ভাড়াবাড়ি
অনেকদিন পর কলকাতায় বদলি হয়ে এসে বাড়ির সমস্যায় পড়লাম। মণিকার কোনো বাড়িই পছন্দ হয় না, ওকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। এতদিন কানপুরে খোলামেলা বাংলো ধরনের কোয়ার্টার, বাগান, এমনকী চাকরদের জন্য পর্যন্ত আলাদা থাকার ব্যবস্থা, এসবের পর এখানকার ঘিঞ্জি এলাকায় খুদে খুদে ঘরে ওর মন ওঠার কথা নয়।
আমি যখন অফিসে থাকি তখন ও বাড়ি দেখে বেড়ায়। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন ছাড়াও জনা কয়েক বাড়ির দালালও ইতিমধ্যে জুটেছে। এসব বিষয়ে ওর অদম্য উৎসাহ।
সেদিন অফিস থেকে ফেরার সঙ্গেসঙ্গে মণিকা প্রায় ছুটেই আমার সামনে এল। ওর দু-চোখ উজ্জ্বল, উত্তেজনায় ফর্সা মুখ লালচে দেখাচ্ছে।
জান, আজ একটা দারুণ বাড়ি দেখেছি, ভাড়াও ভীষণ কম, খুশিতে ও যেন ডগমগ করছে।
আমি একটু কৌতূহলী হয়েই ওর মুখের দিকে তাকালাম।
বাড়িটা হচ্ছে পার্কসার্কাসে, একটু নিরিবিলিও আছে। একতলায় দুটো বেডরুম আর একটা ড্রইং রুম। রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, বেশ বড়ো বড়ো। দোতলায় তিনটে বেডরুম, একটা বাথরুম, চওড়া বারান্দা। ভাড়া মোটে আড়াই-শো টাকা। মণিকা বিজয়িনীর মতো তার কথা শেষ করল।
আমি অবিশ্বাসের হাসি হেসে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই কোনো জোচ্চোরের পাল্লায় পড়েছ। একটা দোতলা পুরো বাড়ি আড়াই-শো টাকা ভাড়া! ফুঃ।
তুমি তো অমন কথা বলবেই, একটুও গতর নাড়াবে না, বাড়িতে বসে বসে শুধু বাক্যি ছাড়বে। মণিকা বেশ উষ্মাভরেই বলল।
আমি গৃহশান্তির আশায় তাড়াতাড়ি বললাম, আহা, আমার কথাটা আগে শোনো। আজকাল কতরকম মানুষ ঠকানো ফিকির বেরিয়েছে তা তো জান না। হয়তো বাড়ি ভাড়া নেবার পর জানা গেল যাকে বাড়িওলা জেনে সরল বিশ্বাসে টাকা পয়সা দিয়েছি সে একজন ভণ্ড। জাল বাড়িওলা সেজে আমাদের ঠকিয়েছে।
অত কাঁচা মেয়ে আমাকে পাওনি, মণিকা আমার দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বাড়িওলার সঙ্গে দেখা করে বাড়ির দলিল আমি দেখে এসেছি।
এরপর আমার আর কথা থাকতে পারে না। বাড়িটা যখন এত ভালো, ভাড়াও নামমাত্র, তবে খালি পড়ে আছে কেন এ প্রশ্ন করার মতো সাহস আমার হল না।
পরদিন রবিবার ছিল। মণিকা আমাকে নিয়ে বেরুল, বাড়িটা দেখাবে আর সেইসঙ্গে বাড়িওলার সঙ্গে পাকা কথা বলে আসবে। বাড়িটা দেখে আমি কিন্তু সত্যিই হাঁ হয়ে গেলাম। পুরোনো বাড়ি সন্দেহ নেই, জায়গাটাও নির্জন, কিন্তু একটু রং-চং করে দিলে আজকালকার বাজারে বেশ মোটা টাকা ভাড়া সহজেই পাওয়া যায়। বাড়িওলা থাকেন গড়িয়াহাট রোডে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সেখানে গিয়ে একটা ভুল ভাঙল। বাড়িটা আসলে এক নিঃসন্তান বিধবা ভদ্রমহিলার। মণিকা যাঁর সঙ্গে কথা বলেছিল তিনি হলেন ভদ্রমহিলার ভাইপো। আজ ভদ্রমহিলার সঙ্গেই কথাবার্তা হল। আমরা বাড়িটা নেবো শুনে তিনি খুব খুশি হলেন। বললেন চুনকাম করিয়ে দেবেন। ভাড়া মাসে ওই আড়াই-শো টাকা আর একমাসের ভাড়া আগাম।
একটা ভালো দিন দেখে আমরা পাকসার্কাসের বাড়িতে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠলাম। আমরা অর্থে আমি আর মণিকা ছাড়া আমাদের পাঁচ বছরের মেয়ে খুকু আর ছোকরা চাকর রাম।
সেটা ছিল একটা ছুটির দিন। আমি সন্ধেবেলা একখানা মোটা বই নিয়ে আয়েস করে বসেছি। মণিকা খুকুকে নিয়ে বেরিয়েছে। আমি একটা সিগারেট মুখে দিয়ে দেশলাইয়ের জন্যে পকেট হাতড়াচ্ছি, এমন সময় নজরে পড়ল সামনের টেবিলের ওপর দেশলাইটা রয়েছে। আগে ওটা ওখানে দেখেছি বলে মনে পড়ল না। মনের ভুল ভেবে আমি হাত বাড়িয়ে দেশলাইটা নিলাম।
খানিক বাদেই মণিকা ফিরে এল। ওর মুখে একটা উত্তেজনা লক্ষ না করে পারলাম না। আমার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে ও বলল, বাড়িটা এত সস্তায় ভাড়া পেয়েছি কেন জান?
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে চোখ তুললাম।
এটা ভূতুড়ে বাড়ি, আগে যারা ভাড়া নিয়েছিল কেউই এক মাস দূরের কথা, পনেরো দিন পর্যন্ত টিকতে পারেনি। অনেকদিন খালি পড়েছিল তাই ভাড়া এত সস্তা। দেখলে না, আমরা বাড়িটা নেবো শুনে ভদ্রমহিলার আনন্দ যেন আর ধরছিল না।
আমি অবিশ্বাস ভরে ঠোঁট বাঁকালাম। মণিকা কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলে চলল, ওই মোড়ের মাথায় যে হলদে বাড়িটা, সেই বাড়ির ভদ্রমহিলার সঙ্গে আজ আলাপ হল। ওঁরা এখানকার অনেকদিনের বাসিন্দা। ওঁর মুখেই শুনলাম বেশ কয়েক বছর আগে এই বাড়িটা ছিল বাসুদেব রায়চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোকের। ভদ্রলোক, তাঁর স্ত্রী আর আমাদের খুকুর মতো পাঁচ বছরের একটি মেয়ে নিয়ে ছিল তাঁদের সংসার। মেয়েটি নাকি তার মা-বাবার খুব আদরের ছিল আর অত ছোটো হলে কী হবে, খুব গিন্নি ছিল। একদিন দোতলা থেকে নামবার সময় পা-পিছলে ও সরাসরি একতলায় পড়ে যায়। সেই যে জ্ঞান হারিয়েছিল আর জ্ঞান ফেরেনি। হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগেই মারা যায়। এই ঘটনায় স্বামী-স্ত্রী একেবারে ভেঙে পড়েন। কিছুদিন পরে তাঁর বাড়িটা বিক্রি করে কাউকে না জানিয়ে কোথায় যে চলে গিয়েছেন, কেউ আর তাঁদের খবর জানে না। বাড়িটা কিনেছিলেন আমারে বাড়িউলির স্বামী। তাঁদের ছেলেপুলে ছিল না। কিছুদিন যাবার পরই বাড়িতে এমন সব ঘটনা ঘটতে লাগল, যাতে তাঁরা ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। তাঁদের চোখের সামনে থেকেই নাকি জিনিসপত্র শূন্যে ভেসে উধাও হয়ে যেত, যেন অদৃশ্য কেউ সেগুলি হাতে করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। তারপর থেকেই ভাড়া দেবার চেষ্টা করে আসছেন, কিন্তু কেউই বেশিদিন টিকতে পারেনি।
অর্থাৎ পাঁচ বছরের মেয়ে ভূত? আমি একটু বিদ্রূপ করেই বললাম।
মণিকা কিন্তু আমার বিদ্রূপ গায়ে মাখল না। ও যেন গভীরভাবে কী চিন্তা করছে। হঠাৎ ও বলে উঠল, মেয়েটির জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। ও বোধ হয় এখনও এই বাড়িতে তার মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ভূত-প্রেত সম্বন্ধে আমার কোনোদিনই কৌতূহল কিংবা বিশ্বাস ছিল না। একটু পরিহাসতরল কণ্ঠে আমি বললাম, মেয়েটি সম্বন্ধে যা শুনেছ তাতে মনে হয় ভালো মেয়ে ছিল, তবে আগে যারা ভাড়াটে এসেছিল তাদের ওপর দৌরাত্ম্য করত কেন?
হয়তো তাঁদের তার পছন্দ হয়নি, মণিকা চিন্তান্বিত কণ্ঠে বলল। কয়েক মুহূর্ত পরে ও আবার বলে উঠল, আমরা যদি ওকে শান্তি দিতে পারি, তবে বোধ হয় ও কিছু করবে না। খুকুর জন্যেই আমার একটু ভাবনা, ওরই তো সমবয়সি ছিল। ছোটোরা আবার অনেক কিছু অনুভব করে, যা আমরা বড়োরা ঠিক বুঝতে পারি না।
আমি আর মণিকার সঙ্গে দার্শনিক আলোচনায় যোগ দিলাম না, কিন্তু হঠাৎ দেশলাইয়ের কথাটা আমার মনে পড়ল। এখন আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে ওটা আগে টেবিলের ওপর ছিল না। আমার মন কেমন যেন খুঁতখুঁত করতে লাগল।
পরদিন রাত্রে আরও একটা ঘটনা ঘটল। মণিকা প্রায় হুড়মুড় করে ঢুকে বলল, জানো, এইমাত্র একটা কাণ্ড হল।
আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবার সুযোগ না দিয়েই ও বলে চলল, আমি রান্না করছিলাম, উনুন থেকে কড়াটা নামাব বলে সাঁড়াশি খুঁজছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ওটা বাড়িয়ে দিল। আমি ভাবলাম বোধ হয় রাম। পরে পেছনে ফিরে দেখি কেউ নেই। আমার কেমন একটু সন্দেহ হল। রামকে ডাকলাম, ও ভাঁড়ার ঘরে রুটি বেলছিল। আমার প্রশ্ন শুনে অবাক, রান্নাঘরে ও নাকি আসেইনি।
আমি এবার সত্যিই একটু চিন্তায় পড়লাম। বললাম, খুকু দুষ্টুমি করে সাঁড়াশি দিয়ে পালিয়ে যায়নি তো?
না, ও হাতের লেখা লিখছে। তা ছাড়া আমি যে মনে মনে সাঁড়াশিই খুঁজছিলাম তা ও জানবে কেমন করে?
কথাটা সত্যি ভাববার মতো। আমি চুপ করে রইলাম। মণিকা আবার বলে উঠল, একটা জিনিস বুঝতে পারছি, ও আমাদের কোনো ক্ষতি করতে চায় না, বরং সাহায্যই করতে চায়। তোমাকে আগে বলিনি, অনেক সময় খুঁটিনাটি জিনিস দরকার মতো আমি হাতের কাছে পেয়ে গেছি, যেন ঠিক কোন সময়ে কোন জিনিসটা লাগবে বুঝে কেউ আমার হাতের নাগালের মধ্যে রেখে দিয়েছে।
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আশ্চর্য!
আমি কিন্তু সহজে এ বাড়ি ছাড়ছি না, মণিকা বেশ দৃঢ়কণ্ঠেই বলে উঠল, আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমরা এ বাড়িতে আসায় ও মোটেই অসুখী হয়নি, বরং ওর আত্মা তৃপ্ত হয়েছে বলেই আমার ধারণা।
একটু থেমে মণিকা আবার বলল, জানো, ও বোধ হয় আমার মধ্যে ওর মাকে খুঁজে পেয়েছে। কত সময় আমার মনে হয়েছে যেন আমার পায়ে পায়ে কেউ হাঁটছে, খুকু মনে করে আমি ফিরে তাকিয়েছি, কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি।
আরও কয়েকটা দিন কেটে গেছে, তেমন উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটেনি এর মধ্যে। সেদিন অফিস যাবার সময় পোশাক পরে টেবিলের ওপর থেকে পার্সটা নিতে গিয়ে সেটা দেখতে পেলাম না। তাড়াহুড়োয় কোথায় রাখলাম ভেবে পকেট হাতড়াচ্ছি, টেবিলের ড্রয়ার খুলে সব উলটেপালটে দেখছি, এমন সময় মনে হল যেন পাশেই কচি মেয়ে খুকু হাসল। খুকুর দুষ্টুমি ভেবে ফিরে চাইলাম, কিন্তু কেউ নেই তো! আবার ঘুরে দাঁড়ালাম, হতভম্ব হয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। পার্সটা টেবিলের ওপরে হাতের কাছেই রয়েছে। ও কি আমার সঙ্গে খেলা করছিল। বাপ-মায়ের আদরের মেয়েরা অনেক সময় যেমন দুষ্টুমি-দুষ্টুমি খেলা করে!
আরেকদিন সন্ধের পর আমি, মণিকা আর খুকু ওপরে আমাদের শোবার ঘরে বসে আছি। মণিকা খুকুকে পড়াচ্ছে আর আমি একটা বই নিয়ে বসেছি, কিন্তু কেন জানি পড়তে ভালো লাগছে না। শীত পড়েছে বলে দরজাটা ভেজানো ছিল। হঠাৎ দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। আমার স্পষ্ট মনে হল যেন ছোট্ট কেউ পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল, তারপরই আবার দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। মণিকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও দরজার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর দু-চোখে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি। খুকু কিন্তু একমনে পড়ে যাচ্ছে, ও কিছু টের পায়নি। অনুভূতি, ছাড়া আর কিছু নয়, কচি কচি পায়ে কেউ যেন এগিয়ে আসছে। মণিকাও যেন সেটা অনুভব করছে। আস্তে আস্তে ও বাঁ-দিকে ঘাড় ফেরাল, যেন ওর পাশে কেউ বসেছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম মণিকার সুন্দর বড়ো বড়ো দু-চোখে একটা অপূর্ব কমনীয় ভাব ফুটে উঠেছে, ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি মৃদু হাসি।
খুকুর কথায় আমাদের দু-জনেরই চমক ভাঙল। বলল, মা আমার লেখা শেষ হয়ে গেছে।
খানিক বাদেই মণিকাকে উঠতে হল, ওর রান্না পড়ে আছে। অমি স্পষ্ট দেখলাম ওঠবার সময় ও বাঁ-দিকে ফিরে অনুচ্চকণ্ঠে যেন বলল, এসো।
মাঝে মাঝে বেশ মজার ব্যাপারও ঘটত। একদিন একতলায় বসবার ঘরে আমি সোফায় হেলান দিয়ে সেন্টার টেবিলের ওপর দু-পা তুলে দিয়েছি, হঠাৎ অনুভব করলাম আমার ডান পায়ের পাতায় কেউ যেন কচি নরম আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিল। আমি চমকে উঠতেই কচি মেয়ের একটা চাপা হাসি যেন মিলিয়ে গেল।
আর একদিন মণিকা খুকুকে নিয়ে একটু বাইরে বেরিয়েছে, ফিরতে রাত হবে। আমি একটা বইয়ে ডুবে আছি, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা কচি মেয়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ স্পষ্ট নাকে এসে লাগল।
মণিকা একদিন দোকানে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, জানো কি হয়েছে? আমি দোকান থেকে হাফ পাউন্ড বিস্কুট কিনে দোকানদারকে টাকা দিয়েছি, দোকানদার চেঞ্জ দিয়ে একটা টফি হাতে করে আমার মাথার ওপর দিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, খুকি এই নাও তোমার টফি। তারপরই একটু অবাক হয়ে বলল, এই তো দাঁড়িয়েছিল, কোথায় গেল? আমিও কম অবাক হইনি, বললাম কার কথা বলছেন? দোকানদার বলল, কেন, আপনার সঙ্গে যে ছোট্ট মেয়েটি এসেছিল। আপনি দোকানে ঢুকলেন ও বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন দেখতে বলুন তো? দোকানদার কিন্তু চেহারার ঠিক বর্ণনা দিতে পারল না, অত ভালো করে লক্ষ্য করেনি। আমার সঙ্গে কেউ আসেনি শুনে লোকটা যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমতা-আমতা করে বলল, তবে হয়তো অন্য কারো মেয়ে।
একটু থেমে মণিকা আবার বলে উঠল, ওকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে।
কিন্তু চূড়ান্ত ঘটনা ঘটল এক শনিবার। আমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছি। আমরা সবাই মণিকার এক দিদির বাড়ি যাব, রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরব! আমি জামা-কাপড় পরে একতলায় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছি, মণিকাও সাজগোজ সেরে দোতলায় সিঁড়িতে পা দেবে, খুকু ওর পাশ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল, হঠাৎ ওর পা হড়কে গেল। মণিকা একটা আর্তনাদ করে উঠল, আমিও নীচে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছি। বুঝতে পারছি যে খুকু পড়ে যাচ্ছে, একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে, কিন্তু আমার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে স্পষ্ট দেখলাম, দুটো কচি হাত খুকুকে ধরে ফেলল, তারপর সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। মুহূর্তকাল মাত্র, তারপরই হাত দুটো মিলিয়ে গেল। একটা সর্বনাশা দুর্ঘটনা হতে হতে থেমে গেল। মণিকা তর তর করে ছুটে এসে খুকুকে জড়িয়ে ধরল। খুকু কিন্তু ঠিক কে যে ওকে ধরেছিল তা বুঝতে পারেনি, ওর মুখে শুধু একটা ফ্যাকাশে হাসি ফুটে উঠল।
এরপরই আমি আর মণিকা আলোচনায় বসলাম। বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব কিছু বিবেচনা করে আমাদের স্থির করতে হবে আমরা এ বাড়িতে থাকব কি থাকব না।
মণিকা বলল, দেখ, আমি যা বুঝেছি, ও আমাদের মধ্যে ওর হারানো পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। ও শুধু আমাদের ভালোই চায় না, এটাও চায় যে আমরা এখানে থাকি, তা না হলে খুকুকে অমন করে বাঁচাত না। আরও একটা জিনিস যা আমার মনে হয়, তা হল আগে যাঁরা ভাড়াটে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে হয়তো মনোমতো পরিবেশ পায়নি বলেই ও বিরক্তি প্রকাশ করত, তাঁরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাক এটাই চাইত। আমরা স্বামী, স্ত্রী আর খুকু ওদের পরিবারও তাই ছিল। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওদের সংসারের পরিবেশটা আমাদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে বলেই ও খুশি। আমি নিজে মা হয়ে অমন একটা কচি মেয়ের সুখ আনন্দকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। আমরা এ বাড়িতেই থাকব, তোমার কোনো আপত্তিই কিন্তু আমি শুনব না।
মণিকার কথা শেষ হতেই আমার স্পষ্ট মনে হল যেন একটি কচি মেয়ে মিষ্টি করে হাসল।