চৌধুরী ভিলা
দমদম এয়ারপোর্ট যাবার পথে মতিঝিল ছাড়িয়ে মাইল দেড়েক যাবার পর বাঁ-দিকে একটা বাড়ি অনেকেরই চোখে পড়েছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে দোতলা মস্ত একটা বাড়ি। বাড়িটা চোখে পড়ার বিশেষ কারণ হল, অত বড়ো বাড়িতে জন-মনিষ্যি নেই, দরজা-জানলা সবসময় বন্ধ থাকে। বাড়ির চারপাশে খোলা মাঠ, গোধূলিলগ্ন থেকেই ওখানে নেমে আসে একটা ভূতুড়ে পরিবেশ।
গত সাত বছর ধরে বাড়িটা এভাবেই পড়েছিল। সাত বছর আগে বাড়ির মালিক মারা যাবার পর থেকেই ওটা বন্ধ ছিল। এতদিন পরে ওটার নতুন মালিক অর্থাৎ আমি স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য এখানে এসেছি।
আমার পরিচয় একটু দেওয়া দরকার। বাড়িটার আদি মালিক ছিলেন অরিন্দম চৌধুরী, শুনেছি তিনি ছিলেন খুব রাশভারী মানুষ। তাঁর একমাত্র মেয়ে লুকিয়ে এক গরিবের ছেলেকে বিয়ে করেছিল। অরিন্দম চৌধুরী ব্যাপারটা মোটেই সহজভাবে নিতে পারেননি, মেয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্কও রাখেননি। তাঁর মৃত্যুর পর ভাগ্নে শশাঙ্ক রায় বাড়ির মালিক হয়েছিলেন, অরিন্দম চৌধুরীর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ীই সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন তিনি। শশাঙ্ক রায় অকৃতদার ছিলেন। শেষ জীবনে তাঁর নাকি মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছিল, অবশ্য বেশিদিন তিনি বাঁচেননি। (এসব আমি পরে জেনেছিলাম)। তাঁর মৃত্যুর পর অরিন্দম চৌধুরীর খুড়তুতো ভাই অন্নদা চৌধুরী উত্তরাধিকার সূত্রে ও বাড়ির মালিক হলেন। তিনি আমার বাবা। আমার বাবা কানপুরে ডাক্তারিতে খুব পসার জমিয়েছিলেন, তাই এ বাড়িটা সম্বন্ধে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না। আমি বাবার একমাত্র সন্তান। ছোটোবেলা থেকেই আমি ছিলাম ভীষণ দুরন্ত আর ডানপিটে। কোনোমতে ইস্কুলের গণ্ডিটা পেরিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বাই গিয়েছিলাম, সাধ ছিল হিন্দি সিনেমার হিরো হব। অন্য দিকে কিছু না হলেও ভগবান আমাকে চেহারাটা দিয়েছিলেন খাঁটি মরদের মতো। কিন্তু নায়ক হতে গেলে যে শুধু চেহারাটাই সব কিছু নয় তা আমার জানা ছিল না। ফলে শাটল কর্কের মতো একবার এখানে আরেকবার ওখানে ঘোরাঘুরি করে আমি যখন হতাশ হয়ে পড়েছি, তখন খবর পেলাম বাবা পরলোকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। মা আগেই চোখ বুজেছিলেন।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে বুঝতে পারলাম যে আমি রীতিমতো একজন বড়োলোক। বাবা সারাজীবন প্রচুর উপার্জন করেছিলেন, আমি তাঁর একমাত্র ওয়ারিশ, সুতরাং টাকার যে কী মহিমা তা টের পেতে লাগলাম আমি। ছোটোবেলা থেকে কানপুরে থাকলেও মার মুখে কলকাতার নানান গল্প শুনে এই শহরের ওপর আমার একটা মোহ পড়ে গিয়েছিল। আমি ঠিক করলাম কানপুরের বাস উঠিয়ে কলকাতায় নতুন জীবন শুরু করব।
অরিন্দম চৌধুরীর অ্যাটর্নি ছিলেন চক্রবর্তী অ্যান্ড চ্যাটার্জি— রণদা চক্রবর্তী আর সুধন্য চ্যাটার্জি, দুই পার্টনার। কলকাতার বাড়ি এবং বিষয়সম্পত্তির তদারকের ভার অরিন্দম চৌধুরীর মৃত্যুর পরেও তাঁদের ওপরেই ছিল; শশাঙ্ক রায় এ ব্যবস্থার অদলবদল করেননি। আমি কলকাতায় আসার আগে তাঁদের কাছে চিঠি লিখে বাড়িটা পরিষ্কার করে রাখতে অনুরোধ করেছিলাম, কবে কোন ট্রেনে আসছি তাও জানিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা ছিল মাঘ মাস।
হাওড়া স্টেশনে ওই ফার্মের একজন কেরানি একটা চিঠি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, বাড়িটা সাত বছরের ওপর খালি পড়ে থাকায় স্যাঁৎসেঁতে এবং বসবাসের পক্ষে অনুপযুক্ত হয়ে আছে। এই অবস্থায় এত শর্ট নোটিসে ওটার সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। আমি যেন আপাতত কোনো হোটেলে উঠি। সাক্ষাতে ওই বাড়ি সম্বন্ধে আলোচনার পর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
‘হুম!’ চিঠিটা পকেটে পুরতে পুরতে আমি একটা স্বগতোক্তি করলাম, তারপর কেরানিবাবুকে লক্ষ করে বললাম, ‘বাড়িটা আমি একবার দেখতে চাই, এখান থেকে কতদূর?’
‘তা দূর আছে,’ বাবুটি যেন একটু হিসেব করে জবাব দিলেন।
‘আপনার কি সময় হবে? আমার সঙ্গে যেতে পারবেন?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
ভদ্রলোক আপত্তি করলেন না, বোধ হয় আমার মন জুগিয়ে চলার নির্দেশ তাঁকে দেওয়া আছে। একজন হবু শাঁসালো মক্কেলকে চটানো যুক্তিসংগত নয়।
‘আপনি হয়তো বাড়িটা দেখতে চাইবেন এ মনে করে গতকালই আমি এজেন্টদের কাছ থেকে চাবিটা চেয়ে নিয়েছি,’ একটু গর্বের সঙ্গেই বললেন কেরানিবাবু।
‘এজেন্ট!’ আমার কপালে সামান্য কুঞ্চন দেখা দিল।
‘আমাদের ফার্মের হাতে আরও বাড়ি আছে তো,’ কেরানিবাবু ব্যাপারটা খোলসা করার জন্যে বললেন, ‘আমরা এক এস্টেট এজেন্টের মাধ্যমে ওগুলো দেখাশোনা করি। ভাড়া, লিজ এসবই ওরা আমাদের হয়ে করে। আমাদের কাছ থেকে ওরা কমিশন পায়, আবার আমরা মক্কেলদের কাছ থেকে এ কাজের জন্য ফি চার্জ করি।’
‘ও’, আমি ঘাড় দোলালাম, ‘প্রফিটেবল বিজনেস, কি বলেন?’
‘ঝক্কিও কম নয়,’ কেরানিবাবু সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিলেন, ‘মালিকদের কোনো ঝামেলা পোয়াতে হয় না, সেটাও বিবেচনা করে দেখুন স্যার।’
শেষের কথাটায় আমি তৃপ্ত হলাম।
একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম আমরা। মালপত্তর এ যাত্রায় আমি বেশি আনিনি। একটা ট্রাঙ্ক, একটা সুটকেস, একটা বেতের বাস্কেটে টুকিটাকি জিনিস আর বিছানা। শুনেছিলাম রেল আর সি,এম,ডি, এর কল্যাণে কলকাতায় এখন খাল-বিল, খানা-খন্দের অভাব নেই, সেখানে দিনে লাখ লাখ মশা জন্মাচ্ছে। কোথাও কোথাও তাদের আকার জাদুঘরে রাখার মতো। আমার আবার মশার বড়ো অ্যালার্জি, তাই মশারি আনতে ভুলিনি।
ট্যাক্সিতে আয়েস করে বসে আমি একটা দামি সিগারেট ধরালাম, ভদ্রলোককেও একটা দিলাম, তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললাম, ‘বুঝলেন মিস্টার, আমার জীবনটা হল একটা ধূমকেতুর মতো, বাঁধা ধরা নিয়ম কানুন মেনে চলা আমার কুষ্ঠিতে লেখা নেই। মেপে মেপে কথা বলা, ভদ্রভাবে হাসা, এসব আমার আসে না। তা ছাড়া আমি একটু নির্জনতা প্রিয়। এক দঙ্গল লোকের মধ্যে আমার কেমন যেন হাঁপ ধরে যায়। তাই ভেবেছিলাম এ বাড়িতে একা একা আমার খুব স্যুট করবে।’
‘তা ঠিক’, কেরানিবাবু আমার যুক্তিতে সায় দিলেন।
‘ছোটোবেলা থেকেই আমি সাবলম্বী, কারও সাহায্য ছাড়াই দু-চার রাত কোথাও কাটিয়ে দিতে আমার কোনো অসুবিধে হয় না।’
‘তা আপনাকে দেখে বোঝা যায়’, কেরানিবাবু তোষামোদের সুরে বললেন।
‘বাড়িটা মেরামতের দরকার, কিন্তু হঠাৎ ছাদ ভেঙে পড়বে এমন অবস্থা নিশ্চয়ই নয়, কি বলেন?’
‘আমি ঠিক জানি না স্যার’, কেরানিবাবু এবার সাবধান হয়ে গেলেন।
‘কোনো একটা ঘরের এক কোণায় শতরঞ্চি বিছিয়ে আর কম্বল মুড়ি দিয়ে আজ রাতটা স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারব।’ আমি বেশ উৎসাহের সঙ্গে বললাম।
আমার সঙ্গী মৃদু কাশলেন, ট্যাক্সির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন, তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয় না—’ ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে কথাটা তিনি শুরু করলেন কিন্তু শেষ করতে পারলেন না, চুপ করে গেলেন।
‘আপনার কি মনে হয় না?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘আপনি আমাকে মাফ করবেন, কিন্তু আমার মনে হয় না ও বাড়িতে আপনার রাত কাটানো উচিত।’
‘একথা কেন বলছেন?’
‘মানে গত সাত বছরে কেউ ও বাড়িতে রাত কাটায়নি। ধুলো-বালি ছাড়াও ঘরগুলো নিশ্চয়ই স্যাঁৎসেঁতে, আপনার অসুখ করতে পারে। আমি যতদূর জানি, বাড়ির আগের মালিক উন্মাদ আশ্রমে যাবার পর থেকেই বাড়িটা খালি পড়ে আছে, তাহলে সাত বছরের বেশিই হবে।’
‘উন্মাদ আশ্রম!’ আমি চমকে উঠলাম।
‘ও, আপনি জানেন না বুঝি!’ কেরানিবাবু একটা খবর দিতে পেরে উৎসাহী হয়ে উঠলেন, ‘শশাঙ্কবাবু মারা যাবার আগে বছর দেড় কী দুই উন্মাদ আশ্রমে ছিলেন, ভীষণ নাকি খেপে যেতেন।’
‘খবরটা আমার জানা ছিল না’, আমি চিন্তিত মুখে বললাম।
‘তা ছাড়া—’ কেরানিবাবু একটু ইতস্তত করলেন।
‘যা বলবার কেশে বলুন’, আমি একটু বিরক্তি বোধ করলাম, ‘আপনি সব কথায় একটা ফুটনোটের ইঙ্গিত দিয়ে চুপ করে যাচ্ছেন।’
‘না—মানে, বাড়িটা এতদিন খালি পড়ে আছে, আপনাকে লুকিয়ে লাভ নেই, ওটার দুর্নাম হয়ে গেছে।’
‘দুর্নাম? স্যাঁৎসেঁতে, অস্বাস্থ্যকর এই তো?’
‘তা নয় স্যার—’
‘তবে কি ভূতুড়ে বাড়ি?’
‘আপনি এক্কেবারে পেরেকের মাথায় হিট করেছেন স্যার,’ কেরানিবাবুর মুখে একগাল হাসি।
‘ও! সেজন্য এ বাড়িতে কেউ থাকতে চায় না?’ প্রশ্ন করলাম।
‘হ্যাঁ স্যার, আর সেই কারণেই বাড়িটা খালি পড়ে আছে, যারাই ভাড়া নিয়েছেন, দু-চার রাত কাটতে না কাটতেই ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের মুখেই বাড়িটার ভূতুড়ে বদনাম ছড়িয়েছে।’
তবে যত তাড়াতাড়ি দুর্নামটা ঘোচে ততই মঙ্গল, আমি মুখে চিন্তিতভাব ফুটিয়ে বললাম, ‘শুধু আজ রাত্তিরটাই নয় রোজ রাত্তিরেই আমার ওখানে থাকার দরকার। আপনি আজ আমার সঙ্গী হলে খুশি হতাম।’
ভদ্রলোকের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। আমতা-আমতা করে তিনি বললেন, ‘মানে…আমার স্ত্রীর শরীর ভালো নয়।’
আমি অতি কষ্টে হাসি চাপলাম।
‘অ্যাডভেঞ্চার আপনার লাইনের নয়’, কৃত্রিম গম্ভীর মুখে বললাম আমি, ‘ভালো কথা, ভূত কি বুড়ো না বুড়ি?’
‘না।’
‘তবে কি পাগল শশাঙ্ক রায়ের প্রেতাত্মা?’
‘না, না, তিনিও নন।’
‘তবে কে সে?’
‘আপনি যদি সত্যিই জানতে চান একটা বাচ্চা ছেলে…মানে বাচ্চা ভূত…’
আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না, হাসির দাপটে আমার দু-চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। ওই অবস্থাতেই আমি বললাম, ‘এমন মজার কথা আমি জীবনে শুনিনি। হোঃ হোঃ।’
‘আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, কথাটা সত্যি’, ভদ্রলোক আহত কণ্ঠে বললেন, ‘আমাকে কেউ এক হাজার টাকা দিলেও আমি ও বাড়িতে একটা রাত কাটাতে রাজি হব না।’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন’, আমি হাসি থামিয়ে বললাম, ‘আপনাকে কেউ হাজার টাকা দেবে না। তা ছাড়া একটা বাচ্চাকে আমি একাই সামলাতে পারব।’
দুই
বাড়িটা বড়ো রাস্তার ঠিক ধারে নয়, একটা খোলা মাঠে ভূতুড়ে বাড়ির মতোই দাঁড়িয়ে আছে। সব কটা জানালার শার্সি বন্ধ, বাড়ির রং বিবর্ণ। আমার বুকের ভেতরটা দমে গেল।
কেরানিবাবু চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলে চাবিটা আমার হাতে তুলে দিলেন। তার সঙ্গেই ধরাধরি করে আমার জিনিসপত্তর ভেতরে নিলাম। ঘরগুলোর অবস্থা শোচনীয়, ধুলোর স্তর আর মাকড়সার জালে ভরতি। মনে মনে আমি রাগলাম। আমার নির্দেশমতো বাড়িটা পরিষ্কার করে রাখলে অনেক পরিশ্রম বেঁচে যেত। আমি সে-কথা কেরানিবাবুকে বলেই ফেললাম, আরও বললাম, কলকাতার বিষয়সম্পত্তির ভার আর কাউকে দেব কিনা তা আমাকে ভেবে দেখতে হবে। কেরানিবাবু এবার ঘাবড়ালেন, একজন শাঁসালো মক্কেল হাতছাড়া হয়ে গেলে চক্রবর্তী অ্যান্ড চ্যাটার্জির খোদ মালিকরা যে সন্তুষ্ট হবেন না, তা বলাই বাহুল্য। ভদ্রলোক আশপাশ থেকে লোকজন ধরে এনে সামনের কয়েকটা ঘর পরিষ্কার করিয়ে দিলেন। তবে সেই লোকজনের আচরণে আর হাব-ভাবে আমার মনে হচ্ছিল তারা যেন পালাতে পারলেই বাঁচে। নেহাত দিন বলে আর নগদ টাকার লোভে তাড়াহুড়ো করে কোনোমতে কাজ সারল।
দুপুরের খাওয়াটা আমরা হোটেলেই সেরে নিলাম। সব গুছিয়ে উঠতে উঠতে বিকেল হয়ে গেল। মজুররা আর থাকতে রাজি হল না, কেরানিবাবুও উশখুশ করছেন। অমি তাঁর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম আমাকে একটা জনতা স্টোভ, পাঁচ লিটার কেরোসিন, একমন কয়লা, কিছু কাঠ আর কিছু তৈজসপত্র আনিয়ে দিতে। হোটেল থেকে ফেরার পথে এক দফা বাজার আগেই সেরে রেখেছিলাম। একটা লন্ঠন আর এক ডজন মোমবাতি কিনতেও ভুল হয়নি। টর্চে নতুন ব্যাটারি আছে, সুতরাং আলোর জন্য দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
ভদ্রলোক চলে গেলেন। দোকান-পাট বাজার খুব কাছে নয়, সেটাই মস্ত অসুবিধে। প্রায় সন্ধের মুখে দু-জন মুটের মাথায় জিনিসপত্তর চাপিয়ে তিনি ফিরলেন। মুটেরা কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকতে রাজি হচ্ছিল না, সদর দরজার সামনে সব নামিয়ে দেবার মতলবে ছিল। আমি তাদের প্রচণ্ড ধমক দিলাম, বললাম, তোমরা মরদ না আর কিছু! দিনের আলোতে এত ভয়! একমন কয়লা দোরগোড়ায় ফেলে গেলে আমি ভেতরে নেব কেমন করে। শেষপর্যন্ত ওরা সামনের ঘরে জিনিসপত্তর নামিয়ে দিল, কয়লার বস্তাটা খালি করল ঘরের এক কোণায়।
কেরানিবাবু বাড়তি টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি নিলাম না, বললাম, ‘ছেলে-মেয়েদের মিষ্টি কিনে দেবেন।
ভদ্রলোক মুখ লাল করে বিদায় নিলেন।
অন্ধকার নেমে এল। সঙ্গেসঙ্গে আক্রমণ করল মশকবাহিনী। বাপস, কানে শুনেছিলাম এবার স্বচক্ষে দেখলাম। এক একটা মশা যেন এক একটা ক্ষুদে এরোপ্লেন। এতদিন দরজা জানালা বন্ধ ছিল তাই বোধ হয় মশা ছিল না। আজ জানলা খোলা পেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘরে ঢুকেছে। জানলা যে বন্ধ করব তারও উপায় নেই, ভেতরটা ভ্যাপসা হয়ে আছে। আত্মরক্ষার জন্য আমি তাড়তাড়ি মুখে আর শরীরের অনাবৃত অংশে ওষুধ মেখে নিলাম, তবু খানিকটা রক্ষে।
এবার আমি ঘর-সংসার গোছাবার দিকে নিজর দিলাম। ভেতর দিকের একটা ঘরে খাট, বিছানা সবই ছিল, কিন্তু সে বিছানা মানুষের শোবার উপযুক্ত নয়। ওটা ফেলে দিয়ে খাটে আমি আমার বিছানা পেতে নিলাম, মশারি টাঙাতে অসুবিধে হল না।
চাল-ডাল, তৈজসপত্র একটা ছোটো ঘরে গুছিয়ে রাখলাম। আগামীকাল রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর সব ঠিক করব। একধারের একটা বড়ো ঘরে দশ বারোটা আলমারিতে ঠাসা বই। দেয়াল ঘেঁষে একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল, একটা ভিক্টোরিয়ান আমলের চেয়ার। টেবিলে পুরোনো কাগজপত্রের স্তূপ। অরিন্দম চৌধুরী বোধ হয় এ ঘরে বসেই কাজ-কর্ম করতেন। তাঁর আপিস ঘর ছিল এটা।
বসবার ঘরের সোফা, চেয়ার পুরোনো হলেও দামি। মেঝের কার্পেটটা শতছিন্ন। এত বড়ো বাড়ি আমার, এত বড়ো বাড়িতে আমি একা। স্টোভে খিচুড়ি চাপিয়ে দিলাম, বড়ো বড়ো আলু আর দুটো ডিম দিতেও ভুললাম না। একটা আমুল বাটারের প্যাকেট এনেছি, রাতের ভোজটা খারাপ হবে না।
আপিস ঘরের আলমারি থেকে একটা বই নিয়ে এলাম। রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে। যতক্ষণ না খিচুড়ি ফুটে ওঠে বইটা পড়ে সময় কাটানো যাবে। অবশ্য বইয়ের আমি তেমন ভক্ত নই, তা ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে থাকায় বাংলা বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগও নেই বললেই চলে, তবু কবিগুরুর ভাষা আমার ভাষা এক একথা ভাবতেও বুকটা ফুলে ওঠে।
ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে বসেছিলাম। বইয়ের মধ্যে কখন যে ডুবে গেছি খেয়াল নেই। হঠাৎ বাইরে থেকে দরজায় মৃদু করাঘাতে আমার চমক ভাঙল। একবার নয়, দু-তিনবার যেন কেউ দ্বিধাভরে দরজায় টোকা মারল।
‘কে? ভেতরে এসো।’ কথাটা বলেই আমি আবার বইয়ের পাতায় চোখ দিলাম।
বাইরে একটা খস খস শব্দ, আবার দরজায় মৃদু করাঘাত। যেন অন্ধকারে কেউ দরজা খোলবার চেষ্ট করছে।
‘ভেতরে আসতে বলছি না’, আমি এবার অধৈর্য কণ্ঠে বললাম, তারপরই মনে পড়ল বাড়িতে আমি একা।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি কিন্তু ভয় পাইনি। আগেই বলেছি ছোটোবেলা থেকে আমি খুব দুরন্ত আর ডানপিটে।
‘তুমি যেই হও, ভেতরে এসো’, আমি চেঁচিয়ে বললাম। একটা চ্যালা কাঠ আমি হাতে তুলে নিয়েছি। বলা যায় না চোর ডাকাতও হতে পারে। ওপাশে যে রয়েছে সে ব্যর্থ চেষ্টা করছে দরজা খোলবার। আমি বড়ো বড়ো পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু কয়েক পা গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হল।
দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল, আর সেই দরজা দিয়ে খুব জড়সড়ভাবে ঢুকল একটি বাচ্চা ছেলে। মলিন মুখ, মাথার চুল রুক্ষ আর এলোমেলো, পরনের পোশাক জীর্ণ, শীর্ণ চেহারা, দু-চোখে বিষণ্ণতা…না, বোধ হয় আমর ভুল হল, বিষণ্ণতম দৃষ্টি।
ছেলেটার বোধ হয় খাওয়া জোটেনি, বেচারি! আমি মনে মনে ভাবলাম, মুখে বললাম, ‘কী চাই তোমার খোকা?’
ছেলেটি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দিল না, ফিরেও তাকাল না আমার দিকে। ঘরের এদিক-ওদিক যেন কাকে খুঁজছে। টেবিলের তলা, ঘরের কোণা, কিছুই বাদ দিল না। সব খোঁজা হয়ে গেলে আবার ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘরের চারদিকে চোখ বুলোতে লাগল।
‘কী খুঁজছ তুমি?’ ওর রোগা রোগা পা, ঢোলা প্যান্ট আর ছেঁড়া জামাটার দিকে এক পলক দৃষ্টি বুলিয়ে আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ‘আমাকে বল, আমি খুঁজে দেব তোমাকে।’
একটি কথাও বলল না ছেলেটি, আমাকে যেন গ্রাহ্যই করছে না।
‘কোথায় থাক তুমি? কাদের বাড়ির ছেলে?’ নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন করলাম আমি।
ছেলেটি বেরিয়ে যাবার জন্য আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল।
‘অত সহজে তোমাকে যেতে দিচ্ছি না’, আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। ‘এখানে কেন এসেছ, কাকেই বা খুঁজছ, না বলা পর্যন্ত তুমি যেতে পারবে না।’
ছেলেটি আমার দিকে পিছন ফিরে দরজার চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। ওর চেহারা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। প্যান্টের পেছন দিকে একটা বড়ো ফুটো, পায়ের গোড়ালি ফাটা, গায়ে একটা সুতোর জামা। এই শীতেও একটুকরো উল নেই গায়ে।
‘বেচারি!’ আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই কথাটা বেরিয়ে গেল, ছেলেটির বোধ হয় খিদে পেয়েছে। ‘কিছু খাবে খোকা?’
ছেলেটি আমার দিকে ফিরে বড়ো বড়ো করুণ দু-চোখ মেলে তাকাল, কিন্তু একটি কথাও বলল না।
বোবা নাকি ছেলেটা? আমি মনে মনে ভাবলাম। ও চলে যাচ্ছে দেখে আমি হাত বাড়িয়ে ওকে আটকাতে চেষ্টা করতেই ও আমার হাতের তলা দিয়ে গ’লে ছুট মারল। আমি টর্চটা জ্বালিয়ে ওর পিছু নিলাম, ছেলেটি সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে দোতলায় উঠে গেল; আশ্চর্য, ওর পায়ের কোনো শব্দ নেই।
আমি কিন্তু কিছুতেই ছেলেটিকে ধরতে পারছি না, যত জোরেই আমি ছুটি না কেন, আমাদের দূরত্ব একটুও কমছে না। চওড়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে একটা ঢাকা বারান্দা দিয়ে ছেলেটি ছুটে চলেছে। ওই করিডরের দু-পাশে সারি সারি ঘর। একেবারে শেষ প্রান্তের বাঁ-দিকের একটা ঘরের দরজা খোলা ছিল। ছেলেটি সেই দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
আমিও ওই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম, ‘এবার আর তোমাকে পালাতে হবে না বাছাধন।’ আরে গেল কোথায় ছেলেটা!
আমার টর্চের আলো ঘরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়ছিল। ঘরটা খালি! দ্বিতীয় কোনো দরজাও নেই যা দিয়ে অন্য ঘরে যাওয়া যায়। লুকোবার কোনো জায়গা নেই। ঘরে একটা তক্তপোষ আর একটা হাতল-ভাঙা চেয়ার ছাড়া অন্য কোনো আসবাবপত্র নেই। এমনকী বেড়ালের বাচ্চা লুকিয়ে থাকবে এমন আড়াল কিছু নেই।
আশ্চর্য তো! ছেলেটা কি উবে গেল নাকি?
আমি আবার ফিরে যেতে যেতে মনে মনে আওড়ালাম। সত্যি আমি যেন হতভম্ব হয়ে গেছি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা চিন্তা ঝিলিক খেলে গেল।
ও হচ্ছে সেই বাচ্চাটা, যার কথা কেরানিবাবু আমাকে বলেছিলেন। যার ভয়ে কোনো ভাড়াটে এ বাড়িতে থাকেনি।
আমার অজ্ঞাতসারেই আমি উচ্চারণ করলাম ‘ও হচ্ছে সেই বাচ্চাটা’, আর আমার কথাটা দেয়ালে দেয়ালে ঠিকরে যেন গম গম করে উঠল।
আস্তে আস্তে আমি নেমে এলাম। আমি বুঝতে পারছি আমার কপালে গভীর ভাঁজ পড়েছে, আমি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছি।
তিন
অন্য কেউ হলে এ অবস্থায় কি করতেন জানি না, আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে পালাবার কথা চিন্তাও করলাম না! ছেলেটিকে ঘিরে যে রহস্য জমাট বেঁধে উঠেছে সেটা ভেদ করার কৌতূহলই বেশি করে পেয়ে বসল আমাকে। এই বাচ্চার ভয়েই একের পর এক ভাড়াটে বাড়ি ছেলে চলে গেছে, কেরানিবাবুর মুখে একথা শুনে আমি একটা মস্ত রসিকতা মনে করে প্রথমদিন হেসেছিলাম, এখন কিন্তু আর হাসি না। প্রথম রাতে আমার হয়তো চোখের ভুল হতে পারে, কিন্তু দিনের বেলাও ওকে আমি দেখেছি। সিঁড়ি দিয়ে চুপি চুপি নেমে এসে এ-ঘর ও-ঘর করছে, যেন কাউকে খুঁজছে, কিন্তু তার দেখা পাচ্ছে না। ছেলেটির চোখে মুখে একটা ব্যর্থ হতাশার চিহ্ন আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।
রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে আমি ওর উপস্থিতি অনুভব করি। ওই বাড়ির কোনো ঘরই ওর কাছে সমস্যা নয়, সর্বত্রই অবাধ গতি ওর। আমি ঘর বদল করেও কোনো ফল পাইনি। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে, যে অবস্থাতেই আমি থাকি না কেন, ছেলেটি চুপি চুপি নিঃসাড়ে এসে হাজির হয়। ও খালি খুঁজে বেড়ায়, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি কোণা, ব্যগ্রভাবে ও শুধু খুঁজেই চলেছে, সে খোঁজার যেন আর শেষ নেই, অন্ত নেই। একটা ঘর খোঁজা হয়ে গেলেই চলে যায় অন্য ঘরে। রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, কিছুই বাদ যায় না। প্রতি বারই মনে হয় যেন নতুন উদ্যমে ও শুরু করছে, তারপর বাঞ্ছিত বস্তুর দেখা না পেয়ে ওর মুখে ফুটে উঠত নিদারুণ হতাশার করুণ এক ছবি।
শেষপর্যন্ত আমি চক্রবর্তী অ্যান্ড চ্যাটার্জি ফার্মের রণদা চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে খাতির করে বসালেন, আমার কুশল বার্তা জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ছেলেটি কে, মি চক্রবর্তী?’ আমি কোনোরকম ভূমিকা না করে সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম।
‘মানে’, রণদা চক্রবর্তী তাঁর কেশবিরল মাথায় হাত বুলোলেন, ‘প্রশ্নটা একটু জটিল।’
‘এক সময় ওই বাড়িতে একটি বাচ্চা ছিল নিশ্চয়ই—আমি বলতে চাচ্ছি রক্তমাংসের ছেলে…মি চক্রবর্তী পুরু লেন্সের চশমাটা খুলে সেটা অন্যমনস্কভাবে রুমাল দিয়ে মুছলেন।
‘একটি নয় দুটি বাচ্চা ছিল’, তিনি জবাব দিলেন, ‘একটি ছেলে, একটি মেয়ে।’
‘ওই বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী হয়েছিল তাদের?’
‘মেয়েটিকে তার এক পিসি নিয়ে গিয়েছিল, আর ছেলেটি মারা গিয়েছিল!’
‘ওঃ! ছেলেটি তবে মারা গিয়েছিল!’ আমি সামান্য উত্তেজিত হয়ে উঠলাম, ‘কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল জানেন?’
‘না, আমি ঠিক জানি না। তবে তার মধ্যে কোনো গোলমাল ছিল বলে আমি শুনিনি, আপনি বোধ হয় তেমন কিছুই ভাবছেন?’
কয়েক মুহূর্ত আমি কোনো জবাব দিলাম না, তারপর বললাম, ‘মি চক্রবর্তী, ওই বাচ্চা দুটির ব্যাপারে ঘোরতর কিছু অন্যায় হয়েছে এ সন্দেহ আমি মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। আচ্ছা, ওদের পরিচয় কী?’
‘ওরা ছিল অরিন্দম চৌধুরীর নাতি আর নাতনি। ওঁর একমাত্র মেয়ে সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি গরিব ছেলেকে বিয়ে করেছিল। মি চৌধুরী মেয়ের সঙ্গে তারপর কোনো সম্পর্ক রাখেননি। বাচ্চা দুটিকে রেখে ওদের মা-বাবা দু-জনেই মারা যায়। তখন চৌধুরীমশাই ওদের নিজের কাছে নিয়ে আসেন। এই হল ঘটনা। মি চৌধুরীর মৃত্যুর পর পরবর্তী মালিক শশাঙ্ক রায় বাচ্চা দুটিকে ফেলে দেননি, ওখানে থাকতে দিয়েছিলেন।’
কীভাবে যে থাকতে দিয়েছিলেন তার ছবিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। পেট ভরে খেতে না পাওয়া অপুষ্ট একটি বাচ্চা, ছিন্ন, জীর্ণ পোশাক।
‘শশাঙ্ক রায় সম্বন্ধে কি যেন শুনেছিলাম?’ আমি অজ্ঞতার ভান করলাম।
‘হ্যাঁ, ভদ্রলোক শেষের দিকে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।’
‘নিজের নাতি-নাতনিকে বাদ দিয়ে অরিন্দম চৌধুরী ভাগ্নেকে সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন কেন?’
‘মা-বাপ হারা ভাগ্নে ছোটোবেলা থেকেই তাঁর কাছে ছিল। মেয়ে অমন বিয়ে করায় রাগ করেই তিনি ভাগ্নের নামে সব উইল করেছিলেন।’
‘এই বাচ্চা দুটির ব্যাপারে শশাঙ্ক রায়ের কোনো হাত ছিল না বলতে চান?’ আমি নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন করলাম।
‘না, না, এ আপনার ভুল ধারণা।’ তারপরই তিনি আমাকে পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাপারটাকে আপনি এত জটিল করে তুলতে চাইছেন কেন মি চৌধুরী? ছেলেটি আজ প্রায় আট-ন বছর হল মারা গেছে, তাকে নিয়ে মিছেই আপনি এত জল্পনাকল্পনা করছেন। আমাদের উপদেশ যদি শোনেন, ওই পোড়োবাড়িটা ভেঙে ফেলুন। হয় ওখানে হাল ফ্যাসানের নতুন একটা বাড়ি তৈরি করুন, নয় ওই অবস্থায় বেচে দিন। অনেকটা জমি আছে, ভালো দাম পাবেন।’
‘ব্যাপারটাকে নিয়ে কেন আমি এত ভাবছি জানেন?’ আমি পালটা জবাব দিলাম, ‘ছেলেটিকে আমি দেখেছি…মানে রোজ দেখছি। আমার বিশ্বাস ওর ওপর কোনো অন্যায় করা হয়েছে। ওর হাব-ভাবে তাই মনে হয়েছে আমার।’
‘অন্যায় যদি করা হয়েই থাকে, এত বছর পরে তার প্রতিকার সম্ভব নয়, মি চোধুরী।’
‘সেই অন্যায়টা কী জানতে পারলে তবেই সে কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আমি এ ব্যাপারে এখনও অন্ধকারে।’
রণদা চক্রবর্তী কিন্তু আমাকে আলো দেখাবার চেষ্টা করলেন না, কিংবা ইচ্ছে করেই অজ্ঞতার ভান করলেন।
আমি অন্য পথ ধরলাম। ওখানকার ফেরিওলা, দোকানদার, তাদের কাছে খবর সংগ্রহের চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেদিকেও আমাকে হোঁচট খেতে হল। এতদিনে পুরোনো লোকদের অনেকেই চলে গেছে, যারা আছে তাদের কাছে উৎসাহজনক তেমন কিছু খবর পাওয়া গেল না।
প্রথম আলোর সন্ধান পেলাম বড়ো রাস্তার উপর একটা মাংসের দোকানে। দোকানদার একজন বুড়ো মুসলমান। আমি প্রায়ই তার কাছ থেকে মাংস কিনতাম, তাই অল্পদিনেই তার চোখে আমি একজন ‘মেহমান’ হয়ে উঠেছিলাম।
একদিন আমার প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, ‘ওই বড়ো লাল বাড়িটার কথা বলছেন? হ্যাঁ, বড়ো মালিককে আমি দেখেছি। আমি তখন সবে দোকান দিয়েছি, জোয়ান বয়স। আমার দোকানের মাংসই তো যেত ও বাড়ি। বুড়োবাবুর খাস নোকর এসে নিয়ে যেত, পেছনের একটা পুরো রাঙ। তারপর ভাগ্নেবাবু মালিক হলেন। কেপ্পনের ঢেঁকি ছিলেন তিনি। দু-শো আড়াই-শো-র বেশি মাংস কিনতেন না, শুনেছি বুড়ো মালিকের মেলাই টাকা তিনি পেয়েছিলেন। না, বাচ্চাদের কখনো দেখিনি আমি, তবে আছে শুনেছিলাম। ছেলেটি যখন মারা গেল, এখান দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেও একটা বাঁশের খাটিয়ায়, যেমন-তেমন করে।’
শশাঙ্ক রায়ের উপর একটা নিষ্ফল আক্রোশে আমি দাঁতে দাঁত চাপলাম।
‘তবে একজনের কাছে আপনি খবর পেতে পারেন।’
‘কার কাছে?’
‘ওই যে ধোবিখানার পাশে রেস্টুরেন্ট দেখছেন ওটার মালিক হলেন হাঁদুবাবু, আমার পুরোনো খদ্দের। ওই বাড়ির বুড়ো সরকারের উনি পেয়ারের লোক ছিলেন।’
সে-দিনই বিকেলে রেস্টুরেন্ট খোলার প্রায় সঙ্গেসঙ্গে আমি গিয়ে হাজির হলাম। তখনও খদ্দের আসতে শুরু করেনি, আমার পক্ষে সুবিধেই হল। একটা ফাউল কাটলেট আর মোগলাই পরোটার অর্ডার দিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললাম। আমার পরিচয় শুনে ভদ্রলোক ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়লেন। আমার মতো একজন দামি ভদ্রলোক তাঁর গরিব রেস্টুরেন্টে পা দেবে এ যেন তাঁর কাছে আশাতীত সৌভাগ্য।
‘আমি তো এ অঞ্চলের বাসিন্দা’, ভদ্রলোক কথায় কথায় বললেন, ‘চৌধুরী ভিলা ছোটোবেলা থেকেই আমি দেখে আসছি। অরিন্দম চৌধুরীকে আমার বেশ মনে আছে। শীত কালে মাংকি টুপি পরে হাঁটু পর্যন্ত ঝুল একটা ঢোলা গরম কোট গায়ে দিয়ে আর হাতে মোটা লাঠি নিয়ে সকাল-বিকাল তিনি বেড়াতে বেরুতেন; লোকজনের সঙ্গে তেমন বেশি মিশতেন না। এসব জায়গা তখন চৌধুরী মশায়ের জমি ছিল, মস্ত একটা বাগান ছিল এখানে। কত রকম ফল গাছ! আমরা ছোটোবেলা পাঁচিল টপকে ফল চুরি করতে আসতাম, আর উনি সারা দুপুর লাঠি নিয়ে আমাদের তাড়া করতেন। আমরা ওঁকে ‘বুড়ো ভাম’ বলতাম। কথাটা বলেই ভদ্রলোক জিভ কাটলেন, বললেন ক্ষমা করবেন স্যার, আমার খেয়াল ছিল না যে, উনি আপনার আত্মীয়।’
‘আপনার লজ্জা পাবার কোনো কারণ নেই’, আমি ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘যদিও অরিন্দম চৌধুরীর সম্পত্তির আজ আমি মালিক, তাঁর সম্বন্ধে আমার কোনো স্পর্শকাতরতা নেই। আচ্ছা, শশাঙ্ক রায় মালিক হবার পর ও বাড়িতে দুটি ছেলে-মেয়েকে দেখেছিলেন বলে মনে পড়ে? অরিন্দম চৌধুরীর নাতি আর নাতনি?’
হাঁদুবাবু ভুরু কুঁচকে পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, ‘মেয়েটিকে দেখেছি কিনা মনে নেই, তবে ছেলেটিকে বার কয়েক দেখেছি। ও বাড়িতে যে ঝিয়ের কাজ করত তার নাম সরমা। তার হাত ধরে দোকানে আসতে দেখেছি, আট দশ বছরের ছেলে। সেও তো আজ আট দশ বছর আগের ঘটনা। আমার নিজের বয়স তখন চব্বিশ-পঁচিশ। এখন মনে পড়ছে, দুটো কারণে ছেলেটির সম্বন্ধে আমার কৌতূহল হয়েছিল।’
‘কী দুটো কারণ?’ আমি নিজেও কৌতূহল চাপতে পারলাম না।
প্রথমত ছেলেটির চেহারা আর জামাকাপড় দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হত যে সে একজন বড়লোকের নাতি। দ্বিতীয় কারণ হল তাকে নিয়ে তখন কানাঘুসো উঠেছিল।’
‘কানাঘুসো! কী কানাঘুসো!’
‘মানে বুড়ো চৌধুরী নাকি নাতির নামে উইল করেছিলেন।’
আমি শিস দিয়ে উঠলাম, এতদিনে রহস্যের সূত্র পাওয়া গেছে।
‘উইল নিশ্চয়ই কোনো উকিলকে দিয়ে করিয়েছিলেন, সাক্ষীসাবুদও দরকার হয়েছিল’, আমি মৃদু প্রতিবাদ করলাম, ‘উইল তো আর এমনি হয় না।’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই,’ হাঁদুবাবু সজোরে মাথা দোলালেন।
‘ওই যে মোড়ের বাড়িটা দেখছেন, ওটা ব্রজ উকিলের বাড়ি। চৌধুরীমশায়ের কিছু কিছু কাজ তিনি করতেন। তাঁকে দিয়েই উইল করিয়েছিলেন। ব্রজ উকিল অবশ্য চৌধুরীমশায়ের আগেই গত হয়েছিলেন।’
‘এতসব কথা আপনি জানলেন কেমন করে?’
‘মানে…’, হাঁদুবাবু একটু ইতস্তত করলেন ‘বুড়োবাবুর যিনি সরকার ছিলেন, তাঁর মুখে শুনেছিলাম। আমি তাঁকে কাকু বলে ডাকতাম। উইলে তিনি একজন সাক্ষী ছিলেন।’
‘হুম!’ আমি চিন্তিত মুখে বললাম, ‘তবে চৌধুরীমশায়ের যাঁরা অ্যাটর্নি তাঁদের দিয়ে উইলটা করানো হয়নি?’
‘আজ্ঞে না। একদিন সন্ধেবেলা বুড়ো চৌধুরী হঠাৎ সরকার কাকুকে হুকুম করেছিলেন ব্রজ উকিলকে খবর দেবার জন্যে। তিনি এলে তাঁর সামনেই উইলের খসড়া তৈরি, সই সব কিছু হয়ে গিয়েছিল। আরও একজন সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার তার পর আর কেউ সেই উইলটা চোখে দেখেনি। তাই বুড়ো চৌধুরী মারা যাবার পর পুরোনো উইলের জোরে শশাঙ্ক রায় সম্পত্তির মালিক হয়ে বসলেন। ওটা অ্যাটর্নির কাছে জমা ছিল, নষ্ট করা হয়নি।’
‘আশ্চর্য’, আমি না বলে পারলাম না।
‘সত্যিই আশ্চর্য’, হাঁদুবাবু মাথা দোলালেন, ‘প্রথমে সবাই ভেবেছিল শশাঙ্কবাবুই দ্বিতীয় উইলটা নষ্ট করে ফেলেছেন। কিন্তু সরকার কাকুর মুখে শুনেছি বুড়ো কর্তা ওটা নাকি নিজের কাছে রাখার জন্য জিদ ধরেছিলেন। থ্রম্বসিসে হঠাৎ মারা গেলেন, হয়তো উইলটা বার করে দিয়ে যেতে পারেননি। কোথায় যে লুকিয়ে রেখেছিলেন তার হদিস পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া ব্রজ উকিলও মারা গেছেন, সরকার কাকু আর ঝামেলায় জড়াতে চাইলেন না, চুপ করে গেলেন।’
চক্রবর্তী অ্যান্ড চ্যাটার্জির কেন ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার এত অনীহা তার কারণ এবার বোঝা গেল। শশাঙ্ককে তাঁরা হয়তো হাতে রাখতে চেয়েছিলেন, পরের উইলটা আদালতে প্রমাণিত হোক এটা তাঁদের ইচ্ছে ছিল না।
‘উইলটা বুড়ো চৌধুরী পরে নষ্টও করে ফেলতে পারেন’, হাঁদুবাবু মন্তব্য করলেন।
‘কিংবা শশাঙ্কর হাতেও পড়তে পারে’, আমি জবাব দিলাম, ‘ওই অবস্থায় আপনি কী করতেন?’
হাঁদুবাবু মাথা চুলকোলেন।
‘ছেলেটা শেষপর্যন্ত মরেই গেল!’ আমি প্রায় স্বগতোক্তি করলাম।
‘ওর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতে হলে আপনি সরমার সঙ্গে দেখা করুন। ওই বস্তিতে ও থাকে।’
হাঁদুবাবু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে মনটা আমার ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। টাকাপয়সার লোভে মানুষ কত নীচেই না নামতে পারে। এই বাড়ি এবং সম্পত্তির ন্যায্য মালিক হবার কথা ছিল ওই বাচ্চাটির, কিন্তু কার অদৃশ্য চক্রান্তে ও শুধু বঞ্চনা পেয়েই অকালে ঝরে গেল!
‘ওই ছেলেটির একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে আমি পাগল হয়ে যাব।’
কথাটা মনে করেই চমকে উঠলাম আমি। ছেলেটি মারা যাবার পর শশাঙ্ক রায় পাগল হয়েছিলেন। তবে কি ওকে দেখেই মাথা খারাপ হয়েছিল? হয়তো মনের গোপনে যে অপরাধ বোধটুকু ছিল, ছেলেটিকে দেখে সেটা একটা ভয়ানক পরিণতি নিয়েছিল।
‘ভগবান, আমি যেন বোধশক্তি না হারাই’, মনে মনে প্রার্থনা করলাম আমি।
চার
আমি ভেবেছিলাম সরমা বোধ হয় খুব বুড়ি হবে, হাঁটাচলা করতে পারে না, কিন্তু দেখলাম তা নয়। বুড়ি নিশ্চয়ই, তবে শক্ত সমর্থ, এখনও খেটে খায়।
আমার পরিচয় পেয়ে ভক্তিভরে একটা ভাঙা মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুনেছিলাম ও বাড়িতে লোক এয়েছে। আপনিই তবে ডাক্তারবাবুর ছেলে? বিয়ের পর ডাক্তারবাবু বউ নিয়ে এয়েছিলেন বড়োবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। আমার এখনও মনে আছে, খুব সোন্দরপানা ছিলেন আপনার মা, খুব ঠান্ডা পেকিতির।’
‘হ্যাঁ’, আমি বললাম আর মনে মনে ভাবলাম তাঁকে আমি কম জ্বালাইনি।
‘বাড়িটা তবে এখন আপনার? খুব ভালো। ভগমান আপনাকে সুখশান্তি দিন।’
‘সরমা’, আমি একটু গাঢ় স্বরে বললাম, ‘বাড়ির মালিক এখন আমি একথা সত্যি, কিন্তু আমি সুখী নই। ও বাড়িতে একটা অশুভ ছায়া আমি সবসময় টের পাই। তাই আমি সত্য ঘটনা জানবার জন্য তোমার কাছে এসেছি।’
বুড়ির সারা শরীর কেঁপে উঠল।
‘তোমার কোনো ভয় নেই সরমা, আমার কাছে সব খুলে বল’, আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, আমার মনে হয় ও বাড়িতে ঘোরতর একটা অন্যায় হয়েছে, সেই অন্যায়ের প্রতিকার না হওয়া পর্যন্ত ওখানে কেউ টিকতে পারবে না। সেই প্রতিকার আমি করতে চাই। আমার টাকার অভাব নেই, ও বাড়ি না হলেও আমার চলবে।’
‘তা আর হয় না বাবু’, ও বলল, ‘টাকায় মরা মানুষ বেঁচে ওঠে না।’
‘শেষ ক-টা মাস ওর দিকে তাকানো যেতনি। ওঃ! এখনও রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় যেন সিঁড়িতে ওর ছোট্ট পায়ের ওঠা-নামার শব্দ শুনতে পাই।’
‘তোমাকে আমি সত্যি কথাই বলছি’, আমি বললাম, ‘ওকে দেখে আমার একটুও ভয় হয় না, কিন্তু কষ্ট হয়।’
‘কী বললেন!’ সরমা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনিও তবে ওকে দেখেছেন?’
‘আমি ওকে প্রায়ই দেখি’, শান্ত কণ্ঠে আমি জবাব দিলাম।
‘আমি জানি না এসবের মানে কি!’ দু-হাত মোচড়াতে মোচড়াতে কাতর কণ্ঠে বলল সরমা।
‘আমিও জানি না’, আমি ওর কথার তালে তাল মেশালাম, ‘কিন্তু সেটা আমি জানতে চাই, তাই তোমার সাহায্য আমার দরকার। ওরা প্রথম যখন এ বাড়িতে এসেছিল, তখনকার কথা মনে আছে তোমার?’
‘আজ্ঞে— বড়োবাবুর মেয়ে সোমা দিদিমণির ওরা ছেলে-মেয়ে। দিদিমণি বাবুকে না কয়ে একজনকে বে করেছিল, একবস্ত্রে বাড়ি ছাইড়ে গেছিল। বাবু আর তার মুখদর্শন করেন নাই। বাচ্চা দু-জন যখন এয়েছিল, কী চেহারা তাদের। যেন অনেকদিন পেট ভইরে খায় নাই। তখন ওদের বয়স কত? খুকির ছয় আর খোকার আট। ওই খোকনের কী টানটাই না ছিল ছোটো বুনের উপর। সবসময় আইগলে রাখত। তাই দেইখ্যে বুড়ো বাবুরও মনটা ভিজেছিল, খুব শক্ত মানুষ ছিলেন তিনি।
‘তারপর বাবুর অসুখ করল। বিছানায় শুইয়ে শুইয়ে সোমা দিদিমণির কথা বলতেন, বাচ্চাদের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। তারপরই তিনি খোকনের নামে লেখাপড়া করলেন; ওই ব্রজ উকিলেরে ডাইকে পাইঠেছিলেন। আমার সেদিনের কথা আজও মনে আছে। ছোটোবাবুর সে কী দাপাদাপি! তার আগে তিনিই যে বিষয়সম্পত্তির মালিক হবেন এ কথা সবাই জানত কিনা।’
‘কিন্তু পরের উইলটা পাওয়া যায়নি’, আমি খেই ধরিয়ে দিলাম।
‘সে কথা এক-শো বার। বড়োবাবুর মিত্যুর পর সরকারবাবু ওটার খোঁজ করেছিলেন, কিন্তু ওটা আর পাওয়া গেলনি। আমার কিন্তু মনে হয় ছোটোবাবু জানতেন ওটা কোথায়। বড়োবাবু মারা যাবার পর বাচ্চাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতেন ছোটোবাবু। পেট ভইরে খেতেই দিতেন না। নতুন জামা কখনো পেরাণে ধরে একটা কিনে দেন নাই। নিজেও কেপ্পনের হাঁড়ি ছিলেন। সরকার আর আমাকে ছাড়া সবাইকে বিদেয় করে দিলেন। কাজ করাতেন তিন জনের মাইনে দিতেন একজনের।’
‘কেপ্পনের ধন ভোগে লাগে না’, আমি বললাম, ‘তাই ছোটোবাবু কিছু ভোগ করে যেতে পারলেন না।’
‘তা যা কয়েছেন। তারপর খুকির যখন আট বছর বয়স, খুব অসুখ করল। আমরা তো আশা ছাইড়েই দেছিলাম। কিন্তু ভগমানই যেন খুকির পিসিরে এখানে পাঠায়ে দিলেন। তিনি হঠাৎই এইসে পড়েছিলেন। মেয়েটার ওই অবস্থা, তার উপর ছোটোবাবু একবারও বদ্যি ডাকেন নাই, এসব দেইখ্যে তিনি মা দুগগার মতো ক্ষেইপে গেলেন। গাড়ি ডাইক্যে খুকিরে কোলে তুইলে চইলে গেলেন। ছোটোবাবু বাধা তো দিলেনই না, উলটে কয়ে দিলেন একবার নে গেলি পর খুকিরে চেরটা কাল রাইখ্যে দিতে হবে।’
‘আর ছেলেটার কী হল?’ আমার ধৈর্য যেন আর বাধ মানছে না।
‘বুনের জন্যি বাছার বুকটা যেন ভাইঙ্গে গেল। সে নিজের চোখে না দেখলি পর পেত্যয় হবেনি বাবু। দাঁত দিয়ে কিছুটি আর কাটতনি। পাঁচটা মাসও গেলনি মইরে গেল।’
‘কীভাবে মারা গেল?’
‘ওই রোগা শরীলে না খাওয়া-দাওয়া করলি পর বাঁচে কেউ? খুকি যে চইলে গেছে সে কথাটা ওর বোধ হয় পেত্যয় হতনি বাবু। সবসময় তারে খুঁইজে বেড়াত, এ-ঘর, ও-ঘর, সব ঘর। শেষের দিকে দোতলায় নিজের ঘর থেকে আর বেরুতনি। আমি চুপি চুপি পিসিরে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তখন কোথায় যেন গেছিলেন, চিঠি পান নাই। যখন তিনি এয়েছিলেন, তখন সব শেষ। ওঃ! পিসি কী গালটাই না দেছিল ছোটোবাবুরে। কয়েছিল, নরকেও ঠাঁই হবেনি ছোটোবাবুর। একটা বাচ্চার সম্পত্তি মিথ্যে কইরে কাইড়েই তিনি ক্ষ্যামা দেন নাই, তারে উপোসি রাইখে রাইখে মাইরে ফেলায়েছেন। অবিশ্যি কথাটা ঠিক নয়, নিজেই খাওয়া ছাইড়েছিল।’
‘তারপর? মারা যাবার পর?’
‘আপনি বিশ্বেস করবেননি বাবু, যে আতে শ্মশানে নে গেল, সে আতেই আমি নিজের চোখে ওকে দেখেছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নাইমে পাঁতি পাঁতি কইরে খুকিরে খোঁজতেছিল। বাঁইচে থাকার সময় যেমন খোঁজতো ঠিক তেমন কইরে খোঁজতেছিল। আমার তো পেরথম মনে হয়েছিল ও বুঝি বাঁইচে ফিরে এয়েচে। তারপর যখন বোঝলাম ব্যাপারটা, আমার দাঁত কপাটি লাগার জোগাড়। তারপর রোজ আতে ও আসত। চুপি চুপি বুনটারে খোঁজতো। ছোটোবাবু তো ওই কারণেই পাগল হয়ে গেলেন। তিনি চেঁচাতেন, অরে খুন করতে চাতেন, মুখে যা আসত কইতেন। তারপর বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতেন আর কইতেন, ‘অরে আমার সুমুখ থেকে সইরে নে যাও, সইরে নে যাও। ওঃ সে কী দিশ্য!’
‘ছেলেটিকে তবে ছোটোবাবু না খেতে দিয়ে মেরে ফেলেননি?’
‘না বাবু মিথ্যে বলবনি। তবে ছোটোবাবু যে তার মিত্যু কামনা করতেন একথা মিথ্যে নয়, আমি নিজের কানে শুনেছি। তা মিত্যু কামনা করা আর মিত্যু ঘটানো তো এক নয় বাবু।’
পিসির ঠিকানা সরমা দিতে পারল না, এতদিনে সেটা মনে না থাকারই কথা। আমি ওর হাতে জোর করেই এক-শো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে এলাম। বাচ্চা দুটির প্রতি অন্তত মায়া ছিল ওর।
কয়েকটা দিন কেটে গেছে। আমি সেদিন বিকেলে বাগানে কাজ করছিলাম। আগেই বলেছি, অনেকটা জমি নিয়ে বাড়িটা। ইতিমধ্যে আমি চারপাশে কাঁটার বেড়া লাগিয়েছি। একজন মালি সারাদিন কাজ করে, কিন্তু সন্ধের আগেই চলে যায়। দু-জন কাজের লোক ঠিক করেছি, তারাও রাতে থাকতে রাজি নয়। অগত্যা এখনও আমাকে অত বড়ো বাড়িতে একাই রাত্রিবাস করতে হচ্ছে। আস্তে আস্তে বাড়িটা জঞ্জালমুক্ত করবার চেষ্টা করছি, রাজমিস্ত্রি লাগাবার কথাও ভাবছি।
বাচ্চা ছেলেটিকে রোজই দেখি। আমরা দু-জনেই যেন দু-জনের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছি।
সেদিন বিকেলে একটা গোলাপ গাছের শুকনো ডাল বড়ো কাঁচি দিয়ে ছাঁটছিলাম, হঠাৎ মেয়েলি গলায় মুখ তুলে তাকালাম। গেটের ওপাশে দু-জন মহিলা, একজনের মাথায় কাঁচা পাকা চুল, অন্যজন একটি কিশোরী। দুধে আলতা গায়ের রং, পদ্মের পাঁপড়ির মতো টানা টানা দুটো চোখ, লাল টুকটুকে ঠোঁট। আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম। গাছের আড়ালে ছিলাম বলে ওরা আমাকে দেখতে পায়নি।
‘বাড়িতে নতুন লোক এসেছে মনে হচ্ছে’ বয়স্কা ভদ্রমহিলা বললেন। ভদ্রলোকের বাগানের শখ আছে দেখছি, বোধ হয় পাকাপাকি থাকবেন। তোর এ বাড়িটার কথা মনে পড়ে, রমা?’
‘আবছা আবছা’, মেয়েটির গলা থেকে যেন বীণার সুর ঝংকার দিয়ে উঠল। ‘যে ঘরে আমরা থাকতুম সেটার কথা মঝে মাঝে মনে পড়ে…মনে পড়ে দাদার কথা। একবার যদি ভেতরে যেতে পারতুম…বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে পিসি।’
আমার বুকের ভিতর প্রচণ্ড দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। যাদের খোঁজে আমি হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছি, তারাই আজ আমার দুয়ারে অতিথি। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বড়ো বড়ো পা ফেলে গেটের কাছে এগিয়ে গেলাম, বললাম, ‘আসুন না ভেতরে, আমি নিজের হাতে এই গোলাপ বাগান করেছি, দামি দামি সব গোলাপ।’ আমার নিজের কানেই কথাগুলো বোকা বোকা শোনালো।
বয়স্কা মহিলা ইতস্তত করছিলেন, কিশোরী ফিসফিস করে বলল, ‘চল না পিসি।’
‘বাড়ির মালিক যদি বিরক্ত হন’, পিসি তবু মনস্থির করতে পারেন না।
আমার পরনে ছিল একটা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, খালি পা, আর হাতে বাগানে কাজ করার কাঁচি। আমাকে বোধ হয় ওরা বাগানের মালি ভেবেছিলেন। (হায়রে, নিজের চেহারা সম্বন্ধে আমার অহংকার ছিল)।
মুখে আমি বললাম, ‘না, কেউ বিরক্ত হবে না, আপনার ইচ্ছে করলে বাড়ির ভেতর ঘুরে দেখতে পারেন। বাড়িতে আর কেউ নেই, আপনাদের কোনো অসুবিধে হবে না।’
বাড়ির ভিতর যেতে যেতে কিশোরী একবার আমার দিকে ফিরে তাকাল, বোধ হয় বুঝতে চেষ্টা করল আমি লোকটা আসলে কে?
প্রায় মিনিট পনেরো পরে ওরা বেরিয়ে এলেন, আমি সদর দরজার সামনেই ওদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম।
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
আমি মৃদু প্রতিবাদ করলাম, ‘এমন কিছু আমি করিনি।’
‘এই মেয়েটি আমার ভাইঝি, এই বাড়ির সঙ্গে ওর একটা করুণ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমরা আজ এদিকে এসেছিলাম, তাই বাড়িটা দেখার লোভ সামলাতে পারিনি।’
কিশোরীর দু-চোখ ভেজা ভেজা, বোধ হয় একটু আগে কেঁদেছিল।
‘আমারও তাই মনে হয়েছিল’, আমি নরম গলায় বললাম, ‘ওর নাম তো রমা মজুমদার, তাই না?’
‘হ্যাঁ,’ পিসি জবাব দিলেন, কিন্তু আপনি জানলেন কেমন করে?’
‘আমার নাম সৌগত চৌধুরী, অরিন্দম চৌধুরী ছিলেন আমার বাবার জেঠতুতো দাদা।’
‘ও, আপনিই তবে এখন এ বাড়ির মালিক?’ পিসি জিজ্ঞেস করলেন। ‘হ্যাঁ, একাই আছি আমি এখানে। বরাবর কানপুরে ছিলাম, এই প্রথম কোনো আত্মীয়ের মুখ দেখলাম।’ তারপর একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘কিছু যদি মনে না করেন, ভেতরে একটু চা খাওয়াবার সৌভাগ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।’
ওরা আপত্তি করলেন না। ভেতরে বসবার ঘরে ওদের নিয়ে বসালাম, ভালো বিস্কুট ছিল ঘরে।
‘আমার এখন মনে পড়ছে’, কিশোরী হঠাৎ বলে উঠল, ‘এই ঘরে আমি আর দাদা লুকোচুরি খেলেছি।’
কিন্তু কিশোরী একটা জিনিস লক্ষ্য করেনি। তার পাশে এসে যে দাঁড়িয়েছিল, তাকে দরজা পেরিয়ে ঢুকতে আমি দেখেছিলাম। আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ যেন হিম হয়ে গেল।
সেই বাচ্চা ছেলেটি। ও কিন্তু এখন আর কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে না, মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘ভাগ্যিস মেয়েটি ওকে দেখতে পাচ্ছে না’, আমি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
সত্যিই মেয়েটি অনুভবই করছে না ওর উপস্থিতি।
আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ওর রোগা হাতটা মেয়েটির কাঁধের ওপর এসে থামল, ওর পাণ্ডুর ঠোঁট স্পর্শ করল মেয়েটির পাকা আপেলের মতো গাল। ওর দু-চোখে আকুল প্রতীক্ষার যেন দীর্ঘ অবসান।
মেয়েটি যখন পিসির সঙ্গে বিদায় নিল, ও তখন তাদের পিছন পিছন সদর দরজা পর্যন্ত গেল, তারপরই যেন মিলিয়ে গেল বাতাসে।
সে-দিন সন্ধের পর আমি বসবার ঘরে বসে একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলাম, হঠাৎ চোখ না তুলেই আমি অনুভব করলাম ওর উপস্থিতি। মৃত ছেলেটির আত্মা এই দীর্ঘ সময় ছোট্ট বোনটির কথাই শুধু ভেবেছে, তার খোঁজ করে চলেছে দিনের পর দিন, এটা মনে হতেই আমার বুকের ভিতরটা কেমন একটা ব্যথায় ভরে গেল। আমার অজান্তেই বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
ঠিক তখুনি কচি হাতে একটা স্পর্শ অনুভব করে আমি ফিরে তাকালাম। ছেলেটি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে নেই সেই বেদনাতুর দৃষ্টি। যাকে হারিয়ে তার আত্মা অতৃপ্তভাবে এতদিন শুধু খুঁজেই বেড়িয়েছে, তার দেখা সে পেয়েছে।
অনুসন্ধানের এখানেই ইতি, আর খুঁজে বেড়াতে হবে না ওকে, এই পুরোনো বাড়ির অন্ধকার অনাচেকানাচে আর উঁকি মারার দরকার নেই। এতদিন ছেলেটি বিশ্বস্তের মতো সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল ছোটো বোনটির জন্য, সেই দায়িত্ব থেকে এখন ও মুক্ত।
সে-রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমুলাম আমি। ভোর রাতে একবার ঘুম ভেঙে গেল, মনে হল যেন একটি বাচ্চার হাত মৃদু স্পর্শ করল আমার গাল।
বাড়িতে রাজমিস্ত্রি লেগেছে, পুরোনো বাড়িটার চেহারাই বদলে যাচ্ছে দিন দিন। সরমা আবার ফিরে এসেছে, একজন ঠাকুরও কাজে লেগেছে। চেষ্টা চরিত্র করে ইলেকট্রিকের কানেকশন পেয়ে গেছি, একটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে বাড়িতে।
পুজো এসে গেছে। রমা ওর পিসির কাছে পড়ছিল। পিসি ওখানকার মেয়েদের ইস্কুলের টিচার। ঝি এসে খবর দিল, একজন বাবু দেখা করতে এসেছেন।
আমি ঘরে ঢুকলাম।
‘আরে আসুন, আসুন’, আমাকে দেখে পিসি হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন।
‘দয়া করে আমাকে আপনি বলবেন না’, আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘সম্পর্কে আপনি আমার গুরুজন।’
‘বেশ কথা,’ পিসি হাসলেন, ‘বস তবে। বল কী খবর?’
‘একটা খবর আছে’, আমি বললাম, ‘দ্বিতীয় উইলটা পাওয়া গেছে। শশাঙ্ক রায়ের শোবার ঘরে একটা দেরাজে তালাবন্ধ ছিল।’
‘তার মানে সে-ই ওটা লুকিয়ে রেখেছিল’, পিসির গলা কঠিন।
‘হতে পারে’, আমি জবাব দিলাম, ‘অবশ্য তার কোনো প্রমাণ নেই। হ্যাঁ, সবাই যা অনুমান করেছিল তাই। উইলে ওই বাড়ি সম্পত্তি অরিন্দম চৌধুরী তাঁর নাতিকেই দিয়ে গিয়েছিলেন। নাতির অবর্তমানে আমার বাবা সব পাবেন, শশাঙ্কর উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ব্রজ উকিলের মুহুরি এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। তাঁর মুখেই শুনেছি কী একটা নিয়ে মামা ভাগনের নাকি তুমুল ঝগড়া হয়েছিল, ভাগনেকে একেবারে ছেঁটে বাদ দিয়েছিলেন।’
‘শয়তানটা খোকনকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলেছে, অথচ ওর সবই পাবার কথা ছিল’, পিসি রাগে যেন ফেটে পড়লেন।
‘উইলে আরও কিছু লেখা আছে’, আমি মৃদুকণ্ঠে বললাম।
‘কী লেখা আছে?’ পিসি এবার ভুরু কোঁচকালেন।
‘রমা পঁচিশ হাজার টাকা পাবে, ওটা ওর বিয়ে বাবদ আলাদাভাবে ব্যাঙ্কে জমা থাকবে।’
‘কিন্তু ওই উইলের এখন আর কোনো মূল্য নেই’, আমার চোখে চোখ রেখে পিসি বললেন।
‘আমার একটা নিবেদন ছিল’, আমি একটু কেশে গলাটা ঠিক করে নিলাম।
‘কী নিবেদন?’ পিসি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
‘এ বাড়ি আর সম্পত্তি আসলে খোকনের ভোগে আসা উচিত ছিল, কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য, ওকে শুধু দুঃখই ভোগ করতে হল। ও বেঁচে থাকলে আমি এসবের মালিক হতাম না, রমার জীবনও অন্যরকম হত। ভেবে দেখুন, আপনি ওর ভার না নিলে আজ ওর অবস্থাও হয়তো খোকনের মতোই হত।’
‘তা মিথ্যে নয়’, পিসি স্বীকার করলেন।
‘মানে আমি বলতে চাইছি, এ বাড়ি আর সম্পত্তিতে রমারও অধিকার আছে।’
‘কেমন করে?’ পিসি একটু অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন।
‘আমি আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না’, আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ‘মানে আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।’
‘যা বলতে চাইছ, স্পষ্ট করে বল’, পিসি এবার গম্ভীর হলেন।
‘খোকন বেঁচে থাকলে রমা আজ চৌধুরী ভিলায় থাকত…তাই আমি বলছিলাম…আমি চুপ করে গেলাম।
‘কী বলছিলে?’
‘যদি আমি রমাকে বিয়ে করি তবে সে সমস্যা মিটে যায়…মনে ওই সম্পত্তি ভোগে ওর কোনো অসুবিধেই আর থাকে না’, আমি এক নিশ্বাসে আমার বক্তব্য শেষ করলাম।
‘সে কী!’ পিসি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘তুমি না সম্পর্কে রমার মামা…!’
‘আমার বাবার জেঠতুতো দাদার মেয়ের মেয়ে রমা, আজকাল ওসব সম্পর্কের খোঁজই কেউ রাখে না’, আমি প্রতিবাদ করে বললাম।
‘না’, রমার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম আমি।
‘আমি কারো দয়া চাই না’, রমা পরিষ্কার গলায় বলল।
‘রমা ঠিকই বলেছে’ ওর পিসি বললেন, ‘তোমার দয়া ও হাত পেতে নেবে কেন? ওর কীসের দুঃখ? আর তুমি যদি অনুশোচনার বশেই ভেবে থাক রমাররই বিষয়সম্পত্তি ভোগ করা উচিত, তবে তোমারও উচিত ছিল অমন প্রস্তাব না করে এমনিতেই বাড়িটা রমাকে দিয়ে দেওয়া। তবেই বুঝতুম যে হ্যাঁ, সত্যিই তোমার উদ্দেশ্য মহৎ।’
আমি এক মুহূর্ত নিঃশব্দে পিসির মুখের দিকে তাকালাম, তারপর পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে খস-খস করে তাতে লিখে দিলাম, অরিন্দম চৌধুরীর বাড়ি এবং সম্পত্তি যা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, শর্তহীনভাবে রমা মজুমদারকে হস্তান্তরিত করলাম।
তলায় নিজের নাম সই করে কাগজটা টেবিলের উপর রেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, ‘বাড়ি দখল নেবার একদিন আগে আমাকে জানাবেন, আমি আমার জিনিসপত্তর নিয়ে চলে যাব।’
আমি দরজার কাছে পৌঁছেছি এমন সময় পিসি বললেন, ‘শোনো।’
আমি ফিরে দাঁড়ালাম।
‘এদিকে এসো।’
আমি এগিয়ে গেলাম।
‘বোস।’
যন্ত্রের পুতুলের মতো বসলাম।
‘নিজেকে খুব মহৎ মনে করছ, তাই না?’ পিসির গলায় ভর্ৎসনার সুর। ‘পরের জিনিস দান করাতে মহত্ত্ব নেই, বুঝেছ?’
আমি চুপ করে রইলাম।
‘তোমার সত্যিকারের ইচ্ছেটা কী বল তো? রমাকে দয়া করতে চাও, না বিয়ে করতে চাও?’
আমি মাথা চুলকালাম।
‘মানে আমি বিয়ে করতেই চাই, কিন্তু আমি ওর যোগ্য নই…তাই—’
‘তুমি একটা বুদ্ধু’, পিসি হেসে ফেললেন, ‘আমার আপত্তি নেই।’
আমি একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে ফেললাম।
রমার মুখে কেউ যেন ফাগ মাখিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ঠোঁটের ফাঁকে সলজ্জ হাসি।
ফুলশয্যার রাতে আবার ওকে দেখলাম।
ঘরের মধ্যে শুধু আমরা দু-জন। ফুলের গয়নায় রমাকে পরির মতো দেখাচ্ছে। খুশিতে ডগমগ করছে ওর মুখ। আমি ওর ডান হাতটা আমার দু-হাতের মধ্যে নিয়ে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম। ঠিক তখুনি দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল, ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল ছেলেটি, আমি স্পষ্ট দেখেতে পেলাম রমার মুখের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টিতে একটা মুগ্ধ ভাব, ভালোবাসা যেন ঝরে পড়ছে। ছোট্ট বোনটি আজ বড়ো হয়ে সুখের সংসার পেয়েছে, তারই আনন্দের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে ওর মুখে। সেখানে বিরাজ করছে চির শান্তির একটা স্নিগ্ধ আভা।
সেই শেষ, আর কোনোদিন ওকে দেখা যায়নি।