড়া, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আত্মিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্য, এবং সভ্যতাগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক নেতাগণের সমন্বয়ের ওপর। সভ্যতার সংঘাত, ইউরোপ এবং আমেরিকায় একত্রে ঝুলে রয়েছে বা পৃথকভাবে ঝুলে রয়েছে। বৃহত্তর সংঘাত, বিশ্বব্যাপী যা ঘটে তা হল প্রকৃত সংঘাত। আর তা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, সম্ভবত ‘সভ্যতা’ ও ‘বর্বরতার’ মধ্যে পৃথিবীর বৃহৎ সভ্যতাসমূহ তাদের উন্নতমানের ধর্ম, কলা, শিল্পকর্ম, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নৈতিকতা এবং করুণা নিয়ে ঝুলে থাকবে একত্রে বা আলাদা আলাদাভাবে। আজ ভয়-ভীতি ও আবির্ভূত দিনগুলোতে সভ্যতার সংঘাত বিশ্বশান্তির প্রশ্নে সবচেয়ে বড় বিপদ। অথচ সভ্যতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নিয়মানুবর্তিতাই হল বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ও সুনিশ্চিত রক্ষাকবচ।