কালো কুকুর
রোজকার মতো আমাদের সান্ধ্য মজলিশ বসেছিল। বাইরে শ্রাবণের বাদল ধারা, আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘরের ভেতর আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে তর্ক আর গল্প করছি। লোডশেডিংয়ের কল্যাণে অন্ধকার এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। গরম গমর আলুর চপ, ফুলুরি আর বেগুনির সদব্যবহারে আমাদের আড্ডা খুব জমে উঠেছে। বাদলার দিনে তেলেভাজার স্বাদই যেন আলাদা।
জানলা দিয়ে অঝোরধারার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে, ঘরের ভেতর মোমবাতির আলোয় আমাদের ছায়া ছায়া মূর্তির ওপর দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিল সুধেন্দু। তারপর সামনের রেকাবি থেকে একটা বড়ো আলুর চপ তুলে, এক কামড় বসিয়ে যেন আপন মনেই বলল, ‘বাইরে বাদল, ঘরের ভেতর প্রায় অন্ধকার, জায়গাটাও নির্জন, সব মিলিয়ে ভূতের গপ্পের চমৎকার পরিবেশ।’
এক মুহূর্ত কেউ কথা বলল না। এমন একটা বাস্তব সত্য যে এতক্ষণ কারো মনে জাগেনি— এই উপলব্ধিটাই যেন সবাইকে মূক করে দিল। তারপর হইহই করে উঠল সবাই। গপ্প নয়, নিজের জীবনে ঘটেছে এমন একটা ভূতুড়ে কাহিনি বলতে হবে কাউকে।
আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছি, কিন্তু কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ একটা মৃদু কাশির শব্দে আমাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মণীশের ওপর। মণীশ অল্প কিছুদিন হল, আমাদের মজলিশে যোগ দিয়েছে। আগে ও ছিল লখনৌয়ে। সেখানেই ওদের বাড়ি। মা-বাবা, ভাইবোন সব ওখানেই আছে। চাকরিতে বদলি হয়ে, ও বছরখানেক হল এখানে এসেছে।
মণীশের বয়স তিরিশের বেশি হবে না। একটু লাজুক প্রকৃতির।
আমাদের সবার দৃষ্টির সামনে ও যেন কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, ‘মানে, আমি একটা কাহিনি বলতে পারি, আমার জীবনেই ঘটেছিল… আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না—’
‘আগে শুনি, তারপর সে-বিচার করা যাবে।’ সুধেন্দু রায় দিল, ‘নিন, আরম্ভ করুন।’ একটা বেগুনি তুলে নিয়ে ও বড়ো একটা কামড় বসাল।
‘মোগলদের আমলে,’ মণীশ ওর কাহিনি শুরু করল, ‘লখনৌ আর তার আশেপাশে নবাবদের ছড়াছড়ি ছিল। বড়ো বড়ো বাড়ি, জাঁকজমক, আর মাইফেলে জমজমাট ছিল লখনৌ আর তার চারপাশ।
লখনৌ শহর থেকে কয়েক মাইল উত্তরে ছিল নবাব আসফ খাঁ-র মস্ত বাড়ি; এখনও সেটা ধ্বসে পড়েনি, তবে দিনের বেলাতেও লোকজন ও বাড়ির ভেতরে ঢোকে না। ঐতিহাসিক পোড়োবাড়ি হিসাবে পর্যটকদের কৌতূহল মেটানো ছাড়া আর কদাচিৎ পা পড়ে ওই প্রাসাদের চত্বরে।
আসফ খাঁ তাঁর প্রাসাদের কোথাও প্রচুর সোনা আর মোহর লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই গুপ্তধন নিয়ে যে কাহিনি প্রচলিত আছে, তা হল ওই অঞ্চলের সীমানায় এক কুঁড়েঘরে বাস করত বুড়ি শাকিনা। ডাকিনীবিদ্যায় সে ছিল পটীয়সী। ধনী, দরিদ্র সবাই সমীহ করে চলত তাকে। আসফ খাঁ তাকে অনুরোধ করে, বাইরের কেউ যেন তাঁর ধনরত্ন প্রাসাদ থেকে অপহরণ বা লুণ্ঠন করতে না পারে, তার জন্য ডাকিনীবিদ্যা প্রয়োগ করতে।
শাকিনা কালো কুচকুচে মস্ত একটা কুকুর আসফ খাঁকে দিয়ে বলেছিল, যতদিন না আসফ খাঁ-র মৃতদেহ কবরে শান্তিতে সমাধিস্থ হবে, ততদিন ওই কুকুরটা তাঁর গুপ্তধন পাহারা দেবে, যক্ষের মতো আগলে রাখবে।
তারপরই সে নাকি হি হি করে ভীষণ হেসেছিল। আসফ খাঁ-র মতো বীর যোদ্ধাও নাকি ভয় পেয়েছিলেন তার সেই হাসিতে। কুকুরটা কিন্তু তাঁর পিছু ছাড়েনি!
দিল্লিতে তখন সম্রাট শাজাহান বৃদ্ধ, অসুস্থ। সিংহাসনের দাবি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আসফ খাঁ সম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার পক্ষ নিয়েছিলেন। কিন্তু আওরংজেবের কাছে পরাস্থ হলেন দারা, তাঁকে হত্যা করা হল। সেইসঙ্গে যত আমির ওমরাহ দারার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন, কোতল করা হল তাদের। আসফ খাঁ সবংশে নিহত হলেন। শেয়ালে আর শুকুনে খেল তাদের মৃতদেহ। সমাধিস্থ করার জন্য কেউ এগিয়ে এল না, আওরাংজেবের কোপ-নজরে পড়ার ভয়েই এগিয়ে এল না কেউ।
বুড়ি শাকিনা বোধ হয় তার জাদুবিদ্যায় আসফ খাঁ-র পরিণাম বুঝতে পেরেছিল, তাই পরিহাস করে বলেছিল, যতদিন না আসফ খাঁ-র মৃতদেহ কবরে শান্তিতে সমাধিস্থ হবে, ততদিন ওই কুকুরটা তাঁর গুপ্তধন যক্ষের মতো পাহারা দেবে।
বুড়ির কথা মিথ্যে হয়নি। আসফ খাঁ সবংশে নিহত হবার পর ভীষণদর্শন কুকুরটা ওই প্রাসাদের রক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কাউকে নাকি ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিত না। পুথিপত্রে জানা যায়, দীর্ঘকাল পর্যন্ত ওই হিংস্র কুকুরটা গোটা অঞ্চলের আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গভীর রাত্রে ওর ডাক শোনা যেত। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে ছড়িয়ে পড়ত ওর একটানা অশুভ গর্জন, অতিবড়ো সাহসীরও বুকের রক্ত হিম হয়ে যেত ওই শব্দে। বুড়ি শাকিনা ডাকিনীবিদ্যা প্রয়োগ করেছিল ওটার ওপর, তাই ওটা একটা অপার্থিব, ভয়ের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। ক্রমে দিনের বেলাতেই আসফ খাঁ-র প্রাসাদ এড়িয়ে চলতে লাগল আশপাশের মানুষ।
শোনা যায়, আসফ খাঁ-র প্রাসাদের কাছেই বাস করত এক কসাই। এক রাত্তিরে কুকুরের ডাকে সে দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ভোরে উঠেই কুকুরটাকে খতম করতে বেরিয়ে পড়বে বলে সে নাকি শপথ করেছিল। সকলের বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে মাংস কাটার দা নিয়ে সে সত্যিই বেরিয়ে পড়েছিল ভোরবেলা।
লোকটা আর ফিরে আসেনি। তার খোঁজে ওখানে যাবে, এমন বুকের পাটা কারো ছিল না। তিনদিন পরে অবশ্য তাকে অনেক দূরে একটা জলার ধারে অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। বিড়বিড় করে সে বকছিল, অসংলগ্ন কথা— কাউকে চিনতে পারছিল না। তার ঘাড়ে একটা বিচ্ছিরি ঘা সবার নজরে পড়েছিল, শ্বাসনালী পর্যন্ত বিস্তৃত সেই ক্ষত। লোকটি কয়েক বছর বেঁচেছিল, কিন্তু ওই ঘা আর শুকোয়নি, বরং যেন আরও দগদগে হয়ে উঠেছিল।
এমনকী আওরংজেবের সেনাবাহিনী পর্যন্ত ওই প্রাসাদ পরিহার করে চলত। বুড়ি শাকিনার জাদুবিদ্যার প্রভাবে পড়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবে এমন দুর্মতি কারো ছিল না, যদিও শাকিনাকে ওই অঞ্চলে আর দেখা যেত না তখন।
তারপরই ওই অঞ্চলে এলেন এক পিরবাবা। খুব সিদ্ধপুরুষ। প্রেত, পিশাচ কিংবা ডাকিনী তাঁর কাছে যেন জব্দ। একদিন ভোরবেলা তিনি ওই প্রাসাদে হাঁটা দিলেন। জাদুসিদ্ধ ওই কুকুরের হাত থেকে তিনি রক্ষা করবেন নিরীহ মানুষকে, ধর্মের জয় সূচিত করবেন অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে। এক হাতে কোরান আর অন্য হাতে একটা খনিত্র, এই শুধু তাঁর অস্ত্র। ওই অঞ্চলের সমস্ত মানুষ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ঘটনার পরিণতির। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন প্রত্যেক ধর্মের মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ থেকে উচ্চারণ করতে লাগল স্তোত্র, যাতে অশুভ কিছু স্পর্শ করতে না পারে পিরবাবাকে।
অনেক ঘণ্টা পরে, সূর্য যখন পশ্চিমে হেলেছে, পিরবাবাকে ফিরে আসতে দেখা গেল। ক্লান্ত তাঁর পদক্ষেপ। সবাই ছুটে গেল তাঁর দিকে। কাছে যেতেই নজরে পড়ল, পিরবাবার মুখটা ভীষণ ফ্যাকাশে, আর যেন ঝুলে পড়েছে, কিন্তু দু-চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। সবার প্রশ্নের উত্তরে তিনি শুধু একটা কথাই বললেন, ‘আল্লার ইচ্ছেই পূর্ণ হয়েছে।’
কালো কুকুরের উপদ্রব আর কিন্তু শোনা যায়নি। অনেক বছর পরে জানা গিয়েছিল, ওটাকে পর্যুদস্তু করে একটা কুঠুরির দেয়ালের ভেতর পুরে দেয়ালটা আবার তিনি গেঁথে ফেলেছিলেন। ওই অবস্থাতেই ওটা ছিল এতকাল।
মণীশ এতক্ষণে থামল। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে ও বলল, ‘আপনাদের শুনতে ইচ্ছে করছে তো? সবটা বলব?’
‘প্লিজ, কন্টিনিউ।’ সুধেন্দু সবার হয়ে বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের সবার মধ্যেই জেগে উঠেছে একটা দারুণ কৌতূহল আর উৎকণ্ঠা। এরপর কী হবে, এরপর কী হবে, এমন একটা ভাব।
‘বিজ্ঞানের জয়যাত্রা সত্ত্বেও ওখানকার মানুষ কিন্তু এখনও ওই কাহিনি বিশ্বাস করে।’ মণীশ আবার শুরু করল, ‘আমার বয়স তখন পঁচিশ— এখানে ওখানে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার কলেজের বন্ধু হল শওকত। বড়োলোকের ছেলে। ওরা নাকি আসফ খাঁ-র মেয়ে পক্ষের বংশধর, কোনোমতে পালিয়ে আওরাংজেবের রোষের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। লখনৌয়ে ওদের শুকনো ফলের ব্যবসা— সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে। কেন জানি না, আমাকে ওর খুব ভালো লেগেছিল— আমারও তাই। ওর মুখেই এ কাহিনি আমার শোনা।
আসফ খাঁ-র প্রাসাদ এখন জরাজীর্ণ। আইনত ওটা এখন শওকতদের সম্পত্তি, তবে পোড়োবাড়ির মতোই ওটা পড়ে আছে।
আমি আর শওকত একদিন পরামর্শ করলাম, কালো কুকুরটা নিয়ে যে কাহিনি এতকাল লোকমুখে চলে আসছে, সেটা সত্যি না মিথ্যে, তা যাচাই করে দেখতে হবে। যে কুঠুরির দেয়ালে কুকুরটাকে গাঁথা হয়েছে বলে লোকের বিশ্বাস, সেটা ভেঙে ভেতরটা পরীক্ষা করলেই আমাদের সব সন্দেহের অবসান ঘটবে। সত্যিই যদি কুকুরটাকে দেয়ালে গাঁথা হয়ে থাকে, তবে তার কঙ্কালটা অন্তত দেখতে পাব আমরা।
যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। একদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি আর শওকত বেরিয়ে পড়লাম। শওকত ওদের একটা গাড়ি নিয়েছিল। ও চালাচ্ছিল, আমি পাশে বসে ছিলাম।
ধ্বংসাবশেষটা লখনৌ শহর থেকে কয়েক মাইল উত্তরে। গাড়িতে যেতে যেতে শওকতের মুখে শুনলাম, ওটার আশেপাশে বসতি নেই; কুসংস্কারের বশেই হোক, কিংবা ভয়েই হোক, আসফ খাঁ-র এককালের সুরম্য প্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যে বাস করার বাসনা কারো হয়নি। কথায় কথায় কুকুরটার প্রসঙ্গ উঠল। শওকত বলল, শুনেছি, রাতের অন্ধকারে ওটা প্রাসাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিত; ওর কুচকুচে কালো রং অন্ধকারে মিশে যেত, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলত আগুনের মতো। যারা ওই দৃশ্য দেখেছে, ভয়ে তাদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড় হত। তাদের মুখে শুনেছে অন্যরা, এভাবেই ছড়িয়েছে। আসফ খাঁ-র প্রাসাদ পরিত্যক্ত হবার এটাও অন্যতম কারণ, আশেপাশে জনবসতি গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে সেই কসাইয়ের মর্মান্তিক ঘটনার পর ধারেকাছে যারা ছিল, তারা অন্যখানে চলে গিয়েছিল।
একটা গাছের ছায়ায় গাড়িটা রাখল শওকত। আমি চারদিকে তাকালাম। নির্জন জায়গা। আসফ খাঁ-র প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ একটা যেন প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমার মনে হল ধ্বংসাবশেষ কথাটা বোধ হয় ঠিক নয়— মজুর লাগিয়ে পরিষ্কার আর মেরামত করলে, এখনও অনেকদিন বাস করা চলে। পুরোনো দিনের শক্ত গাঁথুনি, মালমশলায় খাদ নেই। থাম আর খিলান দেখেই বোঝা যায় কী মজবুত গড়ন।
হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝলক এসে গায়ে লাগল, আর নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। অপরাহ্ন বেলায় পরিত্যক্ত আর জরাজীর্ণ ওই অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল আমার মন। একবার মনে হল, গোঁয়ার্তুমি করে বিপদ না ডেকে এনে, ফিরে গেলেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু পরমুহূর্তে মনকে শাসন করলাম, যে কুসংস্কারে এখানকার সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ বহু বছর ধরে ভুগছে, আমিও কি তার শিকার হব!
শওকতের গলার স্বরে আমার চমক ভাঙল। ও বলছিল, দেয়ালটা ভেঙে ভেতরটা দেখার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। আমি বাজি ধরতে রাজি আছি, ভেতরে যাই থাকুক না কেন, কুকুরের কঙ্কাল নেই।
আমরা একটা শাবল নিয়ে গিয়েছিলাম। কুঠুরিটা খুঁজে নিতে আমাদের বেশি বেগ পেতে হল না। শওকতের কাছে ওই প্রাসাদের এক পুরোনো নকশা ছিল, সেটা দেখে ওই কুঠুরির অবস্থান আগেই ও জেনে নিয়েছিল। এখানে আগেও বার দুয়েক ও এসেছিল, কিন্তু তখন ওই কুঠুরিটা খুঁজে বের করার সুযোগ হয়নি।
ছোট্ট কুঠুরি, মানে অন্যান্য বিরাট বিরাট ঘরের তুলনায়। কিন্তু দেয়াল কী পুরু। ওই দেয়ালে শুধু কুকুর কেন, প্রমাণ চেহারার একজন মানুষকেও অনায়াসে গেঁথে ফেলা যায়। আমরা দেয়ালের সামনে দাঁড়ালাম।
চারদিকে একটা শান্ত ভাব, জনপ্রাণীর সাড়া নেই। ভাঙা ছাদের গর্ত দিয়ে পড়ন্ত বেলার রোদ এসে পড়েছে দেয়ালে। যেখানে কুকুরটাকে পিরবাবা জীবন্ত গেঁথেছিলেন, সেখানে দেয়ালটা এবড়োখেবড়ো ছিল। এই দীর্ঘকাল পরেও জায়গাটা খুঁজে বের করতে আমাদের মোটেই কষ্ট হল না, কারণ রোদের ঝলকটা আশ্চর্যভাবে দেয়ালের ওখানেই পড়েছিল। অদ্ভুত যোগাযোগ।
শওকত আমার হাত থেকে শাবলটা নিয়ে দেয়ালে এক ঘা বসাল। ঠং করে শব্দ হল একটা। যেন ওখানটা পাথর দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। পর পর কয়েকটা শাবলের আঘাতেও দেয়ালের ওখানে কিন্তু চিড় ধরল না। আমি মনে মনে পিরবাবার হাতের কাজের তারিফ না করে পারলাম না, গাঁথুনিটা খুব ভালোভাবেই করেছেন তিনি।
শওকতের পর আমি হাতে নিলাম শাবলটা। বেশ জোরে জোরে কয়েক ঘা দিলাম, কিন্তু কোনো ফল হল না। আমাদের কেমন যেন জিদ চেপে গেল। পালা করে আমরা দু-জনে শাবলের ঘা মারতে লাগলাম দেয়ালের ওই নির্দিষ্ট জায়গায়। শেষ পর্যন্ত একটা ভাঙন সৃষ্টি হল দেয়ালে। নবীন উদ্যমে আমরা সেই ফাটলে শাবল ঢুকিয়ে চাড় দিতে লাগলাম, আরও ইট-পাথর ভেঙে পড়ল।
আস্তে আস্তে আলগা হয়ে এল ইট-পাথর, কিন্তু তবু যখন হাত দিয়ে আমরা ওগুলো টেনে বের করছিলাম, আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল যেন আলগা অংশগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে না। সেটা ছিল হেমন্তকাল, তেমন গরম নয়, কিন্তু আমাদের দু-জনের সর্বাঙ্গ বেয়ে নেমেছিল গামের বন্যা। কেউ বা কিছু যেন ইট-পাথরগুলোকে ধরে রাখতে চাইছে, তাই আমাদের পরিশ্রম বেড়ে গেছে চতুর্গুণ। একবার আমার মনে হল, কেউ যেন একটা ইট নিয়ে ওপাশ থেকে আমার সঙ্গে টানাটানি করছে, আমি থমকে গেলাম। শওকতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওর মুখেও ফুটে উঠেছে একটা বিমূঢ় ছাপ।
তারপরই হঠাৎ যেন প্রতিরোধটা স্তিমিত হয়ে এল, আর যে ইটটা নিয়ে আমি ধস্তাধস্তি করছিলাম, সেটা আমার দু-হাত গলে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। দেয়ালে নয়-দশ ইঞ্চির মতো একটা চৌকো ফোকর সৃষ্টি হল।
আমরা দু-জনেই কীসের একটা তাড়নায় দু-পা পিছিয়ে এলাম, দু-জনেই তাকালাম দু-জনের মুখের দিকে।
কী ওটা? শওকতের গলার স্বর তীক্ষ্ন শোনাল।
জানি না। আমি জবাব দিলাম।
আমরা দু-জনেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম সন্দেহ নেই! ওই ফোকরের ভেতর থেকে একটা খসখস শব্দ আমরা দু-জনেই স্পষ্ট শুনেছি।
হয়তো ভেতরে কোনো কাগজ…, শওকত একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, বাতাসে ওটা নড়ে উঠেছে।
ওটা যে কোনো কাগজের শব্দ নয়, সে-বিষয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যেও কিন্তু সন্দেহ ছিল না।
ওই ফোকরের দিকে এক দৃষ্টিতে আমরা দু-জনেই তাকিয়ে ছিলাম, হঠাৎ চমকে উঠলাম। একটা কালো ধোঁয়ার রেখা বেরিয়ে আসছে ফোকর থেকে, কুণ্ডলী পাকিয়ে শূন্যে জমা হচ্ছে, আস্তে আস্তে যেন আকার নিচ্ছে একটা। আবহাওয়া কেমন যেন দূষিত হয়ে উঠছে। আমাদের তখনকার মনের অবস্থা ঠিক বোঝাতে পারব না, তবে কিছু একটা অশুভ… ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ইভল, তার উপস্থিতি স্পষ্ট টের পাচ্ছি।
ঠিক সেই মুহূর্তে কীসের একটা তাড়নায় আমরা দু-জনেই নীচু হয়ে বড়ো ইটটাকে তুলবার চেষ্টা করলাম। দু-জনের মনেই তখন এক চিন্তা, ওই ফোকরটাকে আবার বন্ধ করে দিতে হবে। ওটাকে ফোকরে গুঁজে দিতেই সুন্দরভাবে জুড়ে গেল, যেন কোনো নাড়াচাড়া পড়েনি।
একটা প্রবাদ আছে না— কপালে ঘাম মুছে শওকত বলল, ‘ঘুমন্ত কুকুরকে জাগিয়ো না।’ আমাদের সেটা মেনে চলাই উচিত ছিল।
আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। —ক্ষীণ কণ্ঠে আমি জবাব দিলাম, চলো, এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি, ভালো লাগছে না আমার।
তোমারও তাই মনে হচ্ছে। আশ্চর্য! শওকত বলল, আমিই ভাবছিলাম ওকথাটা বলব।
আমার জন্য অপেক্ষা না করেই বড়ো বড়ো পা ফেলে ও বাইরের দিকে হাঁটা দিল। আমি ওর পিছু নিলাম। একবার ঘাড় ফিরিয়ে সেই কালো ধোঁয়ার আকারটাকে কিন্তু দেখতে পেলাম না।
গাড়িটা যেখানে দাঁড় করানো ছিল, তার থেকে আমরা যখন প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত দূরে, আমি চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। আমার স্পষ্ট মনে হল, যেন একটা চারপেয়ে জন্তু আমার পায়ে পায়ে আসছে। বুড়ি শাকিনার জাদুসিদ্ধ সেই ভয়ংকর কালো কুকুরটাকে জীবন্ত দেয়ালে গেঁথে ফেলেছিলেন যোগসিদ্ধ পিরবাবা, ওই অঞ্চলের সবাইকে মুক্তি দিয়েছিলেন ভীষণ একটা আতঙ্কের হাত থেকে। আমরা কি নিজেদের আহম্মকিতে ওটাকে মুক্তি দিলাম! আবার জাগিয়ে তুললাম চিরনিদ্রিত কুকুরটাকে?
কথাটা মনে আসা মাত্র আমার ধৈর্যের সমস্ত বাঁধন যেন ছিঁড়ে গেল। প্রাণপণে ছুটলাম গাড়ি লক্ষ করে— শওকতকেও তাই করতে বললাম। গাড়ির কাছে পৌঁছে এক হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমি, দরজাটা জোরে বন্ধ করে তবে নিশ্চিন্ত হলাম।
মনে আবার সাহস ফিরে আসতেই পেছন ফিরে দেখলাম, শওকত ঠিক একইভাবে বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে আসছে। ও কি পায়ে পায়ে কুকুরের অনুসরণের শব্দ শোনেনি? তবে কী সবটাই আমার কল্পনা!
হঠাৎ দৌড় মারলে কেন?— দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে শওকত প্রশ্ন করল। কিন্তু ও যে চট করে দরজা বন্ধ করে পেছনটা দেখে নিল, তা আমার দৃষ্টি এড়াল না। তারপরই ও বলে উঠল, তোমাকে আমি দোষ দিই না, আমার নিজেরও তাই মনে হয়েছিল। কেন যে আমার তা মনে হয়েছিল, তা জিজ্ঞেস করলে কিন্তু আমি জবাব দিতে পারব না।
তুমি কিছু শোননি? আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
আমার হৃৎপিণ্ড ভীষণ জোরে লাফাচ্ছিল, তার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। শওকত জবাব দিল আর কিছু আমাকে প্রশ্ন কোরো না। আমি নিজেই জানি না, আমার মনের ভেতর কী অনুভূতি হচ্ছিল! শুধু এটুকু বলতে পারি, ওখানকার আবহাওয়ায় আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল, অশরীরী কিছু একটা আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেয়ালটা ভাঙা আমাদের উচিত হয়নি।
তার সাত দিন পরেই একটা চাকরি পেয়ে আমি এলাহাবাদ চলে গেলাম। আর তার ঠিক সাত দিন পরেই ডাকে আমার নামে একটা কাগজ এল। ওটা লখনৌয়ের একটা স্থানীয় সংবাদপত্র— পাঠিয়েছে শওকত। দু-জায়গায় দুটো খবর মোটা করে লাল কালিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটা খবর আর তার ভাষা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। প্রথমটা হল দু-দিন আগে দু-জন বিদেশি লখনৌ শহরের কয়েক মাইল উত্তরে আসফ খাঁ-র ঐতিহাসিক প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে একটা প্রকাণ্ড কালো কুকুর কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছেন। কুকুরটা প্রাসাদের প্রধান প্রবেশমুখে পাহারা দিচ্ছিল। সৌভাগ্যক্রমে বিদেশিদের একজনের হাতে মোটা একটা লাঠি ছিল, তাই দিয়ে কোনোমতে তাঁরা আত্মরক্ষা করেন। তবে তাঁদের একজনের ঘাড়ে একটা বিচ্ছিরি ক্ষতের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছে। এই ঘটনায় ওই অঞ্চলে একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
লাল কালির দাগ দেওয়া অন্য খবরটা হল সম্পাদকীয় মন্তব্য। তাতে বলা হয়েছিল স্থানীয় সংবাদের পাতায় আসফ খাঁ-র ঐতিহাসিক প্রাসাদ দর্শনপ্রার্থী দু-জন বিদেশির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি অতিকায় সারমেয় তাদের আক্রমণ করেছিল। আমার অনুরাগী পাঠক-পাঠিকা হয়তো এ খবরটা জেনে কৌতূহলী হবেন যে, প্রায় তিনশো বছর আগে, আরেকটি কৃষ্ণবর্ণ প্রকাণ্ড সারমেয় ওই প্রাসাদ পাহারা দিত। জনশ্রুতি, আসফ খাঁকে ওই কুকুরটা উপহার দিয়েছিল ডাকিনীবিদ্যায় পটীয়সী শাকিনা বিবি। ওই কুকুরটা ছিল শাকিনার জাদুসিদ্ধ— উত্তরকালে গোটা অঞ্চলের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কুকুরটা।
এই বিংশ শতাব্দীতে অলীক ঘটনায় আমরা বিশ্বাস করি না। আশা করি, সরকারি কর্তৃপক্ষ ওই হিংস্র কুকুরটার বিরুদ্ধে যথোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
সম্পাদকীয় মন্তব্যে ‘আরেকটি কৃষ্ণবর্ণ প্রকাণ্ড সারমেয়’ কথাটি গভীরভাবে লাল কালিতে চিহ্নিত করা ছিল।
মণীশ চুপ করল। ঘরের মধ্যে টুঁ শব্দটি নেই, আমরা সবাই যেন বোবা হয়ে গেছি— যেন অনুভব করছি অপার্থিব কিছু একটা উপস্থিতি।
তারপরই কথা বলে উঠল সুধেন্দু। বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে, সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘গাঁজা।’