রাতের হাতছানি
ভারী ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটতে আমার কষ্টই হচ্ছিল, তাই দামি গাড়িটা থামিয়ে ভদ্রলোক আমার গন্তব্যস্থল জিজ্ঞেস করতেই আমার মন আশায় নেচে উঠল। আমার জবাব শুনে ভদ্রলোক দরজা খুলে বললেন, ‘আসুন, আমিও ওদিকেই যাচ্ছি।’
আমি ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। ভদ্রলোক ভারী ব্যাগটার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি বললাম, ‘কলকাতা থেকে এসেছি, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। এ অঞ্চলটা আমার আওতায়। তাই গত ক-দিন ধরে খুব ঘুরতে হচ্ছে। একটা সাইকেল রিকশা করে আসছিলাম, মাঝরাস্তায় ওটার চেন ছিঁড়ে গিয়ে এই বিপত্তি। আধ ঘণ্টার ওপর হাঁটছি। একটা রিকশা কিংবা গাড়ি চোখে পড়ল না।’
‘এদিকটায় গাড়ি চলাচল কম,’ ভদ্রলোক সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার সঙ্গে দেখা হয়ে না গেলে আপনাকে অনেকটা পথ হাঁটতে হত।’
‘আপনার সঙ্গে দেখা হবে তা হয়তো আমার কপালে লেখাই ছিল,’ আমি একটু পরিহাস করার চেষ্টা করলাম।
‘হয়তো তাই,’ ভদ্রলোক মৃদু হেসে জবাব দিলেন।
ভদ্রলোক না বলে যুবক বলাই বোধ হয় ব্যাকরণসম্মত হবে। পঁচিশ থেকে সাতাশের মধ্যে বয়স। লম্বা, পাতলা চেহারা, একটু ফ্যাকাশে, কিন্তু ঠিক হীনস্বাস্থ্য তাও বলা চলে না। চোখে-মুখে একটা আভিজাত্যের ছাপ চোখে পড়ে।
কথায় কথায় আলাপ হল।
নাম জয়ন্ত ভাদুড়ি, বাবা সঞ্জয় ভাদুড়ির লোহার ব্যাবসা ছিল, প্রচুর টাকা করেছিলেন। বছর দুই হল মারা গেছেন। জয়ন্তর ব্যাবসাপত্র ধাতে সয় না। তাই সব বিক্রি করে দিয়েছে। এমনিতেই তার বাবা যা রেখে গেছেন তা দু-তিন পুরুষের পক্ষে যথেষ্ট, সে একা মানুষ, টাকার অঙ্ক আরও বাড়িয়ে কী করবে? তবে একেবারে পায়ের ওপর পা দিয়ে অলস জীবনযাপনও তার উদ্দেশ্য নয়। তাই সময় কাটাবার জন্য একটা কিছু করবে ভাবছে।
সঞ্জয় ভাদুড়ি নামটা আমার কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল, কোথায় যেন শুনেছি এবং তা যেন প্রীতিকর নয়, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
আমি রাতটা হোটেলে কাটাব শুনে জয়ন্ত বলল, ‘একটা রাতের ব্যাপার, আপনার আপত্তি না থাকলে আমার ওখানেই থাকতে পারেন।’
আমি একটু অস্বস্তি বোধ করলাম, এতটা সুবিধে নেওয়া আমার উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। মুখে বললাম, ‘আপনাকে বিব্রত করতে চাই না…’
‘ভুল বললেন,’ জয়ন্ত গম্ভীর মুখে বলল, ‘আপনি বরং আমাকে বাধিত করবেন। অনেকদিন প্রাণ খুলে কথা বলি না, আপনার মতো একজন সঙ্গী পেলে রাতটা ভালো কাটবে।’
আমি তার কথার ভঙ্গিতে অবাক হলাম। যাহোক, একথার পর আর আপত্তি করা চলে না। তাই আমিও তাকে দ্বিতীয়বার ধন্যবাদ জানালাম।
‘ভাদুড়ি ভিলা’ ওই অঞ্চলের শেষ সীমানায়। জায়গাটা বেশ নির্জন। প্রকাণ্ড বাড়ি, বিরাট জমি, বড়ো বড়ো গাছ। বাড়ির ভেতর ঢুকলাম, প্রথমেই বসবার ঘর, সাজানো গোছানো। একটা গোল পাথরের টেবিলের ওপর দামি ফ্রেমে আঁটা একটি সুন্দরী সপ্তদশীর ছবি আমার চোখে পড়ল। সপ্তদশী কথাটা হয়তো আমি একটু কাব্য করে বলছি কিন্তু ছবি দেখে বয়স তাই মনে হয়। বাড়িতে গৃহস্বামী ছাড়া আর কেউ না থাকলেও ঘরের কাজ করার লোক আছে জনা চারেক— হয়তো অতবড়ো বাড়ি ঝকঝকে তকতকে রাখতে গেলে ওর কম লোকে চলে না।
ওদের মধ্যে একজন বড়ো একটা ট্রে করে চা আর খাবার নিয়ে এল। আমার খিদেও পেয়েছিল প্রচণ্ড। চায়ের পাট শেষ হতে জয়ন্ত বলল, ‘চলুন, আপনাকে বাড়িটা দেখাই। বাড়ির প্রত্যেকটা ঘর সত্যিই ঝকঝকে, চমক লাগবার মতো। নারীবর্জিত গৃহে এমন পরিচ্ছন্নতা আর সুরুচি আমাকে বিস্মিত করল।
আরও একটি জিনিস আমি লক্ষ করলাম, প্রায় প্রত্যেক ঘরেই ওই মেয়েটির ছবি। তবে কি মেয়েটির কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়ন্ত নির্জন, নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছে?
জয়ন্তর মধ্যে অস্বাভাবিকতার প্রথম লক্ষণ আমি টের পেলাম, যখন ও আমাকে বাইরের বাগান ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল।
বড়ো বড়ো ফল গাছ ঋতুর ফলে ভরে আছে, কেউ খায় বলে মনে হয় না। একটা বড়ো কুল গাছ আমার চোখে পড়ল। অজস্র কুলে গাছটা ছেয়ে গেছে, আকারেও এত বড়ো যে সহজে চোখে পড়ে না, তার ওপর আবার রং ধরেছে। রসালো, লোভনীয়।
ঠিক আমার সামনে একটা টোপা কুল গাছ থেকে টুপ করে ঝরে পড়ল। আমি ওটা কুড়িয়ে মুখে দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু জয়ন্ত এক ঝটকায় আমার হাত থেকে কুলটা ফেলে দিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘না না, ভগবানের দোহাই, এ গাছের পাতা পর্যন্ত ছোঁবেন না।’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
জয়ন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আমি আপনার ভালোর জন্যই ওই কুলটা খেতে দিইনি। বাগানে আরও অনেক ফলের গাছ আছে, যত ইচ্ছে ফল খেতে পারেন, শুধু ওটি বাদে।’
আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলাম না। জয়ন্ত যেন আপন মনেই বলল, ‘গাছটা কতবার কেটে ফেলব ভেবেছি, কিন্তু সাহসে কুলোয়নি।’
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল প্রায় রাজকীয়। জয়ন্ত যে শুধু প্রচুর সম্পত্তির মালিক তাই নয়, একজন ভোজনবিলাসীও বটে। তার পরিচয় পেলাম খেতে বসে। মাংসের চাররকম পদ। আর কী সুস্বাদু, মুখে দেওয়ামাত্র যেন গলে যেতে লাগল। খেতে খেতে মামুলি কথাবার্তা হল।
আমরা আবার বসবার ঘরে এসে বসলাম। জয়ন্ত দামি সিগারেটের টিনটা আমার দিকে বাড়িয়ে নিজেও একটা ধরাল, তারপর মুচকি হেসে বলল, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন আমার মাথায় নিশ্চয়ই গোলমাল আছে। ইচ্ছে করলেই আমি শহরের বিলাস বৈভবের মধ্যে গা ভাসিয়ে দিতে পারি, নিদেনপক্ষে জীবনটা উপভোগ করতে পারি, কিন্তু তা না করে আমি লোকালয়ের বাইরে এই নির্জন বৈচিত্র্যহীন জীবন বেছে নিলাম কেন?’
আমি অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললাম, ‘না না…।’
জয়ন্ত একটা হাত তুলে আমার কথায় বাধা দিয়ে বলল, ‘আপনার চোখ-মুখ কিন্তু তাই বলছে, তা ছাড়া কুলের ব্যাপারটাও আছে। সিগারেটে বড়ো একটা টান দিয়ে জয়ন্ত আবার বলল, ‘গাড়িতে আপনি বলেছিলেন না, আমার সঙ্গে দেখা হওয়া আপনার কপালে লেখা ছিল? ওটা আমার বেলাও প্রযোজ্য। হঠাৎ কী মনে করে গাড়ি থামিয়েছিলাম। অমন তো কত লোককেই পথ দিয়ে হাঁটতে দেখি। একজনের কাছে আমার সব কথা খুলে না বলে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না, আপনাকেই কেন জানি সেই লোক মনে হয়েছিল। আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?’
‘না, না,’ আমি সজোরে প্রতিবাদ করে উঠলাম।
‘আমার বাবার কথা আগেই বলেছি,’ জয়ন্ত আবার শুরু করল, ‘তিনি এখানকার একজন মানী লোক ছিলেন, সবাই তাঁকে উদার, পরোপকারী বলে জানত। বাড়িতে কিন্তু তিনি ছিলেন একেবারে অন্য মানুষ— নির্দয়, নিষ্ঠুর। চাকর-বাকররা তাঁর ভয়ে সব তটস্থ থাকত। বাবার নিষ্ঠুরতায় আমার মা-র বুক ভেঙে গিয়েছিল, অকালে আমি তাঁকে হারিয়েছিলাম। বাইরের লোকের কাছে বাবার রূপটা যে একটা ছদ্মবেশ, তা আমার মা বুঝতে পেরেছিলেন।
‘আমার স্বভাবও মা-র মতো হয়েছিল। তাই বাবার রাগের শেষ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ছেলেও হবে তাঁরই মতো বেপরোয়া, নিষ্ঠুর। আমাদের পরস্পরের সম্পর্কটা হয়ে উঠেছিল ঘৃণা আর বিদ্বেষের, বিশেষ করে মা মারা যাবার পর।
‘আমাদের এক পুরোনো চাকর ছিল, বাবার ছোটোবেলার আমলের। অমন ভালোমানুষ হয় না। আমাকে সে খুব ভালোবাসত। সে খুব বুড়ো হয়ে পড়েছিল, আমার ঠাকুরদার সময়কার লোক, বুঝতেই পারছেন। বাবা একদিন সামান্য কারণে তাকে বরখাস্ত করলেন। বেচারার কেউ ছিল না, আমাদের সংসারে জীবনপাত করেছিল। মনের দুঃখে সে আত্মহত্যা করে। ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে। বাবার রূঢ় আচরণ আদালতে ওঠেনি।
‘ওই ঘটনার পর বাবার সঙ্গে আমার তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল। বাবা চাইতেন একচ্ছত্র আধিপত্য, তাঁর রাজত্বে কারো টুঁ শব্দটি করার অধিকার থাকবে না। আমি টাকাপয়সার ব্যাপারে তাঁর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম, নিজের কোনো রোজগার ছিল না, তাই ইচ্ছে করলে তিনি আমাকে বিষয়সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না, আমাকে আরও বেশি হেনস্থা, লোকের চোখে হেয় করার সংকল্প তিনি এঁটেছিলেন।
‘ওই ঘটনার কয়েক মাস পর বাবা মারা গেলেন, স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, আত্মহত্যা। এবার কিন্তু ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ল না। বাবার শেষ লেখা একটা চিঠি পুলিশের হাতে পড়ল। তিনি লিখেছিলেন আমার অকৃতজ্ঞতা, আমার স্বভাব আর চারিত্রিক দুর্বলতাই তাঁর জীবনে চরম হতাশা এনে দিয়েছে, তাই ওই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন।
‘আমাকে আদালতের কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছিল। ছাড়া পেলেও সকলের ধিক্কারে আমি মরমে মরে গিয়েছিলাম। বাবা বাইরের লোকের কাছে প্রিয় ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যুর জন্যে আমিই যে নীতিগতভাবে দায়ী সে-বিষয়ে কারু মনে সন্দেহ ছিল না। সকলের চোখে আমি হেয় হয়ে গিয়েছিলাম।
‘শুধু একজন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে হল অরুণা। আপনি হয়তো ওর ছবি দেখেছেন…।’
আমি ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালাম।
‘আমরা দু-জনে দু-জনকে ভালোবাসতাম। আমি ওকে বিয়ে করব ঠিকই করেছিলাম…।’
‘করেছিলাম বলছেন কেন?’ আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
‘আমিই পেছিয়ে এসেছি, সে অন্য এক ব্যাপার।’
‘আপনি দেশভ্রমণে যেতে পারতেন, এখানকার বসবাস উঠিয়ে দিতে পারতেন,’ আমি উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে মন্তব্য করলাম।
‘তা পারি না। বাবার উইলের নির্দেশে আমি এখানকার বাস ওঠাতে পারব না আর বছরের এগারো মাস এখানেই থাকতে হবে। এই নির্দেশ অমান্য করলে সম্পত্তি, টাকাকড়ি সব কিছু আমার এক খুড়তুতো ভাই পাবে। বাবা সেসব চিন্তা করেই উইল করেছিলেন, আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে এখানে বেঁধে রাখার কোনো ফাঁকই তিনি রাখেননি। নিজের কোনো রুজিরোজগার থাকলে হয়তো আমি এসব পায়ে ঠেলে চলে যেতাম।’
‘কিন্তু অরুণা দেবীর সঙ্গে বিয়েতে আপনি পেছিয়ে এলেন কেন?’ আমি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলাম না। ‘উনি আপনাকে ভালোবাসতেন, ওঁকে বিয়ে করলে আপনি একজন মনের মতো সঙ্গিনী পেতেন।’
জয়ন্ত সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিল না। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিয়েছে, জেনেশুনে একজনের জীবন আমি নষ্ট করতে পারি না।’
‘আপনি কি কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন?’
‘না, দরকার মনে করিনি।’
‘আপনার কথা শুনে আমার অবাক লাগছে, কারণ সত্যিই যাদের মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দেয় সাধারণত তারা তা বুঝতে পারে না কিংবা বুঝলেও অন্যের কাছে গোপন রাখার চেষ্টা করে।’
‘হয়তো আমি অসাধারণ,’ জয়ন্ত নীরস কণ্ঠে জবাব দিল।
‘আমার ধারণা আপনি মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়ায় ভুগছেন, মানসিক রোগে নয়।’
‘আপনার ধারণা সত্যি হলে আমি খুশিই হতাম, আমি আরও একটা রোগে ভুগছি, ইংরেজিতে যাকে আমরা ডিলুজ্যন বলি।’
‘কুলগাছের ব্যাপারটা?’ আমি মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।
জয়ন্ত আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর বলল, ‘হয়তো তাই।’
দোতলায় একটা বড়ো ঘরে আমার শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল। বড়ো একটা খাটে নরম গদির বিছানা। শোবার সঙ্গেসঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে অপরিচিত পরিবেশে আমি কোথায় শুয়ে আছি, ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। ঘোরটা কেটে যেতেই আমি চমকে উঠলাম। পরিণত বয়স্কের একটা মুখ আমার ওপর ঝুঁকে পড়েছে। চাঁদের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখলাম হলদে, গোলপানা, কুটিল, নিষ্ঠুর একটা মুখ। ওটার ঠোঁট দুটো নড়ছিল, যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু আমি কিছু শুনতে পেলাম না, শুধু ফিসফিস একটা শব্দ আমার কানে এল।
আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। চিৎকার করবার চেষ্টা করলাম কিন্তু গলা দিয়ে টুঁ শব্দটি বেরুল না। মাত্র দু-এক মিনিট, তারপরই মুখটা মিলিয়ে গেল।
মুখটা বেলুনের মতো যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল, শরীরের অন্য কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমার চোখে পড়ল না। তারপরই আবার ওটা ভেসে এল। ঠোঁট দুটো আবার নড়ে উঠল, কদাকার দুটো ঠোঁট; এবারও কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না, কিন্তু ওটা কিছু বলতে চায় তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। ওটার কথাগুলো যেন কোনো অদৃশ্য মিডিয়ামের সাহায্যে আমার কানে পৌঁছে দেওয়া হল।
‘কুলগাছটার দিকে তাকাও, কুলগাছটার দিকে তাকাও।’
নরম বিছানায় শুয়ে আমার শরীর কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেল, ঘামে চাদর ভিজে গেল। মুখটা বোধ হয় বুঝতে পারল আমি ওর কথা বুঝতে পেরেছি, কারণ তারপরই ওটা অদৃশ্য হল।
কয়েক মিনিট আমি স্থির হয়ে শুয়ে রইলাম, যেন নড়বার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি। তারপরই এক লাফে বিছানা ছেড়ে আমি উঠে পড়লাম। শোবার আগে লক্ষ করেছিলাম, কুলগাছটা আমার মাথার সামনের জানলার ঠিক নীচেই।
জানলাটা খোলাই ছিল। আকাশে অসংখ্য তারা আর পাণ্ডুর চাঁদের আলোয় বাইরে আলো-ছায়ার লুকোচুরি চলছে। চারদিক নিস্তব্ধ, একটা সূচ মাটিতে পড়লেও বোধ হয় শব্দ হবে। শুধু কুলগাছের একটা মোটা ডাল নড়ার শব্দ হচ্ছিল। ডালটা নড়ার অবশ্য কারণ ছিল— ওটা থেকে কিছু একটা ঝুলছিল। একগাছা লম্বা দড়ি আর একটা মানুষের অস্পষ্ট চেহারা— দড়িটা ওটার গলায় এঁটে আছে। আমি শিউরে উঠলাম এটাই কি ওই বীভৎস মুখটা আমাকে দেখতে বলছিল। আমি তাড়াতাড়ি জানলা থেকে সরে এলাম। বাকি রাত আর আমি ঘুমুতে পারলাম না। ঘরের মধ্যে পায়চারি করে কাটিয়ে দিলাম। ভোরের প্রথম আলোয় আমি বাগানে নেমে নীচে এলাম। কুলগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম, কিচ্ছু নেই। তবে কি আমি ভুল দেখলাম? অসম্ভব! আমি তারপর আর ঘুমুইনি। তাই সবটাই দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
খানিক বাদেই জয়ন্ত বাগানে এল। আমার মুখের ভাব লক্ষ করে ও বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার? আপনাকে এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?’
‘রাতটা আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে কেটেছে,’ আমি জবাব দিলাম, ‘হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল আর মনে হল যেন একটা হলদে কদাকার মুখ আমার ওপর ঝুঁকে পড়েছে।’
‘সত্যি!’ জয়ন্ত প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ওর মুখে প্রচণ্ড বিস্ময় আর উত্তেজনার চিহ্ন ফুটে উঠেছে।
‘শুধু মুখ, আর কিছু না?’
‘না। একটা গোল, নিষ্ঠুর মুখ,’ আমি জবাব দিলাম।
জয়ন্তর সর্বাঙ্গ উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল।
‘তারপরের ঘটনা আমি জানি,’ ও বলল। ‘মুখটা আপনাকে কুলগাছটার দিকে তাকাতে বলেছিল। আপনি কী দেখেছিলেন বলতে হবে না। তবে ব্যাপারটা আমার কল্পনা নয়! ভগবানকে ধন্যবাদ, সব সত্যি। আগে আমি বিশ্বাস করিনি। আপনি যে মুখটা দেখেছিলেন তা আমার বাবার মুখ আর যাকে আপনি দেখেছিলেন সে হল রামুদাদা, আমাদের সেই পুরোনো চাকর। তারা দু-জনেই ওই কুলগাছে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আপনি আমার কী উপকার করলেন, তা হয়তো বুঝতে পারছেন না।’ উত্তেজনায় জয়ন্ত আমার দু-হাত চেপে ধরল।
‘আমার নিদারুণ অভিজ্ঞতায় আপনি বেশ খুশি হয়েছেন মনে হচ্ছে,’ আমি একটু রাগত কণ্ঠেই বললাম।
‘আমার কথা ভাবুন, রোজ রাতে আমাকে ওই দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাটাতে হয়।’ জয়ন্ত আমাকে প্রবোধ দিতে চাইল।
‘বুঝলাম। আমারও যাতে ওই অভিজ্ঞতা হয় তাই আপনি যেচে আমাকে আতিথ্য দিয়েছিলেন!’
আমি একটু ঠেস দিয়েই বললাম।
‘আপনি বুঝতে পারছেন না,’ জয়ন্ত প্রতিবাদের সুরে বলে উঠল, ‘আমি ছাড়া অন্য কেউ ওটা দেখেছে কিংবা দেখতে পারে কি না এটাই আমি জানতে চেয়েছিলাম।’
‘আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,’ আমি একটু বিমূঢ়ের মতো বললাম।
‘আপনার কাছে আমি আর লুকোব না।’ জয়ন্ত বলতে লাগল, ‘আমি ইচ্ছে করেই আপনাকে ও ঘরে শুতে দিয়েছিলাম। ওটা আমারই শোবার ঘর। আমি ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয় কি না তা আমি পরখ করতে চেয়েছিলাম।’
আমি তখনও অবুঝের মতো তাকিয়ে আছি দেখে জয়ন্ত বলল, ‘বুঝতে পারলেন না? আমি ভেবেছিলাম আমার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আপনিও ওটা দেখায় প্রমাণ হল আর পাঁচজনের মতোই আমি সুস্থ, স্বাভাবিক। এখন আমি নিশ্চিন্তমনে অরুণার কাছে আবার ফিরে যেতে পারব। আপনি আমাকে নতুন জীবন দান করলেন, তার জন্য আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’