1 of 2

১.২৬ ভাগ্নেদের মেয়ের বিয়ের পরামর্শ

কিন্তু ভাগ্নেদের মেয়ের বিয়ের পরামর্শ দিতে এসে যে এমন দিশেহারা দৃশ্যের সামনে পড়তে হবে, এমন ধারণা কি ছিল শ্যামাসুন্দরীর?

দেখতে হবে এমন ধারণা তো ছিল না, বিষয়বস্তুটাও ধারণাতীত।

তবু দেখতে হলো।

দেখলেন সুবৰ্ণলতা ছেলে পিটোচ্ছে। বরাবর শুনে এসেছেন, সুবৰ্ণলতা নাকি ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তোলে না। নাকি ছেলে ঠেঙানো তার দুচক্ষের বিষ। অন্য জায়েররা ছেলে মারলে রাগ করে। বলে, তোমার অধীনের প্রজা বলেই তুমি মারবে? তাহলে আর তুমি যার প্রজা, সে-ই বা তোমায় ছেড়ে কথা কইবে কেন?

সেই সুবৰ্ণলতা ছেলে পিটোচ্ছে!

অথবা শুধু পিটোচ্ছে বললে কিছুই বলা হয় না। ক্ষ্যাপা জন্তুর মত ছেলেটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্য আক্রমণে তাকে যেন শেষ করে দিতে চাইছে।

বিধ্বস্ত হয়েছে নিজের কেশবেশ, চেঁচাবার শক্তিও বুঝি নেই। শুধু হাঁপাচ্ছে আর মারছে। উল্টেপাল্টে মারছে।

উমাশশী ছাড়িয়ে নিতে পারে নি, পারে নি ছোটবৌ বিন্দু, মুক্তকেশী তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, মেরে ফেলবে নাকি ছেলেটাকে? মেরে ফেলবে নাকি? ওমা এ কী খুনে মেয়েমানুষ গো! ওগো বেটা ছেলেরা যে কেউ বাড়ি নেই গো, আমি এ বৌকে নিয়ে কী করি? অ সেজবৌমা—

সেজবৌমা অর্থে গিরিবালা।

পারেন নি, কারণ ওটাও ধারণা-বহির্ভূত বস্তু।

পরের ছেলেকে এমন মার মারে কেউ?

অবশ্য ছেলেটাই যে নীরবে পড়ে মার খাচ্ছে এমন নয়। চারখানা হাতপায়ের সাহায্যে যুদ্ধজয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। তাতেই সুবৰ্ণলতার কাপড় ছিঁড়েছে, চুল খুলে গেছে, গুঁড়ো হয়েছে হাতের শাখা।

প্ৰহারের শব্দ, ছেলেটার চীৎকারের শব্দ, বাড়ির অন্যান্য ছোট ছেলেদের ভীত-ক্ৰন্দন শব্দ আর সুবৰ্ণলতার অনমনীয় মনের তীব্র ঘোষণার শব্দ, মেরেই তো ফেলবো, খুনই করবো! এমন কুলাঙ্গার ছেলের মরাই উচিত। .

এমন এক অদ্ভুত পরিবেশের সামনে এসে দাঁড়ালেন শ্যামাসুন্দরী।

তারপর ব্যাপারটা বুঝে ফেলার পর ছুটে এসে মল্লযুদ্ধের দুই যোদ্ধার মাঝখানে পড়ে বলেন, কি হচ্ছে মেজবৌমা? খুনের দায়ে পড়তে চাও?

করলেন।

তবু ব্যাপারটার কতটুকুই বা বোঝা হয়েছে তাঁর!

ছেলেটা যে সুবর্ণর নয়, গিরিবালার, তা বুঝতে পারেন নি।

তবু বলে উঠেছিলেন, ছেলেটাকে কি খুন করবে মেজবৌমা?

হ্যাঁ, তাই করবো। সুবৰ্ণলতা ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে থাকে। ওকে একেবারে জন্মের শোধ খুন করে ফেলে ফাঁসি যাবার বাসনটাও ঘোষণা করে।

আর এই সময়ই ব্যাপারটা বুঝে ফেলেন শ্যামাসুন্দরী। বুঝে চমকে ওঠেন।

ছেলেটা গিরিবালার।

তার মানে? এই প্রাণঘাতী প্ৰহারটা দিচ্ছে সুবর্ণ, নিজের ছেলেকে নয়, পরের ছেলেকে?

সুবৰ্ণ কি তাহলে সত্যই বিকৃতমস্তিষ্ক?

শ্যামাসুন্দরী এ পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। তবু শ্যামাসুন্দরী নিজেকে প্রস্তুত করে নেন। ছেলেটাকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন, বুঝেছি কোনো ঘোরতর অন্যায় করেছে ছেলেটা, তবু আমিই ওর হয়ে মাপ চাইছি। মেজবৌমা!

এবার এতক্ষণে গিরিবালার মুখে বাকস্মৃতি ঘটে, আপনি মাপ চাইলেই তো হবে না মামীমা, থানা-পুলিস করে ছাড়বো। আমি!

পরিস্থিতি যাই হোক, গিরিবালার ওই থানা পুলিসের ঘোষণাটাও ঠিক বরদাস্ত করতে পারলেন না। শ্যামাসুন্দরী, অসতুষ্ট স্বরে বলে উঠলেন, ছিছি সেজবৌমা, এ কী কথা! এ কথা উচ্চারণ করা তোমার ভাল হয় নি। ছেলে দোষ করেছে, জেঠি দু ঘা মেরেছে, এই তো কথা? বুঝলাম রাগের মাথায় মারটা একটু বেশীই হয়ে গেছে। তা সে তোমার নিজেরও হতে পারতো। তাই বলে জেঠিকে তুমি পুলিসের ভয় দেখোচ্ছ ছেলের সমক্ষে? ছিছি!

শ্যামাসুন্দরী নিতান্তই বাপের বাড়ির সম্পর্কে একমাত্র এবং নিতান্তই নিকটজন, তাই মুক্তকেশী তাকে যথেষ্ট পদমর্যাদা দিয়ে থাকেন, তবু আজ আর দিয়ে উঠতে পারলেন না।

শ্যামাসুন্দরীর বিরূপ মন্তব্যের উপর ছুরি চালান, তুমি থামো বৌ! থানা-পুলিসের নাম সেজবৌমা সহজে করে নি। ও তো মা, না কি? এতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে সহ্য করেছে, তাতেই বাহাদুরি দাও ওকে! ওই ঘরজ্বালানী পরভোলানীকে বুঝতে তোমার এখনো দেরি আছে বৌ। এতখানি বয়েস হলো, এমন জাঁহাবাজ মেয়ে দেখলাম না কখনো। ছেলে।পুলে কোথায় কি খেলা করছে, সেদিকে তোর নজর দেবার দরকার কি? আর দোষের খেলাই বা কি খেলেছে? বড়বৌমার ছেলেরা সম্প্রতি দারোগা মেসোর বাড়ি ঘুরে এসে গপ্লোগাছা করেছে, তাই শুনে দারোগা, সেজে খেলবার বাসন হয়েছে, এই তো কথা? খেলায় ছেলেপুলে কখনো রাজা হয়, কখনো মন্ত্রী হয়, কখনো চোর হয়। কখনো জল্লাদ হয়, সেটা ধর্তব্য?

ঘটনাটা ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে।

দারোগা-বাড়ির গল্প শুনে গিরিবালার ওই বীর সন্তানটি দারোগা সেজে স্বদেশী পাজীদের শায়েস্ত করা করা খেলা করছিল। নিরীহ দু-চারটে কুচোকাঁচাকে স্বদেশী সাজিয়ে নিজে জামা টুপি ও বুটজুতোয় সাজ সম্পূর্ণ করে সেই সবুট পদাঘাতের সঙ্গে স্বদেশীদের প্রতি যথেচ্ছ কটুক্তি করার খেলাটা নাকি ইতিপূর্বে দু-একদিন হয়ে গেছে, এবং সুবৰ্ণলতা নাকি সে কথা শুনে কড়া নিষেধ করে দিয়েছিল।

তথাপি অমন মনোমত খেলাটি সে ছাড়তে পারে নি, আবার আজ তোরজোড় করে শুরু করেছিল, আর পড়বি তো পড় খোদ মেজজেঠিরই সামনে।

একেবারে বুটপরা পা তোলার মহামুহূর্তে।

পরবর্তী দশ্য ওই।

শ্যামাসুন্দরীর জানা হয়ে গেছে ঘটনাটা, তাই শ্যামাসুন্দরী বলেন, ত্বা ওকেও বলি, জেঠি যখন দু-তিন দিন নিষেধ করেছে, তখন ওই খেলাটিই বা খেলা কেন?

মুক্তকেশী বিকৃতকণ্ঠে বলেন, ভারী আমার মহারাণী এসেছেন সংসারে! তাই সংসারসুদ্ধ লোক ওঁর নির্দেশে ওঠ-বোস করবে!… বেশ করেছে ও ওই খেলা খেলেছে! ওই স্বদেশী মুখপোড়াদের অমনিই শাস্তি হওয়া উচিত। ওই মুখপোড়াদের জন্যেই তো দেশে যত অশান্তির ছিষ্ট হয়েছে। তাছাড়া অপরের ছেলে কি করেছে, না করেছে, তাতে তোর নাক গলাবার কি দরকার? তুই মারবার কে?

শ্যামাসুন্দরীর চিরদিনের দোষ, শ্যামাসুন্দরী ন্যায়পক্ষ সমর্থন করে বসেন।

অন্তত ওঁর কাছে যেটা ন্যায় মনে হয়। তাই শ্যামাসুন্দরী অসন্তুষ্ট গলায় বলেন, এ তোমার কি কথা ঠাকুরঝি? ছেলে দোষ করলে জেঠি, খুড়ি, ঠাকুমা, পিসিতে শাসন করবে না?

করবে। শাসন, তাই বলে খুন করে নয়! সেজবৌমা ঠিক কথাই বলেছে, ওর হাতে দড়ি পরানোই উচিত।

হ্যাঁ, সেই কথাই বলেছে গিরিবালা।

বলেছে, ওঁর হাতে যদি আমি দড়ি পরাতে না পারি তো আমার নাম নেই। আমিও একটা উঁকিলের পরিবার। কিসে কি হয় জানতে বাকি নেই আমার!

 

কিন্তু উঁকিলের পরিবারের সেই দম্ভোক্তি কি সত্যিই কার্যকরী হয়েছিল?

সুবৰ্ণলতা নামের বেঁটার হাতে দড়ি পড়েছিল?

তা যদি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই চাপা ও মল্লিকা নামে মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়ে ওঠে নি?

সংসারে একটা ভয়াবহ তছনছ কাণ্ড ঘটে গেছে?

তা সেদিনের সেই পরিস্থিতি মনে করলে তাই মনে হয় বটে!

কিন্তু সেসবের কিছুই হয় নি, যথারীতিই সর্ববিধ অনুষ্ঠান সহকারে বিয়ে হয়ে গেছে।

না হবে কেন?

একেই তো জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে।

তাছাড়া বাঙালী মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষগুলোর মত এমন মজবুত জীব অল্পই আছে।

এরা জলে ডোবে না, আগুনে পোড়ে না, খাঁড়ায় কাটে না। মনে হয় গোল গেল সব গোল—, আবার দেখা যায়, কই কিছুই হল না।

আবার যথারীতি সংসারে ভাত চড়ে, ডাল চড়ে, খাওয়া-শোওয়া হয়, কচিগুলো বড়ো এবং বড়গুলো বুড়ো হতে থাকে, এবং তিন বিধাতা ঘটিত ওই জীবনলীলা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে।

মুক্তকেশীর সংসারেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি।

বিয়েতে শাক বেজেছে, উলু পড়েছে, লোকজন খেয়েছে, জগু এসে বিরাট হাঁকডাক সহযোগে যজ্ঞি দেখেছে ও পরিবেশন করেছে এবং শ্যামসুন্দরীও অন্তঃপুরের অনেক কাজ সমাধা করেছেন। এবং মুক্তকেশী নাতজামাইদের নিয়ে রঙ্গরস করেছেন।

মোটের মাথায় অনুষ্ঠানের ক্রটি হয় নি।

শুধু বিরাজ তখন আর একবার মৃত সন্তানের জের টেনে আঁতুড়ঘরে বসে থেকেছে, আসতে পারে নি, আর আসা হয় নি। সুবালার।

সুবালার সংসারে তখন দু-দুটো বিপৎপাত।

একে তো ফুলেশ্বরী হঠাৎ মারা গেলেন, তার উপর হঠাৎ ওই অসময়েই ঘাড়ের উপর উঁচোনো খাঁড়াখানা ঘাড়ে পড়লো সুবালাদের।

অম্বিকা ধরা পড়লো।

অম্বিকার জেল হলো।

হবারই কথা।

আশঙ্কার প্রহরই তো গুনছিল। সে যাক–বিয়েতে যে আসা হল না সেটাই হচ্ছে কথা।

তবে সব শূন্যতার পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল মুক্তকেশীর সুরাজের আসায়।

বিয়েতে সুরাজ এসেছিল।

অবস্থা আরো ফিরেছে, স্বামীর আরো পদমর্যাদা হয়েছে। দুই ভাইঝিকে দু-দুখানা গহনা দিয়েছে।

আর তারপর?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *