বিলে সর্দার
সকাল সকালই সোমনাথরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। ও, ওর বউ, ফুটফুটে তিন বছরের মেয়ে শ্রীময়ী আর ওদের কাজের মেয়ে আরতি। কলকাতা থেকে গাড়ি করে ওরা যাবে তারাপীঠ। তার জন্য ড্রাইভার সমেত একটা অ্যামবাসাডার গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। সকালে বেরিয়েছে, সন্ধে সাতটার মধ্যে তারাপীঠ পৌঁছে যাবে। ওখানে একটা হোটেলে আগে থেকেই ঘর ভাড়া করে রাখা হয়েছিল, অসুবিধে কিছু হবে না। ট্রেনে করে আগেও কয়েকবার সোমনাথ তারাপীঠ গিয়েছে কিন্তু মোটরগাড়িতে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। যেখানে খুশি গাড়ি থেকে নেমে পড়, চারদিকে প্রাকৃতিক দৃশ্য, চোখ জুড়িয়ে যায়।
ওরা দক্ষিণেশ্বর হয়ে বিবেকানন্দ ব্রিজ পেরিয়ে দিল্লি রোড ধরল। ড্রাইভারের পাকা হাত, এসব রাস্তা তার অজানা নয়। ব্যান্ডেলে গাড়ি থামিয়ে ওরা প্রাতরাশ সারল। সেই সকালে শুধু চা পান করে বেরোতে হয়েছিল।
ব্যান্ডেলে কিন্তু ওদের দু-আড়াই ঘণ্টা আটকা পড়তে হল কারণ গাড়ির ডায়নামো পুড়ে গিয়েছিল, সেটা সারাতে সময় লাগল।
তারপর মগরা, পান্ডুয়া বর্ধমান হয়ে পানাগড়ে ওরা থামল। ওখানে পথের ধারে ধাবায় দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেবার জন্যেই থামা। ওখানকার ধাবার মাংস রান্নার খ্যাতি আছে। আশপাশের অনেকেই নরম পুরু রুটি দিয়ে ওই কষা মাংস খাবার জন্য গাড়ি নিয়ে চলে আসেন।
পানাগড়ে ওদের পৌঁছুবার কথা ছিল দুপুর একটায়, কিন্তু ব্যান্ডেলে দেরি হওয়ায় চারটে নাগাদ ওরা পৌঁছেছিল পানাগড়।
ওখান থেকে প্রায় উনিশ কিলোমিটার ইলমবাজারের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ওরা চলল দুবরাজপুরের দিকে, শান্তিনিকেতনকে ডান দিকে রেখে। পথে একটা বাঁধ ওদের চোখে পড়ল। দুবরাজপুর থেকে সিউড়ির পর রাস্তাটা এক জায়গায় দু-ভাগ হয়ে গেছে। একটা মালদার দিকে চলে গেছে, অন্যটা গেছে রামপুরহাট নলহাটির দিকে। ওদের যেতে হবে নলহাটির রাস্তায়। ওখান থেকে দশ বারো কিলোমিটার গেলেই তারাপীঠ।
সিউড়ির মোড়ে গাড়ি থামিয়ে ওরা চা-পর্ব সেরে নিল। পথের ধারেই চা আর মিষ্টির দোকান।
ওই মোড় থেকে নলহাটির রাস্তার দু-পাশে ঘন শালবন। নির্জন রাস্তা। এদিকে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে।
খানিকটা যাবার পরই গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ওদের চোখে পড়ল কালো মতন, লম্বা-চওড়া একজন মানুষ পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামাবার জন্য হাত নাড়ছে। ওদের গাড়ি থামাবার ইচ্ছে ছিল না। ওই নির্জন রাস্তায় কার কী মতলব কে জানে! ডাকাত-টাকাতও হতে পারে, হয়তো তার সাঙ্গোপাঙ্গরা গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে আছে। কিন্তু লোকটা এমনভাবে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে যে তাকে চাপা না দিয়ে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। অগত্যা ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে হল।
লোকটার গায়ে একটা হাফ হাতা সাদা জামা আর পরনে মালকোচা মারা ধুতি। পায়ে কিছু নেই। ঝাঁকড়া চুল। কপালের ওপর একটা কাটা দাগ।
‘আমি বড়ো বিপদে পড়েছি, আপনারা আমাকে মাইল দুয়েক যদি গাড়িতে নিয়ে যান খুব উপকার হয়,’ লোকটি বলল।
সোমনাথের বউ ইশারায় মানা করছিল, কিন্তু সোমনাথের কী মনে হল তাকে গাড়িতে উঠে আসতে বলল। সামনের আসনে নিজের পাশে লোকটিকে ও জায়গা করে দিল। ড্রাইভারেরও এ ব্যাপারে আপত্তি ছিল। সে ব্যাজার মুখে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ যাবার পর হঠাৎ ড্যাশবোর্ডের দিকে নজর পড়ল ড্রাইভারের আর সে চমকে উঠল। মাইল মিটারের কাঁটায় দেখা যাচ্ছে যেখান থেকে লোকটিকে সে তুলেছিল তার পর প্রায় একুশ কিলোমিটার পথ সে চলে এসেছে। অবাক কাণ্ড! এতটা পথ এল তবু শালবন শেষ হল না! তা ছাড়া এই অল্প সময়ের মধ্যে এতটা পথ আসা কী করে সম্ভব! মাইল মিটারের কাঁটাটা নিশ্চয়ই ঠিকমতো কাজ করছে না।
লোকটিকে লক্ষ করে সে বলল, ‘আপনি যে বললেন মাইল দুয়েক পরেই নেমে যাবেন, এ তো অনেকটা এসে গেছেন।
‘হ্যাঁ, এবার নামব,’ লোকটি একটু যেন কর্কশ গলায় জবাব দিল।
সত্যিই আর মিনিট দুই পরে এক জায়গায় গাড়ি থামাতে বলে সে নেমে গেল। ওরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার শুরু করল যাত্রা। সোমনাথের বউ গাড়ির পেছনের কাচ দিয়ে লোকটি কোথায় যায় দেখবার চেষ্টা করল, কিন্তু তাকে দেখতে পেল না।
আরও কিছুক্ষণ যাবার পর পেছন থেকে আরতি হঠাৎ বলে উঠল, ‘দেখো দেখো বউদি, আমরা যে বাঁধটা পেছনে ফেলে এসেছিলাম আবার সেখান দিয়ে যাচ্ছি। ওই যে দোকানগুলো, ওগুলো তখনও দেখেছিলাম।’
ততক্ষণে সন্ধে পেরিয়ে গেছে। রাস্তায়, দোকানে আলো জ্বলছে। সোমনাথরাও দেখল আর চমকে উঠল। ব্যাপারটা কী হল! ওরা তো সোজা পথেই যাচ্ছিল, পেছনে এল কী করে! এসব কি ওই লোকটার কোনো কারচুপি! কিন্তু সে তো চুপচাপ বসে ছিল।
সোমনাথের বউ বলল, ‘আর যাবার দরকার নেই, এখানেই কোথাও হোটেল দেখো, কাল দিনের বেলা যাওয়া যাবে।’
সোমনাথ কিন্তু অত সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নয়। ড্রাইভারকে ও বলল, ‘আমরা নিশ্চয়ই অন্ধকারে পথ ভুল করেছি, এবার দেখেশুনে চালাও।’
আবার সিউড়ি হয়ে গভীর শালবনের ভেতর দিয়ে রামপুরহাটের দিকে ওদের গাড়ি ছুটল। এবার ড্রাইভার বেশ জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল, পথে কেউ গাড়ি থামাতে বললে আর সে থামাবে না। তাতে যদি দুর্ঘটনা ঘটে ঘটবে। যা হোক, এবার রাস্তায় আর কোনো গোলমাল হল না।
তারাপীঠে ওরা যখন পৌঁছুল, তখন রাত পৌনে এগারোটা। অথচ গাড়িটা পিছিয়ে গিয়ে সিউড়ি থেকে ওদের দ্বিতীয়বার যাত্রা শুরু করার জন্য যে সময় নষ্ট হয়েছিল তার জন্য আরও পরে ওদের পৌঁছুবার কথা।
হোটেল মালিক সে রাত্রে ওদের পৌঁছুবার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কোনো কারণে হয়তো ওরা রওনা হতে পারেনি কিংবা রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়েছে।
সোমনাথের মুখে সব শুনে তিনি বললেন, ‘আপনারা খুব বেঁচে গেছেন। ওই শালবনের রাস্তাটা খুব বিপজ্জনক। কত যে ডাকাতি হয়েছে ওই রাস্তায়। গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের সর্বস্ব লুঠ করে তাদের খুন করেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।’
একটু চিন্তা করে তেনি বললেন, ‘আপনি যে লোকটির চেহারার বর্ণনা দিলেন তার সঙ্গে বিলে সর্দারের চেহারার মিল আছে।’
‘বিলে সর্দার!’ সোমনাথ একটু অবাক হয়ে বলল, ‘সে আবার কে?’
‘সে ছিল এক ডাকাত দলের সর্দার। দলবল নিয়ে ওই জঙ্গলে ডাকাতি করত, কত যে খুন করেছে তার হিসেব নেই। বছর কয়েক আগে পুলিশের সঙ্গে এক লড়াইয়ে ও মারা যায়। ওর দলের প্রায় সবাই পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিল। এখন তারা জেলে ঘানি টানছে।’
‘কিন্তু সে তো পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল বলছেন,’ সোমনাথ অবাক হয়ে বলল।
‘সে কথাই তো বলছি,’ হোটেলের মালিক জবাব দিলেন, ‘ওকে নাকি মাঝে মাঝেই দেখা যায়, বিশেষ করে যেদিন পুলিশের গুলিতে ও মারা গিয়েছিল সেদিন। আমার মনে হয় আজই সেই দিন।’
সোমনাথ স্তম্ভিত। তবে কী ওদের গাড়িটা যে আবার সিউড়ির দিকে পিছিয়ে গিয়েছিল, কিংবা ওই সময়ের গণ্ডগোল তা ভৌতিক ব্যাপার। আর সেই ভূতুড়ে কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল বিলে সর্দারের প্রেতাত্মা! ডাকাতির জন্য পথের মধ্যে গাড়ি থামাবার অভ্যেসটা মরে গিয়েও সে ছাড়তে পারেনি!
সোমনাথের বুদ্ধিতে আজও এ ঘটনার ব্যাখ্যা মেলেনি।