(ক) বিশ্বের সভ্যতাসমূহ
(খ) সভ্যতার ভারসাম্যের বদল
(গ) সভ্যতার প্রকাশমান বিন্যাস
(ঘ) সভ্যতার সংঘর্ষ
(ঙ) সভ্যতার ভবিষ্যৎ

অধ্যায় ১ – বিশ্বরাজনীতির নবযুগ

অধ্যায় ১ – বিশ্বরাজনীতির নবযুগ 

সূচনা : পতাকা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় 

১৯৯২ সালের ৩ জানুয়ারি, রাশিয়া এবং আমেরিকার বিজ্ঞজনদের মাঝে একটি সভা মস্কোর সরকারি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। এর মাত্র দুসপ্তাহ আগে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন হয় এবং সেখান থেকে রাশিয়ান ফেডারেশনের জন্ম হয়। এর ফলে লেনিনের মূর্তি অডিটোরিয়ামের সম্মুখভাগ থেকে অপসারণ করে নবগঠিত রাশিয়ান ফেডারেশনের পতাকা দেয়ালে টানানো হয়। কিন্তু একজন আমেরিকান লক্ষ করলেন যে, পতাকাটি উল্টোভাবে স্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি জানানো হলে তারা তা বিনাবাক্যে এবং নীরবে সংশোধন করে নেন। 

শীতলযুদ্ধোত্তর সময়ের এক বছরের মধ্যে মানুষের মনের গভীরে ‘প্রতীক’ এবং ‘পরিচয়ের’ গণ্ডিতে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেল। বিশ্বরাজনীতি সাংস্কৃতিক অবয়বে নতুন মোড় নিল। পতাকার উল্টো স্থাপনকে এই উত্তরণকালের ‘নমুনা’ বলা যায়। আর ওই পতাকা যতই ঊর্ধ্বে উড়তে লাগল, রাশিয়ার জনগণ ততই যেন নতুন স্বাদের অন্বেষণে, নতুন সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সন্ধানে মেতে উঠতে লাগল। 

১৯৯৪ সালে ১৮ এপ্রিল। দুহাজার মানুষ সারায়াভোতে সৌদিআরব ও তুরস্কের পতাকা দোলাতে লাগল। জাতিসংঘ এবং ন্যাটো অথবা আমেরিকার পতাকার পরিবর্তে দুটি মুসলমান দেশের পতাকা দুলিয়ে সারায়াভোবাসী সমগ্র দুনিয়াকে বুঝাতে চাইল তাদের বন্ধু-সুহৃদ মুসলমান সমাজ এবং কারা তাদের প্রকৃত মিত্র, আর কারা তাদের শত্রু। 

১৯৯৪ সালের ১৬ অক্টোবর, লস এঞ্জেলস-এ ৭০,০০০ মানুষ মেক্সিকোর পতাকা নিয়ে মিছিল করে ‘প্রস্তাবনা ১৮৭’-এর বিরুদ্ধে, যে প্রস্তাবনার মাধ্যমে অনেক অঙ্গরাজ্যে অবৈধ অভিবাসী এবং তাদের সন্তানদের সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত করার জন্য গণভোটের দাবি করা হয়েছিল। কেন তারা মেক্সিকোর পতাকা নিয়ে মিছিল করতে রাস্তায় নেমে এল এবং কেন তাদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে, এরূপ দাবি উত্থাপনের কারণটি এখন অনেকের জিজ্ঞাস্য। ‘তারা আমেরিকার পতাকা নিয়ে মিছিল করবে’— এটাই ছিল বিশ্বজুড়ে পাশ্চাত্যের প্রত্যাশা। দুসপ্তাহ পরে আরও অধিক সংখ্যক প্রতিবাদী মানুষ আমেরিকার পতাকা নিয়ে রাস্তায় পাল্টা মিছিল করল। এই মিছিল প্রকৃতপক্ষে ‘প্রস্তাবনা ১৮৭’-এর বিজয় সুনিশ্চিত করল। এই প্রস্তাবনা ক্যালিফোর্নিয়ার শতকরা ৫৯ ভাগ ভোটারের সমর্থন অর্জন করল। 

শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বে রাষ্ট্রীয় পতাকাগুলো বিভিন্ন দেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টিগত চেতনাকেই ধারণ করতে লাগল, যেমন— ক্রসচিহ্ন, ক্রিসেন্ট ইত্যাদি। বাস্তবে সাংস্কৃতিক চেতনাই মানবগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর সে-কারণেই তা এত অর্থবহ। মানুষ নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করে সামনে এগিয়ে চলছে, কিন্তু পুরাতন পরিচয়কে অস্বীকার করে বা এড়িয়ে যেতে পারছে না। সে-কারণেই পুরাতন পতাকার প্রভাব কমছে না। বরং তা প্রকারান্তরে পুরাতন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং সংঘাতকে নতুনরূপে এগিয়ে নিচ্ছে। 

বর্তমান সময়ের একটি নির্মম সংঘাতের চিত্র ফুটে উঠেছে মাইকেল ডিবডিন নামক একজন বক্তৃতাবাগীশ নেতার ডেড লেগুন ( Dead lagoon) উপন্যাসটিতে। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত শত্রু না থাকলে প্রকৃত বন্ধু থাকতে পারে না। ঘৃণার বিষয়কে ঘৃণা না করলে প্রকৃত উত্তমকে ভালোবাসা যায় না। …যারা তা অস্বীকার করে, তারা তাদের পরিবার, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, জন্মগত যোগসূত্রকে অস্বীকার করে। তারা দাসতুল্য। তারা কখনও ক্ষমার যোগ্য নয়।’ দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হয়, প্রাচীন সভ্যতাসমূহকে দেশহিতৈষী বা পণ্ডিতজনেরা অবজ্ঞা করতে পারেন না। যেসব মানুষ আত্মপরিচয় ও নৃতাত্ত্বিক ধারাকে পুনঃউন্মোচন করতে চায়, তারা তাদের শত্রুকে অবশ্যম্ভাবীভাবে চিহ্নিত করে; সেইসাথে এর ভেতর দিয়ে বিশ্বের শত্রুভাবাপন্ন প্রধান সাংস্কৃতিক অঞ্চলসমূহের ‘ফাটলরেখা’সমূহের ক্ষমতা ও চিহ্নও গোচরীভূত হয়। 

এই পুস্তকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঞ্চল, তথা সভ্যতাসমূহ সম্পর্কে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি এই সভ্যতাসমূহের পারস্পরিক একত্রীকরণের দৃঢ়তা, অনৈক্য বা বিভেদ, অথবা সংঘাতময়তা সম্পর্কে বিশ্লেষণধর্মী বর্ণনা দেয়া। 

পুস্তকটিকে পাঁচটি ভাগে বিন্যস্ত করে মূল প্রস্তাবসমূহ সন্নিবেশিত করা হবে। যথা : প্রথম খণ্ড : বিশ্ব ও বহুধাবিভক্ত সাংস্কৃতিক, বহুপক্ষভিত্তিক সভ্যতার বাস্তবতায় প্রথমবারের মতো বিশ্বরাজনীতি এমন একটি মোড় নিয়েছে যেখানে ‘আধুনিকায়ন’ আসলে ‘পাশ্চাত্যকরণের’ ধারণা থেকে পৃথক বলে বিবেচিত হচ্ছে। এই নতুন ধারাটি বিশ্বজনীন সভ্যতার ধারণাকে কোনো যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে এগিয়ে নিচ্ছে না, বা অপাশ্চাত্য বিশ্বকে পাশ্চাত্যমুখী করতে পারছে না। 

দ্বিতীয় খণ্ড : সভ্যতার ওপর নির্ভরশীল শক্তিভারসাম্য’ পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে, অপাশ্চাত্যের ওপর পাশ্চাত্য তার আপেক্ষিক প্রভাব হারাচ্ছে। এশীয় সভ্যতা তার অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ইসলাম জনসংখ্যাগত দিক থেকে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলাফলস্বরূপ, মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক অস্থির হয়ে উঠেছে, এবং অপাশ্চাত্য সভ্যতাসমূহ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি ক্রমাগত আকৃষ্ট ও আগ্রহী হয়ে উঠছে। 

তৃতীয় খণ্ড : নিজস্ব সভ্যতাভিত্তিক বিশ্ব জোরালো হলেও বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং সমন্বয় কিন্তু এগুচ্ছে না, বরং তার উল্টোটিই ঘটে চলেছে। এভাবে দেশগুলো বিভিন্নভাবে জোটবদ্ধ হচ্ছে বা নিজেরাই ‘কোর’-রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। 

চতুর্থ খণ্ড : পশ্চিমের সর্বজনীনতার ধারণাগুলো ক্রমাগত বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতাসমূহের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হচ্ছে। এই ধারণাগুলো ক্রমেই ইসলাম এবং চীনের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘাত ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছে। আঞ্চলিক পর্যায়ে ‘ফাটলরেখায়’ অবস্থিত যুদ্ধগুলো; বিশেষত বৃহত্তরভাবে মুসলমানদের সঙ্গে অমুসলমানদের সমমনা আপন বা বন্ধুসুলভ রাষ্ট্রগুলোর একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। ফলে ‘কোর’-রাষ্ট্রগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে ও কালক্রমে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। 

পঞ্চম খণ্ড : পশ্চিমাদের অস্তিত্ব মূলত আমেরিকার পশ্চিমা পরিচয় রক্ষার মনমানসিকতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কেননা, পশ্চিমাবিশ্ব তাদের সভ্যতাকেই অদ্বিতীয় বলে’ গণ্য করে, যা সর্বজনীন দৃষ্টিতে পুরোপুরি সঠিক নয়। তারা তাদের নিজসত্ব রক্ষার জন্যই অপাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতে আগ্রহী। ফলে, মুসলমান অমুসলমানদের মাঝে সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সভ্যতার সংকট থেকে সৃষ্ট এই সংঘাত ও যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন বিশ্বনেতৃত্বের দূরদৃষ্টি ও কর্মতৎপরতা। বিশ্বরাজনীতির বহুধাবিভক্ত সভ্যতাগুলোর মধ্যে সঠিক সমন্বয় ও সহযোগিতার মনোভাব বলিষ্ঠ করতে বিশ্বনেতৃত্বের সহযোগিতা বিশেষ প্ৰয়োজন। 

বহুপাক্ষিক এবং বহুধাবিভক্ত সভ্যতাসম্বলিত বিশ্ব 

ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বে বিশ্বরাজনীতি হয়ে পড়েছে বহুপাক্ষিক ও বহুধাবিভক্ত সভ্যতাকেন্দ্রিক। বিগত দিনের মানবেতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্নধর্মী সভ্যতার মধ্যে সংযোগ ছিল ধীর লয়ে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা একবারেই ছিল না। তারপর আধুনিক যুগের সূচনালগ্নে (১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) বিশ্বরাজনীতির ‘দ্বিবিধ’ অবস্থা লক্ষ করা গিয়েছে। প্রায় চারশত বৎসর জাতিরাষ্ট্র পাশ্চাত্যজগতে, বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে একটি বহুপাক্ষিক বিশ্ব সৃষ্টি করেছিল এবং তারা পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধবিগ্রহও করেছে। একই সঙ্গে পাশ্চাত্যজগৎ অবশিষ্ট বিশ্বের বহুরাষ্ট্র পদানত করেছে, স্থাপন করেছে কলোনি ও সাম্রাজ্য বিস্তার করে অপাশ্চাত্যের ওপর তাদের অর্থবহ ও কার্যকর প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল রাখতে সচেষ্ট ছিল (ম্যাপ নং ৯ দ্রষ্টব্য)। 

শীতলযুদ্ধের সময়ে বিশ্বরাজনীতি ছিল দ্বিপক্ষীয় (বাইপোলার) এবং বিশ্ব ছিল তিন ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ ছিল সম্পদশালী ও গণতান্ত্রিক ধারার প্রতীক, যার নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই অংশটি দরিদ্র এবং কম্যুনিস্টভাবাপন্ন সোভিয়েট শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে আদর্শিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং একসময়ে সামরিক শক্তির প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। দুই শক্তির এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছে তাদের দেশের বাইরে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে, যেখানে দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিত্যদিনের সঙ্গী, যারা সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত এবং যারা উভয় জোটের বাইরে একটি জোটনিরপেক্ষ অবস্থানে আছে বলে দাবি করত (ম্যাপ- ১.২)। 

১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে কম্যুনিস্টবিশ্ব ভেঙে পড়ে এবং শীতলযুদ্ধের সময়ের বিশ্বব্যবস্থা অতীত ইতিহাসের বুকে ঠাঁই নেয়। শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বের মূল বৈশিষ্ট্য হল এই যে, মানুষ পূর্বের ন্যায় আর মতাদর্শিক, রাজনৈতিক, অথবা অর্থনৈতিক অবস্থানে থাকল না। বরং তারা সংস্কৃতিমুখী হয়ে, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আবদ্ধ হল। জনগণ এবং জাতিসমূহ তাদের সামনে উত্থাপিত মৌলিক প্রশ্ন, যেমন : আমরা কারা?— তার উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর এ-প্রশ্নের উত্তর পেতে তারা গতানুগতিক ধারাতেই এগুতে লাগল। মানুষ নিজেদের পিতৃপুরুষ, সহজাত ধারা, ধর্ম, ভাষা, ইতিহাস, নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায়, জাতীয় পরিচয় এবং সর্বোপরি নিজ নিজ সভ্যতার মাপকাঠিতে নিজেদের প্রাপ্তি ও বঞ্চনার বিশ্লেষণ করতে শুরু করল। পূর্বের ন্যায় মানুষ রাজনীতিকে তাদের স্বার্থসমূহ এগিয়ে নেবার ‘একমাত্র’ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা না-করলেও রাজনীতির মাধ্যমে আত্মপরিচয় প্রকাশ করতে শুরু করল। ‘আমরা কারা’ তা জানতে মানুষ জিজ্ঞাসা করতে শুরু করল : ‘আমরা কারা নই’ এবং এভাবেই তারা তাদের বিরুদ্ধশক্তি চিহ্নিত করতে থাকল। ফলে বিশ্ব হয়ে পড়ল সংঘাতপ্রবণ। 

জাতি ও রাষ্ট্র এখনপর্যন্ত বিশ্বব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে রয়ে গিয়েছে। তাদের আচরণ পূর্বের ন্যায় ক্ষমতা এবং সম্পদভিত্তিক হলেও, সেইসঙ্গে সংস্কৃতিক বন্ধন, সম্প্রদায়গত চেতনা এবং তাদের মধ্যকার মতবিরোধনির্ণয়ে তারা ব্রতী হয়েছে। শীতলযুদ্ধের সময়ের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিরাজমান গোষ্ঠীবদ্ধতা বা ‘ব্লক’ এখন আর বজায় নেই। তার স্থলে সাত অথবা আটটি প্রধান সভ্যতাসম্পৃক্ত জাতি এখন একক গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে (ম্যাপ-১.৩)। অপাশ্চাত্য সমাজ, বিশেষ করে পূর্বএশিয়া তাদের অর্থনীতিকে দৃষ্টান্তমূলকভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এরই অনুষঙ্গী হিসেবে সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বেড়ে যাচ্ছে। অপাশ্চাত্য সমাজের শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সঙ্গে তারা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করছে এবং তা করছে পাশ্চাত্য থেকে চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেই। হেনরি কিসিঞ্জার ‘একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ সম্পর্কে বলতে চেয়েছেন এভাবে : ‘… কমপক্ষে ছয়টি প্রধান শক্তি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন, জাপান, রাশিয়া এবং সম্ভবত ভারত এবং সেসঙ্গে কিছু মধ্যম আকৃতির রাষ্ট্র হবে অনাগত ভবিষ্যতে বিশ্বের মূল নিয়ন্তা।’ কিসিঞ্জার কর্তৃক বিবৃত ছয়টি প্রধান শক্তির পাঁচটি দেশই কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার গণ্ডিভুক্ত। উপরন্তু রয়েছে কিছু ইসলামি রাষ্ট্র, যাদের কুশলী অবস্থান, ব্যাপক জনসংখ্যা এবং তৈলসম্পদের মালিকানা বিশ্বরাজনীতিতে তাদেরকে প্রভাবশালী করে তুলেছে। এই নতুন বিশ্বে আঞ্চলিক রাজনীতি নৃগোষ্ঠীকেন্দ্রপ্রবণ। বিশ্বরাজনীতি বাস্তবে বিভিন্নধর্মী সভ্যতাকেন্দ্রিক। বৃহৎ শক্তিসমূহের পারস্পরিক শত্রুতা আসলে সভ্যতার সংঘাত দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। 

এই নবতর বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মারাত্মক সংঘাতসমূহ সামাজিক শ্রেণীগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়, এমনকি নয় তা ধনী ও দরিদ্রের অথবা অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত; বরং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলোর ভেতরে অনুষ্ঠিত দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন সভ্যতার অভ্যন্তরস্থ উপজাতিগুলোর মধ্যে আন্তঃযুদ্ধ এবং নৃগোষ্ঠীভিত্তিক সংঘাত দেখা দেবে বলে মনে করা যায়। 

অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন সভ্যতার এক দেশের সঙ্গে অন্যদেশের ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সহিংসতা দেখা দেবে এবং এতে ‘আত্মীয় বা বন্ধুতুল্য’ দেশগুলো মিলে ‘জোট’ গঠন করবে। সোমালিয়ার রক্তাক্ত গোত্রগত সংঘাত দেশের সীমানা সম্পর্কিত নয়। রোয়ান্ডায় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তাক্ত যুদ্ধ মূলত উগান্ডা, জায়ার এবং বুরুন্ডির ওপর অংশত বর্তায়, তবে তা খুব ব্যাপকভাবে নয়। বসনিয়া, ককেসীয় এবং মধ্যএশিয়া অথবা কাশ্মীরের সভ্যতা সংক্রান্ত রক্তাক্ত সংঘাত বৃহৎ আকারের যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। 

যুগোস্লাভিয়া সংঘর্ষে রাশিয়া সার্বীয়দেরকে কূটনৈতিকভাবে সমর্থন প্রদান করেছে; অন্যদিকে সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান এবং লিবিয়া অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে বসনীয়দেরকে সমর্থন দিয়েছে। উভয়পক্ষের এ কার্যক্রম কোনোভাবেই মতাদর্শিক বা ক্ষমতার রাজনীতি কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় বরং এটি মূলত সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মিল বা অমিলের কারণেই ঘটেছে। ‘সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ’ সম্পর্কে ভ্যাকলভ হাবেল বলেন, ‘দিনদিন বাড়ছে এবং ইতিহাসের যে-কোনো সময়ের তুলনায় তা ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।’ জ্যাকব ডেল্যুর যুক্তি দেখান যে, ‘ভবিষ্যতের সংঘর্ষ অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক ঘটনার নিরিখে; অর্থনৈতিক বা মতাদর্শের নিরিখে নয়।’ বিশ্বের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সভ্যতার ত্রুটিরেখা বরাবরই সবচেয়ে বেশি এবং সেসব স্থানেই সবচেয়ে মর্মান্তিক সংঘর্ষ হবে বলে ধারণা করা যায়। 

পুনরায় উল্লেখ করা যায়, শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বে সংস্কৃতিই হল মূল উৎস, যা সভ্যতাকে প্রভাবিত করে সমগোত্রীয় সংস্কৃতিসম্পন্নদের একত্রিত করে চলেছে। মানুষ মতাদর্শিক দৃষ্টিতে পৃথক হয়েও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দুই জার্মানির একত্রীকরণ হল এর প্রকৃত উদাহরণ। কোরিয়াতেও এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। ঐতিহাসিক বাস্তবতায় সমাজসমূহ কখনও কখনও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে একত্রিত হলেও তা আবার সাংস্কৃতিক চেতনার দ্বারা খণ্ডবিখণ্ডিত হয়েছে। যেমন সোভিয়েট ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া প্রভৃতি সভ্যতার ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। অন্যদিকে, এ-ধরনের চাপের মুখে রয়েছে বসনিয়া, ইউক্রেন, নাইজেরিয়া, সুদান, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য কিছু দেশ। সাংস্কৃতিকভাবে পরস্পর কাছাকাছি দেশগুলোই আবার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে ঐক্য গড়ে তোলায় সচেষ্ট থাকে। তাই দেখা যায়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের বেলায় জোটবদ্ধতার পেছনে থাকে সাংস্কৃতিক মিল বা অমিল। অন্য কথায় বলা যায় : সাংস্কৃতিক দিক থেকে কাছাকাছি সভ্যতাসমূহই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোটবদ্ধ হচ্ছে। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন; এ ইউনিয়নটি অনেক সংগঠনের চাইতে অধিক কার্যকর ও শক্তিশালী। পূর্ব ইউরোপের জাতিগুলোর মধ্যে যে লৌহকঠিন দেয়াল সৃষ্টি হয়েছিল, আজ তা অপসারিত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বেও বিভিন্নতা নতুনভাবে সৃষ্টি হচ্ছে, যার একদিকে থাকছে খ্রিস্টধর্ম প্রভাবিত পাশ্চাত্য এবং অন্যদিকে মুসলমান ও অন্যান্য গোঁড়া জনগোষ্ঠী। সামাজিক, মূল্যবোধ, সামাজিক সম্পর্ক ও প্রথাসহ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে দর্শনগত দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতার পার্থক্যরেখা সূচিত হয়। ধর্মীয় চেতনা সেই সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পার্থক্যবোধ সৃষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি ও চেতনাকে আরও উস্কে দেয়। কৃষ্টি ও সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। সেইসাথে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক সম্পর্কের ওপর এর প্রভাবও পরিবর্তশীল এবং নির্দিষ্ট একটি সময়ের ব্যাপ্তিতে এটি স্থির থাকে না। তারপরও বলা যায়, এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতার মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের মূলে অবস্থান করে সাংস্কৃতিক চেতনাসমূহ। পূর্বএশিয়ার অর্থনৈতিক সাফল্য আসলে পূর্বএশিয়ার সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই ঘটেছে, আর একই কারণে পূর্বএশিয়ায় একটি স্থায়ী ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে বারবার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ইসলামি সংস্কৃতির কারণে সামগ্রিকভাবে মুসলমানবিশ্বে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। কম্যুনিস্ট ব্যবস্থার পতন-পরবর্তী পূর্বতন সোভিয়েট ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের উন্নয়নসমূহ তাদের সাংস্কৃতিক ধারার ওপরই ঘটে চলেছে। সেখানকার পাশ্চাত্যমুখী খ্রিস্টীয় ঐতিহ্য প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এ দৃষ্টিতে দেখা যায় গোঁড়াপন্থী দেশসমূহে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, আর মুসলমান রাষ্ট্রসমূহের জন্যও ওই একই বক্তব্য প্রযোজ্য। 

পাশ্চাত্যজগৎ আগামী পৃথিবীতে শক্তিশালী সভ্যতা হিসেবে বজায় থাকবে। তবে অবশিষ্ট সভ্যতার ওপর তার প্রভাব ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। পাশ্চাত্যজগৎ অপাশ্চাত্য জগতের ওপর যতই তাদের মূল্যবোধগুলো আরও বিস্তার করতে চাচ্ছে, ততই অপাশ্চাত্য জগতে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে। সেইসাথে তৈরি হচ্ছে প্রতিরোধবোধ। কনফুসীয় এবং ইসলামি সমাজ ক্রমাগত তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে ‘ভারসাম্য’ সৃষ্টি করা, এমনকি পাশ্চাত্যকে প্রতিরোধ করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

পাশ্চাত্য ও অপাশ্চাত্য দেশসমূহের মধ্যে রাজনীতি, ক্ষমতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সুষম ধারায় পরস্পরের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বের একটি বাস্তবতা। 

শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্ব কার্যত সাত কিংবা আটটি বড় সভ্যতায় বিভক্ত। সাংস্কৃতিক মিল ও অমিল দ্বারাই বিভিন্ন সভ্যতার স্বার্থগুলো চিহ্নিত হচ্ছে, বৈরিতা বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক নির্ণীত হচ্ছে, অথবা মিত্র বা শত্রু দেশগুলো একত্রিত হচ্ছে। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে কোথাও কোথাও সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে যা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণেই ঘটছে বলে মনে করা যায়। এককথায় : একটি সভ্যতা থেকে অন্য একটি সভ্যতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তরের ভিন্নতা সাংস্কৃতিক পার্থক্য থেকেই তৈরি হচ্ছে। 

তাই বলা চলে, অধুনা আন্তর্জাতিক এজেন্ডাগুলোর মূলে রয়েছে বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে পারস্পরিক ভিন্নতার বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তির ধারা অপাশ্চাত্যের শক্তি বৃদ্ধির নিরিখে পরিচালিত হচ্ছে এবং সোজা কথায় বলা চলে : পাশ্চাত্য বিশ্ব অবশিষ্ট বিশ্বের ওপর আধিপত্য হারাচ্ছে। বৈশ্বিক শক্তি ক্রমান্বয়ে বহুপাক্ষিক ও বহুধারায় বিভক্ত সভ্যতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। 

অন্যরকম বিশ্ব? 

মানচিত্রসমূহ ও নমুনা 

শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বরাজনীতির ধারা কার্যত সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহ এবং বিভিন্নধর্মী রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীর বলয়ে গড়ে উঠেছে। তবে এ চিত্রটি কিন্তু অতিসরলীকরণ বৈ কিছু নয়। এর মধ্যে অনেককিছুই নেই, আবার যা আছে তারও হয়তো অনেককিছুই বিকৃতভাবে রয়েছে এবং হয়তো সেখানে অনেক কিছুই অস্পষ্ট। তবুও আমরা যদি এই বিশ্বকে নিয়ে আন্ত রিকভাবে চিন্তা করি এবং সেমতো কাজ করতে চাই, তাহলে একধরনের সরলীকৃত অথচ বাস্তব কিছু তত্ত্ব, ধারণা, মডেল ও নমুনা (প্যারাডাইম) প্রণয়ন করা দরকার। বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম ব্যতীত এ-কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম জেমস-এর বক্তব্য বিবেচনা করা যায়। তিনি বলেন : মেধা ব্যতীত কাজটি করা হলে তা হবে শুধুমাত্র ‘মারাত্মক ভুলে ভরা গুঞ্জন’ এবং বিভ্রান্তিকর। শীতলযুদ্ধকালীন বৃহৎ শক্তিসমূহের প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে হ্যারি ট্রুম্যান একটি মডেল দেবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভূ-রাজনীতির নিরিখে মানচিত্র প্রণেতার চর্চা আন্তর্জাতিক ভূদৃশ্যাবলি সকলের বোধগম্য করে তোলে। সেইসাথে পরিশীলিতভাবে অন্য রাষ্ট্রের ওপর প্রভাববিস্তার করার পথও তা বলে দেয়। এই পথগুলো যথাশীঘ্র অনুসরণীয় বলে প্রতিভাত হয়।’ বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার কার্যকারণ সম্পর্কিত তত্ত্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকে। 

প্রায় চল্লিশ বৎসর যাবৎ শিক্ষার্থী এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত মাঠপর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞ কর্মীরা শীতলযুদ্ধ সম্পর্কিত নমুনা নিয়ে বিশ্বের চলমান ঘটনাবলির অত্যন্ত উপযোগী কিছু কাজ সমাপ্ত করেছিল। তবে, এই নমুনাসমূহের নানাধরনের অসংগতির ফলে তৎকালীন বিশ্বরাজনীতির সকল বিষয় তারা তাদের চর্চার আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়নি। যেমন—কুহনের ভাষায় নমুনায়ন পণ্ডিতজনদের একসময়ের অন্যতম আলোচ্য বিষয়, তথা চীন-সোভিয়েটের আলাদা হয়ে যাওয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়েছিল। 

এই পর্যন্ত বৈশ্বিক রাজনীতির সাদামাটা এই মডেলটি বিশ্বরাজনীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত করেছে, যা পূর্বে হয়নি। আদতে, এটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি রচনা করেছে। আর সেজন্যই এটি সর্বজনগ্রাহ্যতা পেয়েছে এবং পরবর্তী দুটি প্রজন্মের বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নূতনভাবে ভাবনাচিন্তা করার কার্যকর অবকাশ এনে দিয়েছে। 

সহজবোধ্য নমুনা বলতে কী বোঝানো হয়েছে? কার্যত মানচিত্র আসলে মানুষের চিন্তা এবং কর্মের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। সুনির্দিষ্টভাবে প্রণীত তত্ত্বাবলি অথবা মডেলসমূহ আমাদের চিন্তার খোরাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আমাদের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে। এর বিকল্প হিসেবে, আমরা ওই ধরনের পথপ্রদর্শকের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট ‘লক্ষ্য’ ও সত্যঘটনা মাফিক এবং কোনোকিছুর ‘সঠিক যোগ্যতা’ নিরূপণের মাধ্যমে কাজ করতে পারি। যাইহোক, যদি আমরা আগেই সেটা ধরে নিই, তবে আমরা নিজেদেরকে বিভ্রান্ত করব। আমাদের মনের পশ্চাতে গোপনভাবে বেড়ে ওঠা ধারণাগুলোর প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং সংস্কারগুলো আদতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবতা, অর্থাৎ কী ধরনের সত্যের প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই এবং সেগুলোকে কীভাবে বিচার বা মূল্যায়ন করি তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

আমরা মডেলসমূহ সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট যে উপায়েই চাই না কেন, বাস্তবে যা পাওয়া যাবে, তা হল : 

১. বাস্তবতা সম্পর্কে নির্দিষ্ট ও সাধারণীকরণ; 

২. বিভিন্ন সত্তার মধ্যে পরস্পরের কার্যকারণ সম্পর্ক; 

৩. যা ঘটতে পারে সে-সম্পর্কে আগাম কিছু বলার ক্ষমতা অর্জন করা; 

৪. গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন বিষয়গুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা; 

৫. আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবার পথগুলোকে দেখতে পাওয়া।

প্রত্যেক মডেল অথবা মানচিত্রই হল একটি বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি, যা বিশেষ কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন-রাস্তায় ঠিকমতো ও যথাযথভাবে মোটরযান চালানোর জন্য রোডম্যাপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু প্লেন চালনার জন্য সড়কপথের জন্য প্রস্ত তকৃত রোডম্যাপ অকার্যকর। এর জন্য চাই বিমানবন্দর, রেডিও স্টেশন, বিমান চলাচল পথের নির্দেশ সম্বলিত মানচিত্র। যাহোক, কোনো মানচিত্রই আমরা কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারি না। যে মানচিত্রে যতবেশি বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটে, সেই মানচিত্র তত উত্তম। অতিরিক্ত বিশদ বিবরণসম্পন্ন মানচিত্র অনেক সময় তেমন কার্যকরী নাও হতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টির আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই বলা যায়, আমরা এমন মানচিত্র প্রত্যাশা করব যা বাস্তবসম্মত, তথ্য বিবৃত হবে সহজ ও সাবলীলভাবে এবং থাকবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট রাস্তার নির্দেশনা। শীতলযুদ্ধের সময়ে বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রকার মানচিত্র ও মডেল প্রস্তুত ও তা প্রয়োগ করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছিল। 

একক বিশ্ব : রমরমা ও প্রীতিকর 

কতিপয় ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত অত্যন্ত বহুলপ্রচারিত একটি নমুনা মডেল ছিল এরূপ : শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বে রাজনীতির দ্বারা সৃষ্ট সংঘাতসমূহ দূরীভূত হবে এবং বিশ্ব আগের তুলনায় অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতিময় হয়ে উঠবে। এই মডেলের বহুকথিত ধারাটি ফ্রান্সিস ফুকোওয়ামা ইতিহাসের পরিসমাপ্তি নামে প্রচার করেছেন। তাঁর যুক্তি ছিল এমন : ‘…ইতিহাসের পরিসমাপ্তির (End of History) অর্থ হল এমন যে, মানবেতিহাসে মানুষের কল্যাণে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান হয়েছে এবং এখন এমন পরিস্থিতি এসেছে যে বিশ্বব্যাপী এখন সর্বজনীন চেতনা ও পাশ্চাত্য উৎসারিত উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানুষের সমাজের জন্য স্থায়ী এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।’ আরও নিশ্চিত করে তিনি বলতে চান, কিছুসংখ্যক সংঘাত হয়তো তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে হতে পারে, কিন্তু বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সংঘাতের সমাপ্তি ঘটেছে, এবং তা শুধুমাত্র ইউরোপে নয় বরং সমগ্র বিশ্বজুড়ে। ‘বিশেষ করে অ-ইউরোপীয় বিশ্বে’ এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। চীন এবং সোভিয়েট ইউনিয়নে এ পরিবর্তন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। মতাদর্শিক যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মাকর্সীয়-লেনিনবাদ মানাগুয়া, পয়োনজিয়াংগ, ক্যামব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস্ প্রভৃতি স্থানে হয়তো এখনও বহাল রয়েছে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রায় সর্বত্র উদারনৈতিক গণতন্ত্র স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে আর সময় বা অর্থ ব্যয় করতে হবে না বরং অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য সবাই কাজ করে যাবে। তবে তিনি দুঃখের সঙ্গে বলেন, ‘এ সবই হবে খুবই বিরক্তিকরভাবে। 

শীতলযুদ্ধোত্তর তাৎক্ষণিক সময়ে কাঙ্ক্ষিত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বেশ ভালোমতো দানা বেঁধেছিল। রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলও এ-বিষয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। বার্লিনের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, কম্যুনিস্ট সরকার ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটে, জাতিসংঘ আশাবাদী হয়ে ওঠে; এবং ধরে নেয় যে, শীতলযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাবেক শক্তিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ‘অংশীদারিত্ব’ এবং একটি বড় মাপের দেনা-পাওনাসুলভ সম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং এভাবে শান্তিস্থাপন ও শান্তিরক্ষার প্রক্রিয়াই হবে যুগের অর্জন বা সময়ের যথোপোযুক্ত চাহিদা। বিশ্বের বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপতিগণ একটি ‘নবতর বিশ্বব্যবস্থার’ ঘোষণা দেন। পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যুক্তি দেখাতে থাকে যে, নিরাপত্তা বিষয়ক অধ্যয়নের দিন শেষ হয়ে এসেছে এবং এ বিভাগে আর প্রফেসর পদে নিয়োগ দানের প্রয়োজন নেই— ‘খোশ আমদেদ। আমরা আর যুদ্ধ সম্পর্কে পঠন-পাঠন করব না; কারণ আর যুদ্ধ হবে না।’ 

শীতলযুদ্ধাবসানের পরের রমরমাভাব আসলে একধরনের ‘ভ্রম’ সৃষ্টি করেছিল, যাতে মনে করা হত সত্যিই বুঝি বিশ্ব সংঘাতমুক্ত হয়ে সৌহার্দ্যের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে। ১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব আগের চেয়ে পরিবর্তিত হল সত্য, তবে কাঙ্ক্ষিত শান্তি পাওয়া গেল না। পরিবর্তন ছিল অবশ্যম্ভাবী; তবে অগ্রগতি হল না কোনো ক্ষেত্রেই। সৌহার্দ্যের মোহ বাস্তবায়িত হল না। বিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি নতুন ধরনের সংঘাত আবির্ভূত হল। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে ধরে নেয়া হয়েছিল এটিই হবে ‘শেষযুদ্ধ’ এবং পৃথিবী এখন গণতন্ত্রের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ অবস্থা ও পরিবেশ অর্জন করল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট চিত্রিত করেছেন এভাবে : ‘এটি হবে একক কর্তৃত্বমূলক কার্যক্রম ও সিদ্ধান্তের শেষ অঙ্ক এবং অন্যকে বাদ দিয়ে জোট বা আঁতাত করার দিনও শেষ হবে। সেইসঙ্গে শক্তির ভারসাম্য’ সৃষ্টি হবে। আর যাবতীয় অশুভ তৎপরতা যা বিশ্বকে অস্থির করে তোলে; তারও পুনরাবৃত্তি হবে না।’ একটি সর্বজনীন সংস্থা যা শান্তিকামী দেশসমূহের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত স্থায়ী শান্তির প্রক্রিয়া আমরা খুঁজে পেতে পারি। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে উপহার দিল কম্যুনিজম এবং শতাব্দীকাল ধরে চলে আসা গণতন্ত্রের পশ্চাৎ যাত্রা। আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সৃষ্টি করল শীতলযুদ্ধ, যা সমগ্র বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করল। আর শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বে শান্তির ‘মিথ্যা প্রত্যাশা’ অতিদ্রুত নৃগোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, নৃগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্নকরণ (ethnic cleansing), আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, সন্ত্রাস, সংঘাতপ্রবণ নতুন নতুন জোট বা সংঘ, নব্য কম্যুনিস্ট ও নব্য ফ্যাসিস্ট আন্দোলন, ধর্মীয় মৌলবাদের উগ্র বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদির দ্বারা দূরীভূত হয়ে গেল। সেইসাথে ‘সহাস্য কূটনীতির’ বদলে ‘হ্যাঁ’ সূচক নীতির সম্প্রসারণ ঘটল, যা রাশিয়া পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে চর্চা করে যাচ্ছে। উপরন্তু, জাতিসংঘের দুর্দশা ও অস্থিরতা, যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা অন্যান্য আঞ্চলিক সংঘাতের রক্তাক্ত পরিণতি, আর আগামীতে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য সৃষ্ট হওয়া চীনের অপূর্ব সুযোগ, ইত্যাদি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল। 

বার্লিনের দেয়াল পতনের পাঁচ বৎসর পর ‘গণহত্যা’ নামক শব্দটি বারবার শ্রুত হতে লাগল, যা শীতলযুদ্ধ চলাকালীন পাঁচ বৎসরে শোনা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, শীতলযুদ্ধাবসানের ভেতর দিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ বিশ্ব সৃষ্টির কোনোপ্রকার লক্ষণ পরিদৃষ্ট হল না। 

বহুধা বিভক্ত বিশ্ব 

দুই বিশ্ব : ‘আমাদের’ এবং ‘তাদের’ 

মানবেতিহাসে যখন ‘এক বিশ্বজনীন’ চেতনায় ছেদ পড়ল, দ্বন্দ্বের বিচারে তখন ‘দুই বিশ্ব’ ধারণাটি মানবেতিহাসে পুনরায় সবল হতে থাকল। মানুষ প্রায়শই ‘আমাদের’ এবং ‘তাদের’, গোষ্ঠীভুক্ত বা গোষ্ঠীভুক্ত নয়; ‘আমাদের সভ্যতা’ অন্যদিকে ‘বর্বরদের সভ্যতা’ ইত্যাদির নিরিখে ভাবতে ভালোবাসে। পণ্ডিতেরা জগৎকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, উত্তর ও দক্ষিণ, কেন্দ্র ও প্রান্তিক, এভাবে ভাগ করে দেখতে আগ্রহী। ওদিকে, মুসলমানেরা একদিকে ‘দারুল ইসলাম’ এবং ‘দারুল হার্ব’, ‘শান্তির নীড়’ আর অন্যদিকে ‘অশান্তির যুদ্ধ’—এভাবে ভাবতে চায়। শীতলযুদ্ধ শেষের দিকে এই ধারণাটি সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে যায়। একজন আমেরিকান পণ্ডিত বিশ্বকে একদিকে ‘শান্তির এলাকা’ আর অন্যদিকে ‘হাঙ্গামার এলাকা’ এইভাবে ভাগ করে দেখতে থাকেন। আর সেক্ষেত্রে শান্তির এলাকা বলতে পশ্চিমাবিশ্ব ও জাপান যার মোট জনসংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগের বেশি নয়, আর অন্যদিকে বাদবাকি শতকরা ৮৫ বিশ্বকে ‘হাঙ্গামা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

খণ্ডিত বিশ্ব নিয়ে যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁরা খণ্ডিত অংশকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চান তার ওপর অনেককিছু নির্ভরশীল। তবে দ্বিখণ্ডিত বিশ্ব-সম্পর্কিত বিশ্বধারণার সঙ্গে বাস্তবতার কিছু মিল আছে। অতি সাধারণ বিভাজন, যেমন—ধনী (আধুনিক ও উন্নত) এবং দরিদ্র (গতানুগতিক, অনুন্নত অথবা উন্নয়নশীল) দেশসমূহের পার্থক্য সম্পর্কে বুঝাতে চাওয়া হয়। ঐতিহাসিকভাবে এ-ধরনের বিভাজন অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে বলে ধরে নিলেও তার গভীরে আসলে সাংস্কৃতিক চেতনাই কাজ করে থাকে, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। কেননা, এখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য যতটা না বিবেচিত হয়, তার চেয়েও বেশি বিবেচিত হয়ে থাকে উপাদানসমূহ, যেমন—মূল্যবোধ, জীবনযাপন প্রণালী ইত্যাদি। উল্লিখিত সব ক্ষেত্রেই বাস্তবতার ছাপ থাকলেও তার সীমাবদ্ধতার কথাও ভুলে গেলে চলবে না। ধনী এবং আধুনিক দেশসমূহে দরিদ্র এবং গতানুগতিক দেশগুলো থেকে বৈশিষ্ট্যাবলি অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন এবং উভয়পক্ষের ক্ষেত্রে ‘মিশ্র’ অবস্থায় থাকতে দেখা যায়। তবে, এজন্য মাত্রাগত পার্থক্য নির্ণয়ই হল বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তিসঙ্গত কার্যাবলির লক্ষণ। 

সম্পদের বৈষম্য প্রকারান্তরে উভয় সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের জন্ম দিতে পারে, তবে নজির ও ঘটনা থেকে দেখা যায় যে, সংঘাত তখন আসে যখন ধনী ও ক্ষমতাশালী দেশসমুহ দুর্বল দেশকে ভৌগোলিকভাবে জয় করতে চায়; কিংবা উপনিবেশ হিসেবে রাখতে চায়। পাশ্চাত্যরা বিগত চারশত বৎসর এই কাজটি করে এসেছে। তাই দেখা গিয়েছে, কোনো কোনো উপনিবেশিত দেশ স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে পশ্চিমাশক্তির (দখলদার) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, করেছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রেই দখলদার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দখলকৃত সমাজে স্বাধীনতা প্রদান করে ঘরে ফিরে আসতে হয়েছে। কিন্তু চলতি বিশ্বে, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বাতিলকরণ প্রক্রিয়ার যুদ্ধ ও সংঘাত প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে সংঘটিত হচ্ছে। 

সাধারণ পর্যায়ে ধনী ও দরিদ্রের সংঘাত তত প্রকট নয়। কারণ, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত দারিদ্র্যকবলিত দেশগুলোতে রাজনৈতিক ঐক্যের অভাব রয়েছে। এছাড়া, তারা অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে বড় দেশগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেও সক্ষম নয়। 

এশিয়া ও লাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধনী-দরিদ্রের বিভাজনের ওপর একটি কলঙ্কতিলক বিশেষ। ধনীদেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ চালিয়ে যায়; আর দরিদ্রদেশগুলো পরস্পরের মধ্যে সহিংস ও রক্তাক্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। কিন্তু দক্ষিণের দারিদ্র্যপীড়িত ও উত্তরের ধনবান দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা বাস্তবতাবিবর্জিত 

আদর্শিক দিক থেকে বিশ্বের বিভেদগুলো আজ আর তত কার্যকর নয়। প্রায় সর্বত্রই পশ্চিমা জগৎ একটি বাস্তব সত্তা। অপাশ্চাত্য দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে কোন্ উপায়ে ও কত পরিমাণ গভীরতায় একই সূত্রে গাঁথা তা একটি বড় প্রশ্ন। কেননা, এক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের মধ্যে মিল একটিই, আর তা হল, তারা সবাই অপাশ্চাত্য। জাপানি, চৈনিক, হিন্দু, মুসলমান এবং আফ্রিকান সভ্যতা খুব কমই একে অন্যের সঙ্গে মিলে যায়। বিশেষ করে ধর্ম, সমাজকাঠামো, প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং চলমান মূল্যবোধের দৃষ্টিতে এই ঐক্য বেশি দেখা যায়। তাই বলা চলে, অপাশ্চাত্যের দেশসমূহের মধ্যে ঐক্য বা পূর্ব-পশ্চিম বিভাজন একটি কল্পকাহিনী যা পশ্চিমাবিশ্ব নিজেরাই তৈরি করেছে। 

এইসব কল্পকাহিনীর সঙ্গে প্রাচ্যের বিশ্বাসের দুঃখজনক যোগ রয়েছে, যাকে এডওয়ার্ড সাঈদ সঠিকভাবেই সমালোচনা করে বলেছেন : ‘আমাদের’ বলতে ইউরোপ ও পশ্চিমাবিশ্বকে বুঝানো হয়েছে এবং অন্যদিকে ‘তাদের’ বলতে প্রাচ্য এবং পূর্বকে বুঝানো হয়েছে। বলাবাহুল্য, ‘আমাদের’ শ্রেণীই উচ্চমার্গের বলে অন্তঃস্থায়ী। তাই ‘আমরা’ ‘তাদের’ ওপর আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারকারী।১০ শীতলযুদ্ধকালীন বিশ্ব ছিল মতাদর্শিক কারণে দুই মেরুতে বিভক্ত। সেখানে কোনোপ্রকার একক সাংস্কৃতিক ধারা ছিল না। মেরুকরণের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম প্রকৃতপক্ষে বৈশ্বিক দৃষ্টিতে একে অপরের অংশ হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইউরোপের সভ্যতাকে পশ্চিমা সভ্যতা হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। ‘পূর্ব’ এবং ‘পশ্চিমের’ পরিবর্তে আসলে ‘পশ্চিমাবিশ্ব’ ও ‘বাকি অপরাপর বিশ্ব’ বলাই বোধহয় যথার্থ হতে পারে। তাহলে অন্ততপক্ষে অপাশ্চাত্যের অনেককিছুই এর আওতাভুক্ত হতে পারবে। এটি আসলেই খুবই জটিল বিষয়। আগাম মন্তব্য ও বিশ্লেষণ করা কঠিন, বিশ্বকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে বিভাজন, যেমন—উত্তর-দক্ষিণ আর সাংস্কৃতিকভাবে বিভাজন, যেমন পূর্ব-পশ্চিম একই পর্যায়ভুক্ত। 

১৮৪টি রাষ্ট্র, কম অথবা বেশি 

শীতলযুদ্ধাবসান-পরবর্তী তৃতীয় মানচিত্রটি হল সেই মানচিত্র যার মাধ্যমে বলতে চাওয়া হয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বেলায় ‘বাস্তব’ তত্ত্বের কথা। এই তত্ত্বের মাধ্যমে বলা হয়, রাষ্ট্র হল একমাত্র প্রাথমিক ও যথার্থ সংগঠন, যার মাধ্যমে বিশ্বরাজনীতিতে ভূমিকা রাখা যায়। কারণ, রাষ্ট্র এই সম্পর্কের ভেতর দিয়ে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে নৈরাজ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে নিজে টিকে থাকার মতো ক্ষমতা অর্জনের প্রশ্নে সংযুক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে অন্যরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজের ক্ষমতার দাপট প্রকাশ করতে চায়, যদি কোনো রাষ্ট্র দেখে যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো রাষ্ট্র ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, আর সেই ক্ষমতা যদি তার জন্য ভবিষ্যৎ হুমকি হিসেবে গণ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে ওই রাষ্ট্রও তার নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হবে, অথবা বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘আঁতাত’ করে ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইবে। শীতলযুদ্ধাবসানোত্তর পরিস্থিতিতে ১৮৪টি রাষ্ট্রের স্বার্থ ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। ১১ 

‘বাস্তববাদী’ এই চিত্রটির ব্যবহারিক দিক খুবই উজ্জ্বল, যার দ্বারা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যাসহ রাষ্ট্রসমূহের প্রকৃত আচরণ জানা যায়। সংগতভাবে বলা যায়, রাষ্ট্র হল বিশ্বপরিস্থিতির শক্তিশালী নিয়ামক। রাষ্ট্র সৈন্যবাহিনী লালনপালন করে, কূটনৈতিক তৎপরতা বজায় রাখে, আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সন্ধি স্থাপন করে, যুদ্ধের সময় যুদ্ধ করে, আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে ও তা নিয়ন্ত্রণ করে। তদুপরি, রাষ্ট্র উৎপাদনব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ করে ও ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে থাকে। রাষ্ট্র তার ভূখণ্ড ও জনগণকে বহিঃশক্তির আক্রমণের ও অভ্যন্তরস্থ অশান্তি সৃষ্টিকারীর হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। সুতরাং, রাষ্ট্রকে একটি ‘একক নমুনা’ হিসেবে অবশ্যই বিশ্বপরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য অন্যতম প্রধান উপাদান বলে বিবেচনা করতে হবে। 

তবে ‘একবিশ্ব’ বা ‘দ্বি-বিশ্ব’ নমুনার পরিবর্তে রাষ্ট্রসুলভ এই নমুনার কিছু প্রকট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই নমুনায় ধরে নেয়া হয় যে, সকল রাষ্ট্র নির্বিশেষে তাদের প্রয়োজনগুলো হৃদয়ঙ্গম করে একইভাবে এবং একই উপায়ে সে সম্পর্কে কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা করে থাকে। এতে মনে করা হয়, ক্ষমতাই সবকিছুর উপরে এবং এর মাধ্যমেই প্রারম্ভিকভাবে রাষ্ট্রের আচরণ বুঝতে হবে। কিন্তু এভাবে বাস্তবে কেউ খুব বেশিদূর এগুতে পারে না। ক্ষমতার দ্বারাই রাষ্ট্রের স্বার্থসমূহ চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এর বাইরেও কিছু বিষয় রয়ে যায়, যা অনুধাবন করা আবশ্যক। রাষ্ট্রকে অবশ্যই সবসময় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। তবে এই বিষয়টি যদি রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ডের ভাণ্ডার হত কিংবা তা অন্যভাবে না হত তবে ১৯৪০ সালে পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে একাঙ্গীভূত হয়ে যেতে পারত। 

রাষ্ট্রগুলো প্রাথমিকভাবে সকলপ্রকারের ভীতির মোকাবিলা করে থাকে; পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো পূর্বাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং সামরিক ভয়ভীতি অনুভব করছিল। তারা মনে করতে থাকল যে, তাদের স্বার্থসমূহ আগের তথা সনাতন প্রথাগত তত্ত্বের দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। মূল্যবোধ, কৃষ্টি এবং বিভিন্নধর্মী প্রতিষ্ঠান খুবই স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রের ওপর প্রভাববলয় বিস্তার করতে সচেষ্ট থাকে এবং কার্যত রাষ্ট্রের স্বার্থ সেভাবেই নির্ণীত হয়। রাষ্ট্রের স্বার্থসমূহ কেবলমাত্র রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠানাদির দ্বারা স্থির হয় না, সেসঙ্গে তার ওপর বাহ্যিক তথা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানাদিরও একটি বিরাট প্রভাব কার্যকর হয়ে থাকে। নিরাপত্তা সম্পর্কিত রাষ্ট্রের প্রধান বিষয়ের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন প্রকার রাষ্ট্র বিভিন্নরকমের স্বার্থ চিহ্নিত করে থাকে। একই ধরনের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠানাদি সম্বলিত দেশগুলো পরস্পরের জন্য একই রকমের (সাধারণ) স্বার্থবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে। 

সেই সূত্রে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে পরস্পরের স্বার্থ প্রায় একই রকম হওয়া স্বাভাবিক এবং ধারণা করা যায়, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে না। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে এমন কোনো কর্মকাণ্ডে কানাডা জোটভুক্ত হবে না। 

মৌলিক এবং প্রারম্ভিক পর্যায়ে ‘রাষ্ট্রসুলভ মডেল’ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। তবে সেই মডেল দ্বারা আমরা বুঝতে সক্ষম হব না যে, শীতলযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক রাজনীতি কীভাবে এবং শীতলযুদ্ধাবস্থায় বিরাজমান বিশ্বরাজনীতি কিংবা তার পূর্বের রাজনীতি কোন্ ধারায় পরিচালিত হয়েছে। সুতরাং, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রসমূহ তাদের স্বার্থগুলো বিভিন্ন কৌশলে এগিয়ে নিতে চেয়েছে। শীতলযুদ্ধোত্তর বিশ্বে রাষ্ট্রগুলো ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে তাদের স্বার্থগুলো সভ্যতার নিরিখে তুলে ধরতে সচেষ্ট রয়েছে। তারা পরস্পরের মধ্যে সাধারণত কৃষ্টি ও সভ্যতাগত মিল বা অমিলের মাধ্যমেই জোটবদ্ধ হচ্ছে এবং যাদের সঙ্গে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মিল নেই তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। 

একটি রাষ্ট্রের প্রতি অন্য রাষ্ট্রের যুদ্ধের হুমকি মূলত উভয় রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পার্থক্য থেকেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। এক দেশের জনগণ এবং জননেতাগণ অন্যদেশের জনগণের সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষ্টি, ধর্ম, মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানাদি ইত্যাদি সম্পর্কে সহজে বুঝতে পারলে তারা পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন হতে পারে ও সেটাই সকলের কাম্য। এই ধরনের মনমানসিকতার ফলে পরস্পরের সাংস্কৃতিক ঐক্য সৃষ্টি হয় এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদূরিত হয়। অপরদিকে, ভিন্নধর্মী সংস্কৃতি যা তারা বুঝতে অক্ষম, সেখান থেকেই ভীতি বা শত্রুতা কিংবা অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। তারই ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

মার্কস ও লেনিন অনুসারিত সোভিয়েট ইউনিয়ন এখন আর কোনো শক্তি হিসেবে জীবিত নেই। তাই তার নিকট থেকে মুক্তবিশ্ব বা যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি বা ভীতির বিষয়টি অকার্যকর। অধুনা সাবেক কম্যুনিস্ট ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বুঝতে পারছে যে, ভয়ভীতির নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, আর তা প্রকৃতপক্ষে বহুধাবিভক্ত সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। 

রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বিশ্বরাজনীতির মুখ্য ভূমিকা পালনকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাষ্ট্রের নিজেরও রয়েছে বহুমাত্রিক যাতনা। কারণ, রাষ্ট্র ক্রমশ তার সার্বভৌমত্ব, কর্মতৎপরতা ও পরিধি এবং ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। 

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের স্থলে অধুনা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব-প্রতিপত্তি চর্চার অধিকারপ্রাপ্ত হচ্ছে। এমনকি বিশেষ একটি রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূখণ্ডে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রকেও তা স্পর্শ করছে এবং ক্রমাগত প্রভাবিত করছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ : কোনো কোনো বিষয়ে, ইউরোপে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এমন সকল কাজকর্ম করছে, যা পূর্বে রাষ্ট্র তার আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে করত। এভাবে আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে অধুনা একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র সৃষ্টি হচ্ছে, যারা তাদের কর্মপরিধি, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করে ফেলেছে। বৈশ্বিকক্ষেত্রে আঞ্চলিক সরকার এই বিকল্প শক্তির আবির্ভাবের কারণে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক, প্রাদেশিক এবং তৃণমূল পর্যায়ের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিসমূহ অনেককে বুঝতে সক্ষম করে তুলেছে যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমশ অবনতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। এই অবস্থাকে মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রগুলোর অবস্থার সাথে তুলনা করা চলে। 

পুরোদস্তুর বিশৃঙ্খলা 

রাষ্ট্রসমূহের দুর্বলতা ও ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের’ (Failed State) ধারণা মূলত বিশ্বব্যাপী চতুর্থ ধাঁচের নৈরাজ্যের নির্দেশক। রাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থার কর্তৃত্ব ভেঙে পড়া, রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের ছত্রভঙ্গকরণ, উপজাতি, গোষ্ঠীগত, নৃগোষ্ঠীগত এবং ধর্মীয় সংঘাত, আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের উদ্ভব, উদ্বাস্তুর সংখ্যাধিক্য, পরমাণুশক্তিসহ অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সীমাহীন ও ব্যাপক বিস্তার, সন্ত্রাসের মাত্রা বৃদ্ধি, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সঙ্গে নৃগোষ্ঠীর নিশ্চিহ্নকরণ কার্যক্রম ইত্যাদি রাষ্ট্রসমূহের নিয়ন্ত্রণশক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিশ্বের এই বিশৃঙ্খল অবস্থা ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত দুটি পুস্তকের মাধ্যমে পরিস্ফুটিত হয়েছে। যথা : লেখক জিবিগনিউ ব্রিজেনসস্কি (Zbignew Brzezinski) কর্তৃক রচিত ‘Out of control’ এবং লেখক প্যাট্রিক মইনিহান (Patrick Moynihan) রচিত ‘Pandae monium’ রাষ্ট্র-সম্পর্কিত নমুনার ন্যায়, বিশৃঙ্খলা সম্পর্কিত নমুনা (প্যারাডাইম) বাস্তবতার কাছাকাছি বলে মনে করে। বর্তমান বিশ্বে চলমান ঘটনা ও পরিস্থিতির একটি গ্রাফিক এবং নির্ভেজাল প্রতিচ্ছবি এই নমুনার মাধ্যমে বিবৃত হয়েছে। তদুপরি, এই ‘বক্স’ বা চিত্রের মাধ্যমে শীতলযুদ্ধাবসানের পর বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসমূহ সম্পর্কে যথাযথভাবে মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৩ সালের শুরুতে, ৪৮টি নৃগোষ্ঠীগত যুদ্ধ সারা বিশ্বব্যাপী সংঘটিত হয়েছে। ১৬৪টি সীমানা ও ভূখণ্ড সম্পর্কিত নৃগোষ্ঠীগত সংঘাত হতে দেখা গিয়েছে, যার অধিকাংশই হয়েছে পূর্বতন সোভিয়েট ইউনিয়নের সীমানার মধ্যে। তন্মধ্যে ৩০টি সংঘাত ছিল সশস্ত্র। এই সংঘাতগুলো তীব্র এবং ভয়ানক রূপ নেয়। তবুও এই নমুনা বা মডেল সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা প্রয়োজন। রাষ্ট্রসম্পর্কিত মডেলের মতো এ মডেলেরও বহু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশ্ব বিশৃঙ্খল ও উত্তপ্ত হলেও একথা বলা যাবে না যে, বিশ্বের ঐক্য একেবারে ভেঙে পড়েছে। বরং বিশৃঙ্খলার মাঝেও বিশ্বে একপ্রকারের শৃঙ্খলাপ্রবণতারও উপস্থিতি আছে। 

সর্বজনীন নৈরাজ্য কিছু দিকনির্দেশনা দেয়, যার মাধ্যমে বিশ্বকে উপলব্ধি করা যায়; কেননা এর ফলে নিয়মমাফিকতা ও এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা সম্ভব হয়, নৈরাজ্যের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি অনুমান করা যায়; বিভিন্ন ধাঁচের বিশৃঙ্খলার ধরন, এর উৎপত্তির কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে জানা সম্ভব হয় এবং বলাবাহুল্য, সেমতো সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করে সমাধানের সঠিক পথ খুঁজে নেয়া যেতে পারে। 

তুলনার মানদণ্ডে বিশ্ব, বাস্তববাদিতা, কৃপণতা এবং ভবিষ্যদ্বাণী 

শিরোনামে উল্লিখিত চারটি নমুনার প্রত্যেকটি পৃথকভাবে, অথবা মিলিতভাবে বাস্তববাদিতা ও কৃপণতার ভিন্ন ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করে, যদিও প্রত্যেক নমুনার অপ্রতুলতা এবং সীমাবদ্ধতা অনস্বীকার্য। 

উক্ত অবস্থা প্রতিরোধের জন্য সম্মিলিত নমুনা হিসেবে এটিকে ধরে নেয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশ্ব একই সঙ্গে ‘বিভেদ’ ও ‘ঐক্য’ বা ‘সংহতি’, উভয় প্রক্রিয়াই ধারণ করে চলেছে। ১৫ উভয় প্রবণতাই আসলে কাজ করে যাচ্ছে এবং বলা যায়, অতি জটিল কোনো মডেল প্রকৃতপক্ষে সহজীকরণের পরিবর্তে প্রকৃত এবং প্রায় বাস্তবতা উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে জটিলতার জন্ম দেয়। তবে, এভাবে ভাবলে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টায় কার্পণ্যের পরিচয় দিতে হয় এবং এতে করে কার্যত যে-কোনো মডেলকেই পরিত্যাজ্য মনে হতে পারে। অধিকন্তু, একই সঙ্গে দুটি পরস্পরবিরোধী প্রবণতা তথা ‘বিভেদ প্রবণতা’ এবং ‘সংহতি প্রবণতা’ সংক্রান্ত মডেল কীভাবে বজায় থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। কোন্ কোন্ পরিস্থিতিতে দুটির একটি এগিয়ে যাবে বা অন্যটি যাবে না, কিংবা কোন্ ধারায় তা সমানতালে এগিয়ে যাবে এবং এভাবে এগিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব কি-না সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। সুতরাং, আমাদের মেধা ও মনন দিয়ে এমন মডেল উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যার মাধ্যমে জটিল বিষয়গুলোও সহজভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায়। 

উল্লিখিত চারটি নমুনা পরস্পরবিরোধী। বিশ্ব কখনও একই সঙ্গে একক (সমন্বিত) ) আবার মৌলিকভাবে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ ভাগে কীভাবে বিভক্ত হতে পারে? বিশ্ব ‘এক’ বা ‘দুই’ বা ১৮৪ রাষ্ট্রে বিভক্ত, এমনটি নয়; বরং প্রকৃত সত্য হল : বিশ্ব অগণিত সংখ্যক উপজাতি, নৃগোষ্ঠীগত চেতনা, ধর্ম এবং জাতিরাষ্ট্রের অবয়বে বিভাজিত। 

বিশ্বকে সাত বা আটটি সভ্যতায় বিভক্তকরণের মাধ্যমে অনেক ধরনের অসুবিধা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এভাবে ধরলে ‘একবিশ্ব’ বা ‘দ্বিবিশ্ব’ নমুনার মতো সত্যকে ধামাচাপা দেবার কোনোপ্রকার কার্পণ্য বা সুযোগ থাকে না। তাছাড়া রাষ্ট্রসুলভ অথবা বিশৃঙ্খল নমুনার ন্যায় সত্যকে গলাটিপে মারার প্রয়োজন পড়ে না। বলা যায়, এটি বিশ্বপরিস্থিতি সহজে বোঝার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সহজ মডেল (প্যারাডাইম) হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব। এই মডেলের ভেতর দিয়ে বহুধা বিভক্ত বিশ্বে বিভিন্নধর্মী সংঘাত উপলব্ধি করে ভবিষ্যতের জন্য কর্মপন্থা ও ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। এভাবে নীতিনির্ধারকগণও তথ্য পেয়ে উপকৃত হতে পারেন। 

এই নমুনার আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল, এটি অন্যান্য নমুনার গুণগুলোকেও সংযুক্ত করার ক্ষমতা রাখে ও অন্যান্য মডেলের সঙ্গে সুসংগতভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম। এই ‘সভ্যতাভিমুখী মডেলের’ নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচ্য, যথা : 

  • বিশ্বের সংহতি রক্ষার জন্য যে শক্তি রয়েছে তা খুবই বাস্তবসম্মত এবং কোন্ কোন্ উপাদানসমূহ এই সংহতির বিপরীতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে সে- সম্পর্কেও এই মডেলটি সতর্ক রাখতে সক্ষম। 
  • একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব দুটি ভাগে বিভক্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে অদ্যাবধি বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব-প্রতিপত্তি তাকে অন্যান্য সভ্যতা থেকে মৌলিকভাবে পৃথক করে রেখেছে। বিশ্ব হল সংক্ষেপে দুটি ভাগে বিভক্ত—এর একদিকে থাকে পাশ্চাত্য বিশ্ব, আর অন্যদিকে থাকে অবশিষ্ট বিশ্ব, যার ভেতর লুক্কায়িত থাকে নানাপ্রকারের সভ্যতা।
  • জাতিরাষ্ট্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হিসেবে বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকবে। জাতিরাষ্ট্রের স্বার্থসমূহ সংগঠনমূলক প্রত্যয় এবং এর দ্বন্দ্বগুলো সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার নানা উপদানের প্রভাবে দিনদিন ধারালো হতে থাকবে। 
  • একথা অনস্বীকার্য, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মাত্রার নৈরাজ্য বিরাজমান। বিভিন্ন উপজাতি এবং জাতিবোধ, জাতিগত অহমিকার কারণে সর্বদা এবং সর্বত্র সংঘাতপূর্ণ। যে-ধরনের সংঘাত বিভিন্ন সভ্যতামুখী রাষ্ট্র এবং গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘটিত হয়ে থাকে, সেই ধরনের সংঘাত স্থায়িত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

উপর্যুক্ত সভ্যতামুখী মডেল আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ এবং সরল মনে হলেও আসলে কিন্তু বিংশ শতাব্দী-পরবর্তী বিশ্ব উপলব্ধি করার জন্য এই মডেলের মানচিত্র তত সহজ সরল নয়। একথা সত্য, কোনো নমুনা বা মডেলই কিন্তু নির্বিশেষে সকল সময়ের জন্য উপযুক্ত নয়। শীতলযুদ্ধকালীন মডেল প্রায় চল্লিশ বৎসর কাল প্রভাববিস্তারকারী মডেল হিসেবে চালু থাকলেও ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এসে এ মডেল তার কার্যকারিতা হারাতে থাকে। সেজন্য বলা যায়, সভ্যতামুখী এই মডেলও অদূর ভবিষ্যতে তার কার্যকারিতা হারাবে। তবুও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই মডেলটি আমাদের জ্ঞানচক্ষুকে উন্মোচিত করে দেয় যে, কোটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা কোটি কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় 

১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত ৪৮টি নৃগোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের প্রায় অর্ধেক দ্বন্দ্ব ঘটেছিল বিভিন্ন সভ্যতার অভ্যন্তরস্থ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব এক্ষেত্রে শান্তিস্থাপনের জন্য কাজ করেছিলেন, যাতে ওইসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত সীমান্তযুদ্ধের দিকে মোড় নিতে না পারে। 

উল্লিখিত মডেলটির মাধ্যমে ভবিষ্যতে কী ঘটবে বা ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব এবং এ-বিষয়ে অপরাপর মডেল থেকে এ মডেলটি অধিকতর সঠিক ও কার্যকর বলে মনে করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রসুলভ মডেলের একজন সমর্থক জন মেয়ারসেইমার (John Mearsheimer) ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, ‘ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে পারস্পরিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা শীঘ্রই পরিণতি পেতে যাচ্ছে। বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে ইউক্রেনের অরক্ষিত সীমান্ত এলাকা রয়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার সীমান্ত এলাকা প্রায়শই নিরাপত্তাজনিত হুমকি ও ভয়ভীতির মধ্যে নিপতিত হয়। রাশিয়া এবং ইউক্রেন এই অসহনীয় অবস্থা উত্তরণের জন্য পারস্পরিকভাবে এগুতে পারে এবং এভাবে তারা ভীতিহীন পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এটি করা কতটুকু সম্ভব তা একটি বড় প্রশ্ন 

অন্যদিকে, সভ্যতামুখী মডেল, খুব নিকট থেকে সাংস্কৃতিক, ব্যক্তিগত এবং ঐতিহাসিক পটভূমি এবং এদের মাঝে অবস্থিত আন্তঃসংযোগ নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে। এ দুটি দেশের মধ্যে সভ্যতার দৃষ্টিতে ফাটল ধরবার কারণ, অবস্থা, এবং কীভাবে তা দূর করা যায়, কিংবা পূর্ব ইউক্রেনের অর্থোডক্স অংশের সঙ্গে পশ্চিম ইউক্রেনের সম্পর্ক কী তা দেখতে চাওয়া হয়। এই পরিস্থিতিগুলো দীর্ঘদিন থেকে একটি ‘ঐতিহাসিক সত্য’ হিসেবে চলে আসছে। এ সবকিছুই কিন্তু সভ্যতামুখী মডেলের ইতিবাচক এবং ‘বাস্তববাদী’ দিক। অথচ জন মেয়ারসেইমার (John Mearsheimar) এসব বাস্তব দিকগুলোকে উপেক্ষা করেই তাঁর মডেল তৈরি করেছেন। রাষ্ট্রসুলভ মডেল রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ভেতর একটি যুদ্ধের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে, অপরদিকে সভ্যতামুখী মডেল সেই বিরোধের মীমাংসার প্রতি দৃষ্টিপাত করে থাকে। তাছাড়া এ মডেল ইউক্রেনের বিভাজনকেও গুরুত্ব দেয় না, যদিও সাংস্কৃতিক দিকগুলো বিবেচনায় আনলে যে-কেউ মনে করতে পারে যে, ইউক্রেনের বিভক্তি চেকোস্লোভাকিয়া বা যুগোস্লাভিয়ার চেয়েও রক্তাক্ত হতে পারে। সভ্যতামুখী মডেল ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বলে থাকে ইউক্রেনকে তার পারমাণবিক অস্ত্র পরিত্যাগ করার পরামর্শ দেয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে বলে এবং ইউক্রেনের ঐক্য ও সংহতি বিধানের পরামর্শ দেয়। 

শীতলযুদ্ধোত্তর অবস্থার সঙ্গে সভ্যতামুখী মডেল সুসংগত বিধায় এই মডেল দ্বারা পরিবর্তিত অবস্থার বিশ্লেষণ এবং সে-সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। এসবের মধ্যে ছিল সোভিয়েট ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়ার পতন এবং ওই ভূখণ্ডে জাতি-সম্প্রদায়গত সন্ত্রাসী এবং সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ইত্যাদি। তুরস্ক ও মেক্সিকোর পরিচয়সংক্রান্ত প্রশ্ন, জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রসার, ইরাক ও লিবিয়ার প্রশ্নে ইসলামি রাষ্ট্র কর্তৃক পশ্চিমি দুনিয়ার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ; ইসলামি ও কনফুসীয় রাষ্ট্রগুলো পারমাণবিক অস্ত্র সহযোগিতার ফলে শক্তি অর্জন করবে এবং এর ব্যবহারবিধি জোরদার করবে। চীন এখন পর্যন্ত ‘বহিরাগত’ বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে, কিন্তু কিছু বাছাই-করা দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত থাকলেও পূর্বএশিয়া অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবে। 

১৯৯৩ সালে ৬ মাস ব্যাপী ঘটে যাওয়া সভ্যতামুখী মডেলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইতিমধ্যে আবির্ভূত বিশ্বের ঘটনাবলির নমুনা নিম্নরূপ : 

  • পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ার ক্রোয়াট মুসলমান এবং সার্বীয়দের মধ্যে যুদ্ধ তীব্র ও ব্যাপক আকারে চলছে। 
  • পশ্চিমাশক্তি যুক্তিপূর্ণ ও সঠিকভাবে বসনিয়ার মুসলমানদের সমর্থনদানে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অন্যদিকে, তারা ক্রোয়াটদের ও সার্বীয়দের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রতিরোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে।
  • জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ক্রোয়েশিয়ার সার্বীয়দের সাথে সরকারের সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে রাশিয়ার অনিচ্ছা দেখা যায়। বসনিয়ার মুসলামদের রক্ষা করতে ইরানসহ অন্যান্য মুসলমান দেশ থেকে ১৮০০০ সৈন্য সংগ্রহের বিষয়টি তথৈবচ। 
  • আরমেনীয়দের সঙ্গে আজেরিসদের যুদ্ধে তুরস্ক ও ইরানের দাবি হচ্ছে আরমেনিয়া অধিকৃত ভূমি ছেড়ে দেবে, সেখানে তুরস্কের বাহিনী নিয়োগ করা এবং আজারবাইজান সীমানায় ইরানি সৈন্য সমাবেশ এবং এ-বিষয়ে রাশিয়ার সতর্কবাণী হচ্ছে ইরানের কর্মতৎপরতা আসলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যার ফলে ‘যুদ্ধ ও সংঘাত আরও গতি পাবে’। অর্থাৎ, এ সিদ্ধান্ত হবে উস্কানিমূলক। এবং ‘তা আসলে আন্তর্জাতিকীকরণের সীমারেখার উপর সংঘাতিক ধাক্কা দেবে।’ 
  • মধ্যএশিয়ায় রুশবাহিনীর সঙ্গে মুজাহিদিন গেরিলাদের যুদ্ধ চলতে থাকবে।
  • মানবাধিকার সম্পর্কিত ভিয়েনা সম্মেলনে উক্ত বিষয়ে পাশ্চাত্য ও অবশিষ্ট বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উক্ত কনফারেন্সে পশ্চিমাজগতের নেতৃত্ব দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব ওয়ারেন ক্রিস্টোফার যিনি সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতার প্রতি প্রকাশ্য নিন্দা জ্ঞাপন করেন। আর সংঘাতের অন্যদিক হল, এ সম্মেলনে ইসলামি ও কনফুসীয় দেশগুলো পশ্চিমা সর্বজনীনতাকে প্রত্যাখ্যান করে। 
  • ন্যাটো এবং রাশিয়ার সামরিক নীতিনির্ধারকেরা সমান্তরালভাবে দক্ষিণদিক থেকে হুমকি আসতে পারার বিষয়টি উল্লেখ করে। 
  • সভ্যতামুখী ধারায় অলিম্পিকের প্রশ্নে প্রায় ২০০ ভোট বেজিং-এর বিপরীতে সিডনির দিকে পড়ে। 
  • পাকিস্তানের কাছে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত প্রযুক্তি বিক্রি করা এবং চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকা কর্তৃক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সেসঙ্গে ইরানে গোপনে পরমাণু-প্রযুক্তি চালান দেয়া নিয়ে চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবাদ গণনাযোগ্য। 
  • উভয়পক্ষ হতে সম্মতিক্রমে গৃহীত চুক্তি ভঙ্গ করে চীন কর্তৃক পরমাণু-অস্ত্রের পরীক্ষাকরণ এবং এ-বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র প্রতিবাদ এবং উত্তর- কোরিয়া কর্তৃক পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে পুনরায় কোনো আলোচনায় যোগ না- দেওয়ার ঘোষণা। 
  • এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইরান এবং ইরাকের ক্ষেত্রে ‘শাস্তিমূলক নীতি’ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতির আশ্রয় নেয়।
  • যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক দুটি প্রধান আঞ্চলিক বিবাদ সম্পর্কে ঘোষণা দেয়া হয়। এর একটি উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে, অন্যটি ইরাকের বিরুদ্ধে। 
  • চীন এবং ভারতের সঙ্গে জোট গঠনের নিমিত্তে ইরানের রাষ্ট্রপতির আহ্বান, ‘যার ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক ঘটনা সম্পর্কে শলাপরামর্শ করা হবে’।
  • জার্মানরা সাংঘাতিকভাবে শরণার্থী দমনে নতুন আইন প্রণয়ন করে যাবে।
  • রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট বোরিস ইয়েলৎসিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট লিওনিচ ক্রাভচুকের মধ্যে কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধজাহাজ চলাচলসহ অন্যান্য বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। 
  • বাগদাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বোমাবর্ষণে পশ্চিমাশক্তির সক্রিয় সমর্থন ছিল, কিন্তু নির্বিশেষে সকল মুসলিম রাষ্ট্র এ-ঘটনার নিন্দা করে এবং এ- ঘটনা আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতির প্রতিফলন ঘটায়। 
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সুদানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং মিশরের শেখ ওমর আবদেল রহমান ও তাঁর অনুসারীদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কেননা, মার্কিন ভাষায় তারা ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি শহুরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চাপিয়ে দিয়েছে।’ 
  • পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক এবং স্লোভাকিয়ার ন্যাটো (NATO) জোটে অন্তর্ভুক্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। 
  • ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচার করা হয় যে, রাশিয়া একটি ছিন্ন রাষ্ট্র যার মানুষ এবং এলিটগণ জানে না যে তারা কী করবে; তারা পশ্চিমাবিশ্বকে সমর্থন দেবে নাকি তার বিরোধিতা করবে। 

শীতলযুদ্ধের প্রথমদিকে কানাডার রাষ্ট্রহিতৈষী লেসটার পিয়ারসন অপাশ্চাত্য সমাজের পুনরুত্থানের ক্ষমতা ও শৌর্যবীর্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন : “এটি হবে অহেতুক যদি কেউ ভেবে থাকেন যে, নতুন রাজনৈতিক সমাজগুলো জন্ম নিচ্ছে প্রাচ্যে আর তা পশ্চিমের মতো সেখানে কার্বনকপি হবে বরং সেখানকার প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যগুলো ওই দেশকে নতুন অবস্থায় নিয়ে যাবে।’ তিনি বলেন যে, ‘ভবিষ্যৎ সমস্যা সৃষ্টি হবে একটি বিশ্বের সভ্যতার অভ্যন্তরস্থ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নয়, বরং তা হবে এক সভ্যতার সঙ্গে অন্য সভ্যতার মধ্যে।’ শীতলযুদ্ধের দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং দ্বিধাবিভক্তি পিয়ারসনের বক্তব্যের বাস্তবতাকে পিছিয়ে দিয়েছে মাত্র; শীতলযুদ্ধাবসানের সঙ্গে-সঙ্গে সংস্কৃতি ও সভ্যতার শক্তি দ্রুত জেগে ওঠে যা তিনি ১৯৫০-এর দশকে আবিষ্কার করেছিলেন এবং বলাবাহুল্য, বিশ্বের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী এবং বিশ্বরাজনীতির ধারা বিশ্লেষণের স্বীকৃতি দিয়েছেন। যারা বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী, তাদের প্রতি কারন্যান্ড ব্রাউভেল বক্রভাবে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যে-কেউ বিশ্বমানচিত্র নিয়ে কাজ করতে চান, তাকে জানতে হবে কীভাবে এটি নিয়ে কাজ করতে হয়। যে মানচিত্রের উপর আজ বিশ্বসভ্যতা দণ্ডায়মান, তাদের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে তাদের কেন্দ্ৰ ও চৌহদ্দিসমূহ, তাদের প্রদেশ এবং যে বায়ুদ্বারা তারা শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় তা সহ সাধারণ ও সুনির্দিষ্ট ‘ধরন’ যা তার সাথে সম্পর্কিত সবই জানতে হবে। অন্যথায়, সেখানে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ১৯ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *