ভিটে
শিশু-সাহিত্যিক হিসাবে অল্পবয়সেই পীযূষের বেশ নাম হয়েছে, বিশেষ করে রোমঞ্চকর আর ভূতের গল্পে ও এখন খুব জনপ্রিয়। সম্পাদকদের কাছ থেকে ওই ধরনের গল্পের জন্য প্রায়ই তাড়া আসে। গত বছর শিশু সাহিত্যের সেরা পুরস্কারও জুটেছে ওর ভাগ্যে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এবার দুই বাংলার শিশু-সাহিত্যিক সম্মেলন হচ্ছে। পীযূষও আমন্ত্রিত হয়েছে, ওকে যাবার জন্য বার বার করে বলেছে সংগঠকরা। পীযূষ ঠিক করেছে যাবে। যাবার আরও একটা কারণ আছে। ওদের আদি বাড়ি ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের এক গ্রামে। ছোটোবেলা ও গ্রামেই ছিল, দেশ বিভাগের পরেও। যখন ওর দশ বছর বয়স, তখন ওর বাবা-মা এ দেশে চলে আসেন। ওর জ্যাঠামশাই আর জ্যাঠাইমা কিন্তু আসেননি। তাঁদের ছেলে-মেয়ে ছিল না, বাবাকে বলেছিলেন, ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
ওরা প্রথমে রাণাঘাটে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, তারপর ওর বাবা একটু একটু করে যখন দাঁড়িয়েছেন ঠিক তখুনি মারা গেলেন। পীযূষের বয়স তখন পনেরো। ওর এক মামা ছিলেন বারাসতে সচ্ছল অবস্থা। ওর হাত ধরে মা সেখানে গিয়ে উঠেছিলেন। মামা-মামিমা আদর করেই ওদের ঠাঁই দিয়েছিলেন। বাবা বেঁচে থাকতে জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে চিঠির আদান-প্রদান ছিল। বাবার মৃত্যু সংবাদও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি খুব দুঃখ করে চিঠি লিখেছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে যায়।
শৈশব আর বাল্যের স্মৃতি আজও অটুট হয়ে আছে পীযূষের মনে। ওখানে খেলার মাঠ, পুকুর, গাছগাছালি কি না ছিল! ওর বন্ধু শওকত, জহর, আব্বাস, রহমান সবাই চোখের জল ফেলেছিল ওরা যখন চলে আসে। যাকে বলে ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়,’ তাই ছিল ওদের গ্রাম। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ওখানে ছড়ায়নি। বরং গাঁয়ের মুসলমানরাই হিন্দুদের বুক দিয়ে আগলে রাখত। কিন্তু আশেপাশের গাঁয়ের মানুষরা গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করেছিল তাই ওর বাবা আর ভরসা করতে পারেননি, দেশ ছেড়ে ছিলেন।
বাবা মারা যাবার পর কুড়িটা বছর কেটে গেছে। পীযূষ মামাবাড়ি থেকেই কলেজের পড়া শেষ করেছিল, ভালো ছাত্র ছিল। তারপর বি সি এস পাশ করে হাকিম হয়েছে, সেইসঙ্গে চলেছে সাহিত্য চর্চা। সাহিত্যে ছোটোবেলা থেকেই ওর ছিল অনুরাগ। এতদিন পরে বাংলাদেশ যাবার সুযোগ পেয়ে ওর আনন্দই হয়েছিল। নিজেদের ভিটে একবার ঘুরে আসবে। জ্যাঠামশাই জ্যাঠাইমার সঙ্গে দেখা করবে। কতদিন তাঁদের কোনো খবর নেই। কেমন আছেন কে জানে? জ্যাঠাইমাকে ও বলত বড়োমা, তিনি ওকে কোলে পিঠে করে বড়ো করেছিলেন, আর জ্যাঠামশাই তো ওর ব্যাপারে স্নেহে অন্ধ ছিলেন। জ্যাঠামশাইয়ের বয়স বোধ হয় এখন পঁচাত্তর হবে, আর জ্যাঠাইমার পঁয়ষট্টির কাছাকাছি। ওর মারই তো বয়স প্রায় ষাট হয়েছে।
ওর বাংলাদেশ যাবার কথা শুনে মা খুব খুশি হলেন, তিনিও সঙ্গে যেতে চাইলেন। কিন্তু পীযূষ যাবে একটা দলের সঙ্গে। ঢাকায় সম্মেলনের মধ্যে সময় করে ঘুরে আসবে গ্রাম। তা ছাড়া ও এখন দায়িত্বপূর্ণ পদে আছে, ছুটিও বেশি নিতে পারেনি, মাত্র কয়েক দিনের। মা কিন্তু জ্যাঠামশায় জ্যাঠাইমার জন্য সুটকেশ ভরে জিনিসপত্র গুছিয়ে দিলেন।
পশ্চিমবাংলা থেকে শিশু-সাহিত্যিকের যে দলটা যাচ্ছিল তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পরিচিত, তাই বেশ আড্ডার পরিবেশে পথটা কেটে গেল। ঢাকায় ওদের অভ্যর্থনার ত্রুটি ছিল না। দুই দেশের শিশু-সাহিত্যিকরা যেন ঘরোয়া পরিবেশে মিশে গেলেন। খুব ভালো লাগল পীযূষদের। মাতৃভাষা যাদের এক, তাদের মধ্যে একটা আন্তরিকতা আপনা থেকেই গড়ে ওঠে, ভাষা যত সহজে পরস্পরকে কাছে টানে আর কিছু বোধ হয় তা পারে না।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ছিল গল্প পড়ার আসর। উদ্যোক্তাদের অনুরোধে পীযূষ একটা ভূতের গল্প পড়ল। তবে গা ছমছম করা ভূতের গল্প নয়, বেশ মজার এক ভূতের গল্প। শ্রোতারা সবাই খুব হাততালি দিল।
তৃতীয় দিন ওদের লঞ্চে বুড়ি গঙ্গা নদী বেড়াবার ব্যবস্থা হয়েছিল। সারাদিনের প্রোগ্রাম, লঞ্চেই মোগলাই খানার ব্যবস্থা। পীযূষ ঠিক করল এই ফাঁকে ও নিজের গ্রাম ঘুরে আসবে। রাতটা জ্যাঠামশায় জ্যাঠাইমার সঙ্গে কাটিয়ে, সকালে পুরোনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা করবে, তারপর বেলা দশটা নাগাদ ওখান থেকে আবার রওনা দেবে। সম্মেলনের চতুর্থ দিন বত্তৃ«তা, কবিতা পাঠ আর সমাপ্তি উৎসব। তাতে ও উপস্থিত না থাকলে ক্ষতি নেই। পরের দিন পশ্চিমবাংলার অতিথিদের ফেরার পালা, তাঁদের সঙ্গেই ফিরতে পারবে ও।
সকাল দশটার মধ্যে লুচি আর আলুরদম খেয়ে ও বেরিয়ে পড়ল। নৌকো করে গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে যাবে। ছোটোবেলায় এই খাল বিল দিয়ে নৌকো করে যেতে ওর কী মজাই না লাগত। কত জায়গায় কচুরিপানা ভরতি খালের ভেতর দিয়ে যেতে হত। মাঝিরা বইঠা দিয়ে কচুরিপানা সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে যেত নৌকো। কী করে যে ওরা পথ চিনে যেত সেটা ওর কাছে ছিল একটা বিস্ময়।
নৌকোয় আরও যাত্রী ছিল। কয়েক জনের সঙ্গে আলাপ হল। কথায় কথায় ও বলল, পশ্চিমবাংলা থেকে শিশু সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছে, ফিরে যাবার আগে নিজের গ্রাম ঘুরে যাবার ইচ্ছেটা ছাড়তে পারেনি।
যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন স্কুল মাস্টার। বাংলা পড়ান। তিনি যাবেন ওদের গ্রাম ছাড়িয়ে আরও দুটো পরের গ্রামে। তিনি ওর পরিচয় শুনে বললেন,’হ, আপনার বই পড়ছি। ‘আন্দামানের বিভীষিকা’ বইডা আমার বাড়িতে আছে। কী সাসপেন্স সৃষ্টি করেছেন! চমৎকার বই।’ তারপর দীর্ঘ-নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আপনার পিতৃপুরুষের ভিটায় আপনি এখন পরদেশি। দ্যাশটা বাগ কইরা কার যে উপকার হইল খোদাই জানেন! স্বাধীনতার কী মূল্যই না আমাগো এখনও দিতে হইতাছে।’
ভদ্রলোকের নাম ইমানুল হক। দুপুরে তিনি পীযূষকে না খাইয়ে ছাড়লেন না। অনেকটা পথ যেতে হবে। বড়ো বড়ো পারশে মাঝের ঝোল দিয়ে ভাত। যেমন টাটকা মাছের স্বাদ তেমন রান্না।
সন্ধের মুখে ওকে ওদের গ্রামের নদীর ঘাটে নামিয়ে দিল মাঝি। ও একাই নামল ওখানে। কাল এই নৌকাটাই আবার ফিরে যাবে, মাঝিকে ও বলে রাখল, ঘাটে ও থাকবে, ওকে যেন তুলে নেয়। ইমানুল হকের কাছে বিদায় নিয়ে ও বলল, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। ঠিক যেন আপনজন।’
ইমানুল হক মৃদু হেসে বললেন, ‘আল্লা আপনারে দোয়া করবেন।’
নৌকো ছেড়ে দিল। সুটকেশটা হাতে নিয়ে পীযূষ হাঁটা দিল। এত বছর পরেও এদিকটায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। পথ চিনে যেতে ওর একটুও কষ্ট হল না। এই নদীর ঘাটে ওরা বন্ধুরা কত বেড়াতে এসেছে। ছবির মতো সব কিছু ভেসে উঠছে মনের আয়নায়। সন্ধে হয়ে গেছে তাই ও একটু তাড়াতাড়ি পা চালাল।
গ্রামের বাড়িগুলি একটু ছাড়া ছাড়া। তবুও ঠিক চিনে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সদর দরজা বন্ধ, চারপাশে অন্ধকারে, জোনাকি পোকা মিটমিট করে জ্বলছে।
‘জ্যাঠামশাই, জ্যাঠামশাই। বড়ো মা, বড়ো মা।’ কয়েক বার ডাকাডাকির পর সদর দরজা খুলে গেল। অন্ধকারে আবছা এক পুরুষ মূর্তি বলল, ‘কে?’
‘আমি পীযূষ…খোকা, জ্যাঠামশাই।’
‘খোকা।’ পুরুষ কণ্ঠে যেন অপার বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, জ্যাঠামশাই, ঢাকায় এসেছিলাম, ভাবলাম একবার তোমাদের দেখে যাই।’
‘খোকা আইছে, অগো শুনছ, আমাগো খোকা আইছে।’ উত্তেজনা আর আনন্দে গলা কাঁপছে।
একটা কুপি হাতে দোর গোড়ায় এসে দাঁড়ালেন লাল পেড়ে শাড়ি, পাকা চুল এক মহিলা, পীযূষের জ্যাঠাইমা।
‘বড়োমা!’
পীযূষ এগিয়ে ওঁদের প্রণাম করতে যেতেই ওঁরা দু-পা পিছিয়ে গেলেন, জ্যাঠাইমা বললেন, ‘থাক থাক, এই ভর সন্ধ্যায় প্রণাম কইরা কাম নাই, অমঙ্গল হইব। তুই যে আমাগো দেখতে আইছস এই ঢের, আইজকাল কেইবা কারে মনে রাখে।’
জ্যাঠাইমার গলায় অভিমানের সুর।
‘বাবা মারা যাবার পর আমাদের অনেক কষ্ট গেছে বড়োমা।’ পীযূষ বলল, ‘তোমরা তো সব জান না।’
‘না জানলেও বুঝি কি আর নাই,’ এবার জ্যাঠামশাই বললেন, ‘কিন্তু আমাগো করনের কিচ্ছু আছিল না। আমরা বুড়া-বুড়ি এখানে বইশ্যা শুধু কপাল চাপড়াইছি।’
‘অরে ভিতরে আইতে কও’, জ্যাঠাইমা এবার বললেন, ‘বাইরে খাড়া রাইখ্যা কথা কইবা নাকি। আয়রে খোকা, ভিতরে আয়।’
ওঁরা দু-জন দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। পীযূষ ঘরে ঢুকল। টিম টিম কুপির আলোয় ঘরের কিছুই দেখা যায় না, তবু ওর মনে হল ঘরটা বড়ো অপরিষ্কার। ওর বড়ো দুঃখ হল। এই বয়সে একা একা জ্যাঠামশায় জ্যাঠাইমা মাটি কামড়ে এখানে পড়ে আছেন, দেখাশোনা করবার কেউ নেই। কেমন করে দিন চলে কে জানে। জ্যাঠামশায়ের পরনের ধুতিটা আর জ্যাঠাইমার শাড়িটায় মলিনতার ছাপ।
‘তোমাদের জন্য মা অনেক জিনিস পাঠিয়েছেন,’ ও সুটকেশটা মাটিতে রেখে খুলতে খুলতে বলল, ‘জ্যাঠামশাই তামাক খেতে ভালোবাসেন তাই অম্বুরি তামাকও দিয়ে দিয়েছেন।’
কথাটা বলে ও মুখ তুলে তাকাল, আর কেমন যেন একটা হোঁচট খেল। জ্যাঠামশাই আর জ্যাঠাইমা ওর দিকে অমন করে তাকিয়ে আছেন কেন! দু-জোড়া চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে।
বোধ হয় ওর মনের কথা বুঝতে পেরে জ্যাঠাইমা বলে উঠলেন, ‘তরে দ্যাখতাছিরে খোকা, চক্ষু ভইরা দ্যাখতাছি। সেই দশ বছরের পোলাডা আজ কত বড়ো হইছে। আইলিই যদি আরও আগে আইলি না ক্যান? তরে লইয়া কত আনন্দ করতাম, এখন যে আমাগো কিছুই নাই।’
‘তার জন্য ব্যস্ত হতে হবে না বড়োমা,’ পীযূষ বলল, ‘আমার রাত্রে না খেলেও চলবে, পেট ভরাই আছে। আগে আসার সুযোগ হয়নি, এখন তো এটা বিদেশ, ইচ্ছে করলেই আসা যায় না।’
‘হ, বিদেশ!’ জ্যাঠামশাই এবার বললেন, ‘এই দ্যাশের লাইগাইতো সূর্য স্যানরা প্রাণ দিছিলেন।’
‘থাক থাক ওইসব কথা’, জ্যাঠাইমা বাধা দিয়ে বললেন, ‘শোন খোকা তুই পুকুরঘাটে গিয়া হাত-মুখ ধুইয়া আয়। এই কুপিটা লইয়া যা। আর আসনের সময় শওকতের লগে দেখা কইরা আসিস। তর কথা কতবার কয়, এতদিনেও ভোলে নাই তরে। আমি রান্না বসাইয়া দিতাছি। তুই কইমাছ খাইতে ভালোবাসিস, তাই রান্ধুম।’
‘তুমি ব্যস্ত হয়ো না বড়োমা,’ পীযূষ বাধা দিয়ে বলে।
‘তর বড়ো মায়েরে কি ভিখারিণী ভাবতাছস খোকা!’ জ্যাঠাইমা অভিমানের কণ্ঠে বললেন, ‘এতকাল পরে তুই আইছিস, তরে এক মুঠা ভাত আর মাছ খাওয়াইতে পারুম না!’
‘না, না, আমি সেকথা মনে করে বলিনি বড়োমা,’ পীযূষ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, আমি পুকুরঘাট হয়ে আসছি। আমার কাছে টর্চ আছে কুপি লাগবে না। আসার সময় শওকতের সঙ্গে দেখাও করে আসব। ওকে এমন চমকে দেব না,’ জোরে জোরে হেসে উঠল পীযূষ। ‘তোমাদের জিনিসপত্তরগুলো গুছিয়ে রাখ, আমি বেশি দেরি করব না। কাল দশটার আগেই কিন্তু নৌকার ঘাটে যেতে হবে।’
ও চলে গেল। ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে ও চলল শওকতের বাড়ি। ওদের বাড়িটাই সবচেয়ে কাছে আর শওকতই ছিল ওর প্রাণের বন্ধু।’
বাড়ির সামনের ঘরে একটা পেট্রোম্যাক্স জ্বলছিল। ঘরে উজ্জ্বল আলো।
পীযূষ বাইরে থেকে ডাকল, ‘শওকত।’
ঘরের ভেতর থেকে এক জন বেরিয়ে এল। পরনে লুঙ্গি, গায়ে একটা ফতুয়া। একটু কালো, মোটাসোটা চেহারা, কোঁকড়া চুল।
‘শওকত আছে?’
‘আপনারে তো চিনতে পারলাম না।’
পীযূষ কিন্তু চিনেছিল, ওই কোঁকড়ানো চুল দেখেই চিনেছিল, হাসিমুখে বলল, ‘আমি পীযূষ।’
‘পীযূষ!’
‘হ্যাঁ রে, হ্যাঁ, তোর ছেলেবেলার বন্ধু পীযূষ। চিনতে পারছিস না?’
এবার শওকত এক লাফে মাটিতে নেমে ওকে প্রায় বগলদাবা করে ঘরের ভেতর নিয়ে এল তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘আব্বা, আম্মা, দেইখ্যা যাও ক্যাডা আইছে।’
ওর চিৎকারে একজন বৃদ্ধ আর একজন বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। শওকত ওর পরিচয় দিতেই তাদের মুখে ফুটে উঠল হাসি। পীযূষও এগিয়ে তাঁদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারপর শুরু হল প্রশ্নবাণ। কোথায় আছে, কী করছে, মা কেমন আছেন, এখানে কী করতে এসেছে এইসব।
একটা করে প্রশ্নের উত্তর দিল পীযূষ সব শেষে বলল, ‘ঢাকায় যখন এসেইছি, ভাবলাম এখানে একবার ঘুরে যাব, সবার সঙ্গে দেখা হবে।’
‘তা তর মালপত্তর কই?’ শওকত বলল, ‘হাত তো খালি দ্যাখতাছি।’
‘কেন, বাড়িতে রেখে এসেছি। জ্যাঠাইমাই তো বললেন, পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে আয়, আর আসার আগে শওকতের সঙ্গে দেখা করে আসবি।’
শওকতের মুখে কেমন একটা ছায়া পড়ল, তাকাল ওর মা-বাবার মুখের দিকে, তারপর বলল, ‘চাচির লগে দেখা হইছে?’
‘হ্যাঁ, কেন হবে না!’ পীযূষ অবাক হয়ে বলল, ‘জ্যাঠামশাই জ্যাঠাইমা দু-জনের সঙ্গেই দেখা হয়েছে। ওঁদের চেহারা কিন্তু তেমন বদলায়নি।’
শওকতের মা ওকে হাত ধরে বসালেন, গায়ে হাত বোলাতে লাগলেন।
‘কী ব্যাপার!’ পীযূষ বলল।
‘ব্যপারটা হইল কী’, গলা খ্যাঁকারি দিয়ে শওকত বলল, ‘তর জ্যাঠামশাই জ্যাঠামায়েরে পনেরো বৎসর আগে আমরাই শ্মশানে দাহ করেছি, আপনজন কইতে আর তো কেউ আছিল না।’
‘কি বলছিস তুই!’ পীযূষ যেন আকাশ থেকে পড়ল।
‘হ’ এবার বললেন, শওকতের মা, ‘তর আব্বার খবরটা পাইবার পরেই অগো শরীর ভাইঙ্গা পড়েছিল, কয়েকটা বৎসর বাঁইচ্যা ছিলেন। তর কথা খুব কইতেন, মরণের আগে একবার তরে চক্ষে দ্যাখবার বড়ো সাধ হইছিলরে।’
‘কিন্তু আমি যে একটু আগে তাদের সঙ্গে কথা বলে এলাম,’ পীযূষ যেন বিশ্বাস করতে চায় না।
‘ঠিক আছে, আমার লগে চল’, একটা লন্ঠন হাতে নিয়ে শওকত চলল, পীযূষও তার পেছন পেছন।
বাড়ির সদর দরজা বন্ধ। শওকত ঠেলা মারতেই খুলে গেল, আর লন্ঠনের আলোয় একরাশ ধুলো মাটি থেকে শূন্যে ভাসতে লাগল, ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। শওকতের হাতের আলো পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা সুটকেশটার ওপর। ওটা খোলা অবস্থায় সেইভাবেই পড়ে আছে। শওকত ওকে নিয়ে সব ঘরে গেল। কোথায় জ্যাঠামশাই জ্যাঠাইমা, তাঁদের চিহ্নমাত্র নেই।
‘চল’, সুটকেশটা বন্ধ করে হাতে তুলে নিয়ে শওকত বলল, ‘আমাগো ঘরে চল।’
বিমূঢ়ের মতো ওর অনুসরণ করল পীযূষ, কিছুই যেন ওর মাথায় ঢুকছে না। ওর আসার খবর পেয়ে পুরোনো বন্ধুরা দেখা করতে এল। কিন্তু পীযূষ কারো সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে পারল না, একটা অপরিসীম দুঃখে ওর বুকের ভেতরটা যেন ভারী হয়ে উঠেছে।
পরদিন সকালে শওকতের মা-বাবার কাছে বিদায় নিয়ে ও নৌকোর ঘাটের দিকে হাঁটা দিল। যাবার আগে একবার নিজেদের বাড়ি ঘুরে গেল। রাত্রে বুঝতে পারেনি, দিনের বেলা বাড়িটা দেখে ও আঁতকে উঠল, একটা পোড়োবাড়ি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। এখানে-ওখানে ভেঙে পড়েছে, বাসের উপযোগী নয়। তারই দোরগোড়ায় ও কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করল। এটাই যে ওর পূর্বপুরুষের ভিটে। শওকত ওর সঙ্গে ছিল।
নৌকোয় ওঠার আগে ওর হাত দুটো ধরে শওকত বলল, ‘আমাগো উপর রাগ লইয়া যাইস না পীযূষ। এতকাল পরে এখন বুঝতাছি এইডা ভালো হয় নাই, ভাগাভাগি, রক্তারক্তি ইয়ার লাইগ্যাই কি আমাগো আল্লা আর তগো ভগবান আমাগরে সৃষ্টি করেছিলেন!’
সারাটা পথ ওই কথাটাই কানে বাজতে লাগল পীযূষের, আর ভেসে উঠতে লাগল জ্যাঠামশাই জ্যাঠাইমার মুখ। একটা কান্না ওর বুক ঠেলে আসতে চাইছে।