কালরাত্রি

কালরাত্রি

চিরটাকাল বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মেরে আর হেসে-খেলে দিনগুলি কাটিয়ে, চল্লিশ পেরোবার পর বরেন দুম করে বিয়ে করে বসল। বরেনের টাক মাথা, গোলগাল চেহারার পাশে ওর কমবয়সি সুন্দরী বউকে বেমানান লাগলেও ও কিন্তু বউকে নিয়ে একটু বেশিরকমই মাতামাতি শুরু করে দিল। বেশি বয়সে বিয়ে করলে সব পুরুষমানুষেরই মাথায় বোধ হয় একটু ছিট দেখা যায়, ভারসাম্য বজায় রাখা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা ওর বাড়াবাড়ি দেখে কৌতুক বোধ করতাম, ঠাট্টা-বিদ্রূপে জর্জরিত করতাম, ও কিন্তু কিছুই গায়ে মাখত না।

বিয়ের মাসখানেক পর বরেন সস্ত্রীক পুরী বেড়াতে গেল, আমি অফিসের কাজে পাটনা বদলি হলাম। কলকাতায় ফিরলাম বছর দুই পর। বরেনের সঙ্গে হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা। ওকে দেখে আমি চমকে উঠলাম, এই দুই বছরে ও যেন একেবারে বুড়ো হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে কথা বলে মনে হল ও যেন আগের বরেনের প্রেতাত্মা, চোখে-মুখে সেই হাসিখুশি ভাবের বদলে একটা দারুণ দুশ্চিন্তার ছাপ প্রকট হয়ে উঠেছে। আমি ওকে ওর বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই ও যেন কেমন ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকাল, আমি মনে মনে একটু অস্বস্তিই বোধ করলাম, অজান্তে হয়তো ওর কোনো দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছি। বরেন কিন্তু নিজেকে সামলে নিল, তরপর বলল, ‘বন্ধুদের মধ্যে তুই-ই আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ছিলি, এতদিন যা কাউকে বলিনি আজ তোকে তাই বলব, কারো কাছে মন খোলসা করতে না পারলে আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাব।’

আমরা দু-জনে লেকের ধারে এক নিরিবিলি জায়গা বেছে বসলাম। বরেন আমাকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে সিগারেট ধরাল, তারপর তার কাহিনি শুরু করল

‘তোর হয়তো মনে আছে, বিয়ের পর মানসীকে নিয়ে আমি পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা একটা হোটেলে উঠি। মানসীকে একান্তভাবে পাওয়ার জন্য আমি ইচ্ছে করেই লোকজনের ভিড় নেই এমন একটা হোটেল খুঁজে বের করেছিলাম, হয়তো ভাগ্যই আমাকে ওখানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। হোটেলটা দোতলা, খুব পুরোনো, আমরা ছাড়া আরও জনা পাঁচেক লোক সেইসময় হোটেলে ছিল। অথচ অন্যান্য হোটেলে তিলধারণের জায়গা ছিল না। আমাদের হোটেল সমুদ্রের ধারে হলেও একটু ছাড়া ছাড়া, এজন্যই বোধ হয় ভিড়ও কম।

দিন কয়েক বেশ আনন্দেই কেটে গেল, সমুদ্রের বালুতটে সকাল-বিকেল আমরা বেড়াতাম, নির্জনতা আমার কাছে যেন একটা আশীর্বাদের মতো মনে হয়েছিল। মানসীও সমুদ্র দেখে মুগ্ধ। ওর বাবা ছিলেন সামান্য কেরানি। সীমিত আয়, তার ওপর পাঁচটি মেয়ে, মানসীর তাই কোনোদিন বাংলার বাইরে যাওয়া ঘটেনি। সমুদ্রের নীল জল যখন ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে শতধা হয়ে তীরে আছড়ে পড়ত আর সাদা সাদা ফেনার পুঞ্জ তিরবেগে ছুটে এসে অনেকটা ভিজিয়ে দিত, ও তখন সেই ফেনার মধ্যে পা ডুবিয়ে ছোটো মেয়ের মতো দু-হাতে তালি দিয়ে হেসে উঠত।

‘একদিন হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম হোটেলে আমরা দু-জন এবং এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছাড়া আর কেউ নেই। আমি তখন ব্যাপারটায় অত গুরুত্ব দিইনি, ভেবেছিলাম যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ায় আবার যে যার কর্মস্থানে ফিরে গেছেন। যে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ছিলেন তাঁর নাম মি পট্টনায়ক, উড়িষ্যার অধিবাসী। আমার সঙ্গে তাঁর অল্প ক-দিনের মধ্যেই বেশ আলাপ জমে উঠল। ভদ্রলোক কটকে একটা নামি কোম্পানির সেলস ম্যানেজার, অফিসের কাজেই পুরী এসেছেন। ভদ্রলোক বেশ জ্ঞানী, ওড়িয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনেক তত্ত্বই তাঁর মুখে আমি শুনলাম।

‘সেদিন ছিল পূর্ণিমা তিথি। সকাল থেকেই মানসীকে কেমন যেন চঞ্চল মনে হচ্ছিল, একটা অস্থিরতা ওকে যেন পীড়া দিচ্ছে, কথায় কথায় অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে,। আমার কোনো কথাই যেন ওর কানে যাচ্ছে না। ওর হাবভাবে আমি রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। সন্ধেবেলা চাঁদ উঠল, পূর্ণ চন্দ্র, রুপোলি আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। চাঁদের আলোয় সমুদ্রের ঢেউগুলিকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। পূর্ণিমার আকর্ষণে ঢেউয়ের তীব্রতাও বেড়েছে, সমুদ্র যেন মত্ত হয়ে উঠেছে। আমি আর মি পট্টনায়ক একতলায় হোটেলের লাউঞ্জে বসে ছিলাম, সামনেই সমুদ্র। মানসী দোতলায় আমাদের নির্দিষ্ট ঘরে একাই ছিল, বিকেল থেকে মাথা ধরেছে বলে ও সেই যে বিছানা নিয়েছিল আর ওঠেনি।

মি পট্টনায়কের মুখের জ্বলন্ত সিগারের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেন জানি নিজেকে বড়ো নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগল, একটা অহেতুক আশঙ্কায় মন ভরে উঠল। হোটেলে মাত্র আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। চাকর-বাকরদের টিকি দেখা যাচ্ছে না, গোটা হোটেলটা প্রায় অন্ধকার, চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। মি পট্টনায়কের গলার স্বরে আমি প্রায় চমকে উঠলাম। তিনি বললেন, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন মি ঘোষ? আমি উত্তর দিলাম, না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করি না। মি পট্টনায়ক কয়েকবার তাঁর সিগারে ঘন ঘন টান দিয়ে সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিলেন। মাটিতে আছড়ে পড়ে ওটা থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরোল। সেদিকে চোখ দুটো রেখে মি পট্টনায়ক বললেন, আজ আপনাকে একটা বিচিত্র কাহিনি শোনাব। ঘটনাটি ঘটেছিল এই হোটেলেই আর সেটাও ছিল এক পূর্ণিমার রাত। মি পট্টনায়ক একটু থামলেন, যেন নিজেকে গুছিয়ে নিলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা, এই হোটেল সবে চালু হয়েছে, এমন সময় আপনাদের বাংলা মুলুক থেকে এক ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে হোটেলে এসে উঠলেন। ভদ্রলোকের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, সেই তুলনায় স্ত্রীর বয়স নেহাতই অল্প। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী। বেশি বয়সে কচি বউ হলে সাধারণত যা হয়ে থাকে, এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভদ্রলোক সবসময় চোখে চোখে রাখতেন বউকে, একদম চোখের আড়াল করতেন না। কোনো পরপুরুষের সঙ্গে স্ত্রীকে কথা বলতে দেওয়া দূরের কথা, কাউকে তাঁর সুন্দরী বউয়ের ওপর মুগ্ধ দৃষ্টি বুলোতে দেখলে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠতেন। ভালো কথা, ভদ্রলোকের পদবিও ছিল আপনার মতো ঘোষ।

‘তখন পুরীতে হোটেল এত বেশি ছিল না, তাই নির্জনতা সত্ত্বেও অনেকেই হৃতস্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় এই হোটেলে আস্তানা গাড়তেন। মি ঘোষের বউয়ের নাম ছিল মালবিকা। গরিবের ঘরের সুন্দরী মেয়ে, অবস্থার বিপাকেই বয়সের অনেকটা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একজন প্রৌঢ়কে স্বামিত্বে বরণ করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন একথা বলা বাহুল্য। মি ঘোষ দীর্ঘকাল কঠিন অসুখে ভুগে ডাক্তারদের পরামর্শ মতো পুরী এসেছেন, মাসখানেক থাকবেন। দিন দশেক পর কাশীনাথ নামে একজন যুবক এই হোটেলে এসে উঠল। কাশীনাথ কলকাতার এক ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র সন্তান, পুরী বেড়াতে এসেছে। কাশীনাথের যেমন সুন্দর স্বাস্থ্য তেমনি সে ছিল সুপুরুষ। মালবিকাকে দেখে প্রথম দর্শনেই সে মুগ্ধ হল, তার চোখে-মুখে যে সপ্রশংস ভাব ফুটে উঠল তা মালবিকার দৃষ্টি এড়াল না। তার বন্দি বিহঙ্গিনী জীবন যেন একটা ঝোড়ো হাওয়ায় চঞ্চল হয়ে উঠল। প্রথম দু-দিন শুধু চোরা চোখের চাউনি দিয়েই ওরা পরস্পরের মনোভাব বুঝে নিয়েছিল, তারপর মি ঘোষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তাদের গোপনে দেখাসাক্ষাৎ শুরু হল। তবে মি ঘোষের চোখকে ফাঁকি দিতে তারা পারেনি, পরের ঘটনা শুনলেই তা আপনি বুঝতে পারবেন।

‘কাশীনাথ মালবিকাকে বোঝাল, এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে ব্যর্থ জীবন কাটাবার কোনো মানেই হয় না। তার সুন্দর জীবনটা কেন সে নষ্ট করবে। তার চাইতে সে স্বামীকে ত্যাগ করে কাশীনাথের সঙ্গে চলুক, ও তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবে। মালবিকা প্রথমে তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি, সংস্কারই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কাশীনাথের যুক্তিতর্ক আবেগের কাছে তার সমস্ত প্রতিরোধ বন্যার জলে কুটোর মতো ভেসে গেল। ওরা ঠিক করল, এক রাত্রে মি ঘোষকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আচ্ছন্ন করে রেখে পালাবে।

‘ওরা যখন এই ফন্দি আঁটছিল, তখন মি ঘোষ অন্ধকারের আড়ালে নিজেকে গোপন রেখে তাদের সব কথা শুনছিলেন, আর তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল জিঘাংসার এক পৈশাচিক ছাপ।

‘আগেই বলেছি, সেটা ছিল এক পূর্ণিমার রাত। সব আয়োজন ঠিক। কাশীনাথ ওষুধের দোকান থেকে কয়েকটা ঘুমের ওষুধের বড়ি কিনে মালবিকার হাতে দিল। রাত্রে শুতে যাবার আগে মি ঘোষের এক গ্লাস জল খাওয়া বরাবরের অভ্যেস, সেই জলে মালবিকা সুযোগ বুঝে বড়ি মিশিয়ে দেবে।

‘মালবিকার মনে সেদিন সকাল থেকেই আশা ও আশঙ্কার যে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।

‘কথা ছিল, রাত ঠিক বারোটার সময়, মি ঘোষ যখন ঘুমের বড়ির প্রভাবে আচ্ছন্ন থাকবেন, কাশীনাথ তাঁদের ঘরের দরজায় মৃদু করাঘাত করবে আর মালবিকাও সঙ্গেসঙ্গে একবস্ত্রে বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে গেল উলটো।

‘রাত্রে খাবার সময় মি ঘোষ এক ফাঁকে মালবিকার জলের গ্লাসে গুঁড়ো করা ঘুমের বড়ি মিশিয়ে দিলেন। ফলে ঘরে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই মালবিকা ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর সে-ঘুম। আর মি ঘোষ অন্ধকার ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর চোখ দুটো হিংস্র শ্বাপদের মতোই জ্বলছিল।

‘ঠিক রাত বারোটার সময় দরজায় শব্দ হল, ঠক ঠক ঠক।

‘আস্তে আস্তে দরজা খুলে গেল। আর জানলা দিয়ে এসে পড়া এক ঝলক চাঁদের আলোয় কাশীনাথ যা দেখল, তাতে সে আতঙ্কে দু-পা পেছিয়ে গেল। কোথায় মালবিকা! মূর্তিমান যমের মতো দাঁড়িয়ে আছেন মি ঘোষ। তাঁর চোখে-মুখে হিংস্র শ্বাপদের অভিব্যক্তি, হাতে উদ্যত ছোরা।

‘কাশীনাথ আর আত্মরক্ষার সময় পেল না, মি ঘোষ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তীক্ষ্ন অস্ত্র হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ করল। কাশীনাথের পরনে ছিল ধুতি পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বুকের কাছটা রক্তে ভিজে একটা গোল আকার ধারণ করল। এসব কথা অবশ্য বিচারের সময় জানা গিয়েছিল।

‘বিচারে মি ঘোষের ফাঁসি হয়।

‘আর মালবিকা! তার যখন ঘুম ভাঙল, তখন সব শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে রক্তের ছড়াছড়ি, আর কাশীনাথের রক্তাক্ত মৃতদেহটা দরজার কাছে পড়ে আছে। বীভৎস সেই দৃশ্যে মালবিকা বুক-ফাটা আর্তনাদ করে উঠল, তারপরই সে যেন পাথর হয়ে গেল।

‘এই ঘটনার পর মালবিকাও আর বেশিদিন বাঁচেনি। মরবার আগে একবার মাত্র সে মুখ খুলেছিল। বলেছিল, কাশীনাথ আবার আসবে, আমি ওর জন্য অপেক্ষা করব।

‘মি পট্টনায়ক আর একটা সিগার ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ক্রমে লোকে এই ঘটনা ভুলে গেল। ঠিক পাঁচ বছর পরে এক বয়স্ক ভদ্রলোক তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীকে নিয়ে ওই ঘরটায় ছিলেন। সেটা ছিল আজকের তারিখ, অর্থাৎ যে রাত্রে কাশীনাথ খুন হয়েছিল। মাঝরাত্রে হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শুনে ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী জেগে উঠলেন। দরজা খুলে দিতেই এক ভয়াবহ দৃশ্য তাঁদের চোখে পড়ল। আবছা অন্ধকারে যেন একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তার জামার বুকের কাছটা রক্তাক্ত, আর তার দু-চোখে যেন প্রাণহীন দৃষ্টি।

‘ভদ্রলোক ভীষণ ভয় পেয়ে সঙ্গেসঙ্গেই হার্টফেল করেন, আর তাঁর স্ত্রী মূর্ছা যান। যখন তাঁর জ্ঞান হল তখন তিনি উন্মাদিনী।

‘এরপর থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এক পূর্ণিমা তিথির মাঝরাতে ওই ঘরের দরজায় নাকি করাঘাত শোনা যায়।

‘মি পট্টনায়ক থামলেন। একটু চুপ করে থেকে যেন আপন মনেই তিনি বললেন, আজ সেই কালরাত্রি, আর আপনারা আছেন সেই অভিশপ্ত ঘরে। আপনি একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করেছেন। আর আপনার স্ত্রী সুন্দরী। কী ভয়ানকভাবে সব মিলে যাচ্ছে!

‘মি পট্টনায়কের কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম। বললাম, এই বিংশ শতাব্দীতে এসব আজগুবি কাহিনি আপনি বিশ্বাস করেন?

‘ভদ্রলোক সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দিলেন না, যেন কী ভাবলেন। তারপর বললেন, এই ঘটনার সময় আমি এখানে ছিলাম, আমার বয়স তখন পনেরো। সেই বীভৎস ঘটনা আমার মনে এমন দাগ কেটেছিল যে, এখনো সব কিছু যেন আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। একটা ব্যাপার আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে, মালবিকার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর অদ্ভুত সাদৃশ্য। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরেও, ওঁকে দেখে প্রথম দিন আমি চমকে উঠেছিলাম।

‘ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা হিম শিহরন বয়ে গেল।

‘মি পট্টনায়ক বললেন, আমি প্রেততত্ত্ব নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি। ওই ঘটনার পাঁচ বছর পরে দ্বিতীয় ঘটনা এবং তারপর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দরজায় করাঘাত আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। গত কুড়ি বছর ধরে এই কালরাত্রে কী-একটা দুর্নিবার আকর্ষণে আমি এখানে না এসে পারি না। ওই ব্যাপারে এই হোটেলে দুর্নাম ছাড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি, তাই পারতপক্ষে কেউ এই হোটেলে ঘেঁষতে চান না। শুধু যাঁরা জানেন না, তাঁরাই এই হোটেলে এসে ওঠেন। দেখছেন না, আজ হোটেল ফাঁকা। যে চাকরটা আমাদের খাবার দেয়, তাকেও দেখা যাচ্ছে না। একটু পরেই ম্যানেজার নিজের হাতে খাবার দিয়ে চলে যাবেন, রাত দশটার পর কাউকেই আপনি পাবেন না।

‘আমি বললাম, কিন্তু আপনি…!

‘মি পট্টনায়ক একটু হাসলেন। তারপর বললেন, আমার ভয় নেই, এক সিদ্ধ বাবাজির মন্ত্রপূত কবচ ভূত-প্রেতের হাত থেকে আমার সবসময় রক্ষা করে। তবে আপনাদের কথা আলাদা। আপনি যদি আমার কথা শোনেন, তবে আমি বলব, আপনারা এই মুহূর্তে এই হোটেল ছেড়ে চলে যান।

‘আমি বললাম, এই রাত্রে কোথায় যাব! কোনো হোটেলেই জায়গা হবে না।

‘মি পট্টনায়ক বললেন, কোথাও জায়গা না পান, স্টেশনে গিয়ে রাত কাটান, আপনাদের ভালোর জন্যই বলছি।

‘ঠিক এই সময় হোটেলের ম্যানেজার আমার হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার দিয়ে বললেন, আজ লোকজন নেই— আপনাদের খাবারটা এর মধ্যে দিয়ে দিলাম, ঘরেই খেয়ে নেবেন।

‘আমি পুতুলের মতো হাত বাড়িয়ে টিফিন ক্যারিয়ারটা নিলাম।

‘মি পট্টনায়ক হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে হোটেলের ভেতর চলে গেলেন।

‘আমি ঘরে এসে দেখলাম, মানসী অঘোরে ঘুমুচ্ছে। বিকেলে মাথার যন্ত্রণায় ও সত্যি কষ্ট পাচ্ছিল। এখন শান্তভাবে ঘুমুচ্ছে দেখে, আমি আর ওকে জাগালাম না। একাই খেয়ে নিলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম, মি পট্টনায়কের কথায় কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখলাম, মানসীর এই অসুস্থ অবস্থায় ওকে উঠিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ার কোনো অর্থ হয় না। রাত্রে একটু সাবধান থাকলেই চলবে। তা ছাড়া ভূতুড়ে গল্পে আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যাওয়াটাও আমার পৌরুষে লাগল।

‘প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত আমি একটা গল্পের বই পড়লাম। তারপর আমার হাই উঠতে লাগল। দরজাটা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। আর প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গাঢ় ঘুম আমাকে গ্রাস করল।

‘হঠাৎ কেন জানি না, আমার ঘুমটা ভেঙে গেল! খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে। সেই আলোতে আমি অবাক হয়ে দেখলাম মানসী খাটের ওপর উঠে বসেছে। ওর দু-চোখ দরজার দিকে, যেন কিছু একটার জন্য ও সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছে।

‘ঠিক সেই সময় একটা দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। আর আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, কেউ যেন জুতো পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসছে। আমার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভয়ে আমি যেন মূক হয়ে গেছি।

‘মানসী আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। ওর দু-চোখে যেন আকুল প্রত্যাশা। তারপরই আমি শুনলাম ঠক ঠক ঠক। দরজায় কেউ যেন করাঘাত করছে।

‘মানসী দু-হাত বাড়িয়ে আত্মনিবেদনের ভঙ্গিতে দরজার দিকে প্রায় ছুটে গেল।

‘আর সেই মুহূর্তে আমার সম্বিত ফিরে এল। আমি একলাফে ওকে জাপটে ধরলাম। মানসী আমার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য উন্মাদিনীর মতো যুঝতে লাগল। আঁচড়ে কামড়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। কিন্তু আমি আমার বাহুবন্ধন শিথিল করলাম না। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন আমার কানে কানে বলছিল, মানসী ছাড়া পেলেই দরজা খুলে দেবে, আর তারপর সর্বনাশ হয়ে যাবে।

‘এদিকে দরজায় ঠক ঠক শব্দটা বেজেই চলেছে। যে করাঘাত করছে, সে যেন ক্রমশই অধৈর্য হয়ে উঠছে। আমার সঙ্গে সমানে ধস্তাধস্তি করে মানসী যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। তারপর একসময় ও জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

‘আমি ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম, তারপর দরজার কাছে গিয়ে বেশ জোরে জোরে ‘রাম’ নাম করতে লাগলাম। আশ্চর্য, দরজায় করাঘাতের শব্দটা যেন থেমে গেল, তারপর যেন কেউ ক্লান্ত পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে আবার নীচে নামতে লাগল। আমার ঘরের জানলা দুটো ছিল সমুদ্রের দিকে মুখ করা, রাস্তাটাও সমুদ্রের ধার দিয়ে চলে গেছে। আমি একটা জানলার সামনে দাঁড়ালাম। পরক্ষণেই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একটা মূর্তি যেন অনেকটা টলতে টলতে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল। তার হাঁটা-চলার ভঙ্গি অদ্ভুত, হাত দুটো যেন শরীর থেকে আলগাভাবে ঝুলছে, যেন দম দেওয়া একটা দানবীয় পুতুল টলতে টলতে এগোচ্ছে। হঠাৎ মূর্তিটা ফিরে আমার দিকে তাকাল আর আমার সমস্ত শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ-শিহরন বয়ে গেল। ফুটফুটে জ্যোছনায় আমি স্পষ্ট দেখলাম তার মুখ অস্বাভাবিক সাদা, যেন এক ফোঁটা রক্ত নেই মুখে, ঘোলাটে দু-চোখে যেন একটা তীব্র ধিক্কারের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আর তার পাঞ্জাবির বুকের কাছে গোল রক্তের ছাপ। বোধ হয় মুহূর্তকাল সে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, তারপরই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।

‘যখন আমার জ্ঞান হল তখন সবে ভোর হয়েছে, মানসী বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে।’

বরেন তার কাহিনি শেষ করল তারপর আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, মানসীকে এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলিনি, মানসীও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আমার ধারণা সেরাত্রে যা ঘটেছিল তা ওর মনে নেই, যেন একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে ওর রাতটা কেটেছে, কিন্তু তারপর থেকেই ওর একটা আশ্চর্য পরিবর্তন আমি লক্ষ করেছি। গত দু-বছরে ওই তিথিতে ও যেন কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে, পুরী বেড়াতে যেতে চায় আর মাঝরাত্রে উঠে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওকে চোখে রাখবার জন্য, রাত্রে আমি ভালো করে ঘুমুতে পর্যন্ত পারি না। সেটা অবশ্য এমন কিছু নয়, আমি ভয়ে কাঁটা হচ্ছি এই ভেবে যে, আর তিন বছর বাদে ওই তারিখে আবার না জানি কী ঘটে। ভালো কথা, ওই রাত্রে ধস্তাধস্তির সময় মানসী বারকয়েক ‘কাশীনাথ’ ‘কাশীনাথ’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

বরেন চুপ।

আমি স্তম্ভিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, মানসীই কি পঞ্চাশ বছর আগেকার মালবিকা! সমস্ত ঘটনাটাই কি সেই পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি মাত্র! কিন্তু তাও কি সম্ভব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *