1 of 2

২.০৪ পালকি সত্যিই এবার উঠে যাচ্ছে

পালকি সত্যিই এবার উঠে যাচ্ছে।

যাই যাই করছিল অনেক দিন, এবার মনে হচ্ছে একেবারেই যাবার পথে পা বাড়িয়েছে। রাস্তায় বেরিয়ে যখন-তখন তো দূরস্থান, বলতে গেলে চোখেই পড়ে না।

পালকির সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কিছুই অবলুপ্তির পথ ধরবে তাতে আর সন্দেহ কি? পালকিই বলে যাবে–মানুষের কাঁধের উপর মানুষ চড়া নির্লজ্জতা! … মনের গিয়ে শবদেহ হয়ে যাবার পর চড়ো মানুষের কাঁধে, তার আগে নয়।–বলে যাবে—আস্ত একটা মানুষকে একটা বদ্ধ বাক্সয় ঢুকিয়ে ফেলে ঘেরাটোপ ঘিরে নিয়ে যাওয়াটা হাস্যকর, আমি বিদায় নিচ্ছি ওই ঘেরাটোপ আর পর্দার জঞ্জালগুলো কুড়িয়ে নিয়ে। পথ যে পার হচ্ছে, পথটা সে যেন দেখতে পায়।… বলে যাবে, ছোটো ঘোড়ার খুরে ধুলো উড়িয়ে, ছোটো হাওয়ার বেগে হাওয়াগাড়িতে, ওড়ো মাটি ছাড়িয়ে আকাশে।… তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে আপন পরিমণ্ডলটিকেই সমগ্ৰ পৃথিবী জ্ঞান করে আলবেলায় সুখটান দেবার দিন গত হলো।

হাজার বছরের অভ্যাসের ঐতিহ্য আর ইতিহাসের ধারা মুছে দিয়ে যারা চলে যায়, তারা কিছু বলে যায় বৈকি। চলে যাবার মধ্যেই বলে যাওয়া।

কালস্রোত যে কাউকে কোথাও নোঙর ফেলতে দেয় না, দুৰ্নিবার বেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এইটাই আর একবার বলে যায় সে। আজকের পরম প্রয়োজনীয় পরবর্তীকালে জঞ্জালের কোঠায় ঠাঁই পায়, এই হলো পৃথিবীর পরমতম সত্য আর চরমতম ট্র্যাজেডি।

তবু সহজে কেউ মানতে রাজী হয় না। সে কথা। তারা সেই বিদায়ী পথিকের বসন প্ৰান্তটুকু মুঠোয় চেপে ধরে রাখতে চায়, আর আলবোলায় শেষ সুখটানটুকু দিতে দিতে বলে, এসব হচ্ছে কী আজকাল! সব যে রসাতলে গেল!

যারা দার্শনিক তারা উদাস হাসি হেসে বলে, যাবেই তো, সবই যাবে।

মুক্তকেশীও একদা তার ছোট্ট নাতনীর সঙ্গে বাক্যালাপ প্রসঙ্গে বলেছিলেন একথা, পালকি আর কই! ক্রমেই কমে আসছে। যাবে সবই উঠে যাবে।

তবু দেখা যাচ্ছে এখনো মুক্তকেশী। তাঁর বয়সের ভারে জীর্ণ দেহখানা নিয়ে চলেছেন পালকি চড়ে।

একাই চলেছেন!

খানিকটা গিয়ে একখানা গোলাপী রঙের দোতলা বাড়ির সামনে এসে মুক্তকেশী মুখ বাড়িয়ে বোহারাগুলোর উদ্দেশ্যে আদেশজারি করলেন, থাম্ মুখপোড়ারা, এই বাড়ি! চলেছে দেখো হুম্ হুম করে!

যেন বাড়িখানা তাদের চিনে রাখার কথা।

নিমেযে বোহারাগুলোর হুমহুম শব্দ থেমে গেল, পালকিও থামালো। চার-চাৱটে জোয়ানমার্দ লোক পালকিখানা নামিয়ে কোমরে বাধা গামছা খুলে গায়ের ঘাম মুছতে লাগলো।

চারটে দস্যিলোক, অথচ একটা বুড়ীকে বইতে হিমশিম খেয়ে গেছে! পদ্ধতিটা বুদ্ধিহীন বলেই। রিকশাগাড়িরা তখনও আসরে নামে নি, দেখিয়ে দেয় নি একটা লোকই টেনে নিয়ে যেতে পারে চারটেকে!

পালকির দরজা ঠেলে নামলেন মুক্তকেশী।

নড়বড়ে কোমরটা কষ্টে টান করে প্রায় সোজা হয়ে দাঁড়ালেন মুহূর্তকাল। তারপর আঁচলের খুঁট থেকে দুটি ডবল পয়সা বার করে চারটি বেহারার মধ্যে একজনের হাতে দিয়ে বললেন, নে যা, ভাঙিয়ে ভাগ করে নোগে যা!

কোমরটা দুমড়ে যাওয়া পর্যন্ত মুক্তকেশীর ধারণা হয়েছে, পূর্ব সম্মানের সবটুকু আর জুটছে না। তাই অপর পক্ষের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলেই প্রাণপণ চেষ্টায় সোজা হন। অনেক সময় হাড়ের খিল ছেড়ে যাওয়ার একটা শব্দ হয়, শিরদাঁড়াটা কনকনিয়ে ওঠে, তবু সাধ্যপক্ষে হেঁট হওয়ার অগৌরব বহন করতে রাজী নন মুক্তকেশী।

তথাপি অপরপক্ষ সম্মান রক্ষায় উদাসীন হল।

বলে উঠলো, কেতো দিউছি?

যা দেবার ঠিকই দিয়েছি— বাৰ্ধক্য-মলিন পুরনো চোখের তারায় একটি সম্রাজ্ঞজনোচিত দৃপ্তভঙ্গী ফুটিয়ে তুলে মুক্তকেশী সদৰ্পে তাকালেন, আবার কিসের ট্যা-ফোঁ? চাস কত? পুরো তাঙ্ক?

লোকগুলো মুখের প্রত্যেকটি রেখায় অসন্তোষ ফুটিয়ে বলে, আটো পয়সা দিয়!

কী বললি? আট পয়সা? গলায় ছুরি দিবি নাকি? পয়সা গাছের ফল? মুক্তকেশী সদৰ্পে বলেন, আর এক আধলাও নয়। কার হাতে পড়েছিস তা জানিস? এখেন থেকে এখেন, আট পয়সা! হুঁ, যা বেরো!

আশ্চর্য!

আশ্চর্য বৈকি যে লোকগুলো সত্যিই পালকি তুলে নিয়ে চলে যায় নিতান্ত ব্যাজার মুখে।

তারাও জানছে। এ পেশার দিন শেষ হয়ে আসছে। ওদের। মুক্তকেশীর মত দু একটা বুড়ীটুড়ী ছাড়া এরকম শবযাত্রার ভঙ্গীতে মানুষের কাঁধে চড়ে শূন্যে দুলতে দুলতে আর যেতে চাইছে না মানুষ।

তাই বেত ছিঁড়ছে, ডাঙা ভাঙছে, রং চাঁট দাঁত বেরিয়ে যাচ্ছে, তবু পালকি মেরামতের কথা ভাবছে না। ওরা। দলের অনেকেই তো ক্রমশঃ গলায় একটা পৈতো বুলিয়ে রাধুনী বামুনের চাকরি নিচ্ছে। তার চাহিদা বরং দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

বাড়ছেই।

মেয়েরা ক্রমশই বাবু হয়ে উঠছে, রান্নার ভারটা চাপাচ্ছে উড়িয়া কুলতিলকের হাতে।

 

বন্ধ দরজা খোলবার জন্যে কড়া নাড়া অথবা দরজায় ধাক্কা দেবার যে একটা প্রচলিত রীতি আছে সে রীতিকে অগ্রাহ্য করে মুক্তকেশী ভাঙা ভাঙা অথচ সতেজ গলায় ডাক দেন, পেবো–

হ্যাঁ, এ পাড়ার প্রবোধবাবুকেই ডাক দেন। তিনি। বাড়ির ছোট ছেলেপুলেদের নাম ধরে ডাক দেবার যে একটা রীতি প্রচলিত, সেটাকেও অস্বীকার করে থাকেন। তিনি। এ বাড়ি তাঁর ছেলে পেবোর তাকেই ডাকবেন। তিনি। সে বাড়িতে থাক বা না থাক।

অবশ্য যখনই আসেন, প্ৰবোধচন্দ্রের উপস্থিতির সম্ভাবনা অনুমান করেই আসেন।

তা এক ডাকেই কাজ হলো।

যদিও পেবো বা সেই জাতীয় কেউ নয়, দরজা খুলে দিল বছর দশেকের একটি মেয়ে। মুক্তকেশী যতটা সম্ভব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার ওর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে তীব্র গলায় বলে উঠলেন, কপাট খুলে দিতে হুট্‌ করে বেরিয়ে এলি যে? বাড়িতে আর লোক নেই?

মেয়েটা এই প্রশ্নবাণের সামনে থতমত খেয়ে বলে, সবাই আছে।

আছে তো তুই তাড়াতাড়ি আসতে গেলি কেন? আমি না হয়ে যদি অপর কোনো ব্যাটাছেলে হতো? পাবির বিয়ে হচ্ছে না বলে বুঝি তুই কচি খুকী আছিস?

মেয়েটা তাড়াতাড়ি বলে, ছাদ থেকে দেখলাম তুমি এলে, তাই—

ছাদ থেকে!

সেই পুরনো চোখ আবার ধারালো হয়ে ওঠে, ভরদুপুরে ছাদে কী করছিলি?

কাপড় শুকোচ্ছিল, মা বললেন, তুলে আন।

হুঁ, তা বলবেন বৈকি মা। চিরকেলে আয়েসী! নে চল, বাবা বাড়ি আছে?

আছেন। ঘুমোচ্ছেন।

তা তো ঘুমোবেই। মুক্তকেশী ধিক্কারের স্বরে বলেন, সঙ্গগুণের মহিমা! বুকের ওপর পাহাড় মেয়ে, আরো একটা ধিঙ্গী হয়ে উঠলো, ছুটিছাটায় দিন কোথায় মাথায় সাপ বেঁধে ছুটোছুটি করে বেড়াবে, তা নয় নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। নে চল!

মুক্তকেশী আজকাল মাঝে-মাঝেই আসেন।

ভেন্ন হওয়া রূপ দুরাচারের জন্যে অনেকগুলো দিন পুত্রবধুর মুখ দেখেন নি মুক্তকেশী, কিন্তু পুত্রের আকিঞ্চন ও তোষামোদে সে ভাবটা কেটে গিয়েছিল। তারপর সেই সুবৰ্ণলতার গুরুমন্ত্র নেওয়ার সময় বাধা ভাঙলো। রাগের, তেজের, লজ্জার।

সময়ে সবই সয়। সর্বতাপহর।

সময় সবই সহজ করে আনে। এবং মুক্তকেশী মেজবৌমা মেজবৌমাই বেশি করেন। তার জন্যে ঘরে থাকা অন্য বৌদের হিংসের অবধি নেই, কিন্তু এখন যে প্ৰবোধচন্দ্রের মাতৃভক্তিটা প্রায় ভারতের ভ্রাতৃভক্তির তুল্য মূল্যবান! আর মূল্যেই তো জগৎ বশ!

অতএব এখন মুক্তকেশী যখন-তখন মেজ ছেলের বাড়িতে বেড়াতে আসেন, হুকুম আর শাসন চালিয়ে যান, এবং অপর ছেলে-বৌদের সমালোচনায় মুখর হন। হাত-খরচের টাকায় ঘাটতি পড়লেই সেকথা কোনো ছলে মেজবৌমার কর্ণগোচর করেন এবং নিজের মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনী বাবদ অর্থঘটিত যা কিছু সদিচ্ছা, সেও মেজছেলের কাছে প্ৰকাশ করে যান।

বলেন, ওদের বলি না, জানি তো বোন বলে এতটুকু মন কারো নেই। তোর তবু সে মন একটু আছে তাই বলা।

প্ৰবোধ অবশ্য মায়ের ধারণা অনুযায়ী বোনেদের প্রতি মনের অভিনয়ই করে চলে তারপর। বলে উঠতে পারে না-মন আমারও নেই মা। তারা ভিন্ন মাটিতে শিকড় নামিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগ কোথায়? একদা তারা আর আমরা একই আধারে থেকেছি, শুধু এইটুকু সুবাদের জের আর কতকাল টানা যায়?

বলে না।

বলে উঠতে পারে না।

অতএব সুবৰ্ণলতার এই গোলাপী রঙের দোতলাটির মধ্যেও মুক্তকেশী বেশ পুরো চেহারা নিয়েই অবস্থান করেন।

সুবৰ্ণলতা একবারই পেরেছিল অসাধ্য সাধন করতে। একবারই দেখিয়েছিল অসমসাহসিক শব্দটার মানে আছে।

কিন্তু সে ওই একবারই। সে আওতা থেকে সরে এসে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে নিজের ইচ্ছেমত সংসার গড়ে তোলবার বাসনা হয়েছিল, সে বাসনাটা ধূসর হয়ে যাচ্ছে। সেই আওতাটা রয়েই গেছে, হয়তো বা আরো নিরঙ্কুশ হয়েছে।

সুবৰ্ণলতার জীবনের এ এক অদ্ভুত ট্র্যাজেডি। কারণ নিজেও সে মুক্তকেশীর সংসারে বসে যত সহজে মুক্তকেশীর বিরুদ্ধাচরণ করতে পারতো, আপন কেন্দ্রে বসে তা পারে না। ভদ্রতায় বাধে, চক্ষুলজ্জায় বাধে, আর সব চেয়ে আশ্চৰ্য-মমতায় বাধে।

অস্বীকার করে লাভ নেই, এখনকার ওই নখদন্তহীন মানুষটির প্রতি একটা মমতাবোধে সুবৰ্ণলতাকে নিরুপায় করে রেখেছে।

 

মৌজের দিবানিদ্রাটি ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে এসে প্ৰবোধ মায়ের চরণবন্দনা করে, নিজ হাতে হাতপাখা তুলে নেয়।

মুক্তকেশী আসন পরিগ্রহ করে বলেন, থাক বাতাসে কাজ নেই, বলি নাকে তেল দিয়ে ঘুম দিলেই হবে! মেয়ের বিয়ে দিতে হবে না?

নখদন্তহীন মুক্তকেশীর কথার জোর কমেছে বলে যে কথার সুর বদলেছে তা নয়। সুরাটা ঠিক আছে, ধরনটা ঠিক আছে, শুধু ভারটা খুঁজে পাওয়া যায় না।

তবু—

তবু সুবৰ্ণলতা যেন আজকাল হঠাৎ-হঠাৎ ওই মানুষটাকে ঈর্ষা করে বসে। মুক্তকেশী যখন তাঁর পঞ্চাশোন্তীর্ণ ছেলেকে বলে ওঠেন লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা, পোড়ারমুখো বান্দর, তখন অদ্ভুত একটা ঈর্ষার জ্বালা যেন দাহ ধরায় সুবৰ্ণলতাকে।

অথচ নিজে কি সুবৰ্ণলতা কখনো দরাজ ভাষায় ছেলেদের সম্বোধন করবার বাসনা পোষণ করেছে?

এই গ্ৰাম্যতা কি সুবৰ্ণলতার অসহ্য নয়?

তবু–

এই তবুর উত্তর নেই, প্রশ্ন জমে ওঠে আরো।

সুবৰ্ণলতার ছেলেরা কি এই মাতৃভক্ত বংশের ছেলে নয়?

সুবৰ্ণলতা কি তার মাতৃকর্তব্যে কোনো ত্রুটি করেছে? সুবৰ্ণলতা তো বরং সেই কৰ্তব্যের দায়ের কাছেই নিজের সর্বশক্তি বিকিয়েছে বসে বসে।

তথাপি সুবৰ্ণলতার বিয়ে হওয়া মেয়েরা বাপের বাড়ি বলতে সুবৰ্ণলতার প্রাণ দিয়ে গড়া এই গোলাপী রঙের দোতলাটাকে বোঝে না, বোঝে সেই দর্জিপাড়ার গলির বাড়িটা। তাদের প্রাণপড়ে থাকে। সেখানেই। সেখানে এসে তারা পুরনো দালানের তেলচিাটে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে তাদের মায়ের চালচলনের ব্যাখ্যানা করে।

আর সুবৰ্ণলতার ছেলেরা?

তারা অবশ্য সেই দেয়ালে তেলধারা জানালায় চুনের হাত মোছা এবং দরজার পিছনে পিছনে পানের পিক ফেলা বাড়িটাকে আদৌ পছন্দ করে না, তার প্রতি একবিন্দুও মমতা পোষণ করে না, তবু এই বাড়িটাকেও আমাদের বলে পরম স্নেহে হৃদয়ে নেয় না।

সুবৰ্ণলতার ছেলেরা যেন বাধ্য হয়ে তাদের এক প্রবলপ্ৰতাপ প্রতিপক্ষের এক্তারে পড়ে আছে, তাই সুযোগ পেলেই ছোবল বসাতে আসে।

ছোটটাকে অবশ্য এখনো ঠিক বোঝা যায় না, সে যেন বড় বেশি নির্লিপ্ত। সেজটাও আমোদপ্ৰমোদ বাবুয়ানা বিলাসিতাটুকু হাতের কাছে পেয়ে গেলে তেমন হিংস্র নয়, কিন্তু ভানু-কানু?

যারা নাকি প্ৰমাণ সাইজের জামা পরে তবে এ বাড়িতে এসেছে!

তারা যেন ঠিক কাকাদের প্রতিমূর্তি।

বিশেষ করে ভানু।

হঠাৎ যখন পাশ দিয়ে চলে যায়, কি চান করে এসে গামছাখানাকে জোরে জোরে ঝাড়ে, অথবা মুখ নিচু করে ভাত খেতে খেতে কেমন একটা কঠিন ভঙ্গীতে চোয়ালটা নাড়ে, দেখে চমকে ওঠে সুবৰ্ণলতা।

মনে হয়। সেজ দ্যাওর প্রভাসকেই দেখতে পেল বুঝি।

অপর পাঁচজনেও বলে, ভানুকে দেখো যেন অবিকল ওর সেজকাকা!

শুনে অন্ধ একটা রাগে হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছে করে সুবৰ্ণলতার।

সুবৰ্ণর রক্ত-মাংসে গড়া, সুবর্ণর ইচ্ছে চেষ্টা সাধন শক্তি দিয়ে লালিত সন্তান সুবর্ণর পরম শত্রুর রূপ নিয়ে সুবর্ণর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে এ কী দুঃসহ নিরূপায়তা!

কী অস্বস্তিকর বড় হয়ে গেছে ভানু-কানু!

কী বিশ্ৰী লম্বা-চওড়া।

গলার স্বরগুলোই বা কী রকম মোটা। আস্ত দুটো লোক হয়ে গেছে ওরা!

অন্য লোক।

সুবৰ্ণলতার সঙ্গে যাদের জীবনের আর কোনো যোগ নেই, সুবৰ্ণলতাকে যাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই।

সুবৰ্ণলতার সাধ্য নেই। আর ওদের নাগাল পাবার।

আস্তে আস্তে মানু সুবলও হয়তো এই রকমই হয়ে যাবে। তাদের মুখের চেহারায় প্রকট হয়ে উঠবে মুক্তকেশীর ছেলেদের মুখের কাঠামো।

নিরুপায় সুবৰ্ণলতাকে বসে বসে দেখতে হবে এই পরিবর্তন।

মুক্তকেশীর ছেলেদের ঘৃণা করা যেত। অবজ্ঞা করা যেত, এদের বেলায় কোনো উপায় নেই।

আর এদের সম্পর্কে রও কোনো পথ নেই। এরা সুবৰ্ণলতার ইচ্ছানুরূপ শিক্ষিত হয়েছে, সভ্য হয়েছে, চৌকস হয়েছে। সুবৰ্ণলতার জীবনের প্রত্যেকটি অণুপরমাণুর ধ্বংসের মূল্যে যে সম্পদ সঞ্চয় করেছে সুবৰ্ণলতার ছেলেরা, সেই সম্পদের অহঙ্কারেই তারা অহরহ অবজ্ঞা করছে।

হয়তো বা সুবৰ্ণলতার ক্ষেত্রেই নয়, অন্য সব ক্ষেত্রেও এমনিই হয়।

বোধ ঋণবোধ ও জন্মায়, আর সেই ঋণবোধের দাহই ফণা তুলে থাকে ছোবল হানতে। যেখানে ঋণের ঘর হালকা, সেখানে বুঝি আপন হওয়া যায়, সহজ হওয়া যায়।

নচেৎ নয়।

অথচ আজীবনের স্বপ্ন ছিল সুবৰ্ণলতার, তার সন্তানেরা তাকে বুঝবে, তার আপনি হবে। কিন্তু তারা আপন হয় নি, তারা সুবৰ্ণলতাকে বোঝে নি।

হয়তো বুঝতে চায়ও নি।

কারণ সুবৰ্ণলতার ছেলেরা তার মায়ের সেই মধুর আশার স্বপ্নের সন্ধানটুকু পায় নি কখনো? তারা শুধু যোদ্ধা সুবৰ্ণলতাকেই দেখে এসেছে, দক্ষিণের বারান্দালোভী স্বপ্নাতুর সুবৰ্ণলতাকে দেখে নি কখনো।

যুদ্ধবিক্ষত সুবৰ্ণলতার বিকৃত আর হিংস্র মূর্তিটা অতএব বিরক্তি আর ঘৃণারই উদ্রেক করেছে তাদের। সন্ধান করে দেখতে যায় নি সুবর্ণলতার ভিতরে বস্তু ছিলো।

 

ভেবে দেখে নি বস্তু ছিলো, স্বপ্ন ছিলো মানুষের মত হয়ে বাঁচবার দুর্দমনীয় সাধ ছিলো ভব্যতা, সভ্যতা, সৌকুমাৰ্য। শুধু সে সম্পদ ক্ষয় হয়ে গেছে। যুদ্ধের রসদ যোগাতে যোগাতে।

তবে ভেবে দেখবেই বা কখন তারা?

আজো কি যুদ্ধের শেষ হয়েছে সুবৰ্ণলতার?

হয় নি।

হয়তো যুদ্ধের কারণগুলো আর তত বেশি প্রখর নেই, হয়তো অনুভূতিগুলোও তত বেশি তীব্ৰ নেই, তবু সুবৰ্ণলতা এক। আপসহীন সংগ্রামের নায়িকা!

নোংরামি আর কুশীতার সংগ্রাম করতে নিজে যে সে কথা নোংরা আর কুশী হয়ে গেছে, ভব্যতা সভ্যতা শালীনতা সৌন্দর্য বজায় রাখবার লড়াইয়ে যে নিজের চরিত্রের সমস্ত সৌন্দৰ্য শালীনতা জবাই দিয়ে বসে আছে, সে খবর আর নিজেই টের পায় না সে।

সুবৰ্ণলতার সন্তানেরা মায়ের এই অপরিচ্ছন্ন মূর্তিটাই দেখতে পাচ্ছে।

অতএব তারা হচ্ছে।

অতএব তারা মাকে ঘৃণা করছে।

মার দিকে ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

সারা জীবনের এই সঞ্চয় সুবর্ণলতার।

অথচ সুবৰ্ণলতার সন্তানদেরও দোষ দেওয়া যায় না। মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া কেটে বিরাট পরিবারের মধ্যে থেকে সুবৰ্ণলতা তাদের শুধু উদ্ধার করেই এনেছে, আশ্রয় দিতে পারে নি।

শুধু যেন ছড়িয়ে ফেলে রেখেছে।

তাদের সদ্য-উন্মোচিত জ্ঞানচক্ষুর সামনে অহরহ উদঘাটিত হচ্ছে মা-বাপের দাম্পত্যলীলার যুদ্ধ আর সন্ধির বহু কলঙ্কিত অধ্যায়।

তারা জানে তারা সুবৰ্ণলতার স্বপ্ন-সাধনার বস্তু নয়, যুদ্ধের হাতিয়ার মাত্র।

এই অদ্ভুত যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে যত বেশি ধাক্কা খাচ্ছে তারা, তত বেশি বিতৃষ্ণ হচ্ছে, তত বেশি আঘাত হানছে।

পারু পড়তে চায়, কিন্তু পারুর পড়াকে কেন্দ্র করে সুবৰ্ণলতা যে ঘূর্ণিঝড় তোলে, সে ঝড়ের ধুলো-জঞ্জালের দিকে তাকিয়ে পারু পড়ায় বীতস্পৃহ হয়।

পারু নিজেই বেঁকে বসে।

পারু প্রতিজ্ঞা করে, লাঠালাঠি করে আদায় করা বস্তুকে গ্রহণ করে কৃতাৰ্থ হবে না সে। পারুর আত্মমর্যাদাজ্ঞান তীব্ৰ গভীর।

কিন্তু প্ৰবোধের পক্ষে মেয়ের সেই প্ৰতিজ্ঞা জানার কথা নয়। তাই প্ৰবোধ মায়ের প্রশ্নে অসহায় দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে, তোমার মেজবৌ যে বলে গো, আজকাল আর অত সকাল সকাল বিয়ে নেই। বরং একটু লেখাপড়া-

মুক্তকেশী অবশ্য এতে বিচলিত হন না। মুক্তকেশী দৃপ্ত গলায় বলেন, কী বললি লক্ষ্মীছাড়া বামুনের গরু! মেয়ের এখন বিয়ে না দিয়ে লেখাপড়া শেখাতে বসবি? তা বলবি বৈকি, তোর উপর্যুক্ত কথাই বলেছিস। চিরটাকাল তো হাল্কা বুদ্ধিতেই চললি।

না, এখন আর বৌয়ের বুদ্ধিতে চললি বললেন না বুদ্ধিমতী মুক্তকেশী। বললেন, হালকা বুদ্ধিতে চললি!

প্ৰবোধ অবশ্য প্ৰতিবাদ করে না।

মুক্তকেশী বলেন, ওসব কথা বাদ দে, কোমরে কসি গুঁজে লেগে যা। গলার কাটা উদ্ধার না। হলে তো ছেলেদের বিয়ে দিতে পারবি না! এদিকে মেয়ে নিয়ে লোকে আমায় সাধাসাধি করছে। আমি থাকতে ছেলের বিয়ে দিবি, এই আমার সোধ। সুবোটার তো প্রথম দিকে শুধু মেয়ের পাল!

কথাটা শেষ হবার আগেই গলার কাটা ঘর থেকে বিদায় নেয়, আর সুবৰ্ণলতা একটুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলে, হুকুম তো একটা করে বসলেন!। কিন্তু ছেলেদের এক্ষুনি বিয়ে কি? পাসই করেছে, রোজগার তো করতে শেখে নি! কানুর তো পড়াও শেষ হয় নি!

কানু ডাক্তারী পড়ছে, কাজেই তার পাস করে বেরোতে দেরি। মুক্তকেশী সেই কথার উল্লেখ করে ব্যঙ্গহাসি হেসে বলেন, ছেলে ডাক্তার হয়ে বেরুলে তবে বিয়ে দেবে মেজবৌমা? তার থেকে বল না কেন, ছেলের এখনো চুল পাকে নি, বিয়ে দেব কি? ছেলেরা রোজগার না করলে বৌরা এসে তোমার সংসারে দুটি ভাত পাবে না?

সুবৰ্ণলতা শান্ত গলায় বলে, ভাত কেন পাবে না! তবে ভাতটাই তো সব নয় মা?

আহা, হলো না হয় গহনা-কাপড়ই সব, মুক্তকেশী জিদের গলায় বলেন, সে তুমি বিয়ের সময় বেহাইয়ের গলায় গামছা দিয়ে দশ বছরের মতন আদায় করে নেবে। ততদিনে তোমার ছেলে অবিশ্যিই উপায়ী হবে।

সুবৰ্ণলতা আরো নাম হয়, তবু দৃঢ় গলায় বলে, সে তো অনিশ্চিত, রোজগার পাতি না করলে—

দেখ মেজবৌমা, তক্কে তোমার সঙ্গে জিততে পারব না। আমি, তবে গুরুজন হিসেবে বলছি, বামুনের ছেলে, খেটে খেতে না পারে ভিক্ষে করে খাবে, তাতে লজ্জা নেই। বিয়ে একটা সংস্কার সেটা সময়ে দরকার। তবে সব আগে তোমার ওই তালগাছকে পার করো—

সুবৰ্ণলতা উঠে দাঁড়ায়।

বলে, রোদ থেকে এসেছেন, ডাব আনি একটা—

ডাবে ছোঁওয়া লাগে না, তাই মুক্তকেশীর আসার আশায় প্রায়শই ডাব মজুত থাকে। সুবৰ্ণলতারই ব্যবস্থা।

ডাব, গঙ্গাজল আর তসরের থান।

কাপড় ছেড়ে হাতেমুখে গঙ্গাজল ছিটিয়ে ডাবটি খেয়ে ছেলের সংসারের কল্যাণ করেন মুক্তকেশী।

আজ কিন্তু হাঁ-হাঁ। করে উঠলেন।

বললেন, থাক, থাক আজ—

সুবৰ্ণলতা। তবু থাকবে কেন বলে চলে গেল।

আর সুবৰ্ণলতা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সহসা গলা নামালেন মুক্তকেশী। ফিসফিস করে কী যেন বললেন ছেলেকে, ঈষৎ চমকে উঠলো ছেলে, মুখে যেন বিপন্ন ভাবের ছায়া পড়লো তার, বারকয়েক মাথা নাড়লো আচ্ছা এবং না বাচক, তার পর সাবধান হয়ে সোজা হয়ে বসলো।

সুবৰ্ণলতার অঞ্চল।প্রান্তের আভাস দেখা গেছে।

প্রসঙ্গ চাপা দেবার জন্যেই যেন গলাটা আবার তুললেন মুক্তকেশী, বললেন, আজ আর বসবো না বেশিক্ষণ, বুদোর জন্যে একটা কনে দেখতে যাবার কথা আছে সুবোর, দেখি গে। বললাম একা না ভ্যাকা, বাপ-কাকা যাক, তা পোকা-পোভা দুজনেই ঘাড় নাড়লো। ছেলের বিদ্যোবুদ্ধি কম, তার বিয়ের কথা কইতে ওনাদের মান্যে আঘাত লাগবে। সুবো আমার ভালমানুষ-

হঠাৎ ওঘর থেকে পারু এসে উদয় হয়, একটু তীক্ষ্ণহাসি হেসে বলে, ঠাকুমা বুঝি এবার ঘটকালি পেশা ধরেছি?

মুক্তকেশী থতমত খান।

মুক্তকেশী অবাক হন।

কারণ এর জন্য প্ৰস্তৃত ছিলেন না মুক্তকেশী, তবে সামলাতে তিনি জানেন। সামলে নিয়ে বলেন, ওগো অ মেজবৌমা, এ মেয়েকে আরো বিদ্যেবতী করতে চাও? এখুনি তো উকিলব্যারিস্টারের কান কাটতে পারে গো তোমার মেয়ে। কথার কী রাঁধুনি! আমি নয়। ঠাকুমা, ঠাট্টার সম্পর্ক ঠাট্টা করেছে, তবে অন্য ক্ষেত্রে এরকম বোলচাল নিন্দের।

তোমার কাছে কোনটাই বা নিন্দের নয়। ঠাকুমা—, পারুল হেসে ওঠে, তোমাদের সবই বাবা অনাছিষ্টি! ইস্কুলে পড়লে বাঁচাল হয়, ইংরেজি শিখলে বিধবা হয়—

হয়, চোখের ওপর দেখছি লো। তোর বাবার নলিন কাকার নাতনী পান্তির অবস্থা দেখলি না? ঘটা করে মেয়েকে মেম রেখে ইংরেজি শেখানো হয়েছিলো, বিয়ের বছর ঘুরল না, মেয়ে বিধবা হল না!

পারু ফট করে বলে, কিন্তু জ্যাঠামশাই তো বড়দির জন্যে মেম রাখেন নি ঠাকুমা–

মুক্তকেশী মুখ কালি করে বলেন, কুতর্ক করার বিদ্যেয় তুই যে দেখছি মার ওপরে উঠলি পারু! তোর বাপেরই জীবন অন্ধকার। যাই আজ উঠি।

ডাব খেলেন না।

বললেন পেট ভার।

কিছু উৎকৃষ্ট গোবিন্দভোগ চাল, এক বোতল গাওয়া ঘি, পোয়াটাক সাগু, এক সের মিশ্ৰী, গোটাপাচেক টাকা, আর একখানা নতুন গামছা নিয়ে আবার পালকিতে চড়ে বসলেন মুক্তকেশী। ছেলের বাড়িতে এলেই এসব জোটে তাঁর। ডাবটাও পালকিতে তুলে দিল সুবৰ্ণলতা।

পালকি-বেয়ারাদের হাতে ছটা পয়সা দিতে যাচ্ছিলো প্ৰবোধ, মুক্তকেশী ছোঁ মেরে পয়সাটা কেড়ে নিলেন ছেলের হাত থেকে, খরখর করে বলে উঠলেন, রেট্‌ বাড়াসনে পেবো, বাপের পুণ্যে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পেয়েছিস বলেই মা-লক্ষ্মীকে অবহেলা করিসনে। চার পয়সায় বরাবর যাচ্ছি-আসছি। দয়াদাক্ষিণ্য করে তুমি দু পয়সা বেশি দিলে অন্যের তাতে ক্ষতি করবে, তা মনে বুঝে। একবার বেশি পেলে আর কমে মন উঠবে?

এবারে বেয়ারা চারটে কিন্তু প্রতিবাদ করে ওঠে এবং প্ৰবোধও মায়ের দিকে করুণ মিনতি নিয়ে তাকায়, কিন্তু মুক্তকেশী অনমনীয়!

সদৰ্পে বলেন, দূর হ!।দুল হয়ে যা পালকি নিয়ে! ভাত ছড়ালে আবার কাকের অভাব? বলি পালকির বেত তো ছিঁড়ে ওয়ার হয়ে গেছে, পড়ে গিয়ে সোয়ারির হাড়গোড় না চূৰ্ণ হয়, ইদিকে পয়সার লালসাটি তো খুব আছে! যাবি, না যাবি না?

ওরা হাতের গামছাট ঘাড়ে চাপাতে চাপাতে ব্যাজার মুখে বলে, যিবো না কাঁই?

বেশ, ওই চার পালকিতে ওঠেন মুক্তকেশী।

পালকি-বেয়ারাদের পরিচিত ধ্বনিটা শোনা যায় কাছ থেকে ক্রমশ দূরে।

আরো দূরে গিয়ে যেন ক্ষুদ্ধ হৃদয়ের চাপা আৰ্তনাদের মত শুনতে লাগে।

 

মুক্তকেশী যতক্ষণ ছিলেন প্ৰবোদের প্রাণে যেন বল ছিল, মা চলে যেতেই মুখটা শুকিয়ে এল, কমে এল বুকের বল।

তবু কর্তব্য করতেই হবে।

তাই সুবৰ্ণলতার কাছে গিয়ে ইতস্তত করে বলে, মা তো একটা বার্তা দিয়ে গেলেন!

সুবৰ্ণ অবশ্য এই বার্তা সম্পর্কে বিশেষ উৎসুক হল না, শুধু মুখ তুলে তাকালো।

প্ৰবোধ জয় মা কালীর ভঙ্গীতে বলে ফেললো, তোমার বাবা যে ও বাড়িতে এক খবর পাঠিয়েছিলেন—

সুবৰ্ণলতা চমকে ওঠে।

তোমার বাবা!

খবর পাঠানো!

এ আবার কি অভিনব কথা?

সুবৰ্ণলতার যে একজন বাবা এখনো অবস্থান করছেন এই পৃথিবীতে, সে কথা কে মনে রেখেছে?

সুবৰ্ণলতা চমকে ওঠে, কিন্তু প্রশ্ন করতে পারে না। প্ৰবোধই আবার বলে, মানে এ বাড়ির ঠিকানা তো জানেন না। তোমারও একবৰ্গগা গো, আমারও ইয়ে হয় না— বাপ বলে কথা! সে যাক, খবর পাঠিয়েছেন, খুব নাকি অসুখ, তোমাকে একবার দেখতে চান–

তোমাকে একবার দেখতে চান!

সুবৰ্ণর বাবা সুবৰ্ণকে একবার দেখতে চান?

এটা কি সন্ধ্যাবেলা?

এই একটু আগেই না। দুপুর ছিল?

তবে এখন কেন চারিদিক ছায়াচ্ছন্ন হয়ে আসছে?

সুবৰ্ণ সেই হঠাৎ অন্ধকার হয়ে আসা পারিপার্শ্বিকের দিকে অসহায়ের মত তাকায়।

এ দৃষ্টি বুঝি সুবৰ্ণলতার চোখে একেবারে নতুন। প্ৰবোধও তাই অসহায়তা বোধ করে। অতএব তাড়াতাড়ি বলে, আরে বেশি ভয় পাবার কিছু নেই, মানে বয়স হয়েছে তো—মানে অসুখটা বেশি করেছে। হঠাৎ, মানে আর কি-ইয়ে তোমার এখুনি একবার যাওয়া দরকার।

সুবৰ্ণর চোখে জল নেই।

সুবৰ্ণর চোখ দুটো যেন ইস্পাতের।

সেই ইস্পাতের চোখ তুলে সুবর্ণ বলে, যাবার দরকার কি আছে এখনো?

বিলক্ষণ! নেই মানে? প্ৰবোধ যেন ধিক্কার দিয়ে ওঠে, এই কি মান-অভিমানের সময়? যতই হোক জনদাতা পিতা—

সে কথা হচ্ছে না—, সুবৰ্ণ যেন কথাও কয় ইস্পাতের গলায়, বাবার মরা মুখ দেখতে যেতে চাই না। আমি।

বললো এই কথা সুবর্ণ!

কারণ সুবর্ণর সেই কথাটা মনে পড়লো। বহুবার মনে পড়া, আর ইদানীং ধূসর হয়ে যাওয়া, সেই কথাটা। সুবৰ্ণ সেদিন জলবিন্দুটি পর্যন্ত না খেয়ে চলে এসেছিল বাবার কাছ থেকে, বাবা বলেছিল, আচ্ছা, যেমন শাস্তি দিয়ে যাওয়া হলো, তেমন টের পাবে! এই বাপের মরা মুখ দেখতে আসতে হবে।

বলেছিল, বলে সুবৰ্ণকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠেছিল সুবর্ণর বাবা নবকুমার। আর একটাও কথা বলেনি।

সেই শেষ কথা!

সেই কথাটাই মনে পড়লো সুবর্ণর, তাই বলে ফেললো, মরা মুখ দেখতে যেতে চাই না আমি।

প্ৰবোধ হাঁ-হাঁ করে ওঠে, কী আশ্চৰ্য, তা কেন ভাবছো? মানুষের অসুখ করে না?

সুবৰ্ণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

প্ৰবোধ বলে, কানু কলেজ থেকে—

কেন, কানু কেন? সুবৰ্ণলতা বলে, তুমি নিয়ে যেতে পারবে না?

আহা পারবো না কেন? তবে কথা হচ্ছে পারু একা থাকবে—

একা মানে? সুবর্ণ সেই ঝকঝকে শুকনো চোখে চেয়ে বলে, পারু বকুল দুজনে নেই? মানু সুবল এরাও তো এসে যাবে এখুনি-

আহা ওরা আবার মানুষ! মানে—মা বলে গেলেন নেহাৎ খবরটা দিয়েছে, না গেলে ভালো দেখায় না-

থাক, বেশী কথা ভালো লাগছে না, তুমি একখানা গাড়ি ডেকে দাও, আমি একাই যাবো—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *