বিলাপী আত্মা
ফাঁসির আগে আসামি ম্যাথুসের স্বাস্থ্য ডা পিল্লাই বার দুই পরীক্ষা করেছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল কেরালায়, ডা পিল্লাই হলেন জেলের ডাক্তার। ওরা দু-জনই ক্রিশ্চান।
জীবনের আশা আর নেই জেনে ম্যাথুস ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। প্রতিটি রাতের পর প্রসন্ন সকাল যে তার জীবনের মেয়াদ ক্রমেই কমিয়ে আনছে তা জেনেও সে তেমন আতঙ্কিত হচ্ছিল না, মৃত্যুভয় যেন সে জয় করে ফেলেছে। তার জীবনের আবেদন সরকার নাকচ করে দিয়েছেন জানবার পর থেকে তার এই পরিবর্তনের শুরু। তার আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ বাঁচার ক্ষীণতম আশাও তার মনে যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ লোকটি দিবারাত্রের প্রতিটি ঘণ্টা মৃত্যুর অজানা বিভীষিকায় উন্মাদের মতো আচরণ করেছে। ডা পিল্লাই একজন মানুষের মধ্যে বাঁচার এমন তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর শেষ আশাটুকু নির্মূল হয়ে যাবার পর সেই লোকটিরই জীবন সম্বন্ধে নিরাসক্তি আর পরস্পর বিরোধী মনোভাবে বিস্মিত না হয়ে পারেননি। পরিবর্তনটা এত আকস্মিক যে ডাক্তারের মনে হয়েছিল আসামির আবেদন না-মঞ্জুর খবরটাই তার অনুভূতির সমস্ত ইন্দ্রিয়কে বিকল করে দিয়েছে। খবরটা শোনার পরই সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
সেই প্রথমবার ডা পিল্লাই তার চিকিৎসা করেন। জ্ঞান হবার পর থেকে তার এই অদ্ভুত পরিবর্তন।
যে অপরাধ সে করেছিল তার কোনো ক্ষমা নেই। জনসাধারণের মনেও ম্যাথুসের প্রতি বিন্দুমাত্র করুণার সৃষ্টি হয়নি। ত্রিবেন্দ্রামে তার একটা ছোটো মনোহারি দোকান ছিল। নিজের মা আর বউ নিয়ে ছিল তার সংসার। সেই মা-ই হয়েছিলেন তার জঘন্যতম অপরাধের শিকার। বিধবা মায়ের হাজার পাঁচেক টাকা ছিল। সেই শেষ সম্বলটুকুর উপর ম্যাথুসের লোভই এই অপরাধের মূল কারণ।
বিচারের সময় প্রকাশ হয়ে পড়ে ওই ঘটনার সময় বাজারে তার হাজার খানেক টাকা দেনা ছিল। তার বউ দিন কয়েকের জন্যে ত্রিচুরে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল আর সেই সুযোগে এক রাত্রে মাকে গলা টিপে হত্যা করে বাড়ির পেছনে ছোটো বাগানের জমিতে মৃতদেহ কবর দিয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই মায়ের সঙ্গে টাকাপয়সার ব্যাপার নিয়ে তার খিটিমিটি লেগেই ছিল। মা প্রায়ই বলতেন বাড়ি ছেড়ে তিনি চলে যাবেন। ঘটনার দিনেও মা আর ছেলের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয় যার ফলে ভদ্রমহিলা ব্যাঙ্ক থেকে সব টাকা তুলে আনেন। পরের দিন ভোরে তিনি তাঁর বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাবেন বলেছিলেন। পাড়াপড়শি এ ঘটনার সাক্ষী ছিল। সেই রাতেই ম্যাথুস কাজ হাসিল করে।
খুব ঠান্ডা মাথায়, ভেবে-চিন্তে, সে তার পরবর্তী কাজগুলো করেছিল। মায়ের জিনিসপত্র একটা তোরঙ্গে পুরে রাত থাকতেই সে বেরিয়ে পড়ে। স্টেশনে গিয়ে মাদ্রাজগামী একটা গাড়িতে তোরঙ্গটা বসবার আসনের তলায় রেখে সে ফিরে এসেছিল। একটু বেলা হতেই পাড়াপড়শির কাছে সে রটিয়ে দিয়েছিল মা তার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে চলে গেছে, কোথায় গেছে তা সে জানে না। মার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কারো অজানা ছিল না তাই মিথ্যে দুঃখিত হবার ভান না করে খোলাখুলিই সে বলেছিল, মা-ই ছিল যত অশান্তির মূলে, এবার বাড়িতে শান্তি ফিরে আসবে।
বউ ফিরে আসার পর তাকেও সে একই কথা বলেছিল। মা যে কোনো ঠিকানা দিয়ে যায়নি তা জানাতেও সে ভোলেনি, কারণ বউ তার ভালোমানুষ, যদি মাকে ফিরে আসার জন্য চিঠি লেখে তাই বাজে ঠিকনা দিয়ে হাঙ্গামায় পড়তে চায়নি। বউ তার কথা সরল বিশ্বাসেই মেনে নিয়েছিল, অবিশ্বাস কিংবা সন্দেহ করার কারণ অবশ্য ছিল না।
ঘটনার পর কিছুদিন সে খুবই সতর্ক ছিল। প্রতিটি অপরাধীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে একটা নির্দিষ্ট সময় বা সীমা পর্যন্ত তারা হুঁশিয়ার থাকে, কিন্তু তারপরেই তারা ঢিলে দেয়, আর তখনই এমন মারাত্মক ভুল করে বসে যা তাদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। ম্যাথুসও প্রথম প্রথম খুব ভেবে-চিন্তে কাজ করতে লাগল। তার দেনা সে তখুনি শোধ করল না বরং মা যে ঘরে থাকত সেই ঘরে সে একজন ভাড়াটে বসাল আর দোকানে যে ছোকরা তার সহকারী ছিল তাকে সে বিদেয় করল। অর্থাৎ দোকানের খরচা কমিয়ে আর বাড়িতে ভাড়াটে বসিয়ে সে তার অবস্থা ফেরাবার চেষ্টা করছে ওই ধারণাটাই সে পাঁচ জনের মনে ঢোকাতে চাইছিল।
এক মাস পরে ওই পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক-শো টাকা দিয়ে সে ব্যাঙ্কে নিজের নামে টাকা জমা দিল। তার কিছুদিন পরই হাজার টাকা দেনা শোধ করল।
এরপরই সে অসাবধান হতে লাগল। অন্য একটা ব্যাঙ্কে দু-হাজার টাকার আরও একটা অ্যাকাউন্ট খুলে বসল। মাকে বাগানের যে জায়গায় কবর দিয়েছিল তার গর্তটা গভীর করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি তাই শুধু ও জায়গাটায় বেশ কিছু মাটি আর সার ফেলে কয়েকটা গোলাপের চারা লাগিয়ে সে নিশ্চিন্ত বোধ করছিল। এটা কিন্তু তার চালে একটা মস্ত ভুল বলতে হবে, কারণ বাগানের নেশা তার কোনোকালেই ছিল না বরং তার মা-ই ওই বাগানের জমিতে কিছু শাকসবজির বাগান করেছিলেন। তার হঠাৎ এই রুচি পরিবর্তনে শুধু পাড়াপড়শিরাই নয়, তার বউ পর্যন্ত অবাক না হয়ে পারেনি।
তোরঙ্গটা সে মাদ্রাজগামী গাড়িতে তুলে দিয়েছিল দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে—এক, ওটার মালিক না থাকায় কেউ হয়তো ওটা বেমালুম সরিয়ে ফেলবে, আর দুই, যদি তা নাও হয় তবে হারানো মালপত্রের গুদোমে ওটা জমা হবে এবং কোনো দাবিদার না জুটলে রেল কর্তৃপক্ষ হয়তো ওটা নিলেম করে দেবে। ওটার সঙ্গে তাকে জড়াবার কোনো কারণই ছিল না। তোরঙ্গে জামা কাপড়ের ভাঁজে তার মা-র কাছে একজনের লেখা চিঠি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। চিঠিতে তার ঠিকানা ছিল।
তোরঙ্গটা আরও অনেক হারানো মালপত্রের সঙ্গে গুদোমে সত্যিই জমা পড়েছিল এবং সাধারণত এসব ক্ষেত্রে যা ঘটে থাকে তাই হয়েছিল অর্থাৎ ‘আছে থাকুক’ এই মনোভাব নিয়ে কর্তৃপক্ষ ওটার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করেননি। গোলমাল বাধল গুদোমে হঠাৎ আগুন লেগে যাওয়ায়। বেশি কিছু ক্ষতি হবার আগেই আগুন অবশ্য নিভিয়ে ফেলা হল কিন্তু কয়েকটা জিনিসের সঙ্গে তোরঙ্গটাও বেশ পুড়ে গেল আর আশ্চর্যভাবে কিন্তু মালপত্রের সঙ্গে রক্ষা পেল চিঠিটা। একেই বলে কপাল! যাহোক যে সব জিনিসের ক্ষতি হয়েছে তাদের মালিককে রেল থেকে ক্ষতিপূরণের কথা জানিয়ে চিঠি লেখা হল। সামান্য ক-টা জিনিসেরই মালিকের হদিশ পাওয়া গেল। তোরঙ্গটা হ’ল তাদের মধ্যে একটা।
যথাসময়ে ম্যাথুসের মার নামে চিঠিটা এল আর পড়ল ম্যাথুসের বউয়ের হাতে। আপাতদৃষ্টিতে ওটা একটা সাধারণ গতানুগতিক চিঠি ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু ওটা ম্যাথুসের মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হল। তোরঙ্গটা কেন যে এগমোর স্টেশনে এতদিন পড়েছিল তার কোনো কৈফিয়তই সে দিতে পারল না। (কলকাতায় যেমন হাওড়া ও শেয়ালদা, মাদ্রাজেও তেমন দুটো স্টেশন, সেন্ট্রাল আর এগমোর)। অগত্যা তাকে বলতে হল তার মার নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং বাধ্য হয়েই মার সন্ধানের জন্য তাকে পুলিশের শরণাপন্ন হতে হল। এ ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের সন্দেহ পড়ল তার ওপর। হঠাৎ কিছু অচেনা মুখকে তার বাড়ির আনাচেকানাচে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখা গেল। ব্যাঙ্কে খোঁজ করতে গিয়ে তার টাকা জমা দেবার ব্যাপারটা গোয়েন্দা বিভাগের দৃষ্টি এড়াল না। তার বাগানের গোলাপ গাছ হঠাৎ বাইরের লোকের প্রশংসার বস্তু হয়ে দাঁড়াল। তারপরই একদিন পুলিশ ওয়ারেন্ট এসে হাজির হল, বাগানের মাটি খুঁড়ে গলিত যে শব বেরুল তার পরিচয়ও গোপন রইল না। বিচারে তার ফাঁসির হুকুম হল।
এই হল সংক্ষেপ ঘটনা। বিচারের সময় সে এমন ভান করেছিল যেন সে কিছুই জানে না, সম্পূর্ণ নির্দোষ। কিন্তু পুলিশ এমন সব অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণ দাখিল করেছিল যে, তার ভনিতা ধোপে টেঁকেনি। এমনকী জেলের পাদ্রীর কাছেও সে তার অপরাধ কবুল করেনি। খ্রিস্টান ধর্মে মৃত্যুপথযাত্রীদের কনফেশানের অর্থাৎ স্বীকারোক্তির যে রীতি আছে সেই সূত্রেই পাদ্রী সাহেব তাকে কনফেশানের জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। কনফেশন ছাড়া মৃত্যু হলে তাকে নরকে পচতে হবে পাদ্রীর এই সতর্কবাণীতেও কোনো কাজ হয়নি।
চৈত্র মাসের এক ভোর রাতে ম্যাথুসের ফাঁসি হয়ে গেল। ডা পিল্লাইকে কর্তব্যের খাতিরে বধ্যভূমিতে হাজির থাকতে হয়েছিল। মৃতদেহ মাটিতে নামানোর পর তিনি পরীক্ষা করে নিঃসন্দেহ হল যে মেরুদণ্ড ও ঘাড় যেখানে মিশেছে সেই হাড় ভেঙে গেছে এবং মৃত্যু ঘটেছে প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই।
শবব্যবচ্ছেদের কোনো প্রয়োজনই ছিল না, কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী পিল্লাইকে তাও করতে হল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বিচিত্র অনুভূতিতে তাঁর সব ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। তাঁর মনে হল কেউ যেন তাঁর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। চমকে পাশ ফিরে কাউকে কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন না। একটা অস্বস্তিতে তাঁর মন ভরে গেল। তাঁর মনে হল যার শবব্যবচ্ছেদ করছেন সে যেন মারা যায়নি, কিন্তু সেটা যে তাঁর মনের ভুল সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো কারণই ছিল না। ফাঁসির ঘণ্টাখানেক পর তিনি মর্গে দেহটা কাটা-ছেঁড়া করছেন সুতরাং এমন মনের ভুল কেন যে তাঁর হল তা ঠিক তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না।
আরও একটা ঘটনা ঘটল। জেলের ওয়ার্ডারদের একজন এসে ডা পিল্লাইকে জিজ্ঞেস করলেন, যে দড়ি দিয়ে ম্যাথুসকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল সেটা ভুল করে মৃতদেহের সঙ্গে মর্গে চলে এসেছে কিনা। ওটা নাকি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, একেবারে উধাও হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। যে দড়ি জল্লাদের হাতে মরণ খেলায় মেতে ওঠে, সেটা কারো যে দরকার হতে পারে তা ভাবাই যায় না। পারতপক্ষে ও দড়ি সবাই সযত্নে পরিহার করে চলে, স্পর্শ করার লোভ নিশ্চয়ই কারো হয় না। যাহোক, ওটা কিন্তু সত্যিই পাওয়া গেল না।
ডা পিল্লাই বিয়ে-থা করেননি। জেলখানার কাছেই তাঁর কোয়ার্টার। বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না সব কিছুর ভার তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর কমবাইন্ড হ্যান্ড যোশেফের উপর। লোকটি শুধু কাজেরই নয়, রান্নার হাতও তার চমৎকার। ডা পিল্লাই যা মাইনে পান তাতে একা মানুষের স্বচ্ছন্দে চলে যায়। জেলের ডাক্তারের চাকরিটা তিনি নিয়েছিলেন একটা বিশেষ কারণে। সেটা হল ডাক্তারি পড়ার সময়েই তাঁর মনের মধ্যে একটা শখ বা খেয়াল দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। সেটা হল অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা। জেলের ডাক্তারের চাকরিতে এ বিষয়ে গবেষণা করার ঢালাও সুযোগের কথা ভেবেই তিনি এ পথে এসেছিলেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যে বিশ্বাস তাঁর মনে শেকড় গেঁথে বসেছিল তা হল অধিকাংশ অপরাধ বা পাপকর্ম বিশ্লেষণ করে দেখলে এটাই প্রমাণিত হবে যে, মস্তিষ্কের একটা অস্বাভাবিকতা অথবা বুভূক্ষা থেকেই এদের জন্ম। যেমন চৌর্যবৃত্তি— তাঁর মতে শুধু অভাব থেকেই এ প্রবৃত্তি মানুষের আসে না, এর সঙ্গে মস্তিষ্কের এক ধরনের জটিল অসুখেরও যোগাযোগ আছে, নতুবা অভাবী সবাই চোর হত। আবার এমন অনেক ধরনের অপরাধ আছে যা দৈহিক প্রয়োজনের তালিকায় পড়ে না, খেয়ালের বশে মানুষ এ ধরনের অপরাধের দাস হয়ে পড়ে, অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতো। এ বিষয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন এবং তার বিষয়বস্তু গুণীজনের কাছে যথেষ্ট সমাদরও লাভ করেছে।
তবে অপরাধের যে দিকটা তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল তা হল মানুষের হিংস্র হয়ে ওঠা এবং হত্যা করার দুর্দম স্পৃহা। বাড়ি ফেরার পথে, সকালে যে খুনি আসামির শেষ সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন তার কথাই মনে মনে চিন্তা করছিলেন। জঘন্য অপরাধ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ম্যাথুসের টাকার প্রয়োজন এমন স্তরে পৌঁছোয়নি, যার জন্য খুন করা ছাড়া তার আর উপায় ছিল না। খুনের অস্বাভাবিকতার জন্যে খুনিকে তিনি অপরাধী না ভেবে উন্মাদের পর্যায়ে ফেলাই সঙ্গত মনে করেছিলেন। যতদূর জানা যায় লোকটি শান্ত এবং অমায়িক প্রকৃতির ছিল, স্বামী হিসেবেও তার সুনাম ছিল আর পরিচয় ছিল একজন মিশুকে প্রতিবেশী হিসাবে। কিন্তু সেই লোকটিই এমন এক নৃশংস অপরাধ করে বসল, যা সে ঠান্ডা মাথাতেই করে থাকুক কিংবা উন্মাদনা বশতই করে থাকুক, তার জন্য সমাজ তাকে কখনো ক্ষমা করবে না। এমন ঘৃণ্য কাজ যে করে তার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
কিন্তু একটা কথা ডা পিল্লাই কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। লোকটা অপরাধ স্বীকার করল না কেন? সে যে অপরাধী এ বিষয়ে সন্দেহ করার কিছুমাত্র কারণ নেই। তবু শেষপর্যন্ত এমনকী বধ্যভূমিতে যাবার মুহূর্তেও, সে কেন অপরাধ স্বীকার করে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল না তা ডা পিল্লাইয়ের কাছে হেঁয়ালি বলেই মনে হল।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি তাঁর পড়বার ঘরে এসে বসলেন। ঘরটিতে আলমারি ঠাসা বই। আজ কেন যেন পড়তে তাঁর মন বসছিল না। ঘুরে-ফিরেই ম্যাথুসের কথা তাঁর মনে পড়ছিল, আর মনে হচ্ছিল মর্গে সেই বিচিত্র অনুভূতির কথা। যেন তাঁর পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছিল! ম্যাথুস মারা যায়নি এ অনুভূতিই বা কেন হয়েছিল তাঁর? তবে কি ম্যাথুসের অতৃপ্ত আত্মার উপস্থিতিই তিনি অনুভব করেছিলেন? ঘরের ভেতর এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া তাঁর সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। উদ্ভট কল্পনা ভেবে চিন্তাটাকে তিনি জোর করে মন থেকে দূর করতে চাইলেন।
এ অনুভূতি কিন্তু তাঁর আগেও হয়েছিল। আকস্মিক ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এমন সব মানুষের শবব্যবচ্ছেদের সময় তিনি বিদেহী কারো উপস্থিতি অনুভব করে অসহায় বোধ করেছিলেন। আত্মার বিনাশ নেই এ মতাবাদে তিনি বিশ্বাসী, জন্মান্তরবাদেও তিনি বিশ্বাস করেন। হয়তো দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গেই আত্মা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নেয় না, হয়তো আরও কিছুকাল সে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। ডা পিল্লাই অবসর সময় দেহ ও আত্মার পরস্পর বিচ্ছেদের সংকীর্ণ সীমারেখা নিয়ে অনেক পড়াশুনো করেছেন। বিদেহী আত্মা যে জীবিত মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে সক্ষম, সেকথা ডা পিল্লাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন।
তাঁর গভীর চিন্তায় বাধা পড়ল। পাশেই ছোটো একটা গোল টেবিলের উপর টেলিফোনটা ছিল। ওটা হঠাৎ বেজে উঠল। কিন্তু সাধারণ যেভাবে ক্রিং ক্রিং করে বাজে তেমন ভাবে নয়, অনেকটা অস্পষ্ট, মৃদুভাবে। যেন টেলিফোনে কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে। তবে ওটা যে বাজছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ডা পিল্লাই হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা কানে তুললেন। মাউথ-পিসে মুখ লাগিয়ে তিনি বললেন, ‘ডা পিল্লাই বলছি, আপনি কে?’
উত্তরে একটা ফিসফিসে শব্দ তাঁর কানে এল, কথা কিছুই বোঝা গেল না।
‘আপনার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না।’ তিনি বললেন।
আবার সেই ফিসফিস ধ্বনি। তারপর সব চুপচাপ।
ডা পিল্লাই মিনিট খানেক রিসিভারটা কানে লাগিয়েই দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন তিনি সংবিৎ হারিয়ে ফেলেছেন। যখন বুঝলেন, ওপাশ থেকে আর কোনো সাড়া-শব্দই আসছে না তখন তিনি এক্সচেঞ্জকে ফোন করলেন। নিজের নাম্বারটা জানিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখুনি কেউ আমাকে ফোন করেছিল; কোন নাম্বার থেকে বলতে পারেন?’
সামান্য স্তব্ধতার পর তিনি তাঁর প্রশ্নের জবাব পেলেন। ওটা করা হয়েছিল জেলখানা থেকে। তিনি ওই নাম্বারে ডায়াল করলেন।
‘আমাকে এইমাত্র ফোন করেছিল? আমি ডা পিল্লাই বলছি। একটা কথাও আমি শুনতে পাইনি।’
পরিষ্কার কণ্ঠে জবাব এল।
‘আপনার বোধ হয় ভুল হয়েছে ডাগদার সাব, আমরা কেউ আপনাকে ফোন করিনি।’
‘কিন্তু এক্সচেঞ্জ যে বলল জেলখানা থেকেই ফোন করা হয়েছে?’
‘এক্সচেঞ্জ নিশ্চয়ই ভুল করেছে।’ জবাব ভেসে এল।
‘আশ্চর্য! কে কথা বলছ, ওয়ার্ডার রামানুজম, তাই না?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, সাব।’
‘আচ্ছা, রেখে দিলাম।’
ডা পিল্লাই আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিলেন।
ঘুরে-ফিরে টেলিফোনের অদ্ভুত ব্যাপারটা তাঁর মনে একটা খটকার সৃষ্টি করতে লাগল। ভুল করে অনেকবারই তাঁর টেলিফোন বেজে উঠেছে, কিন্তু অত মৃদুভাবে কখনো বাজেনি, অমন চাপা দুর্বোধ্য গলায় কেউ তাঁকে কথাও বলেনি। ব্যাপারটা তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। নিজের অজান্তেই তিনি সারা ঘরে পায়চারি শুরু করলেন। একটা ক্ষীণ সন্দেহ, একটা অদ্ভুত চিন্তা, তাঁর মনে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল।
‘কিন্তু তা অসম্ভব।’ আপন মনেই বলে উঠলেন তিনি।
পরদিন সকাল বেলা যথারীতি তিনি জেলখানায় গেলেন। আশ্চর্য, অদৃশ্য কারো উপস্থিতি আবার তাঁর মনে চাড়া দিয়ে উঠল। কেন জানি তাঁর মনে হতে লাগল, গতকাল যার ফাঁসি হয়েছে সে-ই যেন তাঁর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেলখানার অঙ্গনে সেই অনুভূতিটা প্রবল হয়ে উঠল, আরও প্রবল হল যখন তিনি ফাঁসির আসামিকে যে কুঠুরিতে রাখা হয় তার দরজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
অনুভূতিটা ক্রমে এতই প্রবল হয়ে উঠল যে ওই কুঠুরির মধ্যে যার উপস্থিতি তিনি অনুভব করছিলেন তার দেখা পেলেও হয়তো তিনি বিস্মিত হতেন না। দরজাটা পেরিয়ে, সরু বারান্দার মতো পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে সত্যিই তিনি ঘাড় ফেরালেন, যেন ওকে দেখবেন আশা করেছিলেন।
সমস্তক্ষণ একটা দারুণ আতঙ্ক তাঁর বুকে পাষাণ ভাবের মতো চেপে বসেছিল— এই অদৃশ্য উপস্থিতি তাঁকে বিচলিত করে তুলল। হতভাগ্য সেই আত্মা যেন কিছু বলতে চায়, এটা তিনি মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করলেন। সমস্ত ব্যাপারটা যে কাল্পনিক, তাঁর উর্বর মস্তিষ্কের উদ্ভট চিন্তার পরিণাম, এ কথা কিন্তু একবারও তাঁর মনে হল না। হ্যাঁ, ম্যাথুসের আত্মা জেলখানার মধ্যেই আটকা পড়েছে।
হাসপাতালে ঘণ্টা দুয়েক কাজের মধ্যে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন। সর্বক্ষণ কিন্তু একটা অদৃশ্য কিছুর উপস্থিতি তিনি অনুভব করছিলেন; তবে হাসপাতালে সে প্রভাবটা অত নয়, যতটা জেলখানার মধ্যে। জেলখানার কাজ সেরে ফেরার আগে তাঁর ধারণাটা যাচাই করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বধ্যভূমির ছাউনিতে উঁকি মারলেন। পরমুহূর্তে বধ্যভূমিতে প্রবেশের দরজাটা এক হ্যাঁচকা টানে বন্ধ করে তিনি সরে এলেন। তাঁর মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল।
ফাঁসির মঞ্চে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা আর দু-হাত বাঁধা ঝুলন্ত এক মূর্তির স্পষ্ট আকার তাঁর চোখে পড়ল। অস্পষ্ট হলেও চোখের ভুল তাঁর হয়নি।
ডা পিল্লাইকে অনায়াসে একজন সাহসী পুরুষই বলা চলে। তিনি প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই নিজেকে সামলে নিলেন। ক্ষণিকের এই আতঙ্কের জন্য তিনি মনে মনে লজ্জাই বোধ করলেন। যুক্তি দিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করলেন, আকস্মিক স্নায়বিক চাপই তাঁর মনের এই অবস্থার কারণ। আত্মা এবং আধিভৌতিক ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও বধ্যভূমিতে দ্বিতীয়বার উঁকি মারার সাহস কিন্তু তাঁর হল না। মনের জোর যেন তিনি হারিয়ে ফেললেন। হতভাগ্য ম্যাথুসের আত্মা যদি তাঁকে কিছু বলতে চায় কিংবা তাঁর সঙ্গে কোনো ব্যাপারে যোগাযোগ করতে চায়, তবে দূর থেকেই সেটা ঘটুক— তাই তিনি মনেপ্রাণে চাইলেন। তাঁর মনে হল ওটার গতিবিধি যেন অনেকটা সীমিত। জেলখানার অঙ্গন, যে কুঠুরিতে ফাঁসির আসামিকে রাখা হয় এবং বধ্যভূমি ঘিরেই ওটা ঘোরাফেরা করছে। অবশ্য এটা তাঁর অনুমান।
হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়ায় তিনি তাঁর অফিস ঘরে ফিরে এসে গত রাত্রে যে ওয়ার্ডার টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিল তাকে ডেকে পাঠালেন।
‘কাল রাতে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলার আগে কেউ আমাকে ফোন করেনি বলেছিলেন। তোমার ভুল হয়নি তো?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
ডা পিল্লাই লক্ষ্য করলেন লোকটি সামান্য ইতস্তত করল।
‘নাঃ…,’ লোকটি জবাব দিল, ‘আপনি ফোন করার আধঘণ্টা আগে থেকেই আমি টেলিফোনের পাশে বসেছিলাম। কেউ ফোন করলে আমি দেখতে পেতাম।’
‘তুমি তবে কাউকে দেখনি?’ ডা পিল্লাই এবার একটু জোর দিয়েই কথাটা বললেন।
লোকটির হাবভাবে একটা অস্বস্তির চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠল।
‘না ডাগদার সাব, আমি কাউকে দেখিনি।’ সে যেন ইচ্ছে করেই একটু জোর দিয়ে জবাব দিল।
ডা পিল্লাই তার দিক থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিলেন।
‘কিন্তু তোমার হয়তো মনে হয়েছিল ঘরে কেউ আছে?’ অনেকটা নিরাসক্ত ভাবেই তিনি এবার প্রশ্ন করলেন।
ওয়ার্ডার রামানুজম এবার যেন একটু থতমত খেল। তার মনের মধ্যে যে একটা দ্বন্দ্ব চলছে তা বুঝতে অভিজ্ঞ ডা পিল্লাইয়ের দেরি হল না।
‘আপনি হয়তো ভাববেন আমার তন্দ্রা এসেছিল কিংবা আমি এমন কিছু খেয়েছিলাম যা আমার সহ্য হয়নি…’
ডা পিল্লাইয়ের নিরাসক্ত ভাবটা মুহূর্তে কেটে গেল। রামানুজমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘ওসব কিছুই আমি ভাবব না; বরং তুমিই বলতে পার রাত্রের খাওয়া-দাওয়ার পর আমি যখন বসেছিলাম তখন আমার ঝিমুনি এসেছিল; তাই টেলিফোন বাজার শব্দটা হয়তো আমি স্বপ্নের ঘোরেই শুনেছিলাম।’ ওয়ার্ডারকে আশ্বস্ত করার জন্যই তিনি কথাগুলো বললেন। ‘আরও একটা কথা, টেলিফোনটা কিন্তু যেমন বাজা উচিত তেমন বাজেনি। আমি ওটার পাশেই বসেছিলাম, তবু কোনোমতে ক্রিং ক্রিং শব্দটা আমার কানে এসেছিল। রিসিভার কানে লাগিয়ে আমি শুধু কার যেন ফিসফিসানি শুনেছিলাম। কিন্তু তুমি যখন কথা বলেছিলে তা স্পষ্ট এবং জোরেই শুনেছিলাম। আমার বিশ্বাস একটা কিছু— মানে কেউ টেলিফোনের এধারে ছিল। তুমিও সেসময় ঘরে ছিলে, কিন্তু কাউকে না দেখলেও কারো উপস্থিতি তুমি অনুভব করেছিলে, তাই না?’
লোকটি এবার সায় দিয়ে ঘাড় দোলাল।
‘ডাগদার সাব, আমি ভীতু নই।’ সে বলল, ‘তা ছাড়া আজগুবি কল্পনা আমার মাথায় আসে না। কিন্তু তবু বলব, ঘরে অদৃশ্য কিছু একটা ছিল। ওটা যেন টেলিফোনের চারপাশেই ঘোরাফেরা করছিল। এমন নয় যে, বাতাসের শব্দে আমার মনের ভুল হয়েছিল, কারণ কাল রাতে বাতাস ছিল না বললেই চলে। ওটা নিশ্চয়ই টেলিফোন ডাইরেকটরির পাতা উলটোচ্ছিল। বাতাস ছাড়াই যেভাবে একটার পর একটা পাতা খস খস আওয়াজ করে উলটে যাচ্ছিল, তাতেই আমার ও কথা মনে হয়েছিল। যেন কারও টেলিফোন নাম্বার খুঁজছে। আমার খুব কাছে ওটার উপস্থিতি আমি অনুভব করেছিলাম। বিশ্বাস করুন ডাগদার সাব, আমার গায়েই শুধু কাঁটা দেয়নি, মাথার চুলও খাড়া হয়ে গিয়েছিল। আর…আর…ওটা যখন আমার পাশে এসেছিল। তখন কেমন একটা স্যাঁৎসেঁতে ঠান্ডায় আমি কেঁপে উঠেছিলাম।’
ডা পিল্লাই রামানুজমের মুখের দিকে সরাসরি তাকালেন।
‘তোমার কি কারো কথা মনে হয়েছিল?’ আচমকা তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
লোকটি আবার ইতস্তত করল, তারপর জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, সাব, কাল যার ফাঁসি হয়েছিল তার কথা…’
ডা পিল্লাই সমর্থনসূচকভাবে ঘাড় দোলালেন।
‘ব্যাপারটা তাই।’ তিনি অনেকটা যেন আপন মনে বলে উঠলেন। ওয়ার্ডারের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ রাতেও কি অফিস ঘরে তোমার ডিউটি আছে?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ সাব।’ লোকটার সর্বাঙ্গ একটা অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল।
‘তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি।’ ডা পিল্লাই তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘কাল আমারও তোমার মতোই অবস্থা হয়েছিল। ওটা যাই হোক না কেন, মনে হচ্ছে যেন আমাকে কিছু বলতে চায়। ভালো কথা, কাল রাতে জেলখানায় কোনো গোলমাল হয়নি তো?’
‘হ্যাঁ, হয়েছিল। কম করেও দশ বরোজন কয়েদি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে চেঁচামেচি করে উঠেছিল। তবে কারো ফাঁসি হবার পর প্রথম দু-একটা রাত এমন হয়। আমি আগেও হতে দেখেছি, তবে কাল রাতে একটু বাড়াবাড়িই হয়েছিল।’
‘হুঁ! আচ্ছা, ওটা— মানে অদৃশ্য ওই বস্তুটা যদি আজও টেলিফোনের কাছে আসতে চায়, তবে ওটাকে সে সুযোগ দিও। আমার যতদূর মনে হচ্ছে, ওটা কাল যে সময় এসেছিল আজও সে সময়ে আসবে। তুমি বরং এক কাজ করো—ও সময়টা, ধর রাত সাড়ে ন-টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত, ঘরের বাইরেই থেকো। আমি আমার বাড়িতে টেলিফোনের পাশেই থাকব। যদি ওই সময়ের মধ্যে এখান থেকে আমি কোনো ফোন পাই তবে তা সেরে আমি তোমাকে ফোন করে জেনে নেব সত্যিই কেউ আমাকে ফোন করেছিল কি না? বুঝতে পেরেছ?’
‘আজ্ঞে কোনো বিপদ ঘটবে না তো?’
‘আমার বিশ্বাস সে ভয় করার কোনো কারণ নেই।’ ডা পিল্লাই তাকে অভয় দিয়ে বললেন। পরক্ষণেই বধ্যভূমিতে তাঁর আতঙ্কের হেতু মনে পড়তেই তিনি কেঁপে উঠলেন। ওয়ার্ডার অন্য দিকে তাকিয়েছিল তাই এসব কিছু লক্ষ্য করল না।
রাত সাড়ে ন-টার সময় তিনি পড়বার ঘরে একা বসেছিলেন— বসেছিলেন বললে ভুল হবে, যেন কিছু একটা ঘটবে তারই প্রতীক্ষা করছিলেন। খানিক আগেই তিনি রাতের খাওয়া সেরেছেন। পারলৌকিক ব্যাপার সম্বন্ধে অনেক পড়াশোনা করে তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, মুক্তি পায়নি এমন আত্মা একটা নির্দিষ্ট সময়েই নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়— তার হেরফের বড়ো একটা হয় না, বিশেষ করে সেই আত্মা যদি মানুষের সাহায্যপ্রার্থী হয়, যেমন হয়েছে এ ব্যাপারে। ম্যাথুসের আত্মা যে একটা যন্ত্রণায় ভুগছে এবং সেই বিষয়ে তাঁকে কিছু বলতে চায় তা তিনি অনুভব করছিলেন। মৃত্যুর পর কিছুদিন, পৃথিবীতে বিচরণশীল এ-সব অতৃপ্ত কিংবা মুক্তি না পাওয়া আত্মার নিজের রূপ প্রকাশের অর্থাৎ দেখা দেবার এবং মানুষকে তার ইচ্ছে জানাবার ক্ষমতা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। তারপর যতই ওটা পৃথিবী ছেড়ে ওপরে উঠতে থাকে, ওই ক্ষমতাও ততই কমে আসে। তবে দেহ থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম দু-একদিন ওটা দুর্বল থাকে। কারণ নতুন অবস্থা ও নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতে ওটার দিন কয়েক সময় লাগে। তাই ডক্টর পিল্লাইয়ের ধারণা হয়েছিল আজ হয়তো টেলিফোনে স্পষ্ট কিছু শুনতে পাবেন না, যদিও গতকালের মতো অত অস্পষ্ট হবে না। ঠিক তখুনি টেলিফোনটা বেজে উঠল। গত রাতের মতো ক্ষীণ নয় কিন্তু তবু সাধারণ যেভাবে বাজে অত জোরেও নয়।
ডা পিল্লাই প্রায় লাফিয়ে উঠে রিসিভারটা কানে তুলে ধরলেন আর তখুনি একটা চাপা কান্নার ফোঁপানি তাঁর কানে ভেসে এল। কান্নার অদম্য দমকে যে কাঁদছে তার বুক যেন ফেটে যাচ্ছে!
ডা পিল্লাই যেন বোবা হয়ে গেছেন! একটা হিমশীতল পরশ তিনি বুকের ভেতর অনুভব করছেন, কিন্তু তবু সেই কান্নার মধ্যে যে একটা করুণ আবেদন ছিল তা তাকে বিচলিত করে তুলল। যে কাঁদছে, সে যেই হোক না কেন, তাকে সাহায্য করার জন্য তাঁর সেবার্ত মন উন্মুখ হয়ে উঠল।
‘কে, কে তুমি?’ নিজের গলার স্বরই তাঁর কাছে বিকৃত শোনাল। ‘আমি ডা পিল্লাই কথা বলছি। বল, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি?’
আস্তে আস্তে কান্নার শব্দটা মিলিয়ে গেল, যেন যে কাঁদছিল সে অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিল। তারপরই ফিসফিস করে বলা কথাগুলো ডা পিল্লাইয়ের কানে ভেসে এল।
‘ডাক্তার সাহেব, আমি বলতে চাই…আমি বলতে চাই…আমাকে বলতেই হবে…’
‘কী বলতে চাও, বল আমাকে।’ ডা পিল্লাই একটু একটু করে সাহস ফিরে পাচ্ছেন।
‘না, না আপনাকে নয়…যিনি আমার কাছে আসতেন তাঁকে বলতে চাই। আপনাকে যা বলছি তা যদি তাঁকে একবারটি বলেন। আমি কিছুতেই আমার কথা তাঁকে শোনাতে পাচ্ছি না।’
‘কে তুমি?’ ডা পিল্লাই হঠাৎ প্রশ্ন করলেন।
সঙ্গেসঙ্গে জবাব এল না। তারপরেই ফিসফিস করে যে কথা বলছিল, সে বলল, ‘আপনি তো জানেন, আমি কে। আমার ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। জেলখানা ছেড়ে আমি বেরোতে পারছি না…বড়ো কষ্ট হচ্ছে।… আপনি ওই ভদ্রলোককে আপনার বাড়িতে ডেকে পাঠাবেন? আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
‘তুমি কী পাদ্রী সাহেবের কথা বলছ?’ ডাক্তার শুধোলেন।
‘হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন। কাল যখন আমাকে জেলখানার উঠোন দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তিনি আমার সদগতির জন্য প্রার্থনা করছিলেন। তাঁর কাছে বলতে পারলে আমার আর এত কষ্ট হবে না। —বলবেন তাঁকে আপনি?’
ডা পিল্লাই মুহূর্তকালের জন্য ইতস্তত করলেন। কারাগারের পাদ্রী, ফাদার ডি’সুজার কাছে কি তিনি বলবেন? গতকাল যে খুনি আসামির ফাঁসি হয়েছে সে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায়, এই! ফাদার ডি’সুজা কি ভাববেন না ডাক্তারেরই মাথার চিকিচ্ছের দরকার। কিন্তু টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ম্যাথুসের আত্মাই যে তাঁর সঙ্গে কথা বলছে সে বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহই নেই। ওর যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সেটা তিনি মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করলেন। ও যে ফাদার ডি’সুজার কাছে কী বলতে চায় ডা পিল্লাইয়ের মতো বুদ্ধিমান লোকের তা বুঝতে দেরি হল না।
‘বেশ আমি তাঁকে আসতে বলব।’ শেষপর্যন্ত কথাটা যেন তাঁর মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল।
‘ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ! আপনি তাঁকে নিশ্চয়ই আনবেন।’
কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছিল।
‘আগামীকাল রাত্রেই আনা চাই।’ কণ্ঠস্বর বলল।
‘আমি আর বেশিক্ষণ কথা বলতে পারছি না। আমাকে আবার সেটা দেখতে যেতে হবে–হায় ভগবান!’
নতুন করে ফোঁপানির শব্দ আবার ভেসে এল, কিন্তু ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসছে।
একটা প্রচণ্ড ভয় অথচ ঔৎসুক্য ডা পিল্লাইকে যেন ঘিরে ধরল।
‘কী দেখতে যেতে হবে?’ তিনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। তোমার কি ঘটেছে একটু বল আমায়।’
‘না…না, তা আমি বলতে পারব না…’ কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল।
ডা পিল্লাই রিসিভারটা কানে লাগিয়ে তবু দাঁড়িয়েই রইলেন, কিন্তু আর কোনো কথা ভেসে এল না। তিনি রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন আর তখুনি অনুভব করলেন তাঁর সমস্ত শরীর ঘামে যেন ভিজে গিয়েছে, কপালে যে ঘাম জমেছে তা কেমন যেন শীতের সকালের শিশির বিন্দুর মতো ঠান্ডা! তাঁর বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফাচ্ছে! নিজেকে সামলাবার জন্য তিনি তাড়াতাড়ি চেয়ারে বসে পড়লেন। একবার মনে হল কেউ বোধ হয় তাঁর সঙ্গে সাংঘাতিক রসিকতা করেছে, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন, তা নয়। কৃতকর্মের জন্য একটা অনুতপ্ত আত্মা যে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে বিষয়ে তাঁর মনে কোনো সন্দেহই ছিল না। বিংশ শতাব্দীতে, এই শহরের বুকে, তাঁর কোয়ার্টারের আরামদায়ক কক্ষে এইমাত্র তিনি ম্যাথুসের আত্মার সঙ্গে কথা বললেন। আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
কিন্তু এ নিয়ে বেশি ভাববার সময় ছিল না। তিনি রিসিভারটা আবার তুলে ধরে জেলখানায় ফোন করলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন।
‘ওয়ার্ডার রামানুজম?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর এল, ‘হ্যাঁ, ডাগদার সাব।’
‘কিছু দেখেছ তুমি?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ সাব। ও এসেছিল। আমি ওকে টেলিফোনের ঘরে যেতে দেখেছি… মানে… একটা ছায়ামতো কী যেন ঘরে ঢুকেছিল!’
‘তুমি কি ওর সঙ্গে কথা বলেছ?’
‘আজ্ঞে না, আমি ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম সাব, শুধু ভগবানকে ডেকেছি। কয়েদিদের মধ্যে একটা চেঁচামেচি উঠেছিল, এখন আবার সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমার মনে হয় ও ফাঁসির ছাউনির দিকে গেছে।’
‘তোমার অনুমান মিথ্যে নয়, আজ আর কিছু ঘটবে বলে আমার মনে হয় না।’
সেই রাতেই ফাদার ডি’সুজাকে পরের দিন নৈশ ভোজনের নিমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি একটা চিঠি লিখলেন। ফাদার যেন অবশ্যই আসেন, খুব জরুরি একটা ব্যাপারে তিনি তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে চান। এ কথা লিখতেও ভুললেন না।
পরের দিন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ফাদার ডি’সুজা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলেন। খাবার ঘরটা ডাক্তারের পড়ার ঘরের ঠিক পাশেই। ডাক্তার পিল্লাইয়ের নির্দেশে যোশেফ ভালো ভালো রান্না করেছিল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে পর যোশেফ টেবিল পরিষ্কার করে দু-পেয়ালা কফি দিয়ে গেল। একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে ডা পিল্লাই বললেন, ‘আপনাকে যে কথা বলার জন্য আজ কষ্ট দিয়েছি, তা শোনার পর দয়া করে আমাকে পাগল ভাববেন না, এই আমার অনুরোধ।’
ফাদার ডি’সুজা হাসলেন।
‘হ্যাঁ, সে অঙ্গীকার আমি অনায়াসে করতে পারি।’
‘ভালো। গতকাল এবং পরশু রাতে দু-দিন আগে যার ফাঁসি হয়েছিল তার সঙ্গে আমি টেলিফোনে কথা বলেছি।’
ডি’সুজা হাসলেন না। তিনি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখে বিরক্তির চিহ্ন সুস্পষ্ট।
‘ডা পিল্লাই!’ তিনি বেশ অভিযোগের কণ্ঠেই বললেন, ‘আমি আপনার আতিথেয়তার অমর্যাদা করতে চাইনে, কিন্তু সত্যিই কি এই উদ্ভট কথা শোনাবার জন্যে আপনি আমাকে ডেকে এনেছেন?’
‘রাগ করবেন না, ফাদার ডি’সুজা।’ ডা পিল্লাই অনেকটা অনুনয়ের কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি আমাকে শেষ করতে দিন। কাল রাতে ও আমাকে অনুরোধ করেছিল আপনাকে এখানে আনার জন্য। ও আপনাকে কিছু বলতে চায়।’
‘আমি আপনার কথা শুনতে চাই না।’ ফাদার ডি’সুজার কণ্ঠস্বর থেকে যেন ভর্ৎসনা ঝরে পড়ল। ‘মৃতেরা কখনোই ফিরে আসে না। মৃত্যুর পর কী অবস্থায় তারা থাকে তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু পার্থিব সমস্ত সম্পর্ক যে তাদের চুকে যায় সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।’
‘কিন্তু আমার কথা এখনও শেষ হয়নি, ফাদার।’
ডাক্তার বললেন। ‘দু-রাত আগে আমার টেলিফোনটা খুব আস্তে আস্তে বেজে উঠেছিল, ফিসফিস করে কেউ যেন আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। আমি এক্সচেঞ্জকে তারপরেই ফোন করে জানতে পারি ”কলটা” এসেছিল জেলখানা থেকে। আমি ওখানে ফোন করি। ওয়ার্ডার রামানুজম আমাকে জানায় জেলখানা থেকে কেউ আমাকে ফোন করেনি। তবে কেউ যে টেলিফোনের ঘরে এসেছিল এ অনুভূতি ওর হয়েছিল।’
‘লোকটা বোধ হয় খুব নেশা করে।’ ফাদার ডি’সুজা তীব্র কণ্ঠে বললেন।
‘আপনি ওর উপর অবিচার করছেন ফাদার ডি’সুজা।’ ডা পিল্লাই আহত কণ্ঠে বললেন। ‘ওয়ার্ডারদের মধ্যে ও লোকটাই সবচেয়ে বিশ্বাসী, কোনোরকম নেশা করে না। আর তাই যদি হয়, তবে আমিও ওই অপবাদ থেকে বাদ পড়ি না, তাই না?’
ফাদার ডি’সুজা আবার বসলেন।
‘আমাকে ক্ষমা করবেন,’ তিনি এবার গলা নরম করে বললেন, ‘কিন্তু এ নিয়ে আমি কোনো আলোচনা করতে প্রস্তুত নই। তা ছাড়া সমস্ত ব্যাপারটাই যে একটা রসিকতা নয় তা কী করে বুঝলেন?’
‘রসিকতাটা করবে কে?’ ডাক্তার প্রতিবাদ করে উঠলেন, তারপরই বললেন, ‘ওই শুনুন।’
পাশের ঘরে টেলিফোনটা বেজে উঠল, ডা পিল্লাই স্পষ্ট শুনতে পেলেন।
‘শুনতে পাচ্ছেন?’ তিনি ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
‘কী শুনতে পাচ্ছি?’
‘টেলিফোনটা বাজছে!’
‘না।’ ফাদার ডি’সুজা একটু রাগত কণ্ঠেই জবাব দিলেন, ‘টেলিফোন বাজার কোনো শব্দই আমি শুনতে পাচ্ছি না।’
ডা পিল্লাই কথা না বাড়িয়ে পাশের ঘরে গিয়ে রিসিভারটা কানে তুলে ধরলেন। মাউথ-পিসে মুখ লাগিয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যালো!’ তাঁর অজান্তেই গতকালের মতো গলাটা তাঁর আজও কেঁপে গেল। ‘কে কথা বলছ? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফাদার ডি’সুজা এসেছেন। আচ্ছা, আমি তাঁকে কথা বলতে অনুরোধ করছি।’
তিনি খাবার ঘরে ফিরে গেলেন।
‘ফাদার ডি’সুজা!’ তিনি আবেদন-করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘একজনের আত্মা যন্ত্রণা পাচ্ছে, আপনি দয়া করে ও কী বলতে চায় একবার শুনুন, আমি ভগবানের নামে আপনার কাছে অনুরোধ করছি।’
ফাদার ডি’সুজা মুহূর্তকাল ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন, ‘আপনার যা অভিরুচি।’
ডা পিল্লাই তাঁকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে হুক থেকে নামিয়ে রাখা রিসিভারটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ফাদার ডি’সুজা রিসিভার কানে লাগিয়ে বললেন, ‘আমি ফাদার ডি’সুজা কথা বলছি।’
তিনি অপেক্ষা করলেন।
‘আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।… হ্যাঁ, এবার যেন কিছু শোনা যাচ্ছে, কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে।’
‘একটু চেষ্টা করুন, শুনতে পাবেন?’ ডা পিল্লাই উৎসাহ দিয়ে বললেন।
ফাদার ডি’সুজা আবার শোনবার চেষ্টা করলেন।
হঠাৎ রিসিভারটা কান থেকে নামিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘কে যেন বলল, ”আমি খুন করেছি, আমি স্বীকার করছি, ক্ষমা ভিক্তা করছি আমি।”—এ নিশ্চয়ই রসিকতা ডা পিল্লাই! আপনি যে আধ্যাত্মিক ব্যাপারে একটু বেশি মাত্রায় উৎসুক তা জেনেই হয়তো কেউ আপনার সঙ্গে রসিকতা করছে। আমি এ বিশ্বাস করিনে।’
ডা পিল্লাই রিসিভারটা নিজের হাতে নিলেন।
‘হ্যালো আমি ডা পিল্লাই বলছি।’ তিনি এক নিশ্বাসে বলে গেলেন, ‘ফাদার ডি’সুজাকে এমন কোনো প্রমাণ দিতে পার যে তুমিই কথা বলছ?
ওপাশ থেকে উত্তরটা শুনে তিনি রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ও বলছে আপনাকে প্রমাণ দেবে। তবে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
আজকের রাতটাও বেশ গুমোট, একটা ভ্যাপসা গরম। ঘরের জানলাগুলো খোলাই ছিল কিন্তু একটুও বাতাস আসছিল না। ডা পিল্লাই আর ফাদার ডি’সুজা প্রায় পাঁচ মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছেন, কিন্তু কিছুই ঘটল না। ফাদার ডি’সুজা অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, ‘আমার মনে হয় আর অপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’
তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই একটা হিমেল হাওয়া পাশের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে এক মুহূর্তে ভেতরকার আবহাওয়া সম্পূর্ণ বদলে দিল। ভ্যাপসা গরম আর অনুভূত হচ্ছে না বরং যেন শীত শীত করছে। ডা পিল্লাই কেঁপে উঠলেন, খুব ঠান্ডা পড়লে যেমন মানুষ কাঁপে।
‘কেমন ঠান্ডা হাওয়া, আপনি টের পাননি?’ ফাদার ডি’সুজাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ কেমন যেন শীতের মতো হাওয়া।’ ফাদার ডি’সুজা সম্মতি জানিয়ে বললেন।
ঘরের মধ্যে হাওয়াটা আবার যেন জেগে উঠল, একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি হল, আর টেবিলের ওপর রাখা কয়েকটা কাগজ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল।
‘কিছু বুঝতে পারছেন?’ ডা পিল্লাই আবার বললেন। একটা আতঙ্ক তাঁকে গ্রাস করতে চাইছে।
ফাদার ডি’সুজা নীরবে ঘাড় দোলালেন, তাঁর বুকের ভেতর যেন হাপর পড়তে শুরু করেছে।
‘করুণাময় ঈশ্বর, শয়তানের হাত থেকে আমাদের রক্ষা কর।’ বিড় বিড় করে বললেন তিনি।
‘ঘরে কে যেন এসেছে!’ ডা পিল্লাই আতঙ্কে বলে উঠলেন।
তাঁর মুখের কথা শেষ হবার আগেই, তাঁরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখান থেকে মাত্র পাঁচ হাত দূরে একটা অস্পষ্ট মানুষের মূর্তি আকার নিতে লাগল। শূন্যে সেটা ঝুলছে, কাঁধের একদিকে মাথা হেলে থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। তারপরই ওটা দু-হাত দিয়ে নিজের মুখটা তুলে ধরল, সোজাসুজি তাকাল ঘরে যে দু-জন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের দিকে। ওটার দু-চোখ আর জিভ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, গলার চারপাশে একটা গোল লাল দাগ। তারপরই মেঝের ওপর ধপ করে ভারী কিছু পড়ার শব্দ হল আর সঙ্গেসঙ্গে সব কিছু মিলিয়ে গেল, শুধু মেঝের ওপর পড়ে রইল একগাছা নতুন দড়ি।
বেশ কিছুক্ষণ দু-জনের মুখে কোনো কথা ফুটল না। ডা পিল্লাইয়ের কপাল বেয়ে দর দর করে ঘামের স্রোত নামছিল আর ফাদার ডি’সুজার অস্ফুট কণ্ঠে প্রার্থনা করছিলেন। অসীম প্রচেষ্টায় ডা পিল্লাই মনের সাহস ফিরিয়ে আনলেন। দড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘ফাঁসির পর থেকে ওটা পাওয়া যাচ্ছিল না।’
টেলিফোনটা আবার মৃদু বেজে উঠল। এবার আর ফাদার ডি’সুজাকে কিছু বলতে হল না, তিনি তাড়াতাড়ি রিসিভারটা কানে তুলে কিছুক্ষণ কী যেন শুনলেন।
‘ম্যাথুস’। অনেকটা সংযত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘ভগবানের কাছে তোমার অপরাধের জন্য সত্যিই কি তুমি অনুতপ্ত?’
ডা পিল্লাই শুনতে না পেলেও বুঝতে পারলেন ওপাশ থেকে কিছু একটা জবাব এল।
ফাদার ডি’সুজা রিসিভারটা কানে লাগিয়েই দু-হাঁটু মুড়ে, দু-চোখ মুদে প্রার্থনার ভঙ্গিতে স্তব করতে লাগলেন, তারপর বলে উঠলেন, ‘ঈশ্বর তোমার আত্মার মঙ্গল করুন।’
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ‘আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না।’ বলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
ডা পিল্লাই ঘণ্টা বাজিয়ে যোশেফকে ডাকলেন। সে ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন, ‘ওই দড়িটা নিয়ে যাও…ওটা পুড়িয়ে ফেল যোশেফ।’
মুহূর্তের নিস্তব্ধতা!
‘এ ঘরে তো কোনো দড়ি নেই সাহেব।’ যোশেফ জবাব দিল।