1 of 2

২.১৯ সুবৰ্ণলতার স্মৃতির পৃষ্ঠায়

কিন্তু সুবৰ্ণলতার স্মৃতির পৃষ্ঠায় কবিতা লেখার দিনের স্মৃতি আর কই? তার পাতায় পাতায় খাঁচার পাখীর ডানা ঝটপটানির শব্দটাই তো প্রখর।

তবে তাকে তার সেই স্মৃতির জানলা থেকে-কবিতা পড়তে দেখতে পাওয়া যায়। কে জানে কোথা থেকে সংগ্রহ করে, আর কেমন করেই বা পায় ছাড়পত্র, তবু দেখা যায়, যে বাড়িতে ছেলেদের পাঠ্যপুস্তক আর নতুন পঞ্জিকা ছাড়া আর কোনো বই আসত না, সে বাড়িতে কোণের দিকের একটা ঘরে খাটের তলায়, দেয়াল-আলমারিতে, জানলা-দরজার মাথার তাকে তাকে থাকে-থাকে জমে ওঠে বই, কাগজ, পত্রপত্রিকা।

হয়তো ঘরের প্রকৃত মালিক শাসন করে করে এলে গিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। নইলে কিশোরী সুবৰ্ণলতার স্মৃতির ইতিহাসে তার বই কেড়ে নিয়ে ফেলে দেওয়া, ছিঁড়ে ফেলা, পুড়িয়ে দেওয়া, সব কিছুর নজিরই তো আছে। শাসনকর্তা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়েছে। অথবা হয়তো দেখেছে, এতেই পাখীটা ঝটপটায় কম।

আরও পাখী তো আছ। এ-বাড়ির খাঁচায়, কই তারা তো এমন করে না! বরং তারা আড়ালে বলাবলি করে, ধন্যি বেহায়া মেয়েমানুষ বাবা, এত অপমানের পরও আবার সেই কাজ। আমার হলে বোধ হয়। আর এ বস্তু আঙুলের আগা দিয়েও ছুতাম না। আর মেজবাবুরও হচ্ছে মুখেই মর্দানি! বজ্রআঁটনি ফস্কা গেরো!

সুবৰ্ণলতা তার আড়ালের কথা টের পায় না। সুবৰ্ণলতা তার আপনি আবেগ আর অনুভূতির পরমণ্ডলে বিরাজ করে। তাকে বেহায়া বল বেহায়া, অবোধ বল অবোধ।

তা হয়তো এক হিসেবে অবোধই।

নইলে উমাশশীদের কাছেও এক এক সময় ছুটে যায় সে এক-একটা নতুন অনুভূতির আবেগ নিয়ে। হয়তো শীতের দুপুরে উমাশশী রোদে বসে বড়ি দিচ্ছে, গিরিবালা পশমের রং মিলিয়ে খুঞ্চোপোষ বুনছে আর বিন্দু রোদেই একটু গড়িয়ে নেবে বলে মাদুর বিছোচ্ছে, সুবর্ণ সেখানে যেন আছড়ে এসে পড়ে। উত্তেজিত আরক্ত মুখ আরো লালচে করে বলে, দিদি, জীবনভোর শুধু বড়িই দিলে, জানলে না। এ জগতের কোথায় কি আছে! শোনো, শোনো একবার, পুরুষ কবি কেমন করে ফুটিয়ে তুলেছেন মেয়েমনের কষ্ট-দুঃখ! বলে, কিন্তু চেয়ে দেখে না, ওরা। জগতের কোথায় কি আছে জািনবার জন্যে উদ্‌গ্ৰীব হয়ে তাকাচ্ছে, না পরস্পর কৌতুকদৃষ্টির বিনিময় করছে। কৌতুক তো করেই তারা সুবৰ্ণকে নিয়ে। ওটি যে একদিকে যেমন তেজী অহঙ্কারী আসপদ্দাবাজ, আর একদিকে তেমনি বদ্ধ পাগল। হাসবে না। ওকে নিয়ে?

ওরা সুবর্ণর ওই ছেলেদের পড়া মুখস্থর মতন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পদ্য পড়া দেখলে হাসে। বদ্ধ পাগলটা অবশ্য ততক্ষণে শুরু করে দিয়েছে

বেলা যে পড়ে এল জলকে চল।
পুরনো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে—

আবেগে থরথর করে গলা, চোখ দিয়ে অসতর্কে কখন জল গড়িয়ে পড়ে। আর ভাবে, পদ্য না বুকুক প্ৰাণ-নিংড়ানো ওই মর্মকথাটুকু তো ওদের মর্মে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে।… বেচারীরা চোখ বুঝে দিন কাটাচ্ছে, হঠাৎ হয়তো এতেই চোখ ফুটে যাবে। বুঝতে পারবে এই প্ৰাণপাত করে সংসার করা, ওই ভয়ে সশঙ্কিত হয়ে থাকার সব বৃথা, এখানে আমাদের কেউ আপন ভাবে না। এখানে সবাই আমরা—

ফুলের মালাগাছি বিকোতে আসিয়াছি
পরখ করে সবে করে না স্নেহ।

আর এও বুঝুক, জগতে এমন হৃদয়বান মহৎ পুরুষও আছেন, যিনি নিরুপায় মেয়েমানুষের এই যন্ত্রণা অনুভব করেন, তাকে ব্যক্ত করবার ভাষা যোগান। আশ্চর্য, আশ্চর্য! কি করে জানলেন রবি ঠাকুর–

এখানে মিছে কাঁদা
দেওয়ালে পেয়ে বাধা,
কান্দন ফিরে আসে আপনি কাছে।

কি করে টের পেলেন—

সবার মাঝে আমি
ফিরি একেলা,
কেমন করে কাটে
সারাটি বেলা,
ইঁটের পরে ইঁট,
মাঝে মানুষ-কীট্‌,
নাহিক ভালবাসা
নাহিক খেলা।

এমন স্পষ্ট করে বলাও বুঝতে পারবে না চিরবন্দিনী উমাশশী? বুঝতে পেরে ভাববে নাআমাদের এই যে অবস্থা, তা তো কই আগে জানতাম না! কি অন্ধই ছিলাম!

ওদের চোখ খুলতে বসে সুবর্ণ, আর হঠাৎ একসময় নিজেরই চোখ খুলে যায় ওর! গিরিবালা সহসা শশব্যাস্তে বলে ওঠে, গলাটাকে একটু খাটো করো মেজদি, নিচে যেন কার চটির শব্দ পেলাম, ছোটুঠাকুরপো এলেন বোধ হয়।

আর সেই বলে ওঠার ঢ়িল খেয়ে চমকে তাকিয়ে উঠে দেখে সুবর্ণ, উমাশশীর ইত্যবসরে দুকুলো বড়ি দেওয়া হয়ে গেছে, আর বিন্দু ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছে।

মর, চাটির শব্দে কান খাঁড়া করেই মর তোমরা। জেলখানাই সুখের সাগর তোমাদের–বলে রাগ করে উঠে যায় সুবর্ণ, আর নিজের ঘরে বসে বইটা মুড়ে রেখে মৃদু আবেগে বলে, কোথায় আছিস তুই কোথায় মাগো, কেমনে ভুলিয়া আছিস হাঁ গো—

ফোঁটা ফোঁটা করে জল গড়িয়ে পড়ে বড় বড় চোখ দুটো দিয়ে।

এমন ঘটনা কতদিনই ঘটে।

প্ৰবোধ প্ৰায়ই ভারী। থমথমে অন্য জগতে হারিয়ে-যাওয়া-মন স্ত্রীকে কাছে পায়।

কাজেই দোষ দেওয়া যায় না। তাকে যদি সে বলে, এই এক রবি ঠাকুর হয়েছেন দেশের মাথাটা খাবার জন্যে! মেয়েমানুষগুলো যাবে এবার উচ্ছনে। সেই যে বলে না–

পদ্মা গেল পটল গেল। গুগলি হল আঁখি,
আর শালিক গেল ফিঙে গেল আরশোলা হল পাখী!

হেম বাঁড়ুয্যে, ঈশ্বর গুপ্ত তো ছার-তোমার মতে বোধ হয় তোমার ওই রবি ঠাকুর মাইকেলের চেয়েও বড় কবি!

সুবৰ্ণ মাথা তুলে ওই বিদ্রুপমাখা মুখের দিকে তাকায়, আর তারপর হিন্দুনারীর ঐতিহ্য সম্পূর্ণ ধুলিসাৎ করে মুখ ফিরিয়ে বলে, তোমাদের মত মুখ্যুদের কাছে আমি কিছুই বলতে চাই না।

 

কিন্তু এসব কবেকার কথা?

খাঁচার পাখীর এই ডানা ঝটপটানির কাহিনী!

এসব তো সুবৰ্ণলতার বহু পুরনো কথা।

যেসব কথা খাতায় লিখে গেলে মূল্যহীন, বিবৰ্ণ, একঘেয়ে। তাই খাতায় তোলা হয় না, শুধু স্মৃতি ঘরের চাবিটা খুললেই একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে আসতে চায় অনেকে হুড়মুড়িয়ে একাকার হয়ে।

কিন্তু খাঁচার পাখীর ডানা ঝটপটানোর বাইরের বৃহৎ পৃথিবী তো স্থির হয়ে থাকে না।

খাঁচার পাখী আকাশের দিকে চোখ মেলে আর্তনাদ করে, পাখীর মালিক খাঁচার শিক শক্তি করতে চেষ্টা করে, বৃহৎ পৃথিবী তাকে উপহাস করে এগিয়ে যায়, আকাশকে হাতের মুঠোয় ভরে ফেলবার দুঃসাহসে হাত বাড়ায়.কবিরা শিল্পীরা নিঃশব্দে আপন মনে অচলায়তন ভাঙার কাজ করে চলে, বিচারকের মন সশব্দে প্রতিবাদ তোলে, শিকলদেবীর পূজার বেদীতে শাবল-গাইতির ঘা পড়ে, তার মধ্যে দিয়ে সমাজ মন-অবিরাম ভাঙা-গড়ার পথে দ্রুত ধাবিত হতে থাকে।

তাই সহসা একদিন সচকিত হয়ে দেখা যায় কখন কোন ফাঁকে অবরোধের বীজমুষ্টি যেন শিথিল হয়ে এসেছে, অবগুণ্ঠন হ্রস্ব হয়ে গেছে, রাজরাস্তাটা যে একা পুরুষের কেনা জায়গা নয়, সেটা ওই স্বল্পাবগুষ্ঠিতারা যে বুঝে ফেলেছে, ওদের চোখে-মুখে আচারে-আচরণে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

আর কতকগুলো দুঃসাহসী মেয়ে ইতিমধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই রাস্তায়। তারা পিকেটিং করছে, মার খাচ্ছে, জেলে যাচ্ছে। আসমুদ্রহিমাচল একটি নামে স্পন্দিত হচ্ছে, একটি কণ্ঠের ডাকে ছুটে আসছে।

সে নাম গান্ধীজী।

সে ডাক একলা চলা রে।

কবির ভাষা প্রেমিকের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে।

দেশপ্রেমিক, মানবপ্ৰেমিক!

দর্জিপাড়ার গলিও বুঝি আর চোখে ঠুলি এঁটে থাকছে না। সেখানেও নাকি ছেলেরা বলছে বিলিতি সাবান মাখা হবে না। আর এবং বিন্দু আর গিরিবালা নাকি বিলিতি নুন আর চিনি বাতিল করে কৰ্কাচ আর দোলো খাচ্ছে, এবং বাজার থেকে বিলিতি কুমড়ো বিলিতি আমড়া আর বিলিতি বেগুন আনা নিষেধ করে দিয়েছে।

আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, ইতর-ভদ্র, শিক্ষিত নিরক্ষর সবাই এক কথা কইছে, কেউ আর এখন বলছে না। রাজত্বটা বৃটিশের। সবাই বুঝে ফেলেছে। ওরা অন্যায় করে দখল করে আছে, অতএব ন্যায়ের দখল নিতে হবে। সবাই জেনে গেছে মহাত্মা গান্ধী স্বরাজ এনে দেবেন।

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল। যারা জীবনের জয়গান—এ হয়তো তাদেরই রক্তে ভেজা মাটির ফসর। তারা বীজ পুঁতে রেখে গেছে। এখন এসেছে আর এক মালী তাতে জল দিতে।

ফল?

খাবে দেশের লোক। খেলো বলে।

সদ্য ফল যে হাতে হাতেই মিলবে। যারা পুলিসের গুতো খাচ্ছে, বুটের ঠোক্কর খাচ্ছে, জেলের ভাত খাচ্ছে, তারা কষ্টের শেষের পুরষ্কার খাবে সেই ফল।

কিন্তু সুবৰ্ণলতার মনের মধ্যে কেন তেমন সাড়া নেই? যে সুবৰ্ণলতা স্বদেশীর নামে টগবগিয়ে ফুটতো, সে কেন স্বরাজের ব্যাপারে এমন মিইয়ে আছে?

দেশে যখন নিত্য-নতুন ঢেউ আসছে, যখন কুলভাঙা প্লাবন আসছে, প্ৰবোধের তো তখন সর্বদা সশঙ্কিত অবস্থা। আর বুঝি রাখা যাবে না। ওকে গৃহ-কোটরে। হঠাৎ কোনদিন শুনবে, মেয়ে দুটোকে নিয়ে পিকেটিং করতে বেরিয়ে গেছে সুবৰ্ণলতা লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে।

কিন্তু কই? তেমন উন্মাদনা কই?

কানু যেদিন একটা চরকা কিনে বললো, মা, বাজে গাল-গল্পে দিন না কাটিয়ে এবার প্রতিটি মিনিট সুতো কাটতে হবে, এই চরকা-কাটা সূতোয় কাপড় বুনিয়ে পরতে হবে সবাইকে, সেদিন তো কই সুবর্ণ ওই নতুন জিনিসটার ওপর ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল না? বলল না, তোকে দু হাত তুলে আশীৰ্বাদ করি। কানু, আমার মনের মত কাজ করলি তুই!

না, সে কথা বলল না। সুবর্ণ, শুধু একটু হেসে বললো, গাল-গল্প আবার কে করছে রে এত?

আহা গাল-গল্প না হোক, নাটক-নভেল পাঠা! একই কথা! মোট কথা সময়ের অপচয়। আর অপচয় করা চলবে না।

চলবে না বুঝি? আরও একটু হেসেছিল সুবৰ্ণ, তবে চরকাঁটাই চালা। তোদেরই এখন সামনে সময়। আমার তো এখন সময়ের সম্বল সব পেছনে ফেলে চলে আসা জীবন।

চমৎকার! কত কত আশী-নব্ববুই বছরের বুড়ো-বুড়ী চরকা কাটছে তা জানো? রাস্তায়-চলমানুষ পর্যন্ত তাকলি কাটতে কাটতে চলেছে!

তা চলতেই পারে। যখন যা ফ্যাশান ওঠে!

ফ্যাশান! একে ফ্যাশন বলছে তুমি?

কানু স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

এমন কি কানুর বাবাও।

সুবৰ্ণর মুখে এ কথা অভাবনীয় বৈকি।

সাধে কি প্ৰবোধ এই অদ্ভুত উল্টো-পাল্টা-কে নিয়ে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরলো চিরদিন?

কানু মাকে অনেক ধিক্কার দিয়েছিল।

বলেছিল, স্বরাজ অমনি আসবে না। তার জন্য ক্লেশ চাই, দুঃখ চাই।

মুক্তকেশীর নাতি, প্ৰবোধের বংশধর বলেছিল। এ কথা উত্তেজিত গলায়।

অতএব বলতেই হবে দেশের মজা নদীতে বান ডেকেছিল। তথাপি সুবর্ণ উত্তেজিত হয় নি। সুবৰ্ণ আবার হেসে উঠে বলেছিল, তা তোর এই সুতো কাটার মধ্যে ক্লেশই বা কই? দুঃখই বা কই? আর গোরস্তঘরের মেয়েমানুষের অবসরই বা কই?

কানু আরও জ্বলেছিল।

আর একবার নাটক-নভেলের খোঁটা দিয়েছিল, সুবৰ্ণলতার দু-দুটো বড় হয়ে ওঠা মেয়ে কি রাজকাৰ্য করে তার হিসেব চেয়েছিল। হ্যাঁ, দুটো মেয়ের কথাই তুলেছিল কানু—তখনো পারুর ঘরবসত হয় নি, আর কানুর বিয়ে হয় নি।

কানুর বিয়ে লাগলো। ওই চরকার ঢেউটা একটু কমলে। অনেকের বাড়িতেই তখন আধভাঙা চরকাটা ছাতের সিঁড়িতে কি চিলেকোঠায় আশ্রয় পেয়েছে। শুধু কারুর দেওয়ালে চরকা-কাটা-রত গৃহিণীর বা বধূর ফটোটি ঝুলছে উজ্জ্বল মহিমায়।

তা সে যাই হোক-পারুল-বকুলের কথা তুলেও মাকে নোয়াতে পারে নি। কানু। সুবৰ্ণ বলেছিল, সে ওদের নিজের থেকে ইচ্ছে হয়, প্রেরণা আসে করবে ওরা। আমি হুকুম দিতে যাব কেন? বিশেষ করে আমার যাতে বিশ্বাস আসছে না।

তা হলেই বল উল্টোপাল্টা কিনা?

দু-পাঁচটা ছেলে ঘরে বসে দুটো হাতবোমা বানিয়ে আর পুলিস মেরে দুর্ধর্ষ বৃটিশের গোলাবারুদের শক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলবে এ বিশ্বাস তোমার ছিল, আর এতে তোমর বিশ্বাস নেই?

তা কানুর রাগের মানে অবশ্যই আছে।

সুবৰ্ণর ভুল।

কোনোটাই নিরর্থক নয়। কোনো প্ৰাপ্তিই হঠাৎ আসে না। কাজ চলে নানা চিন্তায় নানা হাতে। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই তো পরামকে পাওয়া যায়।

কিন্তু একবগ্‌গা সুবৰ্ণ বলে, পরমকে পেতে হলে চরম মূল্য দিতে হয়।

অথচ ওই চরমটা যে কি সেকথা বলে না। হয়তো সে ধারণাও ওর নেই। শুধু একটি বড় কথা বলনেওয়ালা ভাবের ফানুস বৈ তো নয়।

তবে মোটের মাথায় দেখা গিয়েছে সুবর্ণ এতখানি সুবৰ্ণ-সুযোগেও রাজপথে নামে নি। রাজপথের কলকোলাহলের দিকে দর্শকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছে শুধু।

তবে বিদেশী জিনিস বর্জন!

সে তো বহুকাল আগে থেকেই হয়ে আসছে। ইচ্ছেয়-অনিচ্ছেয় মেনেই নিয়েছে। সবাই সুক্কুর এই জবরদস্তি। হয়তো বা বাগারগি কেলেঙ্কারির ভয়েই। ঘরে পরে কাউকেই তো বেয়াং করে না সুবর্ণ!

এ পাড়ায় বাড়ি করবার সময় থেকেই পাশের বাড়ির পরিমলবাবুদের সঙ্গে ভাব। পরিমলবাবুর স্ত্রী সর্বদা আগবাড়িয়ে এসে নতুন-আসা পড়াশীদের সুবিধে-অসুবিধে দেখেছেন। বলতে গেলে আত্মীয়ের মতন হয়ে গেছেন। তবু একদিন পরিমলবাবুর স্ত্রী যখন বেড়াতে এসে বলেছিলেন, দেশী দেশলাই দেখেছি বকুলের মা? দেখে আর বাঁচি না। জ্বলবোর আগেই নিভছে। একটা উনুন জ্বালাতে একটা দেশলাই লাগবে। বিলিতির সঙ্গে আর পাল্লা দিতে হয় না বাবা কিছুর।

তখন সুবৰ্ণ ফস করে বিলিতি দেশলাই কাঠির মত জ্বলে উঠে বলেছিল এসব গল্প আমার কাছে করবেন না দিদি, আমার শুনতে খারাপ লাগে।

পরিমলবাবুর স্ত্রী মানুষ ভাল, তবে মাটির মানুষ তো নয়! অতএব হয়ে গিয়েছিল বিচ্ছেদ।

অনেকদিন লেগেছিল মনের সেই মালিন্য ঘুচিতে। বোধ করি ছেলেমেয়েদের কারো বিয়ে উপলক্ষেই আবার আসা-যাওয়ার পথে পুনর্মিল। তাছাড়া পরিমলবাবুর ছেলে সুনির্মল তো কোনোদিনই ওসব মনোমালিন্যের ধার ধারে নি। ঘরের ছেলের মত এসেছে, বসেছে, খেয়েছে।

সেই আসা-যাওয়ার অন্তরালে—

কিন্তু সেকথা থাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *