1 of 2

২.০৩ সুবৰ্ণলতাই বা এমন অনমনীয় কেন

কিন্তু সুবৰ্ণলতাই বা এমন অনমনীয় কেন?

কিছুতেই ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে না কেন? ভেঙে পড়তে পড়তে। আবার খাঁড়া হয়ে ওঠে। কেন? এত প্ৰতিবন্ধকতাতেও ধাড়ি মেয়ে পারুলকে সে স্কুলে ভর্তি করতে বদ্ধপরিকর কেন?

প্ৰবোধচন্দ্র বাইরে থেকে ঘুরে এসে রাগে গানগন করতে করতে বললো, এসব কি শুনছি! পাশের বাড়ির পরিমলবাবুর ছেলেকে দিয়ে নাকি

পারুকে ইস্কুলে ভর্তি করতে পাঠিয়েছিলে!

পাঠিয়েছিলাম তো –সুবৰ্ণ সহজ গলায় বলে, পারু বকু দুজনকেই।

চুলোয় যাক বকুল! পারুকে পাঠিয়েছিলে কী বলে?

এ পর্যন্ত ওটা ওর হয়ে ওঠে নি বলে।

হয়ে ওঠে নি বলে! প্ৰবোধ সহসা একটা কুৎসিত মুখভঙ্গী করে ওঠে, সেই ভয়ঙ্কর দরকারী কাজটা হয়ে ওঠে নি বলে রাজ্য রসাতলে গেছে? পৃথিবী উল্টে গেছে? চন্দ্ৰ-সূৰ্য খসে পড়েছে? তাই তুমি একটা ছোঁড়ার সঙ্গে ওই ধাড়ি ধিঙ্গী সোমত্ত মেয়েকে-

থামো! অসভ্যতা করো না।

ওঃ, বটে? অসভ্যতাটা হল আমার? আর তোমার কাজটা হয়েছে খুব সুসভ্য? পরের কাছে মুখাপেক্ষী হতেই বা গেলে কোন মুখে? এদিকে তো মানের জ্ঞান টনটনে!

অভাবে স্বভাব নষ্ট চিরকেলে কথা—, সুবর্ণ বলে, যার নিজের তিন কুলে করবার কেউ না। থাকে, পরের দরজায় হাত পাতবে এটাই স্বাভাবিক!

ওঃ! তোমার কেউ কিছু করে না? আচ্ছা নেমকহারাম মেয়েমানুষ বটে! বলে সারাটা জীবন এই ভেড়াটাকে একতিল স্বস্তি দিলে না, শান্তি দিলে না, বিশ্রাম দিলে না, নাকে দড়ি দিয়ে ছুটিয়ে মারলে, তবুও বলতে বাধছে না কেউ কিছু করে না?

সুবৰ্ণ স্থির স্বরে বলে, যা কিছু করেছ সব আমার জন্যে?

তা না তো কি? আমার জন্যে? আমার কী এত দরকার ছিল? মায়ের ছেলে মায়ের কাছে পড়ে থাকতাম—

সুবৰ্ণ ওই অপরিসীম ধৃষ্টতার দিকে তাকিয়ে বলে, শুধু মায়ের ছেলে? আর তোমার নিজের জঞ্জালের স্তূপ? তারা? তাদের কথা কে ভাবতো?

তারা তাদের বংশের ধারায় মানুষ হতো! এক-একটি সাহেব বিবি করে তোলার দরকার ছিল না কিছু। বলে দিচ্ছি, বকুল যায় যাক, পারুর কিছুতেই বিনুনি দুলিয়ে ইস্কুলে যাওয়া চলবে না, ব্যস!

পারু-যাবে।

কী বললে? আমি বারণ করছি। তবু পারু যাবে?

তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। আমি যা করেছি। বুঝেই করেছি। আর সেটা হবে। এই হচ্ছে আমার শেষ কথা!

শেষ কথা!

এই শেষ কথার উত্তরে আর কোন কথা বলতে পারতো সুবৰ্ণর স্বামী কে জানে, কিন্তু সুবর্ণর ছেলে কথা কয়ে উঠল। পাশের ঘর থেকে।

পাশের ঘরে কানু বসে খবরের কাগজ পড়ছিল এবং দু ঘরের মাঝখানের দরজা খোলা থাকার দরুন মা-বাপের প্ৰেমালাপ শুনছিল, হঠাৎ অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠলো, মার মুখে চিরদিনই র সমালোচনা শুনে এসেছি, আর স্বভাবতই ভেবে এসেছি দোষ তাদেরই। এখন বুঝতে পারছি গলদটা কোথায়!

বললো।

এই কথা বললো সুবর্ণর মেজ ছেলে।

অসহিষ্ণু হয়ে বলে উঠলো।

বাবা যখন মাকে নেমকহারাম মেয়েমানুষ বিশেষণে বিভূষিত করেছিল, তখন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে নি। সে, যখন বাবা নিজের মেয়ে সম্পর্কে শিথিল মন্তব্য করে রাগ প্ৰকাশ করেছিল তখনও চুপ করে থেকেছিল, অসহিষ্ণু হয়ে মন্তব্য প্রকাশ করে উঠল মায়ের দুঃসহ স্পর্ধায়।

বলে উঠলো, এখন বুঝতে পারছি গলদটা কোথায়!

কিন্তু আশ্চর্য, সুবর্ণলতা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল না তাকে, চীৎকার করে প্রতিবাদ করে উঠলো না করে উঠলো। না। সুবৰ্ণলতা যেন হঠাৎ চড়-খাওয়া মুখে শিথিল স্থলিত গলায় প্রশ্ন করল, কি বললি? কি বললি তুই?

বললো আর মাটিতে বসে পড়লো।

কানু মায়ের সেই নিষ্প্রভ অসহায় মুখের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে ও-ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে গোল খবরের কাগজখানা হাত থেকে আছড়ে ফেলে দিয়ে। কানুর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিত হল, আর কি, জানো তো খালি মূৰ্ছা যেতে, ওইতেই সবাইকে জব্দ করে রাখতে চাও।

আর কিছু করল না।

জল জল, পাখা পাখা বলে ব্যস্ত হলো মুক্তকেশীর ছেলে।

সুবৰ্ণলতার জীবনটা যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা, যে নাগপাশের বন্ধন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পায় নি সুবৰ্ণলতা।

সুবৰ্ণর সংসারত্যাগিনী মা নাকি সংসার ত্যাগের প্রাককালে বলে গিয়েছিল, ওটা নাগপাশই না। লতাপাতার বন্ধন, তাই দেখবে বাকী জীবনটা।

কিন্তু তাতে সুবৰ্ণর কি হলো?

সুবৰ্ণ কি পেল তা থেকে?

পেল না কিছু।

পায় না।

এইটাই যে নিয়ম পৃথিবীর, অনেক দিনের সাধনা চাই। এক যুগের তপস্যা আর সাধনা পরবর্তী যুগকে এনে দেয়। সাধনার সিদ্ধি, তপস্যার ফল। অনেক কেন আর অনেক বিদ্রোহ নিষ্ফল ক্ষোভে মাথা কুট কুটে মরে, তলিয়ে যায় অন্ধকারে, তারপর আসে আলোর দিন।

তবু–

যারা অন্ধকারে হারিয়ে গেল, তাদের জন্যেও রাখতে হবে বৈকি একবিন্দু ভালবাসা, একবিন্দু শ্রদ্ধা, একবিন্দু সমীহ।

হয়তো সুবৰ্ণলতার জন্যেও আসবে তা একদিন।

হয়তো সুবৰ্ণলতার আত্মা সেই পরমপ্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে একটু পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।

বলবে, সারাজীবন যার জন্যে জ্বলেছি আর জ্বালিয়েছি, পুড়েছি আর পুড়িয়েছি, কোথাও কোনোখানে তবে সার্থক হয়েছে সে!

কিন্তু কবে সেই পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাসটুকু ফেলতে পারে সুবৰ্ণলতার আত্মা?

আজো কি অগণিত সুবৰ্ণলতা মাথা কুটে মরছে না। এই আলোকোজ্জ্বল যুগের চোরাকুঠুরীর ঘরে? রুদ্ধ কণ্ঠে বলছে না, তোমরা শুধু সমাজের মলাটটুকু দেখেই বাহবা দিচ্ছ, আত্মপ্ৰশংসায় বিগলিত হচ্ছে, আত্মপ্রচারের জৌলুসে নিজেকেই নিজে বিভ্ৰান্ত করছ, খুলে দেখছি না। ওর ভিতরের পৃষ্ঠা? দেখ সেই ভিতরের পৃষ্ঠায় কোন অক্ষর, কোন ভাষা, কোন লিপি?

সেখানে যে অগণিত সুবৰ্ণলতা আজও অপেক্ষা করছে কবে পাপের শেষ হবে তার প্রতীক্ষ্ণয়!

বলছে না তারা—

কবে অহঙ্কারী পুরুষসমাজ খোলা গলায় স্বীকার করতে পারবে, তুমি আর আমি দুজনেই ঈশ্বর সৃষ্ট! তুমি আর আমি দুজনেই সমান প্রয়োজনীয়!

কবে ঈর্ষাপরায়ণ পুরুষসমাজ মুক্ত মনে বলতে পারবে, তোমাকে যে স্বীকৃতি দিতে পারি নি সেটা তোমার ক্রটির ফল নয়, আমার ক্রটির ফল! তোমার মহিমাকে মর্যাদা দিতে বাধে সেটা আমার দুর্বলতা, তোমার শক্তিকে প্ৰণাম করতে পারি না সেটা আমার দৈন্য। নিজেকে তোমার প্রভু ভাবার অভ্যাসটা ত্যাগ করতে আমার অভিমান আহত হয়। তাই দাস সেজে তোমায় রাণী করি। আজো তোমাকে মুগ্ধ করে মুঠোয় পুরে রাখতে চাই, তাই চাটুবাক্যে তোয়াজ করি। আর আমার শিল্পে সাহিত্যে কাব্যে সঙ্গীতে যে তোমার বন্দনাগান করি, সে শুধু নিজেকে বিকশিত করতে। তুমি আমার প্ৰদীপে আলোকিত হও এই আমার সাধ, আপন মহিমায় ভাস্বর হও এতে আমার আপত্তি। তাই তুমি যখন গুণের পরিচয় দাও তখন করুণার হাসি হেসে পিঠ চাপড়াই, যখন শক্তির পরিচয় দাও। তখন বিরক্তির ভ্রূকুটি নিয়ে বলি ডেপোমি, আর যখন বুদ্ধির পরিচয় দাও তখন তোমাকে খর্ব করবার জন্য উঠে পড়ে লাগি।…

তোমার রূপবতী মূর্তির কাছে আমি মুগ্ধ ভক্ত, তোমার ভোগবতী মূর্তির কাছে আমি বশম্বদ, তোমার সেবাময়ী মূর্তির কাছে আমি আত্মবিক্রীত, তোমার মাতৃ-মূর্তির কাছে আমি শিশু মাত্র।… কিন্তু এগুলি একান্তই আমার জন্যে হওয়া আবশ্যক। হ্যাঁ, আমাকে অবলম্বন করে যে তুমি সেই তুমিটিকেই মাত্র বরদাস্ত করতে পারি। আমি। তবে বাইরের তুমি হচ্ছে বিধাতার একটি হাস্যকর সৃষ্টি।

কে জানে কবে এসব বলতে পারে সুবৰ্ণলতার আত্মা!

হয়তো পাবেই না। এই তো পুরুষের হৃদয়রহস্য।

এই মনের ভাব খুলে বলতে পারবে কোনোদিন পুরুষসমাজ? মনে হয় না। শুধু আধুনিকতার বুলি আউড়ে দেখাবে, দেখ আমি কত উদার! আমি কত মুক্ত! যুগের রং লাগিয়ে লাগিয়ে বলবে, দেখ তোমাকে কত বর্ণাঢ্য করে তুলেছি। কিন্তু সে রং পুতুলের রং। প্রতিমায় প্ৰাণ প্রতিষ্ঠা করবার সাধনা নেই তার, পুতুলে রং লাগিয়েই খুশি। সেই রংচঙে পুতুলগুলি তুলে ধরবে বিশ্বসমক্ষে, বলবে, দেখেছ? দেখ দেখ আমাদের কত ঐশ্বৰ্য!

 

বিদ্যেবতীর আর বাড়ির বিদ্যেয় কুলোচ্ছে না?

খবরের কাগজখানা আছড়ে ফেলে দিয়ে কানু তীব্র বিরক্তিভারে এঘরে এসে পারুকে উদেশ করে বলে ওঠে। ওই কথাটি।

কানুর এই গায়ে পড়ে ব্যঙ্গ করতে আসায় রাঙা হয়ে উঠলো পারুর মুখ, ঠোঁটটা কামড়ে চুপ করে রইল। সুবৰ্ণলতার অন্তত-প্রকৃতির সঙ্গে হয়তো মিল আছে তার, মিল নেই বাইরের প্রকৃতির। চোপা করবার দুরন্ত ইচ্ছেকে দমন করে চুপ করে থাকে সে।

এখন চুপ করেই থাকে হাতের খোলা বইখানা মুড়ে।

কানু একবার তার সেই বইখানার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলে, নাটক-নভেলের তো শ্ৰাদ্ধ করেছো, ওই মাথায় আর যোগবিয়োগ গুণভাগ ঢুকবে?

পারুল এবার কথা কইলো।

বললো, ঢুকবে কিনা সে পরীক্ষা তো করা হয় নি!

ইস, কথা শেখা হয়েছে যে দেখছি খুব! নভেলের যা ফল! লেখাপড়া শেখা তোর কর্ম নয়, বুঝলি? আমার একটা বন্ধুর ছোট বোন, মানে তোর মতন একটা মেয়ে, আসছেবার এস্ট্রেন্স পরীক্ষা দেবে, বুঝলি? সে-সব মাথাই আলাদা।

মাথাটা নিয়েই বোধ হয় জন্মেছিল তোমার বন্ধুর বোন?

কানু ব্যঙ্গহাসি হেসে বলে, তা ছাড়া! তোমার দ্বারা কিসুদ হবে না, বুঝলে? শুধু মাতৃদেবীর মত বড় বড় কথা শিখবে তুমি!

পারু তার প্রকৃতিটা লজঘন করতে চায় না, তবু সে বলে ফেলে, মা ভাগ্যিস ওই বড় বড় কথাগুলো শিখেছিলেন মেজদা, তাই তোমারও এত বড় কথা বলার সুযোগ হচ্ছে!

সত্যি! বাঃ, বেশ বুদ্ধি হয়েছে তো দেখছি খেঁদুর। নাঃ, ভাল দেখে একটা বর তোকে দিতে হচ্ছে! বলে চলে যায়। কানু ভানুর মত অত সিরিয়াস নয়, তাই ব্যঙ্গই করে সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *