রাতের অতিথি
সন্ধের মুখে প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা ধুঁকতে ধুঁকতে স্টেশনে এসে থামল। এখানেই ওটার যাত্রা শেষ। শীতকাল। কুয়াশাহীন পরিষ্কার আকাশে ঝলমল করছে তারা; চাঁদের আলো নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। রজত সুটকেশটা হাতে নিয়ে চটপট নেমে পড়ল। ঠান্ডা কনকনে হাওয়া ওর গরম পোশাক ভেদ করে যেন ছুঁচ ফোটাচ্ছে।
‘আচ্ছা, কাছাকাছি কোনো হোটেল আছে’, স্টেশন থেকে বেরিয়েই একজনকে ও জিজ্ঞাসা করল, ‘একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন?’
‘ভাগীরথী হোটেলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন’, লোকটি জবাব দিল, ‘সোজা গিয়েই বাঁ-দিকে যে রাস্তা পাবেন সেটা ধরে মিনিট দশ হাঁটলেই ওই হোটেল। ওখানে বোধ হয় জায়গা পেয়ে যাবেন।’
রজত তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটা শুরু করল। ‘ভাগীরথী হোটেল’, রজত মনে মনে হাসল বোধ হয় জায়গাটা গঙ্গার তীরে বলেই হোটেলের ওই নাম। ও অবশ্য আগে কখনো এখানে আসেনি, কাউকে চেনেও না। কিন্তু কলকাতা আপিসের ম্যানেজার ওকে বলেছেন জায়গাটা চমৎকার, যেমন ছিমছাম তেমন স্বাস্থ্যকর।
‘রাতটা হোটেলে কাটিয়ে আমাদের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের সঙ্গে পরদিন আপিসেই একেবারে দেখা করো, তিনি তোমার থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন’, তিনি বলেছিলেন।
রজতের বয়স মাত্র উনিশ। সবে বি.কম পাশ করেছে। লেখাপড়ায় ও মাঝারি ধরনের, কিন্তু সুশ্রী চেহারা আর মজবুত স্বাস্থ্যই এই চাকরিটা পেতে সাহায্য করেছে ওকে। কলকাতার আপিসে তিন মাস ট্রেনিংয়ের পর রজতকে এখানে পাঠানো হয়েছে, অবশ্য কলকাতা আপিস থেকে ওকে কথা দেওয়া হয়েছে এক বছরের মধ্যেই কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হবে।
রজত বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটছিল। জীবনে উন্নতি করতে হলে চটপটে হওয়া দরকার এটা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। কলকাতা আপিসের বড়ো কর্তাদের কখনো সে বসে থাকতে দেখেনি, সবসময়ই তাঁরা ব্যস্ত, চটপটে।
লোকটি তাকে বলেছিল সোজা গিয়ে বাঁ-দিকের রাস্তা ধরতে, কিন্তু সোজা রাস্তাটাই তো কম নয়। মস্সলের লোকদের দূরত্ব জ্ঞান বোধ হয় একটু কম। পথ ক্রমেই নির্জন হয়ে আসছে, দোকান পাট আর চোখে পড়ে না, শুধু ছাড়া ছাড়া ঘরবাড়ি।
আঃ, এতক্ষণে বাঁ-দিকে মোড় নিয়েছে পথটা এ দিকটা যেন আরও নির্জন। বাড়িগুলি মনে হয় নবাবি আমলের। চাঁদের আলোয় ইট বার করা ওদের চেহারা চোখে পড়ল রজতের। চুন-বালি খসে পড়া ইটগুলির দিকে রজত একটু কৌতূহলের সঙ্গেই তাকাল, ইটগুলি কেমন যেন ছোটো ছোটো, আজকালের মতো নয়। রজত অবশ্য রওনা হবার আগে এ জায়গাটা সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিল। জায়গাটা যে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এবং নবাবি আমলে এসব অঞ্চলের আলাদা মর্যাদা ছিল, তা রজত জেনেছে। এখন কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এক মৃত পুরী। হয়তো এই পথটা পেরোলেই শহরের নতুন গড়ে ওঠা এলাকা, সেখানেই লোকজনের বাস বেশি, আর হোটেলটাও সেখানে।
এদিকের বাড়িগুলি অনেকটা একই ধরনের। রাস্তার দিকে মুখ করা, চার পাঁচ ধাপ সিঁড়ির পর সদর দরজা। এক সময় এসব বাড়িতে যাঁরা বাস করতেন তাঁরা যে ধনী ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বেশ ফাঁকা ফাঁকা বাড়ি, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।
হঠাৎ পথের মিটমিটে আলোয় একটা বাড়ির গায়ে লেখা একটা বিজ্ঞাপন রজতের চোখে পড়ল। ‘রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে।’ রজত দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ অনেকটা হেঁটে ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, হোটেল আরও কত দূর কে জানে! রাতটা এখানে কাটালে কেমন হয়? সকালে উঠে না হয় অন্য ব্যবস্থা করবে। বিজ্ঞাপনটা ওকে যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে লাগল।
ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে থাকে রজত। না, হোটেলেই ভালো, সেখানে অনেক স্বাধীনতা আছে, গেরস্ত বাড়িতে বাধানিষেধ অনেক। ও আবার হাঁটবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল, আর কেন জানি না ওর চোখ দুটো ওই বিজ্ঞাপনের দিকে আটকে গেল। ‘রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে।’ প্রতিটি কথা যেন চোখের আকার নিয়ে ওকে ইঙ্গিতে আহ্বান করছে। নিজের অজান্তেই ও এগিয়ে গেল, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল।
দরজার কড়া নাড়ল রজত। আশ্চর্য, সঙ্গেসঙ্গে দরজা খুলে গেল। রজত একটু চমকে উঠল। সাধারণত দরজায় কড়া নাড়ার অন্তত কয়েক সেকেন্ড পরে দরজা খোলে, কিন্তু এক্ষেত্রে কড়া নাড়া শেষ হতে না হতেই দরজা খুলে গেল। যেন তার কড়া নাড়ার জন্যই কেউ ওপাশে অপেক্ষা করে ছিল।
দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়িয়েছেন একজন বয়স্কা মহিলা। ভদ্রমহিলার গায়ের রং ফ্যাকাশে যেন শরীরে রক্ত নেই, কিন্তু কালো দু-চোখের দৃষ্টি গভীর।
‘এসো, ভেতরে এসো’, ভদ্রমহিলা মিষ্টি করে বললেন। দরজার একটা পাল্লা তিনি খুলে ধরেছেন। রজত ঘরের ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। পুরোনো আমলের ভারী আসবাবপত্তর, একপাশে একটা পিয়ানো, দেয়ালে রং চটে যাওয়া বড়ো বড়ো ছবি আরও কত কী!
‘আপনার বিজ্ঞাপনটা দেখে এসেছি’, ও বলল।
‘হ্যাঁ, জানি।’
‘আজ রাতের মতো একটা ঘর পাওয়া যাবে?’
‘নিশ্চয়ই’, ভদ্রমহিলা একটু কৌতুক করে হেসে বললেন, ‘তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ঘরটা’, তাঁর ছোটো ছোটো সুন্দর দাঁত পথের আলোয় ঝকঝক করে উঠল।
‘আমি হোটেলের দিকেই যাচ্ছিলাম’, রজত যেন কৈফিয়তের সুরে বলল, ‘আপনার বিজ্ঞাপনটা হঠাৎ চোখে পড়ল।’
‘ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে কেন, বাছা’, ভদ্রমহিলা নরম গলায় বললেন,’ ভেতরে এসো।’
‘আপনার চার্জটা জানতে পারলে সুবিধে হত।’
‘এক রাতের জন্য পঁচিশ টাকা, অবশ্য সকালের খাওয়া নিয়ে।’
খুবই সস্তা। রজতের মনে হল হোটেলে না গিয়ে ভালোই করেছে, সেখানে মিছিমিছি বেশি খরচ হত।
‘তোমার যদি বেশি মনে হয়’ ভদ্রমহিলা যেন একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গেই বললেন, ‘তবে আমি আরও কমাতে পারি। সকালে চায়ের সঙ্গে দুটো ডিম দিই আমি। আজকাল ডিমের দাম বেড়ে গেছে। তুমি যদি ডিম না খাও তো কুড়ি টাকার মধ্যে হয়ে যাবে।’
‘পঁচিশ টাকাই ঠিক আছে’, রজত জবাব দিল, ‘এখানেই থাকব আমি।’
‘আমি জানতাম, তুমি থাকবে। ভেতরে এসো।’
ভদ্রমহিলার মায়ের মতো ব্যবহারে রজত খুশি হল।
ওকে ভেতরে এনে দরজা বন্ধ করে দিলেন ভদ্রমহিলা।
‘রাতে অতিথির সৌভাগ্য খুব বেশি আমার হয় না’, ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে বললেন, ‘তা ছাড়া যে সে লোক এলেই তো আমি থাকতে দিই না, আমার আবার একটু বাছবিচার আছে।’
‘আপনার চার্জ তেমন বেশি নয়’, রজত ভদ্রতার খাতিরে বলল, ‘অতিথির অভাব হবার কথা নয়।’
‘ওই যে বললাম, আমার পছন্দ ছাড়া কাউকে আমি রাতের অতিথির সুযোগ দিই না…আমি কি বলতে চাইছি, বুঝতে পারছ আশা করি?’
‘হ্যাঁ…নিশ্চয়ই।’
‘তবে অতিথির জন্য আমার ঘর সবসময় ঠিক করাই থাকে। যদি হঠাৎ কখনো মনোমতো কোনো ছেলে এসে পড়ে তার জন্য ঘর পরিষ্কার রেখেছি, বিছানাও পাতা আছে। হ্যাঁ, তোমার মতো কম বয়সি আর স্বাস্থ্যবান ছেলে ছাড়া কাউকে আমি এখানে ঠাঁই দিই না। দরজা খুলে যখন দেখি একজন জোয়ান ছেলে রাতের অতিথি হতে চাইছে তখন আমার যে কী আনন্দ হয়।’
ভদ্রমহিলা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে কথা বলছিলেন, ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘জোয়ান ছেলে ঠিক তোমার মতো।’ তাঁর কালো চোখের গভীর দৃষ্টি রজতের সারা অঙ্গে পরশ বুলাল, মাথা থেকে পা পর্যন্ত। রজতের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। মাথা খারাপ নয়তো ভদ্রমহিলার।
দোতলায় উঠে আঙুল দিয়ে বাঁ-দিকটা দেখিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এদিকটায় আমি থাকি, তোমার ঘর ডান দিকের একেবারে শেষেরটা। এসো দেখবে।’
রজতকে তিনি অতিথির জন্য নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা ছোটো হলেও বেশ খোলামেলা।
‘ভোরে সূর্যের আলো জানালা দিয়ে একেবারে বিছানায় এসে পড়ে। কি যেন তোমার নাম…রতন?’
‘না রজত।’
‘ওঃ! কী সুন্দর নাম। হ্যাঁ, আমি একটা গরম জলের বোতল চাদরের তলায় রেখে দিয়েছি। বিছানা গরম রাখবে, খুব শীত পড়েছে ক-দিন।’
‘ধন্যবাদ’, রজত বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’ ও লক্ষ্য করে দেখল নিভাজ বিছানা, ধবধবে চাদর, মাথার দুটো বালিশ, একটা পাশবালিশ। এখন শুয়ে পড়লেই হল।
‘তুমি আজ রাতের অতিথি হয়ে এসেছ বলে সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছি’ ভদ্রমহিলার কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর। রজতের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘আমার দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছিল, আজ রাতটাও বোধ হয় রোজকার মতো নিঃসঙ্গ কাটবে।’
‘আমিও খুশি’, রজত প্রফুল্ল মুখে বলল। সুটকেশটা একটা চেয়ারের ওপর রেখে ও চাবি ঢোকাল।
‘রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে? এখানে আসার আগে কিছু খেয়ে এসেছ?’
‘আমার খিদে নেই, আপনি ও নিয়ে ব্যস্ত হবেন না’, রজত জবাব দিল, ‘আমি একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। অনেক কাজ কাল।’
‘বেশ, তুমি সুটকেশ খুলে জামাকাপড় বার কর, আমি যাই। ভালো কথা, শোবার আগে একতলার বসবার ঘরে গেলে টেবিলের ওপর যে খাতাটা আছে তাতে তোমার নাম, ঠিকানা লিখে এসো। অতিথিদের নাম, ঠিকানা আমার কাছে থাকা ভালো, কখন কি দরকার পড়ে বলা যায় না তো। আমি তাই এটা নিয়ম করেছি। সব কিছুরই একটা নিয়ম থাকা উচিত।’ রজতের কাঁধে মৃদু চাপড় দিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি, যাবার সময় দরজা টেনে দিতে ভুললেন না।
ভদ্রমহিলার মাথায় যে একটু ছিট আছে সে বিষয়ে রজতের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা নিয়ে ও মাথা ঘামাল না। এত কম খরচায় এত ভালো থাকার জায়গা আর কোথাও ও পেত নাকি? তা ছাড়া ভদ্রমহিলা নিরীহ— এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না— তার উপর দয়ামায়া আছে শরীরে, কথাবার্তা থেকেই বোঝা যায়। রজত ভাবল হয়তো ভদ্রমহিলা ওর বয়সি ছেলে হারিয়েছেন তাই মাথায় একটু গোলমাল হলেও শুধু একটা বয়সের ছেলেদেরই থাকতে দেন।
হাত-মুখ ধুয়ে, জামাকাপড় ছেড়ে ও আবার নীচে নেমে এল। বসবার ঘরে ভদ্রমহিলা ছিলেন না, কিন্তু একটা শ্বেত পাথরের গোল টেবিলের উপর খাতাটা ওর চোখে পড়ল। পকেট থেকে কলম বের করে ও নিজের নাম আর ঠিকানা লিখল। ওই পাতায় ওর নামের আগে আর মাত্র দুটি নাম চোখে পড়ল ওর। কৌতূহলবশে রজত পড়ল। ওর ঠিক ওপরের নাম হল প্রদোষ মিত্র, ঠিকানা কলকাতা। অন্য নামটা সঞ্জয় গুপ্ত, কৃষ্ণনগরের ঠিকানা।
রজতের ভুরু কুঁচকে গেল। প্রদোষ মিত্র নামটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় শুনেছে? কবে?
ওর স্কুল, কলেজের সহপাঠী? উঁহু। তবে? আবার ও দৃষ্টি ফেরাল খাতার দিকে।
সঞ্জয় গুপ্ত।
১৭ ডি এল রায় রোড
কৃষ্ণনগর
প্রদোষ মিত্র
৫২এ, সতীশ মুখার্জি রোড
কলিকাতা-২৬
প্রথম নামটাও যেন এখন চেনা চেনা কিংবা শোনা শোনা মনে হচ্ছে।
‘প্রদোষ মিত্র?’ জোরে জোরেই ও উচ্চারণ করল। স্মৃতির সমুদ্র মন্থন করতে চাইছে যেন। ‘সঞ্জয় গুপ্ত?…’
‘চমৎকার ছেলে দুটি’, ওর পেছনে কে যেন বলে উঠল। একটু চমকেই ফিরে তাকাল রজত। ওর আশ্রয়দাত্রী একটা রুপোর ট্রে হাতে ওর পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছেন। এমন নিঃশব্দে যে টেরই পায়নি।
‘নাম দুটো আমার শোনা মনে হচ্ছে’ রজত বলল।
‘তাই নাকি? ভারি মজার তো।’
‘নাম দুটো আমি আগে শুনেছি, নিশ্চয়ই শুনেছি। ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত, তাই না? হয়তো খবরের কাগজে দেখেছি। ওরা কি নামকরা কেউ ছিল? মানে ভালো খেলোয়াড় কিংবা ওই ধরনের কিছু?’
‘নামকরা?’ ট্রে-টা একটা নীচু টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন, ‘না, না, আমার মনে হয় না ওরা নামকরা ছেলে ছিল। কিন্তু সুপুরুষ ছিল, হ্যাঁ দু-জনেই। সেটা আমি জোর গলায় বলব। দু-জনেরই ছেলেমানুষি বয়স, দু-জনেই তাজা স্বাস্থ্যবান আর চমৎকার দেখতে, ঠিক তোমার মতো।’
রজত আবার খাতাটার দিকে তাকাল। ‘কিন্তু’, তারিখগুলো লক্ষ্য করে ও বলে উঠল, ‘শেষের তারিখটা ছ-মাস আগের।’
‘তাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ। আর সঞ্জয় গুপ্তের তারিখ তারও এক বছর আগের মোট দেড় বছর।’
‘ওঃ!’ ভদ্রমহিলা দু-পাশে ঘাড় নাড়তে নাড়তে মৃদু একটা নিশ্বাস ছাড়লেন। ‘সময় যে কীভাবে কেটে যায় তা বোঝা যায় না, তাই না তপন?’
‘তপন নয় রজত’, বাধা দিয়ে বানান করে বলে উঠল ও ‘র..জ…ত।’
‘ও হ্যাঁ!’ একটা সোফায় বসে ভদ্রমহিলা অপরাধীর মতো বললেন, ‘এমন ভুলো মন আমার। তুমি কিছু মনে কোরো না, বাছা।’
‘ব্যাপারটা কি জানেন?’ রজত বলল, ‘যা আমার কাছে হেঁয়ালি ঠেকছে?’
‘কী, বাছা?’
‘মানে— ওই নাম দুটো, সঞ্জয় গুপ্ত আর প্রদোষ মিত্র, নাম দুটো আমার শুধু মনেই পড়ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে নাম দুটোর মধ্যে যেন একটা সম্পর্ক আছে, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না…’
‘তাই বুঝি!’ ভদ্রমহিলা দু-চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন। ‘এবার এদিকে এসো দেখি, আমার পাশে বসো। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চা আর বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়গে।’
‘আপনি আবার এত কষ্ট করতে গেলেন কেন?’ রজত বলল। ভদ্রমহিলা পেয়ালায় চা ঢালছিলেন। রজত লক্ষ্য করে দেখল ভদ্রমহিলার ফর্সা হাত দুটি ছোটো ছোটো, চটপটে, আর আঙুলের নখ রক্তিম।
‘কাগজেই আমি নাম দুটো দেখেছিলাম’, রজত অন্যমনস্কভাবে বলে উঠল। ‘মনে আমার পড়বেই…’
একটা কিছু মনে এসে এসেও যদি মনে না পড়ে তবে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়, রজতেরও ঠিক তেমন একটা অনুভূতি হতে লাগল।
‘ওহো…হো’, রজত প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘প্রদোষ…প্রদোষ মিত্র…কোন একটা কলেজে পড়ত না ছেলেটা? গরমের ছুটিতে বেড়াতে বেরিয়েছিল…তারপরই হঠাৎ…’
‘বেশি দুধ আর চিনি পছন্দ কর চায়ে?’ ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ। তারপরই হঠাৎ…’
‘কলেজে পড়ত?’ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তুমি বোধ হয় ভুল করছ। আমার এখানে যে প্রদোষ মিত্র এসেছিল সে কলেজের পড়া শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছিল। এসো, আমার পাশে বসো, চা জুড়িয়ে যাবে।’ সোফার পাশে যেখানে জায়গাটা খালি ছিল সে জায়গাটা তিনি মৃদু চাপড়ালেন। রজতের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন তিনি।
রজত চিন্তিত মুখে ভদ্রমহিলার পাশে বসল। চায়ের পেয়ালা আর বিস্কুটের রেকাবিটা তিনি রজতের দিকে এগিয়ে দিলেন।
‘আঃ! আরাম করে বসে গরম চা খেয়ে শরীর গরম করে নাও।’ ভদ্রমহিলা স্নেহের কণ্ঠে বললেন।
রজত চায়ে চুমুক দিল। ভদ্রমহিলাও একটা পেয়ালা টেনে নিয়ে চুমুক দিলেন। আধ মিনিট কেউ আর কোনো কথা বলল না। কিন্তু রজত অনুভব করছিল ভদ্রমহিলা তাকে লক্ষ্য করছেন। শরীর ওর দিকে আধখানা ঘুরিয়ে চায়ের পেয়ালার ওপর দিয়ে চোখ দুটো রেখেছেন ওর মুখের ওপর। একটা কেমন গন্ধ নাকে এসে লাগছিল রজতের, গন্ধটা আসছে ভদ্রমহিলার গা থেকেই। খারাপ গন্ধ অবশ্য নয়। মশলা মাখানো বাদামের? নতুন চামড়ার? না, হাসপাতালে যেমন একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ পাওয়া যায় তেমন?
‘প্রদোষ খুব চায়ের ভক্ত ছিল’, নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ভদ্রমহিলা বললেন। ‘আর কাউকে আমি অত চা খেতে দেখিনি, ভারি ভালো ছেলে ছিল…টাটকা তাজা।’
রজত তখনও ভুরু কুঁচকে ভাববার চেষ্টা করছে।
‘তোমার বয়স কত?’ ভদ্রমহিলা হঠাৎ প্রশ্ন করলেন।
‘উনিশ।’
‘উনিশ!’ ভদ্রমহিলা পুলকিত কণ্ঠে বললেন। ‘ঠিক বয়স, ওটাই হচ্ছে ঠিক বয়স। প্রদোষেরও বয়স ছিল উনিশ। তবে ও তোমার মতো লম্বা ছিল না, আর তোমার মতো সুন্দর দাঁতও ছিল না ওর। তোমার দাঁতগুলো কী চমৎকার!’
রজত একটু বোকার মতো হাসল।
‘সঞ্জয়ের বয়স অবশ্য একটু বেশি ছিল,’ ভদ্রমহিলা বলতে থাকেন। ‘ছাব্বিশ বছর। তবে আমাকে যদি না বলত, আমি কিছুতেই ধরতে পারতাম না, এমন কচি কচি চেহারা। খুব রক্ত ছিল শরীরে।’
‘রক্ত!’ রজত অবাক হয়ে তাকায়।
‘হ্যাঁ, টকটকে চেহারা।’
রজত আবার চায়ে চুমুক দেয়। চায়ের স্বাদ কেমন যেন একটু তেতো তেতো, পোড়া বাদামের মতো।
‘খাতায় তোমার নাম সই করেছ তো?’ ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ।’
‘ভালো ছেলে। পরে যদি তোমার নাম ভুলে যাই তবে খাতা দেখে মনে করতে পারব। রোজই আমি খাতাটা দেখি; যারা এখানে রাত্তিরে আশ্রয় নেয় তাদের নামগুলো পড়ে আনন্দ পাই।’
‘আচ্ছা গত দেড় বছরে সঞ্জয় গুপ্ত আর প্রদোষ মিত্র ছাড়া আর কেউ এখানে রাত্তিরে থাকেনি?’
হঠাৎ কী ভেবে প্রশ্ন করল রজত।
চায়ের কাপটা তুলে ধরে, মাথা একপাশে কাত করে ভদ্রমহিলা আড়চোখে তাকালেন রজতের দিকে। তারপর মিষ্টি হাসি হেসে বললেন, ‘না, বাছা, শুধু তুমি।’
রজত উঠে দাঁড়াল, বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
‘আচ্ছা, আমি শুয়ে পড়ি, সারাদিন বড্ড ধকল গেছে’, ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে ও বলল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমাকে তো আবার ভোরেই উঠতে হবে’, ভদ্রমহিলা হাসিমুখেই বললেন। ‘সুন্দর ঘুম হোক তোমার।’
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল রজতের। খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে, চলছে আলো-আঁধারির খেলা।
রজত পাশ ফিরতে গেল, কিন্তু একী! শরীর এমন অসাড় লাগছে কেন। হাত-পা কিছুই নাড়াতে পারছে না। গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। হঠাৎ একটা ভীষণ সম্ভাবনা উঁকি মারল রজতের মাথায়। ভদ্রমহিলা কি চায়ের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন? তাই এমন বিস্বাদ লাগছিল চা? কিন্তু কেন? ওর কাছে যা টাকাপয়সা আছে তা নেবার জন্য? ভদ্রমহিলাকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে, অমন সন্দেহ একবারও মনে হয়নি। না, না, ও মিথ্যে সন্দেহ করছে। ভদ্রমহিলা ওকে যথেষ্ট যত্ন করেছেন।
ঘরে একটা মৃদু পায়ের শব্দ। বিছানার দিকেই এগিয়ে আসছে। রজত অপেক্ষা করতে লাগল, মাথা তুলে দেখবার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছে। তবে কি ওর প্যারালিসিস হল?
ধবধবে সাদা কাপড়ে ঢাকা এক নারী মূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে বিছানার পাশে। আস্তে আস্তে একটা মুখ নেমে আসছে, কাছে…আরও কাছে। কী ভয়ানক চোখ দুটো, লোভীর মতো চকচক করছে। ঝকঝকে দাঁত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কিন্তু দাঁতগুলো হঠাৎ এমন ছুঁচোলো হয়ে গেল কেন? গরম নিশ্বাসের হলকা এসে পড়ছে মুখের ওপর।
হঠাৎ ভীষণ আতঙ্কে প্রাণপণে চিৎকার করবার চেষ্টা করল রজত, কিন্তু গলা দিয়ে টুঁ শব্দটি বেরুল না। তারপরই কণ্ঠনালীর ঠিক তলায় তুলতুলে নরম গলায় তীক্ষ্ন দংশনের অনুভূতি…অসংখ্য ছুঁচ ফোটার যন্ত্রণা।
সেই মুহূর্তে ভয়ংকর সত্যটা স্পষ্ট হয়ে উঠল রজতের কাছে। সঞ্জয় গুপ্ত আর প্রদোষ মিত্রের মতোই একই পরিণতি হতে চলেছে ওর।