কে হাসে?
সে-দিন ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপূজা। বারোয়ারি পূজা তো আছেই। চাঁদের আলো আর কৃত্রিম আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে শহর।
এই প্রথম আমি উত্তরবঙ্গে বেড়াতে এসেছি। খুব ভালো লাগছিল কলকাতা থেকে অনেক দূরে এই ছোট্ট শহরের উৎসবমুখর রাতটি।
আমি উঠেছিলাম ধর্মশালায়। দু-বেলা বাইরেই খেয়ে নিতাম। সেদিনও রাত ন-টার পর একটা হোটেলে ঢুকেছিলাম। হোটেলের রান্না ভালো, রকমারি পদ পাওয়া যায়। শুক্তো থেকে শুরু করে মাছের মাথা দেওয়া মুগ ডাল, পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি, কপির তরকারি, রুই, পারশে, ভেটকি নানারকম মাছ, ডিমের ডালনা, মাংস কোনো কিছুই বাদ নেই।
আমি এক কোণায় জানালার ধারে একটা ছোটো টেবিলের সামনে বসলাম। মুখোমুখি দুটো চেয়ার, দু-জন বসে খেতে পারে। আমি জানলার দিকে পিঠ রেখে বসেছিলাম। হোটেলের একটা ছেলেকে ডেকে ভাত, তরকারি আর পাবদা মাছের ঝোল দিতে বললাম। ছেলেটি বলল, একটু দেরি হবে, ভাত ফুরিয়ে গেছে, উনুনে আবার হাঁড়ি চাপানো হয়েছে। খদ্দেরের বেশ ভিড়, আমার আগে এসেও অনেকেই ভাতের আশায় বসে আছে।
ঠিক তখুনি একজন ঢ্যাঙা মতো লোক আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ফ্যাকাশে মুখ, দু-চোখের তলায় কালি পড়েছে, অথচ শরীরের কাঠামো দেখে মনে হয় একসময় বেশ জোয়ান পুরুষ ছিলেন। বয়স তিরিশের মাঝামাঝি, কী তার একটু বেশি হবে। কুণ্ঠিতভাবে তিনি বললেন, আমি এখানে বসলে আপনার অসুবিধে হবে কি?
আমি বলে উঠলাম, না, না, এটা তো দু-জনেরই টেবিল। যদিও একটা পুরো টেবিল দখল করে খাবার সুযোগটা হাতছাড়া হল বলে মনে মনে আমি একটু ক্ষুণ্ণ হলাম।
ভদ্রলোক আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, আপনাকে আগে কখনো এখানে দেখিনি তো, বেড়াতে এসেছেন?
হ্যাঁ, আমি জবাব দিলাম।
কলকাতা থেকে?
আমি ঘাড় দোলালাম।
আমার বাড়িও কলকাতায়, ভদ্রলোক দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, গত সাত বছরে একবারও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
কলকাতায় কোথায় আপনার বাড়ি? আমি ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলাম।
ভবানীপুরে…কালীমোহন ব্যানার্জি লেনে, ওই যেখানে ইন্দিরা সিনেমা আছে…
আরে আমিও তো ওখানেই থাকি, প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে। আপনার কোন বাড়ি?
দেশ-গাঁয়ের লোকের সঙ্গে বাইরে কোথাও দেখা হলে খুব তাড়াতাড়ি যেমন সংকোচ কেটে যায়, ব্যক্তিগত প্রশ্ন এসে পড়ে, আমাদেরও তাই হল। কথায় কথায় দু-জনের পরিচিত কয়েক জনের নামও বেরিয়ে পড়ল। ভদ্রলোকের নাম বীরেশ্বর রায়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কলকাতা ছেড়েছেন সাত বছর, তাই বললেন না?
হ্যাঁ, বীরেশ্বরবাবু জবাব দিলেন, এখানে আছি দু-বছর। তার আগে এক বছর আমি একটা চা-বাগানের ম্যানেজার ছিলাম।
সে তো খুব ভালো চাকরি, আমি না বলে পারলাম না, শুনেছি রাজার হালে থাকা যায়। তা সেই চা-বাগান কি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?
না, বীরেশ্বরবাবু দু-পাশে মাথা নাড়লেন, আমিই ছেড়ে দিয়েছি।
সেকি! কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল বুঝি?
তাও না। ভদ্রলোক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, আপনাকে সব খুলে বলছি… মানে কাউকে না বললে আমার মন হালকা হবে না। সবাইকে সব কিছু বলা যায় না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি আর সবার মতো নন, সহানুভূতিশীল মানুষ। বিশেষ করে আপনি আমার পাড়ার লোক। আপনাকে বলতে আমার আপত্তি নেই, অবিশ্যি আপনার যদি শুনতে আপত্তি না থাকে।
মোটেই না, আমি হেসে বললাম, হাঁড়িতে চাল ফুটছে, ভাত না হওয়া পর্যন্ত গল্প করে কাটানো যাবে।
আমি যা বলব তা কিন্তু একটি ঘটনা। যাকে আপনারা বলেন অলৌকিক, তেমন কিছু।
আমি কিছু বলার আগেই একটি ছোকরা এসে ভদ্রলোকের খাবার অর্ডার নিয়ে গেল। তিনি শুধু ভাত আর মাংসের কথা বলে দিলেন।
এখান থেকে মাইল তিরিশ দূরে একটা চায়ের বাগানে আমি ম্যানেজারের চাকরি পেয়েছিলাম। ভদ্রলোক শুরু করলেন, আমার স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল, একসময় খুব মারদাঙ্গা করতাম, সাহসের অভাব ছিল না। সেটাই ছিল আমার ফার্স্ট কোয়ালিফিকেশন। চায়ের বাগানে কুলিমজুরদের নিয়ে কাজ, ম্যানেজারকে অনেক রকম সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। আপনি যা ভাবছেন তেমন পায়ে পা দিয়ে সুখের চাকরি নয়, শক্ত মানুষ না হলে টিকতেই পারবে না। অবিশ্যি অন্য যোগ্যতাও যে আমার ছিল না এমন নয় কৃষিবিজ্ঞানের আমি একজন স্নাতক।
আমার বাংলোটা ছিল বেশ বড়ো। সেখান থেকে মাইলখানেক দূরে কুলিকামিনদের বস্তি। বাড়ির কাজকর্মের জন্য এক পাহাড়ি ছোকরাকে আমি রেখে দিয়েছিলাম। সে জুতো পালিশ থেকে রান্নাবান্না সবই করত, চৌকস ছেলে।
আমার বাংলোর কাছকাছি আর কোনো বাড়ি ছিল না, শুধু একটা পোড়োবাড়ি ছাড়া। পোড়োবাড়ি বলছি এইজন্য যে, বাড়িটার চুনপলেস্তারা খসে পড়ে ইটগুলো যেন দাঁত বার করা, কার্নিশের এখানে-ওখানে বট-অশ্বত্থের চারা। বাড়িটা দোতলা, আমার কোয়ার্টারের মতো বাংলো ধাঁচের নয়। দরজা-জানলা সবসময় বন্ধ থাকত। বাড়িতে যে কেউ বাস করে না তা বলে দিতে হয় না।
চারদিকে সবুজ আর সবুজ। কলকাতা থেকে এসে জায়গাটকে আমার খুব ভালো লেগে গেল। কয়েকটা ঘটনায় আমার শক্তি আর সাহসের পরিচয় পেয়ে কুলিকামিনরা আমাকে বেশ সমীহ করে চলছিল। বেশ ভালোই কাটছিল দিনগুলো। রাত্রে ময়দার রুটি আর হাঁস, মুরগি কিংবা হরিণের মাংস—খাসা রান্না করত ছেলেটা।
প্রায় এক মাস কেটে গেল। সে-দিন ছিল পূর্ণিমার রাত। চা-বাগানের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের রূপই আলাদা। বড়ো বড়ো আকাশছোঁয়া বাড়ি নেই, শুধু বাগান আর বাগান। তাই চাঁদের আলো এমন ছড়িয়ে পড়ে যে তার রুপোলি সুধায় মনের মধ্যে একটা মাদকতার সৃষ্টি না হয়ে পারে না।
চা-বাগানে সন্ধের পরেই রাত নামে। কুলিদের বস্তিতে বেশি রাত পর্যন্ত হইহুল্লোড় চললেও আমার বাংলোর চৌহদ্দির মধ্যে জন-মনিষ্যির সাড়া পাওয়া যেত না। নিস্তব্ধ, নিঃঝুম পরিবেশ। রাত আটটার মধ্যেই আমি শুয়ে পড়তাম। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর গাঢ় ঘুমে ডুবে যেতাম।
সেদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে থেকে কার যেন হাসি ভেসে আসছে। আমি অবাক হলাম। এত রাত্রে কে হাসে! এখানে লোকজন নেই, তা ছাড়া এ জায়গাটা চা-বাগানের সম্পত্তি, বিনা অনুমতিতে বাইরের লোকের এখানে আসা নিষেধ। আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। টর্চটা হাতে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাইরে চাঁদের আলোর যেন বন্যা বয়ে যাচ্ছে। তখুনি আবার সেই হাসিটা ভেসে এল।
কে? কে? আমি বারান্দা থেকে নেমে পড়লাম। চারদিকে খুঁজলাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। হাসিটা যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমন হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। আমি চিন্তিত মনে ঘরে ফিরে গেলাম। ঘড়িতে দেখলাম সোয়া দশ।
পরদিন আমার কাজের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম রাত্রে সে কারো হাসি শুনেছে কি না। সে বলল, শোনেনি। আমি ভাবলাম কুলি-মজুরদের কেউ হয়তো নেশা করে কাছাকাছি কোথাও এসেছিল, তার হাসিই শুনেছি। ব্যাপারটা আমি মন থেকে মুছে ফেললাম।
আমার কাজকর্মে মালিকপক্ষ খুব খুশি; একটা চিঠিতে সে-কথা জানাতে তাঁরা কার্পণ্য করলেন না। আমার ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল সেটা বুঝতে আমারও বাকি রইল না।
আরও একমাস কেটে গেল আবার এল পূর্ণিমা। সেদিন রাত্রেও আমার ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় শুয়ে শুনতে পেলাম সেই হাসির শব্দ। বিকট সে হাসি। প্রকৃতিস্থ মানুষের যে নয় তা বুঝতে কষ্ট হয় না। সাধারণ কেউ হলে হয়তো ভয়ে সিঁটিয়ে যেত কিন্তু আমি ছিলাম অন্য ধাতুতে গড়া। ঘড়িতে দেখলাম রাত দশটা। একটা মোটা লাঠি আর টর্চ নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কাউকে খুঁজে পেলাম না। আগের বারের মতো এবারও হাসিটা হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাপারটার কোনো ব্যাখ্যাই আমার মাথায় এল না, শুধু বুঝলাম পূর্ণিমার রাত ছাড়া ওই হাসি শোনা যায় না।
পরদিন ছোকরাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম সে কোনো হাসির শব্দ শোনেনি। আমার কথার জবাব দেবার সময় সে অদ্ভুতভাবে আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। বুঝতে পারলাম ও মনে করছে আমার মাথায় কিছু গণ্ডগোল হয়েছে, তাই ওকে আর ঘাঁটালাম না।
পরের পূর্ণিমার রাতেও সেই একই ঘটনা ঘটল। এবার আমি কান চেপে শুয়ে রইলাম। আর কেউ ওই বিদঘুটে হাসি শুনতে পায় না কেন তা আমার বোধগম্য হল না। একবার মনে হল আমি কি স্নায়বিক পীড়ায় ভুগছি। কিন্তু সে চিন্তা মন থেকে উড়িয়ে দিলাম।
পরের পূর্ণিমায় আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। হাসির রহস্যটা আমাকে জানতেই হবে নইলে আমি হয়তো পাগল হয়ে যাব। সেদিন রাতে ইচ্ছা করেই আমি জেগেছিলাম, তাই হাসি শুরু হতে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। হাসির শব্দটা যেদিক থেকে আসছিল সেদিক লক্ষ করে আমি ছুটলাম। হাসিটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ততক্ষণে আমি পৌঁছে গেছি সেই পোড়োবাড়িটার কাছে। এবার বুঝতে পারলাম হাসিটা আসে ওই বাড়ি থেকে। কিন্তু ওটা পরিত্যক্ত, কেউ থাকে বলে শুনিনি, কাউকে চোখেও পড়েনি। তবে কি রাতে দুষ্টু লোকেরা ওখানে এসে জড়ো হয়। চোরাই কারবারিদের একটা গোপন আড্ডা।
বাড়ির সব দরজা-জানালা বন্ধ, সদর দরজায় বড়ো এক তালা, ভেতর থেকে ক্ষীণ আলোর রেখাও চোখে পড়ছে না। আমি কি করব মনস্থির করতে না পেরে ফিরে এলাম।
পরদিন আপিসে একজন পুরোনো কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলাম ওই বাড়িটা সম্বন্ধে কিছু জানেন কি না। তিনি এক চমকপ্রদ ঘটনা শোনালেন। বছর চল্লিশ আগে ওই বাড়িতে দুই ভাই থাকত। তাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায়নি, লোকজনের সঙ্গে মেলামেশাও তারা করত না। ওই বাড়িটা ছিল টি-এস্টেটের মালিকানার বাইরে। শোনা যায় ছোটো ভাই নাকি ছিল বদ্ধ উন্মাদ, তাকে দোতলার একটা ঘরে শেকল বেঁধে রাখা হত। তাকে দেখাশোনার জন্য একজন লোক ছিল। সেই উন্মাদ ভাই মাঝে মাঝে হিংস্র হয়ে উঠত, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে বেড়ে যেত তার পাগলামি, তখন তাকে চাবুক মারতে হত। চাবুক খেত আর অট্টহাসি হাসত সেই ভাই, ভয়ংকর ছিল সেই হাসি। ওই ভাইয়ের জন্যই নাকি দাদা লোকালয় ছেড়ে এই নির্জন অঞ্চলে বাসা নিয়েছিল। তারপর একদিন পূর্ণিমার রাত্রে সেই উন্মাদ ভাই তাকে যে দেখাশোনা করত তাকে আক্রমণ করে, সে তখন ঘুমিয়েছিল। আচমকা আক্রমণে সে প্রথমে কাবু হয়ে পড়েছিল কিন্তু সেও ছিল খুব বলিষ্ঠ। সেদিন রাত্রে আবার দাদা ওখানে ছিল না, দরকারি কাজে শহরে গিয়েছিল। পাগল সেই লোকটির গলা চেপে ধরেছিল, আত্মরক্ষার জন্য সেও পাগলের গলা চেপে ধরে। পরদিন সকালে দাদা ফিরে এসে দেখে দু-জন দু-জনের গলা টিপে মাটিতে পড়ে আছে, দু-জনেই মৃত। তারপর থেকেই বাড়িটা ওভাবে পড়ে আছে। দাদা সেই যে চলে গিয়েছিল আর ফিরে আসেনি। এই হল বাড়ির ইতিহাস।
পরের পূর্ণিমায় আমি শহরের এক চা-ব্যবসায়ীকে নেমন্তন্ন করলাম। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া করবেন, থাকবেন। খানাপিনার আয়োজনটা আমি ভালোই করেছিলাম। ইচ্ছে করেই সেদিন দেরিতে খেতে বসলাম। খেতে খেতে গল্প করছিলাম। ভদ্রলোক গুজরাতি। কেমন করে কপর্দকহীন অবস্থা থেকে বিরাট ব্যবসার মালিক হয়েছেন সেই গল্প করছিলেন। আমি তাঁর কথা শুনছিলাম আর হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। মনে মনে একটা উত্তেজনা অনুভব না করে পারছিলাম না।
ঠিক দশটার সময় ভেসে এল সেই বিকট হাসি। আমি গুজরাতি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম। তিনি কিন্তু নির্বিকার, খাচ্ছেন আর তাঁর জীবনী বলে যাচ্ছেন।
আমি একটু উত্তেজিত হয়েই বললাম, শুনতে পাচ্ছেন?
কী? ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন।
একটা হাসি!
হাসি! কার হাসি! ভদ্রলোক এদিক-ওদিক তাকালেন, কই, আমি তো কারো হাসি শুনতে পাচ্ছি না।
একটু কান পেতে শুনুন, আমি অসহিষ্ণু গলায় বললাম, আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করলেন, তারপর ঘাড় নেড়ে বললেন, আপনি বোধ হয় ভুল শুনছেন, কেউ হাসেনি, আপনার মনের ভুল।
ভুল শুনেছি! আমার এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, প্রায় চিৎকার করে বললাম, প্রত্যেক পূর্ণিমার রাত্রে আমি এই হাসি শুনছি আর আপনি বলছেন আমার মনের ভুল!
ভদ্রলোক কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বুঝতে পারলাম তিনি আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন, চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্নও ফুটে উঠেছে। বোধ হয় ভাবছেন পাগলের পাল্লায় পড়েছেন।
আমি অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা চাইলাম। বাকি সময়টুকু আমরা চুপচাপ খেলাম। পরদিন সকালেই ভদ্রলোক বিদায় নিলেন, মনে হল তিনি যেন পালিয়ে বাঁচলেন। জানি না ওই ভদ্রলোকের জন্যই কিনা, এ কথাটা চাউর হয়ে গেল যে আমার মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। হেড আপিস থেকেও এ ব্যাপারে একজন খোঁজখবর করতে এলেন। তিনি অবিশ্যি আমার আচরণে অস্বাভাবিক কিছু দেখলেন না, ফলে চাকরিটা রয়ে গেল। একটা কথা কিন্তু আমার কাছে পরিষ্কার হল, আমি ছাড়া আর কেউ ওই হাসি শুনতে পায় না।
পরের পূর্ণিমায় আমি ঠিক করলাম একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। সেই রাতে আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম, হাসি শুরু হবার সঙ্গেসঙ্গে ওই বাড়ির দিকে দৌড়লাম। আমার বাঁ-হাতে পাঁচ ব্যাটারির একটা বড়ো টর্চ আর ডান হাতে রিভলবার।
বাড়িটার সামনে আসতেই হাসি থেমে গেল। আমি এক মুহূর্ত বোধ হয় ইতস্তত করেছিলাম তারপর সদর দরজায় এক লাথি মারলাম। পুরোনো দরজা আর আমার প্রচণ্ড পদাঘাতে, দরজার একটা পাল্লা ভেঙে গেল। আমি ভেতরে ঢুকলাম। চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে লাগলাম। বহুদিন অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকায় ধুলোর স্তর জমেছে মেঝের ওপর, কোণাগুলি থেকে কালো কালো ঝুল ঝুলছে। দীর্ঘকাল পরে ঘরে বাতাস ঢোকায় টর্চের আলোয় অসংখ্য ধূলিকণা উড়তে দেখলাম। তারপরই হঠাৎ দোতলার ঘর থেকে কেউ যেন হেসে উঠল— যেন আমাকে ব্যঙ্গ করে হাসল।
আগেই বলেছি আমার ছিল দুর্জয় সাহস। এতটুকু দ্বিধা না করে আমি লাফ দিয়ে দু-তিনটা সিঁড়ি টপকে দোতলায় উঠলাম, তারপর যে ঘর থেকে হাসির শব্দ এসেছিল সেই ঘরের বন্ধ দরজায় এক লাথি মারলাম। দরজাটা ভেজানো ছিল, দড়াম করে খুলে গেল। আমি টর্চ জ্বালিয়ে আর রিভলবার উঁচিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। সমস্ত ব্যাপারটা যদি কোনো দুষ্টু লোক বা দলের চক্রান্ত হয়, মানুষকে ভয় দেখিয়ে ওই বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই হয়ে থাকে তাদের আসল মতলব, তবে তা আমি ভেঙে দেব এই ছিল আমার সংকল্প।
কিন্তু ঘরে ঢুকে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। ঘরে কেউ নেই— এমনকী একটা আসবাব পর্যন্ত নেই। ফাঁকা শূন্য ঘর। আমি চারদিকে টর্চের আলো বুলোচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা অশরীরী অনুভূতিতে আমার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হতে লাগল কে বা কারা আমার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে। আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না অথচ অদৃশ্য কারো উপস্থিতি অনুভব করছি। সে যে কী ভয়ংকর অনুভূতি তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না।
বীরেশ্বরবাবু একটু থেমে টেবিল থেকে জলের গেলাসটা তুলে এক ঢোক জল খেলেন, তারপর গেলাসটা নামিয়ে রেখে আবার বলতে লাগলেন, বোধ হয় দু-তিন সেকেন্ড আমি ওই ঘরে ছিলাম কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন সময়ের আর শেষ নেই। তারপরই আমি ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে দুড়দাড় সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম আর তখুনি আবার শুরু হল সেই হাসি— শরীরের রক্ত হিম করা বীভৎস হাসি। আমার মতো সাহসী পুরুষেরও শিরদাঁড়া বেয়ে যেন বরফগলা জলের ধারা নেমে এল। কোনোরকমে বাড়িতে এসে শুয়ে পড়লাম, সারারাত ঘুমোতে পারলাম না।
এরপর প্রত্যেক পূর্ণিমার রাত্রে ওই হাসি আমাকে যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করত আর আমি দু-কান চেপে বিছানায় ছটফট করতাম। ক্রমে আমার শরীর ভাঙতে শুরু করল, হয়তো চোখে-মুখেও এমন কিছু ফুটে উঠত যার জন্য সবাই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাত, আমার সম্বন্ধে আড়ালে ফিসফাস করত।
এক বছর কোনোরকমে সেই ভয়াবহ নরক যন্ত্রণা সহ্য করেও আমি টিকে ছিলাম কিন্তু আর পারলাম না, চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে এখানে চলে এলাম, একটা চাকরি জুটিয়ে নিলাম, সেই থেকে এখানে আছি।
কিন্তু আপনি কলকাতায় ফিরে গেলেন না কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে থাকলে আপনার শরীর ও মন দুই-ই ভালো হত।
সেখানেই তো মুশকিল, বীরেশ্বরবাবু ম্লান হাসলেন, আমার আত্মীয়স্বজনেরাও যদি আমাকে পাগল ভাবে সেটা আমি সইতে পারব না।
কিন্তু তাঁরা কেন তা ভাববেন! আমি অবাক হয়েই বললাম, আর তো আপনি সেই হাসি শুনছেন না। ওখান থেকে আপনি চলে এসেছেন।
সেটাই তো হচ্ছে কথা, ভদ্রলোক বললেন, এখানে এসেও আমি সেই হাসির হাত থেকে নিস্তার পাইনি। পূর্ণিমার রাত দশটায় এখানে বসেও সে হাসি আমি শুনতে পাই। পৃথিবীর যেখানেই আমি যাই না কেন, ওই হাসি আমাকে মুক্তি দেবে না।
সেকি! আমি স্তম্ভিতের মতো বললাম।
ভদ্রলোক জানালার দিকে মুখ করে বসেছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, ওই দেখুন… পিছন ফিরে আকাশের দিকে দেখুন…
আমি ফিরে দেখলাম আকশে ঝলমল করছে রুপোলি থালার মতো কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ। তারপরই ভদ্রলোকের ব্যাকুল কণ্ঠে আমি তাঁর মুখের দিকে ফিরে তাকালাম। তাঁর মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে, কোটর থেকে চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তিনি আর্ত কণ্ঠে বললেন, শুনতে পাচ্ছেন…শুনতে পাচ্ছেন সেই হাসি! তিনি দু-হাত দিয়ে দু-কান চেপে ধরলেন।
আমি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত দশটা।
শান্ত হোন, আমি বললাম, আমার মনে হয় আপনি কোনো সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখালে ভালো হয়ে যাবেন, এটা আপনার মনের রোগে দাঁড়িয়েছে।
ভদ্রলোক আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন তারপর বললেন, আপনিও বোধ হয় আমাকে পাগল ভাবছেন…কিন্তু আমি এই ঘটনার কি ব্যাখ্যা করেছি জানেন?
কী? আমি জানতে চাইলাম।
বীরেশ্বরবাবুর দু-চোখে ফুটে উঠল কেমন একটা ঘোলাটে দৃষ্টি, তিনি বললেন, ওই ঘটনার সময় আমার জন্মই হয়নি। আমার নিশ্চিত ধারণা আগের জন্মে আমিই ছিলাম সেই পাগল…
হোটেলের ছোকরা এসে আমাদের সামনে দু-থালা ভাত নামিয়ে দিয়ে গেল। গরম ভাত, ধোঁয়া উঠছে।