অনেকগুলো বছর জেলের ভাত খেয়ে অবশেষে একদিন বাড়ি ফিরল অম্বিকা। কালো রংটা আরও একটু কালো হয়ে গেছে, পাকসিটে চেহারাটা যেন আরো পাকসিটে আর জীর্ণ হয়ে গেছে, চুলের গোড়ায় গোড়ায় বিবৰ্ণ সাদাটে ছাপ। যেন পাকতে শুরু করে নি বটে, কিন্তু একসঙ্গে সবই পাকবে বলে নোটিশ দিয়েছে।
তবু মোটামুটি যেন তেমন কিছু বদল হয় নি। মনে করা যায় এতগুলো বছর পরে সেই অম্বিকাই ফিরে এল।
ফিরে এল অধিকা তার দাদা-বৌদির কাছে। বলতে গেলে সুবালার সুবালার কাছেই।
সুবালার চেহারায় অবশ্য অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সুবালার চুলগুলো বেশ পেকেছে, ঠিক সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেছে, আর রংটা জ্বলে-পুড়ে গেছে। দারিদ্র্যকে যে কেন অনলের সঙ্গে তুলনা করা হয় সেটা অনুভব করা যাচ্ছে তাকে দেখে।
তথাপি সুবালার প্রকৃতিতে খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। সুবালা অম্বিকাকে দেখেই প্রথমে আহ্লাদে কেঁদে ফেললো। তারপর সুবালা শাশুড়ীর নাম করে কান্দলো, কান্দলো অম্বিকার বাড়িতে চোর পড়ে যথাসর্বস্ব নিয়ে গেছে বলে, আর অভাবের জ্বালায় যে সেই চোর-আধুষিত বাড়িটার ভাঙা পাঁচিল আর ভাঙা জানালা মেরামত করে রাখতে পারে নি। সুবালারা, তা নিয়ে কান্দলো এবং সর্বশেষে কান্দলো অম্বিকাকে আর বিপদের পথে পা না বাড়াতে মাথার দিবি দিয়ে।
শেষ কথাটার শেষে অম্বিকা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, আর বিপদ কোথা? দেশ তো বেশ ঠাণ্ডা মেরে গেছে। বিপদ যারা বাধাচ্ছিল তাদের শায়েস্তা করা হয়েছে, এখন দেশের কেষ্ট-বিষ্ট নেতারা কথার জাল ফেলে ফেলে স্বাধীনতারূপ বোয়াল মাছটি টেনে তোলবার তাল করছেন। এর মধ্যে আর আমরা কোথায় পা বাড়াতে যাব? আমরা এখন দাবার আড্ডায় বসে ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, প্ৰফুল্ল চাকি, বাঘা যতীনের আলোচনায় উদ্দীপ্ত হবো। আর বসে বসে দিন গুনবো কবে কখন সেই স্বাধীনতা নামের রসালো ফলটি গাছ থেকে টপ করে খসে পড়ে।
তা অম্বিকার যে একেবারেই পরিবর্তন হয় নি তা বলা যায় না। আগে অম্বিকা ব্যঙ্গের সুরে কথা জানত না, এখন সেটা শিখেছে।
কিন্তু সুবালা এসব প্রসঙ্গের ধারে-কাছে আসতে চায় না, কারণ সুবালা অত বোঝে না। হয়তো বা বুঝতে চায়ও না।
তাই সুবালা তাড়াতাড়ি বলে, যাক গে বাবা ওসব কথা। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে দরকার কি? আমার কথা হচ্ছে – এবার তোমার বিয়ে দেব!
হ্যাঁ, এই সঙ্কল্পই স্থির করেছে এখন সুবালা, ওই বাউণ্ডুলে ছেলেটার বিয়ে দেবে। বয়েস একটু বেশি হয়ে গেছে, তা যাক, দোজবরে তেজবরে তো নয়? কত কত দোজবরে তেজবরে যে ওর ডবলবয়সী হয়েও বিয়ে করতে ছোটে!
মেয়ের অভাব হবে না।
বাংলা দেশে আর যে কিছুরই অভাব থাক না কেন, কনের অভাব নেই। আর সুবালার মতে বিয়ে না করে বুড়িয়ে যাওয়ার মত দুঃখের আর কিছু নেই।
সুবালা ইতিমধ্যে তার দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে কাজ সেরেছে। যদিও সংসারের অবস্থা সুবিধেয় নয়, কিন্তু সংসারের অবস্থা বিয়ের প্রতিকূল হয়েছে কেন এ তর্ক করেছে সুবালা। আর শেষ অবধি তর্কে সে-ই জিতেছে। তাই এখনও বললো, বিয়ে দেব। জানে-জিতবো।
কিন্তু অম্বিকা ছিটকে উঠলো, বললো, বিয়ে? অম্বিকা হেসে ফেলল। কিন্তু আগের মত সেই হো হো হাসির প্রাণখোলা সুরাটা যেন অনুপস্থিত রইল সে হাসিতে। এ হাসি কেমন একরকম নিরুত্তাপ হাসি।
তবু হাসি।
হেসেই উত্তর।
বিয়ে! নাঃ, আপনি দেখছি চুলগুলো মিছিমিছিই পাকিয়েছেন, বিয়েসে সামনে না হেঁটে পিছনে হাঁটছেন!
সুবালা অবাক হয়ে বলে, তার মানে?
অমূল্য এতক্ষণ মিটমিটি হাসছিল বসে বসে। এবার বলে, মানে আর কি, অম্বিকার মতে তোমার শুধু চুলই পেকেছে, বুদ্ধি পাকে নি।
কেন? কাঁচা বুদ্ধির কি দেখলে শুনি?
অম্বিকা হাসে, পুরোপুরিই দেখলাম। এখনো আপনার দ্যাওরের বিয়ে দেওয়ার শখ!
হ্যাঁ, এই রকম করেই বলে অম্বিকা।
হৈ-হৈ করে বলে ওঠে না, কাঁচা বুদ্ধি নয়? শুধু বিয়ের মতলবটি এঁটেই বসে আছেন, কই কনে রেডি করে রাখেন নি? টোপ চেলি ঠিক করে রাখেন নি? কে বলতে পারে আবার কখন শ্ৰীঘর থেকে ডাক পড়ে?
আগেকার অম্বিকা হলে এই রকমই বলতো!
এখনকার অম্বিকা বলে, এখনো আপনার দ্যাওরের বিয়ে দেওয়ার শখ?
সুবালা ভাঙা দাঁতের হাস্যকর হাসি হেসে বলে, তা কখন আর শখ করবার সুবিধা পেলাম শুনি? তুমি তো বসে আছ শ্ৰীঘরে, এদিকে কত ঘটনাই ঘটে গেল, ঘটে চলেছে। তোমার চার-চারটে ভাইপো-ভাইঝির তো বিয়ে হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে!
চার-চারটে ভাইপো-ভাইঝি!
অম্বিকা অর্থই জলে পড়ে।
এতগুলো ছেলেমেয়ে বিয়ের যোগ্য হয়েছিল অমূল্যর? তাছাড়া বিয়ের যোগ্যতা! ওর মধ্যে কোনটা মেয়ে, কোনটা বা ছেলে! হঠাৎ কারো নাম মনে পড়ছে না কেন? বড় বড় ছেলে দুটোর নাম রাসু ঘু বন্ধ ছিল না; রাসবিহার, বন্ধুবিহার, কিন্তু, তারপর? সারি সারি অনেকগুলো ছিল যে?
আশ্চর্য!
এমন স্মৃতিভ্ৰংশ হল অম্বিকার?
দাদার ছেলেমেয়েগুলোর নাম ভুলে গেল? ভুলে গেল কোনটা কত বয়সের ছিল? মুখই বা মনে পড়ছে। কই তেমন করে?
পড়ছে আস্তে আস্তে।
নামও… ভাবতে ভাবতে ভেসে উঠেছে, রাসু, বন্ধু, টিন্ধু, কুলু, নেড়ু টেপু… আরো কি কি যেন! একটা দল হিসেবেই তাদের দেখেছে। অম্বিকা, খুব যেন আলাদা করে নয়।
দাদার ছেলেমেয়েরা!
এই অনুভবের মধ্যে ছিল তারা!
কিন্তু সেই বালখিল্যের দল এত লায়েক হয়ে উঠল এর মধ্যে?
তার মানে সময়ের সেই বিরাট অংশটা হারিয়ে ফেলেছে। অম্বিকা তার জীবন থেকে। অম্বিকা বুড়ো হয়ে গেছে!
কিন্তু জীবনের ওপর কবে মোহ ছিল অম্বিকার? কবে ছিল লোভ? তাই হারিয়ে ফেলেছে বলে মনটা হায় হায় করে উঠল?
হয়তো এমনিই হয়। শুধু অম্বিকার মত পাগলাদের নয়, সকলেরই!
যে মায়া-হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মানুষ, সেই হরিণটা যখন একটা দুয়ো দিয়ে দিগন্তের ধূসরতায় মিলিয়ে যায়, তখন মনটা এমনি হায় হায় করে ওঠে। মনে হয় এতগুলো দিন-রাত্ৰি হারিয়ে গেল! কি করলাম? কি বা পেলাম?
হ্যাঁ, সেটাই হাহাকারের স্বর।
কী পেলাম! কী পেলাম!
যেন কে কোথায় অঙ্গীকার করে রেখেছিল পাইয়ে দেবে অনেক কিছু।
যেন বলে রেখেছিল, তোমার ওই দিনরাত্রিগুলো আমার কারবারে ফেল, তার বিনিময়ে পাওনার পাহাড় জমবে তোমার।
কেউ দিয়েছিল। সেই আশ্বাস?
কেউ করেছিল সেই অঙ্গীকার?
একখানা মূল্য নির্ধারণ করে রেখেছিল, আমার এই দিনরাবিতে গড়া জীবনের?
জানি না।
দেখি নি তেমন কাউকে।
তবু ওই প্ৰাপ্তির ধারণাটা আছে। বদ্ধমূল। নিশ্চিন্ত হয়ে আছি। এই ভেবে যে আমার সোনার দিনগুলো বিকোচ্ছি বসে বসে, তার বদলে জমা হচ্ছে স্বর্গের সোনা। খানিকটা এগিয়ে গেলেই সেই স্বর্গীয় সোনার তালটাকে ধরে নেব খপ করে, ভরে নেব মুঠোর মধ্যে।
কিন্তু সে সোনার আশ্বাস মায়া-হরিণের মতোই অনেক ছুটিয়ে মেরে অকস্মাৎ কখন একসময় দিগন্তের ধূসরতায় মিলিয়ে যায়, তখন ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাস মর্মরিত হয়ে ওঠে, পেলাম না, আমি আমার যথার্থ মূল্য পেলাম না। আমি ঠিকে গেলাম। আমি কত দিলাম, কী বা পেলাম! যেন আমার মনিব আমায় সারা মাস খাঁটিয়ে নিয়ে মাসের শেষে মাইনে দিল না!
আশ্চর্য!
কে বলেছে আমার এই জীবনটা ভারী এক দামী জিনিস? কে বলেছে আমার এই দিনরাত্রিগুলো সোনার দরের?
নিজেই নিজের দাম কষছি, মোটা অঙ্কের টিকিট মারছি তার গায়ে, ভেবে দেখছি না কেন তা করছি! করছি হায় হায়! ভেবে দেখছি না। আমি কেউ না, আমি এই নিখিল বিশ্বের অন্যাহত লীলার একটা অবিচ্ছিন্ন অংশ মাত্র। বাড়তি কিছু পাওনা নেই আমার।
কেউ ভাবি না, কেউ ভাবে না।
অম্বিকাও তা ভাবল না।
অম্বিকা ভাবলো, এতগুলো দিন হারিয়ে ফেললাম! ভাবলো, কী বা পেলাম তার বিনিময়ে?
তাই কেমন যেন দিশেহারার মত বলে উঠলো, কাদের বিয়ে হয়ে গেল?
কেন রাসু, বন্ধু, টেঁপি আর নিভার। নিভাটার অবিশ্যি একটু সকাল সকালই হয়ে গেল, ভাল পাত্তর পেয়ে যাওয়া গেল। আর দিতেই তো হবে। চারটের হিল্লেী হয়েছে, বাকি ছটার হয়ে গেলেই আমাদের ছুটি। তারপর বুড়োবুড়ী কাশীবাস করবো।
বাকি ছটার হয়ে গেলেই–
অম্বিকা ওই দুঃসাহসী আশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে। তারপর ভাবে, হয়তো সেই অসাধ্যসাধন করেই ফেলবে ওরা, হয়তো সত্যিই শেষ অবধি নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তীর্থবাস করতেও যাবে। আর সমস্ত কর্তব্য সমাধা করার যে একটা আত্মতৃপ্তি, সেটুকু রসিয়ে উপভোগ করবে।
অম্বিকা অন্তত তাই ভাবলো।
তাই অম্বিকা সহসা ওদের জীবনটাকে হিংসে করে বসলো।
অনেকদিন জেলের ভাত খেয়ে খেয়ে এ উন্নতিটুকু তা হলে হয়েছে অম্বিকার! অম্বিকা তার স্বপ্ন থেকে শ্বলিত হয়ে তুচ্ছ জীবনের দিকে তৃষ্ণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
অম্বিকা তাই কাঁচা-বুদ্ধি সুবালার কাঁচামি-টাকেই দীর্ঘ বিলম্বিত করে দেখতে চাইছে।
অতএব অম্বিকা বলে উঠেছে, আরো ব্যস, সব ব্যবস্থা কমপ্লিট? তা আমিও তো তাহলে দিব্যি একখানি শ্বশুর হয়ে বসে আছি! আমাকে নিয়ে তবে আবার ডাংগুলি খেলবার বাসনা কেন?
সুবালা এ পরিহাসটুকুর অর্থ বোঝে।
সুবালা তাই হেসে উঠে বলে, তুমি যাতে আর ডাংগুলি খেলে বেড়াতে না পারো তার জন্যে। শক্ত শেকল এনে বাঁধতে হবে তোমায়। করছি তার যোগাড়।
কেন, আমার অপরাধ?
এই তো অপরাধ। জীবনটা মিছিমিছি বিকিয়ে দিলে।
অম্বিকা সুবালার এই আক্ষেপে অবোধ বলে অনুকম্পার হাসি হাসল না। অম্বিকা চমকে উঠল। অম্বিকা ভাবলো, আমি কি এই কথাই ভাবছিলাম না।
তারপর অম্বিকা বললে, আপনি তো শেকল যোগাড়ে লাগবেন, বলি শেকল তো আর ভুইফোঁড় নয়? মা-বাপ থাকতে আর কে এই জেলখাটা আসামীকে মেয়ে দেবে শুনি?
শোনো কথা! সুবালা গালে হাত দেয়। এ কী চুরি-জোচ্চারি খুন-জখমের আসামী? লোকে যে তোমাদের এই স্বদেশী জেলখাটাদের পায়ে ফুলচন্নন দেয় গো!
অম্বিকা এবার যেন পুরনো ধরনে হেসে ওঠে। বলে, পায়ে ফুলচন্নন দেয় বলেই যে হাতে মেয়ে দেবে, তার কোনো মানে নেই!
দেবে না?
সুবালাই এবার অনুকম্পার হাসি হাসে, সুবালা যেন তার মূল্যবান দ্যাওরটির মূল্য সম্পর্কে আরো বেশি অবহিত হয়। বলে, আচ্ছা, দেয় কি না দেয় সে আমি বুঝবো! ব্যাটাছেলে বিয়ে করতে চাইলে আবার মেয়ের ভাবনা?
এবার অম্বিকা অমূল্য দুজনেই হেসে ওঠে। অমূল্য বলে, আহা, এ আশ্বাস যদি কিছুদিন আগে পেতাম তো আর একবার চেয়ে। দেখতাম।
এখনও দেখ না। সুবালা হাসে। তারপর গ্রামের কোন কোন ঘরে এমন কটা বুড়ো ঘরে গিন্নী থাকতেও দিবিব আর একটা বিয়ে করে মজায় আছে, তার আলোচনা এসে পড়ে।
অম্বিকা নিথর হয়ে গিয়ে বলে, বল কি দাদা? দত্ত জ্যাঠামশাই?
অমূল্য হাসে, সেই তো, সেটাই হচ্ছে সব চেয়ে অসহ্য। গিয়েছিলেন ভগ্নীর ছেলের জন্যে কিনে দেখতে-
দেখে আর চোখ ফেরাতে পারলেন না, নাতির হাতে তুলে দিতে বুক ফাটলো—, সুবালা হেসে হেসে বলে, সম্পর্কটা অবিশ্যি খারাপ হল না। নাতবৌ হতো, বৌ হলো। তেরো আর তেষট্টি!
অম্বিকা হাসে না, অম্বিকা হঠাৎ রূঢ় গলায় বলে ওঠে, লোকটাকে ধরে এক দিন হাটতলায় দাঁড় করিয়ে চাবাঁকাতে পারলে না কেউ?
এরা চমকে উঠলো।
সুবালা আর অমূল্য।
অম্বিকার গলায় কখনো এমন রূঢ় স্বর শোনে নি এর আগে। তা যতই হোক, দত্ত জ্যাঠামশাই গুরুজন!
অম্বিকা সেটা বুঝতে পারলো।
অম্বিকা নিজেকে সামলে নিল, অপ্ৰতিভ গলায় বললো, জেলের ভাতের এই গুণ ধরেছে, রাগ চাপতে পারি না। অসভ্যতা দেখলেই মেজাজ আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। বাস্তবিক, এদের শাস্তি দেওয়া উচিত। কিনা তোমরাই বল?
উচিত তো! কিন্তু শাস্তিটা দিচ্ছে কে?
আমি তুমি, এরা ওরা, সবাই। অম্বিকা দৃঢ় গলায় বলে, কিছুদিন স্রেফ ধোলাই চালালেই এ ধরনের পাজীরা শায়েস্তা হয়ে যাবে।
সুবালা যেন অবাক হয়ে অম্বিকার মুখের দিকে তাকায়। বলে, ধোলাই মানে?
অম্বিকা আর একবার অপ্রতিভ হয়। বলে, ওই তো! সঙ্গগুণের সুফল! যত–সব চাষাড়ে কথার চাষের মধ্যে তো বাস ছিল। ধোলাই মানে ধরে ঠ্যাঙানো! দু-পাঁচজন মার-ধোর খাচ্ছে দেখলেই আর পাঁচজন সামলে যাবে।
অমূল্য ক্ষুব্ধ হাসি হাসে, তোর ওই ধোলাই তা হলে পাত্তরকে না দিয়ে পাত্রীর ব্যাপকেই দেওয়া উচিত। তারা মেয়ে দেয় কেন?
সুবালা বলে ওঠে, দেয়, ভাল ঘরে-বরে দিয়ে উঠতে পারে না বলে, নচেৎ টাকাকড়ির লোভে। এই তো তোমাদের দত্ত জ্যাঠামশাইয়ের ব্যাপারই তাই। মেয়ের বয়েস বেশি হয়ে গেছে, জাত যাবার ভয়ে কাতর বাপ হাতের সামনে একটা বড়লোক বুড়ো পেয়ে—
জাত! জাত যাবার ভয়! আশ্চর্য, এত অনাচারে জাত যাচ্ছে না, জাত যাবে শুধু মেয়েকে সাতসকালে বিয়ে না দিলে! অম্বিকা বলে, এ পাপের ফল একদিন পাবেই সমাজ!—তা দত্তজেঠিমা কোথায়?
কোথায় আবার? সুবালা বলে, ঘর-সংসার ছেড়ে যাবেন কোথায়? আছেন। প্রথম প্রথম খুব গালমন্দ করেছিলেন, সতীনটাকে বাটা মারতে যেতেন, ক্রমশঃ সয়ে গেছে। এখন তাকে রেঁধে ভাতও দিচ্ছেন। সেও মহা দুষ্ট মেয়ে! সংসারে কিছু করে না, কেবল সাজেগোজে আর কর্তার তামাক সাজে।
হুঁ। ওটাকেই আশ্রয় ভেবেছে। বুড়ো মরলে তখন? ছেলেরা কে কোথায়?
বড় তো রাগ করে বাপের সঙ্গে পৃথক অন্ন হয়ে গেছে। আর সবাই আছে।
তা যিনি পৃথক অন্ন হলেন, মাকে ভাইদের নিয়ে হতে পারলেন না?
কি যে বল, তার কি ক্ষমতা? বাপ তো তাকে তেজ্যপুত্তুর করেছেন। আসল কথা, সুপ্রিয়ালা লোকেদের সব দরজা খোলা, বুঝলে ঠাকুরপো মরণ শুধু গরীবদের। পৃথিবী জুড়েই এই।
অম্বিকা বলে, হয়তো এর শাস্তিও আসবে একদিন পৃথিবীতে। তবে আমার মতে, কবে কি হবে মুক্তিত্ব এখনই একটা বৌ বেঁচে থাকতে আর একটা বিয়ে করা আইন করে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
অমূল্য হাসে, আইনটা কে করবে শুনি?
করবো। আমরা, তোমরা, সবাই। চিরদিন ধরে ভয়ঙ্কর একটা পাপ চলতে পারে না।
সুবালার এসব কথায় অস্বস্তি।
সুবালা এবার প্রসঙ্গকে অন্য পথে পরিচালিত করে। সুবালা তার ছেলের বৌদের আর জামাইদের কথা তোলে, তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, বলে, আমার ভাগ্যে বাবা সবাই খুব ভালো জুটেছে—
অম্বিকা হেসে ফেলে।
অম্বিকা বলে, আপনার ভাগ্যে মন্দ হবার জো কি? আপনি কি কাউকে ভালো ছাড়া মন্দ দেখবেন?
সুবালা লজ্জিত গলায় বলে, আহা! বলে, নাও বাপু, বল এখন কি খাবে? কতকাল বাড়ির রান্না খাও নি—
বলে, তবে মনে মনে ভাবে, কিই বা জোটাতে পারবো! আহা, বেচারা এতদিন পরে এল। সজনেডাঁটাটা ভালবাসে, মৌরলা মাছটাও খুব ভালবাসতো। আর আড়র ডাল। দেখি যাই—
সুবালা চলে যায় রান্নার যোগাড়ে, এরা দুই ভাই কথা বলে, গ্রামের কথা, পড়াশীর কথা।
আর এর মাঝখানেই হঠাৎ একসময় প্রশ্ন করে ওঠে অম্বিকা, তোমার শ্বশুরবাড়ির খবর কি?
আমার শ্বশুরবাড়ির!
হ্যাঁ, তোমার সেই—— ইয়ে, মেজবোঁদি, তার ছেলেমেয়েরা— আর শ্ৰীযুক্ত বাবু মেজদা?
একটু ভয়ে-ভয়েই বলে।
মনকে প্রস্তুত করে দু-একটা দুঃসংবাদ শোনবার জন্যে।
কিন্তু আশ্চর্য, শুনতে হলো না তা।
বরং ভালো খবর।
মেজদার আয়ের আরো উন্নতি হয়েছে, ছেলেরা ভ্ল ভাল পাস করেছে, নতুন বাড়ি করেছে নিজস্ব, আলাদা হয়ে চলে গেছে। মোটের মাথায় হতাশার খবর নয়।
অথচ আশ্চৰ্য, অম্বিকা যেন খুব একটা হতাশ হয়।
অম্বিকা যেন এসব খবর শোনবার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু কী শোনবার আশাতেই বা ছিল। তবে সে? অমূল্যর শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে খুব একটা দুঃসংবাদ? কে জানে কি! তার মনের কথা সে-ই জানে। তবু— মনে হলো, অম্বিকা যেন ওই খুশির খবরগুলোয় খুশি হলো না।
তবু অম্বিকা নতুন বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইল। বলল, যাবো তো কাল-পরশু কলকাতায়। একবার দেখা করে এলে তো হয়। অবশ্য চিনতে পারবেন। কিনা জানি না।
শোনো কথা! সুবালা হাসে, তোমায় পারবে না চিনতে? তোমাকে কত পছন্দ হয়েছিল তার। আমি তো ভাবছিলাম–
হেসে চুপ করে যায় সুবালা।
কি ভাবছিলেন?
সুবালা মিটিমিটি হেসে বলে, ভাবছিলাম তমাকে তারই জামাই করে দিই! মেয়েটা তো বেশ বড় হয়ে উঠেছে–
আমাকে–জামাই-
অম্বিকা এবার নিজস্ব ভঙ্গীতে হেসে ওঠে সেই আগের মত, চমৎকার! এটা ঠিক আপনার উপর্যুক্ত কথা হয়েছে। বাঃ! বাঃ বাঃ! তাহলে বৃথা আশ্বাস দিচ্ছিলেন না, কনে রেডি? কি যেন হলাম। আমি মেয়েটির? মামা?
আহা, মামা আবার কি? সুবালা সতেজে বলে, কিছুই নয়। জানো না, মামার শালা পিসের ভাই, তার সঙ্গে সম্পর্ক নাই। তুমি হচ্ছে পিসের ভাই—
ব্যস! ব্যস! শাস্ত্রবচনও মজুতা! অম্বিকা বলে, কিন্তু এত সব ছেলেমেয়ের বিয়ে হল, তার মেয়েরই বা হয় না কেন?
সুবালা সন্দেহের গলায় বলে, তার কোন মেয়েটার কথা বলছে তুমি?
আহা, সেই তো সেই যে তোমার এখানে আসে নি। নবদ্বীপে না কোথায় যেন গিয়েছিল!
আশ্চর্য যে এটা ভুলে যায় নি। অম্বিকা।
কিন্তু সে কথা তুলে হাসে না সুবালা। হাসে অম্বিকার অজ্ঞানতায়।
সেই মেয়ে? সেই মেয়ে এখনো বসে আছে, এই ভাবছো তুমি? হায় হায়! চাপা? তার কবে বিয়ে হয়ে গেছে, মেজ মেয়ে চন্ননেরও হয়েছে। এ হচ্ছে, সেই পারুল! সব সময় যে ছোট্ট মেয়েটা চুপচাপ থাকতো—
পারুল! মানে সেই যে দোলাই গায়ে জড়িয়ে মাঠে-বাগানে ঘুরে বেড়াতো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই তো মনে পড়েছে বাপু! ওদের মত ফরসা না হলেও সেই মেয়েটাই তো সব চেয়ে সুচ্ছিরি মেজবৌয়ের—
অম্বিকা আবার বলে, চমৎকার! দত্ত জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে একটু ইতারবিশেষ এই যা।
শোনো কথা, তার সঙ্গে কিসের তুলনা? আমি বাপু ওর কথাই ভাবছিলাম—
আপনার ভাবনার দড়িটা একটু খাটো করুন বৌদি, বড্ড লম্বা হয়ে যাচ্ছে!
অম্বিকা আবার হাসতে থাকে হা-হা করে।
সুবালা একসময় অমূল্যকে চুপিচুপি বলে, ঠাকুরপো কিন্তু ঠিক তেমনটিই আছে, একটুও বদলায় নি।
অমূল্য আস্তে বলে, কে বললে বদলায় নি? বদলেছে বৈকি! অনেক বদলেছে!