মেয়ে-গাড়িতে শুধু বৌকেই তুলে দেয় না প্ৰবোধ, সব ছেলেমেয়ে কটাকেই তুলে দেয়। মালপত্র তো বটেই। নিজে হাত-পা ঝেড়ে পাশের কামরায় বসে মনে মনে চিন্তা করতে থাকে, কি করে আবার অবস্থা আয়ত্তে আনা যাবে!
নিতান্তই যে হাত পুড়িয়ে রোধে খাওয়ার এবং তৎপরে মামীর বাড়ি গিয়ে গিয়ে খাওয়ার যন্ত্রণাতেই বৌকে আনতে গিয়েছিল সে, এবং গিয়ে মাত্র দেখতে না পেয়ে মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল, সেটাই বোঝাতে হবে। বিশদ ব্যাখ্যায়।
তা ছাড়া শরীর খারাপের ভানও করতে হবে একটু, নচেৎ যে পাষাণ মেয়েমানুষ, মন গলবে না!
আশ্চর্য এই, বৌ যতই বেচাল করুক আর প্রবোধ তাতে যতই ক্ষেপে যাক, শেষ পর্যন্ত নিজেকেই যেন ক্ষুদ্র মনে হয়। সুবৰ্ণকে কিছুতেই সত্যি অসতী মেয়েমানুষ ভাবা যায় না। ও যেন আপন মহিমায় মাথা খাঁড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন নিজেকে সমর্থনা করতে, কৌশল করতে বসা ছাড়া আর কি করা যায়?
তা এবার সুবিধে আছে।
বাড়িতে কেউ নেই।
অত বড় বাড়িটায় শুধু তো তারা চার ভাই। আর গিয়ে পড়বে শুধু প্ৰবোধেরই নিজ পরিবারটুকু। অতএব—
কিন্তু হায় প্ৰবোধের কপাল!
একবেলার জন্যে ঘুরে এসে দেখলো কিনা পরিস্থিতি বিপরীত! বাড়ি লোকে লোকরণ্য।
গুরুবাড়ি থেকে মুক্তকেশী এসে গেছেন নাতনীকে নিয়ে, বোনের বাড়ি থেকে উমাশশী এসে গেছে দশ ছেলেমেয়ে নিয়ে।
প্রভাসের বৌ এসে গেছে নিজস্ব বাহিনী নিয়ে।
তা তার জন্যেই মুক্তকেশীর আসার সুবিধে। সে ছিল কাটোয়ায় পিসির বাড়ি, শাশুড়ী রয়েছেন নবদ্বীপে, এই সুবিধয়ে পিসির সঙ্গে গিয়েছিল শ্ৰীপাট নবদ্বীপ দেখতে। মুক্তকেশী এমন সুযোগ ছাড়লেন। না, ওকে ধরে বসে ৱললেন, আর দীর্ঘকাল পরের বাড়ি বসে থেকে কাজ নেই। সেজবৌমা, চলো চলে যাই। রোগবালাই কিছু চিরকাল থাকছে না। আর সব কথার সার কথা রাখে কেষ্ট মারে কে?
সেজবৌ সুবৰ্ণলতা নয়।
সেজবৌ শাশুড়ীর মুখের উপর বলে বসলো না, তা সেই সার কথাটা তো জানাই ছিল মা আপনার, তবে এত বড় সংসারটাকে নিয়ে সাত-ছরকোট করলেন কেন?
বললো না। বলতে জানলেও বলতো না।
কারণ সেজবৌ এ প্রস্তাবে বাঁচালো।
অধিক দিন যে পরের বাড়ি বাস সুবিধেয় নয়, সে কথাটা সেও বুঝে ফেলেছে।
অতএব সেই যাত্ৰাতেই কলকাতার ট্রেনে চেপে বসা! পুরুষ অভিভাবক হিসেবে পিসির ছেলে এল সঙ্গে। বছর ষোলর ছেলেটা, তা হোক, পুরুষ তো বটে!
পাকেচক্ৰে অথবা প্ৰবোধের গ্রহের ফেরে, ক্রুদ্ধ অভিমানাহত দিদির নির্দেশে উমাশশীও সেই দিনই চলে এসেছে দিদির বাড়ি থেকে। এরা সকালে ও বিকেলে।
তার মানে বৌ নিয়ে নির্জন গৃহবাসের রোমাঞ্চময় কল্পনাটা ভূমিসাৎ হয়ে গেল প্ৰবোধের। একা বাড়িতে গলা খুলে উপদেশ আদেশ দিয়ে দিয়ে বৌকে গড়ে পিটে নতুনভাবে তৈরি করে নেবার স্বপ্ন গেল ভেঙে। অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করেই মনে মনে সংসার-পরিজন সকলের সম্পর্কে একটা কটুক্তি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সে।
আর আজ সুবর্ণর মত তারও মনে হল, বাড়িতে বড় বেশি লোক! এত লোকের চাপে সত্যিই নিজের আর কিছু খোলে না। অথচ সুবর্ণ যখন দুমদাম করে বলে বসে, বাবাঃ, এ বাড়িতে মানুষ আর মানুষের বুদ্ধি খেলাবে কোথা থেকে, বৃথা গজালি করতে করতেই দিনরাত্তির কেটে যায়, তখন প্ৰবোধ তাকে একোলর্ষেড়ে, আত্মসুখী বলে গঞ্জনা দিয়েছে।
এমন মনে হচ্ছে বাস্তবিক এত লোকের চাপে নিজের মাহাত্ম্য ফোঁটানো যায় না কোথাও। মনে হচ্ছে, সেই রাতদুপুরের আগে আর সুবর্ণর সঙ্গে মোকাবিলার উপায় নেই।
দূর! শালার সংসারে নিকুচি, বেশ আছে জগুদা! তারপরেই মনে হয় মামীর বাড়িতে খবর দেওয়া আবশ্যক।
সেই দিকেই পা চালায়।
ওরা তো সব এসে গেল।
নৈর্ব্যক্তিক সুরে খবরটা ঘোষণা করলো প্ৰবোধ।
শ্যামাসুন্দরী দাওয়ায় বসে মালা ঘোরাচ্ছিলেন, ইশারায় প্রশ্ন করলেন, কারা?
প্ৰবোধ তেমনি নির্লিপ্ত গলায় বলে, আর কে? মা আর মায়ের চেলাচামুণ্ডো! তোমাকে আর ভাগ্নেদের ভাত বাড়তে হবে না, সেই কথাই বলতে এলাম।
জগু কোথায় যেন ছিল, ভাইয়ের গলা শুনে এদিকে আসতে আসতে ভাবছিল, আজ যে প্ৰবোধ এমন সকাল সকাল? খিদে লেগেছে বোধ হয়। যাক, মার তো বেলাবেলিই রান্না প্ৰস্তুত হয়ে যায়।
কানে এল, ভাত বাড়তে হবে না, সেই কথাই বলতে এলাম।
এক পায়ে খাঁড়া হল জগু।
ক্রুদ্ধ। গলায় বলে উঠল, সেই কথাই বলতে এলাম মানে? খাবি না আজ?
প্ৰবোধ অবহেলার গলায় বলে, আর দরকার কি? এসেই গেছে। যখন সবাই–রান্নাবান্না হচ্ছে বাড়িতে–
জগু আরো ক্রুদ্ধ হয়, দরকার নেই! বলি মায়া-মমতা বলেও কি কোনো বস্তু নেই তো শরীরে পেবো? একটা বুড়ী আশা করে একঘর রোধে রেখেছে, আমি একটা পাগল-ছাগল দাদা আলাদা করে উঠোনে উনুন জ্বলে হাঁসের ডিমের ডালনা, ইলিশ মাছের ঝোল, আর মৌরলার টক বানিয়ে রেখেছি আর তুমি নবাব আলি এসে অমনি হুকুম দিলে, ভাত বাড়বার দরকার নেই, বাড়িতে রান্না হচ্ছে। ধন্যি বটে! লেখাপড়া শিখে এমন বুনো জংলি, হলি কি করে রে পেবো?
শ্যামাসুন্দরীর আর মালাজপা হয় না। শ্যামাসুন্দরী প্ৰবোধের মেজাজ জানেন, অতএব শঙ্কিত শশব্যস্ততায় মালাটি কপালে ছুঁইয়ে রূঢ় গলায় বলে ওঠেন, তা তুই বা ভাল করে সব না। শুনে গেছে। বাঁদরের মতন কথা কইছিস কেন? হঠাৎ ওরা এল কেন, কে কে এল, ঠাকুরঝি হা-ক্লান্ত হয়ে এসে হঠাৎ রান্নাই বা করতে বসলেন কি করে এখুনি, শুধে সে সব?
শুধোতে আমার দায় পড়েছে! জগু বলে, দেখছি না দেমাকে দমদম করছেন বাবু। মা এসেছে আবার কার তোয়াক্কা, কেমন?
প্ৰবোধ বেজার গলায় বলে, শুধু মা কেন, সঙ্গুষ্টির যে যেখানে ছিল, সবাই তো এসেছে। যেন ভাগাড়ের শকুন; একসঙ্গে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল! খবর নেই বার্তা নেই—
এই শোনো উল্টোপাল্টা—, জগু হাত উল্টে বলে, তবে যে পোকা বললো, তুই মেজবৌমাদের আনতে চাপত গেছিস? আবার বলছিস খবর নেই বাত্রা নেই-
আরে বাবা আনতে গেছলাম কে বললে? প্ৰবোধ সাফাইয়ে তৎপর হয়, গিয়েছিলাম খবরাখবর নিতে। তোমাদের মেজবৌমা যে একেবারে কলকাতায় ফিরবো বলে দড়ি-ছেড়া হলো। ফ্যাশানি তো? পাড়াগায়ে আর পোষাচ্ছিল না। আর কি বিবির! ভাবলাম, এতই যখন ইয়ে, তখন চলুক। এসে দেখি-
এসে কী দেখেছে প্ৰবোধ, সে কথায় কান না দিয়ে জগু সন্দিগ্ধ গলায় বলে, মেজবৌমা অন্যায় বায়না নিয়ে দাঁড়ি-ছেড়া হলো? বানিয়ে বানিয়ে বলছিস না তো হতভাগা? তোর তো সে-গুণে ঘাট নেই! নিজেই ছুটিস নি তো আনতে?
প্ৰবোধ অবশ্য নিশ্চিন্ত হয়েই বলেছিল কথাটা। কারণ জানে যে সুবর্ণ কিছু আর ভাসুর বা মামীশাশুড়ীর কাছে এসে প্রকৃত ঘটনা জানাতে যাচ্ছে না, অতএব নিজের মুখটাই রক্ষা হোক! বৌয়ের জন্যে হেদিয়ে মরছিল সে, এ কথাটা উহ্যই থাক।
কিন্তু জগু সেই নিশ্চিন্তির ঘরেই কোপ মারলো। মুশকিল! আবার এখন ভেবে ভেবে কথা বানানো!—শোনো কথা, অকারণ মিছে কথা বলতে যাব কেন? যেতে মাত্ৰই তো কেঁদে পড়লো। বললো, আর এই পচা পুকুরের দেশে পড়ে থাকতে পারছি না। অগত্যাই আমাকে নিয়ে আসতে হল। এসে দেখি, হারেকেষ্ট! নদে থেকে মা, কাটোয়া থেকে সেজবৌমা, ব্যাণ্ডেল থেকে বড়বৌ ছেলে।পুলে সমেত, সব এসে হাজির। তাই ঝালাপালা হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
শ্যামাসুন্দরী সকলের একসঙ্গে আসার খবরে বিস্ময় প্রকাশ করে তারপর বলেন, তা এসেছে এসেছে। আজ আমাদের এখানে রান্নাবান্না হয়েছে। যখন, খেয়ে যাও চার ভাই। নচেৎ মনে বড় কষ্ট হবে। আর ওই আমিষগুলোও নষ্ট হবে। জগা তো খায় না ওসব। তোরা খাবি বলেই দুরকম মাছ এনেছে, হাঁসের ডিম এনেছে—
বলা বাহুল্য সেদিন জগু মুখে ওদের শুধু ডাল চচ্চড়ির নিরাশার বাণী শোনালেও, মামা বাড়ির আদরই করছিল পিসতুতো ভাইদের। নিত্য নতুন।
তবে আজকের পদ দুটো শুনেই হঠাৎ মনটা চঞ্চল হয়ে উঠলো প্ৰবোধের।
সুবৰ্ণ ইলিশ মাছের পরম ভক্ত। হাঁসের ডিমেরও কম নয়। মন ভাল থাকলে তোড়জোড় করে বাড়িসুদ্ধ সকলকে ভোজ খাওয়ানো বাতিক ওর। প্রায়ই সে-ভোজের মূল হচ্ছে খিচুড়ি। এবং অনুমান উপকরণ ওই দুটো জিনিস।
ইলিশ আর হাঁসের ডিম ভাজা।
উমাশশীর জন্যে ডিম হেঁসেলে ওঠে না, সুবৰ্ণই আলাদা উনুন জ্বেলে মহোৎসাহে— তা নিজে ভাল না বাসলে কেউ শুধু পরের জন্যে এত করে?
মনটা উতলা হতে লাগলো, শেষ অবধি এক কৌশল ফেঁদে বসলো প্ৰবোধ।
অমায়িক গলায় বললো, বুঝছি সবই। তবে কিনা মাও তো এতদিন পরে ছেলেরা বলে হামলাচ্ছে। তা তুমি বরং এক কাজ কর মামী, ওই মাছটা, হাঁসের ডিমটা আর তোমার দিকের ব্যানুনের ভাল দু-একটা পদ বাগিয়ে নিয়ে যাবার মতন দুটো বাসন দাও, আমি নিয়ে যাই। মার ভাতের সঙ্গে মামার বাড়ির ব্যঞ্জন! আহা!
নিয়ে যাবি তুই? এখান থেকে বয়ে?
জগু অবাক হয়।
প্ৰবোধ হঠাৎ জগুর কাছে সরে আসে এবং নীচু গলায় ফিসফিস করে কি যেন বলে, সঙ্গে সঙ্গে জণ্ড প্রবলভাবে ওর পিঠে একটা চাপড় দিয়ে হেসে ওঠে। হাসতেই থাকে হা-হা করে।
প্ৰবোধ লজ্জিত হয়, শ্যামাসুন্দরী বিরক্ত। বলেন, পাগলের মতন হাসছিস যে?
জগু আরো উদাত্ত হয়।
আর একবার থাবড়া মারে প্রবোধের পিঠে। বলে, হাসব না? কে বলে ভায়া আমার কাঠখোট্টা? ভেতরে ভেতরে ভায়া—
সুবৰ্ণও প্রথমটা এসে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল বৈকি। এসে যে বাড়ি এমন গুলজার দেখবে সে ধারণা ছিল না। তবে চাঁপাকে দেখে ভাল লাগল। আবার দেখে চোখে জলও এল। কী হাল হয়েছে মেয়েটার! অথচ এরা? বড় জায়ের ছেলেমেয়েরা! মাসির ভাত খেয়ে বলতে নেই দিব্যি হয়ে উঠেছে!
মেয়ের রোগা হয়ে যাওয়ার কথা তোলে না। সুবর্ণ। কে বলতে পারে সে কথায় কত কথা হবে! তোলে রঙের কথা। বলে, কী রং হয়েছে রে তোর চাপা? একেবারে যে কালি-বুলি! গঙ্গার জলে নেয়ে নেয়ে চুলগুলোও তো গেছে!
কথাটা মিথ্যে নয়।
মুক্তকেশী নিজেই পঞ্চাশবার এ আক্ষেপ করেছেন, কিন্তু এখন সহসা চাঁপার মায়ের মুখের আক্ষেপবাণীতে অপমান বোধ করেন। যেন এই রং আর চুলের খর্বতার সঙ্গে মুক্তকেশীর ক্রটির কথা নিহিত আছে।
অথচ অস্বীকার করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, চুলের কথা বাদ দিলেও মেয়েটা শুধু কালোবুলাই হয় নি, রোগা দড়িও হয়ে গেছে। আর সেটা আরো বেশী চোখে পড়ছে উমাশশীর ছেলেমেয়েগুলোর স্বাস্থ্যের লক্ষণীয় উন্নতির পাশে।
মাসির বাড়ি থেকে এত গোলগাল হয়ে আসা কেন! এটা যেন মুক্তকেশীকেই অপমান করা!
অপমানের দাহে জুলতে জুলতে একসময় শোধ নেন। উল্টোপথে নেন।
একটা নাতনীকে ডেকে বলে বসেন, বড়লোক মাসীর বাড়ি গিয়ে খুব আদেখলার মত খেয়েছিলি, কেমন?
নাতিকে বললেন, নজর লাগবে। মেয়েসন্তান নজর লাগে না।
মেয়েটা থিতামত খেয়ে বলে, বাঃ, আমরা বুঝি চেয়ে খেয়েছি?
চেয়ে খেয়েছিস কি মেগে খেয়েছিস তা জানি নে, তবে খেয়েছিস তা মালুম হচ্ছে। তা হঠাৎ চলে এলি যে? আরো থাকলেই পারতিস? ইস্কুল-মিস্কুল তো খোলে নি ভাইদের!
ভাইদেরই! কারণ ওদের ইস্কুলের বালাই নেই! মেয়েমানুষের পড়ার ওপর দস্তুরমত খাপ্পা মুক্তকেশী। মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বাঁচাল, আর ম্লেচ্ছ ভাষা শিখলে বিধবা হয়, এটা যে অবধারিত, তা তার জানা আছে। কাজেই ওদের পড়ার বালাই নেই।
তবু চাঁপাকে সুবৰ্ণ জবরদস্তি করে বাড়িতেই নিজে পড়ায়, কিন্তু চাপা আর এ পর্যন্ত কথামালা ছাড়িয়ে বোধোদয়ে উঠল না। বরং চন্ননটা দাদাদিদির বই টেনে টেনে নিজেই দিব্যি পড়তে শিখে গেছে। সেজমেয়ে পারুলটাও দুলে দুলে পড়া মুখস্থর ভান করে। কাকারা ওদের ঘরের দৃশ্য দেখতে পেলে বলে, মেজগিনীর পাঠশালা!
কিন্তু সে যাক, উমাশশীর মেয়ে মোটা হওয়ার অপরাধে ধিক্কার খেয়ে অপ্রতিভ গলায় বলে, নাই বা ইস্কুল খুললো! কুটুমবাড়িতে কত দিন থাকা হবে?
থাকলেই বা! বড়মানুষ কুটুমবাড়ি! তোর মা তো বোনের সংসারের গপূপো করতে দিশেহারা হচ্ছে।
হঠাৎ মেয়েটা অবিশ্বাস্য দুঃসাহসে বলে ওঠে, হবে না কেন? তোমার মতন তো ওখানে কেউ রাতদিন খিটখিট করে না!
মুক্তকেশী স্তম্ভিত হয়ে যান।
মুক্তকেশী যেন আপন ভবিষ্যতের অন্ধকার ছবি দেখতে পান। মানবে না, আর কেউ মানবে না, মনে হচ্ছে মান-সম্মানের দিন শেষ হয়ে এল! একজন চোপা করলেই সবাই সাহস পাবে।
এইটি করলো মেজবৌমা।
দুঃসাহস ঢোকালো সবাইয়ের মধ্যে!
মেজবৌমাই দেখালো গুরুজনের মুখে মুখে কথা কয়েও পার পাওয়া যায়।
মুক্তকেশীর তবে গতি কি?
মাসতুতো বোন হেমের মতন পাশ-ঠেলা বুড়ী হয়ে পড়ে থাকবেন?
হেমের দুর্দশা তো নিজের চক্ষে দেখে আসছেন। তার তো ওই একটা বৌ থেকেই শনি ঢুকলো!
কিন্তু মুক্তকেশী কি এখনই হার মানবেন?
মুক্তকেশী আর একবার শক্ত হাতে হাল ধরবার চেষ্টা করবেন না?
করেন।
অতএব সেই মেজবৌমাকেই নিয়ে পড়েন।
বলি মেজবৌমা, পোবা নয়। বেটাছেলে এত কথা জানে না। তুমি কি বলে চলে এলে? তুমি জানো না আটে-কাঠে চড়তে নেই? এটা তোমার আট মাস পড়েছে না?
সুবৰ্ণ এতক্ষণ বড় এবং সেজ জায়েদের সঙ্গে নিজ নিজ অভিজ্ঞতার গল্প করছিল এবং বলতে কি মনটা একটু ভালই ছিল। চাপা নেটিপেটি হয়ে গায়ের কাছে বসে ছিল আর ঠাকুমার গুরুবাড়ি সম্পর্কেও ভাল-মন্দ গল্প তুলে হাসছিল। মোট কথা, একা বাড়িতে এসে পড়ার থেকে, ওই জনারণ্য তার পক্ষে ভালই হয়েছিল যেন।
কিন্তু শাশুড়ীর এই গায়ে পড়ে অপদস্থ করায় চাপা-পড়া আগুন জ্বলে উঠল। কঠিন গলায় বলে উঠল সে, জািনব না কেন মা? তবে সেই আদিখ্যেতা করতে গিয়ে কুটুমবাড়িতে দাঁড়িয়ে জুতো খাব?
জুতো!
মুক্তকেশী বলে ওঠেন, তুমি খাবে জুতো? গলবস্ত্ৰ জোড়হস্ত সোয়ামীকেই তো ফি হাত জুতো মেরে তবে কথা কইছ মেজবৌমা? তাকে বলতে পারলে না, এখন যাওয়া চলবে না? সুবলাও তো বুড়োমাগী, সে জানে না?
সুবৰ্ণ তীব্ৰস্বরে বলে, সবাই সব জানে মা, শুধু আপনি আপনার ছেলেকে জানেন না। তবে আটে-কাঠে চড়ে যদি কিছু বিপদ ঘটে তো বুঝবো সেটা আমার পুণ্যফল।
পুণ্যফল! বিপদ ঘটলে তোমার পুণ্যফল? মুক্তকেশী যেন অসহ্য ক্ৰোধে এলিয়ে পড়েন। মেজবৌমা, তুমি না মা?
মা বলেই তো বলছি মা। সুবর্ণ এবার খুব শান্ত গলায় বলে, তবু তো পৃথিবীতে একটা হতভাগাও কমবে!
হতভাগ! মুক্তকেশী এবার স্বক্ষেত্রে আসেন। বলেন, তা বটে! তোমার মত মায়ের গর্ভে যে জন্মাতে এসেছে, তাকে হতভাগাই বলতে হবে!
তা সেই কথাই তো আমিও বলছি মা! কেনা বাদীর পেটের সন্তান হতভাগা ছাড়া আর কি?
চলে যায় সেখান থেকে।
আর গল্পের আসরে গিয়ে যোগ দেয় না, চলে যায় নিজের ঘরে। আর দড়ি বাধা-বাধা সেই পুরনো পত্রিকাগুলো টেনে নিয়ে বাধন খোলে।
হঠাৎ চোখে পড়ে একটা পত্রিকার খাঁজে ভাঁজ করা রয়েছে সেই কবিতার পৃষ্ঠা দুটো! তার সঙ্গে আলাদা একটা টুকরো! যেটুকু হারিয়ে গিয়েছিল। খুঁজে বার করে সঙ্গে দিয়েছে।
সুবৰ্ণর অজ্ঞাতসারে সুবর্ণর চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়ে।
সুবৰ্ণর জন্যেও পৃথিবীতে শ্রদ্ধা আছে, সম্মান আছে, প্রীতি আছে। নির্মল ভালবাসার স্পর্শ আছে। তবে পৃথিবীর উপর একেবারে বিশ্বাস হারাবে কেন সুবৰ্ণ? কেন একেবারে হতাশ হবে? সুবৰ্ণর গর্ভজাত সন্তানদের কি মানুষের পরিচয় দিতে পারবে না। সুবৰ্ণ? যে মানুষ পৃথিবীর উপর
কিন্তু সে কি এই পরিবেশে সম্ভব?
জলের ফোঁটাগুলো গড়িয়ে পড়ে আবার শুকিয়ে যায়, বইগুলো ওল্টাতে থাকে সুবর্ণ।
টের পায় না। তখন— ওর জায়েরা ভাঙা গল্প জোড়া দিয়ে আবার জমিয়ে বসে হেসে হেসে বলছে, ওর পেটের সন্তান হতভাগা? বাবা, ভাগ্যবন্ত তা হলে কে? বলে ওঁর ছেলেমেয়ের আদর দেখিলে-
যত্নকেই আদর বলে ওরা।
ঘরে ঢুকলো প্ৰবোধ।
চোরের মত চুপি চুপি।
কোঁচার খুঁটে কি যেন একটা চাপা দিয়ে।
এ-ঘরটা বাড়ির একটেরে, সুবর্ণর সেই গৃহপ্ৰবেশের দিনের আহত অভিমানের ফলশ্রুতি। সেইটাই কায়েম হয়ে গেছে। প্ৰবোধ অবশ্য বরাবরই আক্ষেপ জানিয়ে আসছে ওঁচা ঘর নিয়ে। তবে সুবর্ণ বলে, এই ভাল! এ ঘরে যে সহজে কেউ ঢুকতে আসে না, সেই আমার পরম লাভ!
তা কেউ ঢুকতে আসে না জেনেও প্ৰবোধ আস্তে দরজাটা আধভেজানো করে ফিসফিস করে বলে, এই শোনো, চাটু করে এটুকু সেরে ফেল দিকি।
সুবৰ্ণ এই অভিনব ধরন-ধারণে অবাক হয়। এবং সেই জন্যই বোধ করি পুঞ্জীভূত অভিমান দমন করেও কথা বলে।
বলে, কি সেরে ফেলবো?
আরে এসো না। এই জানলার ধারে। চাটু করে মুখে পুরে ফেল।
কোঁচার তলা থেকে বার করে ছেঁড়া খবরের কাগজ আর শালপাতায় মোড়া তরকারির ঝোলমাখা একটা চেণ্টে যাওয়া হাঁসের ডিম, আর একখানা ভেঙে টুকরো হওয়া ইলিশ মাছ!
সুবৰ্ণ রাগ করতে ভুলে যায়।
সুবৰ্ণ স্তম্ভিত গলায় বলে, এর মানে?
আরে বাবা, মানে পরে শুনো, করবো গল্প। আগে খেয়ে তো নাও। ছেলে।পুলে কে হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়বে। জিনিস দুটো তোমার প্রিয় বলেই অনেক কৌশলে সরিয়ে নিয়ে এলাম।
আমার প্ৰিয় বলে! আমার প্ৰিয়া!
সুবৰ্ণ সেই হাসির মধ্যে থেকে যেন স্বপ্নাচ্ছিনের গলায় বলে, কে বললো জিনিস দুটো আমার প্রিয়?
কে বললে?
তা রহস্যের হাসি প্ৰবোধের মুখেও ফুটে ওঠে। সেও বেশ একটু কৌতুকের গলায় বলে, না বললে বোঝা যায় না? আমিই না হয় তোমার দু-চক্ষের বিষ, তুমি তো আমার— ধর ধর, গোল আমার কোঁচা ফেচা! তোলে বোলে একসা!
সুবৰ্ণ কিন্তু স্বামীর এই বিব্রত ভাবকে উপেক্ষা করেই বসে থাকে, এবং স্থির গলায় বলে, কিন্তু বাহাদুরি নেওয়াটা আর হল না তোমার! দুটোর একটাও খাই না। আমি।
খাও না তুমি! দুটোর একটাও? প্ৰবোধের গলায় ক্রুদ্ধ অবিশ্বাসের সুর ফুটে ওঠে।
বাস্তবিকই অনেক কসরত করে আনতে হয়েছে তাকে অকিঞ্চিৎকর জিনিস দুটো। এনেছে নেহাতই প্ৰাণের টানে। সাধ জেগেছিল, এনেই সুবর্ণর মুখে পুরে দিয়ে হাসোহাসি করে পূর্ব অপরাধের পাযাণভারটাকে সরিয়ে ফেলবে। কিন্তু মেয়েমানুষটি নিজেই যেন কাঠ-পাথর। এগিয়ে এলো না, দেখলো না, আবার মিছে করে বলছে খাই না!… আর কিছু নয়, পোষা রাগা! আচমকা নিয়ে চলে আসার রাগটি পুযে রেখেছেন! তাই স্বামীর এই বেপোট অবস্থা দেখেও মমতা নেই একটু।
তাই তারও গলায় ভালবাসার সুর মুছে গিয়ে ক্রুদ্ধ সুর ফোটে।
খাও না? ডাহা একটা মিথ্যে কথা বললে?
সুবৰ্ণ খুব শান্ত গলায় বলে, মিথ্যে কথা বলতে যাব কেন শুধু শুধু? আর মিথ্যে কথা বলা আমার স্বভাব কি না ভালই জানো তুমি। ইলিশ মাছে আমার কাটার ভয় সেকথা বাড়ির সবাই জানে।
ওঃ, সবাই জানে! শুধু আমি শালা–তা এটাতে তো আর কাটা নেই, এটা কি দোষ করলো?
ওতে আমার কেমন গন্ধ লাগে। তাছাড়া— যে জিনিস রান্নাঘরে ঢোকে না, তা খেতে আমার রুচি হয় না।
তথাপি প্ৰবোধের এসব কথা বিশ্বাস হয় না। নিত্য এসব এত উৎসাহ করে আনায় সুবৰ্ণ অমনি নাকি?
বলেও বসে সেকথা।
রুচি নেই বললেই হল! বাঙালিকে আর হাইকোর্ট দেখিও না মেজবৌ! বারো মাস এত আহ্লাদ করে আনোচ্ছ, রাধছ, আর নিজে খাও না! তা তো নয়, আমার আনা জিনিস খাবে না–তাই বল।
সুবৰ্ণ ওর অভিমানক্রুদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে।
সুবর্ণ ওর স্বামীর অভিমানের কারণটার দিকে তাকিয়ে দেখে। চেপ্টে যাওয়ার আর ভেঙে যাওয়া খাদ্যবস্তু দুটো যেন সুবর্ণর দিকে ব্যঙ্গদৃষ্টিতে তাকায়।
তবু সুবৰ্ণ নরম গলায় বলে, ওকথা বলছে কেন? তোমার আনা জিনিস খাব না! এমন অহঙ্কারের কথা বলবোই বা কি করে? আমিতো পাগল নই! সত্যিই আমি ওসব খাই না। ইচ্ছে হয় তা জিজ্ঞেস করে দেখো দিদিকে।
এবার হয়তো বিশ্বাস হয় প্ৰবোধের।
আর হয়তো এই আশাভঙ্গেই হঠাৎ তার চোখে জল এসে যায়। নিজেকে ভারী অপমানিত লাগে। অতএব আক্রোশটা গিয়ে পড়ে হাতের জিনিস দুটোর ওপর।
চুলোয় যাক তবে! ফেলে দি গে। রাস্তায়!— বলে দ্রুত পদে চলে যায় ঘর থেকে।
বইয়ের পাতা ওল্টাতেও ইচ্ছে হয় না আর।
বইপত্তরগুলো সাবধানে চৌকির তলায় ঠেলে দিয়ে, হাঁটুর ওপর মুখ রেখে বসে থাকে সুবর্ণ। আর মনে মনে তার বিধাতাকে প্রশ্ন করে, আমার দাম কাষতে একটা কানাকড়ি ছাড়া কি আর কিছুই জোটে নি তোমার ঠাকুর?