1 of 2

২.০৮ ভাগ্নের বাড়ির খবর

শুনেছ মা, তোমার ভাগ্নের বাড়ির খবর?

জগু বাজার থেকে ফেরে একজোড়া ডাব হাতে ঝুলিয়ে, পিছন পিছন নিতাই কাঁধে ধামা নিয়ে।

ভারি জিনিস-টিনিসগুলো নিজেই বয়ে আনে জগু, হাল্কাগুলো নিতাইয়ের ধামায় দেয়। দেয়। নেহাতই মাতৃভয়ে! ফুলকোঁচা দিয়ে ধুতি পরতে শিখেছে নিতাই, গায়ে টুইল শার্ট। খাওয়া-দাওয়া বাবুয়ানার শেষ নেই। এর ওপর যদি দেখা যায়, খালি হাত নাড়া দিয়ে বাজার থেকে ফিরছে। নিতাই, আর জগু আসছে মোট বয়ে, রক্ষে রাখবে না মা।

অবশ্য মার চোখে পড়বার সুযোগ বড় একটা হয় না, কারণ বাজার থেকে যখনই বাড়ি ঢোকে জগু, চেঁচাতে চোঁচাতে আসে, বাজার-টাজার করা আর চলবে না, গলায় ছুরি-মারা দর হাঁকিছে! ডবল পয়সা ভিন্ন একটা নারকোল দিতে চায় না, ডাবের জোড়া ছ। পয়সা। আর মেছুনী ম্যাগীগুলোর চ্যাটাং চ্যাটাং বুলি শুনলে তো ইচ্ছে করে, ওরই ওই আঁশ বঁটিটা তুলে দিই নাকটা উড়িয়ে….. ভাবলাম নিতাই ছোঁড়াটাসুদ্ধ আমাদের সঙ্গে জুটে নিরিমিষ্যি গিলে গিলে মরে, আজ নিয়ে যাই পোয়াটাক কাটা পোনা, তা বলে কিনা চার আনা সের!… গলায় ছুরি দেওয়া আর কাকে বলে! একটা আধলা ছাড়ল না, পুরো আনিটা নিল। গলায় ছুরি আর কাকে বলে!

এমনি বহুবিধ ধুয়ো নিয়ে বাড়ি ঢোকে।

সেই ধুয়োর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যান শ্যামাসুন্দরী। ইত্যবসরে জগু হাতের মালপত্ৰ নামিয়ে ফেলে।

তারপর নিতাইকে নিয়ে হাঁকডাক শুরু করে দেয়। ছেলেটা যে শ্যামাসুন্দরীর হৃদয়মধ্যস্থিত বাৎসল্য রস আদায় করে ফেলেছে, এটা টের পেয়ে গেছে জগু, যতই কেন না সেটা চাপতে চেষ্টা করুন শ্যামাসুন্দরী। তাই জগু এখন নিশ্চিন্ত এবং সেই নিশ্চিত্ততার বশেই ছেলেটাকে শাসন করার ভান করে।,

হাত-পা গুটিয়ে বসে রাইলি যে? সংসারে একটা কাজে লাগতে পার না? কী একেবারে কুইন ভিক্টোরিয়ার দৌত্তুর এসেছো তুমি? একেই বলে—কাজে কুঁড়ে আর ভোজনে দেড়ে!

শ্যামাসুন্দরী এক-এক সময় বলে ওঠেন, থাম জগা, আর ফাঁকা বন্দুকের আওয়াজ করিস না। ওর উপকারের বদলে মাথাটাই খেলি ওর। গরীবের ছেলেকে লাটসাহেব করে তুললি-

জণ্ড আবার তখন অন্য মূর্তি ধরে।

বলে, লাটসাহেব হয়ে কেউ জন্মায় না। আর গরীবের ছেলে বলেই চোরদায়ে ধরা পড়ে না। লাটসাহেবী! লাটসাহেবীর কি দেখলে? একটা ফরসা জামাকাপড় পরে, তাই? বলি ভগবানের জীব নয় ছেঁড়া?

প্রত্যহ প্ৰায় একই ধরনের কথাবার্তা, শুধু আজকেই ব্যতিক্রম ঘটলো। আজ জণ্ড তার মার কাছে অন্য কথা পাড়ে।

বলে, শুনেছ তোমার ভাগ্লের বাড়ির কাণ্ড?

ছেলের কথায় কান দেওয়া শ্যামাসুন্দরীর স্বভাব নয়, দেনও না, আপন মনে হাতের কাজ করতে থাকেন। জগু ক্রুদ্ধ গলায় বলে, বড়লোকের মেয়ের যে দেখছি গরীবের ছেলের কথাটা কানেই গেল না! বেচারা বেঁটা একসঙ্গে মা-বাপ। হারালো, সেটা এমন তুচ্ছ কথা হলো?

একসঙ্গে মা-বাপ। হারালো!

বেচারা বেঁটা!

এ আবার কোন ধরনের খবর?

কাদের বৌ?

এবার আর ঔদাসীন্য দেখানো যায় না। মান খুইয়ে বলতেই হয় শ্যামাসুন্দরীকে, হলোটা কী?

হলো না-টা কি তাই বল? মা গেল। খবরটাও দিল না কেউ তারপর পিঠপিঠ কদিন পরেই বাপ গেল, তখন খবর। নে এখন জোড়া চতুর্থ করে মর।

শ্যামাসুন্দরীও ক্রুদ্ধ হন।

বলেন, কার বৌ, কি বৃত্তান্ত বলবি তো সে কথা?

কার বৌ আবার? শ্ৰীমান প্ৰবোধবাবুর বৌয়ের কথাই হচ্ছে। বেচারা মেজবৌমার কথা। বাপ বুঝি মরণকালে একবার দেখতে চেয়েছিল, তাই গিয়েছিলেন মেজবৌমা! তখন বলেছে, মা তোর মরেছে, তবে অশৌচ নেওয়া নিষেধ। দুদিন বাদে নিজেও পটল তুললো।

শ্যামাসুন্দরী যদিও বুড়ো হয়েছেন, কিন্তু কথায় সতেজ আছেন। তাই সহজেই বলেন, তোর মতন মুখ্যুর সঙ্গে কথা কওয়াও আহম্মুকি! বলি খবরটা তুই পেলি কোথায়?

আরে বাবা, স্বয়ং তোমার ভাগ্লোব কাছেই। আসছিল এখানেই, বাজারে দেখা। আসবে, এক্ষুনি আসবে। দু-দুটো চতুর্থী, ব্যাপার তো সোজা নয়, ঘটা পটা হবে। তাই আমার কাছে আসবে পরামর্শ করতে। এই জগা শৰ্মা না হলে যজ্ঞি। সুশৃঙ্খলে উঠুক দেখি? ইঃ বাবা!

শ্যামাসুন্দরী কিন্তু এ উৎসাহে যোগ দেন না। বলিরেখাঙ্কিত কপালে আরো রেখা পড়িয়ে বলেন, ঘটোপটাটা করছে কে?

কে আবার! তোমার ভাগ্নেই করছে। বললো, তোমার মেজবৌমার বড় ইচ্ছে—

শ্যামাসুন্দরী অবাক গলায় বলেন, মেজবৌমার ইচ্ছে? মা-বাপের সঙ্গে তো কখনো—

ওই তো–এখন অনুতাপটি ধরেছে! সেই যে কথায় আছে না, থাকতে দিলে না ভাতকাপড়, মরলে করলো দানসাগর তাই আর কি।

শ্যামাসুন্দরী দৃঢ় গলায় বলেন, মেজবৌমা সে ধরনের মেয়ে নয়।

জগু অবাক গলায় বলে, তাই নাকি? তবে যে পেবো বললে—

কথা শেষ হয় না, স্বয়ং পেবোই ঢোকে দরজাটা ঠেলে।

বলে, এই যে মামী, তুমিও রয়েছ। পরামর্শ করতে এলাম। মায়ের তো শরীর খারাপ, এখন তুমিই ভরসা। দায়টা উদ্ধার করো তোমার মায়ে-ছেলেয়। সোজা দায় তো নয়, শ্বশুরদায় শাশুড়ীদায়। মাতৃদায় পিতৃদায়ের অধিক।

আপন রসিকতাশক্তির পুলকে টেনে টেনে হাসতে থাকে প্ৰবোধ হ্যাঁ-হ্যাঁ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *