1 of 2

২.১১ তারপর সুবৰ্ণলতা

তারপর? তারপর সুবৰ্ণলতা—

কিন্তু সুবৰ্ণলতা কী বা এমন মানুষ যে, তার প্রতিদিনকার দিনলিপি বাধানো খাতায় তোলা থাকবে, আর পর পর মেলে ধরে দেখতে পাওয়া যাবে! আ-বাধা একখানা খাতার ঝুরো কুরো পাতা থেকে সুবৰ্ণলতাকে দেখতে পাওয়া!

সুবৰ্ণলতা যখন নিজেই হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছিল সেই বুরো খাতার। প্রথম দিকে পৃষ্ঠাগুলো তখনই কি সবগুলোর সন্ধান মিলেছিল? কই আর?

শুধু ওর মাথা কুটে মরার দিনগুলোই—

হ্যাঁ, সাদাসিধে দিনগুলো সাদা কালিতে লেখার মত কখন যেন বাতাস লেগে মিলিয়ে গেছে, আর পৃষ্ঠাগুলোই ঝরে পড়েছে অদরকারী বলে, শুধু ওই মাথা কোটার মত দিনগুলোই গাঢ় কালিতে লেখা হয়ে–

কিন্তু মুশকিল। এই—কিসে যে সুবৰ্ণলতা মাথা কোটে বোঝা শক্ত।

কারো সঙ্গে মেলে না।

নইলে একটা জেলখাটা আসামী, কবে কোনদিনের একটু আলাপের সূত্র ধরে সুবৰ্ণলতার সঙ্গে দেখা করবার আবদার নিয়ে ওর বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখে ওর স্বামী-পুত্তুর তাকে দরজা থেকেই বিদায় দিয়েছিল বলে মাথা কোটে ও?

বলে, ভগবান, এ অপমানের মধ্যে আর কতদিন রাখবে আমায়! এবার ছুটি দাও, ছুটি দাও!

অথচ সত্যের মুখ চাইলে বলতে হয়, আসলে অপদস্থ যদি কেউ হয়ে থাকে তো সে সুবৰ্ণলতার স্বামী-পুত্ৰই হয়েছিল।

ওরা সাধারণ সংসারী মানুষ! অতএব একটা জেলখাটা আসামী সম্পর্কে সহসা হৃদয়দ্বার খুলে দিতে পারে না। তাই ঘরের দ্বার খুলে দেয় নি। ওরা জেরা করেছিল। বলেছিল, কি দরকার, কাকে চান, কতদিন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, সুবৰ্ণলতার সঙ্গে খুব কোন জরুরী প্রয়োজন যদি না থাকে, এত কষ্ট করে এতদূর আসবার মানে কি, ইত্যাদি ইত্যাদি!

বাড়ির কর্তা হিসাবে প্ৰবোধই করছিল প্রশ্ন, তবে ভানুও ছিল দাঁড়িয়ে। তা বাড়ির কর্তাকে বাড়ির নিরাপত্তা, পরিবারের সম্ভ্রম–এসব দেখতে হবে না? তাই দেখছিল প্ৰবোধ। সহসা দেখল সুবৰ্ণলতা অন্তঃপুরের সভ্যতার গণ্ডি ভেঙে বাড়ির বাইরে সদর রাস্তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

ভাবা যায়? দেখেছে। কেউ কখনো এমন দৃশ্য?

ওটা ওর স্বামীর পক্ষে লজ্জার নয়? অপমানের নয়?

তার উপর কিনা, প্ৰবোধ যখন রক্তবর্ণ মুখে বলেছে, তুমি বেরিয়ে এলে যে? এর মানে? ভানু, তোর মাকে বল বাড়ির মধ্যে যেতে—

তখন কিনা সুবৰ্ণলতা, তুমি স্বামীর দিকে দৃষ্টিপাত না করে বলে উঠলে, কী সর্বনাশ অম্বিকা ঠাকুরপো, তুমি এখানে? পালাও, পালাও! এ যে ভূতের বাড়ি! মেজবৌদির সঙ্গে দেখা করতে এসেছ? কী আশ্চৰ্য, কেউ তোমায় বলে দেয় নি সে কবে মরে ভূত হয়ে গেছে! এটা তার প্ৰেতাত্মার বাসভূমি!

এতে অপদস্থ হলো না তোমার স্বামী পুত্ৰ?

পরে যদি তোমার ছেলে বলেই থাকে, বাবা, তুমি বৃথা রাগ করছে, মা তো বেশি কিছু করেন নি! যা চিরকালের স্বভাব, তাই শুধু করেছেন। অন্যকে অপদস্থ করা, গুরুজনকে অপমান করাএটাই তো প্রকৃতি ওঁর, এতেই তো আনন্দ!—সেও কিছু অন্যায় বলে নি।

তার দৃষ্টিতে তো আজীবন ওইটাই দেখেছে সে।

আর সুবৰ্ণ, তুমি তো অম্বিকার সামনে শুধু ওইটুকু বলেই ক্ষান্ত হও নি? আরও বলেছ। অম্বিকা যখন তৎসত্ত্বেও প্ৰেতাত্মাকেই হেঁট হয়ে প্ৰণাম করতে গিয়েছিল, তুমি শশব্যাস্তে পা সরিয়ে নিয়ে বলেছি, ছিছি ভাই, প্ৰণাম করে আর পাপ বাড়িও না। আমার, একেই তো পূর্বজন্মের কত মহাপাপে বাঙালীর মেয়ে হয়ে জন্মেছি, আর আরও কত শত মহাপাপে এই মহাপুরুষদের ঘরে পড়েছি। আর কেন? প্ৰণাম বরং তোমাদেরই করা উচিত। তোমরা যা নিজের সুখ-দুঃখ তুচ্ছ করে দেশের গ্লানি ঘোচাতে চেষ্টা করছি।

কী? প্ৰবোধ যা বলেছে। তাছাড়া আর কি?

নাটক ছাড়া আর কি?

পুরো নাটক!

কিন্তু এই ঘরগেরস্ত লোকদের সংসারটা থিয়েটারের স্টেজ নয়। অথচ সারাজীবনে তুমি তা বুঝলে না। এখনও বুড়ো বয়সেও না।

তোমার কথায় যখন অম্বিকা স্নান হেসে বলেছিল, চেষ্টাই হয়েছে, কাজ আর কী হলো? সবটাই ব্যৰ্থতা! তখন তুমি নাটুকে ভাষাতেই উত্তর দিলে, কেন ব্যর্থতা জান ঠাকুরপো? তোমাদের সমাজের আধখানা অঙ্গ পাকে পোতা বলে। আধখানা অঙ্গ নিয়ে কে কবে এগোতে পারে বল? এ অখদ্যে অবদ্যে মেয়েমানুষ জাতটাকে যতদিন না। শুধু মানুষ বলে স্বীকার করতে পারবে ততদিন তোমাদের মুক্তি নেই, মুক্তির আশা নেই। চাকরানীকে পাশে নিয়ে। তোমরা রাজসিংহাসনে বসবে?

বললে!

একবার ভাবলে না, তোমার স্বামী-পুত্রের মাথাটা কতখানি হেঁট হলো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তোমার ওই নাটক করায়।

অগত্যাই ওদের কঠোর হতে হয়েছে।

অগত্যাই ধমকে উঠে বলতে হয়েছে, পাগলামি করবার আর জায়গা পাও নি? আর ওই পাগলামির দর্শককেও কটু গলায় বলতে হয়েছে, আপনিও তো আচ্ছা মশাই, ভদ্রলোকের ঘরের মান ইজ্জত বোঝেন না! দেখছেন একটা মাথা খারাপ মানুষ ঘর থেকে ছিটকে এসেছে—

এরপরেও অবশ্য কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।

অন্তত অম্বিকার মত শান্ত সভ্য মার্জিত স্বভাব লোকে নিশ্চয় পারে না। মাথা হেঁট করে চলে গিয়েছিল সে।

তবু সুবৰ্ণলতা তুমি হেসে বলে উঠেছিলে, ঠিক হয়েছে! কেমন জব্দ? ভূতের বাড়ি আসার ফল পেলে?

ভাবো নি। এরপরও তোমাকে তোমার স্বামী-পুত্রের সামনে মুখ দেখাতে হবে, পিছনের ওই চৌকাঠ পার হয়েই আবার ঢুকতে হবে।

 

কিন্তু ঢুকতে হলেই বা কি!

আবার এসে ঢোকে নি?

ঢুকেছে। আবার ঢুকেছে, আবার দাপট করেছে। মরমে মরে গিয়ে চুপ হয়ে যায় নি। এদিনও তা গেল না। যখন প্ৰবোধ গর্জে উঠলো, আর ভানু উপর্যুক্ত ধিক্কার দেবার ভাষা খুঁজে না পেয়ে শুধু ঘৃণার দৃষ্টিতে দগ্ধ করা যায়। কিনা তার চেষ্টা করলো, তখন কিনা সুবৰ্ণলতা বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে অনায়াসে বলে উঠলো, কী আশ্চর্য। এতে তোমাদের মুখ পোড়ানো হলো কোথায়? মুখ উজ্জ্বলাই হলো বরং। পাগল পাগলের মতই আচরণ করলো, চুকে গেল ল্যাঠা। তোমার কথার মান বজায় রাখলাম, আর বলছে কিনা মুখ পোড়ালাম?

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়েছিল সেদিন একা সুবৰ্ণলতার বড় ছেলেই নয়, মেজ-সেজও অগ্নিদৃষ্টি হেনে বলেছিল, চমৎকার! মার শোক হয়েছে ভেবে আর মমতা আসে নি। ওদের। ছোট ছেলে সুবলের কথাই শুধু বোঝা যায় না, সে বরাবরই মুখচোরা। সে যে কোথা থেকে তার এই চাপা স্বভাব পেয়েছে!

কিন্তু সুবৰ্ণলতার মেয়েরা?

যে মেয়ে দুটো এখনো পরের ঘরে যায় নি? পারুল আর বকুল?

তা ওদের কথাও বোঝা যায় নি।

মনে হচ্ছিল ওদের চোখে একটা দিশেহারা ভাব ফুটে উঠেছিল। যেন ওরা ঠিক করতে পারছিল না, মায়ের উপরে বরাবর যে ঘৃণা আর বিরক্তি পোষণ করে এসেছে, সেটাই আরো পুষ্ট করবে, না নতুন চিন্তা করবে?

বকুল ছেলেমানুষ।

এত সব ভাববার বয়স হয় নি তার।

কিন্তু তাই কি?

সুবৰ্ণলতার ছেলেমেয়েরা ছেলেমানুষ থাকবার অবকাশ পেল কবে? জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত তো ওরা শুধু ওদের মাকে বিশ্লেষণ করেছে, তার তিক্ততা অর্জন করেছে। তাই করতে করতেই বড় হয়ে উঠেছে।

ওরা অনেক কিছু জেনে বুঝে পরিপক্ক।

বাপকে ওরা ঘৃণা করে না, করে অবহেলা। কিন্তু মাকে তা পারে না। মাকে অবহেলাও করতে পারে না, অস্বীকারও করতে পারে না, তাই ঘৃণা করে।

শুধু আজই যেন ওদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাচ্ছে। অম্বিকার ফিরে চলে যাওয়ার মধ্যে ওরা বুঝি সমস্ত মেয়েমানুষ জাতটার দুঃসহ অসহায়তা টের পেয়ে গেছে। তাই দিশেহারা হয়ে ভাবছে, গৃহিণী শব্দটা কি তাহলে একটা ছেলেভোলানো শব্দ? নাকি দাসী শব্দেরই আর একটা পরিভাষা?

গৃহিণীর যদি তার গৃহের দরজায় এসে দাঁড়ানো একটা অতিথিকে এসো বসো বলে ডাকবার অধিকারটুকুমাত্র না থাকে, তবে গৃহিণী শব্দটা ধোকাবাজি ছাড়া আর কি? ওই ধোকায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দিয়ে দাসত্ত্ব করিয়ে নেওয়া!

সংসার করা মানে তা হলে শুধু সংসারের পরিচর্যা করা, আর কিছু না! আশ্চর্য, যেখানে এক কানাকড়াও অধিকার নেই, সেখানে কেন এই গালভরা নাম?

খুব স্পষ্ট করে মনে না পড়লেও মেজপিসীর বাড়ি গিয়ে থাকার কথাটা পারুলের কিছু কিছু মনে আছে বৈকি। মনে আছে অম্বিকাকাকার নাম, তাছাড়া ছেলেবেলায় কতবারই না। শুনেছে সে নাম মায়ের মুখে। কত শ্রদ্ধার সঙ্গে, কত প্রীতির সঙ্গে, কত মেহের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে সে নাম। অথচ সেই মানুষটাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হলো সুবৰ্ণলতারই সামনে!

গৃহিণীর সম্ভ্রম দিয়ে সুবৰ্ণলতার ক্ষমতা হলো না তাকে ডেকে এনে ঘরে বসাবার!

পারুল দেখেছে সেই অক্ষমতা। হয়তো বকুলও দেখেছে। আর অনুভব করেছে, এ অক্ষমতা বুঝি একা সুবৰ্ণলতারই নয়।

তাই দৃষ্টিভঙ্গী পালটাচ্ছে ওদের।

 

কিন্তু সুবৰ্ণলতার বাপ-মায়ের সেই চতুর্থী শ্রাদ্ধের কি হলো? খুব একটা সমারোহের আয়োজন করেছিল না তার স্বামী ওই উপলক্ষে। বলে বেড়াচ্ছিল, না বাবা, এ হলো গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীর দায়, পিতৃমাতৃদায়ের চতুর্গুণ!

তা সেও একরকম ধাষ্টামো করেই হলো বৈকি। সহজ সাধারণ কিছু হলো না। হবে কোথা থেকে?

সহজে কিছু কি হতে দেয় সুবৰ্ণলতা? সব কিছুকেই তো বিকৃত করে ছাড়ে ও!

সুবৰ্ণলতা তাই বলে বসলো, আমি ওসব করবো না।

করবে না? ভূজ্যি উছুণ্ড্যও করবে তুমি মা-বাপের?

না।

না!

শব্দজগতের চরমতম কঠোর শব্দ।

নিষ্ঠুর, অমোঘ।

আশ্চর্য, আশ্চর্য!

অত সব আয়োজন তাহলে?

নষ্ট গেল?

আবার কি!

পুরোহিত এসে শুনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাছাড়া আর করবেন কি? প্ৰবোধ যদি বা বলেছিল— ওর তো আবার জ্বর হয়ে গেছে রাত থেকে–কাজ আর হবে কি? জ্বর গায়ে তো— কিন্তু সুবৰ্ণলতা তো সে কথাকে দাঁড়াতে দেয় নি। বলে উঠেছিল, উনি ঠিক জানেন না ঠাকুরমশাই, জ্বর-টর কিছু হয় নি আমার—

জ্বর-টর হয় নি? তবে?

কিছু না। ইচ্ছে নেই সেটাই কথা!

পুরোহিত একবার প্রবোধের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন শালগ্রামশিলাকে উঠিয়ে নিয়ে!

এ বাহাদুরিটুকুও কি না দেখালে চলতো না? হেরে যাওয়া গলায় বলেছিল প্ৰবোধ, ও-বাড়ির পুরুত উনি—

সুবৰ্ণলতা চুপ করে তাকিয়ে ছিল।

প্ৰবোধ আবার বলেছিল, চিরকালের গুরুবংশের ছেলে–

জানি, সুবৰ্ণলতাও প্রায় তেমনি হেরে যাওয়া গলায় উত্তর দিয়েছিল, গুরুবংশের ছেলে, পুরোহিতের কাজ করছেন, তাতে শালগ্রাম তাঁর সঙ্গে, আর জলজ্যান্ত মিথ্যে কথাটা কইতে ইচ্ছে হলো না।

হলো না।

হলো না তখন সে ইচ্ছে!

অথচ নিজেই সুবৰ্ণলতা ঘণ্টাকয়েক পরে শরীর খারাপ লাগছে, বোধ হয় জ্বর আসছে— বলে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো গিয়ে।

মিছিমিছিই বলল। বৈকি।

গা তো ঠাণ্ডা পাথর!

বললো কাদের? কেন, যত সব আত্মীয়-কুটুম্বদের! বাড়ি বাড়ি ঘুরে যাদের যাদের নেমন্তন করে এসেছে প্ৰবোধ, তার স্ত্রীর মা-বাপ মরার উপলক্ষে।

আর আত্মীয়দের মুখ দেখতে ইচ্ছে হয় নি বলে চাদর ঢাকা দিয়ে পড়ে আছে?

তবে সুবৰ্ণলতার পড়ে থাকার জন্যে কি কিছু আটকেছিল?

কিছু না। কিছু না।

প্ৰবোধের গুষ্টির সবাই এল, ভোজ খেল, সুবৰ্ণলতার শুয়ে থাকার জন্যে হা-হুতাশ করলো, চলে গেল।

সুবৰ্ণলতাই শুধু চাদর মুড়ি দিয়ে গলদঘর্ম হতে থাকলো।

কিন্তু সুবৰ্ণলতার মায়ের সেই চিঠিটা?

সেটার কি হলো?

সে চিঠি কি খুললো না সুবৰ্ণলতা? কবরের নীচে চিরঘুমন্ত করে রেখে দিল তার মায়ের অন্তিম বাণী?

এত অভিমান সুবৰ্ণলতার?

এত তেজ?

এত কাঠিন্য?

তা প্রথমটা তাই ছিল বটে। কতদিন যেন সেই খাম মুখবন্ধ হয়ে পড়ে রইল সুবৰ্ণলতার ট্রাঙ্কের নীচে কাপচোপড়ের তলায়।

কিন্তু সেই গভীর অন্তরাল থেকে সেই অবরুদ্ধবাণী অনুক্ষণ সুবৰ্ণলতার সমগ্ৰ চেতনাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলেছে, সুবৰ্ণ, তুমি কি পাগল? সুবর্ণ, এ তুমি কী করছো? আর তারপর হতাশ হতাশ গলায় বলেছে, সুবৰ্ণ, তোমার এই অভিমানের মর্ম কে বুঝবে? কে দেবে তার মূল্য?

অবশেষে একদিন এই ধাক্কা অসহ্য হলো। সুবর্ণ ট্রাঙ্কের তলা থেকে ওর মায়ের সেই অন্তিমবাণী টেনে বার করলো।

দিনটা ছিল একটা রবিবারের দুপুর। যদিও জ্যৈষ্ঠ মাস, তবু কেমন যেন ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা মেঘলা দুপুর। আকাশটা যেন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কোনো রকমে দিনসই করেই সন্ধ্যার কুলায় আশ্রয় নেবো নেবো করছে। বাড়ি থেকে কারো বেরোবার কথা নয়, তবু আকস্মিক একটা যোগাযোগে আশ্চর্য রকমের নির্জন ছিল বাড়িটা।

গিরিবালার সাবিত্রীব্রতের উদযাপন সেদিন। সেই উপলক্ষে ব্ৰাহ্মণভোজনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মজন-ভোজনেরও ব্যবস্থা করেছিল সে, তাই ভাসুরের বাড়ির সবাইকে নেমন্তন করে পাঠিয়েছিল ছেলেকে দিয়ে।

কবে যেন ব্ৰতটা ধরেছিল গিরিবালা?

সুবৰ্ণ ও বাড়িতে থাকতেই না?

উদযাপনের খবর মনে পড়েছিল বটে সুবর্ণর। কারণ ওই ব্ৰতটাকে উপলক্ষ করে অজস্রবারের মধ্যে আরো একবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল সুবৰ্ণকে।

মুক্তকেশী বলেছিলেন, বড়বৌমার কথা বাদ দিই, ওর না হয় ক্ষ্যামতা নেই, কিন্তু তোমার সোয়ামীর পয়সা তো ওর সোয়ামীর চেয়ে কম নয়। মেজবৌমা, খরুচে বত্তটায় সেজবৌমা ব্ৰতী হলো, আর তুমি অক্ষমের মতন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখবে?

হয়তো ইদানীং গিরিবালার স্বাধীনতাও ভাল লাগছিল না মুক্তকেশীর, তাই এক প্রতিপক্ষকে দিয়ে আর এক প্রতিপক্ষকে খর্ব করবার বাসনাতেই এ উস্কানি দিচ্ছিলেন। কিন্তু সুবৰ্ণলতা তার ইচ্ছে সফল করে নি, সে অমানবদনে বলেছিল, ও ধাষ্টামোতে আমার রুচি নেই।

ধাষ্টামো!

সাবিত্রীব্ৰত ধাষ্টামো! মুক্তকেশী স্তম্ভিত দৃষ্টি ফেলে বোবা হয়ে তাকিয়ে ছিলেন।

গিরিবালাও মুখ লাল করে বলে উঠেছিল, এ কথার মানে কি মেজদি?

মেজদি আরো অম্লানবদনে বলেছিল, মানে খুব সোজা। যার সবটাই ফাঁকা তা নিয়ে আড়ম্বর করাটা ফাঁকি ছাড়া আর কি? অন্যকে ধোকা দেওয়া, আর নিজেকে ফাঁকি দেওয়া, এই তো? সেটাই

স্বামীভক্তিটা তাহলে হাসির বস্তু?

সুবৰ্ণলতা হেসে উঠে বলেছিল, ক্ষেত্রবিশেষে নিশ্চয় হাসির। ফুল-চন্দন নিয়ে স্বামীর পা পূজো করতে বসেছি আমরা, একথা ভাবতে গিয়েই সে হাসি উথলে উঠছে আমার!

নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার কোরো না মেজদি, ভক্তি যার আছে—

মেজদি এ ধিক্কারকে নস্যাৎ করে দিয়ে আরো হেসে বলেছিল, ভক্তি? ওই ভেবে মনকে চোখ ঠারা, এর মধ্যে ভক্তিও নেই, মুক্তিও নেই। সেজবৌ। আছে শুধু শখ অহমিকা!

সেই অকথ্য উক্তির পর বাড়িতে কোট-কাছারি বসে গিয়েছিল। যে দ্যাওর ডেকে কথা। আর কইত না ইদানীং, সেও এসে ডেকে বলেছিল, বিষটা নিজের মধ্যে থাকলেই তো ভাল ছিল মেজবৌ, অন্যের সরল মনে গরল ঢেলে দেবার দরকার কি? স্বামীকে সত্যবান হতে হবে। তবে স্ত্রীরা সাবিত্রী হবে, নচেৎ নয়, এমন বিলিতি কথার চাষ আর নাই বা করলে বাড়িতে!

আর প্রবোধ বাড়ি ফিরে ঘটনা শুনে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে গিয়েছিল, বলেছিল, হবে বিদেয় হতেই হবে। আমায় এ বাড়ি থেকে। এভাবে আর-

সুবৰ্ণলতা বলেছিল, আহা! এ সুমতি হবে তোমার? তাহলে পায়ে না হোক, মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক তোমার!

অবশ্য বিষমন্ত্র দেওয়া সত্ত্বেও ব্ৰত নেওয়া বন্ধ থাকেনি গিরিবালার, এবং দেখা যাচ্ছে চোদ্দ বছর ধরে নিষ্ঠা সহকারে পতিপূজা করে এখন সগৌরবের ব্ৰত উদযাপন করতে বসেছে সে।

সুবৰ্ণলতা কি ওর সুখী হবার ক্ষমতাকে ঈর্ষা করবে?

না। সুবৰ্ণলতা শুধু হাসবে?

তা এখন আর হেসে ওঠে নি। সুবর্ণ, শুধু ছেলেটাকে বলেছিল, যেতে পারবো না বাবা সুশীল, মাকে বলিস মেজজেঠির শরীর ভাল নেই। আর সবাই যাবে।

সেই উৎসবে যোগ দিতে চলে গেছে সুবর্ণর স্বামী, সন্তানেরা। অবশ্য পারুল বাদে। পারুলের থেকে বয়সে ছোট খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে, পারুর হয় নি, এই অপরাধে প্ৰবোধ বলেছিল, ওরা যাওয়ার দরকার নেই।

পারু মনে মনে বলেছে, বাঁচলাম।

কে জানে, হয়তো বাড়ির কোন কোণে একখানা বই নিয়ে পড়ে আছে পারুল, হয়তো বা তার কবিতার খাতাটা নিয়েও বসতে পারে, এই অকস্মাৎ পেয়ে যাওয়া একখণ্ড অবসরের সুযোগে। সুবর্ণ জানে, পারু তার নির্জনতায় ব্যাঘাত ঘটাবে না।

কিন্তু তখন কি ভেবেছিল সুবৰ্ণ, ওরা চলে গেলে মায়ের চিঠিখানা খুলবো।

আমি?

তা ভাবে নি।

শুধু অনেকটা কলকোলাহলের পর হঠাৎ বাড়িটা ঠাণ্ডা মেরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ানক একটা মন উচাটন ভাব হয়েছিল সুবৰ্ণর!

আর তখনই মনে হয়েছিল ওর, আমি কি সেজবৌয়ের সুখী হওয়ার ক্ষমতাকে হিংসে করছি?… তা নয়তো কেন আজই এত করে। মনে আসছে। সারাজীবন আমি কি করলাম!

অবিশ্রান্ত একটা প্ৰাণপণ যুদ্ধ ছাড়া আর কোনোখানে যেন কিছু চোখে পড়ে না। কোথাও যে একটু সুশীতল ছায়া আছে, কোনোখানে যে একবিন্দু তৃষ্ণার জল মিলেছিল, সে কথা যেন ভুলেই যাচ্ছে সুবর্ণ। সুবর্ণ দেখতে পাচ্ছে অবিরত সে শুধু আক্রমণ ঠেকাচ্ছে, তবু এগিয়ে যাবার চেষ্টায় নিজেকে ছিন্নভিন্ন করেছে।

নিজের উপর করুণায় আর মমতায় চোখে জল এসে গেল সুবর্ণর, ভিতরটা যেন হাহাকার করে উঠলো, আর তখনই মনে হলো, দেখব। আজ আমি দেখব–ভগবান আমাকে শেষ কি উপহার

খাম ছিঁড়তে হাত কাঁপছিল সুবর্ণর, আর বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছিল। যেন ওটা ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মস্ত একটা কিছু ফুরিয়ে যাবে ওর।

কী সে?

পরম একটা আশা?

নাকি ওই খামটার মধ্যে ওর মা এখনও জীবন্ত রয়েছে, খোলার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলবো?

তা তেমনি একটা কষ্টের মধ্যেই খামটা খুললো সুবৰ্ণলতা। আর তার পরই একটা জলের পর্দা যেন ঢেকে দিল সমস্ত বিশ্বচরাচর . কাপসা হয়ে গেল কালো কালো অক্ষরের সারি, ঝাঁপসা হয়ে গেল বুঝি নিজের ওই কাগজ ধরা হাতখানাও। পর্দাটা পড়ে যাবার আগে শুধু একটা শব্দ ঝলসে উঠেছিল–সেই শব্দটাই বাজতে লাগলো মাথার মধ্যে।

কল্যাণীয়াসু

সুবৰ্ণ-

কল্যাণীয়াসু… সুবর্ণ।

এ নাম তা হলে মনে রেখেছে সুবর্ণর মা?

আজো কেউ তা হলে সুবর্ণ নামে ডাকে তাকে?

না না, কোনোদিন ডাকে নি, কোনোদিনও আর ডাকবে না। শুধু নামটা মনে রেখেছিল, অথচ একদিনের জন্যে সেই মনে রাখার প্রমাণ দেয় নি সে।

জলের পর্দাটা মুছে ফেলবার কথা মনে পড়ে নি। সুবর্ণর। যতক্ষণে বাতাসে শুকিয়ে গেল, বুঝিবা বেশিই শুকিয়ে গেল, ততক্ষণে ওই কল্যাণ সম্বোধনের পরবর্তী কথাগুলো চোখে পড়লো।

কল্যাণীয়াসু—

সুবৰ্ণ,

বহুদিন পূর্বে মরিয়া যাওয়া কোনো লোক চিতার তাল হইতে উঠিয়া আসিয়া কথা কহিতেছে

দেখিলে যেরূপ বিস্ময় হয়, বোধ হয় সেইরূপ বিস্ময় বোধ করিতেছ! আর নিশ্চয় ভাবিতেছ, কেন আর? কি দরকার ছিল?

কথাটা সত্য, আমিও সে কথা ভাবিতেছি। শুধু আজ নয়, দীর্ঘদিন ধরিয়া ভাবিতেছি। যেদিন তোমাকে ভাগ্যের কোলে সমৰ্পণ করিয়া চলিয়া আসিয়াছি, সেইদিন হইতেই এই পত্র লেখার কথা ভাবিয়াছি, এবং দ্বিধাগ্ৰস্ত হইয়াছি। ভাবিয়াছি, কেন আর? আমি তো তাহার আর কোনো উপকারে লাগিব না! (জলের পর্দাটা আবার দুলে উঠেছে, সেই সঙ্গে সুবর্ণর ব্যাকুল আবেগ।… মা, মা, সেটাই তো পরম উপকার হতো! তোমার হাতের অক্ষর, তোমার স্নেহ-সম্বোধন, তোমার সুবর্ণ নামে ডেকে ওঠা, হয়তো জীবনের গতি বদলে দিতো তোমার সুবৰ্ণর!) তথাপি বরাবর ইচ্ছা হইতে তোমায় একটি পত্র দিই। তবু দেওয়া হয় নাই। সে অপরাধের ক্ষমা নাই।

জীবনের এই শেষপ্রান্তে আসিয়া পৌঁছাইয়া মনের সঙ্গে যে শেষ বোঝাপড়া করিতেছি, তাহাতেই আজ এই সত্য নির্ধারণ করিতেছি, তোমাকে আমন করিয়া নিষ্ঠুর ভাগ্যের মুখে ফেলিয়া আসা আমার উচিত হয় নাই। হয়তো তোমার জন্য আমার কিছু করবার ছিল।

তবু ভগবানের দয়ায় তুমি হয়তো ভালই আছে। তোমার ছোড়দার কাছে জানিয়াছিলাম তোমার কয়েকটি সন্তান হইয়াছে ও খাইয়া পরিয়া একরকম সুখেই আছো। তবু এমনই আশ্চৰ্য, চিরদিনই মনে হইয়াছে তুমি বোধ হয় সুখে নাই।… (মা মা, তুমি কি অন্তর্যামী? সত্যই দুঃখী, বড় দুঃখী, তোমার সুবর্ণ চিরদুঃখী!) এই অদ্ভুত চিন্তা বোধ করি মাতৃ হৃদয়ের চিররহস্য—যদিও মাতৃহৃদয়ের গৌরব করা আমার শোভা পায় না!… কিন্তু সুবর্ণ, ভাবিতেছি। তুমি কি আমার চিঠির ভাষা বুঝিতে পারিতেছ? জানি না তোমার জীবন কোন পথে প্রবাহিত হইয়াছে, জানি না তুমি সে জীবনে শিক্ষাদীক্ষার কোনো সুযোগ পাইয়াছ কিনা! আজ তুমিও আমার অপরিচিত, আমিও তোমার অপরিচিত।

কিন্তু সত্যই কি তাই?

সত্যই কি আমরা অপরিচিত?

তবে কেন সর্বদাই মনে হয়, সুবর্ণ ভাঙ্গিয়া পড়ে নাই, সুবর্ণ ভাঙ্গিয়া পড়িতে পারে না। সে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে করিতে অগ্রসর হইতে পরিবে। তোমার মধ্যে সে অন্ধুর ছিল। যে কয়টি দিন তোমাকে দেখিবার সুযোগ পাইয়াছি, তাহাতে উক্ত ধারণাই বদ্ধমূল ছিল।

তাই মনে হয়, তুমি হয়তো তোমার হৃদয়হীন মাকে কতকটা বুঝিতে পারো। হয়তো অবিরত ধিক্কার দিবার পরিবর্তে একবার একটু ভালবাসার মন নিয়ে চিন্তা করে।া!

একদা সংসারের প্রতি বিশ্বাস হারাইয়া সংসার হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম। তুমি জানো, তোমাকে উপলক্ষ করিয়াই সেই ঝড়ের সৃষ্টি। বেশি বিশদ করিয়া সেসব কথা লিখিতে চাহি না। তবে এই সুদীর্ঘকাল সংসার হইতে দূরে থাকিয়া অবিরত মানুষকে বিশ্লেষণ করিতে করিতে এইটা বুঝিয়াছি। এ সংসারে যাহাদের অন্যায়কারী বলিয়া চিহ্নিত করা হয়, তাহারা সকলেই হয়তো শাস্তির যোগ্য নয়। তাহারা যা কিছু করে, তার সবটাই দুষ্টবুদ্ধি প্রণোদিত হইয়া করে না। অধিকাংশ করে না। বুঝিয়া। তাহাদের বুদ্ধিহীনতাই তাহাদের অঘটন ঘটাইবার কারণ। কাজেই তাহারা ক্রোধের যোগ্যও নয়। তাহারা বড় জোর বিরক্তির পাত্র এবং করুণার পাত্ৰ।

কিন্তু যখন এই বুদ্ধিহীনতার সঙ্গে একটা জীবনমরণের প্রশ্নের সংঘর্ষ লাগে, তখন মাথা ঠাণ্ডা রাখিয়া বিচার করা সহজ নয়। আর এও জানি, সেদিন আমার পক্ষে এ ছাড়া আর কিছু সম্ভব ছিল না। … তোমার পিতা ও ভ্রাতারা আমাকে ফিরাইয়া লইয়া যাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছেন, পত্রে কোনো কাজ না হওয়ায়, কাশীতে আসিয়াও অনুরোধ উপরোধ ও তিরস্কার করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু যাহা ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি, তাহা আর হাতে তুলিয়া লওয়া চলে না। সেই ফেলিয়া আসা সংসার-জীবনের সহিত আবার নিজেকে খাপ খাওয়ানোও অসম্ভব। তুমি জানো হয়তো, তোমার দাদামহাশয় তখন কাশীবাসী। তাঁহার কাছে সংস্কৃত শিক্ষা করিয়া তদানীন্তন বহু কাশীবাসী পণ্ডিতের নিকট নানা শাস্ত্ৰ অধ্যয়ন করিয়া সন্ধান করিয়াছি হিন্দু বিবাহের মূল তাৎপর্য কি, মূল লক্ষ্য কি, এ বন্ধন যথার্থই জন্ম-জন্মান্তরের কিনা। কিন্তু যখনই প্রশ্ন তুলিয়াছি, এই বন্ধনের দৃঢ়তা পুরুষ ও নারীর পক্ষে সমান নয়। কেন, পুরুষের পক্ষে বিবাহ একটি ঘটনা মাত্ৰ, অথচ নারীর পক্ষে চির-অলঙ্ঘ্য কেন, সদুত্তর পাই নাই। উপরন্তু এই প্রশ্নের অপরাধে অনেক স্নেহশীল পণ্ডিতের স্নেহ হারাইয়াছি। ক্রমশ বুঝিয়াছি। এর উত্তর পুরুষ দিতে পরিবে না, ভবিষ্যৎ কালই দিবে। কারণ কোনো একটি সম্পত্তিতে ভোগ-দখলকারী ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সহজে দানপত্র লিখিয়া দেয় না।… স্ত্রীলোকের যাহা কিছুতে অনধিকার, তাহার অধিকার অর্জন করিতে হইবে স্ত্রীজাতিকেই।

কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্যের!

ইহাই সার কথা, ধৈর্য ব্যতিরেকে কোনো কাজই সফল হয় না। এই কথাটি বুঝিতে আমার সমগ্র জীবনটি লাগিয়াছে, আর এই কথাই মনে হইয়াছে, একথা বলিয়া যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কে কান দিবে? তোমাকে বলিবার ইচ্ছা হইয়াছে, সঙ্কোচে কুণ্ঠায় নীরব থাকিয়াছি। তাছাড়া এই ভয়ও ছিল, হয়তো আমার পুত্র তোমার সাংসারিক জীবনে অশান্তির সৃষ্টি করবে। তাই ইহা আমার মৃত্যুর পর তোমার হাতে পৌঁছাইবার নির্দেশ দিয়াছি। হয়তো তখন তোমার এই সংসারত্যাগিনী মাকে তোমার স্বামীর সংসার একটু সদায়চিত্তে বিচার করিবে। হয়তো ভাবিবে উহাকে দিয়া আর কি ক্ষতির সম্ভাবনা?

তোমাকে এত কথা লিখিতেছি, কারণ বুদ্ধি ও যুক্তির দ্বারা বুঝি, তুমি এখন একটি বয়স্কা গৃহিণী। কিন্তু মা সুবর্ণ, তোকে যখন দেখিতে চেষ্টা করি, তখন একটি ক্ষুদ্র বালিকা ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাই না। পরনে ঘাগরা, মাথায় চুল বেণী করিয়া বাধা, হাতে বই-খাতা-স্লেট, একটি স্কুলপথযাত্ৰিণী বালিকা!

তোর এই মূর্তিটি ভিন্ন আর কোনো মূর্তিই আমার মনে পড়ে না। এই মূর্তিই আমার সুবর্ণ! সেই যে তোকে তোর স্কুলে পাঠাইয়া দিয়া দরজায় দাঁড়াইয়া থাকি,তাম, সেই মূর্তিটাই মনের মধ্যে আঁকা আছে।

কিন্তু তেমন ইচ্ছা করিলে কি আমি তোমায় আর একবার দেখিতে পাইতাম না? আর তেমন ইচ্ছা হওয়াই তো উচিত ছিল। কিন্তু সত্য কথা বলি, তোমার সেই মূর্তিটি ছাড়া আর কোনো মূর্তিই আমার দেখিতে ইচ্ছা ছিল না।… তোমাকে লইয়া আমার অনেক আশা ছিল, অনেক সাধ-স্বপ্ন ছিল, কিন্তু সব আশাই চূর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তবু ওই মূর্তিটা আর চুর্ণ করিতে ইচ্ছা হয় নাই।… তুমি হয়তো ভাবিতেছ। এসব কথা এখন আর লিখিবার অর্থ কি? হয়তো কিছুই অর্থ নাই, তবু মানুষের সব চেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষাই বুঝি কেহ তাহাকে যথার্থ করিয়া বুকুক!… আমাকে কেহ বুঝিল না—এর বড়ো আক্ষেপ বোধ হয়। আর কিছুই নাই। পুরুষমানুষের একটা কর্মজীবন আছে, সেখানে তাহার গুণ কর্ম রুচি প্রকৃতির বিচার আছে। সেখানেই তাহার জীবনের সার্থকতা অসাৰ্থকতা। মেয়েমানুষের তো সে জীবন নাই, তাই তাহার একান্ত ইচ্ছা হয়, আর কেহ না বুঝুক, তাহার সন্তান যেন তাহাকে বুঝে, যেন তাহার জন্য একটু শ্রদ্ধা রাখে, একটু মমতার নিঃশ্বাস ফেলে! সেইটুকুই তার জীবনের যথার্থ সার্থকতা। হয়তো মৃত্যুর পরেও এ ইচ্ছা মরে না, তাই এই পত্র।

হয়তো তুমি চিরদিনই তোমার মমতাহীন মোকাধিকাৰ দিয়াছ, কিন্তু মৃত্যুর পরও যদি সে ভাবের পরিবর্তন হয়, বুঝিবা আত্মা কিঞ্চিৎ শান্তিলাভ করিবে। তাই মৃত্যুর দ্বারে আসিয়া এই পত্র লিখিবার বাসনা।

সুবৰ্ণ, তুমি আমাকে ভুল বুঝিও না।

তোমার ছোড়দাদা মোগলসরাইতে কাজ করে, মাঝে মাঝে আসে। নিষেধ শোনে না। মনে হয় সে হয়তো আমাকে কিছুটা বোঝে, তাই কখনো তোমার দাদার মত মায়ের অপরাধের বিচার করিতে বসে না। এখানে আসিয়াই আমি যে মেয়ে-স্কুলটি গড়িয়াছিলাম, তাহার পরিসর এখন যথেষ্ট বাড়িয়া গিয়াছে। তোমার ছোড়দা স্বেচ্ছায় মাঝে মাঝে তাহার দেখাশুনা করে। মনে হয়, আমার মৃত্যুর পর স্কুলটি টিকিয়া থাকিতেও পারে। প্রথম প্রথম বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া ছাত্রী সংগ্ৰহ করিতে হইত। ক্রমশ অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়াছে, পিতামাতারা স্বেচ্ছায় আগাইয়া আসিতেছেন, এবং অনুধাবন

আশা হয় এইভাবেই কালের চেহারার পরিবর্তন হইবে। মানুষের বুদ্ধি বা শুভবুদ্ধি সহজে যাহঃ করিয়া তুলিতে সক্ষম না হয়, প্রয়োজন আর ঘটনাপ্রবাহই তাহাকে সম্ভব করিয়া তোলে।

কেবলমাত্র পুঁথিপত্রে বা কাব্যে-গানে নহে, ভবিষ্যতে জগতের সর্বক্ষেত্রেই পুরুষমানুষকে একথা স্বীকার করিতেই হইবে—মেয়েমানুষও মানুষ! বিধাতা তাহাদেরও সেই মানুষের অধিকার ও কর্মদক্ষতা দিয়াই পৃথিবীতে পাঠাইয়াছেন! এক পক্ষের সুবিধা সম্পাদনের জন্যই তাহাদের সৃষ্টি নয়।

মহাকালই পুরুষজাতিকে এ শিক্ষা দিবে।

তবে এই কথাই বলি–এর জন্য মেয়েদেরও তপস্যা চাই। ধৈর্যের, সহ্যের, ত্যাগের এবং ক্ষমার তপস্যা।

মনে করিও না উপদেশ দিতে বসিয়াছি।

সময়ে যাহা দিই নাই, এখন এই অসময়ে আর তাহা দিতে বসিব না। শুধু নিজের সমগ্র জীবন দিয়া যাহা উপলব্ধি করিয়াছি, সেই কথাটি কাহাকেও বলিয়া যাইতে ইচ্ছা হইতেছে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর কাহাকে বলিব? আর কে-ই বা কান দিয়া শুনিবে? স্ত্রীলোকেরা তো আজও অজ্ঞতার অহঙ্কার ও মিথ্যা স্বর্গের মোহো তমসাচ্ছন। তাহারা যেন বিচারবুদ্ধির ধার ধারিতেই চাহে না। ভাবনা হয় সহসা যেদিন তাহাদের চোখ ফুটিবে, যেদিন বুঝিতে শিখিবে ওই স্বর্গের স্বরূপ কি, সেদিন কি হইবে! বোধ করি সেদিনের পথনিৰ্ণয় আরো শতগুণ কঠিন।

তবু এখানে বহু তীর্থবাসিনী ও নানান অবস্থার স্ত্রীলোকদের সংস্পর্শে আসিয়া, এবং আপন জীবন পর্যালোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, যদি সংসারের মধ্যে থাকিয়াই জীবনের সর্ববিধ উৎকর্ষ সাধন করিয়া পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়, তাহাই প্রকৃত পূর্ণতা।

কিন্তু তেমন সম্ভব কয়জনের পক্ষেই বা সম্ভব? প্রতিকূল সংসার তো প্রতিনিয়তই আঘাত হানিয়া হানিয়া সে পূর্ণতার শক্তিকে খর্ব করিতে বদ্ধপরিকর।… মেয়েমানুষ মমতার বন্ধনে বন্দী,… মায়ের বাড়া নিরুপায় প্রাণী আর নাই, এ তথ্য বুঝিয়া ফেলিয়াই না পুরুষের গড়া সমাজ এতো সুবিধা নেয়, এতো অত্যাচার করিতে সাহসী হয়! তবে এ বিশ্বাস রাখি, একদিন এ দিনের অবসান হইবেই। দেশের পরাধীনতার দূর হইবে, স্ত্রীজাতির পরাধীনতাও দূর হইবে।

শুধু আশা করিতে ইচ্ছা হয়, ভবিষ্যৎ কালের সেই আলোকোজ্জ্বল দিনের মেয়েরা আজকের এই অন্ধকার দিনের মেয়েদের অবস্থা চিন্তা করিতে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিতেছে, আজকের দিনের মেয়েদের অবস্থা চিন্তা করিতে একবিন্দু অশ্রুবিসর্জন করিতেছে, আজ যাহারা যুদ্ধ করিতে করিতে প্ৰাণপাত করিল, তাহাদের দিকে একটু সশ্রদ্ধ দৃষ্টিপাত করিতেছে।

মা সুবৰ্ণ, এসব কথা না লিখিয়া যদি লিখিতাম— সুবৰ্ণ, এ যাবৎকোল প্রতিনিয়ত আমি তোমার জন্য কাঁদিয়াছি—হয়তো তুমি আমার হৃদয়টা শীঘ্ৰ বুঝিতে। কিন্তু সুবৰ্ণ, আমি তো শুধু আমার সুবৰ্ণর জন্যই কাদি নাই, দেশের সহস্ৰ সহস্র সুবৰ্ণলতার জন্য কাঁদিয়াছি! তাই এই সব কথা।

তাছাড়া অবিরত শুষ্ক জ্ঞানের চর্চায় কাটাইতে কাটাইতে ভাষাও শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, তাই মাঝে মাঝেই মনে হইতেছে, তুমি কি এত কথা বুঝিতে পারিতেছ! ন বছর বয়স হইতেই তো তোমার বিদ্যাশিক্ষায় ইতি হইয়াছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইতেছে, তুমিও নিশ্চয়ই এসব কথা ভাবো, তুমিও কেবলমাত্র নিজের কথাই নয়, আরো সহস্র মেয়ের কথা চিন্তা করো।

অধিক আর কি লিখিব, আমার শতকোটি আশীৰ্বাদ গ্ৰহণ করো। তোমার পরিজনবৰ্গকেও জানাইও। আর যদি সম্ভব হয়, তোমার এই চিরনিষ্ঠুর মাকে – অন্তত তার মৃত্যুর পরও ক্ষমা করিও।

ইতি
তোমার নিত্য আঃ মা।

 

অনেকবার অনেক ঝলক জল গালের উপর গড়িয়ে পড়েছে, অনেকবার সে জল শুকিয়েছে, এখন শুধু গালটায় লোনাজল শুকিয়ে যাওয়ার একটা অস্বস্তির অনুভূতি।

নাকি শুধু গালেই নয়, অসার অনুভূতি দেহমানের সর্বত্ৰ!

স্তব্ধ, মৃত্যুর মত স্তব্ধ!

যেন এ স্তব্ধতা আর ভাঙবে না কোনোদিন। এই স্তব্ধতার অন্তরালে বহে চলবে অন্তহীন একটা হাহাকার।

সুবৰ্ণর মা নিজেকে জানিয়ে গেল, সুবৰ্ণকে জেনে গেল না।

সুবৰ্ণর মা সন্দেহ করে.গেল সুবর্ণ এত সব কথা নিয়ে ভাবে কিন্য।

সুবৰ্ণর মা শুধু আশা করে গেল, হয়তো সুবৰ্ণ সহস্ৰ মেয়ের কথা ভাবে। আর কিছু নয়। আর কিছু করার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *