1 of 2

২.০১ তারপর দিন গড়িয়ে যাচ্ছে

দ্বিতীয় পর্ব

তারপর দিন গড়িয়ে যাচ্ছে।

অনেকগুলো বর্ষা, বসন্ত, শীত, গ্ৰীষ্মের আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে

মানুষের চেহারাগুলোর পরিবর্তন ঘটেছে।

চেহারা?

তা শুধু চেহারাই।

স্বভাব নামক বস্তুটার তো মৃত্যু নেই। ও নাকি মৃত্যুর ওপার পর্যন্ত ধাওয়া করে নিজের খাজনা আদায় করে নেয়।

তাই কাঁচা চুলে পাক ধরে, চোখ কান দাঁত আপন আপনি ডিউটি সেরে বিদায় নিতে তৎপর হয়, শুধু স্বভাব তার আপনি চেয়ারে বসে কাজ করে চলে।

দিন আর রাত্রির অজস্র আনাগোনায় অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, কেটে গেছে অনেক বিষণ্ণ প্রহর, অনেক দুঃসহ দণ্ড আর পল। সেদিন যারা জীবন নাটকের খাতাখাতা খুলে মঞ্চে ঘোরাফেরা করছিল, অনেক অঙ্ক, অনেক গর্ভাঙ্ক পার হয়ে গেল তারা।

স্বদেশী নামের যে দুরন্ত ক্ষ্যাপামিটা। তছনছ করে বেড়াচ্ছিল শৃঙ্খলা আর শৃঙ্খল, সেই ক্ষ্যাপামিটা যেন নিজেরাই তছনছ হয়ে গেল গুলির বারুদে, ফাঁসির দড়িতে, অন্তহীন কারাগারের অন্ধকারে। হারিয়ে গেল অন্য শাসনের আশ্রয়ে পালিয়ে গিয়ে, চালান হয়ে গেল কালাপানি পারের পুলি-পোলাও নামের মজাদার দেশে!… শুরু হলো পাকা মাথার পাকামি। আলাপ আর আলোচনা, আবদেন। আর নিবেদন। এই পথে আসবে স্বাধীনতা।

এঁরা বিজ্ঞ, এরা পণ্ডিত, এঁরা বুদ্ধিমান।

এরা ক্ষ্যাপার দলের ক্ষ্যাপা নন।

অনেক ক্ষ্যাপার মধ্যে একটা ক্ষ্যাপা অম্বিকা নামের সেই ছেলেটা নাকি কোথাকার কোন গারদে পচছে, কিন্তু তার জন্যে পৃথিবীর কোথাও কিছুই কি আটকে থাকলো?

নাঃ, আটকে থাকলো না কিছুই!

শুধু অবহেলা আর অসতর্কতার অবসরে হারিয়ে গেল সুবৰ্ণলতার জীবনের অনেকগুলো অধ্যায়। ছড়ানো ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো বার বার উল্টোপাল্টেও কোথাও সেই ইতিবৃত্তের সূত্রটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যেখানে সুবৰ্ণলতার ঘরভাঙার বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে।

অথচ দেখা যাচ্ছে, সুবৰ্ণলতা ঘর ভেঙে বেরিয়ে এসে আবার ঘর গড়েছে।

কিন্তু অধ্যায়গুলোতে কি নতুনত্ব ছিল কিছু? চাঁপার পর চন্ননের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল; উল্লেখযোগ্য শুধু এইটুকুই। কারণ মানুষের ইতিহাসের বিশেষ তিনটি ঘটনার মধ্যে ওটা নাকি অন্যতম।

তা শুধু ঐ চন্ননের বিয়ে!

তা ছাড়া আর কি?

সুবৰ্ণলতার বাকি ছেলেগুলোর গায়ের জামার মাপ বাড়তে বাড়তে প্ৰমাণ সাইজে গিয়ে ঠেকেছিল, এটাও যদি খবর হয় তো খবর। অথবা মুক্তকেশীর ছেলেদের চুলে পাক ধরেছিল, মুক্তকেশীর কোমরটা ভেঙে ধনুক হয়ে যাচ্ছিল, আর মুক্তকেশীর বৌর আর শাশুড়ীর দরজায় গিয়ে মা আজ কি কুটনো কুটবো? এই গুরুতর প্রশ্নটা করতে মাঝে-মাঝেই ভুলে যাচ্ছিল–এসবকেও খবরের দলে ফেলতে চাইলে ছিল খবর!

কিন্তু সবচেয়ে বড় খবর তো স্বভাব নামক জিনিসটা নাকি মরে গেলেও বদলায় না। তাই বাকি ঘটনাগুলোর ছাঁচ খুব বেশি বদলেছিল বলে মনে হয় না।

হয়তো সুবৰ্ণলতা তেমনিই অবিশ্বাস্য-অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক সব ঘটনা ঘটাচ্ছিল, হয়তো মুক্তকেশীর মেজ ছেলে তেমনিই সর্বসমক্ষে একবার করে তেড়ে উঠে বৌকে শাসন করছিল, আর একবার করে আড়ালে গিয়ে নাক-কান মলছিল। আর পায়ে ধরছিল।.

হয়তো সুবৰ্ণলতা সেই ঘৃণায় আর ধিক্কারে আবারও ভাবতে বসেছিল কোনটা সহজ? কোনটা বেশি কার্যকরী? বিষ না দড়ি? আগুন না জল? আর শেষ পর্যন্ত কোনোটাই সহজ নয় দেখে রান্নাঘরে নেমে গিয়ে বলেছিল, বামুনদি, আমায় আগে চারটি দিয়ে দাও তো! শুয়ে পড়ি গিয়ে!

আর কি হবে?

দরজিপাড়ার ঐ গালিটার মধ্যে আর কোন স্বাদের বাতাস এসে ঢুকবে? আর কোন বৈচিত্র্যের বাণী উচ্চারিত হবে?

তবে বৈচিত্র্যের কথা যদি বলতে হয় তো বলা যায়— মুক্তকেশীর বড়জামাই কেদারনাথ মুক্তকেশীর মুখরক্ষার চিন্তা না করেই দেহরক্ষা করেছেন, আর পেটরোগা সুশীলা হঠাৎ আলোচাল মটরডাল বাটার খপ্পরে পড়ে গিয়ে রক্ত অতিসারে ভুগছেন। আর বৈচিত্র্য— উনিশ বছরের মল্লিকা বিধবা হয়ে এসে ঠাকুরমার হেঁসেলে ভর্তি হয়ে ইস্তক শুদ্ধাচারের বহর বাড়াতে বাড়াতে হাতেপায়ে হাজা ধরিয়ে বসেছে।

মুক্তকেশী আক্ষেপ করে বলেন, মনে করেছিলাম পোড়াকপালী সর্বখাকী এসে তবু আমার একটু সুসার হলো, আমার হাত-নুড়িকুৎ হবে, আমাকে এক ঘটি জল দেবে! তা নয়, আমি এই তিন ঠেঙে বুড়ী ঐ দস্যির ভাত রোধে মরছি!

বড় দুঃখেই বলেন। অবশ্য।

বৌদের পিত্যেশ জীবনে কখনো করেন নি, এখনও চান যে অহঙ্কারের মাথায় নিজের ভাত নিজে ফুটিয়ে খেতে খেতে চলে যাবেন, কিন্তু কোমরটা বড়ই বাদ সাধছে।

এখন টের পাচ্ছেন কেন বলে, কোমরের বল আসিল বল!

মল্লিকাটার কপাল পোড়ায় নিজের কপাল ছেচেছিলেন সত্যি, তবু ভেবেছিলেন, এ তো পরের মেয়ে নয়, ঘরের মেয়ে, এর কাছে একটু পিত্যেশ করলে অহঙ্কার খর্ব হবে না। তা উল্টো বিপরীত। তার ভাত নিয়েই ডেকে ডেকে মরতে হয়, স্নান আর শেষ হয় না তার।

তা ছাড়া বৌরাই বা কে কোথায়?

সেই বাধানো সংসার আর নেই এখন। বড়বৌয়ের শরীর ভেঙেছে, মন ভেঙেছে, মেজবৌ বরের পয়সার দেমাকে এ বাড়ির ভাগ ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র বাড়ি হাঁকড়েছেন। সেজ, ছোট, দুই বৌ একই রান্নাঘরে ভিন্ন হাঁড়ি।… মুক্তকেশী এখন ভাগের মা!

তবু মেজটারই চোখের চামড়া আছে, দূরে থেকেও মুক্তকেশীর ব্যয়ভার বহন করে সে, সময় অসময়ে দেখে, মুক্তকেশীর ইচ্ছেপূরণের খাতে যা খরচাপত্র হয় দায় পোহায়।

সুবোধের সামান্য কটি টাকা পেনসন, করবেই বা কি? আর দুটো তো কঞ্জুসের একশেষ।

…নিজের সেই জমজমাট সংসার আর দাপটের দিনগুলোর কথা মনে পড়লে নিঃশ্বাস পড়ে মুক্তকেশীর…নিতান্ত রাগের সময় ঘরে বসে আঙুল মটকানো আর গাল দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। এমন কি গলাটা সুদ্ধ বাদ সোধেছে, চেঁচিয়ে কাউকে বিকতে গেলেই কাশতে কাশতে দম আটকে আসে।… অতএব আঙুল মটকান, আর ভাঙাগলায় থেমে থেমে বলেন, মরছেন সব চক্ষুছরদের অহঙ্কার মরছেন! আমিও মুক্তকেশী বামনী, এই বাসিমুখে বলে যাচ্ছি, যে দুগ্ৰগতি আমার হচ্ছে, সে দুগ্ৰগতি তোদেরও হোক।

কিন্তু সেই ওরা কারা?

শুধু কি মুক্তকেশীর বৌ কটা?

তা বললে অবিচার করা হবে। মুক্তকেশী অত একচোখা নন। মুক্তকেশী তার নিজের মেয়েকেও বলেন। বিরাজ যখন বেড়াতে এসে ভাই-ভাজদের কাছে সারাক্ষণ কাটিয়ে চলে যাবার সময় একবার এ-ঘরে এসে ঢোকে, বলে মা কেমন আছ গো? তখন মুক্তকেশী ভারীমুখে বলেন, খুব হয়েছে! আর মার সোহাগে কাজ নেই বাছা। যাদের চক্ষুছরদ আছে, তাদের কাছেই বোসো গে।

আর চলে গেলে বিড় বিড় করেন।

কিন্তু সে তো শেষের দিকে।

সুবৰ্ণ যখন ঘর ভাঙলো তখন কি মুক্তকেশীর কোমর ভেঙেছিল?

নাঃ, তখনও মুক্তকেশীর কোমর ভাঙে নি!

তখনও মুক্তকেশী কিছুটা শক্ত ছিলেন।

তখন মুক্তকেশীর শাপ-শাপান্তের গলা আকাশে উঠেছে। তখন মুক্তকেশী বৌ ভেন্ন হয়ে যাওয়ায় বুক চাপড়েছেন, নেচে বেড়িয়েছেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আবার মাথা হেট করে ফিরে আসতে হবে। থোতামুখ ভোঁতা হবে!

হবেই।

কারণ ভেন্ন হয়ে বুঝবে কত ধানে কত চাল। এখন পাঁচজনের ওপর দিয়ে সংসারের দায় উদ্ধার হচ্ছে।

কিন্তু মুক্তকেশীর সে বাণী সফল হয়নি।

সুবৰ্ণ ফিরে আসেনি।

সুবৰ্ণ সেই ভাড়াটে বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে উঠে গিয়েছিল।

এজমালি এই বাড়িটার নিজের অংশের ঘরখানা চাবিবন্ধ করে রেখে যায় নি। সুবর্ণ, তার জন্যে টাকাও চায় নি। এমন কি ধীরে ধীরে যে দু। চারটি আসবাবপত্র জমে উঠেছিল কাঁচা-পয়সাওলা প্ৰবোধের, সে-সবেরও কিছু নিয়ে যায় নি।

নিয়ে যায় নি নিজের বাসনপত্ৰ।

শুধু পরবার কাপড়-চোপড় আর শোয়ার বিছানা—এই সম্বল করে বেরিয়ে পড়েছিল এই গলি থেকে। একদা যে গলিতে ঢুকে মর্মান্তিক রকমের ঠিকেছিল সুবর্ণ। নতুন চুনের আর নতুন রঙের কাঁচা গন্ধে ভরা একখানা বাড়ির গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়িয়েছিল দক্ষিণের বারান্দা খুঁজতে।

অবশেষে দক্ষিণের বারান্দা হলো সুবৰ্ণলতার। বড় রাস্তার ধারে।

সবুজ রেলিং ঘেরা, লাল পালিশ-করা মেঝে, চওড়া বারান্দা।

সেই বারান্দার কোলে টানা লম্বা, বড় ঘর।

পূবে জানালা, দক্ষিণে দরজা।

ঐ পুবটাকে আচ্ছন্ন করে কোনো বাড়ি ওঠে নি। খোলা একখানা মাঠ পড়ে আছে। ঘরের মধ্যে বিছানায় শুয়ে ভোরবেলায় সূর্য-ওঠা দেখতে পাওয়া যায়।

আর কি তবে চাইবার রইল সুবৰ্ণলতার?

আর কি রইল অসন্তোষ করবার? অভিযোগ করবার? উত্তাল হবার? বিষণ্ণ হবার?

সুখী, সন্তুষ্ট, সব আশা মিটে যাওয়ায় সম্পূর্ণ আর পরিতৃপ্ত সুবৰ্ণলতার জীবনকাহিনীতে তবে এরাবার পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেওয়া যায়।

এরপর আর কি?

বাঙালী গোরস্তঘরের একটা মেয়ে এর বেশি আর কি আশা করতে পারে? আর কোন প্ৰাপ্যের স্বপ্ন দেখতে পারে?

চরম সার্থতা আর পরম সুখের মধ্যে বসে একটির পর একটি ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌ আনা, আর বাকি মেয়ে দুটোকে পার করা। এই তো!

তা তাতেই বা কোথায় ঠেক খেতে হবে?

তিনটে ছেলে তো মানুষ হয়ে উঠলই, ছোটটাও হবে নিশ্চিত। লেখাপড়ায় রীতিমত ভালো। শেষের দিকের মেয়ে দুটো পারুল আর বকুল, দেখতে-শুনতে তো দিব্বি সুন্দরী, কাজেই ওদের নিয়ে ঝামেলা নেই। যে দেখবে পছন্দ করবে। পণের টাকা দিতেও পিছপা হবে না প্ৰবোধ।

টাকা সে রোজগারও যেমন করে অগাধ, খরচেও তেমনি অকাতর এখনো। হয়তো এ নেশা ধরিয়ে দিয়েছে সুবৰ্ণই। খরচের নেশা!… কিন্তু হয়েছে নেশা!

অতএব?

অতএব সুবৰ্ণলতাকে নিয়ে লেখার আর কিছু নেই।

গৃহপ্রবেশের সময় কিছু হয় নি, তাই তার কাছাকাছি সময়ে এই উপলক্ষটা নিয়ে লোকজন য়েছিল প্ৰবোধ।

কিন্তু এ ঘটনার মধ্যে সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়?

এ তো রীতিমত সুখাবহ ঘটনা!

তবে সুবৰ্ণলতার রীতি অনুযায়ী হয়তো দুঃখের। ওর তো সবই বিপরীত। যারা ওকে নিয়ে ঘর করেছে আর জ্বলোপুড়ে মরেছে তারা সবাই বলেছে, বিপরীত! সব বিপরীত! বিপরীত বুদ্ধি, বিপরীত চিন্তা, বিপরীত আচার-আচরণ!

অতএব ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করেই দেখা যাক।

প্রথমে নাকি প্রস্তাবটা তুলেছিল প্ৰবোধই। আর সেই প্ৰথমে নাকি সুবৰ্ণলতা বলেছিল, গুরুমন্ত্রটন্ত্র নিচ্ছি না এখন। যদি কখনো তেমন ইচ্ছা হয়, যদি কাউকে এমন দেখি মাথা। আপনি নত হতে চাইছে, গুরু বলে, তখন দেখা যাবে।

আলাদা হয়ে আসার পর কিছুদিন চক্ষুলজ্জায় ও-বাড়ি যেতে পারে নি প্ৰবোধ, কিন্তু সুবৰ্ণলতার প্ররোচনাতেই যেতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত। মায়ের হাতখরচ বলে মাসিক পচিশ টাকা করে দিয়ে পাঠিয়েছে সুবর্ণ একরকম জোর করে।

প্ৰবোধ বলেছে, অত ধাষ্টামো করতে আমি পারবো না। ও টাকা মা পা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন!

সুবৰ্ণ বলেছিল, একবার ফেলে দেন, তুমি বার বার পায়ে ধরে নিইয়ে ছাড়বে! মায়ের পায়ে ধরায় তো লজ্জাও নেই, অমান্যিও নেই!

তা শেষ পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।

যদিও ছোট ভাইরা বাঁকা হাসি হেসে তুমি যে হঠাৎ বলে উত্তরটা না নিয়েই চলে গিয়েছিল, এবং সুবোধ গম্ভীর-গম্ভীর বিষণ্ণ-বিষাণু মুখে বলে ছিল, ভাল আছ তো? ছেলেপুলে সব ভালো? আর বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো আশপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি মারছিল, কথা বলে নি, আর মুক্তকেশী দেখেই ড়ুকরে কেঁদে উঠেছিলেন, তথাপি টাকাটার সদগতি হয়েছিল।

পা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন নি মুক্তকেশী। শুধু ভারী মুখে বলেছিলেন, তুমি যখন লজ্জার মাথা খেয়ে আগ্রহ করে দিতে এসেছি, তখন আর তোমার মুখটা ছোট করবো না! দিচ্ছি রাখছি। তবে কেন আর ছেঁড়াচুলে খোঁপা বাঁধার চেষ্টা? তুমি তো সব সম্পর্ক তুলেই দিয়েছ!

উঁচোনো খাঁড়া ঘাড়ে পড়ে নি। ঐ পর্যন্তই হয়েছে।

তা সেদিনের সেই নিশ্চিন্ততার পর থেকে প্ৰবোধ নিত্য ওপাড়ায় যাত্রী। ওপাড়ার তাসের আড্ডাও প্ৰবোধহীন হচ্ছে না।

আর মজা এই—বাড়িতে থাকাকালে দিনান্তে মায়ের সঙ্গে যতটুকু গল্প হতো, মায়ের কাছে যতটুকু বসা হতো, তার চতুগুণ হচ্ছে এখন। আর সেই অবসরেই মুক্তকেশী তার অন্য ছেলেবৌদের সমালোচনা করে করে মনের ভার মুক্ত হয়ে একদিন ঐ গুরুমন্ত্রের কথা তুলেছিলেন।

ওটা না হলে তোর আর হাতের জল শুদ্ধ হবে না! এতখানি বয়েস হলো, অদীক্ষিত শরীর নিয়ে থাকা! ছিঃ!

তা ছাড়া মরণের তো ধরন ঠিক করা নেই। কাজেই হঠাৎ একদিন যদি দেহই রক্ষা করে বসে সুবৰ্ণলতা তো সেই অদীক্ষিত দেহের গতি হবে?

সুবৰ্ণলতা বরের মুখে শুনে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, গতিটা কি দেহের? না আত্মার? তোমাদের ঐ কুলগুরুর বংশধর বলেই যে ঐ গাঁজাখের শুটকো ছেলেটাকে গুরু বলে পা-পূজো করতে বসবো, সে আমার দ্বারা হবে না।

এ কথা শুনলে, ঘরে-পরে কে না ছি-ছিক্কার করবে। সুবৰ্ণলতাকে? করেছিল। তাই!

বলেছিল, এসব হচ্ছে টাকার গরম!

এমন কি যার টাকার উত্তাপে এত গরম সুবৰ্ণলতার, সেই প্ৰবোধই বলেছিল, দুটো টাকা হয়েছে বলেই তার গরমে ধারাকে সারা দেখো না মেজবৌ! সেই যে মা বলে, ভগবান বলে—দেব ধন, দেখবো মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ? সেটাই হচ্ছে সার কথা! ভগবান মানুষকে দেন, দিয়ে পরীক্ষা করেন।

সুবৰ্ণলতা হেসে ফেলেছিল।

তোমার মুখে ভগবানের বাণী! এ যেন ভূতের মুখে রামনামের মত। কিন্তু কি করবো বল? যাকে গুরু বলে মন সায় না। মানে–

প্ৰবোধ রেগে উঠে বলেছিল, তা তোমার গুরু হতে হলে তো মাইকেল, নবীন সেন, বঙ্কিমচন্দ্ৰ, কি রবিঠাকুরকে ধরতে হয়! তাঁরা আসবেন তোমার দেহশুদ্ধির ভার নিতে? দীক্ষাহীন দেহের হাতের জল শুদ্ধ হয় না তা জানো?

এই কথা!

যেন কে না জানে, এই কথা! বলে সুবৰ্ণ যেন একটু মাত্র-ছাড়া হাসি হেসেছিল। তারপর হাসির চোখমুখ সামলে বলেছিল, শুধু দেহ? তার জন্যে এত দুশ্চিন্তা? তা নেব তাহলে মন্তর! ঐ তোমাদের গেঁজেল গুরুপুত্ত্বরের কাছেই নেবা! দেহটার মালিক যখন তুমি, তখন তোমার মনের মতন কোজই হোক।

প্ৰবোধ অবশ্য ঐ হাসি আর কথার মানেটা খুব একটা হৃদয়ঙ্গম করে নি, তবে চেষ্টাও করে নি। হৃদয়ঙ্গম করতে বোঝা যাচ্ছে রাজী হয়ে গেছে, আর ভয় নেই।

কারণ একবার যখন কথা দিয়েছেন মেজগিনী, আর সে কথার নড়াচড় হবে না। এই বেলা লাগিয়ে দেওয়া যাক!

অতএব–

অতএব গুরুমন্ত্রে দীক্ষা হলো সুবৰ্ণলতার। এ উপলক্ষে সমারোহের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। বিস্তর খরচ করে ফেললো প্ৰবোধ, বিস্তর গুরুদক্ষিণা দিলো। বললো, এতটা কাল ধরে এত রোজগার করছি, সে রোজগারে ভূতভোজন ছাড়া কখনো সৎকাজ হয় নি। এ তবু একটা সৎকাজ, একটা মহৎ কাজে লাগলো।

মুক্তকেশী এসে যজ্ঞের হাল ধরেছিলেন। যজ্ঞশেষে হৃষ্টচিত্তে সকলকে বলে বেড়াতে লাগলেন, জানি আমার পেবো যা করণ-কারণ করবে, মানুষের মতনই করবে। মেজবৌমারও স্বভাবটাই ক্ষ্যাপাটে, নজর উঁচু ! আর চিরকালের ভক্তিমতী! দেখেছি তো বরাবর, গো-ব্ৰাহ্মণ, গুরুপুরুত, কালী-গঙ্গা যখন যাতে খরচ করেছি, সব খরচ মেজবৌমাই যুগিয়েছে। যেচে যেচে সোধে সোধে। তা ভগবানও তেমনি বাড়বাড়ন্ত বাড়াচ্ছে। মনের গুনে ধন।

মেয়েদের বিয়ের সময় যখন ঐ পেবোই একটু খরচপত্তর বেশি করে ফেলেছিল, মুক্তকেশী ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করেছিলেন। বলেছিলেন, চালচালিয়াতি দেখানো এসব!

কিন্তু এখন অন্য কথা বললেন।

এখন কি তাঁর সেই একদার ভবিষ্যৎবাণীর পরাজয়ে লজ্জিত হয়েছেন মুক্তকেশী? নাকি ছেলের এই বাড়িঘর, ঐশ্বর্য, বিভূতি সব দেখে অভিভূত হচ্ছেন?

তাই মুক্তকেশীর মুখ দিয়ে বেরোয়, কী খাসা ভাড়ারঘর মেজবৌমার, দেখলে প্ৰাণ জুড়োয়!

পেবো অবশ্য অনেকবার চুপিচুপি অনুরোধ জানিয়েছিল মাকে, এই থাকাতেই থেকে যেতে।

সুবৰ্ণলতাও তার স্বভাবগত উদারতায় বলে ফেলেছিল সে কথা। —তা বেশ তো—এখানেই কেন থাকুন না। এটাও তো আপনারই বাড়ি।

কিন্তু কেন কে জানে, মুক্তকেশী রাজী হন নি।

মুক্তকেশী যজ্ঞি তুলে দিয়েই চলে গিয়েছিলেন।

আর কখনো সেকথা নিয়ে কথা ওঠে নি।

শুধু সুবৰ্ণলতার বড় মেয়ে চাঁপা, যে নাকি এই উপলক্ষে এসেছিল, সে বলেছিল, ঢের ঢের মেয়েমানুষ দেখেছি বাবা, আমার মাটির মতন এমন বেহায়া দুটি দেখি নি! আবার সাহস হলো ঠাকুমাকে এখানে থাকার কথা বলতে?

কিন্তু সেটা একটা ধর্তব্য কথা নাকি?

চাঁপা তো চিরটা কালই তার মায়ের সমালোচনা করে। ওটা কিছু নয়।

তবে? তবে দুঃখটা কোথায়?

তবে কি সেই পারুর স্কুলে ভর্তি করার কথাটাতেই?

তা হতেও বা পারে!

চিরকালই তো তিলকে তাল করা সুবৰ্ণলতার স্বভাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *